কুমড়োকুমারীর নবজন্ম
সূর্যনগরে প্রায় বারো বছর পর নতুন সূর্য উদয় হতে চলেছে —তা নিয়ে মহারাজ সূর্য নারায়ণের উৎসাহের সীমা নেই।
মহারানী কিরণবালা মহারাজ সূর্যনারায়ণের নয়নের মণি— তা নিয়ে বাকি তিনরানীর হিংসার অন্ত ছিল না।
মহারাজ সূর্যনারায়ণ বংশরক্ষার জন্য একের পর এক তিন তিনজন রানীকে রাজপ্রাসাদে এনে ছিলেন কিন্তু তারা কেউই মহারাজের মনবাঞ্ছা পূরণ করতে পারে নি।
অবশেষে রাজবৈদ্য চরণদাসের কন্যা কিরণবালাকে মহারাজ সূর্যনারায়ণ ভারি পছন্দ হয়। সূর্যনারায়ণ নিজে কিরণবালাকে বিবাহের প্রস্তাব চরণদাসের কাছে রাখেন।
মহারাজের এমন প্রস্তাবে চরণদাস কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন । একদিকে এমন একটি প্রস্তাব তার ওপরে তার মা হারা একমাত্র কন্যা কিরণবালা রাজবাড়ীতে মানিয়ে গুছিয়ে নেবার চিন্তায় তিনি চিন্তান্বিত হয়ে পড়েন।
চরণদাসকে চিন্তিত হতে দেখে মহারাজ সূর্যনারায়ণ গুরুগম্ভীর গলায় বললেন “কি হল চরণদাস কি এত ভাবছ বলতো—তুমি কি আবার আমাকে নাকচ করে দেবে নাকি।”
আমতা আমতা করে চরণদাস হাত কচলে বলে “কি যে বলেন মহারাজ।এতো আমার চৌদ্দ পুরুষের ভাগ্য—-“
শুভদিন দেখে মহাসমারোহে মহারাজ সূর্যনারায়ণ কিরণবালাকে বিবাহ করে রাজপ্রাসাদে নিয়ে আসেন।
কিরণবালা রাজপ্রাসাদে পা রাখা ইস্তক তার তিন সতীনেরা এক্কাটা হয়ে কিরণবালাকে অপদস্ত করার জন্য ষড়যন্ত্র করতে থাকে।
মহারাজের বদ্যানতায় সেই সমস্ত বিপদ থেকে কিরণবালা উদ্ধার পেয়েছে।
এমনি করেই বছর ঘুরতে না ঘুরতেই মহারাজ সূর্যনারায়ণের মনবাঞ্ছা পূরণ হবার সংবাদ জানান মহারানী কিরণবালা।
চরণদাস নিজে রাজবৈদ্য। তাই মেয়ের এইসময়ে যেন কোন বিপদ না ঘটে —সেদিকে তার সজাগ দৃষ্টি।
আনন্দে আত্মহারা মহারাজ সূর্যনারায়ণ।এতদিন পরে তার স্বপ্নপূরণের সংবাদে বেজায় খুশী। তাই তিনি কিরণবালার প্রতি একটু বেশীই যত্নশীল।
মহারাজের কিরণবালার প্রতি অতিরিক্ত এই প্রেমে অসহ্য হয়ে উঠে মহারাজের অন্য তিনরানী।
তারা প্রতিনিয়ত চেষ্টা চালাতে থাকে কি ভাবে কিরণবালার সন্তানের ক্ষতি করা যায়।
কিন্তু মহারাজের আদেশ — কিরণবালার যত্ন আত্তি তাদের করতে হবে।
অগত্যা তারা ওপরে ওপরে কিরণবালার ভীষণ শুভাকাঙ্ক্ষী , ভান করে।
মহারাজের নজরে ভাল সাজবার জন্য তারা সর্বদা কিরণবালার গর্ভবস্থাকালীন যত্নআত্তিতে কোন ত্রুটি রাখে না।
কিরণবালার একদিন কাঁসন্দ দিয়ে কাঁচা আমমাখা খাবার খুব ইচ্ছে হয়। এই ইচ্ছে জানবার পরে গোটা সূর্যনগর তন্ন তন্ন করে কাঁচা আম খোঁজা হয়।কিন্তু অসময়ে কোথাও কাঁচা আম পাওয়া যায় না।
মহারাজ সূর্যনারায়ণ মহারানীর ইচ্ছেপূরণ করবার জন্য দেশে বিদেশে তার দূত পাঠান।
এমন সময় বড়রানী এসে জানায় তার মামাতো ভাইয়ের কাকাতো শালার পিসতুতো বোনের ছেলে নাকি বড় যাদুকর হয়েছে।সে চাইলে যখন খুশি যা খুশি এনে হাজির করে দিতে পারে।
দেশবিদেশে তার খুব নামডাক। শুধু যে যাদু দেখাবার জন্যই যে সে ডাক পায় তা নয় — ছোটবড় কাজেও রাজামহারাজরা নানা কারণে তাকে ডেকে পাঠায়।
মহারাজ সূর্যনারায়ণ কিরণবালা স্বাদপূরণ করতে মরীয়া —তাই ডেকে পাঠান বড়রানীর সেই যাদুকর আত্মীয়কে।
যথারীতি সে সূর্যনগরে এসে তার যাদুর কাঠি আর মন্ত্রের জোরে এনে ফেলে টাটকা তাজা কাঁচা আম।
মহারাজ সূর্যনারায়ণ খুশি হয়ে তার প্রাপ্য পাওনা মিটিয়ে তাকে বিদায় দেন।
অসময়ে এমন আম দেখে অন্য রানীদেরও খুব আম মাখা খাবার ইচ্ছে হয়। কিন্তু আম তো একটা সেটা মাখলে কতটুকুই বা হবে—আর সেটা খেয়ে ফেললে ছোটরানী কিরণবালাকে কি খাওয়াবে।
অনেক ভেবে তিনরানী যুক্তি করে আমের খোসা ছাড়াবার সময় যেটুকু আম থাকে সেটুকু আর তার সাথে কচি আমের বীজকে কেটে কাঁসন্দ দিয়ে ছোটরানী কিরণবালাকে দেয় আর বাকিটা খুব ঝাল ঝাল করে বানিয়ে নিজেরা খায়।
ছোটরানী কিরণবালার আমমাখাটা মুখে দিয়েই কেমন তেতো তেতো লাগে —তবুও অসময়ের আম মনে করে পুরোটা চেটেপুটে খেয়ে নেয়।
দশমাস দশদিন বাদে ছোটরানীর প্রসববেদনা শুরু হলে মহারানীকে আঁতুরঘরে নিয়ে যায় ধাইমা।
মহারাজ সূর্যনারায়ণ তখন মিষ্টির হাঁড়ি নিয়ে আঁতুরঘরে অপেক্ষা করছেন।
কিছুক্ষণ পরে ধাইমা বাইরে এসে জানায় ছোটরানী মা হয়েছে—
মহারাজ খুশি হয়ে তার সন্তানের মুখ দেখতে গেলে একটা কাপড়ে একটা মিষ্টিকুমড়ো জড়িয়ে এনে ধাইমা মহারাজকে দেখায়।
মহারাজ সূর্যনারায়ণ যারপরনাই রুষ্ট হয়ে কিরণবালা সহ ঐ কুমড়োকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেন।
মহারানী কিরণবালার দুঃখের অধ্যায় শুরু হয়। নদীর তীরে একটা ভাঙা কুটীরে কাঠ কুড়িয়ে কুমড়োকে নিয়ে তার দিন কাটে।
কুমড়ো কুমড়ো হলেও বড্ড ভাল। মাকে খুব ভালোবাসে। সুখে দুঃখে মাকে সঙ্গ দেয়। মানুষের গলায় কথা বলে। কিরণবালার অনেক কষ্ট লাঘব করে দিয়েছে এই কুমড়ো।
এই কুমড়োই কিরণবালার অন্ধের যষ্ঠী। সে মা’কে বলে “দুঃখ করো না মা , দেখো একদিন তুমি আবার সব ফিরে পাবে।আমি তোমার দুঃখ দূর করব।”
দুখিনী কিরণবালা ম্লান হেসে ভাবে “সেটা কি করে সম্ভব।”
এদিকে মহারাজ সূর্যনারায়ণ কিরণবালাকে তাড়িয়ে দিয়ে ভীষণভাবে মনকষ্টে থাকেন।অন্যরানীরা নানা ছলাকলা করেও মহারাজের মনে আনন্দ ফিরিয়ে আনতে পারে না।
ধীরে ধীরে মহারাজ সূর্যনারায়ণ প্রতাপ হারিয়ে শয্যা নেন।
কোন ওষুধেই তার কোন কাজ হয় না। এমন সময় সূর্যনগরের সেনাপতি এসে জানায় সূর্যনগরের পাশের গ্রামে নাকি একজন অভিনব বৈদ্য আছেন যার ওষুধে দেশবিদেশের দুঃরারোগ্য ব্যাধি থেকে মানুষ মুক্তি পায়।
তবে তিনি কোথাও গিয়ে রুগী দেখেন না। তাকে দেখাতে তার কাছেই যেতে হয়।
কিন্তু মহারাজ সূর্যনারায়ণ তো শয্যাশায়ী —তাহলে উপায়?
সভাসদেরা ঠিক করে মহারাজকে পাঁজকোলা করে পালকিতে তোলা হবে তারপর সেই বৈদ্যর কাছে নিয়ে যাওয়া হবে।
পরিকল্পনা মতো মহারাজকে নিয়ে যাওয়া হয় সেইবৈদ্যর দরবারে।
বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা দাড়িওয়ালা বুড়ো পাহরাদার ইশারায় বলে ” ভেতরে কেবল রুগীই যেতে পারবে।’
পালকিবাহকরা মহারাজের অক্ষমতার কথা জানালে পাহারাদার বড় ঘরটির ভেতরে পালকি নামিয়েই তাদের বাইরে এসে অপেক্ষা করতে বলে।
পাহরাদারের কথামতো পালকিবাহকেরা ঘরের বাইরে অপেক্ষা করতে থাকে।
মহারাজ সূর্যনারায়ণ এতটা পথ আসতে আসতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলেন —হঠাৎ তার বাঁ হাতের নাড়িতে একটা স্পর্শ পেতেই একটা অন্যরকমের অনুভূতি হয়।
কোনরকমে চোখ খুলে তাকান। দেখতে পান একটি বড়সড় মিষ্টিকুমড়ো তার নাড়ি টিপে দাঁড়িয়ে আছে।
কিছু বোঝার আগেই মানুষের গলায় মিষ্টিকুমড়ো বলে “হুম , বড় দুর্বল।খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন বুঝি?”
মানুষের গলায় মিষ্টিকুমড়োকে কথা বলতে শুনে একলাফে মহারাজ সূর্যনারায়ণ উঠে বসেন।
তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে অতীতের বহু স্মৃতি।
ক্লান্ত ,দুর্বলগলায় বলেন ” কে তুমি? তুমি তো কুমড়ো মানুষের গলায় কথা বলছো।”
“হ্যাঁ আপনার কাছে আমি কুমড়ো।তবে আমার গ্রামের লোকেরা আমার মায়ের দেওয়া নামের আগে একটা ডাক্তার বসিয়েছে।”
“তোমার মা ? কে সে ? কী তার নাম ? আর তোমার নামই বা কী?”
“আমার মা এক দুখিনী মা। আমাকে জন্ম দেবার অপরাধে আমার মা’কে দেশত্যাগী হতে হয়েছিল।
আমার মা দুঃখে আমার নাম রেখেছিলেন সীতা—
গ্রামের লোকেরা আমাকে ডাক্তার সীতা বলেই ডাকে।”
সবকিছু শুনে মহারাজ সূর্যনারায়ণ বলেন ” আমি কি একবার তোমার মায়ের সাথে দেখা করতে পারি।”
“নিশ্চয়ই পারেন তবে আপনাকে নিজে হেঁটে গিয়ে আমার মায়ের সাথে দেখা করতে হবে।”
“তা কি করে সম্ভব।আমি তো বহুবছর ধরে”-বলতে বলতেই মহারাজ সূর্যনারায়ণ খেয়াল করেন তিনি উঠে বসেছেন, তার অসাড় পায়েও জোর এসেছে। মাটিতে পা দিয়ে দাঁড়িয়েও পড়লেন।
“ঠিক আছে ,তাই হবে।কোথায় তোমার মা?”
“পাশের ঘরেই আছেন আমার মা —-“
মহারাজ সূর্যনারায়ণ পাশের ঘরে গিয়ে দেখতে পান সাদাকালো একমাথা চুলে একজন মহিলা চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা—
চশমার আড়ালে সেই বুদ্ধিদীপ্ত দুখানি চোখ।
নিষ্পলকভাবে তাকিয়ে থেকে বলেন ” কিরণবালা ? কেমন আছো?”
“কে কিরণবালা? আমি কিরণবালা টালা নই আমি শুধু ডাঃ সীতার মা “
মহারাজ সূর্যনারায়ণ মহারানী কিরণবালার অভিমানের ভাষা বোঝেন — তাই তিনি অন্যকথা না বাড়িয়ে বলেন ” আমাকে ক্ষমা করে দাও কিরণ—আমি বড় অন্যায় করেছি তোমার সাথে।
বিশ্বাস কর তোমাকে তাড়িয়ে দিয়ে আমি ভালো ছিলাম না।সেই যে শয্যা নিয়েছিলাম—কোন ডাক্তার বৈদ্যি তার কোন সুরাহা করতে পারেন নি। আজ আমাদের সন্তান ডাক্তার সীতা অভিনব চিকিৎসা পদ্ধতিতেই আমি সুস্থ হয়ে উঠেছি। যদিও আমি ওর সাথে চুড়ান্ত অন্যায় করেছি, বঞ্চনা করেছি যার কোন ক্ষমা হয় না।তবু তো আমি ওর বাবা। আমি যথাযথ মর্যাদা দিয়ে তোমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাই—“
সূর্যনগরে প্রজারা ভীষণ খুশি।সূর্যনগর আবার প্রদীপের আলোয় সেজে উঠেছে—-
মহারাজ সূর্যনারায়ণের তিন রানীদের চুলে পাক ধরেছে বটে কিন্তু এতদিনের নিশ্চিন্তজীবনের আশ্রয় নষ্ট হয়ে যাবার ভয়ে কাঁটা —-
মহারাজ সূর্যনারায়ণ স্বসম্মানে মহারানী কিরণবালা আর ডাক্তার সীতাকে রাজপ্রাসাদে নিয়ে আসেন।
ওদের বরণ করার দায়িত্ব পরে বড় তিনরানীর ওপরেই— প্রচন্ড অনিচ্ছা সত্ত্বেও বরণডালা নিয়ে হাজির হয় তারা সিংহদুয়ারে। মহারাজের হুকুম তো আর অমান্য করা যায় না।
বড়রানী রানী বরণডালা নিয়ে বরণ করতেই ঘটে এক অদ্ভুত ঘটনা।
কুমড়ো বলে যাকে এতদিন অবজ্ঞা ,অশ্রদ্ধা করে এসেছে সকলে মঙ্গলপ্রদীপ দেখানোতে আর শঙ্খধ্বনি বেজে উঠতেই সেই কুমড়ো মহারাজের হাত থেকে পড়ে যায় — আর সেটা ফেটে গিয়ে বেড়িয়ে আসে এক রূপবতী কন্যা।
সেই রূপবতী কন্যা বড়রানী সহ অন্যরানীদের পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করে বলে “বড়মা, মেজমা ,রাঙামা —তাহলে তোমরা আমাকে বরণ করলে? আমি যে তোমাদের সকলের সন্তান সীতা গো।”
রূপবতী রাজকন্যা সীতার মুখে এমন মা ডাক শুনে তিন রানী মোহিত।
বড়রানী তখন স্বীকার করে তারই ষড়যন্ত্রে তার যাদুকর আত্মীয়র যাদু আমের খোসা আর বীজ খাওয়ানোতেই — সীতার এই হাল হয়েছিল।
কিন্তু এমন মিষ্টি মা ডাক শুনে আফশোষ করতে থাকে নিজের কৃতকর্মের জন্য।
সীতা তিনমা’ আর বাবাকে পেয়ে ভীষণ খুশি হয়ে বলে ” গতশ্চ শোচনা নাস্তি—“
সূর্যনগরে সূর্য আরো দীপ্তময় হয়ে চারদিকে আবার আলো ছড়াতে থাকে।