প্ৰথম খণ্ড – আদি পর্ব : ১.৭
প্রকাণ্ড নাটমন্দির। মোটা গোল থামের উপর ছাদ—চারপাশে ঢালু চারখানা আলাদা টিনের চাল। উত্তরদিকে কালীমন্দির। প্রশস্ত চৌকোঘরই একখানি —সামনে ঠিক মাঝখানে আলসের উপর তিনকোণা বা ত্রিভুজের মত একটি অলঙ্করণ। তার দু’পাশে দুটি হাতীর মাথা, তারা শুঁড় তুলে রয়েছে। মাঝখানে একটি পদ্ম—তার মধ্যে লেখা ওঁ। বারান্দা ঘর সব মার্বেল দেওয়া।
বারান্দায় গিয়ে সুরেশ্বর উঠল মেজঠাকুমার পিছন পিছন। কেউ একজন আসনে বসে নাক টিপে করগণনা করে জপ করছিল। সামনে মদের বোতল, পাশে নারকেলমালার পাত্র, একখানা শালপাতায় কিছু মুড়ি এবং আরও কিছু ভাজাভুজি উপকরণ। পিছন দিক থেকে লোকটিকে দেখে শুধু এইটুকু বুঝলে সুরেশ্বর যে, লোকটি প্রৌঢ় এবং দেহখানা যেন ভাঙাভগ্ন তবে লোকটি দীর্ঘাকৃতি; মাথায় টাক পড়েছে।
ভিতরে শ্বেতপাথরের গড়া বড় একটি সিংহাসন, যার মাথাতেও ছত্রি, সামনে সরু গোল ছোট ধাম বা ডাণ্ডা; তার মধ্যে কষ্টিপাথরের কালীমূর্তি। মূর্তির রং ঠিক ঝকঝক করছে না, খসখসে মনে হল; এবং বুঝতেও পারলে যে মার্জনা বিশেষ হয় না।
মেজগিন্নী নিজে প্রণাম করলেন। সুরেশ্বর দাঁড়িয়েই রইল। মেজগিন্নী উঠে বললেন—প্রণাম কর।
প্রণাম করতে ঠিক অন্তরের ইচ্ছে ছিল কি না-ছিল তা সুরেশ্বর নিজেই ঠিক জানত না। সে মেজঠাকুমার কথায় প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই প্রণাম করল। বাপের শ্রাদ্ধের জন্য এখানে আসার পিছনে তাদের যে মন রয়েছে সেটাও তাকে বোধহয় নির্দেশ দিলে-প্রণাম কর। তবে যুক্তির দিক থেকে তার বর্তমান মনের যুক্তিতে এতে সায় থাকবার কথা নয়, কিন্তু সংস্কারের প্রভাব একেবারে মুছে যায়নি।
মেজঠাকুমা পূজককে বললেন—চরণোদক দাও ঠাকুর সুরেশ্বরবাবুকে। পূজকঠাকুর তামার চরণোদকের পাত্র নিয়ে বেরিয়ে এল। মেজঠাকুমা বললেন, হাত পাত’ ভাই।
ঠিক এই সময়েই উপাসক ব্যক্তিটির ধ্যানভঙ্গ হল—কালী কালী জয় কালী। কালী কলুষনাশিনী, কালী আনন্দময়ী—বলতে বলতে ফিরে তাকালে পিছন দিকে। সুরেশ্বরকে দেখে গম্ভীরকণ্ঠে প্রশ্ন করলে —কে?
মেজগিন্নী বললেন—এই সুরেশ্বর, যোগেশ্বর ভাসুরপোর ছেলে। সুরেশ্বর, ইনি তোমার বড়কাকা—তোমার মেজঠাকুর্দার ছেলে ধনেশ্বর।
—অ! সুরেশ্বর। সুরের ঈশ্বর। তা চেহারাখানা তো বেশ! উঁ!
সুরেশ্বর বিব্রতবোধ করলে। কি করবে—কি বলবে ভেবে পেল না। হঠাৎ যুগিয়ে গেল, সে বললে—অশৌচে তো প্রণাম করতে নেই বলছিলেন মেজঠাকুমা।
—না, তা নেই।
মেজঠাকুমা বললেন, বিবিমহলে মনমরা হয়ে বসে ছিল। ওর মা–বউমা বলছিলেন এই বয়সে পিতৃহীন হয়ে বড় ভেঙে পড়েছে বেচারা। অভিভাবক নেই সাহস দেবার, ভয় নেই বলবার কেউ নেই! তা আমি বললাম, সে কি? ওর মেজঠাকুরদা বেঁচে, ওর শুর-বীরের মত কাকারা, ধনেশ্বর, সুখেশ্বর রয়েছে, অভিভাবক নেই সে কি কথা! চল, এখুনি চল। দেখবে কাকারা বুকে জড়িয়ে ধরে বলবে-কি ভয়, কিসের ভয়!
সে প্রায় উদাত্তকণ্ঠ যাকে বলে—সেই উদাত্তকণ্ঠে ধনেশ্বর বলে উঠল—নিশ্চয়! বলে উঠে দাঁড়িয়ে দু’হাত মেলে বললে-পুত্রের অধিক। যোগেশদার এক পুত্র সে আমার শতপুত্রের অধিক! ওঃ!
প্রচুর মদ্যপানে তার পা ঠিক থাকছিল না-টলছিল। এবং সর্বাঙ্গ দিয়ে দেশী মদের তীব্র গন্ধ নির্গত হচ্ছিল! টলতে টলতে এসে সুরেশ্বরকে বুকে জড়িয়ে ধরে ধনেশ্বর কেঁদে ফেললে। ওঃ, কি মানুষই ছিল যোগেশদা। ওঃ! তুই তার ছেলে!
সুরেশ্বরের অন্তরাত্মা বিদ্রোহ করে উঠল। তার মনে হল যেন পৃথিবীর কুৎসিততম দুর্গন্ধযুক্ত একটা জন্তুতে তাকে আঁকড়ে ধরেছে। কি করবে সে তা ভেবে পেলে না। বহুকষ্টে আত্মসম্বরণ করেও একটা হাত দিয়ে ধনেশ্বরের বাহু বেষ্টনীতে একটু ঠেলা দিয়ে বললে—ছাড়ুন! আমাকে ছাড়ুন!
মেজগিন্নী বুঝেছিলেন, তিনি বললেন, ওকে ছেড়ে দাও বাবা ধনেশ্বর। তাছাড়া তুমি করলে কী! সন্ধ্যা শেষ না করেই আসন ছেড়ে উঠলে?
সুরেশ্বরকে ছেড়ে দিল ধনেশ্বর। তারপর বললে—তাই তো, অন্যায় হয়ে গেল! ফের গোড়া থেকে করতে হবে। তা তুমি ভেবো না বাবা! কিছু ভেবো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। সব ঠিক করে দেব আমি। বিলকুল ঠিক করে দেব। সিধে ঠিক করে দেব!
বলেই আসনে বসে পড়ে গাঢ় প্রমত্ত-কণ্ঠে বলে উঠল—কালী কালী বল মন। কালী কালী কালী। কালী কল্যাণী। কালী করুণাময়ী।
মেজগিন্নী সুরেশ্বরকে নিয়ে এগিয়ে গিয়ে ডানদিকে একটি দরজায় ঢুকে পড়লেন। বললেন—এ চত্বরটি রাজরাজেশ্বরের আর রাধাশ্যামের চত্বর। চত্বরটি স্বতন্ত্র; পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। বলতে গেলে শাক্ত এবং বৈষ্ণবতন্ত্রের ক্ষেত্র দুটিকে তফাৎ করে আলাদা করে দেওয়া হয়েছে। শক্তি মন্দিরে মদ্য এবং মাংসের গন্ধ যেন ওদিকে না যায়।
ওদিকে কালীমন্দিরের বারান্দায় বসে উচ্চ জড়িতকণ্ঠে ধনেশ্বর চীৎকার করছিল—কলকাতার বাবু, যোগেশ্বর ব্যাটা, ক্রীশ্চান-সাহেবের গোলাম—এঁটো চাটার পুত্র। দেশী কুত্তার গায়ে খুসবু সাবান মাথায় সাহেবরা। তাই সাহেবের দেশী-কুকুর গাঁয়ের বাঘা কুকুরকে ঘেন্না করে! বাঘা কুকুর শ্মশানে ফেরে মশানে ফেরে। তার জাত আছে। জয়কালী জয়কালী। কেরেস্তান দেবোত্তরের দায়ে শ্রাদ্ধ করতে এসেছে। আমি দেখছি—
স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে গেল সুরেশ্বর।
তখনও বলে চলেছে ধনেশ্বর — হারামজাদা-শুওয়ার কি বাচ্চা-তোর বাপ মদ খেত না? কেরেস্তান—! এ-ই ঠাকুর মন্দিরের বারান্দা গঙ্গাপানিসে নাথাল দেও। কেরেস্তান উঠেছিল। করাচ্ছি, তোমাকে শ্রাদ্ধ করাচ্ছি।
মেজগিন্নী এসে সুরেশ্বরের হাত ধরলেন—এস, ওসব শোনে না। ঠাকুরকে প্রণাম কর। করে চল মেজঠাকুরদাকে বলে চলে যাবে।
চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল সুরেশ্বর।
—নাতি!
—আমি ফিরে যাই ঠাকুমা!
—না। যেতে নেই। দেখ ভাই, তর্পণ যখন করবে তখন দেখবে—–অবন্ধু,—শত্রু, বন্ধু, অন্যজন্মের বন্ধু সকলকে জল দিতে হয়। যাদের সন্তান নেই, যারা অপঘাতে মরেছে, তাদের জল দিতে হয়। শ্রাদ্ধে তাদেরও পিণ্ড দিতে হয়। এখন তোমার রাগ করতে নেই।
মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে সুরেশ্বর বললে–আপনি সংস্কৃত পড়েছেন ঠাকুমা?
—না ভাই। কে শেখাবে? বাবা পূজারী বামুন ছিলেন, বলতেন, শুনে শিখেছি। তোমার ঠাকুরদা তর্পণ করেন, শুনেছি। বুঝি। হাজার হলেও বামুনের মেয়ে বামুনের বউ তো!
—চলুন। ঠাকুরদাকে দেখে আসি চলুন।
রায়বংশের পুরুষেরাই দীর্ঘকায়। মেজঠাকুরদার মধ্যে একটু পার্থক্য সে দেখলে। মেজঠাকুরদা ঈষৎ স্থূলকায়, বেশ একটি ভুঁড়ি আছে।
দোতলার বারান্দায় আসর পেতে বসে ছিলেন শিবেশ্বর। একদল তিলকধারী খোল নিয়ে বসে ছিল। আরও দুজন বৈষ্ণবও ছিল। শিবেশ্বর সবে গাঁজার কল্কেটি হাতে ধরেছেন। মেজগিন্নী সুরেশ্বরকে নিয়ে সিঁড়ি ভেঙে ঠিক বারান্দার প্রান্তদেশে দাঁড়ালেন। এবং একটু থমকে গেলেন। গাঁজা শিবেশ্বর খান এ কথা তিনি হেমলতাকে বলেছেন, না-বলবার কারণও ছিল না, কারণ শিবেশ্বর অতি প্রকাশ্যভাবেই গাঁজা খেয়ে থাকেন। এবং সুরেশ্বর বিবি-মহলে পাশের ঘরে থেকে এ সব শুনেছে তাও তিনি জানেন, তবুও যেন একটু লজ্জিত হলেন।
শিবেশ্বর গ্রাহ্য করলেন না। গাঁজার কল্কে মুখের কাছে ধরে টানতে লাগলেন। মেজগিন্নী বললেন—সুরেশ্বর এসেছে।
গাঁজার ধোঁয়া ছেড়ে একটু দাবা গলায় শিবেশ্বর প্রশ্ন করলেন—কে এসেছে?
—সুরেশ্বর। তোমার কাছে এসেছে, তোমাকে দেখবে—দেখা করবে।
—যোগেশ্বরের ছেলে?
—হ্যাঁ।
—এস। এস। ভাই এস।
সুরেশ্বর এগিয়ে গেল। শিবেশ্বর কল্কেটা খোলবাজিয়ের হাতে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। সুরেশ্বর তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর মুখের দিকে তাকালে। আলো উজ্জ্বল নয়—হ্যারিকেন জ্বলছে। তবু তার মনে হল, ঠিক সাধারণ নেশাখোর মানুস তো নন। মুখে এবং দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে একটি সুস্পষ্ট ব্যক্তিত্বের ছাপ রয়েছে।
সে বললে—মেজঠাকুমা বলেছিলেন, অশৌচের মধ্যে প্রণাম করতে নেই।
—না। নেই। কিন্তু প্রণামেরই বা দরকার কি ভাই! যারা বুকে চড়ে মলমূত্র ত্যাগ করলে চন্দন মনে হল, ঠিক সাধারণ নেশাখোর মানুষ তো নন। মুখে এবং দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে একটি লেপনের আনন্দ পায় মানুষ, তাদের কাছে প্রণাম কি প্রয়োজন? বোসো।
অভিভূত হয়ে গেল সুরেশ্বর। নুতন কালের মানুষ সে। সবুজপত্রের যুগ সদ্য শেষ হয়েছে বা সবুজপত্র সদ্য উঠে গেছে; পেঁচিয়ে কথা বলে বক্তব্যটিকে বক্র ও তীক্ষ্ণ করে বলার রেওয়াজ উঠেছে; ভারের চেয়ে ধারের দাম বেশি হয়েছে; তাতে উল্লাস এবং কৌতুক দুই-ই আছে। এ কথা সে জাতের নয়—সে মেজাজের নয়; এ কথা সোজা কথা এবং হয়তো কিছুটা ভাবালুতা আছে, তবু সে অনুভব করলে, তার মন আনন্দে এবং আবেগে যেন ভরপুর হয়ে গেল।
শিবেশ্বর তাকে ধনেশ্বরের মতো বুকে জড়িয়ে ধরলেন না, হাতে ধরে বললেন, বস তোমার কম্বলের আসন কই? আনোনি? মেজবউ, আসন দাও। গালিচার আসন পেতে দাও।
তারপর হঠাৎ আলোটা তুলে নিয়ে তার মুখের সামনে ধরে তাকে দেখলেন। আবার আলোটা নামিয়ে চশমা বের করে চোখে দিয়ে দেখে বললেন—তাই তো ভাই! তুমি তো দেখি অপরূপ হে! রায়বংশে শ্রেষ্ঠ সুপুরুষ ছিলেন তোমার পিতামহ। আমার জ্যেষ্ঠ দেবেশ্বর রায়। তার অয়েলপেন্টিং নিশ্চয় দেখেছ। সে অবশ্য পরিণত বয়সের। প্রথম যৌবনের সে ছবি আমার মনে ভাসছে। তুমি হয়তো তাঁর থেকেও সুপুরুষ। প্রেমে পড়বার মতো রূপ হে! আমি যে চিন্তিত হলাম ভাই! তুমি যে সাক্ষাৎ মদন হে!
লজ্জা পেয়েছিল সুরেশ্বর; সে লজ্জাকে জয় করে সে একটু পুলকিত কৌতুকেই বললে—কেন? এ যুগে আর তো শিবের তপোভঙ্গ করতে হবে না! চিন্তা করছেন কেন?
—ভাই। গম্ভীরভাবে বললেন শিবেশ্বর, ভাই, আমার যে তৃতীয় পক্ষের গৃহিণী এবং সুন্দরী গৃহিণী। বলে হা-হা করে হেসে উঠলেন।
—না ঠাকুরদা, আপনার গৃহিণী রতি নন—উনি সতী—না, সতী বলব না,—উনি গৌরী, উমা।
—বহুৎ আচ্ছা! সাধু-সাধু-সাধু। দীর্ঘায়ু হও। তার তুল্য খ্যাতিমান হও! চমৎকার বলেছ হে। ঠাকুরদাকে ঠকিয়ে দিয়েছ। এবং—। একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন, বললেন—লজ্জিতও করেছ আমাকে। তুমি আমার সঙ্গে নিজে থেকে দেখা করতে এসেছ। যাওয়া তো আমারই উচিত ছিল। তুমি পিতৃহীন হয়েছ; আমি পিতামহ, তুমি পৌত্র—ভ্রাতুষ্প্রৌত্র, আমারই তো গিয়ে বলা উচিত ছিল—এস ভাই, কোন ভয় নেই তোমার, আমি যতক্ষণ আছি। তা আমি করিনি!
—করনি, এবার কর। মেজগিন্নী সুযোগ পেয়ে মাঝখানে ঠুকে দিলেন।
—হুঁ। শুধু একটি হুঁ বলে শিবেশ্বর একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন।
সংসারে বোধহয় অবস্থার আনুকূল্যে প্রসন্নতায় মানুষ মুখর হয়ে ওঠে—আবার প্রতিকূলতায় ক্ষোভে বিষণ্ণতায় কথা হারিয়ে ফেলে—বা কোনোক্রমে দমন করে রাখে নিজেকে। সুরেশ্বরের মনে এবং মুখে কথা আপনি এসে গেল, সে বললে—আমাদের উপর কি রাগ করে আছেন। আপনি?
—না। রাগ তো নয় ভাই। রাগ নয়। দেখ, আমি ধর্মে একটু গোঁড়া। সেই কারণে সেই প্রথম যৌবন থেকে তোমার ঠাকুরদার মত কলকাতায় যাই নি, রামেশ্বরের মত বিলেত যাই নি। তিনবার বিবাহ করেছি—তবু পরদার করি নি। আজ বলতে গেলে নিঃস্ব হয়েছি। সেই ধর্ম। মানে তোমার বাবা। থাক সে সব কথা। আমি ভাবছি। এখনও ভাবছি। ভাবছি বলেই এখনও দূরে দূরেই রয়েছি। তা ছাড়া আমিও তো বলতে গেলে ঠিক স্বাধীন নই। আমার ছেলেরা অপোগণ্ড, মূর্খ, মাতাল-তা ছাড়া অন্য দোষও তাদের আছে। তারা অমত করছে। তারা বিষয়ের জন্যে করছে। সে বলতে হবে। তবে কি জানো, আমার বিচারে তো তোমার বাপের সঙ্গে এদের তফাৎ খুব নেই। দুইই পচেছে। তাই হয়, বড় বড় বংশে তাই ঘটে। তোমার বাপ ইংরিজী মতে পচেছে, এরা দেশী মতে পচেছে। দেখ, আমার কাছে তোমার বাপের পচাটাই বেশী পচা। কারণ ইংরেজী মতে পচা মানেই জাত দিয়ে পচা। আমার ছেলেরা জাতটা রেখেছে। আমি ভাবছি!
সুরেশ্বর বললে—ভেবে দেখুন তা হলে। আমি আজ যাই!
—এস। কাল আমি যাব। বউমার সঙ্গে দেখা করে আসব। ওঁকে সেই বিয়ের সময় আর বিয়ের পরই সাতদিনের জন্য এখানে এসেছিলেন, তখন দেখেছি, আর দেখি নি। দেখে আসব। ইতিমধ্যে ভেবে দেখি। ছেলেদের সঙ্গে পরামর্শও করি।
পরদিন সকালে শিবেশ্বর সঙ্গে সেজছেলে সুখেশ্বরকে নিয়ে নিজে এলেন। সুখেশ্বরের বয়স বছর চল্লিশেক। মেজ জগদীশ্বরের থেকে বেশ কয়েক বছরের ছোট। সুখেশ্বর বেশ ভদ্র। ম্যাট্রিক পাস। এখানকার ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট। কিছু ঠিকাদারি ব্যবসাও আছে। লোকে বলে- ইউনিয়ন বোর্ডের ইন্দারা, রাস্তার সাঁকো এ-সব বেনামীতে সুখেশ্বরই করে থাকে। ইউনিয়ন কোর্টেরও হাকিম। তাতেও নাকি কিছু কিছু আয় হয়। চেহারায় রায় বংশের ছাপ আছে, তবে রঙটা কালো।
শিবেশ্বর হেমলতাকে ডেকে অনেক সান্ত্বনা, অনেক উপদেশ দিলেন। পরিশেষে বললেন—কাল আমি সুরেশ্বরকে সব বলেছি মা। দেখ মা, আমার কাছে ধর্ম সবার উপরে। বুঝেছ! তা আমি আমার গুরুর কাছে লোক পাঠিয়েছিলাম। তিনি বলেছেন, এ অনুমতির কাজ নয়। বিচারের কাজ। যা তোমার বিচারে হবে তাই কর। সে বিচার আমি করছি। হ্যাঁ, করছি। মনে হয় দুপুর নাগাদ একটা সিদ্ধান্ত করতে পারব।
হেমলতা চুপ করে রইলেন।
শিবেশ্বর বললেন—হরচন্দ্র কাল সকালে গিয়েছিল, বলছিল, তোমাদের ইচ্ছে ছিল বসত বাড়ীতে উঠবে। ইচ্ছেটা স্বাভাবিক বটে। বসতবাড়ী—পৈতৃক ভদ্রাসন। আর ওগুলি দেবত্রও নয়—সবই ব্যক্তিগত সম্পত্তি। মেরামতও করাও—
হেমলতা বললেন-না-না-না। এই তো আমরা এখানে বেশ রয়েছি।
—হ্যাঁ। এ বাড়ী ওখান থেকে অনেক আরামের। তবে ভদ্রাসন। তা—যদি প্রয়োজন হয় তা হলে আমি আজই খালি করে দেব। আমার বাড়ীটা জীর্ণ হয়েছে। তা হোক, পরিষ্কার এ বেলাতেই হয়ে যাবে। বিকেল চারটে নাগাদ খালি হয়ে যাবে! যদি চাও!
সুখেশ্বর এতক্ষণ পর্যন্ত প্রায় চুপ করেই বসে ছিল, সে এবার বললে—এ সময় কথাটা বলা হয়তো অন্যায় হচ্ছে আমার। একটা ব্যাপার হয়ে আছে—সেটা আমি বলে রাখতে চাই বউদি!
—কি বলুন!
—আমাকে বলুন বলছেন কেন? আমি যোগেশদার চেয়ে দশ বছরের ছোট।
হেসে মাথায় ঘোমটাটা টেনে দিলেন হেমলতা।
সুখেশ্বর বললে—যোগেশদা তখন কলকাতায় ছিলেন, সে সময় আমি তাঁর কাছে গিয়েছিলাম দেবোত্তরের একশো বিঘে ধানজমির একটা প্লট, আমরা আট ভাই বাবার অংশ রায়তী স্বত্বে বন্দোবস্ত নিয়েছিলাম। যোগেশদাকে বলেছিলাম, দাদা, তোমার তো অনেক আছে, কোন অভাব নেই, এটা বাবা যখন আমাদের খাজনা করে দিলেন তখন তুমিও আমাদের দাও। তা উনি বলেছিলেন—দিলাম! আমি ভুল করে দলিলটা নিয়ে যাই নি—তাই সই হয়নি। এই তারপরই উনি নেটিভ স্টেটে চলে গেলেন। উনি যখন বিলেত চলে গেলেন, তখন হরচন্দ্র সেটা অস্বীকার করলেন—তা কি করে হবে? কই, আমরা তো কিছু জানি না। সেই তখন থেকে একটা গাঁট লেগে রয়েছে। সেটা, এদিকটা যখন মিটেই যাবে, তখন মিটে গেলে ভাল হয় না?
শিবেশ্বর বললেন—এ কি সুখেশ্বর। এ সময়ে ওকথা কেন? এ কি?
হরচন্দ্র নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। সে এবার হেমলতা কিছু বলবার আগেই বললে—না না কত্তা। উনি ঠিক বলেছেন। সব গাঁট খুলে যাওয়াই ভাল।
তা—নিশ্চয়। স্বর্গীয় বাবু যখন বলে গেছেন, তখন দলিল আনবেন, সই করে দেবো।