Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

পরদিন শরৎ আবার খোকাদের বাড়ি ধ্রুবেশ্বরের গলিতে গিয়ে হাজির, সঙ্গে পটলের বউ৷

খোকার মা বললেন, দু-দিন আস নি ভাই, খোকা ‘মাসিমা মাসিমা’ বলে গেল৷

খোকার জন্যে আজ সে এসেছে শুধু হাতে, কারণ পাগলিকে পয়সা দেবার পরে ওর হাতে আর পয়সা নেই৷ মিনুর কাকিমার কাছে বার বার চাইতে লজ্জা করে৷

খোকা শরতের কোল ছাড়তে চায় না৷

শরৎ যখন এদের বাড়ি আসে, যেন কোনো নূতন জীবনের আলো, আনন্দের আলোর মধ্যে ডুবে যায়৷ আবার যখন মিনুর কাকিমাদের বাড়ি যায়, তখন জীবনের কোন আলো-আনন্দহীন অন্ধকার রন্ধ্রপথে ঢুকে যায়, দূর দিকচক্রবালে উদার আলোকোজ্জ্বল প্রসার সেখান থেকে চোখে পড়ে না৷

খোকা বলে, এসো মাছিমা—খেলা করি—

খোকার আছে দুটো রবাবের বল, একটা কাঠের ভাঙা বাক্স, তার মধ্যে ‘মেকানো’ খেলার সাজ-সরঞ্জাম৷ শেষোক্ত জিনিসটা ছিল খোকার দাদার, এখন সে বড় হয়ে তার ত্যক্ত সম্পত্তি ছোট ভাইকে দিয়ে দিয়েছে৷

খোকা বলে, সাজিয়ে দাও মাছিমা৷

শরৎ জীবনে ‘মেকানো’র বাক্স দেখে নি, কল্পনাও করে নি৷ সে সাজাতে পারে না৷ খোকাও কিছু জানে না, দুজনে মিলে হেলাগোছা করে একটা অদ্ভুত কিছু তৈরি করলে৷

খোকার মা শরতের জন্যে খাবার করে খেতে ডাকলেন৷

শরৎ বললে, আমি কিছু খাব না দিদি—

—তা বললে হয় না ভাই, খোকার মাসিমা যখন হয়েছ, কিছু মুখে না দিয়ে—

—রোজ রোজ এলে যদি খাওয়ান তা হলে আসি কি করে?

—খোকনকে তুমি বড় হলে খাইও ভাই৷ শোধ দিয়ো তখন না হয়—

বকসীদের বড় বউ খবর পেয়ে এসে শরতের সঙ্গে অনেকক্ষণ গল্প করলে৷

সে বললে, কি ভালো লেগেছে ভাই তোমাকে, তুমি এসেছ শুনে ছুটে এলাম—একটা কথা বলবে?

—কি, বলুন?

—তোমার বাপের বাড়ি কোথায় ভাই?

—গড়শিবপুর, যশোর জেলায়৷

—শ্বশুরবাড়ি?

—বাপের বাড়ির কাছেই—

—বাবা-মা আছেন?

শরৎ চুপ করে রইল৷ দু চোখ বেয়ে টস-টস করে জল গড়িয়ে পড়ল বাবার কথা মনে পড়াতে৷ সে তাড়াতাড়ি চোখের জল আঁচল দিয়ে মুছে নিয়ে বললে, ওসব কথা জিজ্ঞেস করবেন না দিদি—

বকসীদের বউ বুদ্ধিমতী, এ বিষয়ে আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না তখন৷ কিছুক্ষণ অন্য কথার পরে শরৎ যখন ওদের কাছে বিদায় নিয়ে চলে আসছে, তখন ওকে আড়ালে ডেকে বললে, আমি তোমাকে কোনো কথা জিজ্ঞেস করতে চাই নে ভাই—কিন্তু আমার দ্বারা যদি তোমার কোনো উপকার হয়, জানিও—তা যে করে হয় করব৷ তোমাকে যে কি চোখে দেখেছি!

শরৎ অশ্রুভারনত চোখে বললে, আমার ভালো কেউ করতে পারবে না দিদি৷ যদি এখন বাবা বিশ্বনাথ তাঁর চরণে স্থান দেন, তবে সব জ্বালা জুড়িয়ে যায়৷

—তুমি সাধারণ ঘরের মেয়ে নও কিন্তু—

—খুব সাধারণ ঘরের মেয়ে দিদি৷ ভালোবাসেন তাই অন্যরকম ভাবেন৷ আচ্ছা এখন আসি৷

—আবার এসো খুব শীগগির—

শরৎ ও পটলের বৌ পথ দিয়ে চলে আসতে আসতে সেদিনকার সেই পাগলির সঙ্গে দেখা৷ সে রাস্তার ধারে একখানা ছেঁড়া কাপড় পেতে বসেছে জাঁকিয়ে—আর যে পথ দিয়ে যাচ্ছে তাকেই বলছে—একটা পয়সা দিয়ে যাও না?

শরৎ বললে, আহা, সেদিন ওর কিছু খাওয়া হয় নি, পয়সা আছে কাছে ভাই?

পটলের বউ বললে, পাঁচটা পয়সা আছে—

—ওকে কিছু খাবার কিনে দিই—এসো৷

নিকটবর্তী একটা দোকান থেকে ওরা কিছু খাবার কিনে নিয়ে ঠোঙাটা পাগলির সামনে রেখে দিয়ে বললে, এই নাও খাও—

পাগলি ওদের মুখের দিকে চেয়ে কোনো কথা না বলে খাবারগুলো গোগ্রাসে খেয়ে বললে—আরও দাও—

শরৎ বললে, আজ আর নেই—কাল এখানে বসে থেকো বিকেলে এমনি সময়, কাল দেব৷

পটলের বৌ বললে, ভাই, আমাদের বাড়ি থেকে দুটো রেঁধে নিয়ে এসে দেব কাল?

—বেশ এনো৷ আমি একটু তরকারি এনে দেব৷ আমার যে ভাই কোনো কিছু করবার যো নেই—তা হলে আমার ইচ্ছে করে ওকে বাড়ি নিয়ে গিয়ে ভালো করে পেটভরে খাওয়াই৷ দুঃখ-কষ্টের মর্ম নিজে না বুঝলে অপরের দুঃখ বোঝা যায় না৷ বাঙালির মেয়ে কত দুঃখে পড়ে আজ ওর এ দশা—তা এক ভগবান ছাড়া আর কেউ বলতে পারে না৷ আমিও কোনোদিন ওই রকম না হই ভাই—

—বালাই ষাট, তুমি কেন অমন হতে যাবে ভাই?…. ধরো, আমার হাত ধরো, ভাই, বড্ড উঁচু-নীচু—

এই অন্ধ পটলের বউ—এর ওপরও এমন মায়া হয় শরতের! কে আছে এর জগতে, কেউ নেই পটল ছাড়া৷ আজ যদি, ভগবান না করুন, পটলের কোনো ভালোমন্দ হয়, তবে কাল এই নিঃসহায় অন্ধ মেয়েটি দাঁড়ায় কোথায়?

আবার ওই রাস্তার ধারের পাগলির কথা মনে পড়ে৷

জগতে যে এত দুঃখ, ব্যথা কষ্ট আছে, শরৎ সেসবের কিছু খবর রাখত না৷ গড়শিবপুরের নিভৃত বনবিতান শ্যামল আবরণের সংকীর্ণ গণ্ডী টেনে ওকে স্নেহে যত্নে মানুষ করেছিল—বহির্জগতের সংবাদ সেখানে গিয়ে কোনোদিনও পৌঁছায় নি৷

শরৎ জগৎটাকে যে রকম ভাবত, আসলে এটা সে রকম নয়৷ এখন তার চোখ ফুটেছে, জীবনে এত মর্মান্তিক দুঃখের মধ্যে দিয়েই তবে যে উদার দৃষ্টি লাভ হয়েছে তার—এক একদিন গঙ্গার ঘাটে চুপ করে বসে থাকতে থাকতে শরতের মনে ওঠে এসব কথা৷

আগেকার গড়শিবপুরের সে শরৎ আর সে নেই— সেটা খুব ভালো করেই বোঝে৷ সে শরৎ ছিল মনেপ্রাণে বালিকা মাত্র৷ বয়স হয়েছিল যদিও তার ছাব্বিশ—দৃষ্টি ছিল রাজলক্ষ্মীর মতোই, সংসারের কিছু বুঝত না, জানত না৷ সব লোককে ভাবত ভালো, সব লোককে ভাবত তাদের হিতৈষী৷

সেই বালিকা শরতের কথা ভাবলে এ শরতের এখন হাসি পায়৷

শরৎ মনে এখন যথেষ্ট বল পেয়েছে৷ কলকাতা থেকে আজ এসেছে প্রায় দেড় বছর, যে ধরনের উদভ্রান্ত ভীরু মন নিয়ে দিশেহারা অবস্থায় পালিয়ে এসেছিল কলকাতা থেকে—এখন সে মন যথেষ্ট বল সঞ্চয় করেছে৷ দুনিয়াটা যে এত বড়, বিস্তৃত—সেখানে যে এত ধরনের লোক বাস করে, তার চেয়েও কত বেশি দুঃখী অসহায়, নিরাবলম্ব লোক যে তার মধ্যে রয়েছে, এই সব জ্ঞানই তাকে বল দিয়েছে৷

সে আর কি বিপদে পড়েছে, তার চেয়েও শতগুণে দুঃখিনী ওই গণেশ-মহল্লার পাগলি, এই অন্ধ পটলের বউ৷ এই কাশীতে সেদিন সে এক বুড়িকে দেখেছে দশাশ্বমেধ ঘাটে, বয়স তার প্রায় সত্তর-বাহাত্তর, মাজা ভেঙে গিয়েছে, বাংলা দেশে বাড়ি ছিল, হাওড়া জেলার কোনো এক পাড়াগাঁয়ে৷ কেউ নেই বুড়ির, অনেকদিন থেকে কাশীতে আছে, ছত্রে ছত্রে খেয়ে বেড়ায়৷

সেদিন শরৎকে বললে, মা, তুমি থাকো কোথায় গো?

—কাছেই৷ কেন বলুন তো?

—তোমরা?

—ব্রাহ্মণ৷

—আমায় দুটো ভাত দেবে একদিন?

—আমার সে সুবিধে নেই মা৷ আমি পরের বাড়ি থাকি৷ আপনার মতো অবস্থা৷ কেন, আপনি খান কোথায়?

—পুঁটের ছত্তরে খেতাম, সে অনেকদূর৷ অত দূর আর হাঁটতে পারি নে—আজকাল আবার নিয়ম করেছে একদিন অন্তর মাদ্রাজীদের ছত্তরে ডালভাত দেয়৷ তা সে-সব তরকারি নারকোল তেলে রান্না মা, আমাদের মুখে ভালো লাগে না৷ আজ এক জায়গায় ভোজ দেবে, সেখানে যাব—ওই পাঁড়েদের ধর্মশালায়—চলো না, যাবে মা?

—কতদূর?

—বেশি দূর নয়৷ এক হিন্দুস্থানী বড়লোক কাশীতে তীর্থধর্ম করতে এসেছে মা৷ লোকজন খাওয়াবে—আমাদের সব নেমন্তন্ন করেছে৷ চলো না?

—না মা, আমি যাব না৷

—এতে কোনো লজ্জা নেই, অবস্থা খারাপ হলে মা সব রকম করতে হয়৷ আমারও দেশে গোলাপালা ছেল, দুই ছেলে হাতির মতো৷ তারা থাকলে আজ আমার বের্দ্ধ বয়েসে কি এ দশা হয়?

বুড়ির চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল৷

শরৎ ভাবলে, দেখেই আসি, খাব না তো—যা জিনিস দেবে, নিয়ে এসে পাগলিকে কি পটলের বউকে দিয়ে দেব৷

তাই সেদিন সে মনোমোহন পাঁড়ের ধর্মশালায় গেল বুড়ীর সঙ্গে৷ ধর্মশালার বিস্তৃত প্রাঙ্গণে অনেক বৃদ্ধ বাঙালি ও হিন্দুস্থানী ব্রাহ্মণ জড়ো হয়েছে—মেয়েমানুষও সেখানে এসেছে, তবে সংখ্যা খুব বেশি নয়৷

যাঁরা ভোজ দিচ্ছে তারা বাংলা জানে না—হিন্দীতে কথাবার্তা কি বলে, শরৎ ভালো বুঝতে পারে না৷ তারা খুব বড়লোক, দেখেই মনে হল৷ শরৎকে দেখে আলাদা ডেকে তাদের একটি বউ বললে, তুমি কি আলাদা বসে খাবে, মাইজি?

—না মা—আমি নিয়ে যাব৷

—বাড়িতে লেড়কালেড়কি আছে বুঝি?

শরৎ মৃদু হেসে বললে, না৷

—আচ্ছা বেশ নিয়ে যাও—এখানে থাকো কোথায়?

—একজনদের বাড়ি৷ রান্না করি৷

—বাঙালি রান্না করো?

—হ্যাঁ মা৷

একটু পরে ভোজের বন্দোবস্ত হল৷ অন্য কিছু নয়, শুধু হালুয়া, তিল তেলে রান্না৷ প্রকাণ্ড চাদরের কড়াইয়ে প্রায় দশ সের সুজি, দশ সের চিনি—আর ছোট টিনের একটিন তিল তেল ঢেলে হালুয়া তৈরি হচ্ছে, শরৎকে ডেকে নিয়ে গিয়ে হিন্দুস্থানী বৌটি সব দেখালে৷ অভ্যাগত দরিদ্র নরনারীদের বসিয়ে পেটভরে সেই হালুয়া খাওয়ানো হল—যাবার সময় দু-আনা করে মাথাপিছু ভোজনদক্ষিণাও দেওয়া হল৷ শরৎকে কিন্তু একটা পুঁটুলিতে হালুয়া ছাড়া পুরী ও লাড্ডু অনেক করে দিলে ওরা৷

খাবারগুলো পুঁটলি বেঁধে নিয়ে এসে শরৎ পটলের বউকে দিয়ে দিলে৷ বললে, আজ আর পাগলির দেখা নেই! আজ খেতে পেত, আজই নিরুদ্দেশ!

পটলের বউ বললে, পাগলির জন্যে রেখে দেব দিদি?

—কেন মিথ্যে বাসি করে খাবে? কাল যে আসবে তারই বা মানে কি আছে? খাও তোমরা৷

—তুমি খাবে না?

—আমি খাব না, সে তুমি জানো৷ ওরা কি জাত তার ঠিক নেই, ওদের হাতে রান্না—

—কাশীতে আবার জাতের বিচার—

—কেন, কাশী তো জগন্নাথ ক্ষেত্তর না, সেখানে নাকি জাতের বিচার নেই—

এমন সময় ওপর থেকে ঝি এসে বললে—ওগো বামুনঠাকরুণ, মা ডাকছেন—ওপরে যেতেই মিনুর কাকিমা এক তুমুল কাণ্ড বাধিয়ে দিল৷ মোগলসরাই থেকে তার ভাইপোরা এসেছে, রাত আটটার গাড়িতে চলে যাবে, অথচ বামনীর দেখা নেই, মাইনে যাকে দিতে হচ্ছে সে সব সময় বাড়ি থাকবে! বিধবা মানুষের আবার এত শখের বেড়ানো কিসের, এতদিন কোনো কৈফিয়ৎ চাওয়া হয় নি শরতের গতিবিধির, কিন্তু ব্যাপার ক্রমশ যে-রকম দাঁড়াচ্ছে, তাতে কৈফিয়ৎ না নিলে চলে না!

শরৎ বললে, আমি তো জানতাম না ওঁরা আসবেন৷ আমি আটটার অনেক আগে খাইয়ে দিচ্ছি—

—তুমি রোজ রোজ যাও কোথায়?

—পটলের বউয়ের সঙ্গে তো যাই—

—কোথায় যাও?

—৬ নম্বর ধ্রুবেশ্বরের গলি৷ হরিবাবু বলে এক ভদ্রলোকের বাড়ি—

—সেখানে কেন?

—পটলের বউ বেড়াতে নিয়ে যায়৷ ওদের জানাশুনো৷

—আজ কোথায় গিয়েছিলে?

—একটা ধর্মশালা দেখতে৷

—ওসব চলবে না বলে দিচ্ছি—কোথাও বেরুতে পারবে না কাল থেকে৷ ডুবে ডুবে জল খাও, আমি সব টের পাই৷ একশো বার করে কর্তাকে বললাম পটলদের তাড়াও নীচের ঘর থেকে—এগারো টাকার জায়গায় এখুনি পনেরো টাকা ভাড়া পাওয়া যায়! তা কর্তার কোনো কথা কানে যাবে না—পটলের বউয়ের স্বভাবচরিত্র আমার ভালো ঠেকে না—

বেচারি অন্ধ পটলের বউ, তার নামে মিথ্যে অপবাদ শরতের সহ্য হল না৷ সে বললে, আমার নামে যা হয় বলুন, সে বেচারি অন্ধ, তাকে কেন বলেন? আমায় না রাখেন, কাল সকালেই আমি চলে যাব—

—বেশ যাও৷ কাল সকালেই চলে যাবে—

শরৎ নির্বিকার-চিত্তে রান্নাবান্না করে গেল৷ লোকজনকে খাইয়ে দিলে৷ রাত ন’টার পরে মিনুর কাকিমা বললে, তোমার কি থাকবার ইচ্ছে নেই নাকি?

—আপনিই তো থাকতে দিচ্ছেন না৷ পটলের বউয়ের নামে অমন বললেন কেন? আমি মিশি বলে সে বেচারিও খারাপ হয়ে গেল?

—তোমার বড্ড তেজ—কাশী শহরে কেউ জায়গা দেবে না৷ সে কথা ভুলে যাও—

—আমার কারো আশ্রয়ে যাওয়ার দরকার নেই৷ বিশ্বেশ্বর স্থান দেবেন৷ আমি আপনাদের বাড়ি থাকতে পারব না, সকালে উঠেই চলে যাব, যদি বলেন তো রেঁধে দিয়ে যাব, নয়তো খোকাদের খাওয়ার কষ্ট হবে৷

রাত্রে বাড়ি ফিরে মিনুর কাকা সব শুনলেন৷ সেই রাত্রেই তিনি শরৎকে ডেকে বললেন, তুমি কোথাও যেতে পারবে না বামুন-ঠাকরুন৷ ও যা বলেছে, কিছু মনে করো না৷

শরৎ মিনুর কাকার সামনে বেরোয় না, কথাও বলে না৷ ঝিকে দিয়ে বলালে, তিনি যদি যেতে বারণ করেন, তবে সে কোথাও যাবে না৷ কারণ গৌরী-মা তাকে তাঁর হাতে সঁপে দিয়েছিলেন—তাঁর অর্থাৎ মিনুর মা’র বিনা অনুমতিতে সে এ সংসার ছেড়ে যেতে পারবে না৷

আরও দিন পনের কেটে গেল৷ একদিন বিশ্বেশ্বরের গলির মুখে সেই বুড়ির সঙ্গে আবার দেখা৷ বুড়ি বললে, কি গা, যাচ্ছ কোথায়? কোন ছত্তরে?

শরৎ অবাক হয়ে বললে, আমি ছত্তরে খাই নে তো? আমি লোকের বাড়ি থাকি যে৷

—চলো, আজ কুচবিহারে কালীবাড়িতে খুব কাণ্ড, সেখানে যাই৷ নাটকোটার ছত্তর চেন?

—না মা, আমি কোথাও যাই নি—

—চলো আজ সব দেখিয়ে আনি—

সারা বিকেল তিন-চারটি বড় বড় ছত্রে শরৎ কাঙালিভোজন, ব্রাহ্মণভোজন দেখে বেড়াল৷ বাঙালীটোলা ছাড়িয়ে অনেক দূর পর্যন্ত পাঁচিল দিয়ে ঘেরা বিরাট কালীবাড়ি ও ছত্র কুচবিহার মহারাজের৷ কালীমন্দিরের দেওয়ালে কত রকমের অস্ত্রশস্ত্র, কি চমৎকার বন্দোবস্ত অনাহূত রবাহূত গরিব, নিরন্ন সেবার! মেয়েদের জন্যে খাওয়ানোর আলাদা জায়গা, পুরুষদের আলাদা, ব্রাহ্মণদের আলাদা৷ এত অকুণ্ঠ অন্নদান সে কখনো কল্পনাও করতে পারে নি৷

শরৎ বললে, হ্যাঁ মা, এখানে যে আসে তাকেই খেতে দেয়?

—কুচবিহারের কালীবাড়িতে তা দেয় গো৷ তবুও আজকাল কড়াকড়ি করেছে৷ হবে না কেন, বাঙাল দেশ থেকে লোক এসে সব নষ্ট করে দিয়েছে৷

—আমি নিজে যে বাঙাল—হ্যাঁ মা—

শরৎ কথা বলেই হেসে ফেললে৷ বুড়ি কিছুমাত্র অপ্রতিভ না হয়ে বললে, হ্যাঁগো, বাঙাল না ছাই, তোমার কথায় বুঝি বোঝা যায় কিছু, চলো চলো—নাটকোটার ছত্তর দেখিয়ে আনি—

নাটকোটার ছত্রে যখন ওরা গেল, তখন সেখানকার খাওয়া-দাওয়া শেষ৷ বাইরের গরিব লোকেরা ভাত নিয়ে যাচ্ছে কেউ কেউ৷

শরৎ বললে, এ কাদের ছত্র মা?

—তৈলিঙ্গিদের ছত্তর৷ এখানে খেতে এসেছিলুম একদিন, ডালে যত বা টক, তত বা লঙ্কা৷ সে মা আমাদের পোষায় না৷ তুণ্ডুমুণ্ডুদের পোষায়, ওদের মুখে কি সোয়াদ আছে মা?

শরৎ হেসে কুটি কুটি৷ বললে, তুণ্ডুমুণ্ডু কারা মা?

—আরে ওই তৈলিঙ্গিদের কথাবার্তা শোনো নি? তুণ্ডুমুণ্ডু না কি সব বলে না?

—আমি কখনো শুনি নি৷ আমায় একদিন শোনাবেন তো!

—একদিন খাওয়া-দাওয়ার সময় নাটকোটার ছত্তরে নিয়ে আসব—দেখতে পাবে—

—আর কি ছত্তর আছে?

—এখানে রাজরাজেশ্বরী ছত্তর, পুঁটের ছত্তর, আমবেড়ে—আহিল্যেবাই—

—সব দেখব মা, আজ সব দেখে আসব—

সমস্ত ঘুরে শেষ করতে ওদের প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল৷ বুড়ি বললে, কাশীতে ভাতের ভাবনা নেই, অন্নপুণ্ণো মা দু-হাতে অন্ন বিলিয়ে যাচ্ছেন—

শরৎ বাসায় ফিরে এসে ভীষণ অন্যমনস্ক হয়ে রইল৷ তার সকলের চেয়ে ভালো লেগেছে কাশীর এই অন্নদান৷ এমন একটা ব্যাপারের কথা সত্যিই সে জানত না৷ ডাল-ভাত উনুনে চাপিয়ে দিয়ে সে শুধু ভাবে ওই কথাটা৷ তার আর কিছু ভালো লাগে না৷ কাল সকাল সকাল এদের খাইয়ে-দাইয়ে দিয়ে সে আবার বেরুবে ছত্র দেখতে৷ ছত্রে খাওয়ানোর দৃশ্য সে মাত্র দেখলে কুচবিহারের কালীবাড়িতে৷ অন্য ছত্রে যখন গিয়েছিল তখন সেখানকার খাওয়ানো বন্ধ হয়ে গিয়েছে৷ সে দেখতে চায় দুচোখ ভরে এই বিরাট অন্নব্যয়, অকুণ্ঠ সদাব্রত—যেখানে গণেশমহল্লার পাগলির মতো, ওই অন্ধ রেণুকার মতো, তার নিজের মতো, ওই সত্তর বছরের মাজা-ভাঙা বুড়ির মতো—নিরন্ন, নিঃসহায় মানুষকে দুবেলা খেতে দিচ্ছে৷ ওই দেখতে তার খুব ভালো লাগে—খুব—খুব ভালো লাগে—ওই সব ছত্রেই বিশ্বেশ্বর ও অন্নপূর্ণা প্রত্যক্ষ বিরাজ করেন বুভুক্ষু অভাজনদের ভোজনের সময়—মন্দিরে তাঁদের দেখার চেয়েও সে দেখা ভালো৷ অনেক—অনেক ভালো৷

ঝি এসে বলে, ও বামুন-ঠাকরুণ, মাছের ঝোল দিয়ে বাবুকে আগে ভাত দিতে হবে৷ খেয়ে এখুনি বেরিয়ে যাবেন—

—ও ঝি, শোনো—পাঁচফোড়ন মোটে নেই, বাজার থেকে আগে এনে দাও—

ঝি চলে যায়৷ মাছের ঝোল ফোটে৷ নিভৃত রান্নাঘরের কোণে গোলমাল নেই—বসে শরৎ স্বপ্ন দেখে, সে প্রকাণ্ড ছত্র খুলেছে কেদার ছত্র, বাবার নামে৷ কত লোক এসে খাচ্ছে—অবারিত দ্বার৷ বাবার ছত্র থেকে কোনো লোক ফিরবে না, অনাহারে কেউ ফিরে যাবে না৷ সে নিজে দেখবে শুনবে—সকলকে খাওয়াবে৷ সে দু-হাতে অন্নদান করবে৷ সকলকেই—ব্রাহ্মণ-শূদ্র নেই, তুণ্ডুমুণ্ডু নেই, বাঙাল-ঘটি নেই—সকলেই হবে তার পরম সম্মানিত অতিথি৷ নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সবাইকে খাওয়াবে সে৷

শরতের মাথার মধ্যে কি যেন নেশা জমেছে৷….

রান্নাবান্না সেরে সে মিনুর কাকিমাকে বলল, আজ একবারটি বাইরে যাব?

—কোথায়?

শরৎ হঠাৎ সলজ্জ হেসে বললে—সে বলব এখন এসে৷

শরতের হাসি দেখে মিনুর কাকিমার মনে সন্দেহ হল৷ সে বললে, কোথায় যাচ্ছ না বললে চলে? সব জায়গায় যেতে দিতে পারি কি? রাগ করলে তো চলে না—বুঝে দেখতে হয়৷

—ছত্তর দেখতে৷ রাজরাজেশ্বরী ছত্তরে অনেক বেলায় খাওয়া-দাওয়া হয়, পুঁটের ছত্তরেও হয়—দেখে আসি একটিবার—

মিনুর কাকিমা শরতের মনের উত্তাল উদ্বেল সমুদ্রের কোনো খবর রাখে না—সেবা ও অন্নদানের যে বিরাট আকৃতি ও আগ্রহ, তার কোনো খবর রাখে না—বললে, কেন, ছত্তর দেখতে কেন? সে আবার কি?

—দেখি নি কখনো৷ যেতে দিন আজ আমায়—

শরতের কণ্ঠে সাগ্রহ মিনতির সুরে মিনুর কাকিমা ছুটি দিতে বাধ্য হল, তবে হয়তো শরতের কথা সে আদৌ বিশ্বাস করলে না৷

শরৎ এসে বললে, ও রেণু পোড়ারমুখী—কি হচ্ছে?

—ও, আজ যেন খুব ফুর্তি, তোমার কি হয়েছে শুনি?

—কি আবার হবে, তোর মুণ্ডু হবে! চল ছত্তরে যাই, খাওয়া দেখে আসি৷

রেণু অবাক হয়ে বললে, কেন?

—কেন, তোর মাথা! আমি যে কাশীতে ছত্তর খুলছি, জানিস নে?

—বেশ তো ভাই৷ আমাদের মতো গরিব লোকে তাহলে বেঁচে যায়৷ দু-বেলা ছত্তরে পেট ভরে দুটো খেয়ে আসি৷ হাঁড়ি-হেঁসেলের পাট উঠিয়ে দিই৷ কি নাম হবে, শরৎসুন্দরী ছত্র?

—না ভাই, বাবার নামে—কেদার ছত্তর৷ কেমন নাম হবে বল তো?

—যাই বলো ভাই, শরৎসুন্দরী ছত্র শুনতে যেমন, তেমনটি কিন্তু হল না৷

রাজরাজেশ্বরী ছত্রে ওরা যেতেই ছত্রের লোকে জিজ্ঞেস করলে—আপনারা আসুন, মেয়েদের জন্যে আলাদা বন্দোবস্ত আছে—

শরৎ বললে, চল ভাই রেণু, দেখি গে—

—যদি খেতে বলে?

—জোর করে খাওয়াবে না কেউ, তুমি চলো৷

মেয়েদের মধ্যে সবাই বুড়ো-হাবড়া, এক আধ জন অল্পবয়সী মেয়েও আছে—কিন্তু তারা এসেছে বুড়িদের সঙ্গে কেউ নাতনী, কেউ মেয়ে সেজে৷ বুড়িরা বড় ঝগড়াটে, পাতা আর জলের ঘটি নিয়ে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া বাঁধিয়েছে৷ শরৎ বললে, মা বসুন, আমি জল দিচ্ছি আপনাদের—

একজন জিজ্ঞেস করলে—তুমি কি জেতের মেয়ে গা?

—বামুনের মেয়ে, মা৷

—কাশীতে এলে সবাই বামুন হয়৷ কোথায় থাকো তুমি?

—বাঙালিটোলায় থাকি মা—কিছু ভাববেন না আপনি৷

ছত্রের পরিবেশনকারিণী একটি মধ্যবয়স্কা মেয়ে শরতকে বললে, তোমরা বসছ না বাছা?

—আমি খাব না মা৷

সে অবাক হয়ে বললে, তবে এখানে কেন এসেছ?

—দেখতে৷

রেণুকা বললে, উনি বড়লোকের মেয়ে, ছত্তর খুলবেন কাশীতে—তাই দেখতে এসেছেন কি রকম খাওয়া-দাওয়া হয়৷

এক মুহূর্তে যে-সব বুড়ি খেতে বসেছে এবং যারা পরিবেশন ও দেখাশুনো করছে, সকলেরই ধরন বদলে গেল৷ যে বুড়ি শরতের জাতি-বর্ণের প্রশ্ন তুলেছিল, সে-ই সকলের আগে একগাল হেসে বললে, সে চেহারা দেখেই আমি ধরেছি মা, চেহারা দেখেই ধরেছি৷ আগুন কি ছাইচাপা থাকে? তা দ্যাখো রানীমা, একটা দরখাস্ত দিয়ে রাখি৷ আমার এই নাতনী, অল্পবয়সে কপাল পুড়েছে, কেউ নেই আমাদের৷ আপনার ছত্তর খুললে এর দুটো বন্দোবস্ত যেন সেখানে হয়৷ ভগবান আপনার ভালো করবেন৷ কুচবেহার কালীবাড়িতেও আমাদের নাম লেখানো আছে মাসে পনেরো দিন৷ বাকি পনেরো দিন আমবেড়েয় আর এই ছত্তরে—

আর চার-পাঁচজন নিজেদের দুরবস্থা সবিস্তারে এবং নানা অলঙ্কার দিয়ে বর্ণনা করেছে, এমন সময় পায়েস এসে হাজির হল৷ একটা ছোট পিতলের গামলার এক গামলা পায়েস, খেতে বসেছে প্রায় জন ত্রিশ-বত্রিশ, বেশি করে কাউকে দেওয়া সম্ভব নয়—অথচ প্রত্যেকেই নির্লজ্জভাবে অনুযোগ করতে লাগল তার পাতে পায়েস কেন অতটুকু দেওয়া হল, রোজই তো পায়েস কম পায়, তাকে আজ একটু বেশি করে দেওয়া হোক৷ কেউ কেউ ঝগড়াও আরম্ভ করলে পরিবেশনকারিণীর সঙ্গে৷

শরৎ রেণুকাকে নিয়ে বাইরে চলে এল৷ বললে, কেন ওরকম বললি? ছিঃ—ওরা সবাই গরিব, ওদের লোভ দেখাতে নেই৷

তারপর অন্যমনস্কভাবে বললে, ইচ্ছে করে ওদের খুব করে পায়েস খাওয়াই৷ আহা, খেতে পায় না, ওদের দোষ নেই—ছত্তরে বন্দোবস্ত ঠিকই আছে, একটু পায়েস দেয়, একটু ঘি দেয়—তবে ছিটেফোঁটা৷

রেণুকা বললে, বাবা, বুড়িগুলো একটু পায়েসের জন্যে কি রকম আরম্ভ করে দিয়েছে বল তো? খাচ্ছিস পরের দয়ায়—আবার ঝগড়া! ভিক্ষের চাল কাঁড়া-আঁকাড়া!

—আহা ভাই—কত দুঃখে যে ওরা এমন হয়েছে তা তুমি আমি কি জানি? মানুষে কি সহজে লজ্জাশরম খোয়ায়? ওদের বড় দুঃখ৷ সত্যি ভাই, আমার ইচ্ছে করছে, আজ যদি আমার ক্ষমতা থাকত, বাবার নামে ছত্তর দিতাম৷ আর তাতে নিজের হাতে বড় কড়ায় পায়েস রেঁধে ওদের খাওয়াতাম৷ সেদিন যেমন কড়ায় হালুয়া রেঁধে দিল সেই ছত্তরটা—তুই দেখিস নি—চাদরের মস্ত বড় কড়া৷

—নে চল আমার হাত ধর—

—ওই পাগলিকে নিজের হাতে রেঁধে একদিন পেটভরে খাওয়াব৷ তোর বাড়িতে—

—বেশ তো৷

—আমি মাইনে বলে কিছু চাইলে ওরা দেবে না?

—দেওয়া তো উচিত৷ তবে গিন্নিটি যে রকম ঝানু—তুমি তো ভাই মুখ ফুটে কিছু বলতে পারবে না—

—মরে গেলেও না৷ তবে একবার বলে দেখতে হবে৷ বেশি লোককে না পারি, একজনকেও তো পারি৷

ওরা খানিক দূর এসেছে, ছত্রের উত্তর দিকের উঁচু রোয়াক থেকে পুরুষের দল খেয়ে নেমে আসছে, হঠাৎ তাদের মধ্যে কাকে দেখে শরৎ থমকে দাঁড়িয়ে গেল৷ তার মুখ দিয়ে একটা অস্ফুট শব্দ বার হল—পরক্ষণেই সে রেণুকার হাত ছেড়ে দিয়ে সেদিকে এগিয়ে চলল৷

বিস্মিতা রেণুকা বললে, কোথায় চললে ভাই? কি হল?

পুরুষের ভিড়ের মধ্যে এঁটোহাতে নেমে আসছেন সেই বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ, তিন বৎসর আগে যিনি পদব্রজে দেশভ্রমণে বেরিয়ে গড়শিবপুরে শরৎদের বাড়ির অতিথিশালায় কয়েকদিন ছিলেন৷

শরৎ চেয়ে চেয়ে দেখলে৷ কোনো ভুল নেই—তিনিই৷ সেই গোপেশ্বর চট্টোপাধ্যায়৷

সে প্রথমটা একটু ইতস্তত করছিল—কিন্তু তখনি দ্বিধা ও সঙ্কোচ ছেড়ে কাছে গিয়ে বললে, ও জ্যাঠামশাই? চিনতে পারেন?

সেই বৃদ্ধ ব্রাহ্মণই বটে৷ শরতের দিকে অল্পক্ষণ হাঁ করে চেয়ে থেকে তিনি আগ্রহ ও বিস্ময়ের সুরে বললেন—মা, তুমি এখানে?

—হ্যাঁ জ্যাঠামশাই, আমি এখানেই আছি—

—কতদিন এসেছ? রাজামশায় কোথায়? তোমার বাবা?

—তিনি—তিনি দেশে৷ সব কথা বলছি, আসুন আমার সঙ্গে৷ আমার সঙ্গে একটি মেয়ে আছে—ওকে ডেকে নিই৷ আপনি হাতমুখ ধুয়ে নিন জ্যাঠামশায়৷

পথে বেরিয়েই গোপেশ্বর চাটুজ্জে বললেন—তারপর মা, তুমি এখানে কবে এসেছ? আছ কোথায়?

—সব বলব৷ আপনি আগে বসুন, আপনি কবে এসেছেন?

—আমি সেই তোমাদের ওখান থেকে বেরিয়ে আরও দু-এক জায়গায় বেড়িয়ে বাড়ি যাই৷ বাড়িতে বলেছি তো ছেলের বউ আর ছেলেরা—তাদের অবস্থা ভালো না৷ কিছুদিন বেশ রইলাম—তার পর এই মাঘ মাসে আবার বেরিয়ে পড়লাম—একেবারে কাশী৷

—হেঁটে?

—না মা, বুড়ো বয়সে তা কি পারি? ভিক্ষে-সিক্ষে করে কোনোমতে রেলে চেপেই এসেছি৷ ছত্তরে ছত্তরে খেয়ে বেড়াচ্ছি৷ মা অন্নপুণ্ণোর কৃপায় আমার মতো গরিব ব্রাহ্মণের দুটো ভাতের ভাবনা নেই এখানে৷ চলে যাচ্ছে এক রকমে৷ আর দেশে ফিরব না ভেবেছি মা৷

রেণুকাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে শরৎ বললে, চলুন জ্যাঠামশায়, দশাশ্বমেধ ঘাটে গিয়ে বসি৷ দুজনে গিয়ে দশাশ্বমেধ ঘাটের রানায় বসলো৷

গোপেশ্বর চাটুজ্জে বললেন, তারপর মা, তোমার কথা বলো৷ কার সঙ্গে এসেছ কাশীতে? ও মেয়েটি বুঝি চোখে দেখতে পায় না? ও কেউ হয় তোমাদের?

শরতের কোনো দ্বিধা হল না৷ এই পিতৃসম স্নেহশীল বৃদ্ধের কাছে সব কথা খুলে বলতে৷ অনেক দিন পরে সে এমন একজন মানুষ পেয়েছে, যার কাছে বুকের বোঝা নামিয়ে হালকা হওয়া যায়৷ কথা শেষ করে সে আকুল কান্নায় ভেঙে পড়ল৷

বৃদ্ধ গোপেশ্বর চাটুজ্জে সব শুনে কাঠের মতো বসে রইলেন৷

এসব কি শুনছেন তিনি? এও কি সম্ভব?

শেষে আপন মনেই যেন বললেন, তোমার বাবা রাজামশায় তা হলে দেশেই—না?

—তা জানি নে জ্যাঠামশায়, বাবা কোথায় তা ভেবেছিও কতবার—তবে মনে হয় দেশেই আছেন তিনি—যদি এতদিন বেঁচে থাকেন—

কান্নার বেগে আবার ওর কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে গেল৷

—আচ্ছা, থাক মা, কেঁদো না৷ আমিও বলছি শোনো—গোপেশ্বর চাটুজ্জে যদি অভিনন্দ ঠাকুরের বংশধর হয়, তবে এই কাশীর গঙ্গাতীরে বসে দিব্যি করছি তোমাকে তোমার বাবার কাছে নিয়ে যাবই৷ তুমি তৈরি হও মা—কালই রওনা হয়ে যাব বাপে-ঝিয়ে—তুমি কোন বাড়ি থাকো—চল দেখে যাই৷ তুমি কি মেয়ে, আমার তা জানতে বাকি নেই৷ নরাধম পাষণ্ড ছাড়া তোমার চরিত্রে কেউ সন্দেহ করতে পারে না৷ আমার রোগ থেকে সেবা করে তুমি বাঁচিয়ে তুলেছিলে—তা আমি ভুলি নি—আমার আর জন্মের মা-জননী তুমি৷ তোমায় এ অবস্থায় এখানে ফেলে গেলে আমার নরকেও স্থান হবে না যে৷

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress