কেদার রাজা (Kedar Raja) : 15
শরৎ কাঠের পুতুলের মতো স্তব্ধ হয়ে বসে রইল কতক্ষণ৷ এখন সে কি করবে? গড়শিবপুরের রাজবংশে সে কি অভিশাপ বহন করে এনেছে, তার বংশের নাম বাবার নাম ডুবতে বসেছে আজ তার জন্যে!
মানুষ এত খারাপও হয়!
এই পল্লীগ্রামের বনে বনে হেমন্তকালের কত বনকুসুম, লম্বা লতার মাথায় থোবা থোবা মুকুল ধরেছে বন্য মাখম-সিম ফুলের শিউলির তলায় খই-ছড়ানো শুভ্র পুষ্পের সমারোহ, সুমুখ জ্যোৎস্নারাতের প্রথম প্রহরে ছাতিমবনের নিবিড়তায় চাঁদের আলোর জাল-বুনুনি, ছাতিম ফুলের সুবাস—এ সবের আড়ালে লুকিয়ে আছে প্রভাসের মতো, বটুকের মতো ভয়ানক প্রকৃতির লোক, যাদের অসাধ্য কাজ নেই, যাদের ধর্মাধর্ম জ্ঞান নেই! এত কষ্ট দিয়েও ওদের মনোবাঞ্ছা মিটল না? এতদিন পরে আবার এখানেও এসে জুটল তার জীবনে আগুন জ্বালাতে?
আচ্ছা সে কি করেছে যার জন্যে তার এত শাস্তি?
সে কি জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে কিছু করেছে? সে কি স্বেচ্ছায় কমলাদের পাপপুরীর মধ্যে ঢুকেছিল? হতে পারে সে নির্বোধ, কিছু বুঝতে পারে নি, অত খারাপ কাউকে ভাবতে পারে নি বলেই তার মনে কোনো সন্দেহ জাগে নি৷ সন্দেহ সত্যই জাগলো, তখন ওরা তো তাকে বেরুতে দিল না৷ অথচ সে যদি সব কথা খুলে বলে গ্রামে, কেউ তাকে বিশ্বাস করবে না৷
প্রভাসের ও গিরীনের বদমাইশির কথা শুনে ওদের কেউ শাস্তি দেবে না? ভগবান সত্যের দিকে দাঁড়াবেন না?
না হয় সে কালোপায়রা দিঘির জলে ডুবে মরে বাবার ও বংশের মুখ রক্ষা করবে৷ তা সে এখুনি করতে পারে—এই দণ্ডে!
শুধু পারে না বাবার মুখের দিকে চেয়ে৷
আচ্ছা সে শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে দু’দিনের জন্যে? টুঙি-মাজদে গ্রামে খুড়শাশুড়ির আশ্রয়ে এখন থাকবে গিয়ে কিছুদিন? কার সঙ্গে পরামর্শ করা যায়? জ্যাঠামশায় বা বাবাকে এসব কথা বলতে বাধে৷
তার চেয়ে জলে ডুবে মরা সহজ৷
সকলে মিলে অমনভাবে তাকে যদি জ্বালাতন করে, বনের মেটে আলু, বুনো সিম-ভাতে-ভাত এক বেলা খেয়েও যদি শান্তিতে থাকতে না দেয়, তবে মায়ের মুখে শোনা তারই বংশের কোন পুরনো আমলের রানীর মতো—তারই কোন অতি-বৃদ্ধ প্রপিতামহীর মতো নিজের মান বাঁচাবার জন্যে কালোপায়রা দিঘির শীতল জলের তলায় আশ্রয় নিয়ে সব জ্বালা জুড়ুতে হবে, যদি তাতে হতভাগারা শান্তিতে থাকতে দেয়৷….চোখের জলে শরতের গালের দু-পাশ ভেসে গেল৷
কতক্ষণ পরে তার যেন হুঁশ হল—কত বেলা হয়েছে! রান্না চড়ানো হয় নি—বাবা জ্যাঠামশায় এসে ভাত চাইবেন এখুনি!
উঠে সে স্নান করে এল—তেল আগেই মেখে বসে ছিল, বটুক আসবার আগেই৷
রান্না চড়িয়ে দিয়ে আবার সে ভাবতে বসল৷ সব সময়েই ভাবছে, বটুক চলে যাবার পর থেকে৷ কতবার চোখের জল গড়িয়ে পড়েছে, কতবার অঁচল দিয়ে মুছেছে—কি সে করে এখন?
তার কি কেউ নেই সংসারে?
কেউ তার দিকে দাঁড়িয়ে, তার হয়ে দুটো কথা বলবে না? প্রভাস ও গিরীন যদি তার নামে কুৎসা রটিয়ে দেয় গ্রামে, তবে তাদের কথাই সবাই সত্য বলে মেনে নেবে? তার কথা কেউ শুনবে না?
এমন সময় কেদার ও গোপেশ্বর এসে পৌঁছে গেলেন৷
তাঁরা মুখুজ্জে-বাড়ির জামাই সোমেশ্বরের কাছে নতুন রাগিণীর সন্ধানে গিয়েছিলেন, বোধ হয় খানিকটা কৃতকার্যও হয়েছেন, তাঁদের মুখ দেখলে সেটা বোঝা যায়৷
গোপেশ্বর খেতে খেতে বললেন—গলাটা ভালো লোকটার৷
—বেশ৷ ভৈরবীখানা গাইলে বড় চমৎকার—অবরোহীতে একবার যেন ধৈবৎ ছুঁয়ে নামল—
—না না, আমার কানে তো শুনলাম না৷ কোমল ধৈবৎ তো লাগবেই অবরোহীতে—
—সেটা আমার খুব ভালো জানা আছে—শুনবে? এই শোন না—আচ্ছা খেয়ে উঠি৷ অবরোহীতে কোমল নিখাদ, তার পরেই কোমল ধৈবৎ আসছে৷ যেমন—
শরৎ বললে, বাবা খেয়ে নাও দিকি! এর পর ওর অনেক সময় পাবে—
—এটা কিসের চচ্চড়ি মা?
—মেটে আলু৷ রাজলক্ষ্মী আর আমি তুলে এনেছিলাম আজ ওই বনের দিক থেকে—
—রাজলক্ষ্মী এসেছিল নাকি?
—কতক্ষণ ছিল৷ এই তো খানিকটা আগে গেল—
—ওর বিয়ের কথা শুনে এলাম কিনা—তাই বলছি—
—আমার সঙ্গে অত ভাব, ও চলে গেলে গাঁয়ের আর কেউ এদিকে মাড়াবে না৷ ওকে একটা কিছু দিতে হবে বাবা—
—কি দিবি?
—তুমি বলো বাবা—
—আমি ওসব বুঝি নে৷ যা বলবি, কিনে এনে দেব—ওসব মেয়েলি কাণ্ডকারখানার আমি কোনো খবর রাখি নে—
আহারান্তে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে দুজনে হাটে চলে গেলেন, আজ পাশের গ্রামে হাট৷ পূর্বে হাট ছিল না, দুই জমিদারে বাদাবাদির ফলে আজ বছরখানেক নতুন হাট বসেছে৷ হাটের খাজনা লাগে না বলে কাপালিরা তরিতরকারি নিয়ে জমা হয়—সস্তায় বিক্রি করে৷
অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম সপ্তাহ শেষ হয়ে দ্বিতীয় সপ্তাহ পড়েছে, অথচ এবার শীত এখনও তেমন পড়ে নি৷ বাবা ও জ্যাঠামশায় চলে গেলে শরৎ রোদে পিঠ দিয়ে বসে আবার সেই একই কথা ভাবতে লাগল৷
গড়ের খাল পার হয়ে দেখা গেল রাজলক্ষ্মী আসছে৷ ওর জীবনে যদি কেউ সত্যিকার বন্ধু থাকে তবে সে রাজলক্ষ্মী, ও এলে যেন বাঁচা যায়, দিন কাটে ভালো৷
রাজলক্ষ্মী আসতে আসতে বললে, আজ একটু শীত পড়েছে শরৎদি—না?
—আয় আয়, তোর কথাই ভাবছি—
—কেন—
—তুই চলে গেলে যেন ফাঁকা হয়ে যায়, আয় বোস—
শরৎ ভাবছিল বটুকের কথাটা বলা উচিত হবে কিনা৷ কিন্তু তা হলে অনেক কথাই ওকে এখন বলতে হয়—রাজলক্ষ্মী তাতে কিছু যদি মনে করে সব শুনে? শরৎ তাহলে মরে যাবে—জীবনের মধ্যে দুটিমাত্র বন্ধু সে পেয়েছে—অন্ধ রেণুকা আর এই রাজলক্ষ্মী৷ এদের কাউকে সে হারাতে প্রস্তুত নয়৷
আর একটি মেয়ের কথা মনে হয়—হতভাগিনী কমলার কথা—কে জানে সেই পাপপুরীর মধ্যে কি ভাবে সে দিন কাটাচ্ছে?
সরলা শরৎ জানত না—পাপে যারা পাকা হয়ে গিয়েছে, তারা পাপপুণ্য বলে জ্ঞান অল্প দিনেই হারিয়ে ফেলে, পাপে ও বিলাসে মত্ত হয়ে বিবেক বিসর্জন দেয়৷ কোনো অসুবিধাতে আছে বলে নিজেকে মনে করে না৷ পুণ্যের পথই কণ্টকসঙ্কুল, মহাদুঃখময়—পাপের পথে গ্যাসের আলো জ্বলে, বেলফুলের গড়েমালা বিক্রি হয়, গোলাপজলের ও এসেন্সের সুগন্ধ মন মাতিয়ে তোলে৷ এতটুকু ধুলোকাদা থাকে না পথে৷ ফুলের পাপড়ির মতো কোঁচা পকেটে গুঁজে দিব্যি চলে যাও৷
রাজলক্ষ্মী বললে, দিন ঘনিয়ে এল, তাই তো তোমায় ছাড়তে পারি নে—
—হুঁ—
—কি ভাবছ শরৎদি?
শরৎ চমক ভেঙে উঠে বললে—কই না—কিছু না৷ হ্যাঁরে, তুই আশাদিদির বরের গান শুনেছিস? খুব নাকি ভালো গায়? বাবা আর জ্যাঠামশায় সেখানে ধন্না দিয়ে পড়ে আছেন আজ ক’দিন থেকে৷ দিন দশেক থেকে দেখছি—
—ও, তাই শরৎদি—মুখুজ্জে-বাড়ির দিকে যেতে দেখেছি বটে ওঁদের আজ সকালে—
—রোজ সেখানে পড়ে আছেন দুজনে—কি সকাল, কি বিকেল—কেমন গান গায় রে লোকটা?
—হিন্দী-মিন্দি গায়—কি হা-হা করে, হাত-পা নাড়ে, আমার ও ভালো লাগে না৷
দুজনে সন্ধার পূর্ব পর্যন্ত গল্প করলে, সন্ধার আগে প্রতিদিনের মতো রাজলক্ষ্মী চলে গেল, শরৎ এগিয়ে দিতে গেল৷ অল্প অল্প অন্ধকার হয়েছে, ভারি নির্জন গড়বাড়ির জঙ্গল৷ শরৎ ভয় পায় না একটুও, বরং এতকাল পরে তার বড় ভালো লাগে৷ এসব জিনিস তার হারিয়ে গিয়েছিল, আবার সে ফিরে পেয়েছে৷ চিরদিনের গড়বাড়ির জঙ্গল তার পল্লব-প্রচ্ছায় বীথিপথে কত কি বনপুষ্পের সুবাস ও বনবিহঙ্গের কলকাকলি নিয়ে বসে আছে, পিতৃপিতামহের পায়ের দাগ আজও যেন আঁকা আছে সে পথের ধুলোয়, মায়ের স্নিগ্ধ স্নেহদৃষ্টি কোন কোণে সেখানে যেন লুকিয়ে আছে আজও—তাই তো মনে হয় তার যদি কোনো পাপ হয়ে থাকে নিজের অজ্ঞাতে—সব কেটে গিয়েছে এখানে এসে ধুয়ে মুছে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে৷
রাজলক্ষ্মীর বিবাহে বেশি ধুমধাম হবে না, গ্রামের সকলকে ওরা বিবাহ-রাত্রে নিমন্ত্রণ করতে পারবে না বলে বেছে বেছে নিমন্ত্রণ করছে৷ কেদার ও গোপেশ্বর দুজনেই অবিশ্যি নিমন্ত্রিত—এসব খবর কেদারই আনলেন৷
শরৎ বললে, বাবা, ওর বিয়েতে কি একটা দেওয়া যায় বলো না—
—তুই যা বলবি, এনে দেব৷
—তুমি যা ভালো ভাব, এনো৷
—আমি তো তোকে বললাম, ওসব মেয়েলি ব্যাপারে আমি নেই—
—টাকা আছে?
—আড়তে চাকরি করার দরুন টাকা তো খরচ হয় নি৷ সেগুলো আছে একজনের কাছে জমা৷ কত চাই বলে দে—
—আইবুড়ো ভাতের একখানা ভালো শাড়ি দাও আর একজোড়া দুল—ও আমায় বড় ভালোবাসে, আমার ছোট বোনের মতো৷ আমার বড় সাধ—
—তা দেব মা৷ কখনো তোর কাউকে কিছু হাতে করে দেওয়া হয় না—তুই হাতে করে দিয়ে আসিস—হরি সেকরাকে আজই দুলের কথা বলে দিই—
বিবাহের দু-তিন দিন আগে কেদার শাড়ি ও দুল এনে দিলেন৷ শরৎ কাপড়ের পাড় পছন্দ না করাতে দুবার তাঁকে ও গোপেশ্বরকে ভাজনঘাটের বাজারে ছুটোছুটি করতে হল৷ শরৎ নিজে ওদের বাড়ি গিয়ে রাজলক্ষ্মীকে আইবুড়ো ভাতের নিমন্ত্রণ করে এল৷ সকাল থেকে শাক, সুত্তুনি, ডালনা ঘণ্ট অনেক কিছু রান্না করলে৷ গোপেশ্বর চাটুজ্জে এসব ব্যাপারে শরৎকে কুটনো কোটা, ফাইফরমাশ—নানা রকম সাহায্য করলেন৷
শরৎ বললে, জ্যাঠামশায়কে বড় খাটিয়ে নিচ্ছি—
—তা নেও মা৷ আমি ইচ্ছে করে খাটি৷ আমার বড় ভালো লাগে—এ বাড়ি হয়ে গিয়েছে নিজের বাড়ির মতো৷ নিজে যা খুশি করি—
ইতিমধ্যে দুবার গোপেশ্বর চাটুজ্জে চলে যাবার ঝোঁক ধরেছিলেন, দুবার শরৎ মহা আপত্তি তুলে সে প্রস্তাব না-মঞ্জুর করে৷
শরৎ বললে, সেই জন্যেই তো বলি জ্যাঠামশায়, যতদিন বাঁচবেন, থাকুন এখানে৷ এখান থেকে যেতে দেব না৷
—সেই মায়াতেই তো যেতে পারি নে—সত্যি কথা বলতে গেলে যেতে ভালোও লাগে না৷ সেখানে বৌমারা আছেন বটে, কিন্তু আমার দিকে তাকাবার লোক নেই মা—তার চেয়ে আমার পর ভালো—তুমি আমার কে মা, কিন্তু তুমি আমার যে সেবা যে যত্ন করো তা কখনো নিজের লোকের কাছ থেকে পাই নি—বা রাজামশায় আমায় যে চোখে দেখেন—
শরৎ ধমকের সুরে বললে, ওসব কথা কেন জ্যাঠামশায়? ওতে পর করে দেওয়া হয়—সত্যিই তো আপনি পর নন?
রাজলক্ষ্মী খেতে এল৷
শরৎ বললে, দাঁড়া, কাপড় ছাড়তে হবে—
রাজলক্ষ্মী বিস্ময়ের সুরে বললে, কেন শরৎদি?
—কারণ আছে৷ ঘরের মধ্যে চল—
পরে কাগজের ভাঁজ খুলে শাড়ি দেখিয়ে বললে—পর এখানা—পছন্দ হয়েছে? তোর কান মলে দেব—কান নিয়ে আয় এদিকে—দেখি—
—দুল? এসব কি করেছ শরৎদি?
—কি করলাম! ছোট বোনকে দেব না? সাধ হয় না?
রাজলক্ষ্মী গরিবের মেয়ে, তাকে এমন জিনিস কেউ কোনো দিন দেয় নি৷ সে অবাক হয়ে বললে, এই সব জিনিস আমায় দিলে শরৎদি! সোনার দুল—
শরৎ ধমক দিয়ে বললে, চুপ৷ বলিনি আমাদের রাজারাজড়ার কাণ্ড, হাত ঝাড়লে পর্বত—
রাজলক্ষ্মীর চোখের জল গড়িয়ে পড়ল৷ নীরবে সে শরতের পায়ের ধুলো নিয়ে মাথায় দিলে৷ বললে, তা আজ দিলে কেন? বুঝেছি শরৎদি—তুমি যাবে না বিয়ের রাতে!
—যাব না কেন—তা যাব—তবে পাড়াগাঁ জায়গা, বুঝিস তো—
—তোমার মতো মানুষ আমার বিয়েতে গিয়ে দাঁড়ালে আমার অকল্যাণ হবে না শরৎদি৷ এ তোমায় ভালো করেই জানিয়ে দিচ্ছি, তুমি না গেলে আমার মনে বড্ড কষ্ট হবে৷ আর তুমি গেলে যদি অকল্যাণ হয়, তবে অকল্যাণই সই—
—ছিঃ ছিঃ—ওসব কথা বলতে নেই মুখে—আয়, চল রান্নাঘরে—কেমন গোটা দিয়ে সুত্তুনি রেঁধেছি খেয়ে বলবি চল—
বিকেলের দিকে শরৎ পুকুর থেকে গা ধুয়ে বাড়ি গিয়ে দেখলে রান্নাঘরের দাওয়ায় ইটচাপা একখানা কাগজের কোণ বেরিয়ে রয়েছে৷ একটু অবাক হয়ে কাগজটা টেনে নিয়ে দেখলে, তাতে লেখা আছে—
‘‘আজ সন্ধ্যার পরে রানীদিঘির পাড়ে ডুমুরতলায় আমাদের সঙ্গে দেখা করিবা৷ নতুবা কলিকাতায় কি হইয়াছিল প্রকাশ করিয়া দিব৷ হেনা বিবি আমাদের সঙ্গে আছে ভাজনঘাটের কুঠির বাংলায়৷ সেই তোমার সঙ্গে দেখা করিতে চায়৷ দেখা করিলে তোমার ভালো হইবে৷ এ চিঠির কথা কাহাকেও বলিও না৷ বলিলে যাহা হইবে দেখিতেই পাইবে৷ সাবধান৷’’
শরৎ টলে পড়ে যেতে যেতে কোনো রকমে নিজেকে সামলে নিলে৷ মাথাটা যেন ঘুরে উঠল৷ আবার সেই হেনা বিবি, সেই পাপপুরীর কথা—যা মনে করলে শরতের গা ঘিনঘিন করে! এ চিঠিখানা ছুঁয়েছে, তাতেই তাকে নাইতে হবে এই অবেলায়৷
এরা তাকে রেহাই দেবে না? তাদের গড়বাড়িতে কলকাতার লোকের জোর কিসের?
সব সমস্যার সে সমাধান করে দিতে পারে এখুনি, এই মুহূর্তেই কালোপায়রা দিঘির অতল জলতলে—
কিন্তু বাবার মুখের অসহায় ভাব মনে এসে তাকে দুর্বল করে দেয়৷ নইলে সে প্রভাসেরও ধার ধারত না, গিরীনেরও না৷ নিজের পথ করে নিত নিজেই৷ তাদেরই বংশের কোন রানী ওই দিঘির জলে আত্মবিসর্জন দিয়েছিলেন মান বাঁচাতে৷ সেও ওই বংশেরই মেয়ে৷ তার ঠাকুরমারা যা করেছিলেন সে তা পারে৷
বাবাকে এ চিঠি দেখাবে না৷ বাবার ওপর মায়া হয়, দিব্যি গানবাজনা নিয়ে আছেন, ব্যস্ত হয়ে উঠবেন এখুনি৷ গোপেশ্বর জ্যাঠামশায়কে দেখাতে লজ্জা করে৷ থাক গে, আজ সে এখুনি রাজলক্ষ্মীদের বাড়ি গিয়ে কাটিয়ে আসবে অনেক রাত পর্যন্ত৷ উত্তর দেউলে পিদিম আজ সকাল সকাল দেখাবে৷
রাজলক্ষ্মীর মা ওকে দেখে বললেন, এসো এসো মা শরৎ, আচ্ছা পাগলি, মেয়ে, অত পয়সাকড়ি খরচ করে রাজিকে দুল আর শাড়ি না দিলে চলত না?
রাজলক্ষ্মীর কাকিমা বললেন, গরিবের ওপর ওদের চিরকাল দয়া অমনি—কত বড় বংশ দেখতে হবে তো? বংশের নজর যাবে কোথায় দিদি?
শরৎ সলজ্জ সুরে বললে, ওসব কথা কেন খুড়িমা? কি এমন জিনিস দিয়েছি—কিছু না—ভারি তো জিনিস—রাজি কোথায়?
রাজলক্ষ্মীর মা বললেন, এই এতক্ষণ তোমার কথাই বলছিল, তোমার দেওয়া কাপড় আর দুল দেখতে চেয়েছেন গাঙ্গুলীদের বড় বউ, তাই নিয়ে গিয়েছে দেখাতে৷ শরৎদি বলতে মেয়ে অজ্ঞান, তোমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ৷ বলে, মা—শরৎদিকে ছেড়ে কোথাও গিয়ে সুখ পাব না৷ বসো, এল বলে—
একটু পরে গাঙ্গুলী-বউকে সঙ্গে নিয়ে রাজলক্ষ্মী ফিরল, সঙ্গে জগন্নাথ চাটুজ্জের পুত্রবধূ নীরদা৷ নীরদা শরতের চেয়ে ছোট, শ্যামবর্ণ, একহারা গড়নের মেয়ে, খুব শান্তপ্রকৃতির বউ বলে গাঁয়ে তার সুখ্যাতি আছে৷
গাঙ্গুলী বউ বললেন, এই যে মা শরৎ, তোমার কথাই হচ্ছিল৷ তুমি যে শাড়ি দিয়েছ, দেখতে নিয়েছিলাম—ক’টাকা নিলে? ভাজনঘাটের বাজার থেকে আনানো? বটঠাকুর কিনেছেন বুঝি?
শরৎ বললে, দাম জানি নে খুড়ীমা, বাবা ভাজনঘাট থেকেই এনেছেন৷ দুবার ফিরিয়ে দিয়ে তবে ওই পাড় পছন্দ—
নীরদা বললে, দিদির পছন্দ আছে৷ চলুন দিদি, ও ঘরে একটু তাস খেলি আপনি আমি রাজলক্ষ্মী আর ছোট খুড়িমা—
রাজলক্ষ্মীর মা শরৎকে পাশের ঘরে নিয়ে বললেন, মা, কাল তুমি আসতে পারো আর না পারো, আজ সন্দের পর এখান থেকে দুখানা লুচি খেয়ে যেয়ো—রাজলক্ষ্মী আমায় বার বার করে বলেছে—
সবাই মিলে আমোদ-স্ফূর্তিতে অনেকক্ষণ কাটাল—বেলা পড়ে সন্ধ্যা হয়ে গেল৷ বিয়েবাড়ির ভিড়, গ্রামের অনেক ঝি-বউ সেজেগুজে বিকেলের দিকে বেড়িয়ে দেখতে এল৷ মুখুজ্জে বাড়ির মেজ বউ পেতলের রেকাবে ছিরি গড়িয়ে নিয়ে এলেন৷ রাজলক্ষ্মীর মা বললেন, বরণ-পিঁড়ির আলপনাখানা তুমি দিয়ে দ্যাও দিদি—তুমি ভিন্ন এসব কাজ হবে না—এক হৈমদিদি আর তুমি—তারকের মা তো স্বর্গে গেছেন—আলপনা দেবার মানুষ আর নেই পাড়ায়—তারকের মা কি আলপনাই দিতেন!
শরৎ বললে, বাবাকে একটু খবর দিন খুড়িমা, কালীকান্ত কাকার চণ্ডীমণ্ডপে গানের আড্ডায় আছেন৷ যাবার সময় আমাকে যেন সঙ্গে নিয়ে যান এখান থেকে৷ অন্ধকার রাত, ভয় করে একা থাকতে৷
পরদিন সকাল আটটার সময় শরৎকে আবার রাজলক্ষ্মীদের বাড়ি থেকে ডাকতে এল৷ নিরামিষ দিকের রান্না তাকে রাঁধতে হবে৷ গাঙ্গুলীদের বড় বউয়ের জ্বর কাল রাত্রি থেকে৷ তিনিই রান্না করে থাকেন পাড়ার ক্রিয়াকর্মে৷
রাজলক্ষ্মী প্রায়ই রান্নাঘরে এসে শরতের কাছে বসে রইল৷
শরৎ ধমক দিয়ে বলে—যা রাজি, দধিমঙ্গলের পরে হটর হটর ক’রে বেড়ায় না৷ এখানে ধোঁয়া লাগবে চোখেমুখে—অন্য ঘরে বসগে যা—
রাজলক্ষ্মী হেসে বললে, কারো ধমকে আর ভয় খাই নে৷ এই বসলাম পিঁড়ি পেতে—দেখি তুমি কি করো?
নীরদা এসে বললে, শরৎদি একটা অর্থ বলে দাও তো?
আকাশ গম গম পাথর ঘাটা
সাতশো ডালে দুটি পাতা—
শরৎ তাকে খুন্তি উঁচিয়ে মারতে গিয়ে বললে, ননদের কাছে চালাকি—না? দশ বছরের খুকিদের ওসব জিজ্ঞেস করগে যা ছুঁড়ি—
গরিবের বিয়ে বাড়ি, ধুমধাম নেই, হাঙ্গামা আছে৷ সব পাড়ার বউ-ঝি ভেঙে পড়ল সেজেগুজে৷ প্রথম প্রহরের প্রথম লগ্নে বিবাহ৷ শরৎ সারাদিন খাটুনির পরে বিকেলের দিকে নীরদাকে বললে, গা হাত পা ধুয়ে আসব এখন৷ বাড়ি যাই—কাউকে বলিস নে—
বাড়ি ফিরে সে সন্ধ্যাপ্রদীপ দেখাতে গেল৷ শীতের বেলা অনেকক্ষণ পড়ে গিয়েছে, রাঙা রোদ উঠে গিয়েছে ছাতিমবনের মাথায়, ঈষৎ নীলাভ সাদা রঙের পুঞ্জ পুঞ্জ ছোট এড়াঞ্চির ফুল শীতের দিনে এই সব বনঝোপকে এক নির্জন, ছন্নছাড়া মূর্তি দান করেছে৷ শুকনো বাদুড়নখী ফল তাদের বাঁকানো নখ দিয়ে কাপড় টেনে ধরে৷ থমথমে কৃষ্ণা চতুর্দশীর অন্ধকার রাত্রি৷
এক জায়গায় গিয়ে হঠাৎ সে ভয়ে ও বিস্ময়ে থমকে দাঁড়িয়ে গেল৷ একটি লোক উপুড় হয়ে পড়ে আছে উত্তর দেউলের পথ থেকে সামান্য দূরে বাদুড়নখী জঙ্গলের মধ্যে৷ শরৎ কাছে দেখতে গিয়ে চমকে উঠল—কলকাতার সেই গিরীনবাবু!
মরে কাঠ হয়ে গিয়েছে অনেকক্ষণ৷ ওর ঘাড়টা যেন শক্ত হাতে কে মুচড়ে দিয়েছে পিঠের দিকে, সেই মুণ্ডুটা ধড়ের সঙ্গে এক অস্বাভাবিক কোণের সৃষ্টি করেছে৷ গিরীনের দেহটা যেখানে পড়ে, তার পাশেই মাটিতে ভারী ভারী গোল গোল কিসের দাগ, হাতির পায়ের দাগের মতো৷….শরতের মাথা ঘুরে উঠল, সে চিৎকার করে মূর্ছিতা হয়ে পড়ে গেল৷ হাত থেকে সন্ধ্যাপ্রদীপ ছিটকে পড়ল বাদুড়নখীর জঙ্গলে৷
এই অবস্থায় অনেক রাত্রে কেদার ও গোপেশ্বর তাকে বিয়েবাড়ি থেকে ডাকতে এসে দেখতে পেলেন৷ ধরাধরি করে তাকে নিয়ে বাড়ি যাওয়া হল৷
লোকজনের হৈ-হৈ হল পরদিন৷ পুলিশ এল, রানীদিঘির জঙ্গলে এক চালকবিহীন মোটরগাড়ি পাওয়া গেল৷ কি ব্যাপার কেউ বুঝতে পারলে না৷ সবাই বললে গড়বাড়ির সবাই সারারাত বিয়েবাড়িতে ছিল৷ মৃতদেহের ঘাড়ে শক্ত, কঠিন পাঁচটা আঙুলের দাগ যেন লোহার আঙুলের দাগের মতো, ঘাড়ের মাংস কেটে বসে গিয়েছে৷ গোল গোল হাতির পায়ের মতো দাগগুলোই বা কিসের কেউ বুঝতে পারলে না!
গড়ের জঙ্গলে ঝিঁঝি পোকা ডাকছে৷ সন্ধ্যাবেলা৷ কেদার ঘোর নাস্তিক, কি মনে করে তিনি হস্তপদভগ্ন বারাহী দেবীর পাষাণ মূর্তির কাছে মাথা নিচু করে দণ্ডবৎ করে বললেন, গড়ের রাজবাড়ি যখন সত্যিকার রাজবাড়ি ছিল, তখন শুনেছি তুমি আমাদের বংশের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ছিলে৷ আমাদের অবস্থা পড়ে গিয়েছে, অনেক অপরাধ করেছি তোমার কাছে, কিন্তু তুমি আমাদের ভোলো নি৷ এমনি পায়ে রেখো চিরকাল মা—অনেক পুজো আগে খেয়েছ সে কথা ভুলে যেয়ো না যেন৷