প্ৰথম খণ্ড – দ্বিতীয় পর্ব : ২.৮
সুরেশ্বর বললে—সুলতা, তুমি নিশ্চয় জান, অন্তত এম.এল.এ. সুবোধবাবুর বক্তৃতায় শুনেছ, পশ্চিমবাংলায় জমিদারেরা পার্মানেন্ট সেটেলমেন্টের সময় প্রজার কাছে খাজনা আদায় করে কোম্পানী সরকারকে দিত তার ৯০ ভাগ, নিজেরা পেত ১০ ভাগ। সেই স্থলে তারা ক্রমে খাজনা বাড়িয়ে যে আয় করেছিল বা করেছে তাতে এখন সরকারের ভাগ হয়েছে ২১, জমিদার লাভ করে ৭৯। বাংলার সরকারের রাজস্ব আয় এখন এক কোটি বারো লক্ষ—আর জমিদারের আয় সাত কোটি ঊনআশী লক্ষ। তার পথ আবিষ্কার করেছিলেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে সোমেশ্বর একজন।
সোমেশ্বর এতেই মেতেছিলেন।
জামাই কলকাতায় পড়ছিল। জামাই বিমলাকান্ত সুপুরুষ, শান্ত বুদ্ধিমান। তার সম্বন্ধে তাঁর চিন্তা ছিল না। কাত্যায়নী কিন্তু বলতেন-বিমলের সম্পর্কেই ভাবনা আমার। ও চালকলা-বাঁধা বামুনের ছেলে, ছেলেবেলায় যজমান চরিয়েছে তো। বিমলাকে যদি আমার রোগেই পায় তবে কুলীনের বেটা সংস্কৃতজানা যজমান-চরানো ছেলে ও কি—?
অর্থাৎ ও কি আবার তাহলে বিয়ে না করে সেবাদাসী বাঈজী নিয়ে সন্তুষ্ট থাকবে? আমি যে মাথায় মাথায় ভাবছি গো।
তারপর ছেলে বীরেশ্বরকে দেখিয়ে বলতেন, আর দেখ না, এই ভটচায্যি থেকে রায় হওয়া হারামজাদাকে দেখ না! সেই যে না, হিদুর ছেলে মুসলমান হলে কালাপাহাড় হয়, ঠিক তাই। একেবারে মেলেচ্ছ হল।
নয় বছরের বীরেশ্বরের সঙ্গে রবিনসন সাহেবের ছেলে জনি, জন রবিনসনের খুব ভাব হয়েছে। তার বোন মেরীর সঙ্গেও ভাব। সে সকালবেলা উঠেই টাট্টু ঘোড়ায় চড়ে চলে যায় কুঠী-বাড়ীতে। বেলা বারোটায় এসে খায়। তাতেও তার আপত্তি। ওখানে খাবে না কেন? ওখানে সে জনির সঙ্গে হুটোপুটি করে, গুলতিতে শিকার করে। বন্দুক নিয়ে বড় রবিনসন শিকার করে, সঙ্গে সঙ্গে ফেরে। বীরা, বীরেশ্বরকে পাদরী হিল সাহেব বলে, বীরা; বীরা হেলে সাপের লেজ ধরে ঘুরপাক খাইয়ে ওদের বিস্ময় অর্জন করে বীর হয়ে ওঠে।
মায়ের কথা শুনতে পেলে সে ক্ষেপে যায়, বলে, খবরদার, হারামজাদা তুমি বলবে না। মা বলত-বললে কি করবি রে হারামজাদা!
প্রথম প্রথম আপন মনে গজগজ করত সে, তারপর বলত, তাহলে তোমাকেও বলব হারামজাদী।
প্রথম দিন শুনে রাগে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন তিনি।
সেবারেই বিমলার প্রথম সন্তান হল—হল সেই কাত্যায়নীর মত মরা ছেলে। শিউরে উঠলেন কাত্যায়নী।
মেয়েকে নিয়ে কলকাতায় এসে ডাক্তার দেখিয়ে কাত্যায়নী ফিরে গেলেন। রেখে গেলেন জামাইয়ের সেবার জন্য একটি –
হেসে সুরেশ্বর বললে-কি বলব সুলতা। খারাপ কথা একটু ভাল কথায় ঢেকে বা গিল্টি দিয়েই বলি। রেখে গেলেন একটি ‘তাম্বুলকরঙ্ক বাহিনী’। কলকাতার বাড়ীর নায়েব বা ম্যানেজারকে ডেকে শলাপরামর্শ করে ষোল বছরের জামাইয়ের জন্য একটি ষোড়শী মেয়েকে রেখে গেলেন। তার মাসোহারার বন্দোবস্ত করে, টাকা মাস কয়েকের অগ্রিম দিয়ে গেলেন। এবং তার কর্ম কি তাও বুঝিয়ে দিলেন।
অনেক ভেবে-চিন্তে করেছিলেন।
তাঁর লেখা একখানি চিঠি আছে, তাতে লিখছেন—কুলীনের ছেলে তদুপরি ভট্টাচার্য বংশের পুত্র পাগল বিমলাকে লইয়া ঘর না করিয়া পলায়ন করিয়া বিবাহ করিলে কি করিব? এই সমুদয় চিন্তা করিয়া তাহাকে বাঁধিয়া রাখিবার জন্য সেবাদাসী রাখাই স্থির করিলাম। আপনার জন্য বিধবা ব্রাহ্মণকন্যা রাখিয়াছিলাম, কিন্তু কলিকাল পূর্ণ হইয়াছে, ওদিকে ব্রাহ্মধর্ম অনাচার শুরু করিয়াছে। আবার বিধবা-বিবাহের হুজুগ উঠিয়াছে। সুতরাং ব্রাহ্মণকন্যা ভয়ে রাখিলাম না। মুসলমান বাঈজী রাখিলেও বিষম বিপদ ঘটিতে পারে। যদি মুসলমান হইয়া যায়। অগত্যা নানাবিধ শলাপরামর্শ করিয়া ও খোঁজ করিয়া একটি বেশ্যা-কন্যাকেই পছন্দ করিলাম। মেয়েটির মা অত্র কলিকাতার বিখ্যাত ঘোষালবাবুদের বাড়ির বড়কর্তার বাঁধা খেমটাওয়ালী।
চিঠিখানা সোমেশ্বর রায়ের চিঠির দপ্তর থেকে পেয়েছি। যা ছিল ওই সিন্দুকের মধ্যে। বাড়ী এসে কাত্যায়নী চারিদিকে খোঁজ করতে লাগলেন সাধু-সন্ন্যাসীর—বিশেষ করে তান্ত্রিক সাধুর। তান্ত্রিক শ্যামাকান্তের ওষুধ এবং যাগ-যজ্ঞের ফলে তাঁর অসুখ ভাল হয়েছে। সুতরাং তাঁর দৃষ্টিতে ও ছাড়া পথ দেখতে পান নি। তান্ত্রিক শ্যামাকান্ত তাঁর কিছু ওষুধ গ্রামের বায়েনদের দিয়ে গেছেন কিন্তু সে-সব জ্বর-জরির ওষুধ, আধ-কপালে মাথাধরার ওষুধ; বন্ধ্যা মেয়ের সন্তান হয়, এমন জড়িবুটি ওষুধও তারা জানে। কিন্তু মৃতবৎসাদোষ সারে, মাথার পাগলামির ওষুধ—এ তারা পায়নি।
ওদিকে ঘটেছিল বিপর্যয়!
জামাই বিমলাকান্ত পলাতক হয়েছিলেন কলকাতা থেকে। একেবারে এসে উঠেছিলেন মাতামহের ভিটেতে। মাতামহী তখন গত হয়েছিলেন বৎসর দুয়েক পূর্বে। ঘর-দোর অবশ্য সোমেশ্বর রায়ের বন্দোবস্তে সুরক্ষিতই ছিল। সোমেশ্বর রায় ঘর-দোর মেরামত করিয়েছিলেন, নতুন কোঠাঘর করিয়েছিলেন, যে ঘর পাকাঘরের মতই অথচ তার থেকেও আরামদায়ক। পাকা বারান্দা, পাকা মেঝে, চুনকাম করা দেওয়াল, শুধু চালই খড়ের। ইচ্ছে ছিল পাকা ঘরই করিয়ে দেবেন। কিন্তু আপত্তি হয়েছিল দু দিক থেকে। প্রথম, স্ত্রী রাজকুমারী কাত্যায়নী দেবীর দিক থেকে, বলেছিলেন, না। তারপর মুখ নেড়ে বলেছিলেন—ঘটে যদি বুদ্ধি থাকে তবে এসব কি খুলে বলতে হয়? জন জামাই ভাগনা তিন নয় আপনা। মেয়ের বিয়ে হলেই মেয়ের আবার মান বাড়ে। এখানে একটা কিছু হবে আর পাকাবাড়ি থাকলে হনহন করে গিয়ে ঘরে উঠে খিল দেবে। পাকা ঘরে বাস করে খড়ের চালে মানুষ থাকতে পারে না। মনে হয় সাপে কামড়াবে, আগুন লাগবে, ঝড়ে উড়বে। ও থাক।
আর আপত্তি করেছিলেন বিমলাকান্তের মাতামহী, ও থাক বাবা। পাকা ছাদ ঘর করতে নেই। ও গরমে মানুষকে পচিয়ে দেয়। তোমার বাড়িতে মহল করে দিয়েছ সেই ঢের। এই ভটচাজের ভিটেতে ওটা করো না।
বিমলাকান্ত পাকাবাড়ীতে বেশ ক’বছর থেকেও ওখানে গিয়ে থাকতে অসুবিধা বোধ করেননি। আসবার সময় শ্বশুরকে চিঠি লিখে এসেছিলেন, সে চিঠি আমি পেয়েছি। লিখেছিলেন, ভক্তিপূর্বক অসংখ্য প্রণামান্তর নিবেদনমিদং পরে লিখি যে, আমি অদ্যই শ্যামনগর রওনা হইতেছি। অতঃপর স্থির করিয়াছি যে, সেখানেই জীবন নির্বাহ করিব। এ ধনৈশ্বর্য, এ সম্ভোগ আমার কোনমতেই সহ্য হইতেছে না। সারমেয়ের ঘৃত যন্ত্রপ সহ্য হয় না, তদ্রূপই বলিতে হইবে। কিন্তু আমি ভট্টাচার্য ব্রাহ্মণ ঘরের সন্তান। আমার পিতা সাধক ছিলেন। মাতামহ ক্রিয়াবান শাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন। আমি বাল্যকালে ভক্তিমতী ভট্টাচার্য-গৃহিণী মাতামহীর নিকট যে সকল শিক্ষা লাভ করিয়াছি তাহা বিস্মৃত হইতে পারিতেছি না। উপনয়নের পর আমিও স্বহস্তে ‘নারায়ণশিলা’র সেবা করিয়াছি। ইহার পর এবম্বিধ রাজৈশ্বর্য বাদশাহী, ম্লেচ্ছসুলভ ভোগ আমার জন্য নহে। বাল্যকালে কোন কদাচার হইলে মাতামহী বলিতেন, কদাচার করিলে ব্যাধিগ্রস্ত হয়, কুষ্ঠরোগ হয়। তাহা আমার পক্ষে বিভীষিকার সৃষ্টি করিয়াছে। যাহাই হউক অতঃপর গৃহে থাকিয়া শাস্ত্রচর্চা ও কুল-কর্ম করিয়াই কাল কাটাইব। পূজ্যপাদ মহাশয়, আমার কোন অভাবও রাখেন নাই। শ্বশ্রূমাতাঠাকুরাণী আমার জন্য দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হইয়া মদীয় মনোরঞ্জন এবং পরিচর্যার জন্য গীতবাদ্যনৃত্যকুশলা পরিচারিকা নিযুক্ত করিয়া দিয়া গিয়াছেন। ওদিকে হিন্দু কলেজেও আমার জীবন প্রায় অতিষ্ঠ হইয়া উঠিয়াছে। মহাশয়ের ইহা অগোচর নহে যে, তত্রস্থ ছাত্রবৃন্দের মধ্যে পরলোকগত ডিরোজিও সাহেবের মতাবলম্বী ধর্মবিশ্বাসহীন অনেক ছাত্র আছে। তাহারা মদ্যপান করে, গো-মাংস ভক্ষণ করে। তাহারা আমার মতামতের জন্য ব্যঙ্গ করে, অনেক সময় আমার পিরানের পকেটে উচ্ছিষ্ট হাড় ভরিয়া দেয়। জোরপূর্বক মদ্যপান করাইবার জন্য টানাটানি করে। আমি তাহাদের সহিত কলহে অপারগ। তাহার উপর এই পরিচারিকা নিয়োগকরণের জন্য আমি সব অন্ধকার নিরীক্ষণ করিতেছি। ধর্ম চরিত্র গেলে আর কি থাকে মনুষ্যের? সুতরাং আমি শ্যামনগর রওনা হইতেছি। শ্বশ্রুমাতাকে চিন্তা করিতে নিষেধ করিবেন। চিন্তার কোন কারণ নাই। আমি শপথপূর্বক কহিতেছি যে বিমলার অবস্থা যেমতই হউক না কেন, আমি দ্বিতীয় দারপরিগ্রহ কদাপি করিব না। ইহা ত্রিসত্য বলিয়া কহিতেছি। করিলে আমার চতুর্দশ পুরুষ নরকস্থ হইবেক। আমাকে যখন স্মরণ করিবেন তখনই শ্রীচরণে গিয়া হাজির হইব। কেবলমাত্র ধর্মাচরণ ও ধর্মরক্ষা হইলেই হইল। মহাশয়ের শ্রীচরণে আমার অসংখ্য কোটি প্রণাম নিবেদন করিতেছি। পরমারাধ্যা পুজনীয়া শ্বশ্রুমাতার চরণে—ইত্যাদি ইত্যাদি—।
পত্রখানি আশ্চর্যই শুধু মনে হয় নি আমার সুলতা, একটি সত্যও আমি প্রত্যক্ষ করেছি। কোন দেশের সকল মানুষই পতিত হয় না। কোন ধর্মের এমন বিকৃতি কোন কালে ঘটে না, যাতে সব মানুষ বিকৃত হয়ে যায়। কোন কালেই এমন প্রমাণ নেই যা একটা জাতির সাধনার সবটুকুকে গ্রাস করে অবশেষে যা ফেলে রাখে তার সবই আবর্জনা। সেই কারণেই আজ মানুষ মাটি খুঁড়ে চলেছেই এবং তাদের মিলছেও অতীতের ধনরত্ন। সেকালে বিমলাকান্তের মত কিছু লোক ছিলেন। রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহনদের দলকে যে গুড়ুম সভা মারধোর করেছিল, তাদের যত অপরাধই থাক, এদের ছিল না। আর গুড়ুম সভার বলেই সেদিন জাতটা বাঁচে নি। বেঁচেছিল এদের জোরেই।
সুলতা হেসে বললে—মতপার্থক্য থাকতে পারে।
অর্থাৎ একে তুমি বাঁচা বল না। বল ভূতের উপদ্রবে জীবনের মৃত্যু।
সুলতা বললে-বললে ঝগড়া বাধবে, তর্ক উঠবে। তা করতে আমি আসি নি। আমি শুনতে রয়ে গেলাম, তাই বল।
—বলছি। তবে সেদিন পথের মোড় না ফিরলে গোটা জাতটাও খ্রীশ্চান হয়ে যেতে পারত। এবং তাতে সম্ভবত তোমার মতে ভালই হত। আমরা তখন থেকেই কোটপেস্টালুন পরতে শিখতাম। মন্দিরগুলো গির্জে হয়ে যেত। তার সঙ্গে মসজিদগুলো যেতো কিনা আমার ঘোরতর সন্দেহ আছে। তাহলে তোমরা ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলন করতে না, করত এই মসজিদওয়ালারা। তোমরা খ্রীশ্চান হয়ে সাদা গুরুদের অনুগমন করতে।
—না। কিন্তু ও রাখ সুরেশ্বর। বল, কড়চার কথা বল। আমি অবশ্যই বিমলাকান্তের এ আশ্চর্য দৃঢ়তা ও চরিত্রবলের প্রশংসা করছি, নমস্কার জানাচ্ছি। চরিত্র যেখানে বড় হয়ে ওঠে সেখানে যা ধরেই সে উঠুক না কেন তাই সত্য, তাই শ্রদ্ধার, তাই প্রগ্রেসিভ!
—আর ঝগড়া রইল না। মিটিয়ে ফেললে তুমি। হাসলে সুরশ্বের। তারপর শুরু করলে- এর পর তুমি যা বললে, তাই হল অর্থাৎ জিতলেন বিমলাকান্তই। জমিদার সোমেশ্বরের বজরাটা সেদিন আবার রওনা হল শ্যামনগর। এবার তিনি একা নন, সঙ্গে শ্রীরাজকুমারী কাত্যায়নী দেবী এবং জমিদার-কন্যা বিমলা। গেলেন না কেবল বীরেশ্বর। তিনি বাড়ীতে হিল সাহেবের কাছে রইলেন। রবিনসন সাহেবের কুঠীতে গিয়ে জনি রবিনসনকে নিয়ে পাখী শিকার করে বেড়ালেন। তখন বন্দুক ছুঁড়তে শিখেছেন তিনি।
সোমেশ্বর এবং কাত্যায়নী গিয়ে জামাইকে বলেছিলেন—বাবা, তুমি দেবতা। আমরা বুঝতে পারি নি। ইষ্টদেবতার নামে শপথ করে বলছি বাবা, তোমার রান্না আর রাজরাজেশ্বর প্রভুর রান্না একরকম পবিত্রতার সঙ্গে হবে।
বিমলাকান্ত লজ্জিত হয়েছিলেন। এবং এসেও ছিলেন। বিমলা নাকি হাত ধরে বলেছিল, যাবে না তুমি? আমি কি করে থাকব?
এরপর সোমেশ্বর বাড়িতে জামাতা ও পুত্রের সংস্কৃত পড়ার জন্য পণ্ডিত এবং পার্সী পড়ার জন্য মৌলবী রেখেছিলেন, ইংরিজী শেখাতেন ওই পাদরী হিল সাহেব। কড়াই বাটা আর ভাত পরিতোষ সহকারে খেয়ে ভিক্টোরিয়া যুগের খাঁটি ইংরিজী শেখাতেন। পণ্ডিত লোক ছিলেন।
তিনি বলতেন, বীরা দি ইন্টেলিজেন্ট, বিমলা দি ডিলিজেন্ট। বিমলা খুব বড়া পণ্ডিটা হইবে। কিন্তু জিমিডার হইটে পারিবে না। বীরা জিমিডার হইবে। বিমলা টুমি যডি—শেষটা বলতেন না। কি সেটা তুমি অনুমান করতে পার। অর্থাৎ ক্রীশ্চান।
সুলতা, একটা সিগারেট খেয়ে নিই। একটু জলও খাব। বকেছি অনেক না? দাও, জলের গ্লাসটা অনুগ্রহ করে এগিয়ে দাও।
সিগারেট ধরিয়ে এক রাশ ধোঁয়া গিলে মুখে নাকে উদ্গীরণ করে সুরেশ্বর বললে, এইসব উপকরণের মধ্য থেকে সেই অসুখের মধ্যে ফুরসীতে তামাক খেতে ইচ্ছে হত। পাঁচ-ছ দিন জ্বরে ভুগেছিলাম। তার মধ্যে মেজঠাকুমা আমাকে তাঁর ঠাকুরমার ঝুলি প্রায় উজাড় করে ঢেলে দিয়েছিলেন। এবং একদিন ডেকে এনেছিলেন জ্ঞাতি ভটচাজদের প্রবীণতম ব্যক্তিটিকে। তিনি সম্পর্কে তাঁর শ্বশুর হতেন। মেজঠাকুরদার থেকে বয়সে বড়। প্রায় আশীর কাছাকাছি বয়স। ডেকেছিলেন আমার নাড়ী দেখতে। তিনি নাড়ী দেখে বলে দিতে পারেন, জ্বর কদিন থাকবে, কবে ছাড়বে। তিনি নাড়ি দেখে বলেছিলেন, সাদা জ্বর বউমা। ভয় নেই। পাঁচ দিন ভোগ। তবে কুইনিন যদি ফোঁড়ো তবে এক-আধ দিন কম হবে।
হয়েছিল তাই। কুইনিন ইঞ্জেকশনে তিন দিনে জ্বরটা বেমক্কা ছোট ঘোড়ার রাশের টানে বাগ মানার মত বাগ, মেনেছিল কিন্তু পা ঠুকতে মাথা নিয়ে এপাশ-ওপাশ করতে ছাড়ে নি, মানে একটু করে টেম্পারেচার আরও দুদিন হয়ে ছাড়ল।
সে যাক। পরে বলব।
ঠাকুমা বলেছিলেন, সেকালের কথা শুনবে তো ওঁকে ধরো ভাই। উনি আমার খুড়শ্বশুর। তোমার ঠাকুরদার বয়সী। উনি অনেক জানেন।
—কি ব্যাপার?
—ও, রায়বংশের কথা শুনবে। জানে না তো। বাপ গেছেন অল্পবয়সে। মা এ বাড়ী আসেননি। আমি কাত্যায়নী দেবীর গল্প বলছিলাম।
—ওঃ, তিনি ছিলেন রাজার মেয়ে, এখানে বলত রাজকুমারী বউঠাকরুণ। আড়ালে বলত বাঘিনীঠাকরুণ। শুনেছি, আমরা দেখি নি। তাঁর দাপে এ গাঁয়ে কোন অন্যায় কেউ করতে পারত না। স্বয়ং সোমেশ্বর রায় তটস্থ। পাদরী হিল সাহেব পর্যন্ত তটস্থ। একদিন কি হিন্দুধর্মের নিন্দে করেছিল। তিনি শুনে বলেছিলেন—ওই পাদরী মিনসেরে বলিস তো ওই সব যদি বলবে তো ওর দাড়ি চাঁচিয়ে দেব। আবার ভক্তিমতীও ছিলেন। শুনলেন কাঁদীর বাড়ীতে সিংহরাজাদের রাধাবল্লভ ঠাকুর সোনার ফুরসিতে তামাক খান তিনবার। একবার বাল্যভোগের পর, একবার দুপুরের ভোগের পর, একবার রাত্রে। অমনি হুকুম হল, রাজরাজেশ্বরেরও সোনার ফুরসীর ব্যবস্থা করতে হবে।
পাঁচ দিনই তিনি এসে নাড়ী দেখে যেতেন, ঠাকুমা তাঁকে মিষ্টি খাওয়াতেন, চা খাওয়াতেন, তিনি আমাকে একদিন বলেছিলেন সোমেশ্বর রায়ের গল্প। বলতে তাঁর দ্বিধা ছিল বোধহয়। সোমেশ্বর রায়ের কোন ভাল দিক তাঁর মনে স্মৃতির ঘরে বোধহয় স্থানই পায়নি। যেটুকু পেয়েছিল সেটুকু সবই তাঁর আমিরীর কথা। বিশেষ করে দেহবিলাসের।
সেদিন ঠাকুমা ছিলেন না। হঠাৎ বললেন—তাই তো হে, বলব কি করে? একটু চুপ করে থেকে বলেছিলেন—তা তোমার বয়স অনেক হয়েছে, ষোল অনেক দিন পার হয়েছে। আমি তো তোমার ঠাকুরদাদার খুড়ো। বাহাত্তুরে পেরিয়েছি। তা শোন। সরস করে বলেছিলেন, সোমেশ্বরের এখানকার নৈশজীবনের কথা। কাত্যায়নী দেবী এক কন্যা এক পুত্রের পর স্বামী থেকে অব্যাহতি চেয়েছিলেন, তাঁর ভয় ছিল, তান্ত্রিক গত হয়েছেন, আবার যদি সন্তান গর্ভে এলে তিনি পাগল হন অথবা মৃতবৎসা রোগ আবার ধরে! এই জন্যে কলকাতা থেকে তাঁর পরিচর্যার জন্য দাসী তিনি এনেছিলেন। কিন্তু সোমেশ্বর তাতেও তৃপ্ত হতেন না। রাত্রিকালে বজরায় তাঁর আসর বসত ব্রাত্য মেয়েদের নিয়ে। কিন্তু জামাই বিমলাকান্ত আসতেই তাতে ছেদ টানতে হল। বৃদ্ধ হেসে বলেছিলেন, ভাই, সে আসর যেমন-তেমন আসর নয়। স্বর্গের দেবালয়ের আসরের মত আসর। সোমরসে বিভোর হয়ে সোমেশ্বর বসতেন চন্দ্রের মত আর ব্রাত্য মেয়েরা তাঁকে ঘিরে বসত নক্ষত্রের মত।
শুনেছি। কানে-কানে বলেছিলেন, সে নাকি উলঙ্গের আসর। বাইরে বন্দুকধারী সিপাহী পাহারা দিত। বজরার কামরার দরজা আগলে থাকত তারাচরণ হাড়ি। সে ছিল একটি ব্যাঘ্র বিশেষ।
সুলতা, হয়তো বুড়োর নিজের মনেও এ নেশার ঘোর কাটে নি। সেই নেশার ঘোরেই দন্তহীন মুখে গল্প করেছিলেন। বলা শেষ করেও হাসি মিলায় নি তাঁর। বৃদ্ধের জিভখানা ফোকলা মুখের মধ্যে থরথর করে কাঁপছিল। বলব কি তোমাকে, তার ছোঁয়াতে আমার জ্বরজর্জর দেহে-মনেও একটা নেশা লেগেছিল। সেই সময় তোমাকে একখানা পত্র লিখেছিলাম। তাতে জ্বরের কথা লিখিনি, লিখেছিলাম এখানকার গোয়ানপাড়ার মেয়েদের কথা। তাতে খুব রসিকতা এবং উল্লাস ছিল। যেটা আমার নেশালাগার সত্যকে গোপন করবার জন্যেই বোধহয় লিখেছিলাম
গোয়ানদের মেয়েগুলো কাঁসাইয়ের ধারে এসে দাঁড়িয়ে ডাকত—ঐ বাবু সাহেবের নোকর এ রঘু মহারাজ!
রঘু যেত না—যেতেন মেজঠাকুমা —বলতেন, কি লা বজ্জাত ছুঁড়ীরা?
—বাবু কেমন আছে গো মাঝলা বিবি রাণী।
—মরণ। ফের যদি বিবি বলবি তো ডিকুকে বলব, চুলের ঝুঁটি ধরে কিল মারবে পিঠে। বিবি কি লা? মা বলতে পারিস না?
ওরা হাসত। খিলখিল করে হাসত।
মেজঠাকুমা বলতেন, বল না পোড়রামুখীরা কি বলছিস?
—বললাম তো। বাবু হুজুর কেমন আছে গো!
—জ্বরে আছে। যা পালা।
কোন কোন দিন আমি নিজেই যেতাম। ওরা যে কত আহা উহু করত সে কি বলব। হায় হামারা নসীব! বাবুর কাছে বোখার হল গো! হামার কেনো হলো না! আঃ বাবু! তোমার চাঁদের পারা মুখ শুখায়ে গেল গো। রোজী বেচারীর নিদ নাই গো!
সঙ্গে সঙ্গে দলটাকে দলটা হেসে উঠত। আমার অসুস্থ দেহের উত্তপ্ত রক্ত আবার উত্তপ্ত হত। মনে হত রায়বংশের ধারাটা যেন এই রক্তসমুদ্রের ঈশান কোণে ঝড়ের মত উঁকি দিচ্ছে। সাত দিনের দিন, ছদিন উপবাস করে যেদিন পথ্য করলাম সেদিন, মেজঠাকুমা কাত্যায়নীর মৃত্যু পর্যন্ত এসে পৌঁছেছিলেন।
তবে মৃত্যুর কথাটা বলি। সেটা আমার ভাল লেগেছিল।
মেজঠাকুমা বলেছিলেন, ভাই, স্বামী পুত্র এবং জামাই রেখে কাত্যায়নী দেবী ডঙ্কা বাজিয়ে চলে গেলেন। সজ্ঞানে দেহত্যাগ যাকে বলে, তাই। সামান্য তিন দিনের জ্বর। তিন দিনের দিন সকালে স্বামীকে ডেকে বললেন, ও গো, আজ আমি যাব।
—সে কি? কি যাতা বলছ?
—ঠিক বলছি। কবরেজ ভাল আছে বলে গেল, ও ধরতে পারলে না। আজ যেন কোথাও যেয়ো না। তাই হল ভাই। সেই রাত্রেই গেলেন। স্বামীকে ডেকে বললেন, তোমার পা দুটো আমার মাথায় ঠেকিয়ে দাও। আবার আসছে জন্মে যেন তোমাকে পাই। এই আশীর্বাদ কর।
হাউ হাউ করে কেঁদেছিলেন সোমেশ্বর।
কাত্যায়নী দেবী ধমক দিয়েছিলেন, দেখ দেখ, বুড়োবয়সে ছেলে জামাই মেয়ের সামনে ঢঙ দেখ! চুপ কর। চুপ কর বলছি। হ্যাঁ!
জামাইকে বলেছিলেন-বাবা, তুমি আমার দেবতা। বিমলাকে তোমার হাতে দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত হয়ে যাচ্ছি।
ছেলেকে বলেছিলেন, আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছিস। আমি হারামজাদা বললে, তুই আমাকে হারামজাদী বলেছিস। যা বারণ করেছি তাই করেছিস। বুড়ো বাপকে যেন কষ্ট দিস না, বুঝলি!
বীরেশ্বর ভুরু কুঁচকে বসেছিলেন।
—আর বিমলাকান্ত দেবতা। তার অসম্মান করিস না। তোর দিদি—
বীরেশ্বর বলেছিলেন—তুমি দিদিকে যত ভালবাস তার থেকে আমি দিদিকে বেশী ভালবাসি। তুমি বরং চুপ কর। এত বকলে অসুখ বাড়বে। অসুখ হয়েছে ক’দিন, অমনি মরব বলে একটা হৈ-হৈ লাগিয়ে দিলে।
—তুই একটা হারামজাদা রে! একেবারে নাস্তিক। আমি বুঝতে পারছি, আজ আমি যাব! তাই তিনি গিয়েছিলেন। বীরেশ্বরেরও একথা বলার দোষ ছিল না, কারণ জুর মাত্র তিন দিনের। তিন দিনের সকালবেলা থেকে ওই শুরু করলেন, সন্ধ্যে নাগাদ চলে গেলেন।
মেজঠাকুমা হেসে বলেছিলেন, কাত্যায়নী বলতেন, চিঠিতেও স্বামীকে নাকি লিখেছিলেন। সতী-যাওয়াকে যারা অত্যাচার বলে উঠিয়ে দিচ্ছে, দিতে চাচ্ছে তারা মেলেচ্ছ, তারা যবন। স্বামীকে বলেছিলেন, তুমি যদি দরখাস্তে সই কর তবে তোমার মুখ আমি দেখব না। সতীপ্রথা উঠে গেল, কোন লাট জানি উঠিয়ে দিলে, তোর মেজঠাকুরদা নামটা তার বলতেন।
আমি নামটা বলে দিয়েছিলাম সুলতা। লর্ড বেন্টিঙ্ক!
—হ্যাঁ হ্যাঁ। লাটসাহেব বেন্টিঙ্ক। কাত্যায়নী গাল দিতেন বেন্টিঙ্ককে। বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বলতেন, আইন করলি করলি; কলার পাতে লেখা রইল। কাত্যায়নী যদি বিধবা হয় তাহলে সে তোর ওই আইন মানবে না, মানবে না, মানবে না। সতী সে যাবেই।
সেইটেই তাঁর পূর্ণ হল না। তার বদলে সিঁথিতে সিঁদুর নিয়ে দলমল করে চলে গেলেন। তাঁর চন্দনধেনু শ্রাদ্ধ হয়েছিল। সে উপলক্ষ্যে কীর্তিহাটের ব্রাহ্মণদিগে সবৎসা গাভী দান করেছিলেন। সে সব বড় গাই। মেজঠাকুমা বলেছিলেন, ভাগলপুরের গাই। গ্রামে বড় পাঞ্জাবী গাইকে ভাগলপুরের গাই বলত। সধবা যে, ব্রাহ্মণ শূদ্র সব, শাড়ী সিঁদুর শাঁখা দিয়েছিলেন। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন অতিথিশালা।
সুলতা, এসব জেনে যখন শুলাম রাত্রে তখন কাত্যায়নীর মৃত্যু শ্রাদ্ধ সব কোথায় গেল—মনে জেগে রইল সোমেশ্বর রায়ের ওই নৈশআসরের কথা। যারা সেদিন অ্যাসেম্বলীতে জমিদারের ব্যভিচারের কথা বললেন, তাঁদের দোষ দেব না। আমার পূর্বপুরুষদের সব কথা বাদ দিয়ে ওইটে যখন আমার মনেই সাড়া তুললে, তখন আর তাদের দোষ দেব কি করে?
শেষ পর্যন্ত নিজের উপর রাগ করে বললাম, যাক ও খাতাপত্র ঘেঁটে আর কাজ নেই। যে বিষ চাপা আছে, সে চাপাই থাক। তাকে খুঁড়ে বের করে কাজ নেই। ছেদ টেনে দেওয়াই ভাল কীর্তিহাটের কড়চার। মন থেকে মুছে ফেলাই ভাল।