কেন্দ্র কবুতর
ছিটকে গিয়ে পড়লম ঘরের কোনায় রাখা শৌখিন টেবিলটার ওপর। মট করে ভেঙে গেল ওটার পায়া। টেবিলের ওপর থেকে কাচের গ্লাসটা মাটিতে পড়ে ঝনঝন করে ভেঙে গেল। আবার যখন ভালো করে তাকালাম, তখন আমার জিভের ডগায় নোনতা স্বাদটা স্পষ্ট হয়ে উঠল। প্রায় ছফুট লম্বা লোকটি পায়ে-পায়ে আমার মাথার কাছে এসে দাঁড়াল। ফাঁসফেঁসে গলায় বলল, আমার কাছে রিভলভারও আছে।
এ-কথা বলার কোনওই প্রয়োজন ছিল না। কারণ ওর একটা ঘুষিতেই আমি সরষেফুল দেখছিলাম। কোনওরকমে বললাম, কী কী চাই তোমার? যদিও মনে-মনে ভালোই বুঝতে পারছিলাম যে ও কী চায়।
লোকটি বলল, পাণ্ডুলিপিটা।
ওই ব্যথার মধ্যেও আমার চোখে বোধহয় একটা সপ্রশ্ন দৃষ্টি ফুটে উঠেছিল। সেটা দেখে লোকটি বলল, আমার দলের চিহ্ন– বলে একটা কাগজ ওর জামার বুকপকেট থেকে বের করে আমার হাতে দিল।
কাগজটার মধ্যে লাল রঙ দিয়ে তোলা একটা হাতের পাঞ্জার ছাপ। ওটা দেখছিলাম, লোকটির কথায় আমার চমক ভাঙলঃ আমি লালপাঞ্জা দলের কমরেড।
আমি হেসে বললাম, এটা খুব উঁচুদরের অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট, ঠিক ধরতে পারছি না। তবে মনে হয়, ক্যালিফোর্নিয়ার সমুদ্রতীরে সূর্যোদয়ের ছবি, তাই না?
উত্তরে একটা বুটসুদ্ধ ভারি পা দড়াম করে এসে পড়ল আমার চোয়ালে ও পাণ্ডুলিপিটা বের করে দাও।
মনে-মনে রাগ হলেও আমি নিরুপায়। বললাম, ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে আছে, বলে ওর পেছনে আঙুল নিয়ে দেখালাম। লোকটি ড্রেসিং টেবিলের দিকে তাকাল।
ব্যস, ওই একটি মুহূর্তই যথেষ্ট ছিল আমার কাছে। একটুও দেরি না করে টেবিলের ভাঙা পায়াটা তুলে নিয়ে বিদ্যুৎগতিতে সর্বশক্তি দিয়ে বসিয়ে দিলাম ওর চোয়ালে। ফট করে একটা শব্দ হল। সঙ্গে-সঙ্গে অতবড় দেহটা সটান পড়ে গেল মেঝেতে।
উঠে দাঁড়িয়ে ঘরের বন্ধ দরজার দিকে তাকালাম। লোকটি ঢুকল কোথা দিয়ে! ভালো করে দেখেশুনেও কোনও দরজা খোলা দেখলাম না। তবে কি জানলা দিয়ে ঢুকেছে! এই ভেবে এগিয়ে গেলাম জানলার কাছে।
দূরে হোটেলের কার পার্কের সামনে একটা লোক দাঁড়িয়ে ছিল। আমাকে দেখেই উধ্বশ্বাসে দৌড়ে গিয়ে একটা গাড়িতে উঠে গাড়ি চালিয়ে দিল। এও কি লালপাঞ্জার কমরেড নাকি? রহস্যের জট ক্রমশ জটিল হয়ে উঠছে দেখছি!
প্রথম থেকে ভাবতে লাগলাম ঘটনাগুলো।
ঘটনার শুরু সেইদিন থেকে, যেদিন অশোকের সঙ্গে আমার দেখা হয় কলকাতায়–একরকম হঠাৎই বলতে হবে।
নিত্তনৈমিত্তিক একঘেয়ে জীবন থেকে কিছুক্ষণের জন্যে মুক্তি পাওয়ার আশায় সন্ধের সময় গিয়েছিলাম ময়দানে। ঠান্ডা হাওয়ায় ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎই দেখা হয়েছিল অশোকের সঙ্গে। অশোক বোস–আমার স্কুলের বন্ধু ছিল ও।
আরে, কাঞ্চন না!
চন্ডাশোক নিশ্চয়ই! আমিও কম অবাক হয়নি।
হ্যাঁ। তা কী করছিস এখন?
এই দেশভ্রমণ বলতে পারিস হালকা সুরে জবাব দিয়েছিলাম।
আচ্ছা, কাঞ্চন, আমার একটা কাজ করে দিবি?
একটু আশ্চর্য হয়ে বলি, কী কাজ?
খুবই সামান্য একটা ম্যানাস্ক্রিপ্ট একজন প্রকাশকের কাছে পৌঁছে দিতে হবে।
তা সেটা আমাকে করতে বলছিস কেন? জানতে চাইলাম আমি।
দ্যাখ, তোকে খুলেই বলি, বলল অশোক, তুই নিশ্চয়ই সিরাজনগর স্টেটের নাম শুনেছিস?
হ্যাঁ–শুনেছি। না শুনলেও বললাম আমি।
সেই সিরাজনগরের রাজা ছিলেন শুদ্ধসত্ত্ব রায়। তিনি সিনেমার এক হিরোইনকে বিয়ে করেছিলেন। তাঁর নাম ছিল সুলক্ষণা সেন। পরে সিরাজনগরের বিপ্লবীরা বিপ্লবের সময় রাজা-রানীকে খুন করে। শোনা যায় এর পেছনে নাকি লালপাঞ্জা নামে একটা দলের হাত ছিল। রানী সুলক্ষণা অভিনেত্রী ছিলেন বলে তার ওপর বিপ্লবীদের রাগ বোধহয় বেশি ছিল। তাকে ওরা এমনভাবে পিটিয়ে মেরেছিল যে, রাজবাড়ির সিঁড়ির ওপর শুধু এক তাল মাংসপিণ্ড পড়ে ছিল। এরপর শুদ্ধসত্ত্ব রায়ের প্রথম পক্ষের ছেলে অতলান্ত রায় রাজা হন। রানী সুলক্ষণার ব্যাপারটা তিনি জানতেন না। রাজ্যের দায়িত্ব নেওয়ার সময় রানীর মৃত্যুর খবর পান তিনি। কিন্তু কিছুদিন পর গুপ্তঘাতকের ভয়ে তিনি নিরুদ্দেশ হয়ে যান। পরে শোনা যায় যে, তিনি নাকি নেপালে এক অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছেন। কিছুদিন পর অবস্থা শান্ত হলে রণজিৎ সেন রাজ্যের দায়িত্ব নেন। কিন্তু আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে ওঠায় তিনি অর্থ সাহায্যের জন্যে দু-একটি প্রদেশের কাছে গোপনে আবেদন জানান।
কিন্তু এর মধ্যে পাণ্ডুলিপিটা আসছে কোত্থেকে? এতক্ষণ পর অধৈর্য হয়ে উঠি আমি।
আসছে–আসছে। একটু ধৈর্য ধরে শোন, বলে অশোক আবার শুরু করল, তুই নিশ্চয়ই সুরেন্দ্র পালিতের নাম শুনেছিস? আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই ও বলে চলল, সুরেন্দ্র পালিত ছিলেন সিরাজনগরের রাজা শুদ্ধসত্ত্বর মুখ্য প্রতিনিধি। এই দিনসাতেক হল তিনি মারা গেছেন। এই পালিতসাহেবের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল একটু বিচিত্রভাবে। সে আজ প্রায় বছরদুয়েক আগের কথা। সিরাজনগরে আমি গিয়েছিলাম অফিসের কাজে–সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভ হয়ে। একদিন রাতে একটা অন্ধকার গলিতে দেখি দুটো লোক একজন বৃদ্ধ লোকের ওপর চড়াও হয়েছে। রাস্তায় আর লোকজন ছিল না। আমি ছুটে গিয়ে ওদের ওপর পড়ি। তারপর আমার সেই পুরোনো অভিজ্ঞতা সামান্য পরিমাণে অবোধ শিশুদুটোকে দান করলাম। বলে প্রাক্তন জেলা বক্সিং চ্যাম্পিয়ন অশোক হাতের মাসল ফুলিয়ে দেখাল। আমরা একসঙ্গেই বক্সিং শিখতাম।
বললাম, তারপর?
তারপর আর কী, সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোক বললেন, আপনি কি জানেন, আপনি আজ কার জীবনরক্ষা করলেন? আমি বললাম, না–আমি এখানে নতুন এসেছি। তিনি বললেন, আমার নাম সুরেন্দ্র পালিত।…চমকে উঠলাম আমি। কারণ ওই ভদ্রলোক সম্পর্কে কানাঘুষোয় অনেক কথাই শুনেছিলাম। শুনেছিলাম সুরেন্দ্র পালিতই নাকি রাজা শুদ্ধসত্ত্বের পেছনে বসে সবকিছুর কলকাঠি নাড়তেন। যাকগে, তিনি বললেন, আমি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ–আমার মনে থাকবে। এরপর তিনি আমার নাম-ঠিকানা নিয়ে চলে গিয়েছিলেন।
এতদিন পর হঠাৎ সেদিন–এই দিনদশেক আগে তিনি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। খবরের কাগজেই দেখেছিলাম, তিনি কলকাতায় আছেন। গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি তখন ভীষণরকম অসুস্থ। আমাকে দেখে বললেন, মিস্টার বোস, আপনার ওপর আমি খুব বড় একটা কাজের দায়িত্ব দিয়ে যেতে চাই। সিরাজনগরের রাজনীতির সমস্তরকম খেলারই সাক্ষী ছিলাম আমি। প্রচুর গুপ্তকথাও জানতে পেরেছিলাম। আমি আজ আমার স্মৃতিকথার পাণ্ডুলিপিটা আপনার হাতে তুলে দিতে চাই। আপনি দিল্লি যাবেন। সেখানে এক পাবলিশার্স আছে– মেহেতা অ্যান্ড সন্স। তাদের হাতে আপনি এই পাণ্ডুলিপিটা সামনের মাসের মধ্যে তুলে দিলে তারা আপনাকে পনেরো হাজার টাকা দেবে। এইরকমই কথা আছে। আপনি না করবেন না, মিস্টার বোস। আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। সেই কৃতজ্ঞতা শোধ দেওয়ার এই আমার শেষ সুযোগ। আপনি আমাকে নিরাশ করবেন না। কথা দিন আপনি।
আমি কথা দিয়েছিলাম। তখন তিনি আমাকে একটা মোটা পাণ্ডুলিপি দেন। আমি সেটা নিয়ে আমার কাছে রাখি। কিন্তু তারপর থেকে একদম সময় করে উঠতে পারছি না। এর ওপর পরশুদিনই অফিসের কাজে একবার রাজস্থান যেতে হবে। এখন তুই এই কাজের ভারটা নিতে পারিস। পনেরোর মধ্যে পাঁচ হাজার তুই নিস, আর আমাকে বাকিটা দিয়ে দিস–রাজি? অশোক হাসিমুখে তাকাল আমার দিকে।
অশোকের কথাগুলোর মধ্যে কেমন একটা রহস্যের গন্ধ পাচ্ছিলাম। তাই সঙ্গে-সঙ্গে রাজি হয়ে গেলাম বললাম, আপত্তির কী আছে! কিন্তু রণজিৎ সেন এখন কোথায়, দিল্লিতে?
ঠিকই ধরেছিস, বলল অশোক, সেখানে কুমার রণজিৎ কয়েকজন বিরাট বিজনেস ম্যাগনেটের সঙ্গে কথা বলতে গেছেন, রাজ্যের অর্থসঙ্কট কাটিয়ে ওঠার জন্যে। কয়েকজন বিজনেসম্যান সিরাজনগরে তেলের কোম্পানি খোলার জন্যে আবেদন জানিয়েছিলেন। সেই ব্যাপারেই রফা করে একটা চুক্তি হবে আর কী। ও চাই তেল, আর এ চায় টাকা। বলে অশোক হাসল।
আচ্ছা, অশোক, রণজিৎ সেন শুদ্ধসত্ত্ব রায়ের ঠিক কীরকম রিলেটিভ হন?
কুমার রণজিৎ শুদ্ধসত্ত্ব রায়ের শ্যালক। ওহ্-হো, আর-একটা কথা তোকে বলতেই ভুলে যাচ্ছিলাম, কাঞ্চন। আমার কাছে কতকগুলো চিঠি আছে। আশ্চর্যভাবেই পেয়েছিলাম ওগুলো। একবার একজন নেপালিকে আমি খুব রিস্ক নিয়ে একটা অ্যাক্সিডেন্ট থেকে বাঁচিয়েছিলাম। কৃতজ্ঞতায় সে একটা চিঠির বান্ডিল আমাকে দিয়েছিল।
হেসে বাধা দিলাম আমি : মাইরি, একটা বই লেখ তুই, যাহাদের আমি প্রাণরক্ষা করিয়াছি।
শোনই না আগে! লোকটি আমাকে যা বলল, তা হল যে, ওই চিঠিগুলো সে একটি লোকের কাছ থেকে পায়। লোকটির পকেটে সে নাকি একটা লালপাঞ্জার ছাপওয়ালা কাগজ দেখতে পায়। লোকটি গুরুতর অসুস্থ ছিল। সে মারা যাওয়ার আগে শুধু বলেছিল ভীষণ দামি চিঠি এগুলো। তাই সে কৃতজ্ঞতায় এগুলো আমাকে দিচ্ছে। যা হোক, পরে আমি এক আশ্চর্য ব্যাপার লক্ষ করি যে, পাণ্ডুলিপির হাতের লেখা আর চিঠির হাতের লেখা একেবারে এক। তবে কি সুরেন্দ্র পালিতই চিঠিগুলো লিখেছেন? কিন্তু চিঠির নীচে সই আছে দিল্লির কোনও এক মিসেস সুচরিতা চৌধুরির। অনেকগুলো চিঠি–আমি আর পড়ে দেখিনি। ওগুলোও তুই নিয়ে আমাকে রেহাই দিস। আর পারলে ওই সুচরিতা চৌধুরীকে চিঠিগুলো ফেরত দিয়ে দিস।
এরপর আমি অশোকের সঙ্গে গিয়ে পাণ্ডুলিপি আর চিঠি নিয়ে অশোকেরই বুক করা এয়ার টিকেটে দিল্লি রওনা হই। তা এই অতি সামান্য কাজের জন্যে পাঁচ হাজার টাকা বা মন্দ কী? কিন্তু তখন কি জানতাম, কী সাঙ্ঘাতিক বিপদ হায়েনার মতো হাঁ করে বসে রয়েছে আমারই জন্যে– দিল্লিতেই!
.
ঘরের জানলা দিয়ে বিষণ্ণ দৃষ্টি মেলে রাস্তার দিকে তাকিয়েছিল সুচরিতা চৌধুরী। এ-জীবন আর ভালো লাগছে না। ওর মনে পড়ছিল সিরাজনগরের দিনগুলোর কথা। সেখানে সামরিক বাহিনীর অধিনায়ক ছিল অমিত-অমিত চৌধুরী। ওর কথা মনে পড়লে মাঝে-মাঝে এই পোড়া মনটা বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। হয়তো একথা সত্যি যে, অমিত সুচরিতাকে ভালোবাসেনি– যন্ত্র হিসেবেই দেখেছে চিরকাল। অথচ কী যে হয়েছিল ওই আঠেরো বছর বয়েসটায়! সব ছেড়ে ছুঁড়ে দিয়ে অমিতকেই হৃদয়ের সিংহাসনে বসিয়েছিল ও। বিয়ের পর স্বামীর জন্য সবরকম কাজই করেছে। উঃ–সেই বিপ্লবের রক্তাক্ত দিনগুলো, যেদিন শেষবারের মতো আর্তনাদ করে উঠেছিল অমিত। ওর মনে পড়ল লালপাঞ্জা দলের কথা। আজ পর্যন্ত ও সে-দলের কাউকেই দেখেনি। তবে একটা কাগজ দেখেছিল অমিতের কাছে তাতে একটা পাঞ্জার ছাপ ছিল লাল রঙের। সেটা নিশ্চিত বিপদের ইশারা বয়ে এনেছিল।
অমিতের মৃত্যুর পর যখন ও সিরাজনগর ছেড়ে স্থায়ীভাবে থাকার জন্য দিল্লির দিকে পা বাড়িয়েছিল, সেইসময় ওকে রণজিৎ সেন ডেকে পাঠিয়েছিলেন। অমিত চৌধুরীর একনিষ্ঠ সাহায্যের প্রতিদান দিতে তিনি যে অক্ষম সে কথাই জানিয়েছিলেন। বারবার করে। সুচরিতা লজ্জা পেয়েছিল। এর পরই ও দিল্লিতে চলে আসে। টাকার অভাব ওর ছিল না–এখনও নেই। কিন্তু একটা ব্যাপারে ও ভীষণ দুশ্চিন্তায় আছে।
এই প্রসঙ্গেই ওর মনে পড়ল সুরেন্দ্র পালিতের কথা। তার স্মৃতিকথা লেখার ব্যাপারটা। ম্যানাস্ক্রিপ্টের কথা। হেন ব্যাপার বোধহয় ছিল না, যা সুরেন্দ্র পালিত না জানতেন। এখন যদি ম্যানাস্ক্রিপ্টটা ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয়, তা হলে! তা হলে যে সর্বনাশ হবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কুমার রণজিৎ একেবারে অথৈ জলে পড়বেন, অথৈ জলে পড়বে লালপাঞ্জা দলের কমরেডরাও। আর হ্যাঁ, আর অসুবিধেয় পড়বে সমর বর্মন। তবে সবচেয়ে বেশি অসুবিধেয় পড়বে সিরাজনগর।
সমর বর্মনকে নিজের লাইনে শিল্পী বলা যেতে পারে। লোকটার সঙ্গে সুচরিতার সামনাসামনি পরিচয় নেই, কিন্তু তার সম্বন্ধে এত কথা শুনেছে যে, তার চরিত্র সুচরিতার কাছে একটুও অচেনা নয়। লোকটা বহুবার প্রমাণ করেছে চুরিবিদ্যা মহাবিদ্যা। এরকম নিখুঁত টাইপের হীরে চোর ও ব্ল্যাকমেলার কেউ বোধহয় কোনওদিন দেখেনি। সুরেন্দ্র পালিত বহুবার সমর বর্মনকে ধরার চেষ্টা করেছিলেন। অনেক চেষ্টার পর সফলও হয়েছিলেন। সমর বর্মন জেলে গিয়েছিল তিন বছরের জন্য।
কিন্তু এখন? হ্যাঁ, এর মধ্যে তার মেয়াদ সম্পূর্ণ হয়ে সে বোধহয় ছাড়া পেয়ে গেছে। এই বর্মন লোকটা ছদ্মবেশ নিতে এত ওস্তাদ যে, ধারণার বাইরে। এককথায়, সমর বর্মন তার লাইনে সম্রাট। সে যখন সুরেন্দ্র পালিতের হাতে ধরা পড়েছিল তখন সুরেন্দ্র পালিত নিশ্চয়ই তাঁর স্মৃতিকথায় বর্মন সম্পর্কে অনেক কথাই লিখে গিয়েছেন, যা পুলিশ জানতে পারলে বর্মন মুশকিলে পড়বে।
সিরাজনগর যে মুশকিলে পড়বে তারও কারণ আছে। কারণ, কুমার রণজিতের আর্থিক অনটনের কথা বাইরের কেউই বিশেষ জানেন না। জানলে কুমার রণজিৎ সারা ভারতের কাছে ছোট হয়ে যাবেন। কিন্তু সুরেন্দ্র পালিত যদি এই সব ব্যাপারে খোলসা করে লিখে গিয়ে থাকেন ওই পাণ্ডুলিপিতে? নাঃ, পরের ব্যাপার আর ভাবতে পারছে না সুচরিতা। এখন যা অবস্থা দাঁড়িয়েছে, সত্যিই সাঙ্ঘাতিক।
আবার অমিতের কথা মনে পড়ল সুচরিতার। ভালোবাসা কথাটার প্রকৃত সংজ্ঞা সুচরিতা জানে না। অনেকেই এখন ওকে পাওয়ার জন্য ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। সুচরিতা তাতে হেসেছে। যদিও অত্যন্ত স্বাভাবিক এই ব্যাপারটা। কারণ ওর তিরিশ বছরের সৌন্দর্য, ব্যক্তিত্ব, কটাক্ষ, চেহারা ইত্যাদিকে অবহেলা করা কোনও পুরুষের পক্ষে সম্ভব নয়। এখনও কোনও-কোনও বিজ্ঞাপনের কাজে সুচরিতা নিজের অমূল্য সময় খরচ করে। নাম করা সিনেমার কাগজেও ওর ছবি মাঝে-মাঝে ছাপা হয়। তবু একটা কিছুর অভাব যেন ও বুঝতে পারে।
এমন সময় ফ্ল্যাটের বেল বেজে উঠল। চটপট উঠে গিয়ে দরজা খুলে দাঁড়াল সুচরিতা। দরজায় মৃদু হাসি মুখে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তরুণ সান্যাল। ছিপছিপে চেহারার যুবক। চেহারার একটা আকর্ষণ আছে। বয়স সুচরিতার চেয়ে কমই। আটাশ কি উনতিরিশ। তবু ছেলেটা ওর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠতে চায়। সত্যি, কী বিচিত্র!
ঘরে ঢুকতে ঢুকতে তরুণ বলল, সুচরিতা, একটা জরুরি খবর নিয়ে এসেছি। মানেকজি পাঠিয়েছেন আমাকে বুঝতেই তো পারছ।
দরজা বন্ধ করে সুচরিতা এসে চেয়ারে বসল। বলল, কী জরুরি খবর, শুনি?
মানেকজি আমাকে আজ সকালে বললেন, তোমাকে ফোন করে একটা খবর দিতে। আমি ফট করে বলে দিলাম ফোন খারাপ আছে, যাতে তোমার সঙ্গে অন্তত দেখাটা হয়। তখন তিনি আমাকে পাঠালেন কুরিয়ার হিসেবে।
তরুণ সান্যাল মানেকজিপ্রসাদজি ফার্মের পার্টনার মানেকজির প্রাইভেট সেক্রেটারি। সারাদিনে বেচারা একদম ছুটি পায় না, খালি ডিক্টেশন আর টাইপ।
রাবিশ বিরক্ত গলায় বলল তরুণ, আমার আর ভালো লাগছে না, সুচরিতা।
কেন, বেশ তো আছ। যাকগে, জরুরি কথাটা নিশ্চয়ই তোমার অজানা নয়? মুচকি হেসে জানতে চাইল সুচরিতা। ও জানে তরুণ সান্যাল বোকা নয়।
তা, মোটামুটি জানি বইকী। ইতস্তত করে বলল তরুণ, তুমি বরং মানেকজির কাছ থেকেই শুনে নিয়ো।
তরুণ! ঈষৎ ভৎর্সনা, কটাক্ষ, চোখের ইশারা-ব্যস ওইটুকুই যথেষ্ট ছিল তরুণের পক্ষে। গড়গড় করে বিগলিতকণ্ঠে বলতে শুরু করল তরুণ, সুচরিতা, ব্যাপারটা সিরাজনগরের সঙ্গে, সুরেন্দ্র পালিতের সঙ্গে কানেক্টেড। অশোক বোস নামে এক ভদ্রলোক দিল্লি আসছেন আগামীকাল। সুরেন্দ্র পালিতের স্মৃতিকথার পাণ্ডুলিপিটা তার কাছেই আছে। তিনি সেটা এখানকার কোনও এক পাবলিশার্সের কাছে পৌঁছে দেবেন। তুমি তো বুঝতেই পারছ–ওই পাণ্ডুলিপি এখন ছেপে বেরোলে সর্বনাশ হবে। সেইজন্যেই মানেকজি আর প্রসাদজি খুব আপসেট হয়ে পড়েছে। তোমার মনে আছে, গত বছর মিস্টার পালিত একবার কবুতর-এ এসেছিলেন, কিছু গোপন ব্যাপার আলোচনা করার জন্যে?
হ্যাঁ মনে আছে। উত্তর দিল সুচরিতা।
কবুতর! প্রসাদজির বাগানবাড়ি। শহরতলিতে বিরাট জায়গা নিয়ে তৈরি এই কবুতর। মাঝে মাঝে গোপন মিটিং থাকলে প্রসাদজি ওই কবুতরকেই ব্যবহার করেন। এবারও সেই তেলের ব্যাপারটা, টাকার ব্যাপারটা, আলোচনার জন্য একটা ঘরোয়া মিটিং ডাকা হয়েছে ওই কবুতরে।
এবারের মিটিংয়ের আলোচনার বিষয় কিন্তু অন্য। কুমার রণজিতও আসছেন। মানেকজি তোমাকেও ওই মিটিং-এ থাকতে বলেছেন। আর…।
তরুণকে ইতস্তত করতে দেখে সুচরিতা হাসল, বলল, শ্রীঅশোক বোসও আশা করি ওই মিটিং-এ আসছেন!
না, এখনও বোধহয় তাঁকে বলা হয়নি। আগামীকাল তিনি এসে হোটেল কন্টিনেন্টালে উঠছেন। তারপর নিশ্চয়ই বলা হবে।
ও, এবার বুঝেছি, ব্যঙ্গের হাসি ঠোঁটের কোণে ফুটিয়ে সুচরিতা বলল, তা হলে কবুতরে গিয়ে আমাকে ওই ভদ্রলোককে কবজা করতে হবে, যাতে তিনি আমার ছলাকলায় মুগ্ধ হয়ে ওই ম্যানাস্ক্রিপ্ট পাবলিশার্সের কাছে না দেন!
বুঝতেই তো পারছ, সুচরিতা। এতে তোমারও স্বার্থ আছে। তুমি কি চাও যে, ওই ম্যানাস্ক্রিপ্ট ছেপে বেরোক?
দ্যাখো তরুন, সত্যি কথা বলতে গেলে আমি তা চাই না। কিন্তু তা বলে মনের দ্বিধাকে কাটিয়ে উঠতে পারল না সুচরিতা, বলল, যাকগে, আমি সোজাসুজি মানেকজিকেই আমার মত জানাব।
আচ্ছা, সুচরিতা, একটা কাজ করলে হয় না?
কী? অবাক হয়ে তরুণের মুখের দিকে তাকাল সুচরিতা। পাণ্ডুলিপি সম্বন্ধে তরুণ বোধহয় নতুন কিছু বলবে।
চলো না, আমরা দুজন একটু বেড়িয়ে আসি। মানেকজিকে গিয়ে বললেই হবে যে, আমি এতক্ষণ তোমার সঙ্গে কথা বলছিলাম।
না, তরুণ, আমার ঠিক মুড নেই। তা ছাড়া সময় কোথায়!
হুঁ, সময় তোমার আর কোনওদিনই হবে না। কবে তোমার মত পালটাবে বলতে পারো, সুচরিতা!
আচ্ছা, তরুণ, গতকাল সঁদনী চকের কাছে তোমাকে একটি মেয়ের সঙ্গে দেখলাম…ওই মেয়েটি কে?
মুহূর্তের মধ্যে তরুণ স্যানালের মুখের রং পালটে গেল। আমতা-আমতা করে বলল, ও কিছু নয়। তুমি কি জানো না সুচরিতা, ভালো আমি তোমাকেই বাসি!
মনে-মনে হাসল সুচরিতা। এ ধরনের লোকদের দেখলে ওর রাগ হয়। এইজন্যই আজকাল ওর আর কিছুই ভালো লাগছে না। চারপাশে সব স্তাবকের দল স্বার্থসিদ্ধির জন্য দিনরাত প্রশংসা করে চলেছে। উঃ! মুখে বলল, তরুণ, তুমি এখন যাও। আমাকে একটুখানি একা থাকতে দাও–।
তারপর শোওয়ার ঘরের দিকে পা বাড়াল ও।
তরুণ সান্যাল হতাশভাবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর ঘর ছেড়ে যাওয়ার সময় দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিয়ে গেল।
সুচরিতা শুয়ে-শুয়ে ভাবছিল অমিতের কথা। সুরেন্দ্র পালিতের পাণ্ডুলিপি যদি ছাপা হয় তবে কি ও বিপদে পড়বে? অথবা অমিত চৌধুরীর চরিত্রে দাগ পড়বে? না, কিচ্ছু ভাবতে পারছে
সুচরিতা। এ ছাড়াও কানাঘুষোয় ও আঁচ পেয়েছে যে, সমর বর্মন নাকি ওইদিনের মিটিংয়ে হাজির থাকছে। কারণ? কারণটা ঠিক পুরোপুরি জানে না সুচরিতা। তবে শুনেছিল যে, গত বছরের মিটিংয়ে সুরেন্দ্র পালিত অন্য উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছিলেন। রানী সুলক্ষণার গলায় যে হীরের নেকলেস ছিল, সেটা কোনওরকমে সরিয়ে সুরেন্দ্র পালিত এতদূরে এসে এই কবুতরেই লুকিয়ে রেখেছিলেন–ওই মিটিংয়ের দিনই। অথচ সেই নেকলেস চুরির দায় চাপিয়ে দিয়েছিলেন সমর বর্মনের ঘাড়ে। সত্যিই সাংঘাতিক কূটবুদ্ধির লোক ছিলেন এই সুরেন্দ্র পালিত।
সুরেন্দ্র পালিত চলে যাওয়ার কিছুদিন পর কবুতরের মালি লাইব্রেরি-ঘরে একজন লোকের মৃতদেহ পায়। মৃত লোকটির পকেটে লালপাঞ্জা দলের প্রতীকচিহ্ন পাওয়া গিয়েছিল। তার মানে হীরের নেকলেসটার কথা সবাই জানে। আগামী মিটিংয়ে বর্মন যদি কারও ছদ্মবেশে আসে– তবে? নাঃ–এই অশোক বোস নামের ভদ্রলোকটির সঙ্গে একবার দেখা হওয়া দরকার। এবং কালই।
.
লোকটির অচেতন দেহটা নিয়ে কী করব তাই ভাবছিলাম, এমন সময় ঘরে ঢুকল ইব্রাহিম।
ইব্রাহিম হোটেল কন্টিনেন্টালের বেয়ারা। ও-ই আমার ঘর অ্যাটেন্ড করে। ও ঘরে ঢুকে অত্যন্ত অবাক হয়ে গেল, বলল, স্যার–এ কী কাণ্ড!
আমি কেটে যাওয়া ঠোঁটের কোনাটা রুমাল দিয়ে মুছে নিচ্ছিলাম, বললাম, তুমি এসেছ ভালোই হয়েছে। আমি আর-একটু হলেই একে জানলা দিয়ে ফেলে দিতাম। একে নিয়ে গিয়ে হোটেলের বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দাও।
ইব্রাহিম চায়ের কাপ টেবিলে নামিয়ে রেখে লোকটির উপুড় হয়ে পড়ে থাকা দেহটিকে চিত করে দিল। আমি আয়নায় দেখছিলাম কতখানি আহত হয়েছি। হঠাৎ আয়নাতেই লক্ষ করলাম, ইব্রাহিম লোকটিকে দেখে খুব অবাক হয়ে গেছে। কে জানে! হয়তো আমার দেখার ভুল।
একটু পরেই লোকটিকে কোথায় যেন রেখে ইব্রাহিম আমার ঘরে ফিরে এল। এসে ঘর পরিষ্কার করতে শুরু করল। ঘর সাফসুতরো হয়ে গেলে ওকে পাঁচটা টাকা দিলাম। ও চলে গেল।
হাতঘড়ির দিকে তাকালাম। সন্ধে ছটা। দারুণ কৌতূহল হচ্ছে ওই পাণ্ডুলিপি আর চিঠিগুলো নিয়ে। আজ পড়ব, কাল পড়ব, করেও সময় করে উঠতে পারিনি। এখন হাতমুখ ধুয়ে দরজা বন্ধ করে সুটকেশ খুললাম। দুটো প্যাকেটই বের করলাম।
প্রথমে চিঠির বান্ডিলটা ধরলাম। দু-একটা চিঠি উলটেপালটে দেখলাম। নিছকই প্রেমপত্র। আনন্দ আর উচ্ছ্বাসে ভরা। লেখিকা মিসেস সুচরিতা চৌধুরী। আর চিঠির ওপরে কোনও নাম উল্লেখ করে সম্বোধন নেই। শুধু মাই ডিয়ার দিয়ে শুরু। তবে একটা বিশেষ চিঠির মধ্যে একটা বাড়ির নামের উল্লেখ করা হয়েছে। কবুতর থেকে চিঠিটা লেখা হয়েছে। আর চিঠির ওপরে দিল্লি শব্দটি লেখা আছে। তার মানে দিল্লিরই কবুতর নামের কোনও বাড়ি থেকে চিঠিটা লেখা। কেউ কি এই চিঠিগুলো নিয়ে সুচরিতা চৌধুরিকে ব্ল্যাকমেল করছিল? সেইজন্যেই কি এগুলো দামি বলেছিল নেপালীটি? যাকগে, যার চিঠি তার দেখা যদি পাই তবে এ-ভার থেকে মুক্ত হওয়া যাবে। বলা যায় না, ভদ্রমহিলা হয়তো আতঙ্কে পাগল হয়ে নিশিদিন কোনও ব্ল্যাকমেলারের অপেক্ষা করছেন।
চিঠিগুলো রেখে পাণ্ডুলিপিটা নিয়ে পড়লাম।
প্রথম থেকে পড়তে শুরু করলাম।
সাধারণ ধরনের স্মৃতিকথা। সিরাজনগর সম্বন্ধে নানা তথ্য লেখা। পড়তে-পড়তে এক জায়গায় সমর বর্মনের কথা পেলাম। পাণ্ডুলিপিতে লেখা আছে, মানুষ ছদ্মবেশ নিয়ে সর্বাঙ্গে পরিবর্তন আনতে পারে, কিন্তু কানের পরিবর্তন করা অসম্ভব…। তার মানে সমর বর্মনের কানে কি কোনও বিশেষত্ব আছে? নাকি এটা নিছক কল্পনা?
পাণ্ডুলিপিটা প্রায় ঘণ্টাদুয়েক পর শেষ করলাম। এমন সময় ঘরের দরজায় নক করার শব্দ শোনা গেল। পাণ্ডুলিপি আর চিঠির বান্ডিলটা ড্রেসিং টেবিলের ওপর রেখে উঠে গিয়ে দরজা খুললাম।
দেখি ইব্রাহিম দাঁড়িয়ে। ওর হাতের ট্রেতে সাজানো ডিনার।
ও ট্রে-টা এনে টেবিলের ওপর রাখল। হঠাৎ লক্ষ করলাম, ওর চোখের দৃষ্টি ড্রেসিং টেবিলের ওপর।
আমার দেখার ভুল?
ও খাবার রেখে ঘর ছেড়ে চলে গেল। তা হলে কি তা হলে কি…।
খাওয়া-দাওয়া সেরে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। অবশ্য তার আগে চিঠির বান্ডিলটা সুটকেসে বন্ধ করে রাখলাম। আর পাণ্ডুলিপিটা বালিশের নীচে রেখে ঘুমিয়ে পড়লাম।
অনেক রাতে ঘরের ভেতরে কারও চলাফেরার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। সামান্য চোখ খুলে তাকিয়ে দেখি ঘরের জানলাটা নেই। শুনতে অবাক লাগলেও ঠিক তাই। জানলার জায়গাটা জমাট অন্ধকারে ঢাকা। হঠাৎ সেই জমাট অন্ধকারটা নড়ে উঠল। জানলাটা আবার দেখা গেল।
ছায়ামূর্তিটা ক্রমশ ড্রেসিংটেবিলের দিকে এগোতে লাগল। আমি চুপিচুপি উঠে গিয়ে একলাফে ঘরের বাতিটা জ্বেলে দিলাম। যে-লোকটি হতভম্ব হয়ে চমকে ফিরে তাকাল, তার হাতে একটা ছুরি ঝিকিয়ে উঠল। লোকটি আর কেউ নয়, স্বয়ং ইব্রাহিম!
আমাকে আলো জ্বালতে দেখেই ও তীরবেগে আমার দিকে ছুটে এল। আমার চোখ ছিল ওর হাতের দিকে। নিমেষের মধ্যে দু-হাতে ওর ডানহাতের কবজি চেপে ধরলাম। দুজনেই মাটিতে গড়াগড়ি খেতে লাগলাম। আমার আঁকুনিতে ইব্রাহিমের হাতের ছুরি পড়ে গেল মাটিতে। তারপর কেন জানি না ও হঠাৎই নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড়োল জানলার দিকে। এবং মুহূর্তের মধ্যেই জানলা পথে সটকে পড়ল।
ইব্রাহিমের পিছু নিয়ে লাভ নেই জেনে সে-চেষ্টা আর করলাম না। এগিয়ে এসে ছুরিটা তুলে নিলাম। সাধারণ ছুরি একটা, কিন্তু বাঁটের ওপর একটা হাতের পাঞ্জা খোদাই করে আঁকা। এখানেও লালপাঞ্জা! ইব্রাহিমও লালপাঞ্জা দলের কমরেড? তাই হয়তো গত বিকেলের অচেতন লোকটিকে দেখে ও একটু অবাক হয়েছিল।
তাড়াতাড়ি গিয়ে সুটকেসটা খুললাম। সর্বনাশ! চিঠির বান্ডিলটা অদৃশ্য হয়েছে। তবু ভালো যে, পাণ্ডুলিপিটা বালিশের নীচে রেখে শুয়েছিলাম।
কিছুক্ষণ পর আবার আলো নিভিয়ে জানলা বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম। বুঝতে পেরেছিলাম যে, এই রাতে চেঁচামেচি করেও কোনও ফল হবে না। কারণ, ইব্রাহিম নিশ্চয়ই আর কন্টিনেন্টালের চত্বরে বসে নেই!
.
ভোরবেলা ঘুম ভেঙে উঠেই প্রথমে গেলাম ম্যানেজারের ঘরে।
আমাকে দেখেই তিনি বললেন, মিস্টার বোস, (অশোকের নামেই হোটেলে ঘর বুক করেছিলাম আমি। শুনলাম আপনার ঘরে নাকি গত রাতে চোর এসেছিল!
আমি বললাম, না তো! ইব্রাহিম কী একটা জরুরি খবর দিতে ভুলে গিয়েছিল বলে রাত দুটোর সময় খবরটা দিতে একবার এসেছিল।
কী খবর? কী খবর? ব্যগ্র হয়ে উঠলেন ম্যানেজার।
ইব্রাহিমের শাদির নেমন্তন্ন করতে এসেছিল। যাওয়ার সময় ও তাড়াতাড়িতে ওর ছুরিটা নিয়ে যেতে ভুলে গেছে। আপনি কাইন্ডলি ওকে এটা দিয়ে দেবেন। বলে পাশপকেট থেকে ইব্রাহিমের অস্ত্রটা বের করে ম্যানেজারসাহেবকে দিলাম।
এটা যে সত্যি-সত্যিই একটা ছুরি দেখছি! আঁতকে উঠলেন ম্যানেজার।
না, দাঁত খোঁচানোর কাঠি মনে-মনে বললাম আমি, মুখে বললাম, ইব্রাহিম আশা করি হোটেলে আর নেই।
না, পালিয়েছে। সঙ্গে-সঙ্গেই জানালেন তিনি।
চুরি অবশ্য তেমন কিছু যায়নি। তবু খবরটা দিয়ে রাখা ভালো, বললাম আমি, এক বান্ডিল চিঠি নিয়ে গেছে ইব্রাহিম। বোধহয় কোনও নামকরা লোকের নিজের হাতে লেখা এক অমূল্য পাণ্ডুলিপি মনে করেছে ওটাকে। বিবিকে শাদিতে উপহার দেবে হয়তো। চেয়ার ঠেলে উঠলাম আমি।
এমন সময় ম্যানেজার আমতা-আমতা করে প্রশ্ন করলেন, মিস্টার বোস, আপনি কি আমাদের হোটেলে আর থাকবেন?
তার মানে! যেতে গিয়েও ঘুরে তাকালাম আমি।
না, এরকম একটা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে গেল…।
ওঃ– হেসে ফেললাম আমি : আপনিশুদ্ধ সবকটা বেয়ারাও যদি আমার ঘরে চুরি করতে ঢোকেন, তবু আমি এ-হোটেল ছাড়ছি না, আন্ডারস্ট্যান্ড?
ম্যানেজারকে উত্তর দেওয়ার কোনও সুযোগ না দিয়েই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলাম।
ওপরে ঘরে গিয়ে ব্রেকফাস্ট সবে শেষ করেছি, এমন সময় ফোন বেজে উঠল। অনিচ্ছাসত্ত্বেও রিসিভার তুলে নিলাম।
হ্যালো–
স্যার, ডেস্ক ক্লার্কের কণ্ঠস্বর ভেসে এল, এক ভদ্রলোক আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন।
কী নাম? অবাক হয়ে জানতে চাইলাম আমি।
মিস্টার…। মিনিটখানেক নীরবতার পর আবার গলা শোনা গেল, স্যার, আমি ভদ্রলোকের কার্ড আপনার কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
ফোন নামিয়ে রাখার একটু পরেই দরজায় নক করার শব্দ পেলাম। দরজা খুলতেই একজন বেয়ারা একটা কার্ড দিল আমার হাতে। তাতে লেখাঃ
শ্রীনরসিংহ দত্তরায় সেন চৌধুরী
বার-অ্যাট-ল
ডেক্স ক্লার্কের নীরবতার কারণ এখন বুঝতে পারলাম না। যা হোক, মনে-মনে নরসিংহবাবুর বাবাকে ছেলের নামকরণের জন্যে কয়েক হাজার ধন্যবাদ জানিয়ে বেয়ারাটিকে বললাম, বাবুকে ডেকে দাও–আমি দেখা করব।
একটু পরেই ঘরে যিনি প্রবেশ করলেন তাঁকে এক কথায় জলহস্তীর ছানা বলা যায়। আমি তাড়াতাড়ি বললাম, আসুন, আসুন
একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসতে-বসতে তিনি বললেন, আমার নাম।
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাধা দিলাম আমিঃ প্লিজ, আর বলার প্রয়োজন নেই। কার্ড পড়েই মাথা ঘুরছে। তার ওপর আবার বললে হয়তো হার্টফেল করব।
ভদ্রলোক একটু হাসলেন, বললেন, যদি ভুল না আমার হয়ে থাকে, তবে বোধহয় অশোক বোস আপনিই?
আমি মৃদু হেসে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালাম। বললাম, আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না ।
লয়ালিস্টদের তরফ থেকে আমি আসছি। শুনেছি আপনার কাছে সুরেন্দ্র পালিতের স্মৃতিকথার ম্যানাস্ক্রিপ্টটা আছে।
ঠিকই শুনেছেন। জানালাম আমি। ওঁর কথা বলার ভঙ্গিতে ক্রমশ অবাক হচ্ছিলাম।
চাই না আমরা যে, পাণ্ডুলিপিটা ছাপা এখন হোক। কুমার রণজিতও চাইবেন না সেটা। আপনি আশা করি রাখবেন কথা আমাদের এবং প্রকাশ এখন পাণ্ডুলিপিটা করবেন না।
মোটেই না–মোটেই না। বরং আজকালের মধ্যেই আমি মেহেতা অ্যান্ড সন্সের হাতে পাণ্ডুলিপিটা তুলে দিচ্ছি। নির্বিকারভাবে জানালাম আমি।
করতে এটা পারেন না আপনি। এতে বিপদ অনেক হবে।
আমি কথা দিয়েছি।
আপনি তা হলে শুনবেন না অনুরোধ আমাদের? এই শেষ কথা আপনার তা হলে?
আমি নিরুপায়–।
বেশ, উঠে দাঁড়ালেন শ্রীনরসিংহ : জানি অন্য আমরা উপায়। আমরা এটা ছাপানোর ব্যাপারটা করবই যেভাবে হোক বন্ধ। নমস্কার।
শ্রীনরসিংহ থপথপ করে বিদায় নিলেন।
আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। অন্য উপায় মানে! ইব্রাহিমের মতোই কাউকে তিনি ব্যবহার করবেন নাকি!
প্রায় ঘণ্টাখানেক ডুবে রইলাম নানান চিন্তায়।
হঠাৎই সমস্ত চিন্তা ছিন্নভিন্ন করে ফোন বেজে উঠল।
চিন্তিত হলাম। এ আবার কে ফোন করল! এগিয়ে গিয়ে রিসিভার তুলে নিলাম।
হ্যালো।
মিস্টার অশোক বোস?
আপনি?
মেহেতা অ্যান্ড সন্সের শ্রী জগদীশকিশোর মেহেতা।
ও কী ব্যাপার? ভীষণ অবাক হলাম আমি।
মিস্টার বোস, ম্যানাস্ক্রিপ্টটা কি আপনি আজ দেবেন?
হ্যাঁ, আমি একটু পরে গিয়ে দিয়ে আসব। ভাবলাম ঝামেলা চুকিয়ে দেওয়াই ভালো।
পাগল হয়েছেন আপনি! আমি ডেফিনিটলি বলতে পারি ওই ম্যানাস্ক্রিপ্ট নিয়ে আপনি কোনওদিনই আমাদের অফিসে সুস্থ অবস্থায় পৌঁছোতে পারবেন না।
তা হলে?
আমি বরং গজানন শিকদার নামে আমার এক অতি বিশ্বস্ত কর্মচারীকে পাঠাচ্ছি। আপনি ম্যানাস্ক্রিপ্টটার মতো একটা নকল প্যাকেট তৈরি করে হোটেলের কাস্টডিতে জমা দিন। তা হলে সবার নজর ওইদিকেই থাকবে। আর বাই দ্যাট টাইম পনেরো হাজার টাকার একটা চেক দিয়ে আমি গজানন শিকদারকে আপনার ওখানে পাঠাচ্ছি। আপনি ওর হাতে সুরেন্দ্র পালিতের ম্যানাস্ক্রিপ্টটা দিয়ে দেবেন। আচ্ছা, রাখছি।
প্রায় আধঘণ্টা পর একজন ভদ্রলোক এলেন। বললেন, আমি মেহেতা অ্যান্ড সন্সের গজানন শিকদার। বলে একটা পনেরো হাজার টাকার চেক পকেট থেকে বের করলেন।
আমি ইতিমধ্যে সব ব্যবস্থা করে ফেলেছিলাম। চেকটা নিয়ে পাণ্ডুলিপিটা তার হাতে তুলে দিলাম। বললাম, মিস্টার শিকদার, সাবধানে যাবেন। আমার কিন্তু আর কোনও দায়িত্ব নেই।
মৃদু হেসে গজানন শিকদার চলে গেলেন।
তিনি চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই একটা বয় এসে একটা কার্ড আর চিঠি দিয়ে গেল। অবাক হয়ে সেটা নিলাম, দেখি তাতে লেখা?
শ্রী অশোক বোস সমীপেষু,
মহাশয়, আগামী রবিবার কবুতরে যে-পার্টি দেওয়া হচ্ছে তাতে আপনাকে সম্মানিত অতিথি হতে অনুরোধ করছি। বয়টির কাছে আপনার উত্তর দিলে বাধিত হব। ইতি–
সঙ্গের কার্ডে মানেকজিপ্রসাদজির ফার্মের নাম ও কবুতরের ঠিকানা ছিল। বয়টিকে ডেকে ওগুলো ফেরত দিয়ে বললাম, দুঃখিত, তোমার মালিককে বোলো, আমি বিশেষ কারণে পার্টিতে যেতে পারছি না।
বয়টি চিঠি ও কার্ড নিয়ে চলে গেল।
আমি এবার হাত-পা ছড়িয়ে বসলাম। সব কাজ শেষ। এখন শুধু জানতে হবে কে ওই সুচরিতা চৌধুরী। নামটার মধ্যেই যেন কেমন এক প্রচ্ছন্ন ব্যক্তিত্ব লুকিয়ে আছে।
হঠাৎ আমার চোখ গেল ড্রেসিং টেবিলের ওপর খোলা অবস্থায় রাখা একটা ফিল্ম ম্যাগাজিনের দিকে। এখনও পর্যন্ত নেড়েচেড়ে দেখিনি। হাওয়ায় ম্যাগাজিনটার কতকগুলো পাতা উলটে গেছে। সেখানে একজন মহিলার ফটো দেখা যাচ্ছে। নীচে লেখা : শ্ৰীমতী সুচরিতা চৌধুরী, মোতিবাগ।
লাফিয়ে উঠলাম আমি। ইস, যদি এঁরই হয়ে থাকে চিঠিগুলো! নাঃ, এক্ষুনি ওঁকে একবার সাবধান করে দিতে হবে। নয়তো বলা যায় না, চিঠিগুলো নিয়ে কেউ হয়তো মিসেস চৌধুরীকে ব্ল্যাকমেল করবে। ভদ্রমহিলা তা হলে এখানে বেশ পরিচিত দেখছি!
ভাবলাম শহর দেখতে বেরোব। উঠে দাঁড়িয়ে জামাকাপড় পালটাতে লাগলাম। মনে-মনে নিজের পিঠ চাপড়ে বললাম, এখন শ্রীযুক্ত অশোক বোস মঞ্চ থেকে প্রস্থান করবেন এবং তার পরিবর্তে মঞ্চে আবির্ভূত হবেন একমেবাদ্বিতীয়ম, আদি ও অকৃত্রিম, শ্ৰীযুক্ত কাঞ্চন মৈত্র!
.
সুচরিতা প্রসাধন সেরে বেরোতে যাচ্ছিল। উদ্দেশ্য, তরুণের কাছ থেকে ঠিকানা জেনে শ্ৰীযুক্ত বোসের সঙ্গে দেখা করা। কী জানি কেমন দেখতে হবে ভদ্রলোককে! তিনি কি জানেন যে, সঙ্গে অ্যাটমবোমার মতো একটি ম্যানাস্ক্রিপ্ট নিয়ে তিনি ঘুরছেন! বোধহয় না।
বেরোনোর আগে কাজের লোককে ডেকে সুচরিতা বলল, যতীন, আমি একটু বেরোচ্ছি।
কিন্তু দরজা খুলে বেরোতে যেতেই ধাক্কা লাগল একজন লোকের সঙ্গে। লোকটি বোধহয় ঘরে ঢুকতে যাচ্ছিল।
মাপ করবেন, লোকটি বলল, আপনিই কি মিসেস সুচরিতা চৌধুরী?
হ্যাঁ। সুচরিতার ভ্রূ-কুঞ্চিত হল। কী চায় লোকটি? একে তো ও চেনে বলে মনে হচ্ছে না।
লোকটি ওর দিকে চেয়ে হাসল, দাঁতের ফাঁক দিয়ে বিচিত্র এক শব্দ করে বলল, আপনার সঙ্গে একটু ব্যাবসার ব্যাপারে গোপন কথা আছে।
গোপন কথা! খুবই অবাক হল সুচরিতা।
প্লিজ, দয়া করে দরজাটা ছাড়ুন, ম্যাডাম। এখানে দাঁড়িয়ে তো আর কথা হতে পারে না! বলল লোকটি।
ইতস্তত করে সুচরিতা বলল, আচ্ছা–আসুন, ভেতরে আসুন।
ভেতরে গিয়ে বসল দুজনে।
বিচিত্রভাবে হাসল লোকটি ও আমার কাছে কতকগুলো কাগজ আছে। বলল সে।
কাগজ! আবার অবাক হল সুচরিতা।
লেখা কাগজ।
কী বলতে চাইছেন?
আপনার লেখা কাগজ।
আমার লেখা?
কাউকে আপনার লেখা চিঠির কাগজ।
আমার লেখা চিঠি! দেখি!
পকেট থেকে একটা চিঠি বের করে সুচরিতা চৌধুরীর হাতে দিল লোকটি ও অনেকগুলো চিঠির একটি।
চিঠি দেখে মনে-মনে হাসল সুচরিতা। এ-চিঠি ও কোনওদিনই লেখেনি। ওর হাতের লেখাও নয় এগুলো। শুধু লেখিকার নামের জায়গায় ওর নাম লেখা আছে।
কিন্তু কী উদ্দেশ্য এই লোকটির? ব্ল্যাকমেলিং? নাকি অন্য কোনও গভীর উদ্দেশ্য আছে?
মনে-মনে নিশ্চিত কিছু একটা ভেবে নিয়ে সুচরিতা বলল, এগুলো আপনি কেমন করে পেলেন?
দেখুন, আমার এখন খুব অভাব চলছে। তাই হাজার পঁচিশেক টাকার ব্যবস্থা যদি করেন… সব চিঠিগুলোর জন্যে। অত্যন্ত বিনীতভাবে বলল লোকটি।
মনে-মনে অতি দ্রুত চিন্তা করল সুচরিতা। এর পিছনে নিশ্চয়ই কোনও গূঢ় উদ্দেশ্য আছে। ভাবল, দেখিই না কী মতলব।
সুচরিতা বলল, দেখুন, আপাতত আমার কাছে তো এত টাকা নেই। এই চিঠিটার জন্যে আমি শদুয়েক টাকা দিচ্ছি। আগামীকাল রাতে আপনি আসুন, তখন বাকি চিঠিগুলোর ব্যাপারে কথা বলা যাবে।
ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একশো টাকার দুটো নোট বের করে লোকটির হাতে দিল ও। চিঠিটা রেখে লোকটি চলে গেল।
চিঠিটা পড়ল সুচরিতা। নিছক একটা প্রেমপত্র। কী কারণে কে কাকে লিখেছিল তা বুঝতে পারল না। চিঠিটা ভ্যানিটি ব্যাগে রেখে উঠে গিয়ে ফোন করল তরুণের অফিসে। সেখান থেকে। অশোক বোসের হোটেলের নাম জেনে সেই হোটেলে ফোন করল।
হ্যালো, হোটেল কন্টিনেন্টাল?
হ্যাঁ–কাকে চান?
অশোক বোসকে।
কাইন্ডলি একমিনিট অপেক্ষা করুন, লাইন দিচ্ছি।
কিছুক্ষণ পর টেলিফোনে কারও কণ্ঠস্বর ভেসে এল, কে কথা বলছেন?
আমি কি অশোক বোসের সঙ্গে কথা বলছি?
হ্যাঁ, কিন্তু আপনি কে বলছেন?
মিসেস সুচরিতা চৌধুরী।
ওদিকের কণ্ঠস্বর চমকে উঠল মনে হলঃ মিসেস চৌধুরী!
হ্যাঁ। আপনার কাছেই তো নটোরিয়াস ম্যানাস্ক্রিপ্টটা রয়েছে, না?
কাছাকাছি গিয়েছিলেন। আছে নয়, ছিল।
তার মানে! তার মানে আপনি?
ঠিকই ধরেছেন। ওটা এখন মেহেতা অ্যান্ড সন্সের কাছে। আজ সকালেই ওটা ওদের হাতে তুলে দিয়েছি।
ওঃ– সুচরিতা যেন আশাহত হলেও হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। রিসিভার নামিয়ে রাখল।
ওপারের কণ্ঠস্বর তখনও বলছিল, কিন্তু মিসেস চৌধুরী, আপনার সঙ্গে আমার–।
সুরেন্দ্র পালিত, কুমার রণজিৎ, মৃত কুমার অতলান্ত রায়, মানেকজি, প্রসাদজি, তরুণ, অমিত এবং অশোক বোস–সবাই যেন সুচরিতার চারপাশে এসে ছায়ার মতো ভিড় করে দাঁড়িয়েছেন। সবাই হাত বাড়িয়ে ওর থেকে যেন কিছু চাইছেন।
চকিতে সুচরিতার মনে পড়ল ব্ল্যাকমেলারটির কথা। আবার আগামীকাল! চোখ বুজল সুচরিতা।
.
পরদিন রাত দশটার সময় ক্লাব থেকে ফিরল সুচরিতা। একটু বেশিই দেরি করে ফেলেছে আজ। কিন্তু সদর দরজা হাট করে খোলা কেন! দ্রুত পায়ে ভেতরে ঢুকল। যতীনকে কোথাও দেখতে পেল না। কোথায় যেতে পারে! হঠাৎই লক্ষ করল, একটুকরো কাগজ মেঝেতে হাওয়ায় উড়ছে। কৌতূহলে কুড়িয়ে নিল ওটা। এ যে একটা চিঠি! তাতে লেখাঃ
যতীন,
শিগগিরই চাঁদনি চকের বাজারের কাছে চলে আয়। অনেক জিনিসপত্র কিনে ফেলেছি।
–দিদিমণি।
অবিশ্বাস্য। কোনও চিঠি ও যতীনকে পাঠায়নি। অবশ্য একথা ঠিক যে, ক্লাবের ফোন খারাপ থাকলে মাঝে-মাঝে এ ধরনের চিঠি ও ক্লাব থেকে পাঠিয়ে থাকে। কিন্তু ক্লাবের ফোন তো ঠিকই আছে!
অর্থাৎ, সব জেনেশুনেই এই চিঠিটা কাউকে দিয়ে পাঠানো হয়েছে।
পায়ে-পায়ে শোবার ঘরে এসে সুচরিতার বিস্ময় আতঙ্কে পালটে গেল। শোওয়ার ঘরের মেঝেতে পড়ে আছে একজন চেনা লোক। একটা সুদৃশ্য ছুরি তার হৃৎপিন্ডকে এফেঁড়-ওফেঁড় করে দিয়েছে। লোকটি এই হিসেবে চেনা যে, তাকে আগের দিনই সুচরিতা দেখেছে। এ সেই ব্ল্যাকমেলার।
তার মানে টাকার জন্য সে আজ সময়মতোই এসেছিল। কিন্তু কে মারল ওকে?
হতভম্ব অবস্থায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল সুচরিতা। আজই ওকে কবুতরে যেতে হবে। ও মিটিং এ যাবে, কারণ অশোক বোসের ব্যাপারটা মিটে গেছে। কিন্তু এ কী ঝামেলা? এরপর পুলিশ আসবে। ওকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। ব্ল্যাকমেলিংয়ের কথা বেরিয়ে পড়বে। ও যে শুধুমাত্র কৌতূহল মেটানোর জন্যই দুশো টাকা দিয়েছে তারা তা শুনবে না। তার মানে নিঃসন্দেহে ওঁকে কিছুদিনের জন্য পুলিশ হেফাজতে থাকতে হবে। অর্থাৎ, মিটিং-এ যাওয়া যাবে না। কিন্তু কারা ওকে এভাবে রহস্যের জালে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে।
এই মুহূর্তে কারও সাহায্য খুব দরকার এই ভেবে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এল সুচরিতা। তখনই দেখল একজন সুপুরুষ যুবক ওর বাড়ির নেমপ্লেটের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে।
হাতে যেন চাঁদ পেল সুচরিতা। কিন্তু ওকে দেখামাত্রই লোকটি বলে উঠল, মিসেস চৌধুরী, তাই না?
আপনি আমাকে চিনলেন কেমন করে?
একটা সিনেমা-ম্যাগাজিনের একটা ছেঁড়া পাতা তুলে ধরল লোকটি : আমার নাম কাঞ্চন মৈত্র।
দেখুন, ইতস্তত করে শুরু করল সুচরিতা, মানে, আমার ঘরে একজন লোক মরে পড়ে আছে–মানে, তাকে কেউ খুন করেছে। আপনি যদি পুলিশে…মানে…।
তার বেশি আর বলতে হল না। কোথায় বডি? বলে তৎপর হয়ে উঠল কাঞ্চন। সুচরিতা জবাব দেওয়ার আগেই ওকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকল সে।
সুচরিতার মাথা ঠিকঠাক কাজ করছিল না। তাই বোধহয় প্রথম দেখাতেই একজন অচেনা মানুষকে বিশ্বাস করে ফেলেছে। কিন্তু…।
কোনও উপায় না দেখে সদর দরজা বন্ধ করে কাঞ্চনকে অনুসরণ করে শোবার ঘরে এল সুচরিতা।
ঘরের অবস্থা দেখে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল কাঞ্চন। তার মুখ দিয়ে বিস্ময়ের শব্দ বেরিয়ে এল। তারপর নিজেকে সামলে বলল, বাড়িতে আর কে-কে আছে?
আপাতত কেউ নেই, তবে একজন কাজের লোক আছে–এখন বাইরে গেছে।
সে এলে দূরের একটা দোকান-টোকানে পাঠিয়ে দেবেন। ততক্ষণে আমি দেখি কদুর কী করতে পারি। বলে চটপট কাজে লেগে গেল সে।
তাকে সাহায্য করতে নিজেও হাত লাগাল সুচরিতা।
প্রায় একঘণ্টা পর বাইরের দরজায় কারও নক করার শব্দ শোনা গেল।
ওই বোধহয় যতীন এসেছে, বলে কাঞ্চনের দিকে একটা ইশারা করে বলল, প্লিজ কোনও শব্দ করবেন না। আমি এখুনি আবার ওকে বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছি। সুচরিতা বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
ইতিমধ্যে লাশটাকে একটা ট্রাঙ্কের মধ্যে রাখা হয়ে গেছে। তখনই হঠাৎ ছোরার হাতলটার দিকে চোখ গেল কাঞ্চনের। সে কি ভুল দেখছে নাকি? এই তো! এই তো লেখা রয়েছে পরিষ্কারভাবেঃ সুচরিতা চৌধুরী।
সর্বনাশ! তা হলে তো ছুরিটার আলাদা একটা ব্যবস্থা করতে হয়! চটপট হাতে রুমাল জড়িয়ে এক হ্যাঁচকায় ছুরিটাকে বের করে নিল কাঞ্চল। রক্ত এতক্ষণে জমাট বেঁধে আসায় বিশেষ অসুবিধেয় পড়তে হল না।
এই সময় আবার ঘরে এসে ঢুকল সুচরিতা। ওকে দেখেই কাঞ্চন বলল, দেখুন তো, কিছুটা ব্রাউন পেপার আনতে পারেন কি না। এই ছোরাটাকে মুড়ে একটা প্যাকেটমতো করতে হবে।
তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল সুচরিতা।
ট্রাঙ্কের ডালাটা বন্ধ করতে গিয়েই দ্বিতীয় বিস্ময়। একচিলতে কাগজ উঁকি মারছে ইব্রাহিমের পকেট থেকে।
হ্যাঁ, এ-বিষয়ে আর কোনও সন্দেহই নেই? মৃত লোকটি হোটেল কন্টিনেন্টালের সেই রহস্যময় বেয়ারা ইব্রাহিম।
নীচু হয়ে চিরকুটটাকে বের করে নিল কাঞ্চন। তাতে লেখাঃ কবুতর, রাত বারোটা পঁয়তাল্লিশ
কাগজটা পকেটে গুঁজল সে।
কিছুক্ষণ পরই ব্রাউন পেপার হাতে ঘরে ঢুকল সুচরিতা।
সব কাজ সেরে তৈরি হয়ে কাঞ্চন বলল, মিসেস চৌধুরী, আপনি ঘরটাকে আর-একবার ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করে রাখুন। আমি আপনার গাড়িটা নিয়ে এগুলোর ব্যবস্থা করতে রওনা হচ্ছি। গাড়িটা হয়তো কাল আপনাকে ফেরত দিয়ে যাব। আশা করি, আপনি আমাকে বিশ্বাস করবেন।
সুচরিতা এমনভাবে হাসল যার অর্থ, বিশ্বাস না করে উপায় কী!
ওরা দুজনে মিলে ট্রাঙ্কটাকে বাইরে এনে গাড়ির ডিকিতে রাখল। কাঞ্চন গাড়ি ছেড়ে দিল। যাওয়ার আগে সুচরিতার দিকে আশ্বাসের একটা মিষ্টি হাসি ছুঁড়ে দিয়ে গেল।
সুচরিতা ভাবছিল। মিটিং আগামীকাল। কিন্তু আজ রাত থেকেই সকলের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে কবুতরে। ওরও আজ রাতেই যাওয়ার কথা।
তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিল সুচরিতা। যতীন ফিরে এলেই ও বেরোবে। লক্ষ্য কবুতর।
মিটিং-এ ওর থাকাটা কি বিপজ্জনক? তাই কি এই রহস্যময় জঘন্য খুনের খেলা? কিন্তু কারা, কেন, মিটিংয়ে ওর হাজিরা চায় না? সেটাই–সেটাই এখন জানতে চায় সুচরিতা।
.
কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় সেটা দেখার লোভ সামলাতে পারছিলাম না। শেষ পর্যন্ত খুনই হল ইব্রাহিম! কার দলের হয়ে কাজ করছিল ও লাল পাঞ্জা কি? হতে পারে। হয়তো তাদের কথার অবাধ্য হয়েই সুচরিতা চৌধুরীকে ব্ল্যাকমেল করতে চেয়েছিল ইব্রাহিম। তাই হয়তো লালপাঞ্জার এই নিষ্ঠুর শাস্তি।
কিন্তু চিঠিগুলো গেল কোথায়? সুচরিতা চৌধুরী বাড়িতে ঢোকার আগে কি কেউ ঢুকেছিল ওঁর বাড়িতে? গাড়ি চালাতে চালাতে এই সব কথা মনে পড়ছিল। অথচ একইসঙ্গে আর-এক চিন্তা। সেটা হল, এই লাশটাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব লুকিয়ে ফেলতেই হবে–যাতে এটা খুঁজে বের করতে অন্তত দু-তিনদিন সময় লাগে।
হঠাৎই একটা কথা মনে এল। সুচরিতা চৌধুরীকে এই খুনের সঙ্গে জড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে কেন? ওঁর বাড়িকেই খুনের জায়গা হিসেবে বেছে নেওয়া হল! ছুরির বাঁটেও ওঁরই নাম লেখা! অর্থাৎ, কেউ-কেউ কবুতরে সুচরিতা চৌধুরীর উপস্থিতি চান না। কারণ? সুচরিতা মিটিংয়ে হাজির হলে কি কোনও বিপদের সম্ভাবনা আছে? কেন? কার?
চিন্তার জালে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছিলাম। স্টিয়ারিং ধরে সোজা হয়ে বসলাম। শহরতলিতে চলে এসেছি বুঝতে পারলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই নির্জন রাস্তার ধারে একটা গাছের কাছে গাড়ি থামালাম। ক্যারিয়ার খুলে ট্রাঙ্কটাকে বের করে রাস্তার ধারের নদৰ্মার দিকে গড়িয়ে দিলাম। দু চারবার উলটে-পালটে ট্রাঙ্কটা নদৰ্মার মধ্যে গিয়ে পড়ল। এইবার ব্রাউন পেপারে মোড়া ছুরিটাকে পকেট থেকে বের করে চিন্তা করতে লাগলাম, কোথায় লুকোনো যায় এটাকে।
হঠাৎই একটা মতলব মাথায় আসাতে হেসে উঠলাম। তারপরই ছুরিটাকে পকেটে রেখে চটপট গাছে উঠে পড়লাম। দুটো ডালের খাঁজে সাবধানে গেঁথে দিলাম ওটা। গাছে উঠে খোঁজার কথা পুলিশের নিশ্চয়ই মাথায় আসবে না।
গাছ থেকে নেমে হাতঘড়ির দিকে নজর দিলাম। পৌনে বারোটা। ফিরে যাওয়ার জন্যে গাড়িতে উঠে গাড়ি ছাড়তেই মনে পড়ল সেই কাগজটার কথা। ইব্রাহিমের পকেট থেকে পাওয়া চিরকুটটার কথা। কবুতর, রাত বারোটা পঁয়তাল্লিশ। কবুতরে রাত বারোটা পঁয়তাল্লিশে কি কিছু ঘটবে নাকি? কবুতরের ঠিকানাটা ভাগ্যিস মনে রয়েছে এখনও। অতএব ভাগ্যকে ধন্যবাদ দেওয়া ছাড়া উপায় নেই।
ঝড়ের বেগে গাড়ি ছুটিয়ে দিলাম কবুতরের উদ্দেশে। যে করেই হোক, বারোটা পঁয়তাল্লিশের আগেই কবুতরে আমার পৌঁছোনো চাই-ই চাই! আরও জোরে চাপ দিলাম অ্যাকসিলারেটরে।
শেষ পর্যন্ত এসে হাজির হলাম কবুতরে। হাতঘড়ির দিকে তাকালাম। রাত বারোটা চুয়াল্লিশ। আর এক মিনিট বাকি।
গাড়ি ছেড়ে বাইরে এসে দাঁড়ালাম। সামনেই দেখা যাচ্ছে প্রসাদজির বাগানবাড়ি কবুতর। কবুতর নাম সত্যিই সার্থক হয়েছে। গোটা বাড়িটা ধপধপে সাদা। যেন কোনও রাজহংসী ডানা মেলে রয়েছে উড়ে যাওয়ার জন্যে।
কবুতরের সদর গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম। বাড়িটার কোনও ঘরেই আলো দেখা যাচ্ছে না। নিঝুম নিস্তব্ধ। সুরকি ঢালা পথ ধরে এগিয়ে চললাম। কিন্তু কিছুটা যেতেই এক বিকট শব্দ ভেসে এল বাড়ির ভেতর থেকে।
গুড়ুম।
নিশ্চয়ই গুলির শব্দ!
শব্দটা একতলার কোনও ঘর থেকেই এল বলে মনে হল। পরমুহূর্তেই দোতলার একটা ঘরে আলো জ্বলে উঠল। আমি তীরবেগে ছুটলাম শব্দের উৎস লক্ষ্য করে। কে জানে, পরমুহূর্তে আমি কী দেখতে চলেছি!
দৌড়ে গিয়ে উঠোন পার হয়ে একতলার একটা ঘরের কাছে পৌঁছোলাম। ঘরের সবকটা ফ্রেঞ্চ উইন্ডোই ভেতর থেকে আটকানো। অন্ধকারে কিছুই ঠাহর করা যাচ্ছে না। জানলার শার্সিগুলো ধরে টানাটানি করলাম। নাঃ, ভেতর থেকেই বন্ধ।
হঠাৎই আমি একটু ভয় পেলাম। এইরকম অবস্থায় কেউ যদি আমাকে আবিষ্কার করে, তবে! একথা মনে হতেই আবার ছুটলাম গাড়ি লক্ষ্য করে। গাড়িতে পৌঁছে আর-একবার ঘুরে তাকালাম কবুতরের দিকে। সেই আলোটা এখন নিভে গেছে। গাড়িতে বসে স্টার্ট দিলাম।
গাড়ি চালাতে চালাতে আবার মনে হল ইব্রাহিমের পকেটে পাওয়া সেই চিরকূটটার কথা। ইব্রাহিমের এখানে আসার কথা ছিল। আর তার বদলে এসেছি আমি। একেই বলে ভাগ্যের পরিহাস। কিন্তু সুচরিতা? সুচরিতা যদি কবুতরে পৌঁছে থাকে, তবে ও গেল কোথায়! গুলির আওয়াজে কি কারওরই ঘুম (একজন বাদে, যার ঘরে আলো দেখা যাচ্ছিল) ভাঙল না!
যাই হোক, আমি আবার আসব এই কবুতরে মিটিংয়ে যোগ দিতে। নোবডি ক্যান স্টপ মি ফ্রম কামিং হিয়ার। আপনা থেকেই আমার চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল।
.
পরদিন ভোরবেলা খবরের কাগজে খবরটা দেখে চমকে উঠলাম। কবুতরে আমার প্রায় চোখের সামনে গতকাল রাতে যিনি নিহত হয়েছেন, তিনি সিরাজনগরের বর্তমান প্রধান কুমার রণজিৎ সেন।
তা হলে মিটিং-এ এসেছিলেন তিনি। কিন্তু তাকে খুন করে কার লাভ? কেউ কি চেয়েছিল যে, কুমার রণজিৎ মিটিংয়ের আলোচনায় যোগ না দেন। কিন্তু কেন?
এ কী জটিল রহস্যের মুখোমুখি হলাম! রহস্যময় পাণ্ডুলিপি। ইব্রাহিমের মৃত্যু। সুচরিতা চৌধুরির নাম ধার করে লেখা প্রেমপত্র। সুচরিতা চৌধুরীকে মিটিংয়ে যেতে বাধা দেওয়া। কুমার রণজিতের মৃত্যু। লালপাঞ্জা–উঃ, কে জানে এর পরের অধ্যায় কী!
যা হোক, কবুতরে যাওয়ার জন্যে তৈরি হলাম। অসুবিধে হবে না। কারণ, সুচরিতা চৌধুরীর গাড়িটা সঙ্গে রয়েছে। মিনিটদশেকের মধ্যেই তৈরি হয়ে গাড়িতে করে রওনা দিলাম। উদ্দেশ্য– কবুতর। কে জানে, হয়তো আরও কী রহস্য সেখানে আমার জন্যে ওত পেতে রয়েছে।
কবুতরে পৌঁছেই প্রথম যেটা চোখে পড়ল তা হল সারা বাড়ি জুড়ে একটা থমথমে ভাব। গেটের কাছে গাড়ি থামিয়ে সুরকি ঢালা পথ ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। বাড়ির কাছে পৌঁছোতেই কবুতরের একতলার বাঁদিকের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল সুচরিতা চৌধুরী। গাঢ় বেগুনি রঙের শাড়িতে কী সুন্দরই না দেখাচ্ছে!
কিছুক্ষণ বোধহয় হাঁ করে চেয়েছিলাম ওর দিকে। চমক ভাঙতেই জোর করে হাসার চেষ্টা করলাম।
কিন্তু সুচরিতার চোখের তারায় আশঙ্কার ছায়া কেঁপে উঠল। হরিণী-গতিতে ও এগিয়ে এল আমার কাছে। অস্ফুটভাবে বলল, আপনি এখানে। আপনার-আপনার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে।
একটু অবাক হলেও সে-ভাবটা মুখে প্রকাশ করলাম না। কবুতরের বাইরে এসে দুজনে উঠে বসলাম গাড়িতে। গাড়ি ছেড়ে দিলাম। লক্ষ্য, উদ্দেশ্যবিহীন।
কিছুদূর যাওয়ার পর আড়চোখে তাকালাম সুচরিতার দিকে। ওর চোখে সপ্রশ্ন দৃষ্টি দেখে অভয় দেওয়ার ভঙ্গিতে বললাম, ভয় নেই। ইব্রাহিমকে খুঁজে বের করতে পুলিশের অন্তত দিনদুয়েক লাগবে।
তারপর ওকে শুরু থেকে আমার কাহিনি শোনালাম–সব বললাম। শেষে জিগ্যেস করলাম, কিন্তু সুচরিতা, এদিকের খবর কী?
একথা বলেই হৃৎপিণ্ডে এক প্রচণ্ড ধাক্কা খেলাম। চোখ, মুখ, কান লাল হয়ে উঠল সর্বনাশ! ওকে নাম ধরে ডেকে ফেলেছি!
কিন্তু এ কী! সুচরিতা মাথা নীচু করে ছিল। আমার দিকে চোখ তুলে এক চিলতে হাসল। আমি সাহস করে বাঁ হাতটা ওর হাতের ওপর রাখলাম। বুঝলাম আমরা দুজনেই দুজনকে জানতে চাই।
এক হাতে স্টিয়ারিং ধরে গাড়ি চালাতে চালাতে বললাম, সুচরিতা, আমরা একটা কিছু করতে পারি না?
কী? আনন্দে, কৌতূহলে ওর মুখ ঝলমল করছিল।
না, মানে, এই যে সব রহস্য–সেগুলো সম্ভ করার চেষ্টা করলে ক্ষতি কী?
তা হলে তো দারুণ হবে। ছোট্ট মেয়ের মতো খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল সুচরিতা।
আমি ওকে গতরাতের সব কথা খুলে বললাম। ও চোখ বড় বড় করে শুনল।
আমি জিগ্যেস করলাম, আচ্ছা, দোতলার বাঁদিক থেকে তিন নম্বর জানলাটা কার ঘরের?
ওই ঘরেই কি আলো জ্বলতে দেখেছিলে তুমি?
মনে তো হয় তাই।
কিন্তু, তা হলে তো ঠিক মিলছে না। একটু চিন্তিতভাবেই জানাল সুচরিতা।
কেন? কেন?
ওই ঘরটায় মানেকজির এক দূরসম্পর্কের বোন থাকেন। তিনি তো বেশ কয়েকদিন হল আছেন। ওঁকে ঠিক এ-ব্যাপারে…।
মাঝপথে বাধা দিলাম আমি, বললাম, সূত্র যখন পাওয়া গেছে, তা যতই সামান্য হোক, তাই ধরেই এগোব আমরা। আমি ওই ভদ্রমহিলার সম্বন্ধে খোঁজখবর নিচ্ছি। ওঁর নাম কী?
নয়না কল্যাণী।
এবার তবে কবুতরে ফেরা যাক। বললাম আমি, কিন্তু আমার সঙ্গে কী অনেক কথা আছে। বলছিলে যেন? হঠাৎই মনে পড়ায় প্রশ্ন করলাম।
কুমার রণজিৎ গতকাল রাতে রিভলভারের গুলিতে মারা গেছেন।
কাগজে পড়েছি। তুমি তাকে দেখেছ নাকি?
না। তবে সিরাজনগরে তার সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল।
সঙ্গে-সঙ্গে একটা সম্ভাবনা বিদ্যুৎ ঝলকের মতো আমার মানসচক্ষে ধরা পড়ল। চকিতে ব্রেক কষে দাঁড় করালাম গাড়িটাকে। ব্যাক করে ঘুরিয়ে নিয়ে হাওয়ার বেগে আবার গাড়ি ছুটিয়ে দিলাম।
এ কী! কী হল? ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে উঠল সুচরিতা।
এখন আর কোনও প্রশ্ন নয়। এই মুহূর্তে আমাদের কবুতরে পৌঁছানো দরকার। দাঁতে দাঁত চেপে বললাম আমি, তোমার কবুতরে পৌঁছোনো বন্ধ করার চেষ্টা যারা করছিল তাদের উদ্দেশ্য আমি বোধহয় বুঝতে পেরেছি।
তার মানে! কৌতূহলের ঝাপটায় যেন তলিয়ে যাচ্ছে সুচরিতা।
এই কুমার রণজিৎ সম্ভবত তোমার পরিচিত কুমার রণজিৎ নন।
সুচরিতার মুখ থেকে শুধু একটা অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে এল। আমি বলে চললাম, যে এখানে কুমার রণজিৎ পরিচয়ে এসেছে, সে জানে যে, তোমার চোখকে ফাঁকি দেওয়া মুশকিল হবে। তাই কবুতরে তুমি যাতে না আসতে পারো সেই ব্যবস্থা করেছিল। হয়তো সমর বর্মনই এখানে কুমারের ছদ্মবেশে এসে শত্রুপক্ষের হাতে মারা গেছে।
কিন্তু সমর বর্মন এখানে আসবে কেন?
সুরেন্দ্র পালিত রানী সুলক্ষণার হীরের নেকলেস কবুতরেই লুকিয়ে রেখে গিয়েছিলেন। তার ম্যানাস্ক্রিপ্টেই এরকম হিন্টস ছিল। বর্মন সেই খবর পেয়ে হয়তো…।
কবুতরের বাইরে গাড়ি থামিয়ে সুচরিতার হাত ধরে টেনে নিয়ে চললাম। উত্তেজনায় তখন আমার আর মাথার ঠিক নেই। হাঁটতে হাঁটতে ওকে জিগ্যেস করলাম, পুলিশ কি এখনও কবুতরে রয়েছে?
কোনওরকমে ঘাড় কাত করে সম্মতি জানাল সুচরিতা।
কবুতরের একতলার দরজা দিয়ে দুজনে ঢুকলাম। ডানদিকেই লাইব্রেরি। সেই ঘরের দরজা পেরিয়ে ভেতরে পা দিলাম দুজনে। আর সঙ্গে-সঙ্গেই চমকে উঠলাম।
কাঞ্চনবাবু, প্লিজ, একটিবার পেছন ফিরে তাকান। একটিবার দেখুন শিগগিরই। ওই দেখুন, কালো পোশাক পরা একটি নোক আপনার রেখে যাওয়া গাড়ির পেছনের সিটের নীচ থেকে বেরিয়ে এল। গাড়ির দরজা বন্ধ করে একটু হাসল। ওই দেখুন, সে তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে দুরের বনানীতে। লোকটি কে বলুন তো! লোকটাকে যে আপনি চেনেন না সে কথা হলফ করে বলতে পারি। প্লিজ, আমার কথা এখনও শুনুন। কবুতরে কেন এলেন। ওই লোকটি প্রথম থেকেই পেছনের সিটের নীচে লুকিয়ে ছিল। কী সাঙ্ঘাতিক কান্ড বলুন তো!
আপনাকে তো প্রথমেই বলেছিলাম, প্লিজ কবুতরে আসবেন না।
লাইব্রেরিতে পা দিয়েই আমি চমকে উঠলাম। পুলিশের লোকজন ঘরময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। লাইব্রেরির র্যাকে সাজানো থরেথরে বই। মাঝখানে রাখা টেবিলটার নীচ দিয়ে দেখা যাচ্ছে তাকে। যে-লোকটি শূন্য দৃষ্টি মেলে চিৎ হয়ে সিলিংয়ের দিকে চেয়ে আছে সে আমার বিশেষ পরিচিত। মেহেতা অ্যান্ড সন্সের কর্মচারী, গজানন শিকদার।
সুচরিতা আমার কানে ফিসফিস করে বলল, হ্যাঁ, ইনিই কুমার রণজিৎ। আমি শিয়োর।
তা হলে কুমার রণজিৎই মারা গেছেন! শেষ পর্যন্ত কুমার রণজিৎ নিজেই গিয়ে ভঁওতা দিয়ে আমার কাছ থেকে সুরেন্দ্র পালিতের ম্যানাস্ক্রিপ্টটা হাতিয়েছিলেন! বিন্দুমাত্রও সন্দেহ নেই যে, কুমার নিজেই গজানন শিকদারের পরিচয় নিয়ে আমার কাছে গিয়েছিলেন। তার মানে মেহেতা অ্যান্ড সন্স থেকে যে-ফোন এসেছিল, সেটা ভঁওতা দিয়ে কুমার রণজিতই করেছিলেন।
যাকগে, ওই ম্যানাস্ক্রিপ্টটার জন্যে হা-হুঁতাশ করে কোনও লাভ নেই। সুচরিতার গা টিপে ফিসফিস করে বললাম, সু, চলো আমরা যাই।
ঘুরে দাঁড়িয়ে ঘর থেকে বেরোতে যেতেই একটা হাত আমার কাঁধের ওপর এসে পড়ল।
চমকে পেছন ফিরে তাকালাম আমি। চোখে পড়ল কাঠে খোদাই করা ভাবলেশহীন একটা বলিষ্ঠ চেহারা। একটু মৃদু হাসি ঠোঁটের রেখায় টেনে তিনি বললেন, মিস্টার…প্লিজ টেক ইওর সিট, বলে লাইব্রেরি-ঘরের চেয়ারটা দেখিয়ে দিলেন।
আমি সুচরিতার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে চেয়ারে গিয়ে বসলাম।
তারপর সপ্রশ্ন দৃষ্টি নিয়ে চোখ তুলে তাকাতেই তিনি বললেন, আ অ্যাম নোন টু এভরিবডি বাই দ্য নেম ক্রসওয়ার্ড। যদিও আমার নাম ওয়াডি ক্রসবি।
কাঞ্চন মৈত্র–। বলে কাঁধ ঝাঁকিয়ে প্রশ্ন করলাম, বলুন, আমি আপনাদের কী কাজে লাগতে পারি? ইন্সপেক্টরকে বাঙালি ক্রিশ্চান বলে মনে হল।
আমি এখানকার থানার পুলিশ ইন্সপেক্টর, মুখ খুললেন ক্রসওয়ার্ড, কুমার রণজিতের মিস্টিরিয়াস ডেথের ব্যাপারটা ইনভেস্টিগেট করার ভার আমার ওপর পড়েছে। আপনাকে আমি ঠিক চিনতে পারছি না। আর তা ছাড়া আপনি ঘরে ঢুকেই কুমারের ডেডবডিটা দেখে যেভাবে চোখ কপালে তুললেন…। কথা অসম্পূর্ণ রেখে চোখ নাচালেন ক্রসওয়ার্ড।
এরপর মুখ না খুলে চুপ করে থাকা হবে স্রেফ বোকামি। তাই একটুও সময় নষ্ট না করে বললাম, ইন্সপেক্টর, আমি সুচরিতার বন্ধু। ওয়েল উইশার বলতে পারেন। কুমারের মারা যাওয়ার খবর আমি কাগজেই পড়েছি, কিন্তু তাঁর ডেডবডি দেখে আমার অবাক হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে…।
তারপর প্রথম থেকে শুরু করে সব খুলে জানালাম তাঁকে। অবশ্য ইব্রাহিমের ব্যাপারটা বাদ। দিলাম।
সব শোনার পর কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন ইন্সপেক্টর। তারপর বললেন, মিস্টার মৈত্র, এবার কাজের কথায় আসা যাক। কাল রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ গাড়ির ইঞ্জিনের আওয়াজ শোনা গেছে। কবুতরের সবাইকেই আমরা প্রশ্ন করেছি, কেউ কিছু বলতে পারেননি। তাই আমরা কবুতরের চারিদিকে খোঁজ নিয়ে জেনেছি যে, একজন লোককে একটা গাড়ি চালিয়ে বারোটা সোয়া বারোটা নাগাদ কবুতরের দিকে যেতে দেখা গেছে। আপনাকে দেখে আমিও কম অবাক হইনি। কারণ, আপনার সঙ্গে সেই অপরিচিত লোকটির ডেসক্রিপশন প্রায় মিলে যাচ্ছে…।
কী…। ইন্সপেক্টরকে বাধা দিয়ে বলতে গেলাম আমি। কিন্তু ক্রসওয়ার্ড বাধা দেওয়ায় আমার চাইতেও বেশি এক্সপার্ট। তিনি চটপট বলতে শুরু করলেন, সেটাই সব নয়। আমরা কবুতরের সুরকি ঢালা পথে একসারি জুতোর ছাপ পেয়েছি। ছাপগুলোর মধ্যে দূরত্ব বেশি এবং তাদের ডেস্থ দেখে আমরা আন্দাজ করছি যে, গত রাতে যেই এসে থাকুক না কেন, সে দৌড়েছিল। কবুতরের প্রত্যেকের জুতোর ছাপ আমরা নিয়েছি। আমার মুখের দিকে চেয়ে হাসলেন ক্রসওয়ার্ড, হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। কারও সঙ্গে সেই ছাপ মেলেনি। এখন আপনার জুতোর সঙ্গে যদি এই ছাপটা না মেলে তবে আমাদের আরও ভালো করে প্রোব করে দেখতে হবে…। একটু থেমে দম নিলেন ক্রসওয়ার্ড।
আমি মাথা ঝুঁকিয়ে বললাম, লুক হিয়ার, ইন্সপেক্টর। শুধু-শুধু আপনাদের পরিশ্রম আর খরচ বাড়িয়ে লাভ নেই। আমিই সেই রাতের আগন্তুক। আমিই এসেছিলাম কবুতরে।
ইন্সপেক্টর অবাক-টবাক কিছুই হলেন না। অল্প-অল্প হাসতে লাগলেন।
অত্যন্ত বিরক্ত হলেও বিরক্তি চেপে বললাম, মিস্টার ক্রসওয়ার্ড, ইফ ইউ ওয়ান্ট মাই কো অপ দেন প্লিজ স্টপ লাফিং। তারপর কাল রাতে যা-যা হয়েছিল সব খুলে বললাম।
ইব্রাহিমের পকেট থেকে পাওয়া সেই চিরকুটটার কথা চেপে গিয়ে বললাম, আমি সন্দেহ করেছিলাম যে, কবুতরে একটা কিছু ঘটতে চলেছে। তাই শখের গোয়েন্দাগিরির নেশাতেই কবুতরের ওপর লক্ষ রাখতে গত রাতে এসেছিলাম।
জানি না আমার ব্যাখ্যাটা কতটা জোরদার হল। কিন্তু ইন্সপেক্টরের মুখ দেখে মনে হল তিনি আমার কথা মোটামুটি বিশ্বাস করেছেন।
হঠাৎই মুখ তুলে বললেন তিনি, মিস্টার মৈত্র, একটা প্রশ্ন করব–ভালো করে ভেবে উত্তর দিন।
আমি সপ্রশ্ন দৃষ্টি নিয়ে তাকালাম তার দিকে।
আপনি কি শিয়োর যে, জানলাটা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল?
হ্যাঁ, দৃঢ়স্বরে জবাব দিলাম আমি, আমি গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে ওটা টানাটানি করেছিলাম। কিন্তু নড়াতেই পারিনি। বলতে বলতে আমি লাইব্রেরির তিনটে জানলার মধ্যে বাঁদিকেরটা দেখিয়ে বললাম, ওই তো, ওই জানলাটা।
কিন্তু এইখানেই একটা মুশকিল দেখা দিয়েছে, কাঞ্চনবাবু। আজ যখন আমরা এই ঘরে আসি তখন শুধু একটা জানলা খোলা ছিল এবং ওই জানলাটাই।
আশ্চর্য, বললাম আমি, তা হলে নিশ্চয়ই যে খুন করেছে, সে এটাই বোঝাতে চেয়েছে যে, খুনি বাইরের লোক। জানলা দিয়ে এসে খুন করে আবার জানলা দিয়েই চলে গেছে।
ঠিকই ধরেছেন আপনি, বললেন ইন্সপেক্টর, কিন্তু জানলায় আপনার ছাড়া আর কারও হাতের ছাপ পাওয়া যায়নি। তবে আপনার হাতের ছাপগুলো আপনার কথামতো শুধু বাইরের দিকেই ছিল।
আমি চেয়ারে একটু নড়েচড়ে বসলাম, বললাম, মার্ডার ওয়েপনটা পেয়েছেন?
নাঃ, জানালেন ইন্সপেক্টর, সারা বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজেও আমার লোকেরা রিভলভারটা বের করতে পারেনি। তবে আশা করি দিনকয়েকের মধ্যেই খুঁজে পাব। আচ্ছা, নমস্কার–আপনি এখন যেতে পারেন। পরে যদি দরকার হয় আপনার সঙ্গে কথা বলবখন।
কোনওরকমে নমস্কার জানিয়ে শ্লথ পায়ে দরজার দিকে এগোলাম।
সুচরিতা এতক্ষণ চুপ করে বসেছিল। আমার পেছন-পেছন সেও বেরিয়ে এল বাইরে।
বাইরে এসে আমি বললাম, সুচরিতা, কবুতরে যারা রয়েছেন তাদের নামের একটা লিস্ট আমাকে দাও।
সুচরিতা বলল, মানেকজি, প্রসাদজি, তরুণ সান্যাল–মানেকজির সেক্রেটারি। শ্রীনরসিংহ চৌধুরী আর কিরণ শর্মা। এঁরা হলেন লয়ালিস্টদের তরফের। কিরণ শর্মা কুমার রণজিৎকে ফাইনান্স করতে রাজি ছিলেন। নয়না কল্যাণী এবং সর্বেশ্বর রায়–তেলের ব্যাপারটায় এঁর স্বার্থ ছিল। এঁরা ছাড়া কুমারের একজন নেপালি চাকর আর কবুতরের কাজের লোকজন।
আমার মনে নামগুলো গেঁথে গেল। বললাম, সাতকাণ্ড রামায়ণ পড়া শুরু করব এবার। প্রথম কাণ্ড হলেন নয়না কল্যাণী।
আমার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। গজানন শিকদার আর কুমার রণজিৎ এক ও অভিন্ন। অবিশ্বাস্য মনে হলেও কথাটা সত্যি!
কাঞ্চনবাবু, এই যে,…আপনি কিন্তু একজনকে বিশেষভাবে বাদ দিয়ে গেছেন। সুচরিতাদেবীকে আপনি ভালোবাসেন–তাই ওঁকে বাদ দেওয়ার যুক্তি থাকতে পারে– চাকরবাকরদের মোটিভ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এসব মানলাম। কিন্তু ওই লোকটিকে আপনি বাদ দিলেন কী বলে? আরে, ওই লোকটা, যে কালো পোশাক পরে গাড়ির সিটরে নীচে লুকিয়ে আপনাদের কথা শুনছিল। দেখুন না, ওই দেখুন– সে এখনও দাঁড়িয়ে আছে কবুতরের সদর গেটের কাছে। হাঁ করে তাকিয়ে আছে আপনার দিকে। হাতে সিগারেট। দেখুন না, কাঞ্চনবাবু, প্লিজ এদিকে তাকান না একবার!
কবুতর থেকে শপাঁচেক গজ দূরে গাছ-গাছড়ার একটা জঙ্গলের মতো রয়েছে। বনই বলা যেতে পারে সেটাকে। এবড়ো-খেবড়ো জমি। বড়-বড় বট, অশথ, দেবদারু ইত্যাদি গাছ জায়গাটাকে ছেয়ে ফেলেছে। সেইখানে পা ফেলে হেঁটে যাচ্ছিলাম আমি আর সুচরিতা।
আমি এখন কবুতরের অতিথি। আমিই যে অশোক বোস নাম নিয়ে ভাগ্যচক্রে পাণ্ডুলিপির জালে জড়িয়ে পড়েছিলাম সেটা প্রসাদজিকে খুলে বলেছি। এখন ব্যাপারগুলোর একটা ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত কবুতরেই থাকব আমি।
বিকেলের সোনা-রোদ যেন অনেক কষ্ট করে লুকোচুরি খেলে গাছের আড়াল দিয়ে এসে পড়েছে আমাদের গায়ে। মাঝে-মাঝে ঠান্ডা হাওয়ায় একটা আদর টের পাচ্ছিলাম। পাশাপাশি হেঁটে যেতে কী ভালো যে লাগছিল! মনে হচ্ছিল, যদি এই পথ আর না ফুরোয়…।
হাতে হাত ধরে ঝরাপাতার পথ মাড়িয়ে এগিয়ে যেতে-যেতে তাকালাম সুচরিতার দিকে। সুচরিতাও আমারই দিকে চেয়ে ছিল। চোখাচোখি হতেই ফিক করে হেসে ফেলল। আমি একটু বোকা বোকা হাসি হেসে বললাম, সুচরিতা, সত্যিই আমি কোনওদিন ভাবিনি যে, এমনিভাবে তোমার সঙ্গে– সুচরিতার চোখে কপট রাগ দেখে চটপট বলে ফেললাম, তোমার সঙ্গে ভাগ্য এমন চাতুরী করবে। সত্যি, কী বিপদেই না জড়িয়ে পড়েছ!
থাক, আর কথার জাল পাততে হবে না, হেসে বলল সুচরিতা, এবার কাজের কথায় আসা যাক।
হ্যাঁ, গলার স্বর গম্ভীর করে শুরু করলাম, নয়না কল্যাণী সম্পর্কে তুমি কী জানেনা, তাই খুলে বলো।
কিছুই না। ওঁকে আমি চোখে দেখিনি কোনওদিন, ঠোঁট বেঁকিয়ে জবাব দিল ও, শুনেছি গতবছর পর্যন্ত নাকি সাইরেন ইন্টারন্যাশনাল হোটেলে রিসেপশনিস্টের কাজ করতেন। তারপর মানেকজি ওঁকে কবুতরে ডেকে পাঠান। মানেকজির ইচ্ছে, নয়না কল্যাণী তাঁর সঙ্গেই রাজনীতি নিয়ে থাকুক।
তিনি কবুতরে কতদিন হল এসেছেন?
গতকাল সকালে। কিন্তু ওঁকে তুমি সন্দেহ করছ কেন?
না। সন্দেহ আমি প্রত্যেককেই করছি। কিন্তু ভাবছি যে, রণজিৎ সেনকে খুন করে নয়না কল্যাণীর কী লাভ? হঠাৎই ঘুরে দাঁড়িয়ে বললাম, সু, চলো ফেরা যাক।
ঘুরে দাঁড়াতেই আমার চোখ পড়ল একজন ছায়া-ছায়া মানুষের দিকে। আমাদের ঘুরে দাঁড়াতে দেখেই সে দৌড়োতে শুরু করল। দিনের আলোয় উজ্জ্বল আকাশের পটভূমিতেও তাকে চেনা গেল না। তবু আমি ছুটলাম।
সুচরিতা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে যত তাড়াতাড়ি পারে আমাকে অনুসরণ করে আসতে লাগল।
দৌড়োতে-দৌড়োতে বনের বাইরে চলে এলাম। কিন্তু কই, কেউ তো কোথাও নেই! হতাশ হয়ে হাঁফাতে-হাঁফাতে বললাম, সুচরিতা, এই লোকটা কোন দলের, সমর বর্মন, না লালপাঞ্জা?
উত্তরে ঠোঁট উলটে হাসল সুচরিতা।
দুজনে আবার কবুতরে ফিরে এলাম। বাড়িতে ঢুকতে যেতেই একটা ব্যাপার দেখে চমকে উঠলাম। বাঁদিক থেকে তৃতীয়? নাঃ, এ তো চার নম্বর জানলাটা দেখা যাচ্ছে। ডানদিকে আরও দু-চার পা এদিক-ওদিক সরলেই তিনটে জানলা থেকে চারটে হয়ে যাচ্ছে। কারণ, দ্বিতীয় সারির ঘরগুলোর একটা জানলা প্রথম সারির ঘরগুলোর সঙ্গে দেখা যাচ্ছে। যাকগে, কুছ পরোয়া নেই।
সুচরিতার দিকে ঘুরে প্রশ্ন করলাম, সু, ওই জানলাটা কার ঘরের?
কেন বলো তো! ওটা কিরণ শর্মার।
কিরণ শর্মার? ঈষৎ ভাঁজ পড়ল আমার কপালে, তা হলে, আমার লিস্টে দ্বিতীয় ব্যক্তি শ্ৰীযুক্ত কিরণ শর্মা। দৃঢ়স্বরে বললাম আমি।
আবার পা বাড়ালাম কবুতর লক্ষ্য করে।
ভেতরে গিয়ে দেখা হল মানেকজির সঙ্গে। তিনি ক্রসওয়ার্ডের সঙ্গে কথাবার্তা বলছিলেন। আমাকে দেখেই বললেন, আসুন, আসুন–
আমি মৃদু হেসে তার পাশে গিয়ে বসলাম। সুচরিতাও আমার পাশে বসল।
মিস্টার মৈত্র, আমাকে লক্ষ্য করে বললেন মানেকজি, আপনার জন্যে দোতলার যে-ঘরটা ঠিক করে দিয়েছি, সেটা আপনার পছন্দ হয়েছে?
আজ্ঞে হ্যাঁ। ধন্যবাদ।
এইবার ক্রসওয়ার্ডের দিকে ফিরলেন মানেকজি। বললেন, ওয়াডি, এ তো ভীষণ বিশ্রী ব্যাপার ঘটে গেল। মানেকজির স্বচ্ছন্দ বাংলা শুনে অবাকই হলাম।
কুমার রণজিৎ এখানে সাঙ্ঘাতিক জরুরি একটা কনফারেন্সে এসেছিলেন, মানেকজি বলে চললেন, মিটিং তো হলই না, তার ওপর এই স্ক্যান্ডালাস ব্যাপার। কে, কেন, কুমার রণজিৎকে খুন করল আমি ভেবেই পাচ্ছি না, ক্রসবি। পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালে, মুখে একবার বুলিয়ে নিলেন মানেকজি।
দেখুন, আমি চেষ্টায় কোনওই ফাঁক রাখব না। আমতা-আমতা করে বললেন ক্রসওয়ার্ড, কিন্তু এটা আমি বুঝতে পারছি না যে, আপনারা গুলির শব্দ পেলেন না কেন? অথচ মিস্টার মৈত্র বারোটা পঁয়তাল্লিশের সময় গুলির শব্দ পেয়েছেন।
একটা সম্ভাবনার কথা মনে হওয়ায় আমি বললাম, ইন্সপেক্টর, হয়তো মার্ডারার কোনও কেমিক্যাল দিয়ে রাতে সবাইকে ড্রাগ করেছিল।
হতে পারে, বললেন ক্রসওয়ার্ড, আমি এবার বাড়ির সবাইকে ডেকে একটা রিকোয়েস্ট করতে চাই। তা হল, কেউ যেন আপাতত, অন্তত দিনসাতেকের জন্যে, কবুতর ছেড়ে কোথাও না যান।
ঠিক আছে, আমি সবাইকে জানিয়ে দিচ্ছি কথাটা। মনে হয় কেউ এতে অরাজি হবেন না। বলে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন মানেকজি। বললেন, ওয়াডি, যেমন করে হোক এই পলিটিক্যাল স্ক্যান্ডালের শেষ চাই আমি। কারণ, ভুরু তুলে তাকালেন মানেকজি ও ..এর সঙ্গে আমার আর প্রসাদজির মানসম্মান জড়িয়ে আছে। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন মানেকজি।
মানেকজি চলে যাওয়ার পর আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, ইন্সপেক্টর, আমি আজ কবুতর ছেড়ে যেতে চাই। কথা দিচ্ছি, কাল বিকেলের মধ্যেই ফিরে আসব।
ক্রসওয়ার্ড হাসলেন : যাবেন যান। কিন্তু মাইন্ড ওয়ান থিং–আমাদের যেন বডি ওয়ারেন্ট বের করতে না হয়।
উত্তরে আমি স্যালুট করার ভঙ্গি করে সুচরিতার হাত ধরে বললাম, এসো, সুচরিতা।
বাইরে এসে বললাম, সু, আমি এখন সাইরেন ইন্টারন্যাশনালে যাব। নয়না কল্যাণী সম্পর্কে খোঁজ নিতে। কাল আবার দেখা হবে। তুমি কিরণ শর্মার ওপর নজর রেখ। আমার জন্যে ভেব না। আর হ্যাঁ–তোমার গাড়িটা আমি নিয়ে যাচ্ছি।
আর দেরি না করে সুচরিতার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়ি চড়ে রওনা দিলাম। উদ্দেশ্য, সাইরেন ইন্টারন্যাশনাল।
গাড়িতে যেতে-যেতে ভাবছিলাম। আলোটা জ্বলেছিল কার ঘরে? কিরণ শর্মা না নয়না কল্যাণী? কী করছিলেন তিনি ওই সময়? গুলির শব্দ শুনে কি ঘুম ভেঙেছিল ওঁর? কিন্তু আর কারও ঘুম ভাঙল না কেন? আর নয়না কল্যাণীর যদি কোনও গোপন ব্যাপার থাকে, তবে আমি নিশ্চিত যে, সাইরেন ইন্টারন্যাশনালে গিয়ে শুনব নয়না কল্যাণী নামে কেউই ওখানে কাজ করত না। দেখা যাক, কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়!
.
শেষ পর্যন্ত সাইরেন ইন্টারন্যাশনালে।
রিসেপশনের ঘুমে ঢুলে পড়া হ্যাংলা মেয়েটিকে বললাম, ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করতে চাই।
একটু পরেই একটি লোক এসে আমাকে নিয়ে গেল ম্যানেজারের ঘরে। ঘরের দরজায় লেখা প্রাইভেট।
দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম।
চেয়ারে বসে একজন প্রৌঢ়। মাথাজোড়া টাক। পাইপ টানছেন। তাকে বললাম, আমি নয়না নামে একটি মেয়ের খোঁজ জানতে এসেছি। সে আপনার হোটেলে কাজ করত।
হ্যাঁ, রিসেন্টলি ও চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে যায়। কোথায় ওর এক কীরকম ভাই না কে থাকে, তার কাছে যাবে বলছিল।
জবাব শুনে একেবারেই দমে গেলাম আমি। এরকমটা ঠিক আশা করিনি। তা হলে কি কিরণ শর্মা…?
থ্যাংক ইউ, ম্যানেজারসাহেব, বলে নড় করে বেরিয়ে এলাম আমি। তার মানে নয়না কল্যাণী মানেকজির সত্যিকারের রিলেটিভ!
হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে এসে গাড়ি স্টার্ট করলাম। সুচরিতাকে সব খুলে বলতে হবে। একবার ভালো করে আলোচনা করা দরকার। ঘড়ি দেখলাম, রাত তিনটে।
কবুতরে পৌঁছেই দেখি সুচরিতা গেটের বাইরে উৎকণ্ঠিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ি থামিয়ে বাইরে বেরোতেই দৌড়ে এল ও। বলল, কাঞ্চন, সর্বনাশ হয়েছে! বলে ও আমাকে হাত ধরে নিরিবিলি গাছ-গাছালির দিকটায় টেনে নিয়ে চলল। ভোরের হালকা আলো তখন ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীতে।
কিছুদূর গিয়ে আমি বললাম, কী হয়েছে?
হাঁফাতে-হাঁফাতে বলতে শুরু করল সুচরিতা, ইব্রাহিমকে খুঁজে পেয়েছে ওরা!
তাই নাকি? মুখে একথা বললেও মনে-মনে রেলগাড়ি ছুটিয়ে চিন্তা করছিলাম, এরপর কী করা উচিত।
হ্যাঁ, ইন্সপেক্টর ক্রসবি খোঁজ করেছিলেন যে, তুমি এসেছ কি না, বলে চলল সুচরিতা, আর কিরণ শর্মাকে দেখলাম লাইব্রেরি-ঘরের বইপত্তর ঘেঁটে-ঘেঁটে দেখছেন। আমি ঢুকতেই মৃদু কাষ্ঠহাসি হেসে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
হঠাৎ যেন সংবিৎ ফিরে পেল সুচরিতা, বলল, ওহ্ হো, আমি তো জিগ্যেস করতেই ভুলে গেছি। ওদিকের খবর কী?
বিষণ্ণ হাসি হেসে বললাম, শিকে ছেড়েনি। একদম বাজে খবর। নয়না কল্যাণী সত্যি কথাই বলেছেন, সাইরেনেই কাজ করতেন উনি। এখন আমার মনে হচ্ছে যে, সে-রাতে আলো বোধহয় কিরণ শর্মার ঘরে জ্বলছিল। কথা বলতে বলতেই একটা দেবদারু গাছের দিকে চোখ গেল আমার। তখনই দেখলাম গাছের গুঁড়ির ওদিক থেকে কারও জামার একটা অংশ দেখা যাচ্ছে। নিশ্চয়ই সেই লোকটা।
পা টিপে টিপে এগোলাম। সুচরিতা কিছুই বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে তাকাল আমার দিকে। আমি মুখে আঙুল তুলে ওকে ইশারায় জানালাম চুপ করে থাকতে। তারপর গিয়ে আচমকা গাছের ওপিঠে হাজির হলাম।
গাছের আড়ালে যে লোকটি নির্বিকার মুখে দাঁড়িয়েছিল, সে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। হাসবার চেষ্টা করল।
আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারছি না, ঠান্ডা স্বরে বললাম আমি, দয়া করে নিজের পরিচয়টা যদি দেন…।
আমি–আমি এখানে নতুন এসেছি, কর্কশ স্বরে থেমে-থেমে সে বলল, ঠিক বুঝতে পারছি না কোন দিকে পড়বে বাড়িটা…।
আমি সুচরিতার দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকালাম। তারপর লোকটিকে উদ্দেশ্য করে বললাম, আসুন আমার সঙ্গে। কোথায় বাড়ি আপনার?
কিছুক্ষণ চুপ করে রইল লোকটি। তারপর বলল, ওই দিকটায়– বলে একটা দিক দেখাল সে।
আমি তার এই এলোমেলো কথায় ক্রমশ অবাক হচ্ছিলাম। হয়তো কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু হঠাৎ লোকটি থ্যাংক ইউ অ্যান্ড গুড বাই বলে হনহন করে হেঁটে অদৃশ্য হয়ে গেল।
ঠিক তখনই আমার মাথায় এল ব্যাপারটা। এই লোকটাই সেই লোকটা নয় তো! নিশ্চয়ই, কোনও সন্দেহই নেই! লোকটার চেহারা মনে করার চেষ্টা করলাম। চোখে সবুজ সানগ্লাস, ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, সরু গোঁফ, কপালে বলিরেখা।
চিন্তার জাল ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে আবার হাঁটতে শুরু করলাম, কবুতরের দিকে।
সুচরিতাকে বললাম, সু, আজ রাতে আমি বোধহয় কবুতরে থাকতে পারব না।
কেন, কেন? অত্যন্ত ব্যগ্র হয়ে উঠল সুচরিতা।
আমি হাসলাম। সুচরিতা এতই চঞ্চল হয়ে উঠল যে, হাসি চাপতে পারলাম না।
কেন, আবার হাসির কী হল? অবাক হয়ে বলল সুচরিতা।
কিছু না। আমি একবার হোটেল কন্টিনেন্টালে যাব। খোঁজ নেব যে, ইব্রাহিমের সঙ্গে কেউ ওখানে দেখা করতে যেত কি না…।
ও, তা বেশ তো। গম্ভীর গলায় বলল সুচরিতা।
প্লিজ সু, বোঝার চেষ্টা করো। কোনও ভয় নেই। আজ রাতে আর কোনও বিপজ্জনক ঘটনা ঘটবে না–তুমি শুধু-শুধু চিন্তা করছ। তা ছাড়া ইব্রাহিমের ব্যাপারটার একটা খোঁজ নেওয়া দরকার।
একটু থেমে সুচরিতা বলল, কাল কখন ফিরবে?
সকালেই। জোর দিয়ে বললাম আমি।
কবুতরের বাইরের গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আমরা কথা বলছিলাম। সুচরিতা কবুতরের বিপরীত দিকে মুখ করে দাঁড়িয়েছিল, তাই আমিই লক্ষ করলাম ব্যাপারটা।
দেখলাম, কিরণ শর্মা উত্তেজিতভাবে ক্রসওয়ার্ডকে কী যেন বোঝাচ্ছেন, আর ক্রসওয়ার্ড চিন্তিত মুখে মাথা নাড়ছেন।
একটু পরে ক্রসওয়ার্ড একাই এগিয়ে এলেন আমাদের দিকে, বললেন, মিস্টার মৈত্র, আমি আপনার সঙ্গে একটু গোপনে আলোচনা করতে চাই।
সঙ্গে-সঙ্গে সুচরিতার মুখ বিবর্ণ হয়ে উঠল।
আমি ওর দিকে ফিরে হেসে অভয় দিলাম, বললাম, কোনও ভয় নেই, সু, তুমি যাও।
অনিচ্ছাসত্ত্বেও চলে গেল ও।
মিস্টার মৈত্র, ক্রসওয়ার্ডের কাঠ-খোদাই মুখে কোনও অভিব্যক্তি লক্ষ করা গেল না, আমরা একটা ডেডবডি পেয়েছি। তার পরিচয়ও আমরা জেনেছি। হোটেল কন্টিনেন্টালের বেয়ারা ছিল সে। হোটেলের ম্যানেজারও আমাদের আপনার সেই চিঠি চুরি করার কথা বলেছে। সবই ঠিক আছে, শুধু একটা ব্যাপারে একটু খটকা দেখা দিয়েছে। যেখানে বডিটা পাওয়া গেছে, সেখানকার জনাদুয়েক লোক বলেছে যে, সে-রাতে তারা নাকি ভারি অদ্ভুত একটা ব্যাপার লক্ষ করেছিল। ওরা ড্রিঙ্ক করে ফিরছিল বলে প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেনি…ভেবেছে দেখার ভুল। অর্থপূর্ণভাবে কথা শেষ করলেন ইন্সপেক্টর।
কী, কী দেখেছিল ওরা? আমি জানতে চাইলাম।
আপনাকে একটা গাছ থেকে নামতে দেখেছিল। আমি ওদের আপনার ফটো দেখাতেই ওরা আইডেন্টিফাই করেছে। এরপর সেই গাছে উঠে আমরা এটা পেয়েছি। বলে পকেট থেকে ব্রাউন পেপারে মোড়া ছুরিটা বের করলেন তিনি।
এরপর চুপ করে থাকার মানে হয় না। তাই সব খুলে বললাম ওঁকে। মৃতদেহ গুম করার কারণটাও খুলে বললাম। জানি না তিনি বিশ্বাস করলেন কি না। আমার বলা শেষ হলে ক্রসওয়ার্ড শুধু মুখ দিয়ে একটা শব্দ করলেন, হু–।
তারপর একটু থেমে দ্বিধাগ্রস্তভাবে আমি বললাম, ইন্সপেক্টর, আমাকে আজ রাতে একটা জায়গায় যেতে হবে। কাল দুপুরের মধ্যেই ফিরে আসব।
যাবেন যান, কিন্তু একটা কথা জেনে রাখুন, দিল্লি পুলিশের ডিকশনারিতে ইমপসিব বলে কোনও শব্দ নেই– বলে হনহন করে এগিয়ে গেলেন ক্রসওয়ার্ড।
ওঁর দিকে তাকিয়ে নিজের মনেই বললাম, মিস্টার ক্রসওয়ার্ড, তুমি যদি জানতে, আমি কে, তবে–।
কাঞ্চনবাবু, সুচরিতা চৌধুরী কিন্তু কবুতরে থেকে গেলেন। আপনি তো যাওয়ার আগে বললেন, আজ রাতে কবুতরে আর কিছু হবে না। কিন্তু শুনুন– হা আজ রাতেই একটা ব্যাপার হবে। সম্ভবত মাঝরাতে– সুচরিতাদেবী বিপদে পড়তে পারেন। তবু আপনি যাবেন? থেকে গেলে পারতেন কিন্তু। যাকগে, নিয়তিকে তো আর কেউ রুখতে পারে না! ভীষণ কান্ড হবে একটা সত্যি বলছি সাঙ্ঘাতিক কিছু একটা হবে!
এ রহস্যের শেষ কোথায়? নিজের ঘরে শুয়ে-শুয়ে এ কথা ভাবছিল সুচরিতা। রাত প্রায় দেড়টা। আশ্চর্য! কুমার রণজিৎ খুন হওয়ার রাতে গুলির শব্দ কেউ শুনল না কেন! তবে কি রাতে ওরা যে-ড্রিঙ্কস নিয়েছিল তাতেই কোনও স্লিপিং ড্রাগ মেশানো ছিল। কিন্তু কে মেশাল! হঠাৎ…।
ঠিক সেই মুহূর্তে সুচরিতার কোষে-কোষে যেন বিদ্যুৎ প্রবাহিত হল। পায়ের শব্দ না! অন্ধকারেই বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল ও। কোনদিক থেকে শব্দটা আসছে ঠাহর করতে পারল না। তাড়াতাড়ি পা টিপে টিপে ঘর ছেড়ে করিডরে বেরিয়ে এল। করিডর নিঝুম নিস্তব্ধ। কেউ কোথাও নেই।
আবার শব্দ হল একটা। নিশ্চয়ই নীচের লাইব্রেরি-ঘরে। কেউ তা হলে আছে নাকি ওখানে?
পা টিপে টিপে সিঁড়ি দিয়ে নেমে লাইব্রেরির সামনে এসে দাঁড়াল সুচরিতা। ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। এগিয়ে এসে চাবির ফুটোয় চোখ রাখল। এ কী!
লাইব্রেরি-ঘরের গভীর অন্ধকারে শুধু একটা টর্চলাইটের আলো ঘুরে-ফিরে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ পাশ থেকে কেউ একজন সরে দাঁড়ানোয় চাবির ফুটো দিয়ে আর কিছু দেখা গেল না।
তবে কি লাইব্রেরি-ঘরে চোর ঢুকেছে? কিন্তু ওর পক্ষে তো একা কিছু করা সম্ভব নয়। চিন্তা করে দেখা গেল সাহায্য করার মতো একজনই আছে কবুতরে। সে তরুণ সান্যাল।
অতএব সিঁড়ি দিয়ে উঠে তরুণের ঘরের কাছে এসে দরজায় টোকা দিল সুচরিতা।
তরুণ–।
একটু পরে ঘুম চোখে এসে দরজা খুলল তরুণ সান্যাল। চেঁচিয়ে কী বলতে যাচ্ছিল। ওর মুখে হাত চাপা দিয়ে সুচরিতা বলে উঠল, শ স্। চুপ! নীচের লাইব্রেরিতে মনে হয় চোর ঢুকেছে।
কী! চোর! তরুণের ঘুমের ঘোর তখনও কাটেনি।
আস্তে, ফিসফিস করে বলল সুচরিতা, তুমি রেডি হয়ে নাও–আমরা দুজনে ঢুকব ও-ঘরে।
দাঁড়াও। বলে ঘরের কোনা থেকে একপাটি লোহার নাল লাগানো জুতো তুলে নিল তরুণ। বলল, চলো, এই জুতোর এক ঘা খেলে চোরবাবাজিকে আর উঠে দাঁড়াতে হবে না।
নিঃসাড়ে চুপিচুপি ওরা দুজনে এসে দাঁড়াল লাইব্রেরির সামনে।
ভেতরে কজন আছে? ফিসফিস করে জিগ্যেস করল তরুণ।
কে জানে! বোধহয় দু-তিনজন! অবহেলাভরে মৃদুকণ্ঠে জবাব দিল সুচরিতা।
আমি ঘরে ঢোকার সঙ্গে-সঙ্গে তুমি ভেতরে ঢুকে আলোর সুইচটা অন করে দেবে। বলে জুতোটাকে বাগিয়ে ধরে এক ঝটকায় দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল তরুণ।
ভেতরে টর্চের আলো তখনও দেওয়ালের গায়ে ঘুরছিল। দরজা খোলার শব্দে টর্চধারী লোকটি সচকিত হওয়ার আগেই তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল তরুণ। ওদের দুজনের ঝাঁপটিতে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সুচরিতা–ওই অন্ধকারেই। ঠিক ওই সময়ই কে যেন মনে হল ওর পাশ কাটিয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল। আর কিছু ভাববার আগেই তরুণের চিৎকার ভেসে এল : সুচরিতা, আলোটা জ্বালাও শিগগিরই
সুচরিতা সুইচের দিকে পা বাড়াতেই দেখা গেল একটি ছায়ামূর্তি এক ছুটে লাইব্রেরির খোলা ফ্রেঞ্চ উইন্ডো দিয়ে লাফিয়ে সুরকি ঢালা রাস্তা দিয়ে দৌড়ে পালাল।
এই দেখে আর আলো না জ্বালিয়ে লোকটির পিছন পিছন ধাওয়া করে বাইরে বেরিয়ে এল সুচরিতা।
দৌড়ে যখন ও কবুতরের গেটে পৌঁছেছে, ঠিক সেই সময় ওর সঙ্গে একজনের ধাক্কা লাগল।
লোকটি পালিয়েছে। গম্ভীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল কারও।
চোখ তুলে তাকাল সুচরিতা। ওর সামনে টেরিন-টি-শার্ট আর ফুলপ্যান্ট পরে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন তিনি শ্রীকিরণ শর্মা।
দারুণ অবাক হয়ে গেল সুচরিতা। এই রাতেও টিপটপ ড্রেস পরে দাঁড়িয়ে আছেন শর্মাসাহেব!
লোকটি পালিয়েছে, মিসেস চৌধুরী, আর ফলো করে লাভ নেই। দ্বিতীয়বার বললেন তিনি।
ও–।
একটা কথা ভাবছিল সুচরিতা। সত্যি যদি তাই হয়! হয়তো অসম্ভব কল্পনা, কিন্তু অসম্ভবও তো সময়ে-সময়ে সম্ভব হয়।
চলুন, শর্মাসাব, কবুতরে ফিরে যাওয়া যাক, বলে দুজনে ফিরে চলল কবুতরের দিকে।
বাড়ির সবাই তখন লাইব্রেরি-ঘরে এসে ভিড় করেছেন–একমাত্র নয়না কল্যাণী ছাড়া। ওঁর নাকি অনিদ্রা রোগ আছে। তাই ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমোন। বাড়ির ছাদ ভেঙে পড়লেও ঘুম নাকি ওঁর ভাঙে না–মানেকজি জানালেন।
তরুণের কপালে একদিকটায় ছড়ে গেছে। সবাইয়ের ননস্টপ প্রশ্নের উত্তরে সবই খুলে বলল ওরা। কিন্তু কারা, কেন এসেছিল, কিছুই জানা গেল না।
অবসন্ন মনে নিজের ঘরে ফিরে চলল সুচরিতা। লোকটা ঘরের দেওয়ালে আলো ফেলে কী দেখছিল? ইস, কাঞ্চন থাকলে কত ভালো হত!
কবুতরের রহস্য কি এখনও শেষ হয়নি? কে জানে, এরপর কবুতরে কোন অধ্যায় অভিনীত হবে!
.
পরদিন সকালেই ফিরে এলাম আমি। আমাকে দেখেই প্রথমে সুচরিতার মুখে ম্লান হাসি ফুটে উঠল। ছুটে এগিয়ে এল আমার কাছে। ওর চোখে আতঙ্ক-বিহ্বল দৃষ্টি।
আমি ওকে আশ্বাস দেওয়ার জন্যে কাছে টেনে নিলাম। ওর কানে কানে প্রায় ফিসফিস করে বললাম, কী হয়েছে, সু, কী হয়েছে?
আমার ভয় করছে ভীষণ ভয় করছে। কাঁপা কাঁপা স্বরে জবাব দিল সুচরিতা।
আরে ভয় কী– থেমে-থেমে বললাম আমি, আমি থাকতে তোমার গায়ে যে হাত দেবে তার গায়ের ছাল ছাড়িয়ে নেব। কী হয়েছে?
শেষ দিকে আমার গলা পালটাতে দেখে ও একটু ঘাবড়ে গেল। তারপর ধীরে-ধীরে বলল সব। কীভাবে রাতে চোর ঢুকেছিল লাইব্রেরিতে, তারপর তাড়া করতে গিয়ে কিরণ শর্মার সঙ্গে ধাক্কা ইত্যাদি ইত্যাদি।
সব শোনার পর কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম আমি। তারপর বললাম, সু, তোমার পাশ দিয়ে অন্ধকারেই যে কেউ বেরিয়ে গিয়েছিল এ-ব্যাপারে তুমি কি শিয়োর?
তাই তো মনে হয়েছিল আমার…।
হুঁ–। তার মানে বাইরের কারও সঙ্গে ভেতরের কেউ হাত মিলিয়েছে। একটু চিন্তা করে বললাম আমি।
তক্ষুনি সুচরিতা এমন একটা কথা বলল যে, আমি সাঙ্ঘাতিকভাবে চমকে উঠলাম। ও বলল, বাইরের লোক হওয়ার কী দরকার? ভেতরের দুজন হলেও বা আপত্তি কিসের! যদি কিরণ শর্মাই সেই বাইরের লোক হয়?
কিন্তু, এ কী করে সম্ভব!
তুমি না একটা আস্ত বোকা! তোমাকে বললাম না, কিরণ শর্মা একদম ড্রেন্ড-আপ হয়ে ছিলেন। মনে করো কিরণ শর্মা জানলা দিয়ে লাফিয়ে দৌড়লেন। আমি তাড়া করলাম। ধরতে পারলাম না, কিন্তু একটু পরেই তো কবুতরে ওঁর অ্যাবসেন্স ধরা পড়বে, তখন! তাই দৌড়ে কবুতরের গেট পার হয়েই তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন। আমার সঙ্গে ধাক্কা লাগল। বললেন যে, লোকটি পালিয়েছে। খুশি-খুশি মুখে চুপ করল সুচরিতা।
জিনিয়াস! সু, তুমি একটা জিনিয়াস। উচ্ছ্বাসে বললাম আমি। কিন্তু পরমুহূর্তেই গলার স্বর খাদে নামিয়ে যেন নিজেকেই প্রশ্ন করলাম, কিন্তু তোমার পাশ কাটিয়ে ঘর থেকে কে বেরিয়ে গিয়েছিল?
কী জানি, আমি বুঝতে পারিনি। তবে কী যেন একটা মনে করেও করতে পারছি না…।
কী? কী কথা? আমি জানতে চাইলাম।
ঠিক মনে করতে পারছি না। হয়তো পরে মনে পড়বে।
এইবার আমি মনে-মনে একটা প্ল্যান ছকে ফেললাম। প্রশ্ন করলাম সুকে, আচ্ছা, তোমার কি মনে হয় যে, যারা এসেছিল, তারা তাদের কাজ গুছিয়ে নিতে পেরেছে?
উঁহু– সঙ্গে-সঙ্গে জবাব দিল সুচরিতা।
তার মানে আবার তারা আসবে–দৃঢ়স্বরে বললাম আমি, হয় আজ রাতে, নয়তো কাল রাতে, নয় আগামী আর কোনও রাতে। তা হলে শুরু হোক আজ রাত থেকেই।
কী শুরু হবে? চোখ নামিয়ে প্রশ্ন করল সুচরিতা।
যাকগে…পরেই শুনবে–দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পর। হ্যাঁ, ভালো কথা–তরুণ সান্যাল কবুতরে আজ থাকছে তো?
হ্যাঁ। কিন্তু ইব্রাহিমের ব্যাপারটার কী হল?
কিস্যু না। যে-অন্ধকারে ছিলাম এখনও সেই অন্ধকারে। ইব্রাহিমের সঙ্গে তেমন কেউ গোপনে দেখা করতে আসত না। একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল আমার বুকের পাঁজর থেকে : চলো, ভেতরে যাওয়া যাক। বলে দুজনে কবুতরে ঢুকলাম।
সেখানেই দেখা হল ইন্সপেক্টর ক্রসবির সঙ্গে। আমাকে দেখে হাসলেন, বললেন, শুনেছেন তো, গত রাতে কবুতরে চোর এসেছিল!
হ্যাঁ, জবাব দিলাম আমি।
এতক্ষণ প্রসাদজিকে লক্ষ করিনি। তিনি ইন্সপেক্টরের পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। বললেন, মিস্টার মৈত্র, আপনার সব কথাই আমি শুনেছি। আশা করি কবুতরে থাকতে আপনার কোনও অসুবিধে হবে না।
না, না,বাধা দিয়ে বলে উঠলাম আমি, কোনও অসুবিধে হচ্ছে না।
প্রসাদজি চলে গেলেন।
ইন্সপেক্টর আমার দিকে ঠান্ডা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, কাঞ্চনবাবু, গতরাতে আপনি কবুতর ছেড়ে কোথায় গিয়েছিলেন?
আমি সব খুলে বললাম। কিন্তু তিনি সন্তুষ্ট হলেন না বলেই মনে হল।
তিনি কি আমাকেই রাতের আগন্তুক বলে সন্দেহ করছেন নাকি? যাক গে, আমি আর সুচরিতা কোনও কথা না বলে পাশ কাটিয়ে চলে গেলাম।
দুপরের খাওয়া-দাওয়ার পর তরুণ আর সুচরিতার সঙ্গে গোপনে আলোচনা করলাম। ঠিক হল, সুচরিতা একটা আলমারির পেছনে লুকিয়ে থাকবে, ঘরে কেউ ঢুকলেই আলো জ্বেলে দেবে। আর আমি থাকব টেবিলের পেছনে। সব শেষে তরুণ থাকবে দরজায় কাছে–যাতে দরজা দিয়ে কেউ পালাতে না পারে। রাত বারোটা থেকে আমরা অপেক্ষা শুরু করব ঠিক করলাম। আমরা ছাড়া আর কেউ যেন কিছু জানতে না পারে, এ-কথা বারবার করে বলে চলে এলাম নিজের ঘরে। সটান গিয়ে শুয়ে পড়লাম বিছানায়।
.
রাত বারোটা বেজে এক মিনিট। অজ্ঞান কবুতরে জেগে আছি শুধু আমরা তিনজন আমি, তরুণ আর সুচরিতা।
পা টিপে টিপে লাইব্রেরিতে ঢুকলাম আমরা। ঘরে জমাট অন্ধকার। আমরা যার-যার নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালাম। তরুণ সঙ্গে এনেছে একপাটি নাল লাগানো জুতো। আমার পাঁচ আঙুলে আটকানো একটা নাল ডাস্টার। সারা ঘর অন্ধকার। শুধু তিনটে কাচের জানলা দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়েছিল ভেতরে।
দম বন্ধ করে অপেক্ষা করছিলাম আমি। আজ হয়তো আমাদের প্রতীক্ষা নিষ্ফল হবে। তবু আশা–। বাঁ হাতের রেডিয়াম ডায়ালে চোখ নামালাম। পৌনে একটা। অদ্ভুত একটা উত্তেজনা উৎকণ্ঠার মধ্যে দিয়ে সময় কেটে যাচ্ছিল।
এইভাবে কতক্ষণ যে দাঁড়িয়েছিলাম জানি না। হঠাৎই যেন সুরকি-ঢালা পথে কারও সতর্ক পায়ের শব্দ আমার কানে এল। শরীরের সবকটা স্নায়ু যেন নিঃশব্দ চিৎকারে গলা ফাটিয়ে বলতে লাগল, এসেছে। সে এসেছে!
একটু পরেই একটি ছায়ামূর্তিকে দেখা গেল জানলায়। দম বন্ধ করে চরম মুহূর্তের জন্যে অপেক্ষা করে রইলাম। ধীরে-ধীরে জানলা টপকে ঘরের মধ্যে নেমে দাঁড়াল সে। একবার এদিক ওদিক তাকাল। তারপর এক পা এগোতেই আমি কাঁপয়ে পড়লাম তার ওপর।
পরমুহূর্তেই ঘরের আলো জ্বালিয়ে দিল সুচরিতা। তরুণ এগিয়ে এসে কলার ধরে এক হ্যাঁচকায় তুলে দাঁড় করাল লোকটিকে।
তার মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম আমি। একী! এ যে সেই রহস্যময় কালো পোশাক পরা লোকটি।
এগিয়ে গিয়ে তাকে উদ্দেশ্য করে বললাম, স্যার, নিজের বাড়ি খুঁজতে এসে আপনাকে যে এত বিপদে পড়তে হবে তা বোধহয় ভাবেননি!
লোকটি গম্ভীর মুখে তাকাল আমার দিকে। ইতিমধ্যে লাইব্রেরিতে প্রায় সবাই এসে হাজির হয়েছেন। শ্রী নরসিংহ আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, মিস্টার বোস, হচ্ছে এসব ব্যাপার কী? মাঝরাত্রে যত সব বিড়ম্বনা।
আমি হাসলাম, ওঁকে নকল করে বললাম, বোস নয়, মৈত্র। দেখুন না নিজেই হয়েছে কী। সর্বেশ্বর রায় নামধারী ভদ্রলোক চোরের মতো দৃষ্টি নিয়ে তাকালেন নৈশ আগন্তুকের দিকে।
সকলের দিকে একপলক দেখে জামাকাপড় ঝেড়ে মুখ খুললেন আমাদের নৈশ অতিথি। আমাদের উদ্দেশ্য করে বললেন, আপনাদের সবাইকে জানাই যে, আমার নাম কিষাণ আপ্তে– দ্যাট ইজ, এজেন্ট জেড। সি.বি.আই. থেকে আমাকে এখানে পাঠানো হয়েছে।
একথায় ঘরের মধ্যে যেন বজ্রপাত হল। বিস্ময়ের অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে এল সবাইয়ের মুখ দিয়ে।
চারিদিকে চোখ বুলিয়ে মিস্টার আপ্তে বলে চললেন, আমি এখানে এসেছি সমর বর্মনকে গ্রেপ্তার করার জন্যে। নামটা আপনাদের সকলের কাছেই বোধহয় পরিচিত। আমি দুঃখের সঙ্গে জানাতে বাধ্য হচ্ছি যে, কবুতরে যে কজন হাজির আছেন, তাদের মধ্যে একজন অবশ্যই সমর বর্মন। বর্মনের ছদ্মবেশ ধরার ক্ষমতা অবিশ্বাস্য। সে আমার ছদ্মবেশ ধরে হাজির হয়েও আপনাদের ধোঁকা দিতে পারে। এই আশ্চর্য চোর এবং ব্ল্যাকমেলারটিকে ধরা অত্যন্ত কঠিন। কিন্তু এখন যেহেতু সে কবুতরে আছে, তাই আমাদের কাজ একটু সহজ হয়ে পড়েছে।
সমর বর্মন কবুতরে এসেছে সম্ভবত হীরের নেকলেসের জন্যে। গতবছর সিরাজনগরের মন্ত্রী সুরেন্দ্র পালিত একটা মিটিং-এ কবুতরে এসেছিলেন। আমরা খবর পেয়েছি যে, তিনি একটা দামি নেকলেস এখানে লুকিয়ে রেখে যান। সেটার খবর বর্মন জেলে বসেই পায়। আমরা আন্দাজ করেছিলাম যে, ওটা হাতানোর জন্যে সে, কবুতরে আসবেই। তাই এতদিন আমি ছদ্ম পরিচয়ে কবুতরের আশেপাশে ঘুরেছি বলে আমার দিকে চেয়ে মুচকি হাসলেন তিনি। তারপর সুচরিতার দিকে ফিরে বললেন, ম্যাডাম, গত রাতেও আমি এসেছিলাম। আমার উদ্দেশ্য ছিল এই লাইব্রেরিতে লুকিয়ে রাখা হীরের নেকলেসটা উদ্ধার করা। আমি চাইনি যে, সবাই এই ব্যাপারটা জানুক। যা হোক, আগামীকাল আমি ইন্সপেক্টর ক্রসবির সঙ্গে দেখা করছি। এবার আমি বর্মনকে ধরবই। সে আমার চোখকে ফাঁকি দিয়ে পালাতে পারবে না। তার চোখ জ্বলে উঠেই নিভে গেল।
সর্বেশ্বর রায় বললেন, মিস্টার আপ্তে, আমি আগামীকাল কবুতর ছেড়ে যেতে চাই। তা না হলে আমার প্রায় পঞ্চাশহাজার টাকা ক্ষতি হয়ে যাবে।
সেটা আপনি ক্রসবিকেই বলবেন–। জানালেন এজেন্ট জেড।
প্রসাদজি মিস্টার আপ্তের জন্যে ওপরে একটা ঘরের ব্যবস্থা করলেন। সবাই লাইব্রেরি ছেড়ে পা বাড়ালেন নিজের নিজের ঘরের দিকে।
সুচরিতাকে নিয়ে ওপরে ওঠার সময় শুধু শুনলাম, শ্রীনরসিংহ নিজের মনেই বলছেন, খুবই ঘটছে আশ্চর্য এখানে ব্যাপার।
.
পরদিন সকালে উঠে চুল আঁচড়াতে যেতেই সাঙ্ঘাতিক অবাক হলাম আমি। আয়না দিয়েই চোখে পড়ল বান্ডিলটা। তারপর তাকালাম টেবিলের ওপর। এই তো! এই তো সেই চিঠির বান্ডিলটা। সুচরিতা চৌধুরীর নাম লেখা সেই চুরি যাওয়া চিঠিগুলো!
হঠাৎই বিদ্যুৎ চমকের মতো একটা কথা মনে এল। সুরেন্দ্র পালিতের লেখা পাণ্ডুলিপির হাতের লেখা আর এই চিঠিগুলোর হাতের লেখা একই। তার মানে এই চিঠির লেখক শ্রীযুক্ত পালিতই। হয়তো এই চিঠিগুলোতে কোনও গোপন ইঙ্গিত আছে। এই যে, কবুতর থেকে লেখা চিঠিটা। এটা আপাতদৃষ্টিতে অর্থহীন মনে হলেও, হয়তো এর সাহায্যেই পালিতসাহেব লুকোনো নেকলেসের সন্ধানটা জানাতে চেয়েছেন।
এক দৌড়ে নীচে নেমে গিয়ে কিষাণ আপ্তেকে সবকিছু খুলে বলে আমার সন্দেহের কথা জানালাম।
তিনি প্রসাদজির সঙ্গে কথা বলছিলেন। আমার কথা শুনে বললেন, মিস্টার মৈত্র, আপনি যা বলেছেন তা খুবই যুক্তিসঙ্গত। আমি এক্ষুনি থানায় যাচ্ছি। এখানকার সাইফার রিডারকে অনুরোধ করব এগুলো ডিসাইফার করার জন্যে। বলেই তিনি হন্তদন্ত হয়ে চিঠিগুলো নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
আমি প্রসাদজির সঙ্গে আলোচনা শুরু করলাম। বললাম, আচ্ছা প্রসাদজি, আপনার বাড়িতে কোনও গুপ্তপথ আছে কি?
না তো। জানালেন প্রসাদজি।
কোনওকালেই ছিল না? গভীর আগ্রহের সঙ্গে প্রশ্ন করলাম আমি।
উত্তরে প্রসাদজি জানালেন যে, অনেক আগে একটা সুড়ঙ্গপথ ছিল ওই লাইব্রেরিতেই। কিন্তু পরে সেটা নষ্ট হয়ে যায়।
আমি আর প্রসাদজি উঠে রওনা হলাম লাইব্রেরির দিকে। মাঝপথেই দেখা হল সুচরিতার সঙ্গে। ওকে সব কথা বললাম। শুনে অবাক হয়ে গেল ও। আমরা তিনজনে গিয়ে হাজির হলাম লাইব্রেরিতে।
প্রসাদজি এগিয়ে গেলেন দেওয়ালে টাঙানো একটা ছবির দিকে। ছবিটা দেওয়াল থেকে নামিয়ে দেওয়ালের সেই অংশে একটু চাপ দিলেন। সঙ্গে-সঙ্গে একটা আলমারির পাশ থেকে দেওয়ালের কিছুটা অংশ নিঃশব্দে সরে গেল। আমরা ভেতরে ঢুকলাম। অতি সাধারণ একটা সুড়ঙ্গপথ। দেখে অনেক পুরোনো বলেই মনে হয়। প্রায় কুড়ি গজ যাওয়ার পর দেখা গেল পথ সম্পূর্ণ বন্ধ। সুড়ঙ্গের দেওয়াল অত্যন্ত জীর্ণ হওয়ায় ইটের গা থেকে চুন-বালি সব খসে-খসে পড়ছে।
মিনিটদশেক পর আমরা বাইরে বেরিয়ে এলাম। প্রসাদজি বললেন, মৈত্রসাব, কিছু ব্যাপারই আমার মাথায় ঢুকছে না। কোত্থেকে কী সব হচ্ছে–
এমন সময় লাইব্রেরির দরজায় হাজির হলেন এজেন্ট জেড। তার মুখ খুশিতে ভরপুর।
আমাদের দেখেই বললেন, সব জেনেছি আমি। আপনি ঠিকই বলেছিলেন, মিস্টার মৈত্র, কবুতরের নাম লেখা চিঠিটাই আসল। সেটা ডিকোড করা গেছে। এই দেখুন– বলে একটা কাগজ আমার দিকে এগিয়ে দিলেন তিনি।
কাগজটা হাতে নিয়ে দেখলাম। তাতে লেখা–
আট বাঁ–সাতটা ইট-পাশে তিনটে কাগজ।
গজ উপরে
—-সুরেন্দ্র
এ তো জলের মতো স্পষ্ট! বলে উঠলাম আমি, তার মানে সুড়ঙ্গপথ ধরে আট গজ গিয়ে বাঁ দিকের দেওয়ালে দেখতে হবে। মেঝে থেকে সাতটা ইট ওপরে গিয়ে তিনটে ইট পাশে– ব্যস, তা হলেই পাওয়া যাবে।
আমিও ঠিক তাই ভেবেছি। বললেন কিষাণ আপ্তে, চলুন, আর দেরি করে লাভ কী!
শুরু করা যাক।
প্রসাদজি একটা মাপার ফিতে নিয়ে এলেন। মাপজোখ করে কাজ শুরু করলাম আমরা চারজন। সাতটা ইট ওপরে আর তিনটে হঁট পাশে যেতেই একটা আলগা ইট চোখে পড়ল। পকেট থেকে ছোট্ট ছুরি বের করে ইটটাকে বের করে নিলাম।
অন্ধকার একটা খুপরি। আনন্দে উত্তেজনায় দম বন্ধ হয়ে গেল যেন। কিষাণ আপ্তে চটপট হাত ঢুকিয়ে দিলেন খুপরির ভেতরে।
একটু পরেই হাত বের করে নিলেন। তার হাতে একটা কাগজ।
তাহলে কি কেউ আমাদের আগেই এ-জায়গার সন্ধান পেয়েছে! উঁচু গলায় বললাম আমি।
মনে তো হয় না। জানালেন এজেন্ট জেড। কাগজটা মেলে ধরলেন চোখের সামনে। কী আশ্চর্য! তাতে শুধু দেখা যাচ্ছেঃ
গ গ গ গ গ
গ গ গ গ গ
দেখে ভীষণ অবাক হলাম আমি। এরকম তিক্ত রসিকতার অর্থ কী?
কিষাণ আপ্তেকে লক্ষ করে বললাম, মিস্টার আপ্তে, আপনি কি এর অর্থ বুঝতে পারছেন?
উঁহু মাথা কঁকালেন এজেন্ট জেড।
প্রসাদজি বললেন, মিস্টার মৈত্র, চলুন বাইরে যাওয়া যাক।
বাইরে বেরিয়ে এলাম আমরা। প্রসাদজি গুপ্তপথটা বন্ধ করে দিয়ে ছবিটাকে আবার যথাস্থানে টাঙিয়ে রাখলেন।
এমন সময় লাইব্রেরিতে এসে ঢুকলেন কিরণ শর্মা ও ক্রসওয়ার্ড। কিষাণ আপ্তের হাতে চিরকুটটা দেখে এক লাফে এসে দাঁড়ালেন সামনে, বললেন, দেখি, দেখি। বলে আর দেওয়ার অপেক্ষা রাখলেন না। একরকম ছিনিয়েই নিলেন ওটা।
জেড বাধা দিলেন না।
আমি একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলাম কিরণ শর্মার মুখের দিকে। হঠাৎ লক্ষ করলাম যে, একটা খুশির ঝিলিক লহমার জন্যে ছড়িয়ে পড়ল তার মুখে। তারপর অপেক্ষাকৃত গম্ভীর মুখ করে বলে উঠলেন, ভারি অন্যায়। এরকম রসিকতা করা ভারি অন্যায়।
ক্রসওয়ার্ডও দেখলেন কাগজটা। কিন্তু কিছু বুঝলেন বলে মনে হল না।
এসবই সমর বর্মনের কারসাজি, দৃঢ়কণ্ঠে বলে উঠলেন জেড? তাকে একবার হাতের মুঠোয় যদি পাই…।
আমি যাচ্ছি–একটু কাজ আছে। বলে সঙ্গে-সঙ্গে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন শর্মা। আমরা অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম তার চলার পথের দিকে।
কিছুক্ষণ পরে নিস্তব্ধতা ভাঙলাম আমি, মিস্টার আপ্তে, এই কিরণ শর্মা যদি কুমার রণজিৎকে খুন করে থাকেন, তা হলে আমি বিন্দুমাত্রও আশ্চর্য হব না।
দুজন অফিসিয়াল হাঁ করে চেয়ে রইলেন আমার মুখের দিকে। সুচরিতা আপনমনেই নখ খুঁটতে থাকল।
.
ওপরে উঠে প্রথম ঘরটায় উঁকি মেরে দেখি শ্রীসর্বেশ্বর রায় গোছগাছ শুরু করে দিয়েছেন। আমি পাশ কাটিয়ে নিজের ঘরে গেলাম। ঘরে ঢুকতেই দেখি একজন চাকরগোছের লোক বসে রয়েছে। আমি তাকে দেখে অবাক হলাম। এ যে কুমার রণজিতের নেপালি চাকরটা!
আমাকে দেখেই লোকটি হাউহাউ করে কেঁদে উঠে বলল, বাবু, আমার সাহেবকে যে খুন করেছে তাকে আমি শেষ করব। আপনি আমাকে আপনার সঙ্গে নিন–আমি আপনার কেনা হয়ে থাকব। বলতে-বলতে লোকটি কোমর থেকে হঠাৎই একটা বাঁকানো ছোরা বের করল। ওর মুখ জিঘাংসায় বিকৃত হয়ে উঠল।
আমি ভাবলাম, লোকটি আমাকেই খুনি ভাবছে না তো! হয়তো আমার বিশ্বাসভাজন হয়ে তারপর আমাকেই খুন করতে চায়।
মুখে বললাম, ঠিক আছে। তোমার কোনও চিন্তা নেই। পুলিশ কুমারের হত্যাকারীকে ধরে ফাঁসিতে ঝোলাবেই।
জানি না, সে আমার কথা কতটুকু বিশ্বাস করল। কিন্তু ধীরে-ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আপনার যে-কোনও কাজে দরকার হলেই আমাকে বলবেন। আপনার জন্যে জান হাসিল।
ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে।
আমি হাঁফ ছেড়ে উঠে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিলাম। তারপর এসে দাঁড়ালাম জানলায় কাছে। এই জানলা দিয়ে কবুতরের পেছনদিকটা চোখে পড়ে। ও কী! কিরণ শর্মা না? পেছনদিকের গোলাপ বাগানে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। ব্যাপার কী জানার জন্যে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে আমি রওনা দিলাম বাগানের উদ্দেশে।
বাগানে গিয়ে হাজির হতেই সেখান থেকে দ্রুতপায়ে প্রস্থান করলেন শ্রীশর্মা। ফিরে আসতে যাব, হঠাৎই দেখি কিষাণ আপ্তে দৌড়ে আসছেন আমার দিকে।
আমি তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেলাম। প্রশ্ন করলাম, কী হয়েছে, মিস্টার আপ্তে?
হাঁফাতে-হাঁফাতে জবাব দিলেন তিনি, পেয়েছি! এতদিন পরে পাওয়া গেছে রিভলভারটা। চলুন, দেখবেন চলুন।
আমি আর কোনও কথা না বলে দ্রুত তাঁর সঙ্গে রওনা হলাম।
কিছুক্ষণ পরে দুজনে এসে হাজির হলাম কবুতরের গেটের সামনে। সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন শ্রীনরসিংহ, সর্বেশ্বর রায়, ক্রসওয়ার্ড, আর সুচরিতা। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম মানেকজি ও প্রসাজি হন্তদন্ত হয়ে আসছেন। আর পেছনে ও কে! তরুণী কথাটা যাকে হুবহু মানায় সেইরকম একজন। নয়না কল্যাণী! নাঃ, রূপ আছে মেয়েটার! চোখে সানগ্লাস, ঠোঁটে লিপস্টিক। ঢল নামা চুলে মুখের অর্ধেকটাই প্রায় ঢাকা।
প্রথমে ভালো করে দেখলাম। সর্বেশ্বর রায়ের সুটকেশটা তার পায়ের কাছে ভোলা অবস্থায় পড়ে আছে, আর তার মধ্যে উঁকি মারছে একটা সুদৃশ্য কালো অটোমেটিক। সর্বেশ্বর রায় চেঁচাচ্ছিলেন, আমি তো বলেছি, আমি জানি না। আমার ব্যাগে কেউ যদি রিভলবার লুকিয়ে রাখে, তবে আমি কী করতে পারি?
কিষাণ আপ্তে বললেন, ঠিক আছে মিস্টার রায়, আপনি যেখানে যাচ্ছেন যান। আমরা পরে এ-ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করব।
বেশ রাগ-রাগ ভাব দেখিয়েই চলে গেলেন সর্বেশ্বর রায়।
ক্রসওয়ার্ড সুটকেশ থেকে রিভলবারটি বের করে নিয়েছিলেন। সেটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে বললেন, হু, এটাই কাজে লাগানো হয়েছিল বলে মনে হয়। আপনার কী মনে হয়, মিস্টার আপ্তে?
পয়েন্ট থ্রি এইট বলেই মনে হচ্ছে। ভালো করে সেটাকে পর্যবেক্ষণ করতে করতে বললেন জেড।
আচ্ছা, আপনারা এবার যার-যার ঘরে ফিরে যান– ক্রসওয়ার্ড হাতে তালি দিয়ে বললেন, এখানে দয়া করে আর ভিড় করবেন না।
মানেকজি, প্রসাদজি আর আমি ছাড়া সবাই চলে গেলেন। নয়না কল্যাণী চলে যাওয়ার আগে মানেকজির সঙ্গে চাপা গলায় কীসব কথা বলে গেলেন।
মানেকজি অস্থিরতাকে আর চাপতে পারছিলেন না। বলে উঠলেন, ক্রসবি, কী সব ফ্যানটাস্টিক ব্যাপার হচ্ছে এখানে? সর্বেশ্বর রায় আমার পরিচিত। তুমি শিগগিরই এর একটা হেস্তনেস্ত করো। ফানি!
মানেকজি ও প্রসাদজি চলে গেলেন।
আমি এবার ক্রসওয়ার্ডকে বললাম, ইন্সপেক্টর, দেখুন, রিভলভারটায় কোনও ফিঙ্গারপ্রিন্ট পান কি না।
আশা খুবই কম, বললেন এজেন্ট জেড। তারপর চিন্তিত মনে তিনজনই ফিরে এলাম কবুতরে।
একটু পরে ছুটতে ছুটতে আমার ঘরে এল সুচরিতা। বলল, কাঞ্চন, মনে পড়েছে। মনে পড়েছে।
কী? কী মনে পড়েছে? অবাক হয়ে জানতে চাইলাম আমি।
সেই রাতে কেউ আমাকে পাশ কাটিয়ে লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। এ-ব্যাপারে আমি শিয়োর। দৃঢ়স্বরে বলল সুচরিতা।
কেন! কী হয়েছে?
আমি একটা গন্ধ পেয়েছিলাম, বলল সুচরিতা, কিসের গন্ধ তা ঠিক বলতে পারব না, কিন্তু আজ আবার আমি গন্ধটা পেয়েছি। আজ, একটু আগে, সবাই যখন গেটের কাছে ভিড় করেছিল তখন!
তার মানে সে-রাতে কেউ একজন লাইব্রেরিতে লুকিয়ে ছিল। মিস্টার আপ্তে তা জানতে পারেননি। অথচ আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম, ঘরে দু-চারজন লোক ছিল।
আমার কথা শেষ হতে-না-হতেই ঘরের দরজায় দেখা গেল সেই চাকরটিকে। কুণ্ঠিতস্বরে সে বলল, যদি এটা একবার দেখেন– বলে আমার দিকে একটুকরো কাগজ বাড়িয়ে ধরল।
উঠে গিয়ে আমি সেটা হাতে নিলাম। তাতে একটা ঠিকানা লেখা।
আমি চোখ তুলে সপ্রশ্ন দৃষ্টি মেলে তাকালাম ওর দিকে। ও জবাব দিল, ওই দাড়িওয়ালাবাবুর পকেট থেকে পড়েছিল এটা।
দাড়িওয়ালাবাবু মানে কিষাণ আপ্তে। কিন্তু এর অর্থ কী! জেড কি এই লোকটাকে পরীক্ষা করার জন্যে পকেট থেকে কাগজটা ইচ্ছে করেই ফেলেছেন? যাকগে, একবার শেষ চেষ্টা করব এই সূত্র ধরে। কিষাণ আপ্তের সঙ্গে কথা বলে এই ঠিকানায় একবার যাব। জানি কোনও লাভ হবে না, তবু– এই আশা নিয়ে সুচরিতাকে বসতে বলে জেড-এর সঙ্গে দেখা করার জন্যে উঠলাম।
নীচের ঘরে এসে তাঁকে দেখলাম। বসে-বসে মানেকজির সঙ্গে কথা বলছেন। আমি গিয়ে তাঁকে একপাশে ডাকলাম, বললাম, মিস্টার আপ্তে, আপনার পকেট থেকে কি এই কাগজটা পড়ে গিয়েছিল?
না তো! সবিস্ময়ে বললেন তিনি, কোথায় পেলেন এটা?
আমি তাকে সব খুলে বললাম।
সব শুনে তিনি বললেন, ওই চাকরটা নিশ্চয়ই কারও হয়ে কাজ করছে। দেখি, ব্যাটার মতলব কী!
আমি আর দেরি না করে কবুতরের বাইরে এসে ক্রসওয়ার্ডের সঙ্গে দেখা করে বললাম, ইন্সপেক্টর, আমি একটা সামান্য সূত্র পেয়েছি। সেটা নিয়েই একবার শেষ চেষ্টা করতে চাই বলে তাকে সব বললাম, ঠিকানাটাও দেখালাম। শেষে যাওয়ার সময় বললাম, আপনি কাইন্ডলি লক্ষ রাখবেন যে, কেউই যেন কবুতর ছেড়ে কোথাও না যান।
কবুতর ছেড়ে যাওয়ার সময় একবার পেছনদিকটায় উঁকি দিয়ে গেলাম। দেখলাম, কিরণ শর্মা তখনও গোলাপের বাগানে ঘুরঘুর করে বেড়াচ্ছেন। আমাকে দেখেই সাঁৎ করে সরে গেলেন।
আমি মনে-মনে একটু হেসে কবুতর ছেড়ে রওনা দিলাম। হতাশা আমার মন ছেয়ে ফেলেছিল।
.
পোড়ো বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে ঠিকানাটা মিলিয়ে নিচ্ছিলাম। এই বাড়িটাই তো? ভাঙা নেমপ্লেট থেকে যতটুকু উদ্ধার করা গেল, তা খুবই সামান্য। তবু ঠিকানাটা মেলাতে অসুবিধে হল । বনজঙ্গলে ভরতি এই ভাঙা পোড়ো বাড়িতে আর যেই থাক, মানুষ বাস করে বলে মনে হল না।
পা টিপেটিপে ঢুকলাম বাড়ির চত্বরে। বেলা পড়ে এসেছিল। জায়গাটা ছায়া পড়ে অন্ধকার অন্ধকার হয়ে রয়েছে। ধীরে-ধীরে বাড়ির পেছনদিকে গিয়ে পৌঁছোলাম। ঝোপঝাড়ে ভরতি পেছনদিকটা। তারই মধ্যে কিছুক্ষণ লুকিয়ে রইলাম।
কিছুক্ষণ পরে নীচের ঘরে উঁকি দিয়ে দেখি, সেখানে জনাসাতেক লোক বসে আছে। ঘরের দেওয়ালে একটা লাল পাঞ্জার ছাপ। এখানেও লাল পাঞ্জা!
লোকগুলোর আলোচনা থেকে বোঝা গেল যে, ওদের নেতা বা ওই ধরনের কেউ এখনও আসেননি। জানলা ছেড়ে সরে দাঁড়াতেই একজন লোককে হেঁটে যেতে দেখলাম। তার পেছনদিকটা দেখে খুব চেনা মনে হল। কিন্তু কে, তা কিছুতেই ধরতে পারলাম না। আমি তো ক্রসওয়ার্ডকে বারণ করে দিয়ে এসেছিলাম যে, কবুতর ছেড়ে কেউ যেন বেরোতে না পারে!
হঠাৎ মাথার ওপরের একটা জানলা থেকে ভেসে আসা গোঙানির শব্দ আমার কানে এল। সঙ্গে-সঙ্গে পুরোনো জীর্ণ পাইপ বেয়ে ওপরে উঠতে লাগলাম। সবসময়ই ভয় হতে লাগল, পাইপটা যদি ভেঙে পড়ে, কিংবা কেউ যদি দেখে ফ্যালে!
শেষ পর্যন্ত জানলার কার্নিশে পৌঁছে জানলা ঠেলে ঘরে ঢুকলাম। অন্ধকার ঘরে আবছা আবছা চোখে পড়ল একটি লোককে। ঘরের এক কোনায় হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে।
কী করব ভাবছি–এমন সময় ঘরের আলো জ্বলে উঠল। আর আমার সামনে যিনি দাঁড়িয়ে, তিনি কিরণ শর্মা।
আমি তাঁকে দেখে অবাক হয়ে বলে উঠলাম, তা হলে শেষ পর্যন্ত আপনিই নাটের গুরু?
কোনও জবাব না দিয়ে আমার দিকে ছপা এগিয়ে এলেন তিনি। তারপরই পকেট থেকে একটা গাঢ় নীলচে রঙের রিভলভার বের করে উঁচিয়ে ধরলেন আমার দিকে, তার মুখ ব্যঙ্গের হাসিতে বিকৃত হয়ে গেল…।
.
রাতে যখন কাঞ্চন ফিরল না, তখন খুবই মুষড়ে পড়ল সুচরিতা। কোত্থেকে কী হয়ে গেল। তাদের মধ্যেই একজন সমর বর্মন! কী সাঙ্ঘাতিক! তবে কাঞ্চন নিশ্চয়ই নয়। সত্যিই, কাঞ্চন ছেলেটা এমন দুরন্ত প্রকৃতিরদারুণ ছেলে। ওকে ছাড়া সুচরিতা নিজেকে ইদানিং ভাবতে পারে না। ও আসার পর থেকেই সব দুঃখ-কষ্ট ভুলে আছে সুচরিতা।
ঠিক এমন সময় ঠক করে একটা আওয়াজ হল কাচের শার্সিতে। চকিতে জানলার দিকে ছুটে গেল সুচরিতা। জানলা খুলল–। নীচের সুরকি ঢালা পথে কেউ একজন দাঁড়িয়ে রয়েছে।
সুচরিতা মুখ বাড়াতেই আর একটা সাদা রঙের কী ছিটকে এল ঘরের ভেতরে। নীচু হয়ে সেটা কুড়িয়ে নিল ও। কাগজে মোড়া একটা পাথর। কাগজটা খুলল..একী! এ যে কাঞ্চনের চিঠি। চিঠিতে লেখাঃ
সু,
ভীষণ বিপদ, শিগগির কবুতর ছেড়ে আমার লোকের সঙ্গে চলে এসো। অনেক কথা বলার আছে। আর, এদিকে কী হয়েছে জানো? কিরণ শর্মা হলেন…।
কাঞ্চন।
আর দেরি করল না সুচরিতা। চটপট তৈরি হয়ে নেমে এল নীচে। দেখল, লোকটি ওর পরিচিত। ওই লোকটিই কুমার রণজিতের চাকর ছিল।
সুচরিতা নেমে আসতেই সে চাপা গলায় বলল, তাড়াতাড়ি চলুন, বাবু আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন।
ওরা দুজন দ্রুতপায়ে হাঁটতে শুরু করল।
সুচরিতা ভাবছিল–তা হলে কাঞ্চনের ধারণাই সত্যি হল। কিরণ শর্মাই আসল লোক।
কবুতরের বাইরে সুচরিতার গাড়ি ছাড়াও আর একটা কালো রঙের স্ট্যান্ডার্ড দাঁড়িয়েছিল। চাকরটার নির্দেশে সুচরিতা গিয়ে বসল সেই গাড়ির পিছনের সিটে। চাকরটা ওর পাশে এসে বসল।
ড্রাইভারের সিটে যে বসেছিল সে গাড়ি ছেড়ে দিল। লোকটির মুখ সুচরিতার চেনা মনে হচ্ছিল, কিন্তু পাশ থেকে দেখে ঠিক ঠাহর করতে পারছিল না।
হঠাৎই পিছনদিকে মুখ ফেরাল লোকটি।
সঙ্গে-সঙ্গে খুশির বন্যায় ছলকে উঠল সুচরিতার আনন্দ ও কাঞ্চন, তুমি!
কাঞ্চন কোনও জবাব না দিয়ে হু-হু করে গাড়ি ছোটাতে লাগল।
এ কী! কাঞ্চন, কী হয়েছে তোমার? কথা বলছ না কেন? ব্যাকুল স্বরে প্রশ্ন করল সুচরিতা।
কাঞ্চন এবারও কোনও জবাব দিল না। গাড়ি ছুটতে লাগল ঝড়ের গতিতে।
সামনের সিটের দিকে ঝুঁকে পড়ল সুচরিতা। খামচে ধরল কাঞ্চনের জামা। তারপর হিস্টিরিয়া রুগির মতো চেঁচিয়ে উঠল, কাঞ্চন, কী ব্যাপার? কথা বলছ না?
সুচরিতা, তুমি ভয় পেলে? গম্ভীর স্বরে জবাব এল।
গাড়ি তখন ঝড়ের বেগে উল্কার মতো ধেয়ে চলেছে অজানার দিকে..।
.
শেষ দৃশ্য! বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, এতক্ষণ ঘটে যাওয়া কবুতর নাটকের এটাই শেষ দৃশ্য।
কবুতরের লাইব্রেরি-ঘর। সেখানে আজ প্রায় সবাই হাজির হয়েছেন। মানেকজি, প্রসাদজি, সর্বেশ্বর রায়, নরসিংহ চৌধুরী, কিষাণ আপ্তে, ক্রসওয়ার্ড, তরুণ সান্যাল। ঘরে অনুপস্থিত কিরণ শর্মা, কাঞ্চন মৈত্র, সুচরিতা চৌধুরী এবং বরাবরের মতোই নয়না কল্যাণী তিনি সম্ভবত মরফিনে আচ্ছন্ন।
জেন্টমেন, আজ সব রহস্যই আমাদের কাছে পরিষ্কার। সমর বর্মনকে আমি খুঁজে পেয়েছি। কিষাণ বলছিলেন, আপনারা শুনলে হয়তো অবাক হবেন যে, সেই দুর্ধর্ষ তস্কর সমর বর্মন আর কেউ নয়–শ্রীকাঞ্চন মৈত্র!
ঘরে যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। হতবাক দৃষ্টি মেলে সবাই তাকিয়ে রয়েছেন কিষাণ আপ্তের দিকে। তিনি তখনও বলে চলেছেন, মিস্টার ক্রসবির সঙ্গে আলোচনা করে আমি সবই জানতে পারি। ভেবে দেখুন কাঞ্চন মৈত্রের কথা। এই দিল্লিতে আসার আগে ইনি কী করতেন? কোথায় ছিলেন? ..কিছুই আমরা জানি না। চিঠিগুলো হারিয়ে যাওয়া এবং ফিরে পাওয়ার ব্যাপারটা দেখুন কী হাস্যকর। আসলে চিঠিগুলো উনি ডিকোড করতে পারছিলেন না। তাই যেমন করে তোক ওগুলোকে আবিষ্কার করলেন–তাও আবার নিজের ড্রেসিং টেবিলেই যাতে আমাদের দিয়ে ওগুলো ডিকোড করিয়ে নেওয়া যায়। কুমার রণজিতের মৃত্যুর ব্যাপারে তাঁর কথাগুলো ভেবে দেখুন। তিনি আসলে পৌনে একটায় হাজির হতে চেয়েছিলেন কবুতরে। হয়তো লাইব্রেরিটা খুঁজে দেখার ইচ্ছে ছিল। কোনও শব্দ-টব্দ পেয়ে পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন কুমার রণজিৎ। লাইব্রেরিতে গেলেন–সমর বর্মনকে চিনে ফেললেন। সঙ্গে সঙ্গেই তাকে গুলি করলেন শ্রীমৈত্র। তারপর আমাদের কাছে একটা বানানো গল্প ছেড়ে দিলেন। সুচরিতা চৌধুরীর সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করে তাকেও দলে টানলেন। মনে রাখবেন, বেশিরভাগ ঘটনাই কাঞ্চনবাবুর নিজের স্টেটমেন্ট। লাল পাঞ্জা নামে আদৌ যে কোনও গ্যাং আছে। তা আমি বিশ্বাস করি না। এরপর মিস্টার মৈত্র রিভলবারটা শ্রীরায়ের সুটকেশে পাচার করে দিলেন। সুড়ঙ্গ পথে ঢুকে আমরা একটা খুপরি দেখতে পাই। তাতে কিছু না পাওয়ায় শ্রীমৈত্র অত্যন্ত ডিসহার্টেন্ড হয়েছিলেন।
কিন্তু সমর বর্মন সম্বন্ধে আমি যতদূর শুনেছি, সে কখনও মানুষ খুন করেনি, দ্বিধাগ্রস্তভাবে জানালেন ক্রসওয়ার্ড।
ঠিক কথা। কিন্তু তখনকার অবস্থাটা একবার চিন্তা করে দেখুন আপনারা। আমি গোপনে তাকে অনুসরণ করে অনেককিছুই জানতে পারি–।
কিন্তু তিনি এখন কোথায়? সর্বেশ্বর রায় প্রশ্ন করলেন।
যেখানেই থাকুন না কেন, আমাদের লোক তাকে খুঁজে বের করবেই। দৃঢ়কণ্ঠে জানালেন ক্রসওয়ার্ড।
ঠিক এই সময় সবাইকে অবাক করে দিয়ে ঘরে ঢুকলেন কিরণ শর্মা, কাঞ্চন মৈত্র ও সুচরিতা চৌধুরী। সঙ্গে সঙ্গে ক্রসওয়ার্ড এগিয়ে গেলেন কাঞ্চনের দিকে।
.
হাতে হাতকড়া লাগানো অবস্থায় বিস্ময়-বিমূঢ় চোখে একবার তাকালাম সকলের দিকে। বিষণ্ণ হাসি হেসে সুচরিতার দিকে চেয়ে বললাম, সু, তুমিও কি এসব বিশ্বাস করো?
বিশ্বাস না করতে পারলেই খুশি হতাম… সুচরিতার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল।
আমি মিস্টার মৈত্রকে পরীক্ষা করার জন্যে তার অনুচরের–নেপালী চাকরটা, যে কুমারের সঙ্গে এখানে এসেছিল সামনে ইচ্ছে করেই বাজে ঠিকানা লেখা একটা কাগজ ফেলে দিই। পরে দেখলাম, কাঞ্চনবাবু আমাকে ওটা দেখিয়ে কৌতূহল প্রকাশ করেন। কিন্তু এর মধ্যে আশ্চর্য কী জানেন! ওই কাগজটা আমি পেয়েছিলাম কাঞ্চনবাবুর ঘর থেকেই ব্যঙ্গের হাসি হেসে থামলেন কিষাণ আপ্তে।
দাঁতে দাঁত চেপে আগুনঝরা দৃষ্টি মেলে আমি এগিয়ে গেলাম ক্রসওয়ার্ডের দিকে। বললাম, মিস্টার ক্রসওয়ার্ড, প্লিজ, ফর হেভেন্স সেক–এই হাতকড়াটা কিছুক্ষণের জন্য খুলে দিন।
কী ভেবে ক্রসওয়ার্ড আমার অনুরোধ রাখলেন। আমি ধীরে-ধীরে এগিয়ে গেলাম কিষাণ আপ্তের দিকে। তার সামনে দাঁড়িয়ে বললাম, মিস্টার জেড, আমার নামে কেউ মিথ্যে কথা বললে আমি একেবারে সহ্য করতে পারি না। সুরেন্দ্র পালিত তার স্মৃতিকথায় একটা কথা ঠিকই লিখেছিলেন–তা হল– বলে আমি জেডের কানের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললাম, মানুষ নিজের কান কখনও চেঞ্জ করতে পারে না। পরের মুহূর্তেই এক বিরাশি সিক্কার চড় মেরে তাঁকে মেঝেতে ফেলে দিয়ে বললাম, এটা আপনার মিথ্যে কথা বলার শাস্তি। ক্রসওয়ার্ডের দিকে ফিরে বললাম, ব্যস্ত হবেন না, ইন্সপেক্টর–এই হল আপনাদের ভাষায় দুর্ধর্ষ সমর বর্মন!
অসম্ভব! বলে উঠলেন ক্রসওয়ার্ড।
আমি উত্তরে মৃদু হেসে এগিয়ে গেলাম মেঝেতে পড়ে থাকা আপ্তের দিকে। একটানে তুলে ফেললাম তার পরচুলা আর ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। সানগ্লাসটা খুলে নিতেও ছাড়লাম না।
কিরণ শর্মা এক ফাঁকে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। এই সময় তিনি এসে ঘরে ঢুকলেন। সঙ্গে এক ভদ্রলোক, তার চোখে সবুজ রঙের সানগ্লাস, ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি।
অবাক এ কী কান্ড সব! বললেন নরসিংহ চৌধুরী।
হ্যাঁ, বললেন কিরণ শর্মা, ইনিই হলেন আসল কিষাণ আপ্তে বা এজেন্ট জেড। যাকে আমরা–মানে, আমি আর কাঞ্চনবাবু, একটা পোড়ো বাড়িতে বন্দি অবস্থায় পেয়েছি।
কিন্তু আপনি! অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন সর্বেশ্বর রায়।
অধমের নাম, অরুণ চৌধুরী ফ্রম ক্যালকাটা। পেশায় শার্লক হোমস–মানে, ডিটেকটিভ।
আপনিই! বিস্ময়াপন্ন স্বর বেরিয়ে এল অনেকের গলা দিয়ে।
হ্যাঁ, আমিই। আমি কাঞ্চনবাবুকে সব খুলে বলেছি–উনিই আপনাদের সব বুঝিয়ে বলবেন। আমি কোনওদিন এরকম জটিল রহস্যের মুখোমুখি হইনি।
ক্রসওয়ার্ড এগিয়ে গিয়ে ভূলুণ্ঠিত বর্মনকে দাঁড় করিয়ে হাতকড়া এঁটে দিলেন। বললেন, কিন্তু, মিস্টার চৌধুরী, কুমার রণজিৎকে খুন করল কে? সমর বর্মন?
না। বললাম আমি, সে কথায় পরে আসছি। প্রথম থেকেই বলা যাক সব। শ্রীনরসিংহ যেদিন হোটেলে গিয়ে আমার সঙ্গে পাণ্ডুলিপির ব্যাপারে কথা বলেন, তখন আমি বুঝিনি অন্য উপায় বলতে তিনি কী বলতে চেয়েছিলেন। পরে আমি ফোন পাই মেহেতা অ্যান্ড সন্স থেকে। তারা একজন রিপ্রেজেন্টেটিভ পাঠাচ্ছে পাণ্ডুলিপিটার জন্যে। সন্দেহ হওয়ায়, সঙ্গে-সঙ্গে আমি ফোন করি মেহেতা অ্যান্ড সন্সে। কিন্তু তারা আমাকে জানায় যে, তারা কোনও ফোনই করেনি। আমি তখন আসল পাণ্ডুলিপিটা হোটেল কন্টিনেন্টালের ভলটে রেখে নকল একটা প্যাকেট গজানন শিকদারের হাতে তুলে দিই।
এখনও তা হলে পাণ্ডুলিপিটা আপনার কাছেই আছে? প্রশ্ন করলেন মানেকজি।
হা-হোটেলের ভলটে। সে যাক, এর পরের ব্যাপার আরও ঘোরালো। চিঠিগুলো আমার কাছে থেকে চুরি করেছিল ইব্রাহিম। সে লাল পাঞ্জার হয়ে কাজ করছিল। পরে বোধহয় বেলাইনে চলার জন্যে সে মার্ডার হয়। তখন মার্ডারারকুমারের হত্যাকারী তাদের নির্দেশ দেয় সুচরিতাকে ফাঁসানোর জন্যে। কারণ? কারণ নিশ্চয়ই একটা ছিল।
আমি পুলিশী ঝামেলা এড়ানোর জন্যে ইব্রাহিমের বডি নিয়ে কী করেছি তা আপনারা জানেন। এদিকে ইব্রাহিমের কাছ থেকে চিঠিগুলো চলে যায় হত্যাকারীর হাতে। কিন্তু এর আগে একটা চিরকুটে সে ইব্রাহিমকে তার সঙ্গে কবুতরে দেখা করতে বলেছিল। সম্ভবত সে নেকলেসটা পাচার করতে চেয়েছিল। কিন্তু ইব্রাহিম মারা যাওয়ায় এবং চিরকুটের ব্যাপারটা ভুলে যাওয়ায় ওটা আমার হাতে পড়ে। আমি সেই রাতে কবুতরে আসি এবং কী ঘটেছিল তা আবার বলার বোধহয় দরকার নেই। হত্যাকারী যখন নেকলেসটা লাইব্রেরিতে খুঁজছিল তখন কুমার আচমকাই সেখানে এসে হাজির হন এবং তাকে চিনতে পারেন। সঙ্গে-সঙ্গে হত্যাকারী তাকে গুলি করে। এই নেকলেস নিয়ে এর আগেও একজন অজ্ঞাতপরিচয় লোক খুন হয়েছিল–এই কবুতরেই।
সমর বর্মনের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল হত্যাকারী। এবং প্রথম রাতে যখন বর্মন (আপ্তের পরিচয়ে) লাইব্রেরিতে ঢোকে তখন তার সঙ্গে মার্ডারার ছিল। সে সুচরিতার পাশ কাটিয়ে অন্ধকারেই বেরিয়ে যায়। সুচরিতাকে অরুণ চৌধুরী ইচ্ছে করেই আটকেছিলেন। কারণ, তখনও তিনি জানতেন যে, আসল এজেন্ট জেডই গোপনে তদন্ত করছেন। পরে তিনি বর্মনের ছদ্মবেশটা ধরে ফেলেন শুধু তার কানের জন্যে। আপনারা আসল জেডকে দেখুন–তাঁর কানের লতিটা গালের সঙ্গে লাগানো নয়। অথচ সমর বর্মনের কান লক্ষ করুন কানের লতিটা গালের সঙ্গে লাগানো। সুরেন্দ্র পালিত এই কথাই লিখেছিলেন তাঁর পাণ্ডুলিপিতে।
কিন্তু, কুমারের হত্যাকারী কে? প্রশ্ন করলেন প্রসাদজি।
রানী সুলক্ষণা সেন। কুমার রণজিৎ সেনের বোন অথবা শ্ৰীমতী নয়না কল্যাণী।
অবাক হয়ে সবাই তাকিয়ে রইল আমার দিকে।
মানেকজি কোনওরকমে বললেন, ইমপসিবল!
আমি ওঁর দিকে ফিরে হেসে বললাম, উনি আপনার দূরসম্পর্কের বোন। কিন্তু এখানে আসার আগে কি আপনি ওঁকে কখনও চোখে দেখেছেন?
মানেকজি হতভম্ব হয়ে মাথা নাড়লেন, বললেন, না।
ঠিক তখনই লাফিয়ে উঠল সুচরিতা, মনে পড়েছে, মনে পড়েছে, কাঞ্চন,–সেই রাতে আমি ল্যাভেন্ডারের গন্ধ পেয়েছিলাম–আর নয়না কল্যাণীর গা থেকে কাল ওইরকম গন্ধ পেয়েছি তখন আমার ঠিক মনে পড়েনি।
প্রসাদজি, মনে করে দেখুন যখন গুপ্তপথে আমরা ঢুকেছিলাম, তখন বর্মনের অতিআগ্রহের কথা–। নয়না কল্যাণী নিজেই চেষ্টা করেছিলেন চিঠিগুলো ডিকোড করতে। কিন্তু না পেরে কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিলেন। সে-কথা আপনারা নকল জেডের কাছ থেকে শুনেছেন। কুমারের মৃত্যুর রাতে নয়না কল্যাণীর ঘরেই আলো জ্বলেছিল।
কিন্তু আসল নয়না কল্যাণী গেলেন কোথায়? প্রশ্ন করলেন শ্রীসর্বেশ্বর রায়।
তিনি কবুতরে আসার পথে বদল হয়েছেন। আসল নয়নার বদলে এসেছেন সুলক্ষণা সেন। সুলক্ষণা সেনকে আমি দেখিনি। আমি তখন নেপালে ছিলাম, কিন্তু সুচরিতা তাঁকে দেখেছিল। তাই, ও যদি চিনে ফ্যালে…তাই ওকে কবুতরে আসা থেকে আটকানোর চেষ্টা করা হয়েছিল।
সুলক্ষণা সেন কি বিপ্লবের সময় মারা যাননি? মানেকজি প্রশ্ন করলেন।
না, কারণ তার মৃতদেহ শনাক্ত করা যায়নি। আমি এটা সন্দেহ করেছিলাম। সুলক্ষণা সেন অভিনেত্রী ছিলেন। তিনি তার দাসীর ছদ্মবেশে পালিয়ে বাঁচলেন, আর তার দাসী মারা পড়ে বিপ্লবীদের আগুনে।
এবার একটা কথা বলি–তা হল ঠিকানা লেখা চিরকুটটার কথা। ওটা সমরের পকেট থেকেই পড়েছিল–ওর অজান্তে। আমি ইন্সপেক্টরকে বলেছিলাম কেউ যেন কবুতর ছেড়ে না যায়। তাই বর্মন বেরোতে পারেনি। কিন্তু অরুণ চৌধুরীর পরিচয় ক্রসওয়ার্ড জানতেন। তাই তাকে যেতে দিয়েছিলেন। মিস্টার চৌধুরীও প্রথমে আমাকেই সন্দেহ করেছিলেন।
সুলক্ষণাকে যদি সুচরিতা চিনে ফেলত তবে ওর বিপদ হত, তাই আমি চিঠি দিয়ে ওকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম। আমি একটু অভিনয় করাতে ও দারুণ ভয় পেয়ে গিয়েছিল। আমি সুর দিকে তাকিয়ে হাসলাম।
আপনার আসল পরিচয়টা সবাইকে এবার বলুন, ইয়োর মেজেস্টি। অরুণ চৌধুরী বললেন।
তার মানে! আটটি কণ্ঠস্বর একসঙ্গে বলে উঠল।
আমিই শুদ্ধসত্ত্ব রায়ের ছেলে–অতলান্ত রায়। আমিই রটিয়ে দিয়েছিলাম যে, অতলান্ত রায় নেপালে দুর্ঘটনায় মারা গেছেন।
কিন্তু, কুমার, নেকলেসটা কোথায় গেল? মানেকজি প্রশ্ন করলেন।
গোলাপ বাগানের নীচে। সারি-সারি গোলাপের ইঙ্গিতই ছিল ওই সাঙ্কেতিক চিঠিতে। বললেন অরুণ চৌধুরী।
তোমার পরিচয় আমাকে আগে বলোনি কেন? অনুযোগের সুরে বলল সুচরিতা।
তা হলে আমি অ্যারেস্টেড হতাম। কারণ রণজিতের পর আমিই ছিলাম সিরাজনগরের অধিপতি। হেসে জবাব দিলাম আমি।
রিভলভারটা আমার সুটকেশে তা হলে নয়নাই রেখে দিয়েছিল? সর্বেশ্বর রায় জানতে চাইলেন।
ঘাড় কাত করে সম্মতি জানালাম আমি।
চলুন, এবার মিসেস সেনের খোঁজ নেওয়া যাক। ক্রসওয়ার্ড বললেন।
তাই তো! কারওরই খেয়াল ছিল না কথাটা। সবাই মিলে দৌড়ে গেলাম ওপরে।
গিয়ে দেখলাম নিজের ঘরে নিপ্রাণ দেহে পড়ে আছেন নয়না কল্যাণী।
আত্মহত্যা করেছেন। বললেন কিষাণ আপ্তে।
সম্ভবত মরফিনের সাহায্যে। জানালাম আমি।
.
এরপর হীরের নেকলেসটা খুঁজে পাওয়া গেল গোলাপ বাগান খুঁড়ে। আবার শান্ত হল কবুতর। সুচরিতার সঙ্গে আমার বিয়েটা হয়ে যাওয়ার পরদিন কাগজে দেখি একটি বিজ্ঞাপন।
কবুতর বিক্রি হচ্ছে। উৎসুক ক্রেতারা খোঁজ নিন।
–মানেকজি প্রসাদজি লিমিটেড কোং
যার হাতেই তুমি যাও, তোমার কথা আমার চিরদিন মনে থাকবে কবুতর।
সুচরিতার বুক থেকে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল।