কেংকেলাস
গদাধরবাবু বললেন, আমার ধানবাদের পিসিমাকে তো তোমরা দেখেছ। পিসিমার খুড়শ্বশুরের নাতির নাম ছিল অশ্বিনী। অশ্বিনীর সম্বন্ধীয় মাসতুতো দাদা হল গিয়ে নগেন। নগেনের মেজকাকার বড় ছেলে নিবারণ। নিবারণের শ্যালক হরেনের ছেলের নাম সত্যেন। সত্যেনের ভগ্নিপতির পিসতুতো ভাইয়ের…
সাতকড়ি গোঁসাই খেপে গিয়ে বললেন,–মলো ছাই! হলটা কী, তা বলবে না। খালি কার পিসি, কার দাদা, কার শ্যালক!
রমণী মুখুয্যে বললেন,–আহা! বলতে দাও, বাধা দিচ্ছ কেন? খোলাখুলি পরিচয় না দিলে বুঝবে কেন তোমরা? বলল হে গদাইভায়া, বলো।
গদাধর কিন্তু গোঁসাইয়ের ওপর চটেছেন বাধা পড়েছে বলে। বাঁকামুখে বললেন, আর বলব না।
অমনি হইচই উঠল আড্ডায়। রমণীবাবু, বটকুবাবু, বংশীলোচনবাবু একসঙ্গে বলে উঠলেন, বলো, বলল। আমরা শুনব।
একঘরে হয়ে যাচ্ছেন টের পেয়ে অগত্যা গোঁসাইও মিনমিনে গলায় বললেন,–আহা! গল্পের রস বলে একটা কথা আছে তো! তাই বলছিলাম, শর্টকাটে এলে রসটা জমে ভালো। গদাই, কিছু মনে কোরো না ভায়া। নাও, শুরু করো।
তখন গদাধর তার উল্লেখযোগ্য আরামকেদারায় একটু চিতিয়ে চোখ বুজে হঠাৎ বললেন,-কেংকেলাস!
আড্ডার সবাই থ। মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছেন পরস্পর। তারপর বটুকবাবুই প্রশ্ন করলেন, কী বললে?
–কেংকেলাস!
রমণীবাবু কৌতূহলী হয়ে বললেন, তার মানেটা তো বুঝতে পারলাম না গদাই! হঠাৎ কেং কৈলাস-টৈলাস…এর মানে?
গদাধর গম্ভীরমুখে বললেন,–কেংকৈলাস নয়, কেংকেলাস। গোঁসাই ওঁর দিকে ঝুঁকে বললেন,–কেংকেলাসটা কী শুনি?
গদাধর তেতোমুখে বললেন, তোমাদের মাথায় তো খালি গোবর পোরা। সহজে কিছু বোঝানো যাবে না। যার কথা বলতে যাচ্ছিলাম, কেংকেলাসের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল তারই মারফত।
বংশীলোচনবাবু রাশভারী মানুষ। জমিদারি ছিল তার বাবার আমলে। এখনও সেই আমলের পাদানিওয়ালা কালো কুচকুচে ফোর্ড গাড়িটা আছে। সেটা হাঁকিয়েই এই আড্ডায় আসেন। তাকে সবাই খুব খাতির করেন। তিনি বললেন,–মনে হচ্ছে, ব্যাপারটা বেশ রহস্যময়। শুরু করে গদাইভায়া।
গদাধর উৎসাহিত হয়ে বললেন, রহস্যময় মানে? রীতিমতো মিসট্রিয়াস। এই দেখো না! লোমগুলো কেমন সূচের মতো হয়ে গেল! দেখো, দেখো।
গোঁসাই বললেন, হ্যাঁ, ক্ষান্তপিসি অনায়াসে কথা সেলাই করতে পারবে। বলল, বলে যাও!
গদাধর ফের চটতে গিয়ে হেসে ফেললেন। বললেন, তুমি তো বরাবর অবিশ্বাসী। ভূত-ভগবান কি মানো না। তবে কেংকেলাসের পাল্লায় পড়লে ঠ্যালাটা বিলক্ষণ টের পেতে। যাকগে, তোমাকে কিছু বোঝানো বৃথা।
বলে একটিপ নস্যি নিয়ে বিকট একটা হচ্চো করে রুমালে নাক মোছর পর গদাধর বকসী শুরু করলেন।
–হ্যাঁ, কদ্দুর বলেছিলাম যেন? সেই সত্যেনের ভগ্নিপতির পিসতুতে ভাইয়ের নাম ছিল ভূতনাথ। এই ভূতনাথ বড় ডানপিটে সাহসী ছেলে ছিল। আর তখন আমার বয়স কম। আমার গায়েও তখন একটা খুদে পালোয়নের জোর। দুজনেই ক্লাস টেনের ছাত্র–তখন বলা হতো ফার্স্ট ক্লাস। তো সেবারে পুজোর ছুটিতে বেড়াতে গেছি ধানবাদ। ভূতনাথ আর আমি দিনরাত টো-টো করে ঘুরে বেড়াচ্ছি এখানে-সেখানে। ওদিকে তো খালি খনি আর খনি। মাটির তলায় টন টন কয়লার চাঙড়। সেইসব কয়লা তোলা হচ্ছে সুড়ঙ্গ কেটে। আমি নতুন গেছি বলে ভূতনাথ ঘুরে-ঘুরে সব দেখাচ্ছে। ওর অনেক আত্মীয় খনিতে চাকরি করেন। তাই একেবারে খনির ভেতরে–মানে পাতালপুরীতে গিয়ে সব দেখছি-টেখছি। এইসময় একদিন হঠাৎ ভূতনাথ বলল,–গদাই, এখান থেকে মাইল পাঁচেক দূরে সিন্দ্রির ওদিকে মাঠের মধ্যে একটা পোড়োখনি আছে, যাবে সেখানে? আমি উৎসাহে চনমন করে উঠলাম। পোড়ো-বাড়ির মতো পোড়োখনিও যে থাকে জানতাম না কিনা। এইসব খনি থেকে খনিজ জিনিস তুলে শেষ করা হয়েছে। তারপর আর সেখানে কেউ যায় না। মাটির তলায় সুড়ঙ্গ, গুহা আর যেন পাতালপুরী শাখা করে। অবশ্য সেইসব পোড়োখনির মুখ বন্ধ করে দেওয়াই নিয়ম। কিন্তু ভূতনাথ যেটার কথা বলল, সেটা নাকি বন্ধ করা যায়নি। কেন যায়নি, সেটাই বড় রহস্যময়। যতবার বন্ধ করা হয়েছে, ততবার দেখা গেছে কে বা কারা মাটি-পাথর সরিয়ে ফেলেছে। তো এই খনিটা ছিল অভ্রের।
গোঁসাই বললেন,–অভ্রের?
হ্যাঁ, অভ্রের বলে গদাধরবাবু চোখ বুজলেন আবার। একটু-একটু দুলতেথাকলেন। এমন সময় ওঁর নাতি আর নাতনি, মুকুল আর মঞ্জুও এসে জুটল। তাদের সঙ্গে গদাধরের চাকর তিনকড়ি একটা ট্রে সাজিয়ে চা-চানাচুর আনল। সঙ্গে সঙ্গে খুব জমে উঠল আড্ডা।
মুকুল বলল, কীসের গল্প দাদু? ভূতের, না রাক্ষসের? আমি ভূতেরটা শুনব।
মঞ্জু বলল,-না, না দাদু। আমি শুনব রাক্ষসের।
গদাধর একটু হেসে বললেন, তাহলে চুপটি করে বোসো৷ গল্প নয়—একেবারে সত্যি ঘটনা। ভূতেরও বলতে পারো, রাক্ষসেরও বলতে পারো।
গোঁসাই ফিক করে হেসে বললেন,–তাহলে সন্ধি করে নাও। ভূত্রাক্ষসের গল্প। ভূত্রাক্ষস নিশ্চয় সাংঘাতিক ব্যাপারই হবে।
তুমি থামো তো!–ধমক দিয়ে গদাধর ফের শুরু করলেন। চায়ে চুমুক দিতেও ভুললেন না। ঘরে এখন শুধু চানাচুরের মুচমুচে শব্দ আর চায়ের সুড়সুড়! কে জানে কেন, মুকুল আর মঞ্জু দাদু আর তাঁর বন্ধুদের মুখের দিকে তাকিয়ে চুপিচুপি হাসতে থাকল। কিন্তু সে হাসি মিলিয়ে যেতে দেরি হল না অবশ্য।
গল্পটা আর গদাধরবাবুর মুখের কথায় না সাজিয়ে চলতি কায়দায় বলা যাক।
তো কিশোর বয়সি গদাধর আর ভূতনাথ একদিন দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর বেরিয়ে পড়ল সিন্দ্রির মাঠে। সেই পোড়ো অভ্রখনি দেখতে।
এখন সিন্দ্রিতে সার কারখানা হয়েছে। কত সব ঘর-বাড়ি, রাস্তাঘাট, লোকজন। বিশাল এলাকা জুড়ে শহর গড়ে উঠেছে। কিন্তু তখন একেবারে খাঁ-খাঁ মাঠ আর কোথাও-কোথাও জঙ্গল। কোথাও আদিবাসীদের বসতিও ছিল।
১৯৪০ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এক ইংরেজ ওই অখনির মালিক ছিলেন। খনির সব অভ্র শেষ হয়ে গেলে দুবছর পরেই তিনি খনিটা ছেড়ে দেন। সুদূর ভাগলপুরের এক রাজা নাকি ছিলেন ওইসব জমির মালিক। লিজ করা জায়গা আবার ফিরে এসেছিল সেই রাজার হাতে। তার কাছ থেকে বন্দোবস্ত নিয়ে আদিবাসীরা খনির ওপরকার জমিতে চাষবাস করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, ফসল কাঁচা থাকতেই শুকিয়ে যেত। সব মেহনত বরবাদ। অগত্যা জমি ছেড়ে দিয়েছিল তারা। জঙ্গল-ঝোঁপঝাড় গজিয়ে গিয়েছিল আবার। তারই নিচে সুড়ঙ্গ আর পাতালপুরীর মতো পোড়োখনিটা রয়েছে।
গদাধর আর ভূতনাথ সেখানে গিয়ে হাজির হল।
ভূতনাথ বলল,-পোড়ো-খনিটার তিনটে মুখ আছে। আমি দুটোর মধ্যে ঢুকে অনেকটা দূর অবধি দেখে এসেছি। ভীষণ অন্ধকার কিন্তু। টর্চ ছাড়া যাওয়া যায় না। সেজন্যেই টর্চ এনেছি। আজ তোমাকে নিয়ে তৃতীয় সুড়ঙ্গটায় ঢুকব চললো।
তৃতীয় মুখটা ঘন ঝোঁপজঙ্গলের মধ্যে একটা ঝাকড়া বটগাছের হাত বিশেক দূরে। মুখটা আন্দাজ হাত পনেরো চওড়া। দুজনে পাথরের খাঁজ আঁকড়ে ধরে অতি কষ্টে নামল।
বর্ষার জল তখন জমে আছে ডোবার মতো। সেই জলের ধার দিয়ে ওরা সুড়ঙ্গের দরজায় পৌঁছল। গদাধরের কেন যেন গা ছমছম করে উঠল। ভেতরটা কী অন্ধকার! টর্চ জ্বেলে আগে ঢুকল ভূতনাথ, পেছনে গদাধর।
সুড়ঙ্গটা বেশ চওড়া আর উঁচু। কিছুটা যেতেই হঠাৎ পোড়া গন্ধ লাগল নাকে। মনে হল ভেতরে কোথাও কে উনুন জ্বেলেছে যেন।
ভূতনাথ ফিসফিস করে বলল,-বুঝেছি। বাছাধনের ওই সুড়ঙ্গ দুটো পছন্দ হয়নি। এই তিন নম্বরে এসে জুটেছে।
গদাধর বলল,–কে? কার কথা বলছ ভুতু?
ভূতনাথ টর্চ নিভিয়ে বলল, কে জানে! ব্যাটার চেহারা বড় বিচ্ছিরি। একেবারে মামদো ভূতের মতো। আধপোড়া মাংস খায়। তবে ওকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আর টর্চ জ্বালব না। তুমি আমাকে ছুঁয়ে-ছুঁয়ে এসো।
ঘুরঘুট্রি অন্ধকার। মাঝে-মাঝে মাকড়সার ঝুল জড়িয়ে যাচ্ছে গদাধরের মাথায়। আর কেমন বিচ্ছিরি গন্ধ। পায়ে গুঁতো মেরে কী একটা জন্তু দৌড়ে যেতেই গদাধর চেঁচিয়ে উঠেছিল আর কী! ভূতনাথ বলল, চুপ, চুপ। স্পিকটি নট।
কিছুটা এগোতেই বোঝা গেল সুড়ঙ্গটা ডাইনে ঘুরেছে। তারপর গদাধর যা দেখল, ভয়ে বিস্ময়ে মুখে কথা সরল না।
একটা মানুষ নাকি, মানুষই নয়–ভূতুড়ে চেহারা, সামনে গনগনে লাল আগুনের অঙ্গার থেকে একটা খেঁকশিয়ালের মতো খুদে জন্তু পুড়িয়ে কড়মড় করে খাচ্ছে। আগুনের ছটায় আবছা তার ভয়ংকর চেহারাটা ফুটে উঠেছে।
দুজনে বসে পড়েছিল চুপচাপ। একটু পরে কে জানে কেন, গদাধরের প্রচণ্ড হাঁচি পেল। কিছুতেই সামলাতে পারল না। হ্যাঁচ্চো করে একখানা জব্বর হাঁচি ঝেড়ে দিল।
অমনি ভুতুড়ে চেহারার সেই পোড়ামাংসখেকোটা এদিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে গর্জে উঠল চেরাগলায়–কেঁ রেঁ?
ওরে বাবা! ভূত নাকি নাকিস্বরে কথা বলে। তাহলে এ ব্যাটা সত্যি ভূত। গদাধর ঠকঠক কঁপতে শুরু করেছে।
কিন্তু ভূতনাথের গ্রাহ্য নেই। টর্চ জ্বেলে তার মুখের ওপর ফেলে বলল, ও কী খাচ্ছ মামা? খেঁকশিয়াল, না খরগোশ?
হিঁ হিঁ হিঁ হিঁ! –সে কী পিলে চমকানো হাসি! ওই হাসি হেসে সে নাকিম্বরে বলল,–কেঁ রেঁ? ভুঁতুঁ নাঁকি? আঁয়, আঁয়!
বলে সে একটা কাঠ গুঁজে দিল আগুনে। হু-হুঁ করে জ্বলে উঠল কাঠটা। তার ফলে আলো হলো প্রচুর। ভূতনাথ গদাধরকে টেনে নিয়ে গিয়ে একটু তফাতে বসল।
–ওঁটা কেঁ রেঁ?
ভূতনাথ বলল, আমার বন্ধু গদাই। তোমাকে দেখতে এসেছে, মামা।
আবার হিঁ হিঁ করে হেসে সে বলল, আঁমাকে দেঁখবি? তঁবে ভাঁলো কঁরে দ্যাঁখ! এঁই দ্যাঁখ!
বলেই সে গদাধরের চোখের সামনে একটা প্রকাণ্ড কালো বাদুড় হয়ে ছাদ আঁকড়ে ধরে দিব্যি দুলতে শুরু করল। গদাধর হাঁ করে তাকিয়ে আছে তো আছে। ভূতনাথের কাধ আঁকড়ে ধরেছে নিজের অজান্তে। কাঁপুনি সামলাতে পারছে না। এ কি সম্ভব!
ভূতনাথ হাসতে-হাসতে বলল, খুব হয়েছে মামা। তোমার খাবার পড়ে রইল যে। এক্ষুনি কেংকেলাস এসে মেরে দেবে!
অমনি বাদুড়বেশী কিম্ভুত সেই প্রাণীটি ধুপ করে পড়ল। পড়ে আবার আগের চেহারা নিয়ে চোখ পাকিয়ে বলল, কঁ, কঁ?
–কেংকেলাস এসে তোমার খাবার খেয়ে ফেলবে। ঝটপট শেষ করে নাও।
–ইঁস! কেঁংকেলাসকে তাঁহলে কুঁলে আঁছাড় মাঁরব নাঁ?
–পারবে না মামা। তার গায়ের জোর তোমার চেয়ে ঢের বেশি।
সে কোনও কথা না বলে কড়মড়িয়ে খুদে প্রাণীর রোস্টটা সাবাড় করতে ব্যস্ত হল। মাথাটি চিবিয়ে খাবার পর তৃপ্তিতে একটু ঢেকুর তুলে বলল, হ্যাঁ রে
–বলল মামা।
–কেঁংকেলাস কোথায় থাকে বেঁ?
–ওপরের বটগাছটায়। সেদিন শুনলে না? কেমন মনের আনন্দে ঠ্যাং ঝুলিয়ে গান গাইছিল!
গদাধরের মনে হল, মামদোটা কেমন মনমরা হয়ে গেল এই শুনে। হওয়ারই কথা। ওরা সুড়ঙ্গের মধ্যে যেখানে বসে আছে, হয়তো তার ছাদের ওপাশেই সেই বটগাছটা।
সে ভূতনাথের কথা শুনে বেজার মুখে বলল,–উঁতু! তাহলে আঁমি রং আঁন্য কোথাও চলে যাই রে।
তাই যাও মামা-ভূতনাথ বলল, চাসনালার ওখানে একটা পোড়া কয়লাখনি . আছে। সেখানে মনের সুখে থাকো গে!
নাঁ বেঁ! কয়লাখনির দিকে গেলেই আঁমি কালো হয়ে যাব। বলে মামদো তার লিকলিকে হাতের চামড়া থেকে ময়লা রগড়াতে থাকল।
ভূতনাথ বলল, এই সেরেছে! ও মামা, মনে হচ্ছে এই অভ্রখনির আসল বাসিন্দা ভদ্রলোক এসে পড়েছেন, পালাও, পালাও!
দুমদাম পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। ক্রমশ শব্দটা এদিকেই আসছে। একবার ঘুরে অন্ধকারটা লক্ষ করেই মামদোটা চোখের পলকে একটা প্রকাণ্ড চামচিকে হয়ে গেল এবং সনসন করে গদাধরের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে পালিয়ে গেল। কী বিচ্ছিরি গন্ধ তার গায়ের।
গদাধরের গালে একটুখানি ঠেকে গিয়েছিল সেই চামচিকের ডানার ডগাটা। আর তাই থেকেই এখন একটা মস্ত আঁচিল হয়ে গেছে।
তো একটু পরে বেঁটে গোলগাল গাঙফড়িং-এর ডানার মতো সাদা রঙের একটা মানুষ কিংবা মানুষ নয়, এমন এক প্রাণী এসে দাঁড়াল আগুনের কুণ্ডটার পাশে।
তার চুলগুলো খোঁচা-খোঁচা, লাল। গোঁফও তেমনি। কানদুটো প্রকাণ্ড। বড় বড় গোল চোখ। সে ভারিক্তি গলায় বলল,-কে রে তোরা?
ভূতনাথ গদাধরকে চিমটি কেটে সেলাম ঠুকল। গদাধরও বুঝল, তাকেও সেলাম ঠুকতে হবে। ভূতনাথ বলল, দাদামশাই, আমি ভুতু। আর এ আমার বন্ধু গদাই।
–আমার ঘরে তোরা কোন মতলবে রে?
ভূতনাথ বিনীতভাবে এবং চাপাগলায় বলল, দাদামশাই, তোমায় সাবধান করতে এলাম। কেংকেলাস তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।
অমনি কিম্ভুত প্রাণীটা চাপাগলায় বলে উঠল, কে, কে?
–কেংকেলাস, দাদামশাই।
এই আজব জীবটি কেংকেলাস শোনামাত্র থপথপ করে দৌড়ে যেদিক থেকে এসেছিল, সেদিকে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল।
ভূতনাথ হাসতে-হাসতে বলল, খুব ভয় পেয়ে গেছে।
গদাধর এতক্ষণে জিগ্যেস করতে যাচ্ছিল,–কেংকেলাস কে। কিন্তু সুযোগই পেল না। খনিমুখের দিকে আবছা চাচামেচি শোনা গেল।
তারপর কারা দৌড়ে আসছে মনে হল।
গদাধর হাঁ করে তাকিয়ে দেখল, গোটা পাঁচেক মানুষ কিংবা মানুষ নয় গোছের আজব প্রাণী এসে তাদের পাশ দিয়ে এগিয়ে আগুনের কুণ্ডটার দিকে ঝুঁকে রইল।
মাথায় তিন ফুট থেকে চার ফুট উঁচু এই জীবগুলো কালো পাকাটির মতো। কাঠির ডগার মুণ্ডু বসালে যেমন হয়, তেমনি। কিন্তু হাত-পা আছে দস্তুরমতো। চোখগুলো ড্যাবড়েবে, লালচে। গোঁফও আছে। তারা চ্যাঁ-চ্যাঁ করে কী বলছে, বোঝা যাচ্ছিল না। মনে হল, সেই মামদোর এটো চিবুনো হাড়গুলো খুঁজছে তারা।
তারপর তাদের চোখ পড়ে গেল ভূতনাথদের দিকে। অমনি পাশটিতে দাঁড়িয়ে গেল। একসঙ্গে আঙুল তুলে এদের দিকে শাসানির ভঙ্গিতে বলতে লাগল, মুন্ডু খাব, ঠ্যাং খাব! ঘিলু খাব, ফুসফুস খাব। কলজে খাব, পিলে খাব। চোখ খাব, নাক খাব।
ভূতনাথ হাসতে-হাসতে বলল,–আর দাঁত? দাঁতগুলো খাবিনে?
সঙ্গে সঙ্গে তারা আবার একসঙ্গে বলে উঠল, দাঁত খাব, দাঁত খাব।
ভূতনাথ কী বলতে যাচ্ছে, গদাধর ততক্ষণে ওইসব খাওয়ার শাসানি শুনে রীতিমতো ঘাবড়ে গিয়ে বলে ফেলল,–কেংকেলাস আসছে! কেংকেলাস!
ব্যস! কাজ হয়ে গেল। প্রাণীগুলি অমনি চাঁ-া করতে করতে যে-যেদিকে পারল, অন্ধকারে পালাতে শুরু করল।
তিন ফুট উঁচু যেটা, সে ধাক্কা খেয়ে গড়িয়ে পড়ে ঊ্যা করে কেঁদে উঠেছিল। একজন এসে তাকে টানতে-টানতে নিয়ে পালাল।
ভূতনাথ বলল, বাঃ গদাই! তাহলে কেংকেলাসের মর্ম পেয়ে গেছ।
গদাধর ততক্ষণে অনেকটা সাহসী হয়েছে। বলল, ভাই ভুতু, আন্দাজে কিংবা মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে। কিন্তু কেংকেলাস ব্যাপারটা কী? ওটা শুনেই ওরা পালিয়ে যাচ্ছে কেন?
ভূতনাথ বলল, যাদের দেখলে, এরা হল গিয়ে পোডো-খনির ভূত। কেংকেলাস তাদের থানার দারোগাবাবুর নাম।
গদাধর অবাক হয়ে বলল, আঁ! ভূতের আবার দারোগা! থানা-পুলিশ!
ভূতনাথ আগুনের কুণ্ডে একটা শুকনো কাঠ ফেলে বলল,-বাঃ! ওদের বুঝি থানা-পুলিশ থাকতে নেই? না থাকলে চলবে কেন? ভূতদের মধ্যে চোর-ডাকাত নেই বুঝি? চোর-ডাকাত থাকলেই পুলিশ থাকবে। সেই ভৌতিক পুলিশের দারোগাবাবুর নাম কেংকেলাস। খুব জাদরেল দারোগা।
গদাধর বলল,-বুঝলাম। কিন্তু তুমি কেমন করে জানলে ভাই ভুতু?
ভূতনাথ হাসতে-হাসতে বলল, আমার নাম ভূতনাথ ওরফে ভুতু। আমি ভূতের খবর জানব না তো কে জানবে?
গদাধর আগ্রহ দেখিয়ে বলল, বলো না ভাই, শুনি?
ভূতনাথ বলল, মুখে শুনে কী হবে? চলো না, তোমার সঙ্গে কেংকেলাসের আলাপ করিয়ে দিই। না, না। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। অতি সজ্জন, ভদ্র, অমায়িক ভদ্রলোক। অবশ্য চোর-ডাকাতের সামনে কড়া না হলে তো চলে না। কই, ওঠো।
দুজনে টর্চের আলোয় সুড়ঙ্গ দিয়ে বাইরে এল। পাথরের খাঁজ আঁকড়ে ধরে খোলা গর্তের মতো খনিমুখ বেয়ে ওপরে উঠল। তখন বেলা পড়ে এসেছে।
ভূতনাথ বটগাছটা দেখিয়ে বলল,–এই গাছের মধ্যিখানে আধপোড়া শুকনো ছাল ছাড়ানো ডালটা দেখতে পাচ্ছ? কেইকোস ওখানেই থাকে। একটু পরে সন্ধ্যা হবে। তখন সে চোর-ডাকাত ধরতে বেরোয়। এসো–এখন তার থাকার কথা।
গদাধরের গা ছমছম করছিল। তবে ভূতনাথের মতো সঙ্গী থাকতে যে তার এতটুকু ক্ষতি হবে না, টের পেয়ে গেছে ততক্ষণে।
দুজনে গাছটার তলায় এসে দাঁড়াল। অজস্র পাখি বটগাছের ডালে তখন এসে জুটেছে। কানে তালা ধরে যায়। ভূতনাথ ডালপালার ফাঁক দিয়ে সেই বাজপড়া ডালটার দিকে তাকিয়ে ডাকল,–কেংকেলাসবাবু আছেন নাকি? কেংকেলাসবাবু-উ-উ!
এ পর্যন্ত শুনেই সাতকড়ি গোঁসাই হো-হো করে হেসে উঠলেন।
আচমকা তাল কেটে গিয়ে গদাধরবাবু খেপে গিয়ে বললেন, হাসবার কী আছে এতে? গোঁসাই, তোমায় সাবধান করে দিচ্ছি। আর যাই করো, কেংকেলাস শুনে হেসো না।
গোসাঁই বললেন,–কেন? হাসব না কেন শুনি? আর কোনও নাম পেল না– সব থাকতে কেংকেলাস।
রমণীবাবু বললেন,–আহা, ওটা যে ভূতপেরেতের নাম।
বংশীলোচন বললেন, তার চেয়ে বড় কথা, ওটা ভূতপ্রেতের দারোগাবাবুর নাম। অন্য নাম মানানসই হবে কেন?
মঞ্জু বলল, নাও! দিলে তো সবাই গল্পটা ভেঙে।
মুকুল বলল,-ও দাদু, কেংকেলাসবাবু কী করলেন বলল এবার।
গদাধর পাশের টেবিলের ড্রয়ার টেনে ছবির একটা অ্যালবাম বের করে বললেন,–গোঁসাই, সেই বটতলায় গত পুজোয় গিয়েছিলাম। এখনও ওটা সিন্দ্রি টাউনশিপের চৌরাস্তার ধারে রয়েছে। ওখানে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছিলাম। এই দেখো, সেই বাজপড়া ডালটা এখনও আছে। দেখতে পাচ্ছ?
সবাই ঝুঁকে পড়লেন ছবিটার দিকে। হ্যাঁ, ডালটা পরিষ্কার উঠেছে।
বংশীলোচন বললেন, তুমি নিজেই তুলেছ নাকি গদাই?
গদাধর বললেন, হ্যাঁ। তুলেছি, তার কারণ আছে। এখন তো জায়গাটা শহর হয়ে গেছে। লোকজন গাড়িঘোড়া চলছে। গতবছর গিয়ে একদিন দুপুরবেলা লোডশেডিং-এর সময় গায়ে হাওয়া দিতে বটতলায় দাঁড়িয়েছিলাম। রাস্তাঘাট তখন প্রায় কঁকা। একটা-দুটো গাড়ি বা রিকশো যাচ্ছে। লু হাওয়া উঠেছে। তাই সব দোকানপাটের সামনে তেরপল ঝুলিয়ে রেখেছে। হঠাৎ মনে হল মাথায় কী ঠেকছে। মুখ তুলে দেখি একটা পা।
সবাই একসঙ্গে বলে উঠলেন,–পা! কীসের পা?
বলছি। বলে গদাধর চোখ বুজে কয়েক দণ্ড চুপ করে থাকার পর মুখ খুললেন। তক্ষুনি বোঝা উচিত ছিল, পারিনি। সেই ছেলেবেলায় একবার মাত্র দেখেছিলাম।
–কাকে? কাকে?
–কেংকেলাসবাবুকে। অথচ আশ্চর্য ব্যাপার, এখনও বেঁচে আছেন দারোগা ভদ্রলোক এবং ওই বটগাছের থানাতেই আছেন। বদলি হননি। মাথায় পা ঠেকতেই ওপর থেকে একটু হেসে বললেন, কী? চিনতে পারছ তো? তক্ষুনি মনে পড়ে গেল। নমস্কার করে বললাম, ভালো আছেন স্যার? প্রমোশন হয়নি। নাকি হয়েছে? কেংকেলাসবাবু দুঃখিভাবে বললেন, ব্রাদার। সেই পোস্টেই আছি।
অবিশ্বাসী গোঁসাই আবার হো-হো করে হেসে উঠলেন।
আবার বাধা পড়ে হইচই উঠল। গদাধর আবার খেপে উঠলেন।
এবং তিনকড়ি দ্বিতীয়বার চা আনল।
তারপর মঞ্জু আর মুকুল খেই ধরিয়ে দিল। সেই বটতলায় ভূতনাথ ডাকছিল,– কেইকোসবাবু, আছেন নাকি? তারপর?
গদাধর অগত্যা শুরু করলেন।…
খনি অঞ্চলে খুনোখুনি মারদাঙ্গা চুরি-ডাকাতি লেগেই আছে। এখন কথা হচ্ছে, ওইসব দাগি খুনি আর চোর-ডাকাতরা মরে কি স্বর্গে যাবে? তাদের মুক্তি অত সোজা? তাদের ভূতপ্রেত হয়েই থাকতে হয়।
কিন্তু স্বভাব যাবে কোথা? তাই ভূত হয়েও উপদ্রব বাধায় হামেশা। তাই কেংকেলাস দারোগা ছাড়া উপায় নেই।
এসব কথা ভূতনাথের কাছে শোনা। সেদিন তো সেই পড়ন্ত বেলায় সিন্দ্রি মাঠে বটতলায় ভূতনাথ অনেক ডেকে কেংকেলাসের সাড়া পেল।
ওপর থেকে খ্যানখেনে গলায় আওয়াজ এল,–কী, কী, কী?
ভূতনাথ বলল, আমি ভুতু, স্যার। সঙ্গে আমার বন্ধু গদাই আছে। ও আপনার সঙ্গে আলাপ করতে চায়।
–সকালে এলেই পারতে বাবু! শুনছ না? এখন আমি রাগিণী ভাঁজছি! সোজা কথা নয়, পুরিয়াধানেশ্রী।
হ্যাঁ, তাই বটে। উনি বাতাসের সুরে রাগিণী ভাঁজছেন। এতক্ষণে কানে এল। তারপর বটগাছটায় হুলুস্থুলু করে একটা বাতাস এসে পড়ল। পাখিগুলো তুলকালাম চ্যাঁচিতে শুরু করল।
তারপর গদাধর কেংকেলাসকে দেখতে পেল।
তখন দেশে ইংরেজের শাসন চলছে। সে আমলের দারোগাবাবুদের নাম শুনলে চোর-ডাকাতের কাজে শুকিয়ে যেত। আর তখনকার ওনাদের চেহারাই বা কী ছিল? আজকাল তো সব ছেলে-ছোকরা দারোগা হয়ে যাচ্ছে।
কেংকেলাসের ভুঁড়িটা আড়াই বিঘৎ পরিমাণ। প্রকাণ্ড মাথা। পেল্লায় গোঁফ। কিন্তু রাগরাগিণী সেধে গলার অংশটা সরু। আর চোর-ডাকাতের সঙ্গে ছোটাছুটি করে পাদুটোও কাঠি-কাঠি। হ্যাট বগলে নিয়ে আর হোঁতকা মোটা বেটন হাতে ঝুলিয়ে দুম করে সামনে পড়লেন। পাখিগুলো চ্যাঁচিতে-চ্যাঁচিতে পালিয়ে গেল। গদাধর বলল, নমস্কার স্যার!
কেংকেলাস দারোগা মাথাটা একটু ঝুঁকিয়ে বললেন, ভালো। খুশি হলাম তোমাকে দেখে। কোন ক্লাস পড়ছ?
গদাধর জবাব দিতে যাচ্ছে, হঠাৎ দূরে সেই খনির গর্তের কাছে কারা চেঁচিয়ে উঠল,–চোর! চোর! চোর! অমনি কেংকেলাস দারোগা ফুটবলের মতো শূন্যে উঠে সেদিকে হাইকিক হয়ে চলে গেলেন।…
আবার বাধা পড়ল। গদাধরবাবু হার্টের রুগি। ডাক্তারবাবু এসে পড়লেন ইঞ্জেকশন দিতে। গদাধর বললেন, আজকের মতো এই তোমরা এখন এসো ভায়া। মঞ্জু, ঠামাকে ডাক।…
সবাই উঠলেন। যেতে-যেতে গোঁসাই বলে গেলেন! কেংকেলাসই বটে। কাকে বললেন, কে জানে।