রামায়ণ : কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ড – বালির বিক্রম ও দুন্দুভি বধ
শ্রীরাম বলেন, মিত্র পড়েছ সঙ্কটে।
কেমন সাহসে থাক দেশের নিকটে।।
সুগ্রীব কহেন কথা শ্রীরামের পাশ।
ঋষ্যমূক পর্ব্বতের শুন ইতিহাস।।
মায়াবীর কনিষ্ঠ সে দুন্দুভি মহিষ।
অগ্রজের বার্ত্তা শুনি ক্রুদ্ধ অহর্নিশ।।
বিক্রমে মহিষাসুর, কারে নাহি গণে।
সমুদ্রে হাঁকারে গিয়া যুঝিবারে মনে।।
সমুদ্র বলিল মম যুদ্ধ নাহি আসে।
যাহ হিমালয়াচল রণের উদ্দেশে।।
হিমালয় পর্ব্বত শঙ্করের শ্বশুর।
তাঁর ঠাঁই গেলে তব দর্প হবে চূর।।
ধনুকের গুণেতে যেমন বাণ ছোটে।
চক্ষুর নিমিষে গেল পর্ব্বত নিকটে।।
শৃঙ্গাঘাতে পর্ব্বতের করে খান খান।
চিন্তিত হইয়া গিরি করে অনুমান।।
পর্ব্বত জানিল তবে চিন্তিয়া সংসার।
যাহাতে মহিষাসুর হইবে সংহার।।
বলিল মহিষাসুরে তুমি মহাবলী।
কিষ্কিন্ধ্যায় যাহ তুমি যথা আছে বালি।।
বল বুদ্ধি চূর্ণ হবে শুন উপদেশ।
বালির মধুর বনে করহ প্রবেশ।।
রাজভোগ মধুবন রাজার ভাণ্ডার।
বন ভাঙ্গি মধু খায়ে করহ সংহার।।
বালিরাজা না সহিবে মধু অপচয়।
প্রাণেতে মারিবে তোরে বালি মহাশয়।।
তোর জ্যেষ্ঠ মায়াবী ছিল যে মহাবলী।
তাহারে মারিল সে বানররাজা বালি।।
শুনিয়া জ্যেষ্ঠের কথা কুপিত অন্তরে।
তখনি চলিল বালি ভূপতির পুরে।।
শৃঙ্গাঘাতে করিল কানন খণ্ড খণ্ড।
কুপিত হইল বালি সংগ্রামে প্রচণ্ড।।
বীরধড়া পরে বীর কাঁকালি বেড়িয়া।
দ্বিগুণ ইন্দ্রের মালা পরিল তুলিয়া।।
স্ত্রীগণ বেষ্টিত বালি আইল নির্ভয়।
তারাগণ মধ্যে যেন চন্দ্রের উদয়।।
রুষিল মহিষাসুর আরক্ত লোচন।
স্ত্রীগণ সম্মুখে করে তর্জ্জন গর্জ্জন।।
মধুপানে মত্ত তুমি ঘূর্ণিত লোচন।
মত্তজন মারি, নাহি মোর প্রয়োজন।।
প্রাণদান দিনু তোরে আজিকার তরে।
আজি রাত্রি বঞ্চ গিয়া কৌতুক শৃঙ্গারে।।
সুখে রাত্রি বঞ্চ গিয়া প্রত্যূষ বিহানে।
বল বুদ্ধি চূর্ণ করি বধিব পরাণে।।
স্ত্রীগণেরে বালি পাঠাইল অন্তঃপুর।
বীরদাপকরি বলে শুনরে অসুর।।
রণে প্রবেশিলে বুঝি রণের পরীক্ষা।
পড়িলে বালির হাতে তোর নাহি রক্ষা।।
যমরাজা যদি ধরে, আছে প্রতিকার।
বালির স্থানেতে কার নাহিক নিস্তার।।
স্বর্গ মর্ত্ত্য পাতালের যতেক বীরগণ।
আইলে আমার যুদ্ধে অবশ্য মরণ।।
কপটে বাঁচিতে চাহ কালিকার তরে।
সে কথা থাকুক, আজি যাও যমঘরে।।
কুবুদ্ধি পাইল তোর, মোর সঙ্গে রণ।
তোর দোষ নাহি তোর ললাট-লিখন।।
পলাইয়া যারে তুই লইয়া পরাণ।
আজিকার দিবস দিলাম প্রাণদান।।
কোপেতে মহিষাসুর কাঁপে থর থর।
পুনশ্চ বলিছে তারে বালি কপীশ্বর।।
আগে মোরে তান তোর বুঝিব বিক্রম।
তোর ঘা সহিয়া তোরে দেখাইব যম।।
যত তোর শক্তি থাকে, তত শক্তি হান।
এই দণ্ডে আমি তোর বধিব পরাণ।।
রুষিয়া দুন্দুভি দৈত্য দুই শৃঙ্গ মারে।
খান খান করিয়া বালির অঙ্গ চিরে।।
সর্ব্বাঙ্গ বিদীর্ণ বালি, তবু নাহি হটে।
অশোক কিংশুক যেন বসন্তেতে ফুটে।।
মহিষ বালির সঙ্গে যুঝে চমৎকার।
পাদপ পাথরে বালি করে মহামার।।
মারে গাছ পাথর সে মহিষ উপর।
পরাভব নহে দৈত্য, যুঝে নিরন্তর।।
দুই শৃঙ্গ বালি তোর ধরিলেক রোষে।
শৃঙ্গ ধরি মহিষেরে তুলিল আকাশে।।
দুই শৃঙ্গ ধরি তার ঘন দেয় পাক।
ঘন পাকে ফিরে যেন কুমারের চাক।।
পাথর উপরে তারে মারিল আছাড়।
ভাঙ্গিল মাথার খুলি, চূর্ণ হৈল হাড়।।
পড়িল মহিষাসুর হয়ে অচেতন।
পদাঘাতে ফেলে তারে একটি যোজন।।
চতুর্দ্দিকে ছড়াইয়া রক্ত পড়ে স্রোতে।
মতঙ্গ মুনির গাত্র তিতিল রক্তেতে।।
মুনি বলে, কোন্ বেটা করিল এমন।
গায়ে রক্ত দেয় যে সে পাপিষ্ঠ কেমন।।
রক্ত প্রক্ষালিয়া করিলেন আচমন।
পবিত্র হইলা মুনি স্মরি নারায়ণ।।
মহাক্রোধ করি মুনি জল নিল হাত।
অভিশাপ দিল তারে হইয়া কুপিত।।
মুনি বলে, হেন কর্ম্ম করিল যে জন।
এ পর্ব্বতে আইলে তার অবশ্য মরণ।।
পরম্পরা শুনে বালি শাপবাক্য তাঁর।
দূর হৈতে মুনি-পদে করে নমস্কার।।
দূরে থাকি মুনিস্থানে যাচে পরিহার।
সঙ্কট-সাগরে প্রভু করহ নিস্তার।।
মতঙ্গ বলেন মম শাপ অখণ্ডন।
এ পর্ব্বত কভু তুমি না কর গমন।।
সেই শাপে বালি না আইসে ঋষ্যমূকে।
দেশ দেশান্তরে থাকি শুনি লোকমুখে।।
ঋষ্যমূকে আইলে সে হারাবে পরাণ।
বালিকে মুনির শাপ তেঁই মম ত্রাণ।।
শ্রীরাম বলেন, মিত্র কহিলে সকল।
বালিকে মারিয়া করি তোমাকে প্রবল।।
সুগ্রীব বলেন, বালি বিক্রম-সাগর।
বালির বিক্রম-কথা শুন রঘুবর।।
যকন রজনী যায়, অরুণ-উদয়।
চারি সাগরেতে সন্ধ্যা করে মহাশয়।।
আকাশে তুলিয়া ফেলে পর্ব্বত-শিখর।
দুই হাতে লোফে তাহা বালি কপীশ্বর।।
উপাড়িয়া পর্ব্বত আকাশোপরি ফেলে।
আপনারে পরীক্ষিতে নিত্য লোফে বলে।।
সপ্তদ্বীপা পৃথিবী সে নিমিষে বেড়ায়।
কি কব পবন তার সঙ্গে না গোড়ায়।।
বালিকে মারিতে যদি না পার এক বাণে।
তবে বালিরাজা মোরে বধিবে পরাণে।।
মহাবীর বালিরাজা এ তিন বুবনে।
পরাভব পায় সর্ব্ব বীর তার রণে।।