Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » কীর্তিহাটের কড়চা || Tarashankar Bandyopadhyay

কীর্তিহাটের কড়চা || Tarashankar Bandyopadhyay

১৯৫৩ সালের ২৫ শে নভেম্বর। রাত্রি তখন দশটা।

মধ্য কলকাতায় জানবাজার। রানী রাসমণির ঐতিহাসিক স্মৃতিজড়িত বিরাট বাড়ীখানির অনতিদূরে আর একখানা বড় বাড়ি। পুরনো কালের বাড়ী। এখানে এ বাড়ীখানাও এককালে সুপরিচিত ছিল। নাম ছিল রায়কুঠী। গত আঠাশ বৎসরে বাড়ীখানা গৌরব হারিয়েছে। পনেরো বৎসরে বাড়ীখানা স্বামী-পরিত্যক্তার মতো ম্রিয়মাণ এবং যেন নিজের পরিচয় গোপন করে বেঁচে আছে।

এই বাড়ির সামনের দিকে যে পুরনো কালের সওয়াশো ফুট লম্বা এবং পনের ফুট চওড়া দীর্ঘ বারান্দাটা ঘিরে বড় কাচের জানালা দিয়ে আধুনিককালের আমেজ এনে—ঘরে বা হলে পরিণত করা হয়েছে—সেই হলটায় উজ্জ্বল আলোর সারি জ্বলছিল। শীতকালের রাত্রি দশটায় কাচের জানালাগুলো বন্ধ কিন্তু কাচে সেই আলো প্রতিফলিত হয়ে ঘোষণা করছিল—এতকাল পরে আমি জেগেছি, সেজেছি।

ঘরটায় বা ওই হলটায় মুখোমুখি বসে ছিল সুরেশ্বর রায় আর সুলতা ঘোষ। সুলতা অবাক হয়ে হলটার দেওয়ালে টাঙ্গানো সারিবন্দী ছবির দিকে তাকিয়ে ছিল। উজ্জ্বল আলোর ছটায় তার মুখে-চোখে ফুটে ওঠা প্রশংসা এবং বিস্ময় গোপন ছিল না।

ছবিগুলি সুরেশ্বরেরই আঁকা। বাড়িখানাও সুরেশ্বরের। শিল্পী হিসাবে সুরেশ্বর আঠারো বছর আগে খ্যাতি অর্জন করেছিল। শুধু স্বদেশে নয়, বিদেশেও। তবে পাগল বা বিকৃতমস্তিষ্ক বা অতি খেয়ালী বেপরোয়া বিদ্রোহী বলত লোকে; যার যেমন ইচ্ছে। আঠারো বছর আগে মানে—১৯৩৫ সাল। যুগটাই বিদ্রোহের। কাজী নজরুলের বিদ্রোহী কবিতার সেই বিধাতার বুকে লাথি মারার আস্ফালন করা বিদ্রোহীদের একজন। সৃষ্টির মধ্যেও তার পরিচয় ছিল ছবির দুর্বোধ্যতায়। আঠারো বছর আগে—সে সুলতার সঙ্গে অন্তরঙ্গ হয়ে উঠেছিল; সুলতা তখন বি.এ. পরীক্ষা দেবে। এই সময়েই সুরেশ্বর হঠাৎ কলকাতা ছেড়ে অজ্ঞাতবাসে ডুব মেরেছিল; সুলতার সঙ্গে অন্তরঙ্গতায়, তার সম্ভাবনাপূর্ণ শিল্পীজীবনে, কলকাতার স্বচ্ছন্দ এবং উত্তেজনাময় জীবনে সব কিছুতে ছেদ টেনে।

আঠারো বছর পরে আবার তাদের দেখা। এ সম্পর্কে সুরেশ্বর সম্বন্ধে অনেক কথা উঠে—মিলিয়ে গিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেছে। ধ্বনি প্রতিহত হলেই প্রতিধ্বনি তোলে। না হলে ছড়িয়ে মিলিয়ে যায়। অপবাদের প্রতিবাদ না হলে পঞ্চতলের বায়ু-কণাগুলি বুদবুদ তুলে বাতাসে মিশে যায়—জলের তলায় পাঁক থিতিয়ে পড়ে। সুরেশ্বরের বেলায়ও তাই হয়েছে। লোকে বলেছে—সুলতাও বিশ্বাস করেছে, কীর্তিহাটের জমিদারপুত্রটি ও খেয়ালী শিল্পীটি—দুই সত্তাকে মিলিয়ে কীর্তিহাটের জমিদারির পঙ্কপম্বলে—মহিষ ও বরাহ এই দুই জন্তুর মিশ্রণে একটি অভিনব জন্তুতে পরিণত হয়ে কণ্ঠ ডুবিয়ে পঙ্করস পান করছে এবং সেই পঙ্কে গড়াগড়ি খাচ্ছে।

সুলতা এখন অধ্যাপিকা। ছাত্রী হিসেবে সে কৃতী ছাত্রী ছিল। এম.এ.-তে অর্থনীতি শাস্ত্রে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে অধ্যাপিকা হিসেবে চাকরি নিয়ে তার সঙ্গে রাজনীতির মন্ত্রদীক্ষা নিয়ে বেশ আনন্দ এবং উৎসাহের সঙ্গেই কাল কাটাচ্ছিল।

হঠাৎ এতকাল পরে দেখা।

সারি সারি ছবিগুলির দিকে তাকিয়ে সুলতা দেখছিল আর ভাবছিল—না, জমিদার-সন্তান সুরেশ্বর মহিষ বা বরাহ যা-ই হোক—তার ভিতরের শিল্পী তো মরেনি।

ছবিগুলি সুন্দর। সুন্দর ছবি। এদিক থেকে ওদিক পর্যন্ত চোখ বুলালেই ধরা পড়ে—ছবিগুলির ধারা এক নয়। বর্ণবিন্যাসে রেখার ভঙ্গিতে নানান বৈচিত্র্য। টেকনিকও এক নয়। কিন্তু ছবিগুলির বিষয়বস্তুতে একটা ধারাবাহিকতা আছে। পরিবেশ যেন এক। নদী বন গ্রাম। এক নদী এক

বন এক গ্রাম। মানুষও আছে। তারাও যেন—অনেকে বার বার ঘুরে ঘুরে এসেছে। রঙ-এর বিন্যাস ভারী সুন্দরী চোখকে যেন ভরে দেয়।

সুরেশ্বরের দিকে সে আবার তাকালে। না, শিল্পী সুরেশ্বর তো মরে নি। এই এত ছবি সে এঁকেছে! সেই গ্রামে বসে—জমিদারী করতে করতে। চোখে একটা পরিবর্তন পড়ছে। স্পষ্ট পরিবর্তন। সেই খেয়ালী ঝড়ের মত দূরস্ত লোক তো নয়। এ যেন শ্রান্ত শান্ত।

হঠাৎ সুরেশ্বর একটা ছড়ি দিয়ে প্রথম ছবিখানার ফ্রেমে ঠেকিয়ে বললে—এই আমার প্রথম ছবি। কংসাবতী বারিবিধৌততট বনচ্ছায়াশীতল কীর্তিহাট নামক গ্রাম। সেই গ্রামের পারমানেন্ট সেটেলমেন্টের দৌলতে যিনি প্রথম জমিদার- তাঁর নাম সোমেশ্বর রায়। তিনি বিবাহ করে গ্রামে প্রবেশ করছেন।

ছবি একখানি গ্রাম্য পথের। তবে গোটা গ্রামের আভাস আছে। নদী আছে—বন আছে—গ্রাম আছে পটভূমিতে—ছবির সম্মুখে গ্রাম্যপথ, সেই পথের উপর একখানা পাল্কী। পাল্কীর ভিতরে বর আর বধু—বরের হাতে একখানা গুটানো কাগজ। পিছনে গ্রাম্য নরনারী।

সুরেশ্বর বললে—ভদ্রমহিলা ভদ্রমহোদয়গণ—

সুলতা চমকাল এবার।—ভদ্রমহিলা ভদ্রমহোদয়গণ? কি বলছে সুরেশ্বর? সুরেশ্বরের দৃষ্টিও কেমন কেমন হয়ে গেছে।—পাগল?

সুরেশ্বর সামলে নিলে নিজেকে। বললে—না, আমার ভুল হয়েছে। এখানে তো তুমি একা সুলতা-! কিন্তু আমার মনে হল কি জান? এই রকম হয়।

—হ্যাঁ হয়।

শঙ্কিত হল সুলতা।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41
Pages ( 1 of 41 ): 1 23 ... 41পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress