কেদার রাজা (Kedar Raja) : 06
রাত্রে শরতের ভালো ঘুম হল না, অচেনা জায়গা, ভালো ঘুম হবার কথা নয়, দেশের বাড়ি ছেড়ে এসে পর্যন্তই তার ঘুম তেমন হয় না৷ কিন্তু কাল রাত্রে কি জানি কেমন হল, বাবার কথা মনে হয়েই হোক বা অন্য যে কারণেই হোক—শরৎ প্রথম দিকে তো চোখের পাতা একটুও বোজাতে পারে নি৷
প্রভাসের বৌদিদি তার পাশে শুয়ে দিব্যি ঘুমিয়ে পড়ল৷ এত শব্দ এত আওয়াজের মধ্যে মানুষ পারে ঘুমুতে? মোটরগাড়ি যাচ্ছে, লোকজনের কথাবার্তা চলেছে—ভালো রকম অন্ধকার হয় না, জানলা দিয়ে কোথা থেকে আলো এসে পড়েছে দেওয়ালের গায়ে—আর সারারাতই কি লোক-চলাচল করবে আর গান-বাজনা চলবে? এখানে এতও গানবাজনা হয়! ডুগি-তবলার শব্দ, হারমোনিয়মের আওয়াজ, মেয়ে-গলার গান চলেছে আশেপাশের সব বাড়ি থেকে৷ দমদমার বাগানবাড়িতে থাকতে সে বুঝতে পারে নি আসল কলকাতা শহর কি৷ এখন দেখা যাচ্ছে এখানকার তুলনায় দমদমার বাগানবাড়ি তাদের গড়শিবপুরের জঙ্গলের সমান৷
ভোরে উঠে সে গঙ্গাস্নান করে আসবে—এখান থেকে গঙ্গা কতদূর কে জানে? প্রভাসদাকে বললে মোটরে নিয়ে যাবে এখন৷ সকালে প্রভাসের বৌদিদির ডাকে তার ঘুম ভাঙল৷ জানলা দিয়ে রোদ এসে পড়েছে বিছানায়৷ অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়েছে নাকি তবে? ওর মুখে কেমন ধরনের ভয় ও উৎকণ্ঠার চিহ্ন প্রভাসের বৌদিদির চোখ এড়ালো না৷
সে বললে, ভাবনা কি দিদি, দেরিতে উঠেছ, তাই কি—তোমার উঠে আপিস করতে হচ্ছে না তো আর৷ মুখ ধুয়ে নাও, চা হয়ে গিয়েছে—
শরৎ লজ্জিত মুখে জানালে এত সকালে সে চা খায় না৷ তার চা খাওয়ায় কতকগুলো বাধা আছে—স্নান করতে হবে, কাপড় ছাড়তে হবে—সে-সব হাঙ্গামায় এখন কোনো দরকার নেই, থাকগে৷ গঙ্গা এখান থেকে কতদূর? একবার গঙ্গায় নাইতে যাবার বড় ইচ্ছে তার৷ প্রভাসদা কখন আসবে?
প্রভাসের বৌদি বললে, গঙ্গা নাইবে? চল না আমাদের—আচ্ছা, দেখি বোসো৷ ওরা আসুক সব—
—কখন আসবে? আসতে বেশি দেরি করবে না তো প্রভাসদা?
—কি জানি ভাই! তবে দেরি হওয়ার কথা নয় তো, এখুনি আসবে—
—গঙ্গা নেয়ে এসে আমি বাবার কাছে যাব—আমায় রেখে আসুক—
—সে কি ভাই? এ-বেলাটা থাকবে না এখানে? থেকে খাওয়াদাওয়া করে ওবেলা—
শরৎ চিন্তিত মুখে বললে, কাল রাতে গেলাম না, বাবা কত ভেবেছেন৷ আমার কি থাকবার জো আছে যে থাকব?
প্রভাসের বৌদিদি বললে, ওবেলা চলো ভাই সিনেমা দেখে দুজনে—
—কি দেখে?
—সিনেমা—মানে বায়োস্কোপ টকি—
—ও—
—দেখে চলো আমরা যশোর রোড দিয়ে মোটরে বেড়িয়ে আসব৷ চাঁদের আলো আছে—
শরৎ হেসে বললে, মোটে একাদশী গেল বুধবারে, এরই মধ্যে চাঁদের আলো কোথায় পাবেন? আপনারা কলকাতার লোক, আপনাদের সে খবরে কোনো দরকার নেই—ওখানে সারারাতই গ্যাসের আলো—ইলেকট্রিক আলো—
ঈষৎ অপ্রতিভের সুরে প্রভাসের বৌদিদি বললে, তা বটে ভাই, যা বলেছ৷ ওসব খেয়াল থাকে না৷
এমন সময় পাশে কমলাদের ঘর থেকে জড়িত স্বরে কে বলে উঠল—আরে ও হেনা বিবি, এদিকে এসো না চাঁদ, আলোর সুইচটা যে খুঁজে পাচ্ছি নে—ও হেনা বিবি—
প্রভাসের বৌদিদি হঠাৎ খিলখিল করে হেসে উঠে বললে, আ মরণ, বেলা সাড়ে সাতটা বাজে—উনি আলোর সুইচ খুঁজে বেড়াচ্ছেন এখন—
শরৎ বললে, কি হয়েছে, কে উনি?
—কে জানে কে? মাতালের মরণ যত—পাশের বাড়ির এক বুড়ো৷ রোজ ভাই অমনি করে—
শরৎও হেসে ফেললে মাতাল বুড়োটার কথা ভেবে৷ বললে, ডাকছে কাকে? ও যেন পাশের ঘর থেকে কথা বললে বলে মনে হল—না?
—ওই পাশের বাড়ি, দোতলার জানলাটা খোলা রয়েছে দেখছ তো, ওই ঘর৷ দাঁড়াও আসছি—
শরৎ শুনলে বুড়ো মাতালটা হঠাৎ ‘এই যে হেনা বিবি, বলিহারি যাই! বলি সার্সি জানলা বন্ধ করে’—এই পর্যন্ত চেঁচিয়ে বলে উঠেই চুপ করে গেল৷ কে যেন তার মুখে থাবা দিয়ে চুপ করিয়ে দিলে৷ কিছুক্ষণ পরে কমলাও ঘরে ঢুকল৷ শরৎ হাসিমুখে বলে উঠল—এসো ভাই গঙ্গাজল এসো—তোমাকেই খুঁজছি—গঙ্গা নাইতে চলো না কেন যাই সবাই মিলে?
কমলা সত্যিই সুন্দরী মেয়ে৷ ঘুম ভেঙে সদ্য উঠে এসেছে, আলুথালু চুলের রাশ খোঁপার বাঁধন ভেঙে ঘাড়ে পিঠে এলিয়ে পড়েছে, বড় বড় চোখে অলস দৃষ্টি, মুখের ভাবেও জড়তা কাটে নি—বেশ ফর্সা নিটোল হাত দুটি কেমন চমৎকার ভঙ্গিতে ঘাড়ের পেছনে তুলে ধরে এলোচুল বাঁধবার চেষ্টা করছে৷ আসলে বাঁধার ছলে একটা কায়দা মাত্র, চুল বাঁধবার চেয়ে ওই ভঙ্গিটা দেখাবার আগ্রহটাই ওখানে বেশি৷ শরতের হাসি পায়—ছেলেমানুষ কমলা!
শরৎ এসব বোঝে৷ সেও এক সময়ে সুন্দরী কিশোরী ছিল, ওই কমলার মতো বয়সে, সে জানে নিজেকে ভালো দেখানো কত খুঁটিনাটি আগ্রহ অকারণে মেয়েদের মনে জাগে৷ তারও জাগত৷ এসব শিখিয়ে দিতে হয় না, বলে দিতে হয় না মেয়েদের৷ আপনিই জাগে৷ শরতের কেমন স্নেহ হয় কমলার ওপর৷ স্নেহের সুরেই বলে—ভাই, চমৎকার দেখাচ্ছে তোমায় গঙ্গাজল—
—সত্যি?
—সত্যি বলছি৷
কমলার মুখে লজ্জার আভাস নেই, সে যে পথে পা দিয়েছে, সে পথের পথচারিণীরা লজ্জাবতী লতা নয়, বনচাঁড়ালের পাতা—টুসি দিলে নাচে৷ কমলা হেসে বললে, আপনার ভালো লাগে?
—খুব ভাই—খুব—
—তবে তো আমার ভবিষ্যতের পক্ষে ভালো—এদিকে আবার গঙ্গাজল পাতিয়েছি—
কমলার কথার নির্লজ্জ সুর শরতের কানে বাজল৷ সে মনে মনে ভাবলে, মেয়েটি ভালো, কিন্তু অল্পবয়সে একটু বেশি ফাজিল হয়ে পড়েছে৷ আমি ওর চেয়ে কত বড়, মা না হলেও কাকি-খুড়ির বয়িসী—আমার সঙ্গে কেমন ধরনের কথা বলছে দ্যাখো—
কমলা বললে, আপনি চা খেয়েছেন?
শরৎ হেসে বললে, না ভাই, আমি বিধবা মানুষ, নাই নি, ধুই নি—এখুনি চা খাব কি করে? চা খাওয়ার কোনো তাড়াতাড়ি নেই আমার৷ এখন গঙ্গা নাইবার কি ব্যবস্থা হয় বলো তো?
—চলুন না হেঁটে গিয়ে নেয়ে আসি৷ এই তো আহিরীটোলা দিয়ে গেলে সামনেই গঙ্গা—
প্রভাসের বৌদিদি ওদের ঘরের মধ্যে ঢুকতে যাচ্ছিল, এমন সময়ে পেছন থেকে গিরীন ডাকলে—ও হেনা বিবি—
হেনা দাঁড়িয়ে গিয়ে পেছন ফিরে বললে, কখন এলে? কি ব্যাপার? ওদিকে—
গিরীন চোখ টিপে বললে, আস্তে৷
হেনা এবার গলার সুর নিচু করে বললে, কি হল?
—এখনো হয় নি কিছু৷ আমরা এখনো বুড়োর কাছে যাই নি৷ বেশি বেলা হলে যাব৷ এদিকের খবর কি?
হেনা রাগের সুরে বললে, তোমরা আমায় মজাবে দেখছি৷ এখনও সে কিছু খায় নি, এ বাড়ি এসে পর্যন্ত দাঁতে কুটো কাটে নি৷ না খেয়ে ও কতক্ষণ থাকবে, ও আপদ যেখানে পারো বাপু তোমরা নিয়ে যাও৷ আমার টাকা আমায় চুকিয়ে দাও, মিটে গেল গোলমাল৷ না খেয়ে মরবে নাকি শেষটা—তার পর এদিকে হরি সা যা কাণ্ড বাধিয়েছিল! হেনা বিবি বলে ডাকাডাকি! সারারাত কমলির ঘরে বসে মদ খেয়েছে—এই একটু আগে কি চেঁচামেচি৷ মেয়েটা যাই একটু সরল গোছের, কোনোরকমে তাকে বুঝিয়ে দিলাম, পাশের বাড়িতে একটা মাতাল আছে তারই কাণ্ড, বিশ্বাস করেছে কিনা কে জানে—
গিরীন হাসিমুখে বললে, ভয় কি তোমার হেনা বিবি, রাত যখন এখানে কাটিয়েছে তখন ওর পরকাল ঝরঝরে হয়ে গিয়েছে৷ ওর সমাজ গিয়েছে, ধর্ম গিয়েছে৷ ওর বাবার কাছে সেই কথাই বলতে যাচ্ছি—
—কি বলবে?
—সে-সব বুদ্ধি কি তোমাদের আছে? গিরীনের কাছ থেকে বুদ্ধি ধার করে চলতে হয় সব ব্যাটাকে৷
—গালাগাল দিয়ো না বলছি—
—গালাগাল তোমাকে তো দিই নি হেনা বিবি, চটো কেন? তার পর শোনো৷ সন্দে অবধি রেখে দাও৷ সন্দের আগে আবার আমরা আসব৷
—টাকা নিয়ে এসো যেন৷
—অত অবিশ্বাস কিসের হেনা বিবি? নতুন খদ্দেরের কাছে তাগাদা করো, আমাদের কাছে নয়৷
—আচ্ছা, কথায় দরকার নেই—যাও এখন৷ আমি দেখি গে, কমলিটা ছেলেমানুষ—কি বলতে কি বলে বসে—ওকে সামলে নিয়ে চলতে হচ্ছে আবার—
হেনা ঘরে ঢুকে দেখলে শরৎ ও কমলা চুল খুলে তেল মাখতে বসেছে৷ বললে—ও কি? নাইতে যাবে নাকি ভাই?
কমলা বললে, গঙ্গাজলকে নিয়ে নেয়ে আসি—
হেনা প্রশংসার দৃষ্টিতে শরতের সুদীর্ঘ কালো কেশপাশের দিকে চেয়ে বললে, কি সুন্দর চুল ভাই তোমার মাথায়! এমন চুল যদি আমাদের মাথায় থাকত—
কমলা বললে, আমিও তাই বলছিলাম গঙ্গাজলকে—
শরৎ সলজ্জ স্বরে বললে, যান, কি যে সব বলেন! গঙ্গাজলের মাথায় চুল কি কম সুন্দর? দেখুন দিকি তাকিয়ে? তা ছাড়া আমার লম্বা চুলের কি দরকার আছে ভাই? বাবা কিছু পাছে মনে করেন তাই—নইলে ও চুল আমি এতদিন বঁটি দিয়ে কেটে ফেলতাম৷ শুধু বাবার মুখের দিকে চেয়ে পারি নে৷ তাঁর চোখ দিয়ে যাতে জল পড়ে, তাতে আমার ধর্ম নেই৷
হেনা এ পথের পুরাতন পথিক, তার মন কোমল হৃদয়-বৃত্তির ধার ধারে না অনেক দিন থেকে—যা কিছু ছিল তাও পাষাণ হয়ে গিয়েচে চর্চার অভাবে, শরতের কথায় তার মনে বিন্দুমাত্র রেখাপাত হল না—কিন্তু কমলা মুগ্ধ দৃষ্টিতে ওর মুখের দিকে চেয়ে রইল৷
হেনা বললে, কমলা, এঁকে গঙ্গায় নিয়ে যাবি? কেন, বাড়িতে চান করে না? বেলা হয়ে যাবে!
শরতের দিকে চেয়ে বললে, সে তুমি যেয়ো না ভাই, ও ছেলেমানুষ, পথ চেনে না—কোথায় যেতে কোথায় নিয়ে যাবে!
কমলা বললে, বা রে, আমি বুঝি আর—সেবার তো আমি—
হেনা কমলাকে চোখ টিপে বললে, থাম বাপু তুই৷ তুই ভারি জানিস রাস্তা-ঘাট৷ তার পর দিদিকে নিয়ে যেতে একটা বিপদ হোক রাস্তায়! যে গুণ্ডা আর বদমাইশের ভিড়—
শরৎ বললে, সত্যি নাকি ভাই, বলুন না?
—আমি কি আর মিথ্যে কথা বলছি—ও ছেলেমানুষ, কি জানে?
এইবার কমলা বললে, না—তা—হ্যাঁ আছে বটে৷
—কি আছে ভাই গঙ্গাজল?
কমলাকে উত্তর দেওয়ার সুযোগ না দিয়েই বললে, কি নেই কলকাতা শহরে বলতে পারো? সব আছে৷ আজকাল আবার সোলজারগুলো ঘুরে বেড়ায় সর্ব জায়গায়৷
—সে আবার কি?
—সোলজার মানে গোরা সৈন্য৷ এরা যে অঞ্চলে আছে, তার ত্রিসীমানায় মেয়েমানুষের যাওয়া উচিত নয়৷ না, তুমি যেয়ো না ভাই৷ আমি তোমায় যেতে দিতে পারি নে৷ তোমার ভালো-মন্দর জন্যে আমি দায়ী যখন৷ প্রভাস-ঠাকুরপো আমার হাতে তোমায় যখন সঁপে দিয়ে গিয়েছে৷
কমলা বললে, আমরা তেল মাখলাম যে!
—তেল মেখে বাড়ির বাথরুমে ওঁকে নিয়ে চান করো৷ মিছিমিছি কেন ওঁকে বিপদের মধ্যে নিয়ে যাওয়া?
আড়ালে নিয়ে গিয়ে কমলাকে হেনা খুব বকলে৷ প্রভাসের কাছ থেকে সেও টাকা নেবে যখন, তখন এতটুকু বুদ্ধি নিয়ে কাজ করলে কি চলে না? বাড়ির মধ্যেই ওকে ধরে রাখা যাচ্ছে না, একবার বাইরের রাস্তায় পা দিলে আর সামলানো যাবে না ওকে৷ এত কম বুদ্ধি কেন কমলার! হরি সা লোকটাকে কাল রাত্রে ঘর থেকে তাড়িয়ে দিলে কি কোম্পানির রাজ্য অচল হত? সামলে না নিলে সব কথা ফাঁস হয়ে যেত যে আর একটু হলে! ঘটে বুদ্ধি হবে কবে তার?…ইত্যাদি৷
কমলা গুরুজন-কর্তৃক-তিরস্কৃতা-বালিকার ন্যায় চুপ করে রইল৷
হেনা বললে, তুমি আর ওঘরে যেয়ো না৷ আমি করছি যা করবার—তুমি যাও৷ হরি সা যেন এখন আর না ঢোকে—
হেনা ঘরে ঢুকে শরৎকে বললে, গঙ্গায় যাওয়া হবে না ভাই৷ পথে আজকাল বড় গোলমাল, তুমি বাথরুমে নেয়ে নাও, আমি সব যোগাড় করে রেখে এলাম—
স্নান করে আসবার কিছু পরে হেনা শরৎকে বললে, তোমার খাওয়ার কি করব ভাই? আমাদের রান্না চলবে না তো?
—আমার খাওয়ার জন্যে কি ভাই! দুটো আলোচাল আনুন, ফুটিয়ে নেব৷
—মাছমাংস চলে না—না? গাঁ থেকে এসেছ, এখন চলুক না, কে আর দেখতে আসছে ভাই?
প্রভাসের বৌদিদির এ কথায় শরৎ বিস্মিত হয়ে ওর মুখের দিকে চেয়ে রইল৷ ব্রাহ্মণের ঘরের মেয়ে নয় বটে, কিন্তু হিন্দু তো—সে একজন ব্রাহ্মণের বিধবাকে একথা বলতে পারলে কি করে? অন্য জায়গায় এ ধরনের কথা বললে শরৎ নিজেকে অপমানিতা বিবেচনা করত, তবে এরা কলকাতার লোক, এদের কথা স্বতন্ত্র৷
হেনা মনে মনে বললে, বাপ রে, দেমাক দ্যাখো আবার! কথা বলেছি তো ওঁর গায়ে ফোস্কা পড়েছে! তোমার দেমাক আমি ভাঙব, যদি দিন পাই—কত দেখলাম ওরকম, শেষ পর্যন্ত টিকল না কোনোটা!
শরৎ বিকেল থেকে কেবল দমদমায় ফেরবার জন্যে তাগাদা করতে লাগল৷ হেনা ক্রমাগত বুঝিয়ে রাখে, ওরা এখনো আসছে না, এলেই পাঠিয়ে দেবে৷ শরৎ তো জলে পড়ে নেই—এর জন্যে ব্যস্ত কি?
কমলার দেখা নেই অনেকক্ষণ ধরে৷ শরৎ বললে, গঙ্গাজল কই, তাকে দেখছি নে—
হেনা কমলাকে সরিয়ে দিয়েছিল, কাঁচা লোক, কখন কি বলে বসবে, করে বসবে,—সব মাটি হবে৷ তা ছাড়া কমলার ঘরে এমন সব জিনিসপত্র আছে, যা দেখলে শরতের মনে সন্দেহ হতে পারে৷ হরি সা’র একটা বিছানা, আলমারিতে তার দাড়ি কামানোর আসবাব, বড় নল লাগানো গড়্গড়া ইত্যাদি৷ মদের বোতলগুলো না হয় পাড়াগাঁয়ের মেয়ে না বুঝতে পারলে—কিন্তু পুরুষের বাসের এসব চিহ্নের জবাবদিহি দিয়ে মরতে হবে হেনাকে!
বিকেলের দিকে হেনা বললে, চলো ভাই, টকি দেখে আসি—
—সে কোথায়?
—চৌরঙ্গীতে চলো, শ্যামবাজারে চলো—
—বাবার কাছে কখন যাবে? ওরা কখন আসবে?
—চলো, টকি দেখে দমদমায় তোমায় রেখে আসব—
শরৎ তখুনি রাজি হয়ে গেল৷ টকি দেখবার লোভ যে তার না হয়েছিল তা নয়৷ বিশেষ করে টকি দেখেই যখন বাবার কাছে যাওয়া হচ্ছে তখন আর গোলমাল নেই এর ভেতর৷
কিন্তু হেনার আসল উদ্দেশ্য কোনো রকমে ওকে ভুলিয়ে রাখা৷ টকি দেখবার জন্যে গাড়ি ডাকতে গিয়েছে বলে দেরি করিয়ে সে প্রায় সন্ধ্যা করে ফেললে৷ শরৎ ব্যস্ত হয়ে কেবলই তাগাদা দিতে লাগল—কখন গাড়ি আসবে, কখন যাওয়া হবে৷ হেনাও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল, এদের কারো দেখা নেই—পোড়ারমুখো গিরীনটা লম্বা লম্বা কথা বলে, তারও তো চুলের টিকি দেখা যাচ্ছে না, গিয়েছে সেই সকাল বেলা! যা করবি করগে বাপু, টাকাটা মিটিয়ে দিয়ে এ আপদ তোরা যেখানে পারিস নিয়ে যা, তার এত ঝঞ্ঝাটে দরকার কি? এদিকে একে আর বুঝিয়ে রাখা যায় না৷
সন্ধ্যার পরে গিরীন এসে নীচের তলায় হেনাকে ডেকে পাঠালে৷
হেনা তাড়াতাড়ি নেমে এসে বললে, কি ব্যাপার জিজ্ঞেস করি তোমাদের? আমার ঘাড়ে যে চাপিয়ে দিয়ে গেলে এখন আমি করি কি? ও যে থাকতে চাইছে না মোটে৷ কোথায় নেবে নিয়ে যাও না, আমি কতকাল ভুলিয়ে রাখব? আমার থিয়েটার আছে কাল৷ কাল ওকে কার কাছে রাখব? ওদিকে কদ্দূর করলে?
গিরীন তুড়ি দিয়ে গর্বের সুরে বললে, সব ঠিক৷
—কি হল?
—বুড়োকে ভাগিয়েছি৷ সে বলব এখন পরে৷ সে পুঁটুলি নিয়ে বুঝলে—হি-হি-হি—
—কি বলো না?
—পুঁটুলি নিয়ে ভেগেছে, হি-হি—ঝি চিঁড়ে আনতে গিয়েছে আর সেই ফাঁকে হি-হি—পুলিসের এ্যায়সা ভয় দেখিয়ে দিইছি, বুড়োটা আর এমুখো হবে না!
—বেশ, এখন নিয়ে যাও—
—দ্যাখো, ওকে একটু ভুলোও-টুলোও৷ পাড়াগাঁয়ে গরিব ঘরে থাকত, সুখ আমোদ-আহ্লাদের মুখ দেখে নি৷ গয়নাগাঁটি কাপড়-চোপড়ের লোভ দেখাবে—
—ওরে বাপ রে, বলেছি তো ও মেয়ে তেমন না৷ একটুখানি মাছমাংস খাওয়ার কথা বলেছিলাম তো অমনি ফোঁস করে উঠল—আর কেবল হা বাবা যো বাবা—
—তবে আর তোমার কাছে দিয়েছি কেন হেনা বিবি? পাকা লোকের কাছে রেখেছি, আজ রাতটা রেখে দাও, রেখে যা পারো করো৷ আজ আর নিয়ে যাই কোথায়? এখনো কিছু ঠিক করি নি৷ প্রভাসের বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, প্রভাস বাড়ি থেকে বেরুতে পারছে না৷ অরুণ আজ নাইট-ডিউটি করবে আপিসে৷ আমি একা—
—কেন, তুমি একাই একশো বলে যে বড্ড গোমর করো! লম্বা লম্বা কথা বলবার সময় হেন করেঙ্গা, তেন করেঙ্গা—এখন কাজের সময়ে হেনা বিবি তুমি করো৷ আরও টাকা চাই তা বলে দিচ্ছি—
—যাহোক, যা বললাম আজকার রাতটা তো রাখো—
—ও টকি দেখতে যাবে বলছিল, নিয়ে যাব?
—দরকার নেই৷ বাড়ির বার করবার হ্যাঙ্গামা অনেক৷ ভুলিয়ে রাখো৷
—কাল সকালে এসো বাপু৷ কাল আমার থিয়েটার, আমার দ্বারা কাল কোনো কাজ হবে না বলে দিচ্ছি—
হেনা মুখ চুন করে শরতের কাছে এসে দাঁড়িয়ে বললে, বড় মুশকিল! প্রভাস-ঠাকুরপোর বাবার বড় অসুখ, এখন যান তখন যান! হঠাৎ অসুখ হয়ে পড়েছে—এই মাত্তর খবর দিয়ে পাঠিয়েছে৷
শরৎ উদ্বেগের সুরে বললে, অসুখ! তা বয়সও তো হয়েছে—বাবা বলেন তাঁর চেয়ে দশ-বারো বছরের বড়!
—তা তো বুঝলুম৷ এদিকে এখন উপায়!
—আজ কি দমদমা যাওয়া হবে না?
—কি করে আর যাওয়া হচ্ছে বলো ভাই৷ প্রভাস-ঠাকুরপোর গাড়ি পাওয়া যাচ্ছে না তো—
—কেন ভাড়াটে গাড়ি?
—কে নিয়ে যাবে? তুমি আমি দুই মেয়েমানুষ, ভাড়াটে গাড়িতে ভরসা করে যাওয়া চলবে না৷ কাল সকালেই যা হয় ব্যবস্থা হবে৷
শরৎ অগত্যা রাজি হল৷ না হয়ে উপায় যখন নেই৷
সন্ধ্যার পরে শরৎকে সঙ্গে নিয়ে হেনা গিয়ে ছাদে উঠল৷ চারদিকে আলোর কুরকুট্টি, নিচের রাস্তা দিয়ে সারবন্দী গাড়ি ঘোড়া, মোটর, কর্মব্যস্ত জনস্রোত, ফিরিওয়ালারা কত কি হেঁকে যাচ্ছে, বেলফুলের মালাওয়ালা ‘চাই বেলফুলের গোড়ে’ বলে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে হাঁকছে, শরৎ মুগ্ধ চোখে চেয়ে চেয়ে দেখলে৷
বললে, সত্যি শহর বটে কোলকাতা! জায়গার মতো জায়গা একথা ঠিক! কি লোকজন, কি আলোর বাহার! আমাদের গাঁ এতক্ষণ অন্ধকার হয়ে ঝিঁ ঝিঁ ডাকছে জঙ্গলে৷
হেনা অবসর বুঝে অমনি বললে, আমিও তো তাই বলি, এখানেই কেন থেকে যাও না? সব বন্দোবস্ত করে দিচ্ছি, সুখে থাকবে, খাও-দাও, আমোদ-আহ্লাদ করে বেড়াও—
শরৎ হেসে বললে, তা তো বুঝলাম৷ আমার ইচ্ছে করে না যে তা নয়, কিন্তু চলবে কি করে? বাবা গরিব মানুষ—
হেনা উৎসাহের সুরে বললে, সব বন্দোবস্ত হয়ে যাবে এখন৷ তুমি রাজি হয়ে যাও ভাই—
—কি বন্দোবস্ত হবে? বাবার চাকরি করে দিতে পারা যায় যদি, তবে সব হয়৷ গড়শিবপুরের জঙ্গলে থেকে আমার প্রাণও হাঁপিয়ে উঠেছে—দুদিন এখানে থেকে বাঁচি—
—বেশ কথা তো! কলকাতার মতো জায়গা আছে ভাই—এখানে নিত্য আমোদ, লোকজন—ইচ্ছে হল আজ শিবপুরে কোম্পানির বাগানে বেড়াতে গেলাম—ইচ্ছে হল আজ জু’তে গেলাম—
—সে আবার কি?
—মানে চিড়িয়াখানা৷ যখন যেখানে যেতে চাও গেলে, যা খাবার ইচ্ছে হয় খেলে, এই তোমার বয়েস, হেসে খেলে যদি এখন না বেড়ালে তবে কবে আর কি করবে? মানব-জীবনে এই সবই তো আসল৷ জঙ্গলে থাকলাম আর আলোচাল খেলাম—এজন্যে কি আসা জগতে?
—কি করব বলুন! অল্প বয়সে কপাল পুড়েছে যখন, তখন কি আর উপায় আছে—ব্রাহ্মণের ঘরের মেয়ের? বাবাও টাকার মানুষ নন যে কলকাতায় বাসা করে রাখবেন৷
—তুমি ইচ্ছে করলেই সব হয়৷ কলকাতায় থাকতে চাও, বাসা কেন—খুব ভালো ভাবে থাকতে পারবে এখন—স্টাইলে থাকবে৷ রেডিয়ো রাখবে এখন বাড়িতে—
—সে কি?
—বেতার৷ ওই শোনো বাজছে—ওই যে দোকানের সামনে লোক জমেছে? গান গাইছে না? তার পর গ্রামোফোন মানে কলের গান—
—জানি৷
—সে কলের গান রাখো—মোটর পর্যন্ত হয়ে যাবে৷ আজ এখানে বেড়াও, কাল ওখানে বেড়াও ইচ্ছে হল আজ কাশী বেড়াতে যাবে, কাল এলাহাবাদ কি দার্জিলিং বেড়াতে যাবে—
শরৎ হি-হি করে হেসে উঠে বললে, আপনি যে রূপকথার গল্প আরম্ভ করে দিলেন দেখছি! আমি মুখে বললেই সব হবে—এ যেন সেই আরব্য উপন্যাসের দৈত্যের—যাক গে, সত্যি হোক না হোক—ভেবে তো নিলাম—বেশ লোক কিন্তু আপনি!
—আমি মোটেই গল্পকথা বলি নি ভাই৷ আপনি ইচ্ছে করলেই হয়—
—আমি কি আর ইচ্ছে করলে বাবার চাকরি করে দিতে পারি? অবিশ্যি আমিও বুঝতে পারি, বাবার যদি থিয়েটারে চাকরি হয় তবে সব হয়৷ বাবা যে কি চমৎকার বেহালা বাজান, সে আপনি শোনেন নি—কলকাতার থিয়েটারে সে-রকম পেলে লুফে নেয়৷ যেমনি বাজান, তেমনি গাইতে পারেন৷
হেনার হাসি পাচ্ছিল৷ পাড়াগেঁয়ে একটা বুড়ো এমন বেহালা বাজায় যে তাকে কলকাতার বড় থিয়েটারে লুফে নিয়ে এত টাকা মাইনে দেবে যে তাতে ওদের বাড়ি, গাড়ি, জুড়ি, ঢাক, ঢোল সব হয়ে যাবে! শোনো কথা! বাঙাল কি আর গাছে ফলে?
হেনা চুপ করে ভাবলে৷ আর বেশি বলা কি উচিত হবে একদিনে? অনেকদূর সে এগিয়েছে—অনেক কথা বলে ফেলেছে৷ মাগী কি সত্যিই বোঝে না—না ঢং করছে? কিন্তু যদি সত্যি ও বুঝতে পেরে থাকে তার কথার মর্ম—তবে আর না বলাই ভালো৷ ভয় করে বাবা, এখনি ফোস করে উঠে একটা কাণ্ড বাধিয়ে তুলতে পারে! বাঙালনীকে বিশ্বাস নেই৷
শরৎ বললে, কই বললেন না, আমি ইচ্ছে করলে কি করতে পারি?
এ কথার জবাবে হেনা খপ করে বলে ফেললে, তুমি বুঝতে পারছ না ভাই, সত্যিই আমি কি বলছি?
এই পর্যন্ত বলেই হেনার হঠাৎ বড় ভয় হল৷ চোখ বুঝে সমুদ্রে ঝাঁপ দেওয়ার দরকার নেই—আপাতত সাহসও নেই তার৷ কথা সামলে নেবার জন্যে সঙ্গে সঙ্গে একই নিশ্বাসে সে কণ্ঠস্বরকে লঘু ও হাস্য-তরল করে এনে বললে, বুঝলে এবার? একটু ঠাট্টা করছি তোমায়৷ তাই কি কখনো হয়? তুমি আমি বললে কি হবে বলো—এমনি বলছিলাম৷ চলো নীচে যাই—রাত্রে কি খাবে?
—কিছু না৷ আমি কিছু খাইনে রাত্রে৷
—বেশ, একটু দুধ একটু মিষ্টি খেতে আপত্তি আছে?
—আমি কিছুই খাব না, আপনি ব্যস্ত হবেন না৷
হেনা মনে মনে বললে, তুমি না খেয়ে মরো না, আমার কি? এমন একগুঁয়ে বালাই যদি আর কখনো দেখে থাকি! যা বলবে তাই, ‘না’ বললে ‘হাঁ’ করাবার জো নেই!
এই সময় নীচের তলায় খুব একটা চেঁচামেচি শোনা গেল৷ কে জড়িত স্বরে চিৎকার করছে, কে গালাগালি করছে৷
শরৎ ভীতমুখে বললে, ওকি ভাই? কে চেঁচাচ্ছে? আমাদের বাড়িতে না?
হেনা পাংশুমুখে বললে, না, ও আমাদের বাড়ি নয়৷
হরি সা মদ খেয়ে কমলার ঘরে ঢুকে নিত্যকার মতো উপদ্রব শুরু করেছে৷ সর্বনাশ!
এই সময় নীচে মারধরের শব্দ শোনা গেল৷ এও নতুন নয়, হরি সা মদ খেয়ে এসে কমলাকে ঠেঙায় মাঝে মাঝে—পয়সার খাতিরে গায়ের কালশিরে ঢেকে আবার হাসতে হয় কমলাকে৷ কিন্তু—
শরৎ ব্যস্ত হয়ে বললে, না, দেখুন, আমাদের বাড়িতে নীচের ঘরেই৷ কমলার ঘরের দিকে মনে হচ্ছে৷ যান যান, আপনি শীগগির যান—দেখুন—চলুন যাই আমরা৷ কে হয়তো বদমাইশ ঘরে ঢুকেছে—
চেঁচামেচি বাড়ল৷ আর রক্ষা হল না৷ হরি সা গর্দভের মতো চেঁচানি জুড়েছে৷ হরি সা যে একদিন মাটি করে দেবে সব, হেনা তা জানত৷ সেই লম্বা কথাওয়ালা গিরীন এই সময় আসুক না দেখা যাক৷
কমলার গলার কান্না মেশানো আর্ত সুর শোনা গেল—ও দিদি, তোমরা এসো, আজ আমায় মেরে ফেললে মুখপোড়া—আর পারি নে দিদি—উঃ, আর রক্ষা হয় না৷
তবুও অ্যাকট্রেস হেনা মরীয়া হয়ে শেষ চাল চাললে৷ মুখে দিব্যি শান্ত হাসি এনে বললে, ও আমাদের বাড়ি না, পাশের বাড়ির সেই বুড়ো মাতালটা৷ ছাদ থেকে মনে হয় যেন আমাদের বাড়ি৷ রোজই শুনছি৷ যাবেন না নীচে—জানলা দিয়ে ওদের ঘরটা দেখা যায় কিনা, আমাদের দেখলে আবার গালাগালি করবে৷ আমি তো এ সময় সিঁড়ি দিয়ে নামি নে—