Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

মদে মাতাল হয় মানুষ। বিষয় নিয়ে তেমনি বিবাদ করে মানুষ। না করে উপায় নেই। সুলতা, রায়বংশের সেরেস্তাখানায় দুটো ঘর আছে, মামলার নথিতে বোঝাই। রায়বংশের একটা বিখ্যাত মামলা—রত্নেশ্বর রায় আর তাঁর বোন সর্বাণী দেবীতে। রত্নেশ্বর নাকি পোষ্যপুত্র। কিন্তু তাঁকে পোষ্য নেবার পর ওই কন্যা হয়েছিল। কন্যাকে টাকা—দু’লক্ষ টাকা—দিয়েছিলেন বীরেশ্বর রায়, সম্পত্তি দেন নি। বাপের মৃত্যুর পর সর্বাণী দেবী মামলা করেন। রত্নেশ্বর হাতজোড় করে আরও টাকা অনেক টাকা দিয়ে সে মামলা মিটিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর ছেলেরা মামলা অনেক করেছে। আমি দুরে থেকে এর সংস্পর্শ বাঁচিয়ে ছিলাম; মেজঠাকুরদার মামলা করার কথা শুনে প্রশ্ন করতাম নিজেকে; কেন? কেন করেন? দু’চারটে মামলা তিনি করতেন জেদের বশে, কুটিল উদ্ধত জোতদারদের সঙ্গে, তাতে তারিফ করতাম। দু’একটা মামলা হত অন্য জমিদারের সঙ্গে, তাতেও মন সায় দিত। বাকীর জন্য আমি নিন্দাই করতাম। যাই হোক, মোটকথা বিবাদ-কলহে রুচি আমার ছিল একথা বলে অপবাদ আমাকে কেউ দেবে না। আমি গেলাম মেজঠাকুমাকে নিয়ে রোজা আর রঘু আমার সঙ্গে গেল, রঘু চাকরখানসামার কাজ করলেও হিন্দুস্থানী। তখন মানে সতেরো বছর আগে ওর বয়স পঁয়তাল্লিশের বেশী ছিল না। সেও লাঠি নিয়ে লণ্ঠন নিয়ে সঙ্গে এল।

হঠাৎ একটু থেমে সুরেশ্বর বললে —সুলতা, অসাধারণ শক্তিশালী বলে অহঙ্কার আমার কোনকালে নেই। তবে রায়বংশের বংশানুক্রমে আমরা লম্বা-চওড়া কাঠামোর অধিকারী, হাড় আমাদের মোটা শক্ত। বাবা-মা যেভাবে মানুষ করেছিলেন তাতে পুষ্টির অভাবও ছিল না। সেটা ছত্রিশ সাল, আমার বয়স ছাব্বিশ। তবে সাহস আমার ছিল। জেদ আমার ছিল। ভয় কিছুতে করিনি। সেটা তুমি জান। স্টেটসম্যানে যে চিঠিটা আমি ছেপেছিলাম, সেটা ন্যায় হোক অন্যায় হোক, অর্ধসত্য অর্ধমিথ্যা যাই হোক, আমার যেটা বিশ্বাস সেটা ছাপতে ভয় আমি পাই নি। এবং তারপর সহজ পদক্ষেপে সমাজে এসেছি। এসেই তোমাকে চিঠি লিখেছি। সুতরাং সবচেয়ে বড়। বল ছিল আমার দুঃসাহস। বল তো বটে এবং সেইটেই বোধহয় ছিল ইলেকট্রিক পাওয়ারের মত একটা শক্তি, যাতে দুর্দান্ত রাগের সুইচ অন করে আমাকে একটা ক্রাশিং মেশিনের মত চালু করে দিলে। তার ফলে আমার থামবার উপায় ছিল না। দুর্দান্ত ক্রোধে সাহসে আমি চলেছিলাম। হয় ওদের পিষে দেব, নয় আমিই অক্ষম হয়ে ফিউজ হয়ে থেমে যাব। কিংবা গোটা যন্ত্রটা ভেঙে যাওয়ার মতই ভেঙে যাব।

ঠাকুরবাড়ীতে ঢুকে ডাকলাম—ঠাকুরমশায়!

ঠাকুরবাড়ীতে হেজাক বাতি জ্বলছিল মন্দিরের বারান্দায়। কালীমন্দিরে একটা, গোবিন্দ মন্দিরে একটা। আমিই দিয়েছিলাম কিনে। মেজঠাকুমাই আদায় করেছিলেন।

গমগম করে উঠল গোটা ঠাকুরবাড়ীটা। আমি আমার কণ্ঠস্বর শুনে একটু চমকে উঠলাম। এমন করে তো কখনও কাউকে ডাকিনি। সন্দেহ হল-এ আমার কণ্ঠস্বর?

মেজঠাকুমা সভয়ে বললেন—সুরেশ্বর!

তখন আমি খুশি হয়ে উঠেছি। হ্যাঁ, এই তো রায়বংশের কণ্ঠস্বর।

বাধা কেউ দেয় নি। ধনেশ্বর ব’সে আহ্নিক করছিলেন। তাঁর দুই ছেলে দ্বিতীয় আর চতুর্থ ভূপেশ্বর এবং রাজেশ্বর, তারা বসে ছিল ঠাকুরবাড়ীর ওপাশে কাছারীবাড়ীর বারান্দায়। কথা বলছিল সুরেশ্বরের আপন জ্যাঠতুতো ভাই প্রণবেশ্বরের সঙ্গে। প্রণবেশ্বর সেইদিন সকালেই এসেছে। এসেছে এই সেটেলমেন্টে নিজের স্বত্ব লেখাতে। নিজেদের স্বত্ব সবই বিক্রী করেছে; করেছেন তার বাপ যজ্ঞেশ্বর; কিনেছিলেন সুরেশ্বরের মা। থাকবার মধ্যে আছে মুনাফা বা লাভশূন্য দেবোত্তরের সেবায়েত-স্বত্ব। তার জন্য আসে নি, এসেছে ধনেশ্বরদের সঙ্গে যোগ দিতে। যা পারা যায়, যেমন ক’রে পারা যায় কিছুটা খামচে নিতে। খবরটা সুরেশ্বরকে নায়েরাই দিয়েছিল। প্রণবেশ্বর এসে সুরেশ্বরের সঙ্গে দেখা করে নি। এবং নিজের যে বাড়ী সুরেশ্বরদের বিক্রি করেছে, যে বাড়ীতে এখন ধনেশ্বর ও সুখেশ্বরের ছেলেরা বাস করছে সেখানেও যায় নি। দেবোত্তরের সামিল কাছারীবাড়ীর একখানা ঘরে এসে উঠেছে। আগে এমন ক’খানাই ঘর ছিল যেখানে বিশিষ্ট প্রজা, পত্তনীদার, উকীল, মোক্তার এলে বাসা দেওয়া হত।

সুরেশ্বরের হাঁকে ঠাকুর বেরিয়ে এসে দাঁড়াল—আজ্ঞে!

সুরেশ্বর বললে—মেজঠাকুমা এসেছেন।

কোন দিক থেকে কোন কথা উঠল না। শুধু একটু চাঞ্চল্য ছাড়া। ধনেশ্বর একবার ফিরে দেখে ডেকে উঠলেন—কালী করুণাময়ী! আর কত সহ্য করবি মা?

ওদিকে তাঁর ছেলেরা খানিকটা ফিসফাস ক’রে চুপ হয়ে গেল। শুধু একবার উঁকি মেরে দেখেই প্রণবেশ্বর ঘরে ঢুকে গেলেন।

নির্বিবাদে কালীমন্দিরে প্রণাম করে, রাজরাজেশ্বর এবং গোবিন্দমন্দিরে প্রণাম করে চরণোদক নিয়ে বেরিয়ে এলেন মেজঠাকুমা। সুরেশ্বর সেদিন বোধহয় একটা ঝোঁকের মাথায় ঠাকুমার সঙ্গে মন্দিরের ভিতরে ঢুকেছিল। সে ঘরে ঢুকে প্রণাম করে উঠে চারিদিক তাকিয়ে দেখে বিস্মিত হয়ে গিয়েছিল। ঘরের কোণে একটা বড় আয়রন-চেস্ট। আলমারী নয়—সিন্দুক। আকারে প্রকাণ্ড। সে জিজ্ঞাসা করেছিল—এখানে ওটা? আয়রন-চেস্ট?

পুজুরী জবাব দিয়েছিল—হ্যাঁ!

—কি থাকে ওতে?

—তা তো জানি না বাবু! আমি তো খোলা দেখি নি!

মেজঠাকুমা বললেন—ওতে গোবিন্দের গহনা থাকত। এখন কতকগুলো পুরনো কাগজ আছে।

—চাবি কার কাছে?

মেজঠাকুমা উত্তর দিলেন না। ঠাকুর বললে—তা তো বলতে পারব না। সিন্দুক তো খোলা হয় না কখনও। আমি দেখি নাই বাবু!

—হুঁ! গহনা আছে, না নেই? ঠাকুরকে পরানো হয় না?

—না।

মেজঠাকুমা হেসে বললেন—গহনা নেই সুরেশ্বর।

—নেই?

মেজঠাকুমা বললেন—এখন ওসব কথা থাক সুরেশ্বর। পরে যা হয় করবে। রাত্রি হয়েছে, গোবিন্দের শয়নের সময় হয়েছে, চল।

সুরেশ্বর বললে —চল।

তার মনটা খুশব্দ্দ হয়ে উঠেছে। সে আঁচ একটা পেয়েছে। একটা নিষ্ঠুর কলহের সূত্র পেয়েছে সে!

বেরিয়ে এসে সে ডাকলে—নায়েববাবু!

বৃদ্ধ নায়েব বেরিয়ে এলেন—আজ্ঞে!

—খুব জরুরী দরকার আছে আমার। একবার আসুন আমার ওখানে।

—কাল সকাল আসতে বল্ ভাই। আজ নয়। আজ মেজাজ তোর ভাল নেই। আমার কথা শোন।

সুরেশ্বর একটু চুপ করে ভাবলে। ইতিমধ্যে মেজঠাকুমা মৃদুস্বরে বললেন—আমার কথাগুলো শুনে নে ভাই আগে।

সুরেশ্বর বললে-থাক। কাল সকালেই আসবেন।

তার নিজের নায়েবকেও ডেকে বললে—কাল সকালে আপনি ওঁকে তাগিদ দিয়ে নিয়ে আসবেন।

আজ সুরেশ্বরের কণ্ঠস্বরে ভঙ্গিমায় অলঙ্ঘনীয় একটি প্রভুত্বের ভার এবং ধার দুই-ই ছিল!

এতক্ষণে প্রণবেশ্বর বেরিয়ে এসে বললে—কেমন আছ?

—ভাল। আপনি কখন এলেন?

হেসে প্রণবেশ্বর বললে-এই সকালে।

—এখানে উঠেছেন?

—হ্যাঁ। নইলে আর উঠব কোথায়। বাবা তো সবই বেচে।

—বেচলেও তো সেটা বাইরে যায় নি। ঘর তো ঘরেই আছে।

—তা আছে। কিন্তু বিষয়-ব্যাপার নিয়ে ঘরে-ঘরেই তো বিবাদ আগে লাগে।

হেসে সুরেশ্বর বললে-তা লাগে!

—সুতরাং—

—বুঝেছি বড়দা। থাক।

—কাল একবার যাব তোমার কাছে।

—আসবেন।

বেরিয়ে এসে পথে প্রথমেই মেজঠাকুমা বললেন—তুই ভাই ঘোষাল ম্যানেজারকে আনা। এরা কুরুক্ষেত্র বাধাতে জোট বেঁধেছে!

সুরেশ্বর বলেছিল—তাঁর যে স্ট্রোক হয়ে প্যারালিসিস হয়েছে ঠাকুমা! সেরেছেন তবে আসা যে অসম্ভব। তা ছাড়া স্মৃতিও ভ্রংশ হয়েছে।

—তা হ’লে!

—ভেবো না তুমি ঠাকুমা। এ যদি সব চলেও যায় তবু আমি ফকির হব না। আর তাই বা হব কেন? মিথ্যের জাল, ও টিকবে না। লড়ব, দরকার হলে হাইকোর্ট পর্যন্ত লড়ব।

তারপর নীরবে পথ হেঁটেছিলেন দুজনে। হঠাৎ নীরবতা ভঙ্গ করে মেজঠাকুমা বলেছিলেন—ঠাকুরের গহনা তোর মেজঠাকুরদা সব বিক্রী করেছেন সুরেশ্বর।

চুপ করে রইল সুরেশ্বর।

—সিন্দুকের চাবি তাঁর কাছেই ছিল। তিনি তো বিষয়বুদ্ধিতে পাকা ছিলেন। তিনি গহনা গালিয়ে, সোনার পরিমাণ কম করে লিখে জমা করে, নিজের বিষয় কিছু—তাও বাজে বিষয়—দেবোত্তরে কেনা হল বলে খরচ লিখেছিলেন। ধরবার তো কেউ ছিল না!

একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললে সুরেশ্বর। কি বলবে? এই মেজঠাকুমার স্বামী ছিলেন তিনি। তাঁর প্রতি এঁর ভালবাসার কথা সে জানে। আশ্চর্য লাগে। সমস্ত দোষত্রুটি সব অকপটেই বলেন—তবু তাঁর প্রতি এই মেয়েটির ভালবাসা তো কম নয়! কি দিয়ে গেছেন তিনি? কিছু না। বলতে গেলে—পথেই দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। তবুও—। আশ্চর্য লাগে সুরেশ্বরের।

মেজঠাকুমা আবার বললেন–কি যে সে বুদ্ধি কি বলব তোকে! তাঁর বাপ–আমার শ্বশুর—রায়বাহাদুরের আমলে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা। রাজরাজেশ্বর প্রথম থেকেই আছেন। সে আমার বড় শ্বশুরের, ফিরেশ্বর রায়, তোদের যিনি জমিদার প্রথমপুরুষ তাঁর আমলের। মা-কালী প্রতিষ্ঠার অনেক ক’বছর পরের কথা। এক সন্ন্যাসীর কাছে পেয়েছিলেন। তোর মেজঠাকুরদা যখন গহনা বিক্রি করেন, তখন এই দুই আমলের যে সব জমাখরচের খাতায় এই গহনা তৈরীর খরচ আছে তা বেছে বের ক’রে এনে নিজের কাছে রেখেছিলেন। ছেলেদেরও বলেননি। তারা গহনা বিক্রীর কথা জানে-খাতার কথা জানে না। গহনা কম ছিল না ভাই। শুধু গহনা নয় অনেক আসবাব—সোনার ফুরসী পর্যন্ত।

সুরেশ্বর ব্যগ্র উত্তেজিত কণ্ঠে বললে-সে সব খাতা তো নষ্ট করে দিয়ে গেছেন তিনি। হেসে মেজঠাকুমা বললেন—না। তা করেন নি। বলতে আজ লজ্জা পাচ্ছি ভাই, আমি বলেছিলাম—দেখ, করলেই যদি চুরির পাপ, তবে আর ওগুলো রাখছ কেন? কিন্তু তিনি বলেছিলেন—উঁহু। কোন্ মকদ্দমায় কখন লাগে! দুই আমলের খাতাতেই অনেক সম্পত্তি কেনার জমাখরচ আছে। অনেক নমুদ আছে। ও থাক। যখন আমার সব যাবে তখন পুড়িয়ে দেব। সেগুলোকে একটা ভাঙা সিন্দুকে কতকগুলো বাজে কাগজের গাদায় লুকিয়ে রেখেছিলেন।

—সেগুলো আছে ঠাকুমা?

—আছে। সেগুলো তুই নিয়ে যা ভাই। আজ তো আর আমার কোন লজ্জাই রইল না। এই যে তোর সঙ্গে ওরা বিষয়ে নানান প্যাঁচ কষে তোকে সম্পত্তি বিক্রী করেও বঞ্চিত করতে চাচ্ছে, এর জন্যে আগেই বের করে দেওয়া উচিত ছিল। ওতে অনেক নজীর পাবি। পুজুরী বামুনের মেয়ে—বুড়ো জমিদারের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল—শিখেছি অনেক, জানি অনেক। দেওয়া উচিত ছিল, তুই আমার ছেলের অধিক, সহোদরের অধিক। তুই খেতে দিস তাই খেতে পাই। তোকে আমিই আনতে গিয়েছিলাম সেটেলমেন্টের জন্যে। তবু পারি নি দিতে বা বলতে। আজ লজ্জা ঘুচে গিয়েছে—

বলে হেসে উঠলেন, বোধ করি সেদিন সেই প্রথম হাসলেন, বললেন-নাতি, তুই শেষে ল্যাভেন্ডার সাবান দিয়ে আমার লজ্জাটজ্জা সব ধুয়েমুছে শেষ ক’রে দিলি! সিন্দুকের চাবিও আমার কাছে আছে, সেও তুই নিয়ে যা। ওরে, সব আজ রাত্রেই নিয়ে যা।

সে অনেক কাগজ অনেক খাতা। মোটা মোটা রোকড় খাতা খেরোতে বাঁধানো শক্ত সুতো পাকানো দড়িতে বাঁধা, প্রায় এক-একটার ওজন আড়াই সের, সংখ্যায় পঁচিশখানা। ওজনে দেড় মণের উপর। আর কাগজ, সে স্তূপীকৃত। তার মধ্যে তারের ফাইলে গাঁথা চিঠি। সে ফাইলও অনেক। আরও কতকগুলো ছোট ছোট দপ্তর। তার সঙ্গে বের করে দিয়েছিলেন একটা সুন্দর বাক্স। এক বারে নিয়ে যাওয়া সম্ভবপর হয়নি রোজা এবং রঘুর পক্ষে। দুবারে নিয়ে যেতে হল। বিবিমহল মূল বাড়ী থেকে কম রাস্তা নয়। বেশ খানিকটা। সবশেষে মেজঠাকুমা দুটো চাবি দিয়েছিলেন। ওই লোহার সিন্দুকটার দুটো চাবি। মেজকর্তার মৃত্যুর পর ও দুটোরও কেউ খোঁজ করেনি। কারণ ওটার গজভুক্ত কপিখের মত অবস্থার কথা মেজতরফের কারুর কাছেই অজ্ঞাত ছিল না। মেজকর্তা যতই তৈরী করা হিসেবের আড়াল দিয়ে থাকুন, আসল সত্যটা চাপা থাকবার কথা নয়, কোন লোকের কাছেই। ধনেশ্বর প্রভৃতির মনে মনে এই বোধটা ছিল। চাবি যার কাছে থাকবে সেই দায়ে পড়তে পারে এই কারণেই কেউ চাবির খোঁজ করেনি। চাবি দুটোর একটা বলতে গেলে অতিকায় ইঞ্চি পাঁচ ছয় লম্বা, তেমনি মোটা; ওজনের হয়তো পোয়া খানেক। আর একটা সেকালের কামারের তৈরী গা-তালার চাবি, সেটাও বেশ বড়।

মেজঠাকুমা দিয়ে বললেন—আমার পুরনো কর্তা সিন্দুকটা ফাঁক করে গেছেন, নতুন কর্তাকে দিচ্ছি, তুই ওটাকে ভরে দিস ভাই।

চাবি দুটো এবং ওই বাক্সটা সুরেশ্বর নিজে নিয়ে এসেছিল। বাক্সটা থেকে চন্দনের গন্ধ উঠছিল।

প্রথমেই সুরেশ্বর খুলেছিল ওই বাক্সটা। হাতীর দাঁতের কাজকরা চন্দন কাঠের বাক্স। তারই মধ্যে ছিল প্রাচীনকালের পুঁথির আকারের একখানি খাতা। প্রাচীনকালের কাগজ। চন্দনের গন্ধ উঠছিল। পাতাগুলোর কোণ দুমড়ে গেছে। সন্তর্পণে সেখানা বের করেছিল সুরেশ্বর, ভেবেছিল কোন পুরনো দলিল জাতীয় কিছু হবে। কিন্তু উপরের মোড়ক কাগজখানা খুলে তার আর বিস্ময়ের অবধি ছিল না। খাতা বা পুঁথিখানার উপরে সেকালের শর বা লটের কলমে কষে কালিতে লেখা—

ওঁ কালী চরণ ভরসা।
কালিকা মঙ্গল—তথা, পাঁচালী রায়বংশস্য, রচিতং কুড়ারামেণ রায়বংশস্য
স্থাপয়িতা। বসতি কীর্তিহাট গ্রাম পরগণা ময়না অন্তর্গত। সরকার-
গোয়ানপাড়াভুক্ত: জেলায়াং মেদিনীপুর। রাজত্ব কোম্পানী বাহাদুরস্য,
বর্গী নবাব নিসূদন। শকাব্দ ১৭২৮। বঙ্গ-সাল ১২১৩। আংরেজী ১৮০৭।

কবি কালিদাস যদি বিক্রমাদিত্যের অনুগ্রহে রাজ্যখণ্ড পেয়ে রাজা কালিদাস হতেন, তাতে বিস্ময়ের কিছু থাকত না; বর্ধমানের রাজার সেরেস্তায় রামপ্রসাদ সেন রোকড়ের খাতায় হিসেবের বদলে শ্যামা সঙ্গীত লিখে ধরা পড়ে রাজার কৃপায় ব্রহ্মত্র পেয়ে সাধক হয়েছিলেন এমন নজীর অনেক আছে; কিন্তু বিক্রমাদিত্য কালিদাসের মত হতে কোনদিন চাননি—চাইলে হ’তে পারতেন না। বর্ধমানের রাজাও রামপ্রসাদ হতে পারতেন না। সেই নজীরে সুরেশ্বরের কাছে কুড়ারামের এই পাঁচালী রচনার নিদর্শন এক মহাবিস্ময়ের সঞ্চার করেছিল। তাঁর একসঙ্গে জমিদার আর পাঁচালীকার হওয়া তার কাছে আশ্চর্য মনে হয়েছিল। সারারাত জেগে সে সেদিন এই পাঁচালি পড়েছিল।

সুরেশ্বর বললে—সুলতা, আমার ভাল লেগেছিল। আশ্চর্য লেগেছিল। শুধু রচনা নয়, কাহিনী এবং এই লোকটিকে আমার আশ্চর্য ভালো লেগেছিল। যদি বল নিজের বংশের আদিপুরুষ বলে ভাল লেগেছে, তাও অস্বীকার করব না। যদি বল আমার মধ্যে সেদিন জমিদার জেগেছিল বলে ভাল লেগেছে, আমি রি-অ্যাকশনারী, তাতেও তকরার করব না। কোন ভান নেই, কোন ধর্মের বা ইজমের দোহাই নেই—আশ্চর্য অকপট মানুষ।

শেষের লাইনগুলো পড়েছ? মন দিয়ে পড়েছ কিনা জানিনে, আমি বলছি, তুমি আবার শোন—

পাপপুণ্য নাহি জানি, যাহা করিয়াছি আমি
সবার মালিক তুমি, জয় কালী-করালী।
ছিলাম দরিদ্র সুত ন ভবিষ্য নাহি ভূত
বর্তমানে দুঃখ কত তুই মা দেওয়ালি।
সেই দুঃখ পার করিলি, তুই সেই শক্তি দিলি
শেষে জমিদারী দিলি, মোর ঘরে এলি।
ছত্রি জমিদারের টাকা, চুয়াড়েরা ডাকাবুকা
লুঠে দিল গাত্র ঢাকা, সে তুই লুঠালি।
থাক মা অচলা হয়ে, বিপদ আপদ জয়ে
সোমেশ্বরে ভাগ্য দিয়ে, দিয়ে বংশাবলী।
দিয়ো মাগো অতঃপর লক্ষ্মী-সরস্বতী বর
রায়কুল বংশধর ভরিয়া অঞ্জলি।
কোম্পানীকে দিয়ো জয় তাদের অনুগ্রহ যেন রয়
রায়বংশে হয়ে অক্ষয় মা তোর কৃপায়।
তোমাতে দেবত্র করি, বিষয় আদি জমিদারী
আমি মা ভাসাই তরী, রাখো রাঙা পায়।

আবৃত্তি শেষ করে সুরেশ্বর বললে—সুলতা, মায়ের যদি চরণ থাকে আর যদি রাঙা টুকটুকেই হয় তবে তা কুড়ারাম পেয়েছিলেন। আর মা না থাকলে কথাই নেই, চরণ নেই, কুড়ারাম চোখ বুজে ফুরিয়ে গেছেন, তিনি মা-হারানো ছেলের মত খুঁজেও বেড়াচ্ছেন না। তবে আজ যদি কুড়ারাম জন্মাতেন, তবে একজন দুর্ধর্ষ রাজনৈতিক কর্মী এবং নেতা হতেন তাতে সন্দেহ নেই।

সুলতা হাসলে। হেসে বললে-অ্যাসেম্বলীতে সুবোধ বাঁড়ুজ্জের এবং আর সবদের গালাগালি তোমাকে আঘাত দিয়েছে, তুমি ভুলতে পারছ না।

—না। সে গালাগালির জন্যে দুঃখ নেই—মনে কোন ক্ষতও নেই। আমি বলছি সুলতা, এত করে এমন করে বলছি এই জন্যে যে, আমি যেন তাঁকে অবিচার না করি।

—না। সে অবিচার তুমি করনি। আমিও করছি না। আমি অ্যাসেম্বলীর মেম্বার হলে হয়তো এমনি গালাগালিই করতাম। আর তার জন্যে দোষও তুমি দিতে পারতে না। কারণ আজ এইটেই মানুষের বিশ্বাস। পারমানেন্ট সেটেলমেন্টের সময় লোকে কর্নওয়ালিশকে আশীর্বাদ করেছিল। আমি কালই চণ্ডীচরণের দেওয়ান গঙ্গাগোবিন্দ সিং পড়ছিলাম। সে কথা থাক। ও নিয়ে মীমাংসার জন্যে আমি বসে নেই সুরেশ্বর। আজ আমি যার জন্যে এই রাত্রেও তোমার এখানে রয়ে গেলাম, বসে রয়েছি, সেই কথা বলে। তোমার পুর্বপুরুষ আমার পূর্বপুরুষকে খুন করেছিলেন বা করিয়েছিলেন, যার জন্যে তুমি আর ফিরে এলে না কীর্তিহাট থেকে। আমার সঙ্গে জীবনে পাক বাঁধবার জন্যে আঁচলের যে খুঁটটা ধরে ছিলে সেটা ছেড়ে দিয়ে লিখলে—এ গ্রন্থি বাঁধা চলে না। ওখানে বিধাতা ছুরি উদ্যত করে রেখেছেন, বাঁধতে গেলে কেটে খানখান হয়ে যাবে। আমি সেই কথাটা শুনতে চাই। তুমি তাই বল। কীর্তিহাটের কড়চা তুমি দশজনকে ডেকে দেখিয়ো। তার থেকে তোমার জবানবন্দীতে আমার গরজ বেশী।

সুরেশ্বর বললে—একটার সঙ্গে আর একটা এমন ভাবে বাঁধা সুলতা, যে বিধাতার ছুরিও তাকে কেটে আলাদা করতে পারবে না।

—কুড়ারামের পাঁচালীতে রায়বংশের খামখেয়ালী প্রকৃতি, ক্ষেত্রবিশেষ উন্মত্ত আচরণের একটা বীজ আছে। হেরিডিটি সায়েন্সে আছে, লুন্যাসি আর প্রতিভা, যদি তাকে পাপপ্রবৃত্তি পুণ্যপ্রবৃত্তি বলি, তবে তর্ক করো না। মেনে নাও, ওদুটো বংশে নানা মিশ্রণের মধ্যে একসময় ঢুকে বসলে সে থেকেই যায় এবং তার খেলা আর থামে না, চলে। এই খেয়ালীপনা পাগলামীর বীজ রায়বংশে ঢুকিয়েছিলেন কুড়ারাম রায়। তুমি তাঁর পাঁচালীটা পড়ে এলে। কিন্তু সন্ধানটা ধরতে পারনি।

সুলতা সবিস্ময়ে বললে—কোনটা বল তো? কুড়ারাম ভট্টাচার্যের পাগলামীর বীজ? তিনি ভালো বা মন্দ সে বিচার না করে একটা কথায় নিশ্চয় তুমি বিস্মিত হবে না যে, তিনি দুই আর দুইয়ে চারের ছিলেন। মনুষ্য বলব না, ও শব্দটি ব্যঙ্গ করে ব্যবহার করি আমরা। পাগলামীর একবিন্দু অপবাদ তাঁকে দিয়ে রেহাইয়ের কোন অজুহাত কেউ তৈরী করতে পারবে না। তা তাঁর ছিল না।

—কিন্তু আমার মধ্যে আছে। আমার বাবার মধ্যে ছিল। বাবার দুর্দান্ত খেয়ালীপনা বা যা তিনি করেছিলেন—যথেষ্ট শিক্ষা সত্ত্বেও—সেটা যে পাগলামীর সামিল তা তুমি অস্বীকার করতে পারবে না।

একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে সুলতা বললে না, তা করব না। কারণ, যারা তোমার আমার কথা জানত, তারা তুমি ডুব মারলে এই কথাই বলেছে। বলেছে ওই বাপেরই ছেলে তো! তবে আমি বলি, তা ঠিক নয়। ওটা তাঁরও এসেছিল, তোমারও এসেছে—অনেক টাকা থেকে। অনেক টাকা থাকলেই মানুষ মদ খেয়ে ব্যভিচার করে। সেটা অভ্যাসে দাঁড়ায়। ও থেকে দেহে মনে দুদিক থেকেই বিষ ঢোকে।

সুরেশ্বর বললে—অস্বীকার অবশ্যই করব না। সে বললে—সবার মধ্যেই ও বীজ আছে। কারণ আদিম কালে ওইটেই ছিল জীবন-ধর্ম, জীব-ধর্ম তো বটেই। কিন্তু তার থেকেও প্রত্যক্ষ কারণ রয়েছে, সেই কথা বলছি। কুড়ারাম ভট্টাচার্যের পাঁচালীতে আছে তিনি সোমেশ্বরের বিয়ে দিয়েছিলেন—

সুলতা বললে—হ্যাঁ, বিয়ে দিয়েছিলেন-তাঁর তারকেশ্বরে যে মেয়েটির সঙ্গে ভালবাসা হয়েছিল তার মেয়ের সঙ্গে। ওটা একটা অতৃপ্ত ভালোবাসার তৃপ্তিসাধনের একটা সস্তা পথ বটে।

সুরেশ্বর বললে—সস্তা বা সুগম পথ ছেড়ে বাঁকাপথ বা সূক্ষ্মপথ ধরবার লোক তো ছিলেন না কুড়ারাম। ভালবেসে ভালোবাসার জনকে, তুমি চন্দ্রলোকে থাকবে আমি পৃথিবীতে বা শুক্রগ্রহে থেকে ভালবেসে যাব অনন্তকাল, এ ধাঁচের মনুষ্যই তিনি ছিলেন না। যাক গে। মানুষ কথাটা এখানে আমিই ব্যবহার করলাম। সে কথা থাক। মোটকথা শোন। এই মেয়েটির বিয়ে হয়েছিল এক মুসলমান আমলের জমিদারের ছেলের সঙ্গে। কুড়ারাম সুপুরুষ ছিলেন, কিন্তু তিনি ছিলেন বামুনে সুপুরুষ। এ একেবারে রাজোয়াড়ী সুপুরুষ। বর্ণনায় রাত্রি কাটাব না, ওটা কল্পনা করে নাও। তাঁর ছবি এখন মনে হচ্ছে আমার আঁকা উচিত ছিল; কিন্তু আঁকিনি। বাড়ী বাঁকুড়া এবং হুগলির বর্ডারে। সেই বাড়ীতে কুড়ারাম রায় হঠাৎ গিয়ে পড়লেন বা উঠলেন একান্ত আকস্মিকভাবে। ইচ্ছে করে নয়। তিনি যাচ্ছিলেন কোম্পানির কাজে বাঁকড়ো জেলা। পথে হঠাৎ এল জল ঝড় দুর্যোগ। পাইক সওয়ার বেহারারা প্রথম একখানা গাঁয়ের ধারে গাছতলায় আশ্রয় নিয়েছিল। কুড়ারাম ছিলেন পাল্কিতে। জল ঝড়ে গাছতলা মন্দের ভাল, কিন্তু তার সঙ্গে দু-একটা বজ্রপাত হলে গাছতলা সাপের গর্ত কি বাঘের দেখার সমান বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।

পাঁচালীতে আছে—

শিয়রেতে সর্পরন্ধ্র অরণ্যে ব্যাঘ্রের গন্ধ
এ থেকেও আরও মন্দ বজ্রপাতে বৃক্ষ।
সুতরাং উঠায়ে পাল্কী
হাঁকারে চলিনু জলদি
সওয়ার বেহারা লগ্নি গ্রাম গৃহ লক্ষ্য।

গ্রাম সামনেই ছিল, এবং বড় একখানা শ্যাওলা-ধরা পাকাবাড়ীর মাথাও দেখা যাচ্ছিল। সেই গ্রামে ঢুকে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সওয়ার বরকন্দাজদের তকমা দেখে গৃহস্বামী ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। কোম্পানীর কানুনগো, খোদ দেওয়ান গঙ্গাগোবিন্দ সিংহের ডানহাত কুড়ারাম ভটচাজের নাম শুনে গৃহস্বামী তটস্থ হয়ে উঠেছিলেন। কুড়ারামও গৃহস্বামীকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। ওই রাজোয়াড়ী চেহারা। সর্বাঙ্গে দুঃখ দৈন্যের ক্লেশের ছাপ, কিন্তু মাথাটা উঁচু সোজা। মিষ্ট কথা। কিন্তু লোকটি বোকা-বোকা।

বলেছিলেন—তাই তো ভাঙা ঘর। ছাদ ভেঙেছে। খড়ের চাল করেছি, তাতেও জল পড়ে, এখানে আপনাকে কি করে কোথায় বসাই। কি খাওয়াই! আমি তো বলতে গেলে সর্বস্বান্ত!

বাড়ীর ভিতর থেকে হুকুম এসেছিল, উনি বাড়ীর ভেতর দোতলায় থাকবেন। হুকুম এনেছিল একটি আশ্চর্য রূপসী সাত বছরের মেয়ে। পরনে ফিরানী। যা নাকি চাষাভুষোদের মেয়েরা পরে। কুড়ারাম বলেছিল—–বাঃ বাঃ বাঃ, এ তো অপরূপ মেয়ে!

বাপ বোকার মত হে-হে করে হেসেছিলেন। বাপকে মেয়ে বলেছিল- মা তুমাকে ডাকছে বাবা। বললে ধরে নিয়ে আসবি! এস!

তখনও কুড়ারামের মনে হয় নি এই মেয়ের সঙ্গে সোমেশ্বরের বিবাহ দেবার। তিনি চারিদিক তাকিয়ে দেখছিলেন। বৈঠকখানার ছাদ নেই। ধ্বসে পড়েছে, খড়ের চাল তুলেছে। সামনে পাঁচিল ভেঙে পড়েছে। এদিকে বড় পুকুরটার বাঁধা ঘাট, তারও দু পাশের রানা দুটো কাত হয়ে পড়েছে। এসবের ইতিবৃত্ত কুড়ারামের অজানা নয়। বাংলাদেশের জমিদারদের বাড়ীর নাড়ীর খবর তাঁর নখ-দর্পণে। এ সব বাড়িকে তিনি ভয় করেন। ভাঙা বড় বাড়ী আর পূর্ববঙ্গের কীর্তিনাশা রাক্ষুসী নদী, ও দুইয়ে কোন তফাৎ নেই। বরং কীর্তিনাশার চেয়েও ভাঙা বাড়ী ভয়ংকর। কীর্তিনাশা একুল ভাঙলে ওকুল গড়ে। বড় বাড়ী যখন ভেঙে পড়ে তখন সব চেপে পিষে মাটিতে মিশিয়ে দেয়। ধুলো হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।

রাজহাটের রায়বাড়ী, মুসলমান আমলের রাজা উপাধিকারী। নিজেরাই রাজা উপাধি নিত। বড়রাজা মেজরাজা সেজরাজা। রাজা অনেক। অনেকেই দেশ ত্যাগ করেছে। অনেকে মরেছে। যেমন পলুপোকার মধ্যে রোগ হলে ঝাঁকে ঝাঁকে মরে। তাদের সম্পত্তি দু-চার বিঘে বা দশ বিশ্বে জমি দৌহিত্র বংশে গেছে। এখন এই পুরনো বাড়ীতে আছে এই একা মানুষটি আর তার স্ত্রী এবং এই একটি মাত্র কন্যা। লোকে বলে পাগল। পাগলামী রাজাগিরি। পাগলামী নিশ্চয়, নইলে সামান্য হাজার কয়েক টাকা আয় নিয়ে কোম্পানীর প্রথম আমলে মেদিনীপুর বাঁকুড়া ঝাড়গ্রাম বিষ্ণুপুর প্রভৃতির রাজারা যখন কোম্পানীর সঙ্গে রাজস্বের নতুন চুক্তি করতে অস্বীকার করলে, তখন তাদের দেখাদেখি শিবনারায়ণ দেবরায় তিনিও বললেন—খাজনা দেব না। কোম্পানী কে খাজনা বাড়াবার? ফলে মেদিনীপুর থেকে ফার্গুসন সাহেব একজন সার্জেন্টের অধীনে ষোলজন বন্দুকধারী সিপাহী পাঠিয়ে দিলেন। রাজার চাকরানভোগী পাইক ছিল জন চল্লিশেক। তারা বন্দুকের শব্দ শুনে পালাল। রাজা ঘরে গিয়ে খিল বন্ধ করলেন। কোম্পানীর সিপাহীরা বন্দুকের গুলিতে দরজা ঝাঁঝরা করে দিলে। তখন জানালা দিয়ে বেরিয়ে এল সাদা কাপড়ের ফালি আর একখানা গয়না-পরা আশ্চর্য সুন্দর হাত। রাজাকে নিয়ে রাণী বেরিয়ে এসে সার্জেন্টের কাছে হার মেনে চুক্তি সই করলেন। লোকে বলে সেটা রাজার জন্যে নয়, সেটা সেই আশ্চর্য সুন্দর হাতের অধিকারিণী রাণীর জন্য। কোম্পানীকে খেসারত দেবার জন্য রাণীই দিলেন তাঁর অলঙ্কার খুলে। তখন সব রক্ষা হল বটে, কিন্তু বছর কয়েকের মধ্যেই সুর্যাস্ত নীলাম আইনে সব জমিদারীই চলে গেল। রয়েছে এখন এই গ্রামখানি। তাও আজ যায় কাল যায়। রাজাকে বার-দুই ধরেও নিয়ে গিয়েছিল হুগলীর কালেক্টরীর পেয়াদা এসে। এসব বিবরণ সব জানতেন কুড়ারাম ভটচাজ। কিন্তু এই বাড়িতে সেই তারকেশ্বরের হৃদয়হারিণীর বিয়ে হয়েছে এ কথাটা তিনি ঠিক স্মরণ করতে পারেন নি। তাই বাড়ীর ভিতর যখন তাঁকে আহ্বান করে নিয়ে গেলেন রাজা, তখন অন্দরের প্রবেশপথে তাকেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে স্তম্ভিতের মত দাঁড়িয়ে গেলেন।

রাণী নমস্কার করে বললেন—আসুন। আজ আমাদের বাড়ী ধন্য হল। রাজকর্মচারী অনেক আসে, কিন্তু ব্রাহ্মণ কর্মচারী তো আসে না। তা ছাড়া আপনার হাত তো শুধু কলমে ধন্য নয়। বাবা তারকেশ্বরের পূজায় ধন্য, মা হংসেশ্বরীর পূজায় ধন্য। আসুন। আসুন।

রাজা হে হে করে হেসেছিলেন।

রাত্রিতে তাঁর খাওয়ার সামনে পাখা হাতে বসে রাণী খাওয়াচ্ছিলেন তাঁকে। রাজা তখন আফিঙের মৌজে নিজের ঘরে বসে তামাক খাচ্ছেন।

রাণী বলেছিলেন—অদৃষ্টই সব থেকে বলবান, নয় কানুনগো সাহেব?

কুড়ারাম বলেছিলেন—দৃষ্ট হলে সেদিন তার সঙ্গে লড়তাম। আজও যদি পাই সেই মরে নয় আমি মরি!

রাণী একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলেছিলেন তারপর বিয়ে-টিয়ে হয়েছে? ছেলে-পিলে কি? নাতিপুতি?

কুড়ারাম বলেছিলেন—বিয়ে অনেক কালই করিনি। তবে ললিতা বলে একটি মেয়ে সেবাটেবা করত।

ফিক করে হেসে ফেললেন রাণী। বললেন-ও তো পুরুষের ভূষণ। তারপর?

—সে মারা যাবার পর বিয়ে করেছিলাম কালীঘাটে। সে একটি সন্তান হবার পরই মারা গেল। বিবাহ আর করিনি। করবও না।

—কটি সেবাদাসী? হঠাৎ থেমে গিয়ে বললেন—থাক গে। নিজের গরজ গজিয়ে উঠেছে কথা শুনে। ছেলেটি কত বড় হল?

দশ বছরের।

পাখাখানি নামিয়ে রেখে রাণী বলেছিলেন—তাহলে অদৃষ্টের মুখে একটু চুনকালি দিয়ে দাও না। তুমি তো পুরুষসিংহ!

একদৃষ্টে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন কুড়ারাম।

হেসে রাণী বলেছিলেন—আমাদের যা হবার তা তো হয়েছে। আমার ওই একটি মেয়ে। সাতটা ছেলে-মেয়ে আঁতুড়ে মরেছে তা ছাড়া। তা আমার মেয়ের সঙ্গে তোমার ছেলের বিয়ে দিয়ে আমাদের বিয়ে না হতে দেওয়ার ঠাট্টার শোধটা নাও না অদৃষ্টের উপর। তোমার তো আজ টাকার অভাব নেই। আমার মেয়েকে দেখেছ। আমার থেকেও সুন্দরী হবে!

পাঁচালীতে আছে—

রাণী মোরে কয় হেসে বেয়ান হইব শেষে
মধু সাথে অম্ল মিশে মিষ্ট হবে আরও
সাথে তার চোখে পানি কাতরে কহিল রাণী
কন্যাদায়ে দিবাযামী নিদ্রা নাহি মোরও।।

কুড়ারাম বলেছিলেন—কেঁদো না তুমি। নিলাম, তোমার কন্যা আমি নিলাম! তোমার কন্যা আমার পুত্রবধূ হল। তোমার মেয়ে রাজবংশের মেয়ে, ওই রক্তে আমার বংশও ধন্য হবে!

মানুষ ভাবে না সুলতা—মানুষের শুদ্ধ রক্ত আর রাজবংশের রক্ত এক নয়! ওইখানে মিশল!

তারপর ভট্টাচার্য উপাধি রায় উপাধির তলায় চাপা দিয়ে জমিদারী কিনে কুড়ারাম ছেলের বিবাহ দিয়ে ঘরে আনলেন সর্বস্বান্ত রাজার রাজকন্যা। তার সঙ্গে রাজরক্ত। ভট্টাচার্য রায় হল। তার কারণ আছে সুলতা। রাণী তাঁর কন্যাকে কুড়ারামের পুত্রের হাতে দিতে চাইলেও এবং মেয়ের বাপ মুঘল আমলের রাজা খেতাবধারী নিঃস্বপ্রায় ব্যক্তিটি কানুনগো চাকুরীজীবী ভট্টাচার্য উপাধিধারী বাপের ছেলের সঙ্গে কন্যার বিবাহ দিতে চাননি। তিনি কোম্পানীর সঙ্গে যুদ্ধ করে হেরেছেন। তার গোলামি করেননি।

লোকটির মস্তিষ্ক ছিল না কিন্তু আশ্চর্য একটি সহনশীল জেদ ছিল। তাঁর কাছে কুড়ারাম যখন প্রস্তাব করলেন এই বিবাহের, তখন তিনি ঘাড় নেড়ে একটু হেসেই বললেন —তা কি করে হবে? আমাদের রাজবংশ! আমাদের মেয়ে ভট্টাচার্যবাড়িতেও যায় না। ও জোতদার কি কানুনগোর ঘরেও যায় না।

হেসে সবিনয়ে বলেছিলেন- আমরা ধরুন নদীর মাছ, পুকুরের জল আমাদের সইবে ক্যানো গো মশায়! ও হয় না!

স্ত্রী অন্তরালে ছিলেন। বেরিয়ে এসে এবার বলেছিলেন—পাগলামী করো না।

— পাগলামী কি হল?

—হল না? রাজা! রাজার ঐশ্বর্য তো ষোল আনা। বাড়ী ভেঙে হাঁ করে আছে, ভেঙে পড়ে কোন দিন চাপা দেবে। রাজার থাকবার মধ্যে তো বাড়ি পুকুর ব্রহ্মত্র, রাণী কাঁখে কলসী করে জল আনে। ঘাটে চান করে। রাজা নিজে হাতে সেজে তামাক খায়। বাকী খাজনার দায়ে কোম্পানী মধ্যে মধ্যে নিয়ে গিয়ে জেলে ভরে রাখে—

চোখ লাল হয়ে উঠেছিল কন্যার পিতার। এবার তিনি ভাঙা পাঁচিল দিয়ে গাছপালাশূন্য বাগানটায় ঢোকা একটা গরুকে তাড়া দিয়ে প্রায় একটা ব্যাঘ্রগর্জন করে উঠেছিলেন।

কুড়ারামেরও মুখ চোখ লাল হয়ে উঠেছিল।

রাজার গৃহিণী রাণী সারদা দেবী থমথমে মুখে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনিও প্রাচীন জমিদার ঘরের মেয়ে। তাঁর বিয়েও ঠিক এই কারণেই তাঁর বাবা কুড়ারামের সঙ্গে দেননি। সে ক্ষোভ তাঁর অন্তরেও ছিল, প্রবলভাবেই ছিল। এবং তিনি এই অক্ষম অপদার্থ শিমুল ফুলের মত মানুষটার হাতে পড়ে যে দুঃখ জীবনে পেয়েছেন তা তাঁর জীবনে তুষানলের মতই জ্বলছে অহরং। তাঁর বাপ বিবাহে তাঁকে অলঙ্কারে অর্থে কম কিছু দেননি। কিন্তু সেসব গিয়েছে। গিয়েছে এই মূর্খ জেদসর্বস্ব ব্যক্তিটির জন্য।

তিনি কঠিন কণ্ঠে বলেছিলেন, মেয়েকে ভাসিয়ে দিতে আমি দেব না।

রাজা গ্রাহ্য করেননি, পাগলের মতই নেমে গিয়েছিলেন এবং গরুটাকে একটা লাঠি দিয়ে পিটতে আরম্ভ করেছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে চীৎকার।

কুড়ারাম রাণীর দিকে ফিরে বলেছিলেন—ঠিক আছে সারদা, হবে। সে ব্যবস্থা আমি করব। তুমি নিশ্চিস্ত থাক। শুধু দুটো বছর সময়। দুটো বছর!

.

দু বছরও লাগে নি, দেড় বছরের মধ্যেই সব হয়ে গিয়েছিল। জমিদারী কেনা, সরকারী আদালতে—একেবারে সুপ্রিম কোর্টে দরখাস্ত করে ভট্টাচার্যকে রায়ভট্টাচার্য করে নিয়ে, ঘটক এবং একজন কর্মচারী পাঠিয়েছিলেন কুড়ারাম রায়।

ঘটক পরিচয় দিলে বোকা মনুষ্য রাজা দেবরায় বলেছিলেন,–এ তো সেই ভটচাজ!

সারদা দেবী বলেছিলেন—না রায়ভটচাজ। ভটচাজ বাদ যাবে।

—তা কি করে যাবে?

—কেন, তোমরা কি ছিলে? গুরুগিরি করতে না ছত্রি রাজাদের? চক্রবর্তী নও তোমরা?

—হুঁ, বটে। তা সে অনেকদিনের কথা!

—তাই জন্যে তো সব গিয়েছে। ঘরে আজ পাঁচটা টাকা নেই যে ঘটককে দেব।

রাজা চুপ করে ছিলেন।

পরদিন সকালে ঘটকের সঙ্গে কথাবার্তা হবার কথা। কিন্তু বাধা পড়েছিল। এসেছিল কোম্পানী কালেকটারীর চাপরাশী। সঙ্গে পরোয়ানা। নীলেম হয়ে-যাওয়া জমিদারীর বাকি অনাদায়ী টাকার জন্যে ক্রোক। না দিলে রাজাকে বেঁধে নিয়ে যাবে।

সেকালের আইনের প্যাঁচ। মবলকে এগার হাজার সিক্কা টাকা দশ আনা সাড়ে বারো গণ্ডা রাজস্ব পাওয়ার জন্য লাট নম্বর বারোশত তিয়াত্তর নিলাম হয় দশ হাজার টাকায়। সে টাকা কোম্পানীর কালেকটারী ভুক্তান হওয়ার পর এক হাজার সিক্কা দশ আনা সাড়ে বারো গণ্ডা কোম্পানীর প্রাপ্য দরুণ এই পরোওয়ানা জারী হইতেছে।

রাজা শিবনারায়ণ কোম্পানীর চাপরাসী দেখে অত্যন্ত ভয় পেতেন। তিনি যে সেই রাজস্ব দেব না ঘোষণা ক’রে লড়তে গিয়ে কোম্পানীর ষোল ষোলটা বন্দুকের পাঁচবার আওয়াজে আশিটা বিস্ফোরণ-শব্দ শুনেছিলেন এবং এমন পুরনো মোটা কাঠের দরজা জোড়াকে ফেটে যেতে দেখেছিলেন সে স্মৃতি তিনি কিছুতেই মুছতে পারেন না। তাঁর আফিঙের নেশা, সোজা নেশা নয়, সকালে দুপুরে সন্ধ্যায় প্রায় ছ মটর কলাই ভোর আফিঙের নেশা। চোখ দুটো শিবের মতই বড় এবং ওই নেশায় শিবের চোখের মতই বারো আনা বুজে থাকত। সে চোখও পুরো খুলে বিস্ফারিত হয়ে উঠত কোম্পানীর চাপরাসী দেখলে। সুতরাং তিনি বাইরে বেরিয়ে চাপরাসী দেখেই দ্রুত ফিরে অন্দরে গিয়ে ঢুকে ঘরে খিল দিয়েছিলেন।

রাণী সারদা দেবী ডেকে বলেছিলেন—দরজা খোল ভয় নেই। ফিরে গিয়েছে।

রাজা শিবনারায়ণ ঘরের মধ্যে একটা শালগ্রাম হাতে ক’রে বসেছিলেন। শালগ্ৰাম নয়, তাঁর সঞ্চয়ের আফিঙ। সেটা গিলবেন কি ক’রে সেইটে সমস্যা হয়েছিল তাঁর। তিনি রাণীকে বলেছিলেন—মিছে কথা বলছ। আমাকে তুমি ধরিয়ে দেবে।

—না। না। না।

রাণীর কথা শেষ হতেই মেয়ে কাত্যায়নী বলেছিল—না বাবা, সত্যিই হারামজাদা কুত্তারা চলে গেল। সেলাম করে চলে গেল বাবা।

তখন দরজা খুলেছিলেন শিবনারায়ণ। মেয়ে কাত্যায়নী বলেছিল—ওই ঘটকবুড়োর সঙ্গে যে নায়ের বেটা না গোমস্তা বেটা এসেছে সে জামিন হয়ে সই করে দিলে। জমিদারবাবু সোমেশ্বর রায়বাহাদুরের বকলমে সই দিলে। কুত্তারা লেজ গুটিয়ে সেলাম করে চলে গেল!

কুড়ারাম রায় ভট্টাচার্য সদর হুগলীতে বসে নিজে কালেকটারীর আমলাদের নিয়ে ব্যাপারটা করেছিলেন।

শিবনারায়ণ রায় হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিলেন। এবং কৃতজ্ঞ হয়েছিলেন বাবু জমিদার সোমেশ্বর রায়ের উপর। সুতরাং তারপর আর বিবাহের পথে একটি কণ্টকও মাথা তুলে ওঠেনি।

আট বছরের কনে কাত্যায়নী কীর্তিহাটে এসেছিলেন, সঙ্গে এসেছিল ওঁদের বাড়ীর একমাত্র ঝি বুড়ী কুন্তী। কুন্তী ওদেশের মেয়ে—বাপ ছিল দেবরায়দের ছত্রী চাপরাসী, মা ছিল কাহার বা কুর্মী। আজীবনই এদের বাড়ী আছে। প্রথম জীবনে শিবনারায়ণের ঝি ছিল, বিয়ে কখনও হয়নি। কাত্যায়নীকে মানুষ করেছিল সেই। সেই আগলে আগলে রেখেছিল কাত্যায়নীকে। কিন্তু তবু কাত্যায়নী প্রথম দিন থেকেই শ্বশুরবাড়ীতে চাকরদের ঝিদের দু-চারবার শাসন ক’রে ডেকেছিল—এই হারামজাদা! শুনতে পাস না? এই হারামজাদী—কানে তোর কভরি সোনা আছে?

কুন্তী তাদের বলেছিল—কিছু মনে করো না। লেড়কী মেয়ে—বাচ্চা। তবে ও তো রাজার বেটী! বেতরিবৎ ওর সয় না!

শুনে কিন্তু কুড়ারাম রায় ভটচাজ খুশী হয়েছিলেন। খুব খুশী!

হ্যাঁ। এইবার বাড়ীতে সত্যিই জমিদারী মহিমা এসেছে!

রাজকুমারী কাত্যায়নী কীর্তিহাটের কড়চায় রায়দের বংশধারায় বইয়ে দিলেন এদেশের পাঁচশো বছরের আমীরশাহী চাল-চলন, ধারা-ধরন, হাঁটা, কথা বলা, রীতিনীতি সব। ঝি-চাকরেরা তাঁকে ভয় করত বাঘের মত। রাগ হলে হাতের কাছে যা থাকত তাই ছুঁড়ে মারতেন। আবার বকশিশ দিতেন। দেবতায় ছিল অচলা ভক্তি। ব্রতে উপবাসে তাঁর মত নিষ্ঠা বিরল। দেবসেবায় যে কত নতুন নতুন ধারা তিনি প্রচলন করেছিলেন তার হিসেব কাগজে পাওয়া যায়। হাঁটতেন তিনি আস্তে কিন্তু পা ফেলতেন তাতে শব্দ হত। ছিপছিপে পাতলা অসাধারণ রূপসী ছিলেন, ওজন বেশী ছিল না কিন্তু তিনি নড়লেই কীর্তিহাটের বাড়ীর মেঝে সাড়া দিয়ে জানাতো যে রাজকুমারী বধূ কাত্যায়নী সচলা হয়েছেন। আবার অতিথি অভ্যাগত কুটুম্ব সজ্জনের কাছে তাঁর মত অনুগ্রহপরায়ণা কেউ ছিল না। মধ্যে মধ্যে পাগল হতেন। বাপের রোগটা পেয়েছিলেন। শুধু বাপের নয় দেবরায়দের বংশে এখানে ওখানে যারা ছড়িয়ে ছিল, যাদের কথা জানত লোকে, তাঁদের মধ্যে দশ পনের জন আধপাগলের নাম আমি পেয়েছি সুলতা। রাজকুমারী কাত্যায়নীর এসব বিবরণ কুড়ারাম রায় ভট্টচার্জের পাঁচালীতে নেই। পাঁচালী তো তুমি সদ্য পড়েছ। তবে তাড়াতাড়ি পড়েছ। আমি বিশদ করে বলে গেলাম। এ বিবরণ আমি শুনেছি।

কিছু জেনেছি রায়বাড়ীতে মেজঠাকুমার কাছে। তিনি এসব শুনেছিলেন মেজঠাকুরদার কাছে। কিছু কিছু এখনও গ্রামে চলিত আছে। বাড়ীতে বাড়ীতে পুরুষ পরম্পরায়—অবশ্য মেয়েদের মধ্যে—চলে আসছে।

রায়বাড়ীর পিছন দিকে দুধসায়র পুকুর আছে। বাঁধানো ঘাট। আগে পাঁচিল দিয়ে ঘেরা ছিল। কুড়ারাম রায় কাটিয়েছিলেন পুকুর রাজকুমারী বউমার স্নানের জন্য। পুকুরে জল ভ’রে একশো ঘড়া দুধ ঢেলেছিলেন, প্রথম যেদিন বউমা পুকুরে স্নান করেন সেই দিন। পুকুরটা এখনও আছে, মঞ্চে এসেছে; পাঁচিল পড়ে গেছে। এখন বাড়ীতে কুয়ো হয়েছে। ওটায় এখন বাসন মাজা হয়। কিন্তু সেদিন ও-পুকুরে রায়বাড়ীর ছেলে বউ ছাড়া কেউ স্নান করত না। দুধপুকুরে স্নান করলে রঙ ফরসা হত। রাজকুমারী বউ কাত্যায়নী নিজেই ছিলেন রূপের ঝর্ণা।

রায়বংশে আমীরশাহী চাল- পাগলামী ব্যাধির সঙ্গে আর একটি জিনিস তিনি এনেছিলেন সেটি রূপ। কুড়ারাম রায় রূপবান ছিলেন কিন্তু বলেছি তো, সেটা বামুনে রূপ। যে রূপ কপালে চন্দনে তিলকে খোলে। এ রূপের জাত আলাদা। এ রূপ প্রসাধন ভূষণ ভূষা ছাড়া খোলে না।

নুরজাহান, পদ্মিনী এ তো সহজ পথে আসে নি সুলতা। অনেক ঐশ্বর্য অনেক শক্তির উপর সাধনপীঠ বানিয়ে তার উপর আলপনা পেতে বাছাইকরা দশ বিশটা রূপের বাটি থেকে রক্ত মিশিয়ে তবে এসেছে। গালে গোলাপ কোন দেশের কোন মৌলিক রূপেই ছিল না বলেই আমার বিশ্বাস। ওটা হয়েছে অনেক সাধনায়। রাজকুমারী কাত্যায়নী তাই এনে দিয়ে গেছেন রায়বংশে। কুড়ারাম ভট্টাচার্য তাতে নিজেকে কৃতার্থ মনে করতেন। বলতেন—সম্পদ সৌভাগ্য এ আমার ছিল। কিন্তু বউমা আমার যে শ্রী নিয়ে এসেছে তাতে সম্পদ-সৌভাগ্য উজ্জ্বল হল।

এইখানেই কুড়ারাম রায়ের পাঁচালীর ইতি। দুটো কথা আছে। তিনি কিন্তু ছেলে-বউ নিয়ে কীর্তিহাটে থাকেন নি। থেকেছিলেন কলকাতায়। থেকেছিলেন ছেলেকে গড়ে তোলবার জন্য। তখন দেশে নতুন হাওয়া বইতে শুরু করেছে। কর্নওয়ালিশ সাহেবের পর লর্ড ওয়েলেসলী এসেছেন। নতুন লাটপ্রাসাদ তৈরী হয়েছে। বিশাল সিঁড়ির দুধারে তকমা আচকান জড়িজড়ানো পাগড়িপরা খানসামা বেয়ারা আর্দালী চোপদার দাঁড়িয়ে থাকে। নতুন গাড়ী ঘোড়া আসছে, বিলেত থেকে সাহেব ব্যবসাদার আসছে, রাইটার আসছে, বড়াটাকি লালদীঘির উত্তর পাড়ে লম্বা রাইটার্স বিল্ডিং সেরেস্তাখানা পড়েছে। ব্যবসাদার আসছে; নতুন উকীল অ্যাটর্নী আসছে, ডাক্তার আসছে। জেনারেল কাপ্তেন আসছে। মেমসাহেব আসছে এখানে বেশ্যাবৃত্তি করতে। সাহেবী সরাইখানা কাফিখানা হচ্ছে। পাদ্রীরা আসছে। তারা এখানে গির্জে করছে। ইস্কুল করছে। কিরিশ্চান করছে। লেখাপড়া শেখাচ্ছে। কজন সাহেব এখানে ইস্কুল করেছে—শেরবোর্ন সাহেব ড্রামন্ড সাহেব আরও কত সাহেব।

ওদিকে হিন্দুস্থানে—ভারতবর্ষে গোলমাল। সেই গোলমাল তামাম মুলুকভরই কোম্পানীর সঙ্গে। সাহেবানরা পাকাপোক্ত ভাবে বসেছে। এখন সরকারী সেরেস্তায় চাকরী বড় ব্যবসা বড় জমিদারী যা কর—ইংরিজী না শিখলে হবে না। ইংরিজীর তরিবৎ না হলে বড় সমাজে ঠাঁই পাবে না। রামমোহন রায় পথ খুলেছেন। কলকাতার কায়স্থরা সুবর্ণবণিকেরা ঠেঙভেঙো ইংরিজী শিখে মুৎসুদ্দি দালালী কাজ করছিল, তাদেরও ইংরিজী শেখার তাড়া পড়েছে। কুড়ারাম নিজে কোনরকমে কাজ চালান। মুখে মুখে শিখে নিয়েছেন। কিন্তু ছেলেকে ভালরকম ইংরিজী, তাঁর সঙ্গে সহবৎ তরিবৎ না শেখালে তার জীবনের সাধ অঙ্কুরেই মরে যাবে এ তিনি জানতেন বলেই সোমেশ্বর এবং পুত্রবধূ রাজকুমারী কাত্যায়নীকে নিয়ে কলকাতায় এলেন। সোমেশ্বর ড্রামন্ড সাহেবের ধর্মতলার ইস্কুলে ভর্তি হল।

বেয়ান সারদা দেবী এবং বেয়াইকে কালীঘাটে মাতৃদর্শন করতে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে এলেন। আলাদা বাড়ী ভাড়া করে দিয়েছিলেন। নইলে পৌত্র না হলে মেয়ের মা-বাপকে জামাইঘরের ভাত খেতে নেই। কিছুদিন তাঁদের এখানে রেখে কাত্যায়নীসহ পাঠিয়ে দিলেন স্বগ্রামে। ইতিমধ্যে ওখানকার বাড়ী মেরামত করিয়ে দিয়েছিলেন, কারণ সবই তাঁর সোমেশ্বর পাবে। এই সময়ের মধ্যে বেয়ানের সঙ্গে অনেক গল্প অনেক রহস্যরসিকতায় পরম আনন্দে কেটেছে তাঁর। বেয়াই আফিঙ খেতেন। বিলিতী মদও খাওয়াতেন কুড়ারাম। তিনিও খুব খুশী ছিলেন। কুড়ারাম মাসে মাসে যেতেন কীর্তিহাট। চাঁদপাল ঘাটে বড় বজরা বাঁধা থাকত তাঁর। নাম ছিল-ললিতা। সেই বজরায় যেতেন। হলদী নদীতে ঢুকে জোয়ার এলাকা পর্যন্ত গিয়ে নামতেন। সেখানে থাকত তাঁর হাতী। হাতীর নাম ছিল জংবাহাদুর।

লোকে অনেক কথা বলত, —বেয়ান সম্পর্ক নিয়ে।

কিন্তু তিনি কড়চায় লিখেছেন—

ছেলে বউ সাথে আনি বেয়ান সারদা রাণী
সর্বসুখী মনে মানি কাটে দিন কয়।
কত হাসি কত কথা আগামী জন্মের তথা
কল্পনা পুরাবে মাতা জানিনু নিশ্চয়।।

তারপর সেই কটা লাইন-আগে বলেছি—

পাপপুণ্য নাহি মানি যাহা করিয়াছি আমি
সবার মালিক তুমি জয় কালী করালী।

তার শেষ লাইন—

তোমাতে দেবত্র করি বিষয় আদি জমিদারী
আমি মা ভাসাই তরী রাখো বাঙালায়।

মায়ের চরণেই তিনি দেহত্যাগ করেছিলেন। একবার কীর্তিহাট গিয়ে অসুখে পড়লেন। ছেলে সোমেশ্বরকে লোক পাঠিয়ে আনালেন। লিখলেন, “অবিলম্বে আসিবা।” সোমেশ্বরের বয়স তখন কুড়ি। বধূ কাত্যায়নীর বয়স সতের। তখন তার তিনটি সন্তান হয়ে মারা গেছে। এই এক খেদ নিয়ে তিনি গেলেন। ওই দেখো তাঁর দেহত্যাগের ছবি। এর মধ্যে তারা খেয়ে উঠে এসে সেই ছবি টাঙানো বারান্দায় ঢুকল। সুরেশ্বর ছবিখানা দেখালে। একটা প্রকাণ্ড গাছ উপড়ে পড়েছে। গাছটার কাণ্ডটায় একটা মানুষের দেহের আভাস।

প্রচুর ধুমধাম করে শ্রাদ্ধ করেছিলেন সোমেশ্বর। টাকা খরচ হয়েছিল চল্লিশ হাজার। চাল খরচ হয়েছিল চল্লিশ মণ। ময়দা খরচ হয়েছিল দশ মণ।

শ্রাদ্ধের পর ও অঞ্চলে কলেরা হয়েছিল। সোমেশ্বর সস্ত্রীক কলকাতায় চলে এসেছিলেন।

সুরেশ্বর পরের ছবিখানা দেখালে। আশ্চর্য একটি রূপসী মেয়ে। সর্বাঙ্গে অলঙ্কার। চোখে প্রদীপ্ত দৃষ্টি। সুরেশ্বর বললে পরের ছবি দেখো সুলতা। এরও চার বছর পরের। সোমেশ্বরের বয়স তখন চব্বিশ। ইংরাজী ১৮১৫ সাল। রাজকুমারী বধু কাত্যায়নীর বয়স একুশ।

তাঁর কোল শূন্য। রাজরক্তের সঙ্গে উন্মত্ততা উগ্রতার সঙ্গে আর একটি ব্যাধি তিনি নিয়ে এসেছিলেন, সেটি তাঁর মৃতবৎসা দোষ।

হয়তো এ যুগ হলে রক্ত পরীক্ষা ক’রে কোন ব্যাধির বীজ বের হত এবং তার প্রতিষেধকও পাওয়া যেত। কিন্তু সে যুগে ইংরেজ ডাক্তারও তার প্রতিকার করতে পারে নি। কুড়ারাণের মৃত্যুর পূর্বে তিনটি মৃত সন্তান প্রসব করেছিলেন। তারপর আরও দুটি মৃত সন্তান প্রসব করেছেন। মধ্যে মধ্যে উন্মাদ হয়েছেন।

অন্তর্বত্নী হলেই তাঁর মস্তিষ্ক অসুস্থ হ’ত। প্রথম হ’ত মেজাজ খারাপ। উগ্র মেজাজ উগ্রতর হত। পাঁচ ছ মাসে তিনি বোবা হয়ে যেতেন। অনবরত ঘুরতেন ঘরের মধ্যে। তারপর প্রায় উন্মাদ। প্রলাপ অসংলগ্ন কথা বলতেন। চাকর-বাকরের লাঞ্ছনার আর সীমা থাকত না। সব থেকে বিপদ হত সোমেশ্বরের। স্বামীকে দেখলে ক্রোধ আক্রোশের আর সীমা থাকত না।

বলতেন—ইচ্ছে করে তোমার বুকে বসে গলাটা টিপে ধরে শেষ ক’রে দি।

দু’তিনবার ধারালো দা দিয়ে তাঁকে কাটতে গিয়েছিলেন। তাকে আটকেছিলেন তাঁর মা সারদা দেবী। সোমেশ্বর পালিয়ে বেঁচেছিলেন। অনেকে বিবাহ করতে পরামর্শ দিয়েছিল তাঁকে কিন্তু তা তিনি করেন নি। কারণ ছিল—–কুড়ারাম মৃত্যুর সময় ছেলেকে প্রতিশ্রুত করিয়ে নিয়েছিলেন—কাত্যায়নী বদ্ধ উন্মাদ হলেও সে যেন বিবাহ না করে। তাঁর শিয়রে তখন ওদিকে বসেছিলেন কাত্যায়নীর মা তাঁর বেয়ান রাণী সারদা দেবী।

সারদা দেবী তখন বিধবা। তিনি কন্যার এই সময় আসতেন কাছে থাকতেন। তিনিই কন্যাকে বলে রাজী করিয়ে তাকে অর্থাৎ কাত্যায়নীকে দিয়েই সোমেশ্বরকে বলিয়েছিলেন, তখন অবশ্য কাত্যায়নীর সুস্থ অবস্থা; বলিয়েছিলেন—দেখ আমার তো এই অবস্থা। তুমি বাড়ীতে তোমার সেবার জন্যে দুটো ভাল ঝি রাখ। মন ভাল রাখতে গানটান শুনবার জন্যে একজন বাঈজী রাখ। নইলে তুমিও যে পাগল হয়ে যাবে।

সোমেশ্বর ঠিক জমিদারবাচ্চা জমিদার ছিলেন না। হতে পারেন নি। তিনি কৌশলী মানুষ ছিলেন, তার সঙ্গে সাহসীও ছিলেন। কিন্তু বেপরোয়া মানুষ ছিলেন না। নইলে নিজেই এসব ব্যবস্থা করতেন। অবশ্য বাঈজী তাঁর ছিল। তবে বাঁধা ছিল না। এখানে ওখানে বাগানে বজরায় আমোদ-আহ্লাদ করতেন।

দু’চারটে খরচ পেয়েছি খাতায়—এসব খাতা সোমেশ্বরের খাস খাতা। তিনি কলকাতায় যে ব্যবসা করতেন অর্থাৎ সায়েবদের মুৎসুদ্দির কাজ করতেন, টাকা লগ্নী করতেন তার জমাখরচের খাতা। সোমেশ্বর একজন সাহেব অ্যাটর্নীর টন্ডি ছিলেন, তাঁকে টাকা ধার দিয়ে তাঁর কেসগুলির থেকে কমিশন পেতেন। তাছাড়া টাকা লগ্নী করেছিলেন নুনের ব্যবসায়ে। মেদিনীপুর কাঁথি অঞ্চলে ‘খালারি’ ইজারা নিয়ে নুন তৈরী করাতেন। নুনের ব্যবসা একচেটে কোম্পানীর, কোম্পানী নুন কিনত। এ ছাড়া রবিনসন সাহেব বলে একজন সাহেব তাদের অঞ্চলে নীলের কুঠী করেছিল, সেই কুঠীতেও তাঁর অনেক টাকা খাটত। জীবনে স্ত্রীকে নিয়ে সুখশান্তির যতই অভাব হোক না কেন, তিনি বাইরের ব্যবসায়ে কাজে মেতে থাকতেন দিনে, সন্ধ্যায় যেতেন বাঈজীবাড়ি। রাত্রে বাড়ি ফিরে ওই ঝিদের সেবায় পরিতুষ্ট হয়ে ঘুমিয়ে যেতেন। উঠতেন বেলা এক প্রহরের সময়। মধ্যে মধ্যে দু’চারদিন দরজায় আঘাত পড়ত। করাঘাত করতেন কাত্যায়নী দেবী। তাঁকে ধরে নিয়ে যেতেন তাঁর মা রাণী সারদা দেবী। কাত্যায়নীর একটা সুস্থ অবস্থাও ছিল। সেটা প্রসবের পর আসত। মৃত সন্তান প্রসব করার পর তিনি কাঁদতে শুরু করতেন এবং পনেরো বিশ দিনের মধ্যে অনেক কান্না কেঁদে বিষণ্ণ প্রতিমার মতো থাকতেন কয়েকদিন, তারপরই হতেন আর এক মানুষ। স্বামীর ঘরে তাঁর বিছানা হত। ঝি-দুটিকে হয় তাড়াতেন, নয় তারা সরে যেত এই বাড়ীর দূরতম প্রাপ্তের একতলার ঘরে। তখন গোটা সংসারটা চলত তাঁর অঙ্গুলিহেলনে। তিনি বাসনের ঘরের বাসনগুলি গুণতেন, কতগুলি হারিয়েছে হিসেব করতেন। আসবাবপত্রও এইভাবে হিসেব করতেন। যা হারাত সেগুলি তৎক্ষণাৎ পূরণ করেও সোমেশ্বরের নিষ্কৃতি ছিল না, কাত্যায়নী তাঁকে দিয়েই চাকর-বাকর, সরকার, নায়েব সকলকে তিরস্কার করিয়ে ছাড়তেন। এবং ডাক্তার-বদ্যি ইত্যাদি ডাকিয়ে সমারোহ জুড়ে দিতেন। মধ্যে মধ্যে স্বপ্ন দেখতেন—কোন দেবস্থলের স্বপ্ন। সেখানে যাওয়ার সাড়া পড়ত।

তারপর একখানা শুধু কালো ছবি। তার মধ্যে সোমেশ্বরের আভাস মাত্র রেখায় ফুটে আছে। কিন্তু ওই দেখ সুলতা—কতকগুলো ঘটনা আঁকা আছে ওই যে ছবিটার প্যানেলে। সোমেশ্বর নিজের জীবনের কোন ঘটনায় মনের কোন ছায়া রেখে যান নি। চিঠি যা পেয়েছি তা ব্যবসায় সংক্রান্ত। যেমন নুনের দেওয়ান দ্বারকানাথ ঠাকুরের চিঠি; পাইকপাড়ার দেওয়ান গঙ্গাগোবিন্দ সিংহের ছেলে—তিনি তখন কোম্পানীর কানুনগো রয়েছেন, তাঁর চিঠি। রবিনসন সাহেবের চিঠি। কীর্তিহাটের প্রধান নায়েবের চিঠি, কালীমাতার পূজকের চিঠি,—তা ছাড়া দুচারজন প্রজা সজ্জনের চিঠি—

মহামহিম মহিমান্বিত শ্রীল শ্রীযুক্ত বাবু সোমেশ্বর রায় জমিদার মহাশয় অশেষ প্রতাপান্বিতেষু।।

হুজুর বরাবর অধীন প্রজার দরখাস্ত এই যে, ইত্যাদি ইত্যাদি। দরখাস্ত তার ঘরের জন্য জোতের মধ্যে একটি তাল গাছ কি শাল গাছ কি তার পুত্রকন্যার বিবাহে পোড়া কাষ্ঠের জন্য একটি বটবৃক্ষের ডাল বা মাতৃশ্রাদ্ধে একটি তিত্তিরী বৃক্ষ কাটবার অনুমতি প্রার্থনা। অথবা একটি ছোট পুষ্করিণী খননের অনুমতি প্রার্থনা। তখন কোম্পানীর সঙ্গে জমিদারের চুক্তি অনুযায়ী জমিদার জমিদারির জলকর ফলকর বনকর, লাহা-মহল, পাতা-মহল, কাঠকয়লা-মহল এমন কি ঊর্ধ্ব অধঃ—সমস্ত কিছুর একছত্র অধিপতি। কন্যার বিবাহে জমিদার প্রণামী পান—তার নাম মারোচা। পিতৃমাতৃশ্রাদ্ধে জলদানের পাত্র, ঘড়ি বা ঘটি কাছারীতে পৌঁছে দিতে হয়।

এর মধ্যে কাত্যায়নী সম্পর্কে কোন কথা নেই। কাউকে সোমেশ্বর রায় লেখেন নি। একবার পোষ্যপুত্র নেওয়ার কথা তুলে—কাত্যায়নীর হাতের কঙ্কণের আঘাতে কপাল কেটে ছিলেন- সে কথা শুনেছি, মেজঠাকুমার কাছে। আর তাঁর ছবিতে দেখছি একটা লম্বা কাটা দাগ। অন্য যারা প্রবীণ তাঁদের কাছেও শুনেছি। কিন্তু কোন নমুদ পাইনি।

জমাখরচের খাতায় মধ্যে মধ্যে পেয়েছি—বিদায়-বকশিশ খাতে খরচ ২৫০ টাকা। শ্রীল শ্রীযুক্ত বাবু সাহেব হুজুর বাহাদুরের খাস ঝিকে বিদায় উপলক্ষ্যে—নগদ বকশিশ—। ২৫০ টাকাই উচ্চতম বকশিশ নয়। নিম্নতম। উচ্চতম বকশিশ ১০০০ টাকাও আছে। কাত্যায়নী দেবী সুস্থ হলে যে সব খাস ঝিদের বিদায় করা হত—এ বকশিশ তারা পেয়েছে।

দেখ প্যানেলটা দেখ, দেখতে পাবে, পুঁটলি বগলে ক’টি মেয়ে চলে যাচ্ছে।

তারপরই দেখ এই ছবিটা। সে আমলের চৌরঙ্গীর পথে সোমেশ্বর চলেছেন স্ত্রীকে নিয়ে কালীঘাটে! এ ঘটনার গল্প রায়বংশে সুপ্রচলিত এবং সুপ্রসিদ্ধ। রায়-বংশের গল্প উঠলেই স্মৃতিপথে এসে যায়। রায়-বংশের ছেলেমেয়ে—সে আধুনিকই হোক আর প্রতিক্রিয়াশীলই হোক—শুনেছে, জানে এবং মানেও। ঘটনার যে শেকল একটার সঙ্গে একটাকে গেঁথে কার্য এবং কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা টেনে নিয়ে যায় তার মাঝখানে এক একটা ঘটনা আকস্মিকভাবে ঘটে থাকে। যেন হঠাৎ একটা বাইরের আংটা কোন এক অদৃশ্য চুম্বকের টানে ছুটে এসে শেকলটার প্রান্তে জুড়ে যায়। এও তাই।

বহুশ্রুত ঘটনাটি এই। কালীঘাট সোমেশ্বরের মামার বাড়ী। কুড়ারাম রায় ভট্টাচার্য তাঁর আমলে এই মধ্যবিত্ত গৃহস্থ পরিবারটিকে সাহায্য করে নানান সুযোগ-সুবিধা পাইয়ে দিয়ে তাঁদের বর্ধিষ্ণু করে তুলেছিলেন। তাঁরা অনুগত ছিলেন এবং সত্যকার হিতৈষী ছিলেন। সোমেশ্বর ও বাল্যকালে কিছুদিন মাতুলালয়ে থাকতেন যখন কুড়ারাম বিদেশে বা মফঃস্বলে যেতেন তখন। সোমেশ্বরও ভালবাসতেন তাঁদের।

একদিন তাঁর মামাতো ভাই এসে খবর দিয়ে গেল, কালীঘাটে এক তান্ত্রিক এসেছে। ক’দিন আগে আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছে। তান্ত্রিক আধপাগলা—।

মামাতো ভাই হরপ্রসাদ চাটুজ্জে বলেছিল—তান্ত্রিকরা আধপাগলা হয়। মুখখারাপ হয়। অনেকে গাইয়েও হয়। লোকটা আশ্চর্য গাইয়ে। গাইয়ে বাজিয়ে সব যন্ত্র বাজাতে পারে; প্রথম যখন কালীঘাটের শ্মশানে আসে তখন একটু সুস্থ ছিল—মধ্যে মধ্যে গান বাজনার আসর বসলে জয় কালী বলে এসে ঢুকে বসত। বলত—আমাকে একটু বাজাতে দেবে? কখনও বলত—গাইতে দেবে? দিত, সবাই—সে অদ্ভুত ব্যাপার। লোকে একটু ভালটাল বাসত। মধ্যে মধ্যে মার খেতো। লোকে মারত। বলত-মেয়েদের দিকে নাকি ড্যাব ড্যাব করে তাকায়। পলক পড়ে না। এক একজনের কাছে এসে তার মুখের কাছে মুখ এনে বলে- তুমি সেই বটে?—বেশ কয়েকদিন মার খেয়েছে। কিন্তু এর বেশী কিছু নয়। কিন্তু ভাই এই দশদিন আগে জোয়ারে একটা যুবতী মেয়ের দেহ ভেসে এসেছিল। একাদশীর জোয়ার। সেদিন জোয়ারটা বেশী। মাঝখানে দেহটা ভেসে চলছিল—একবার ডুবছিল একবার উঠছিল। চোখে পড়েছিল সবারই কিন্তু তান্ত্রিক জয় কালী বলে জলে ঝাঁপ

জলে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল। তুফান-জোয়ার—তারই মধ্যে থেকে সে দেহটা টেনে এনে তুললে। টাটকা মড়া। রূপসী একেবারে বোধ হয় ষোড়শী মেয়ে। সকলে জিজ্ঞেস করলে—কি করবে! বললে—আসন করে সাধন করব। সামনে পরশু চতুর্দশী পরের দিন অমাবস্যে। তারপর তাই চলে গেল নিবিড় জঙ্গলের মধ্যে। লোকে ভেবেছিল বাঘে খাবে। নয়তো মড়ার লোভে শেয়াল এসে ওকে সুদ্ধ ছিঁড়বে। তিনদিন কেউ দেখেনি। চারদিনের দিন নৌকোর মাঝিরা দেখতে পেয়েছিল। পাড় থেকে গড়িয়ে ভাঁটার কাদার ওপর পড়ে আছে অজ্ঞান হয়ে। তুলে এনে মন্দিরের ঘাটে নামিয়ে দিয়েছিল। জ্ঞান হয়ে লোকটা ক’দিন হয়ে গিয়েছিল ঘোর উন্মাদ। কেবল চেঁচাতো—ফেলে দিলি! ফেলে দিলি! দে―! আর খিস্তি গালাগালি। এখন শান্ত হয়েছে। লোকে বলছে সিদ্ধ হয়ে গেছে লোকটা। তা ছাড়া এখন শুনেছি লোকটা অনেকজনকে অনেক ওষুধ—মানে জঙ্গল থেকে লতাপাতা ছিঁড়ে এনে হাতে দলে দেয়, ভাল হয়ে যায়। কটি বাঁজা মেয়েরও সন্তান হবে শুনেছি ওর ওষুধে। যাবে একবার বউমাকে নিয়ে?

সেই চলেছেন সোমেশ্বর ওই দেখ।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress