Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » কুমিরের হাঁ || Ashapurna Devi » Page 6

কুমিরের হাঁ || Ashapurna Devi

পরদিন বউদিকে তাজ্জব করে দিয়ে ওর ঘরে গিয়ে বললাম, এই বউদি শোন, তোমার কী সব বেনারসী-টেনারসী আছে বার কর তো! আমায় ধার দাও একটা ঘণ্টাকয়েকের জন্যে।

বউদি হাঁ করে তাকাল।

আমি মজা পেলাম।

আবার তেমনি হাল্কা গলায় বললাম, আরে শোন তাহলে, নিজের ভালো শাড়ি-টাড়ি তো পরে পরে ঠিক করেছি, এদিকে শিপ্রা ছেলের ভাতের নেমন্তন্ন করে গেছে। ভীষণ নাকি ঘটার ব্যাপার, খুব সেজেগুঁজে যাবার হুকুম।

এটা বানালাম। লজ্জা ঢাকলাম একটু।

কিন্তু তাতে কি?

আমার সব কিছুই তো বানানো। সবই তো মিথ্যে। সমুদ্রে শয়ন যার, গোস্পদে কি ডর তার?

বউদি কৃতাৰ্থমন্য হয়ে ওর সমস্ত দামী শাড়িগুলো আলমারি থেকে বার করে খাটের ওপর স্থূপাকার করে রাখল। তারপর একখানা সাদা জরির ছোটো ফুটকি দেওয়া গাঢ় সবুজের হালকা বেনারসী তুলে সাবধানে বলল, এটা তোমায় খুব মানাবে।

সরু একটা মুক্তোর মালাও দিল ভয়ে ভয়ে, দিল মুক্তোর কানবালা। আমার ঘরে আয়না নেই, বউদির ঘরেই সাজতে বসলাম আয়োজন উপকরণ নিয়ে।

বউদি খুব সাবধানে বলল, ড্রেসিং-টেবিলে পাউডার-টাউডার সবই আছে। তোমার পুরনো বন্ধুবান্ধবরা আসবে সবাই। কত সাজবে তারা!

বলে চলে গেল।

হঠাৎ ভারী আশ্চর্য লাগল। আর ভারী লজ্জা হল।

মনে হল বউদির প্রতি এতদিন অবিচার করে এসেছি। মনে করেছিলাম শাড়ির প্রসঙ্গে বউদির মুখে হয়তো একটু বাঁকা হাসি ফুটে উঠবে।

কিন্তু বউদির চোখের কোণে বাস্পের আভাস দেখলাম।

তাই তাড়াতাড়ি পালাল বউদি।

তার মানে আমার জন্যে তার মনেও অনেকখানি মমতা সঞ্চিত আছে। আমার এই অকারণ কৃচ্ছসাধনে দুঃখ পায় বউদি। হয়তো গতকাল যখন শানুর পাতে ভেটকীর ফ্রাই ভেজে ভেজে দিচ্ছিল,

তখন আমার জন্যে ওর মন কেমন করছিল। জিনিসটা একদা ভারি প্রিয় ছিল আমার।

মনে ভাবলাম, কাল থেকে বউদির সঙ্গে আর একটু ভালো ব্যবহার করতে হবে। বড্ড যেন অগ্রাহ্য করি। ওর আবিষ্কৃত মঠটাকে দখল করে নিয়ে আমি ওকে অবজ্ঞার চোখে দেখি। এটা ঠিক নয়, এটা অসভ্যতা।

তারপর বউদির মান রাখতেই যেন বউদির বড়ো আয়নাদার ড্রেসিং-টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।

.

২৭.

কিন্তু এ কী!

কতদিন পরে নিজেকে দেখলাম আমি!

এ কী হতশ্রী চেহারা হয়েছে আমার!

আমার মঠের দিদিরা আমায় বলে, কী রূপ!

আমি সে প্রশস্তি পরিপাক করি।

আমার গুরুদেব বলেন, মা আমার পূর্বজন্মে ব্রজের গোপিকা ছিল। আমি নতমুখে সে গৌরব গ্রহণ করি, আর বড়ো আরশীতে না দেখলেও নিজে মনে ভাবি আমি আমার এই কৃচ্ছ্বসাধনের জ্যোতিঃপ্রলেপমণ্ডিত কৃশতনুতে, এই তৈলবিহীন রুক্ষ চুলে ঘেরা মুখে, সত্যই অপরূপা।

আর এ-কথাও ভাবতে ছাড়ি না, মঠে আমার প্রাধান্যের মূলে হয়তো এই রূপও কিছু কাজ করে।

কিন্তু আজ এই এক দাম্পত্যজীবনের বহু চিহ্নমণ্ডিত ঘরের যুগলশয্যায় সূপীকৃত করা শাড়ির পাহাড়ের চোখ-ধাঁধানো বর্ণবৈচিত্র্যের মাঝখানে বড় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের খালি হাত আর সরু হলদে পাড় ধুতি পরা হতশ্রী চেহারাটা এনে আমার দিকে তাকিয়ে ব্যঙ্গহাসি হাসল।

যেন দুয়ো দিল আমায়।

যেন বলে উঠল, কী মুখ, কী মুখ! মশা মারতে কামান দেগেছে!

সেই ব্যঙ্গহাসির দিকে তাকিয়ে আমি সহসা হিংস্র হয়ে উঠলাম। উগ্র হয়ে উঠলাম। আমি বউদির সাজসজ্জার সমস্ত উপকরণ নিয়ে নিখুঁত করে সাজালাম নিজেকে।

আশ্চর্য, কিছুই তো ভুলে যাইনি।

কাজল পরলাম সরু রেখায়, কুঙ্কুমের টিপটি আঁকলাম সযত্নে, কানে দোলালাম মুক্তোর কানবালা, গলায় সরু মুক্তোর হার।

হিংস্র জবাবের মনোভাব থেকে কখন যেন শোকাচ্ছন্নের মতো অবস্থা ঘটল। মোহাবিষ্টের মতো তাকিয়ে রইলাম নিজের প্রতিচ্ছায়ার দিকে।

মনে হল বিয়ের সাজ সাজছি আমি।

জানলা দিয়ে এসে পড়া পড়ন্ত সূর্যের কনে দেখা আলো সেই ভাবনাকে আরও মধুর করে তুলল।

কতক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম জানি না, দাদা ঘরে ঢুকল অফিস থেকে এসে। কোমল স্নেহের গলায় বলল, নেমন্তন্নে যাচ্ছিস? বন্ধুর ছেলের ভাতে? পৌঁছে দিয়ে আসব?

তার মানে দাদা ঘরে ঢোকবার আগেই খবর শুনেছে। আর দাদার মনটা খুশি হয়েছে সে খবরে। দাদার স্নেহের সুরটাই সেই খুশির সাক্ষী।

কিন্তু আমার এ কী হল?

আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত বয়ে যাওয়া এক দুর্দান্ত লজ্জার ধাক্কা যেন বিদ্যুতের শক-এর মতো ধাক্কা মেরে ছিটকে সরিয়ে দিল আমায় আয়নার কাছ থেকে। ভয়ঙ্কর রাগ হল দাদার উপর, ভয়ঙ্কর রাগ হল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের উপর। সারা শরীরের মধ্যে ধ্বনিত হল, ছি ছি ছি! এ আমি কী করেছি!

.

২৮.

কেমন করে যে ছিটকে সে ঘরের থেকে চলে এসেছিলাম তা জানি না, কেমন করে যে সেই শাড়ি-গহনাগুলোর ভারমুক্ত হয়েছিলাম, তাও জানি না। শুধু মনে আছে খুব হাঁপাচ্ছিলাম।

এই সময় বুড়ি, গোপালের মা এসে দরজায় দাঁড়াল, দিদি, তোমার গাড়ি এয়েছে।

গাড়ি এসেছে!

কোথাকার গাড়ি?

শিপ্রার পাঠানো?

আরে না না, মঠের গাড়ি। হরিচরণ এনেছে। কনে দেখা আলো মুছে সন্ধ্যার ছায়া পড়ে গেছে যে। আরতির সময় হয়েছে।

কৃতজ্ঞতায় মনে মনে দেয়ালে মাথা কুটে বললাম, ঠাকুর, তুমি আছ, তুমি আছ। তারপর স্নানের ঘরে ঢুকে ধুয়ে ফেললাম মুখের সব রং, মুছে ফেললাম চোখের কাজল, কপালের টিপ। আলনা থেকে নিজের দুধ-সাদা শাড়ি-ব্লাউজটা পরে ছুটে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে গেলাম, ভীষণ ভুলে গিয়েছিলাম বউদি! আজ যে মঠে একটা বিশেষ উৎসব। শিপ্রার বাড়ি থেকে কেউ নিতে এলে বলে দিও…তোমার শাড়ি-টাড়িগুলো অগোছালো করে রেখে গেলাম বাপু

বউদির সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবার সঙ্কল্পটা পালন করলাম। বউদি বলে ডাকলাম, অনেকগুলো কথা বললাম।

কিন্তু বউদি কি বুঝল আমি ভালো ব্যবহার করেছি? নাকি সেও ছি ছি করে উঠে নিশ্বাস ফেলল।

জানি না কী করল।

আমি তো গাড়িতে উঠে নিশ্বাস ফেলে বাঁচলাম।

যেমন নিশ্বাস ফেলে লোকে আততায়ীর হাত থেকে উদ্ধার হয়ে নিজের এলাকায় পৌঁছে যেতে পারলে।

কিন্তু আততায়ী কে?

তাও জানি না। ভেবে দেখবারও সময় নেই, আরতির সময় পার হয়। হরিচরণ পড়ি মরি করে গাড়ি চালাচ্ছে। মঠের ব্যাপার, ঘড়ির কাটায় চলে। মুখের রং তুলতে যেটুকু দেরি করে ফেলেছি আমি, তাতেই দেরি।

তবু দেরি হল না, ঠিক সময় এসে পা দিলাম মঠের চৌহদ্দিতে, মালঞ্চ আর তুলসীবনের কেয়ারির মাঝখানের পথ দিয়ে যখন নাটমন্দিরের সামনে এসে দাঁড়ালাম, তখন আরতির ওয়ার্নিং বেল বাজছে। ঢং ঢং ঢং।

যে যেখানে ছড়িয়ে আছে, এসে স্থির হয়ে বসবে, তাই এই জানান।

আমি নাট-মন্দিরে উঠলাম না, অভ্যস্ত নিয়মে চত্বরের পাশ দিয়ে চলে গেলাম বিগ্রহের ঘরের পিছনে। ভক্তপদধূলি মাথায় ঠেকিয়ে সিঁড়িতে পা দিলাম। উঠে গিয়ে মন্দির প্রদক্ষিণ করে বিগ্রহের সামনে এসে দাঁড়ালাম।

দাঁড়ালাম যেখানে শঙ্কর মহারাজও দাঁড়িয়ে আছেন জীবন্ত বিগ্রহের মতো। সেই দীঘোন্নত গৌরকান্তি, সেই গায়ের রঙে এক হয়ে যাওয়া দুধে-গরদের ধুতি-চাদর, সেই আজানুলম্বিত গোড়েমালা, সেই শুভ্র ললাটে ইন্দু সমান চন্দনচর্চা। মাথা নুইয়ে এল।

সাষ্টাঙ্গে লুটিয়ে পড়ে প্রণাম করলাম।

এই প্রথম এই প্রণাম।

আমি কখনও আমার ওই মঠের দিদিদের কিংবা ব্রহ্মচারী দাদাদের মতো সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করি না, ওটা দেখলে আমার হাসি পায়, সেকেলে লাগে, অতিভক্তি মনে হয়। আমার প্রণামের ভঙ্গি নতজানু। হয়ে আস্তে চরণে মাথা ঠেকানো। চরণে মানে চরণের প্রান্তে। চরণ স্পর্শ করা নিষেধ।

কিন্তু আজ আমি সেকেলের মতো লুটিয়ে পড়ে প্রণাম করলাম, আর সঙ্গে সঙ্গে মাথার মধ্যে দিয়ে যেন একটা বিদ্যুৎপ্রবাহ বহে গেল। লজ্জার নয়, আনন্দের।

গুরুদেব আজ ইচ্ছে করে নিয়ম ভাঙলেন, স্পর্শ দিলেন মাথায়। তার মানে বুঝতে পেরেছেন। আমার চাঞ্চল্য। তাই তাকে প্রশমিত করতে–

কী দয়া, কী করুণা!

ভাগ্য আমার জন্যে এত ঐশ্বর্যও তুলে রেখেছিল।

আরতি অন্তে হরিরলুঠের কাড়াকাড়ির সময় গুরুদেব নিজে আমার হাত টেনে নিয়ে একটি সন্দেশ তুলে দিলেন, বললেন, মায়ের মনে আজ বড়ো চাঞ্চল্য, তাই না? বড়ো ভয় পেয়েছিস?

আমি অবাক হয়ে তাকালাম। সত্যিই কি অন্তর্যামী?

নইলে কেমন করে জানলেন, ভয় পেয়েছি! আগে হলে হয়তো ভাবতাম, বুঝতে পারবেন না কেন, মানুষ চরানোই তো পেশা। হয়তো ভাবতাম, গুরু হবার আগে থরিডিংটা শিখে নিতে হয় বোধহয়।…কিন্তু আজ আর সে কথা মনে এল না। আজ আমি অবাক হলাম, বিহ্বল হলাম। তার মানে খোলসের চাপে আমার সত্তাটা তরলিত হয়ে যাচ্ছে।…ছদ্মনামের আড়ালে আমার সত্যিকার নামটা ঢেকে যাচ্ছে। আর তাতে আমি প্রতিবাদ করে উঠছি না, বরং যেন একটা নিশ্চিন্ত বোধ করছি।

আচ্ছা, আজও কি রাত্রে বিনিদ্র শয্যায় শুয়ে ভাবব, লোকটা জাদু জানে? ভাবব, আমাকে কবলিত করবার জন্যে উঠে-পড়ে লেগেছে কেন ও?

কিন্তু বিনিদ্র শয্যায় শুয়ে চিন্তায় ক্ষতবিক্ষত কি হই আজকাল? রাত্রে কি পায়চারি করি? স্নানের ঘরে গিয়ে শাওয়ারের তলায় মাথা পাতি?

কই, মনে পড়ছে না তো?

কবে শেষ এ রকম করেছিলাম?

ভুলে গেছি।

আজকাল বহুক্ষণ কীর্তনের সঙ্গে গলা মিলিয়ে মিলিয়ে দোহার দিতে, আর কীর্তন গান গাইতে এত পরিশ্রম হয় যে, রাতে যে-পাশে শুই, সকালে সেই পাশে উঠি। তার মানে খোলসটা ক্রমশ এঁটে বসছে। আমি সেটা রোধ করতে পারছি না। আমি যেন দর্শকের ভূমিকায় অভিনয় করছি।

.

২৯.

পরদিন কিন্তু ভয়ানক একটা গ্লানি নিয়ে উঠলাম। মনে হল দাদা-বউদির কাছে আমি আর মুখ দেখাতে পারব না। বাস্তবিক কী হাস্যকর কাণ্ডই করলাম কাল! কী দরকার পড়েছিল সাজবার, আর সাজ ঘোচাবার?

হঠাৎ হরিচরণের উপরও রাগ হল। ও যদি ঠিক সেই মুহূর্তে এসে হাজির না হত! আমাকে নিয়ে যেন কে কোথায় টেনে নিয়ে যাচ্ছে, আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে।

বিকেলবেলা শিপ্রা এল।

বলল, জানতাম আসবে না।

জানতে?

তা ছাড়া কি? আমার ছেলের কি এত ভাগ্যি হবে?

এই ছিঃ, তোমার ছেলেকে দেখে আসব একদিন।

দেখা যাক কবে সাতমণ তেল পোড়ে।

কথার পালা শেষ করে ও কাজের কথায় এল। বলল, এই দেখ কাণ্ড কি এসেছে। ভাবলাম তুমি আসবে, তোমরা হাতেই দেব। তা এলেই না।

তারপর ব্যাগ থেকে চিঠি বার করল।

দুরন্তর চিঠি।

লিখেছে–

ভয়ঙ্কর একটা সুখবর দিচ্ছি নাও। কিন্তু খবরদার শুনে যেন আহ্লাদে হার্টফেল করে বোসো না। শুধু বিগলিত হও, উন্নতি হও। শোনো, আমার ওপরওলার সঙ্গে সাংঘাতিক রকম ভাব করে ফেলে একদিন আমার জীবনের সব কথা বলে বসেছিলাম, তার ফলে সে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে আমার দুমাস ছুটি মঞ্জুর করেছে বিয়ে করে ফেলবার জন্যে। আবার তার সঙ্গে যাতায়াতের খরচা। ভাবতে পারো? অবশ্য এটা একা আমার।…নিকষ কালো মুখে দুষ্টু দুষ্টু হেসে বলল-ফেরার সময় তোমার খরচা আছে। বউকে নিয়ে আসবে। ওটা কিন্তু কোম্পানি দেবে না। তবে ফিরে এসে আলাদা বাড়ি পাবে।… ভারি ভালো লোক! তাছাড়া আমার কাজে এত বেশি সন্তুষ্ট যে নিয়ম ভেঙে সুযোগ দিচ্ছে। আমার দলের আর সবাই আমার সৌভাগ্যে ঈর্ষিত। এর পর আবার যখন একটি সুন্দরী স্ত্রী নিয়ে ফিরব, রাগে বোধহয় আমার মুখ দেখবে না।

তারপর টাকাকড়ি, এখানের ব্যাঙ্ক ওখানের ব্যাঙ্ক, তার নিয়মকানুন, কত কি যেন লিখে শেষকালে লিখেছে, একমাস পরেই রওনা দিচ্ছি। তার আগে তোমায় আমার এখনকার একটা ফটো পাঠাব, যাতে দেখে সহজে চিনতে পার। কে জানে যদি বদলেই গিয়ে থাকি।…এই একমাস বোধহয় রাত্রে ঘুমোতে পারব না, কারণ এখন থেকেই যা রোমাঞ্চ হচ্ছে।…এখানে এসে তোমার নিশ্চয়ই খুব ভালো লাগবে প্রতিক সৌন্দর্যের তুলনা নেই। আগে ভয় ভয় করত, এখন সাংঘাতিক ভাবে এই বন্য সৌন্দর্যের প্রেমে পড়ে গেছি। দেখ, তোমাকেও পড়তে হবে প্রেমে।…আরে না না, তুমি শুধু আমার প্রেমে ডুবে থেকো।

ইতি
তোমার শ্রীদুরন্ত।

কতদিন ধরে কোনো অজানিত দেশে পড়ে আছে দুরন্ত, কেমন তার কাজ, কেমন সহকর্মীরা, কেমনই বা প্রভু, কী তাদের ভাষা, কী আচার-আচরণ, তবু ওর চিঠির ভাষা বদলায়নি। যে ভাষাটা ঠিক ওর মুখের ভাষারই মতো। কারণে অকারণে ভয়ঙ্কর, সাংঘাতিক, অদ্ভুত, অপূর্ব।

ভাষা বদলায়নি, তার মানে স্বভাব বদলায়নি।

অথচ আমি আমার নিজের কেন্দ্রে থেকেও ভয়ঙ্করভাবে বদলে যাচ্ছি।

কিন্তু আমি কি আমার কেন্দ্রে আছি?

শিপ্রা ক্ষুণ্ণ হয়ে চলে গেল।

কারণ শিপ্রা বুঝে গেল আমার সেই বদলটা। এতদিন ধরে ও আশা করেছিল, প্রয়োজন ফুরোলেই আমি আমার এই মিথ্যাচরণ ভেঙে ফেলে প্রকাশিত হব, কারণ ওকে আমি ষড়যন্ত্রের সাক্ষী রেখেছিলাম। ও বলেছিল, তোর বিয়ের দিন আমি তোকে সাজাব। বলেছিল, শবরীর প্রতীক্ষার আর-এক ইতিহাস সৃষ্টি করছিস তুই।

কিন্তু আজ বুঝতে পেরে গেল আমার জগৎ আর ওর জগৎ ভিন্ন হয়ে গেছে। বুঝতে পারল, ভয়ঙ্কর সুখবরবাহী ওই চিঠিটা আমাকে আর এখন উল্লসিত করে তুলতে পারল না। খুব ভালো করে পড়লামও না আমি।

.

৩০.

নাঃ, সত্যিই ভালো করে পড়তে পারিনি।

ওর সুখবরটা হঠাৎ যেন আমার বুকে হাতুড়ির ঘা বসিয়ে দিয়েছিল। মনে হল যেন একখানা লোভের হাত এগিয়ে আসতে চাইছে আমার শান্তির বাসা ভেঙে দিতে।

মনে হল সে হাত অশুচি।

তবে? আমি কেন এগোতে দেব সে হাত?

আমি আমার নিভৃত শান্তি, আমার শুভ্র পবিত্রতা কলুষিত করতে দেব কেন?

কে ও?

আমার একদার মাস্টারমশায়ের আশ্রিত একটা বন্য বর্বর বাজে ছেলে। লেখাপড়া ছেড়ে টাকা টাকা করে ছুটে গিয়েছে আফ্রিকার জঙ্গলে। কে জানে কী খাচ্ছে কী না-খাচ্ছে, কী অপবিত্রতার মধ্যে জীবন যাপন করছে, ওর ওই লোভের হাতে নিজেকে সমর্পণ করব আমি?

ছিঃ! কেন?

এক সময় একটু ছেলেমানুষী ভালোবাসার খেলা খেলেছিলাম বলে? সেই দাবিতে ও আমায় টেনে নিয়ে যাবে আরও বর্বরতার মধ্যে?

না না, অসম্ভব।

ওর সঙ্গে আর আমার জীবনের ছন্দ মিলবে না।

আমার জীবনের ছন্দ শান্ত স্নিগ্ধ শুদ্ধ।

কিন্তু পুজো করতে বসে মন বসাতে পারছি না কেন?

বারে বারে ওই দেবমূর্তির জায়গায় একটা অশান্ত অস্থির-মূর্তির ছায়া পড়ছে কেন? ভয়ঙ্কর একটা যন্ত্রণা বোধ করছি কেন? এ কি অশুচি চিন্তার গ্লানির যন্ত্রণা? না খোলস ভেঙে পড়বার আকুতি?

আমি বুঝতে পারছি না।

আমার ভয় করছে।

মনে হচ্ছে ওই প্রবল হাত আমায় এই শান্তির ছন্দের মধ্যে থাকতে দেবে না। টেনে নিয়ে যাবে, লুঠ করে নেবে।

নিক তবে, সর্বস্ব নিক আমার।

নিজের তৈরি যে জালে আটকে পড়ে ছটফট করছি আমি, সে জাল থেকে উদ্ধার করুক আমায় ছিঁড়ে খুঁড়ে তচনচ্‌ করে।

লজ্জা করবে?

কই, শানুর তো লজ্জা করল না?

শানু তো মুছে-ফেলা সিঁথিতে আবার সিঁদুর তুলেছে। তবে আমার এই কুমারী সিঁথির শুভ্রতা রক্তিম করে তুলতে লজ্জা কি? সেই রক্তিম সিঁথি নিয়ে আমি তো হাততালি দিয়ে বলতে পারব সবাইকে-দেখ, এতদিন কেমন ঠকিয়ে এসেছি তোমাদের! এই অভিনয়টি না করলে তোমরা আমায় প্রতীক্ষার স্বস্তি নিয়ে টিকতে দিতে কি?

আচ্ছা, কাল থেকেই কি তবে সেই হাততালিটা দিতে আরম্ভ করব আমি? সকালে উঠে সবাইকে দেখাব এই চিঠিটা? তারপর বলব—

.

৩১.

নাঃ, বলিনি সকালে উঠে।

আগে আসুক ও।

কে বলতে পারে হঠাৎ ওই ছুটিটা না-মঞ্জুর হয়ে যাবে কি না।

যেমন চলছে তেমনিই চলুক তবে।

এই আমাদের পুজো-জপ-ভোগ-আরতি কীর্তনের ফুল দিয়ে মালা গাঁথা।

হাঁ, এক-একটি দিনকে এক-একগাছি ফুলের মালার মতোই লাগে আমার।

যোগ হতে থাকে মালার সঙ্গে মালার, যেমন যোগ হয় জপের সঙ্গে জপের।

তার সঙ্গে দিন গুনছি কবে ওর ছবি আসবে।

কিন্তু ছবি এল না।

ছবির আগে নিজেই চলে এল।

ও সমুদ্রের ভেসে এল না, আকাশে উড়ে উড়ে এল।

৩২.

তখন কনে দেখা আলো ঝিকমিক করছে, আমি স্নান সেরে কপালে চন্দনসাজ করে নিরাভরণ নির্মল দেহে আমার সেই দুধ-সাদা মিহি শাড়ি-ব্লাউজ পরে অপেক্ষা করছি হরিচরণের গাড়ির শব্দের হঠাৎ দাদা এসে ঘরে ঢুকল।

একটু যেন উত্তেজিত, একটু যেন বিস্মিত। ।

দেবী, দেখো তো কে একজন এসে দেখা করতে চাইছে তোমার সঙ্গে–

দাদা কোনো নাম করেনি, তবু আমি বুঝতে পারলাম, আমার সমস্ত শরীর হঠাৎ হিম হয়ে গেল। আমি কিছু বলতে পারলাম না, শুধু তাকিয়ে রইলাম দাদার দিকে।

দাদা নিজেকে একটু সামলে নিল, বলল, খুব সম্ভব তোমার কোনো গুরুভাই-টাই হবে। বলছে পশ্চিম আফ্রিকায় ছিল অনেক দিন। তুমি নাকি জানো আসবে। জাহাজে আসার কথা ছিল, হঠাৎ প্লেনে সিট পেয়ে–

দাদা নিজেকে সামলাল, আমি বেসামাল হলাম। আমি থরথরিয়ে উঠলাম। তাই কী বলব বুঝতে পেরেই বুঝি উত্তেজিত গলায় বলে উঠলাম, পাগল নাকি!

কী? তুমি চেনো না?

কক্ষনো না।

কী আশ্চর্য! তবে কি কোনো বদলোক দাদা বলল, কিন্তু দেখলে তো–

আমি স্থির গলায় বললাম, হয়তো বাড়ি ভুল করেছে।

কিন্তু তোমার নাম-টাম বলল—একবার দেখবে নাকি?

কোনো মানে হয় না দেখা করবার।

বললাম আমি স্পষ্ট স্থির গলায়।

কোনো মানে হয় না দেখা করবার।

কারণ আমি তখনই সেটা স্পষ্ট টের পেলাম, কোনো মানে হয় না দেখা করবার। দাদা আরও কি বলতে যাচ্ছিল, হরিচরণের গাড়ির আওয়াজ পেলাম। পরিচিত হন।

আমি বললাম, আমি যাচ্ছি। বাড়ি ভুল করেছে সেটাই বুঝিয়ে দাও গে।

হয়তো সেটা বুঝিয়ে দেওয়া দাদার পক্ষে শক্ত হত, হয়তো ও কিছুতেই বুঝতে চাইত না। কিন্তু ওর ভাগ্যই ওকে বুঝিয়ে দিল, নিঃশব্দে সহজে, যে ভাগ্য ওকে বসবার ঘরে বসিয়ে না রেখে ফুটপাতে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল।

হয়তো গাড়িটাকে আসতে দেখেই ও ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল, হয়তো শুধু শুধুই। স্থির থাকতে পারছি না বলে।

আমি ওর সামনে দিয়ে এগিয়ে এসে গাড়িতে উঠলাম। আমার কানে এক টুকরো গরম সীসে এসে ঢুকল। কিন্তু সেটা আমি কানে রাখব কেন? ও তো দেবীবলল না, বলল বেবি।

যে নাম সবাই ভুলে গেছে, আমি নিজেও ভুলে গেছি।

আমি দেবী। দেবী মা। মঠ থেকে নিয়মিত আমার জন্যে গাড়ি আসে, কারণ আমি সুরে সুর না মেলালে কীর্তনে প্রাণসঞ্চার হয় না। এর বেশি আর কি চাইবার থাকতে পারে জীবনে?

৩৩.

আজ আর দেরি হয়নি।

হরিচরণ আস্তে আস্তে গাড়ি চালাচ্ছে। আমি নিজেকে ছেড়ে দিয়ে আরামদায়ক সিটে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছি। আর আমার ভয় নেই, কারণ আমি কুমিরের হাঁ থেকে পালিয়ে আসতে পেরেছি।

এখন আমি শান্ত আর আত্মস্থ মহিমায় মঠের চৌহদ্দির মধ্যে ঢুকে মালঞ্চ আর তুলসীবনের মাঝখানের কেয়ারি-করা পথটি ধরে নাট-মন্দিরের বাঁধানো চত্বরের পাশ দিয়ে অভ্যস্ত অধিকারের ভঙ্গিতে এগিয়ে যাব বিগ্রহেব ঘরের পিছনে, সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাব বারান্দায়, মন্দির প্রদক্ষিণ করে এসে দাঁড়াব বিগ্রহের সামনে, যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন আর এক জীবন্ত বিগ্রহ। যার পরনে গায়ের রঙের সঙ্গে মিশে যাওয়া রঙের দুধে-গরদের ধুতি-চাদর, যে চাদর খসে খসে পড়ে বার বার উদ্ভাসিত করে তোলে দীঘোন্নত সুগঠিত দেহদ্যুতি। কপালে তাঁর চন্দনলেখা, গলায় আজানুলম্বিত গোড়েমালা, মুখে অলৌকিক করুণার হাসি!

এ আশ্রয় ছেড়ে কোথায় যাব আমি? এর চেয়ে পরম পাওয়া আর কি আছে?

Pages: 1 2 3 4 5 6
Pages ( 6 of 6 ): « পূর্ববর্তী1 ... 45 6

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress