রামায়ণ : কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ড – সীতা উদ্ধারের জন্য সুগ্রীবের প্রতি তাড়না
বরিষা হইল গত, শরৎ প্রবেশ।
তথাপি না হইল জানকীর উদ্দেশ।।
ভেকের নিনাদ গেল, মেঘের গর্জ্জন।
নির্ম্মল চন্দ্রমা তারা প্রকাশে গগন।।
মন প্রাণ স্থির নহে সীতার লাগিয়ে।
মরিলেন সীতা বুঝি, দিন গেল বয়ে।।
কি করিবে ভাই তুমি, কি করিবে মিতে।
সব অন্ধকার মোর সীতার মৃত্যুতে।।
স্ত্রী পুরুষ দুই জনে ধরেছে সংসার।
ভার্য্যাতে সন্ততি হয়, বাড়ে পরিবার।।
স্ত্রী থাকিলে পুত্র হয় সংসারের সার।
পুত্র না হইলে তার গতি নাহি আর।।
পিণ্ড দেয় গয়ায় সে, করয়ে তর্পণ।
সংসারের মধ্যে ভাই পুত্র বড় ধন।।
স্ত্রী পুত্র পরিবার কেহ নহে ছাড়া।
পুত্র না থাকিলে লোক বল আঁটকুড়া।।
তার মুখ দেখি যেবা শ্রাদ্ধ করিতে যায়।
শ্রাদ্ধক্রিয়া বৃথা তার, শাস্ত্রে হেন কয়।।
অতএব শুন ভাই ভার্য্যা বড় ধন।
তাহাতে সন্ততি হয় সংসার পালন।।
জ্ঞাতি বন্ধু সহোদর মরে যত লোক।
সবার অধিক ভাই স্ত্রীর বড় শোক।।
সুগ্রীব আমাকে নাহি ভাবে, সে নির্দ্দয়।
স্ত্রী পাইয়া কেলি করে আপন আলয়।।
তাহার লাগিয়া আমি মারিলাম বালি।
আমাকে না স্মরে কপি রাজ্যভোগে ভুলি।।
বালিকে বধিয়া অতি পাইলাম লাজ।
ধর্ম্মাধর্ম্ম না ভাবিয়া সাধি তার কাজ।।
কিষ্কিন্ধ্যা পাইল কপি আমার কারণে।
এখন আমার কর্ম্ম নাহি করে মনে।।
এইক্ষণে যাও ভাই কিষ্কিন্ধ্যানগর।
সমক্ষে বলিবে তারে উচিত উত্তর।।
লক্ষ্মণ বলেন, যাই কিষ্কিন্ধ্যানগরে।
দেখিব কেমন আজি সুগ্রীব বানরে।।
জ্ঞাতি বন্ধু তাহার কুটুম্ব যত আর।
পাঠাইব সবাকারে শমনের দ্বার।।
নিশ্চিন্ত বসিয়া আছে আপনা না চিনে।
সুগ্রীবে মারিয়া আজি পাড়ি এক বাণে।।
তুমি প্রভু রঘুনাথ বেড়াও কান্দিয়া।
কৌতুকে সুগ্রীব থাকে পালঙ্কে শুইয়া।।
বুঝাইয়া লক্ষ্মণে কহেন রঘুবর।
মিত্রবধ না করিও, দেখাইও ডর।।
লক্ষ্মণ বিদায় হয় শ্রীরামের স্থান।
বাম হস্তে ধনুক, দক্ষিণ হস্তে বাণ।।
মহাকোপে চলিলেন ঘূর্ণিত লোচন।
স্বর্গ মর্ত্ত্য পাতাল কাঁপিল ত্রিভুবন।।
কিষ্কিন্ধ্যানগর-পথে যান রড়ারড়ি।
গায়ের বাতাসে গাছ করে জড়াজড়ি।।
কিষ্কিন্ধ্যানগরে বীর হয়ে উপনীত।
দ্বারে দেখে অঙ্গদের কটক-বেষ্টিত।।
লক্ষ্মণের কোপ দেখি হইয়া ফাঁফর।
প্রণতি করিল তাঁরে সকল বানর।।
হইলেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বানর অস্থির।
লাফে লাফে হয় তারা প্রাচীর বাহির।।
লক্ষ্মণ বলেন, শুন বালির নন্দন।
সুগ্রীবের জানাও আমার আগমন।।
বনে বনে ভ্রমিতেছি আমরা কান্দিয়া।
সুগ্রীব থাকেন সিংহাসনেতে শুইয়া।।
সীতা লাগি দুই ভাই ভ্রমি বনে বনে।
নিশ্চিত আছেন তিনি রত্ন-সিংহাসনে।।
বালিকে মারিয়া রাম দিলেন রাজত্ব।
সুগ্রীব পাইয়া রাজ্য হইয়াছে মত্ত।।
অতি দুষ্ট মিষ্ট বাক্যে আসে আশ্বাসিয়া।
কোন্ লাজে থাকে ঘরে নিশ্চিন্ত বসিয়া।।
পিঁপিড়ার পাখা উঠে মরিবার তরে।
রাজ্য সহ পোড়াইব আজি এক শরে।।
সাহায্য করিতে আগে করিয়া স্বীকার।
এখন না মনে করে তাহা একবার।।
বালি ভয়ে অতি ভীত বেড়াইত বনে।
সে সকল সুগ্রীবের নাহি কিছু মনে।।
সুগ্রীবের কহ গিয়া এই সমাচার।
রামের অনুজ ভাই আসিয়াছে দ্বার।।
মারিলেন যে রাম বালিকে অনায়াসে।
সুগ্রীব তাঁহারে তুচ্ছ করে কি সাহসে।।
পশুজাতি বানর, সুগ্রীব দুরাচারী।
তাহাকে বলেন মিত্র আপনি মুরারি।।
আপনি শ্রীরঘুনাথ দয়ার সাগর।
তাঁর যোগ্য মিত্র কি এ সুগ্রীব বানর।।
কত যোগী জিতেন্দ্রিয় মুনি ব্রহ্ম-ঋষি।
অনাহারে কত জপ করে দিবানিশি।।
হেন রাম কোল দেন সুগ্রীব বানরে।
সুগ্রীবের কত পুণ্য ছিল জন্মান্তরে।।
অঙ্গদ বলেন, শুন ঠাকুর লক্ষ্মণ।
স্থির হও মহাশয় করি নিবেদন।।
পাদ্য অর্ঘ্য দিল তাঁরে বসিতে আসন।
যোড়হাতে স্তুতি করে বালির নন্দন।।
লক্ষ্মণের কোপ দেখি বড় ভয় মনে।
অন্তঃপুর মধ্যে যায় পরম সম্ভ্রমে।।
সুগ্রীবে প্রণমি বন্দে মায়ের চরণ।
যোড়হাতে বলে, প্রভু দ্বারেতে লক্ষ্মণ।।
ঘূর্ণিত লোচন রাজা শৃঙ্গারের মদে।
শোভা পায় শরীর কুঙ্কুম মৃগমদে।।
কামরসে বিহ্বল সুগ্রীব অন্য মন।
কিছু নাহি শুনিল অঙ্গদের বচন।।
জাগাইতে রাজারে করিল পাঁচাপাঁচি।
অনেক বানর মেলি করে কিচিমিচি।।
বানরের কোলাহল হইলেক দ্বারে।
কার সাধ্য স্থির থাকে এ ঘোর চীৎকার।।
শব্দ শুনি সুগ্রীব শয্যা ছাড়িয়া উঠয়।
পাত্র মিত্র দেখি রাজা ক্রোধভরে কয়।।
অন্তঃপুরে গোল কেন কর ঘোরতর।
অঙ্গদ সম্মুখে গিয়া করিছে উত্তর।।
পাঠাইয়াছেন রাম আপন ভ্রাতারে।
সুমিত্রা-নন্দন বীর উপস্থিত দ্বারে।।
মহাকোপান্বিত দেখি ঠাকুর লক্ষ্মণ।
বলিব কতেক, যত করিল ভৎসন।।
সাধিলে আপন কর্ম্ম করিয়া মিত্রতা।
রামের কর্ম্মের কালে করিলে খলতা।।
সুগ্রীব বলেন, রাম করিয়া মিতালি।
পাঠাইয়া লক্ষ্মণেরে দেন গালাগালি।।
অপরাধ নাহি করি, কারে মোর ডর।
কেন কোপ করেন লক্ষ্মণ ধনুর্দ্ধর।।
করিয়াছি মিত্রতা, সে নহে অপ্রমাণ।
রাখিবারে মিত্রতা কি হারাইব প্রাণ।।
ত্রিলোক-বিজয়ী সে রাবণ মহাবীর।
যাহার ভয়েতে যত দেবতা অস্থির।।
তাহার সহিত যুদ্ধে নর কি বানর।
আসিবেক পুনঃ প্রাণ লইয়া কি ঘর।।
এখন ফিরিয়া যাউন স্বস্থানে লক্ষ্মণ।
আগু পাছু যাহা হবে বলিব তখন।।
মহামন্ত্রী হনুমান অতি তীক্ষ্মমতি।
কহেন হিতোপদেশ সুগ্রীবের প্রতি।।
স্বয়ং বিষ্ণু রমানাথ কমললোচন।
হেন বাক্য বল কেন, না বুঝি কারণ।।
যাঁহার প্রসাদে তুমি পাইলে রাজত্ব।
তাঁহাকে এমত বল, হয়েছ কি মত্ত।।
রাত্রিদিন কর তুমি শৃঙ্গার-বিলাস।
না দেখ রামের দুঃখ, নাহি যাও পাশ।।
কুপিত লক্ষ্মণ বীর আইলেন দ্বারে।
অবিলম্বে যাও রাজা, সাধ গিয়া তাঁরে।।
যাঁর বাণে ত্রিভুবনে কেন নাহি আঁটে।
তাঁর আজ্ঞা না মানিলে পড়িবে সঙ্কটে।।
আমি তব মন্ত্রী যেই শুন মহাশয়।
হিত উপদেশ বলি হইয়া নির্ভয়।।
বালি হেন মহাবীর পড়ে যাঁর বাণে।
তাঁহার শরণ লও, বাঁচিবে পরাণে।।
রামের দুর্দ্দশা শুনি বুক হয় চির।
শোকেতে কাতর অতি, নহেন সুস্থির।।
পরমা সুন্দরী লৈয়া ঘরে কর ক্রীড়া।
রাজভোগে মত্ত থাক, নাহি হয় ব্রীড়া।।
রাবণের ভয়ে যদি রামেরে ছাড়িবে।
লক্ষ্মণেরে হাতে তুমি কেমনে বাঁচিবে।।
রাবণ ভয়ে যদি রামেরে ছাড়িবে।
লক্ষ্মণের হাতে তুমি কেমনে বাঁচিবে।।
রাবণ সাগর পারে, দ্বারেতে লক্ষ্মণ।
লক্ষ্মণের বাণাগ্নিতে মরিবে এখন।।
লক্ষ্মণের বাণে কার নাহিক নিস্তার।
বধিতে বানরগণে কি তাঁহার ভার।।
আমার বচন রাখ, হবে তব হিত।
রামের শরণ লহ, নহে বিপরীত।।
সত্য করিয়াছ তুমি অগ্নি সাক্ষী করি।
শ্রীরামের কার্য্য কর, চল ত্বরা করি।।
সত্যবাদী লোকে করে সত্যের পালন।
সত্যের কারণে রাম আইলেন বন।।
যেই রাম আইলেন সত্য পালিবার।
তেঁই সে রামের বাণে বালিরাজা মরে।।
তেঁই সে পাইলে তুমি ছত্র নবদণ্ড।
তেঁই প্রজাগণ লৈয়া কর রাজ্যখণ্ড।।
চতুর্দ্দশ সহস্র রাক্ষস পড়ে রণে।
যাঁর বাণে, তাঁরে কি সামান্য ভাব মনে।।
ভোগ ছাড়, রাম ভজ পাইবে নিষ্কৃতি।
রঘুনাথ বিনা রাজা আর নাহি গতি।।
হনুমান নিরপেক্ষ সুগ্রীবে সম্ভাষে।
মধুর বচনে রাজা হনুমানে তোষে।।
লক্ষ্মণেরে আনাইতে করিল আদেশ।
লক্ষ্মণ ভিতর গড়ে করেন প্রবেশ।।
ইন্দ্রপুরী সমান দেখেন দিব্য পুরী।
দেখিয়া বানরী-সজ্জা লজ্জা পায় সুরী।।
চতুর্দ্দিকে অট্টালিকা শোভিত প্রচুর।
চলিলেন লক্ষ্মণ দেখিয়া অন্তঃপুর।।
গেলেন লক্ষ্মণ বীর ভিতর আবাসে।
লক্ষ্মণের কোপ দেখি বানর তরাসে।।
দেখিয়া সুগ্রীব রাজা উঠিল সম্ভ্রমে।
ডাহিনে উঠিল তারা, উমা উঠে বামে।।
যোড়হাতে লক্ষ্মণেরে করিল স্তবন।
পাদ্য অর্য্য দিল রাজা বসিতে আসন।।
কুপিত লক্ষ্মণ বীর না লয় আসন।
সুগ্রীবের কহিলেন আরক্ত নয়ন।।
তুমি যে করিলে সত্য অগ্নি সাক্ষী করি।
উদ্ধারিতে নিজ কার্য্য করিলে চাতুরী।।
রাত্রি দিন ক্লেশ পাই দুই ভাই বনে।
বারেক না কর তত্ত্ব, মত্ত রাত্রি দিনে।।
পাইলে কাহার গুণে কিষ্কিন্ধ্যানগরী।
পাইলে হে কার গুণে তারা কৃশোদরী।।
পাইলে কাহার গুণে উমা নিজ নারী।
কাহার প্রসাদে তুমি রাজ্য-অধিকারী।।
সরল হৃদয় রাম, তুমি হে নিষ্ঠুর।
সাধিলে আপন কার্য্য সত্য করি দূর।।
তোমার মিত্রতা হেন ত্রিভুবনে থাকে।
আর যেন হেনকর্ম্ম নাহি করে লোকে।।
তোরে মারি অঙ্গদেরে দিব রাজ্যভার।
অঙ্গদ হইতে হবে সীতার উদ্ধার।।
অধর্ম্মী বানর রে লঙ্ঘিলি সত্যপথ।
দেখ ধনুর্ব্বাণ, পূর্ণ করি মনোরথ।।
এক বাণে মারি তোরে রাখে কোন্ জনে।
খণ্ড খণ্ড কিষ্কিন্ধ্যা করিব আজি বাণে।।
বাণে কাটি সবারে করিব খণ্ড খণ্ড।
অঙ্গদের উপরে ধরাব ছত্রদণ্ড।।
বালি-বধে শুনিয়াছ ধনুক টঙ্কার।
সেই ধনু সেই বাণে করিব সংহার।।
বালি রাজা কেবল মরিল একজন।
তোর মরণেতে মরিবেক কপিগণ।।
দেখিয়াছ বালি রাজা গেল যেই বাটে।
সেই বাটে থাক গিয়া ভায়ের নিকটে।।
মারিব অধর্ম্মী তোরে, তাহে নাহি পাপ।
হের বাণ এড়ি এই, দেখহ প্রতাপ।।
প্রাণ লব আজি তোর বজ্রসম বাণে।
একত্র হ্ইয়া থাক ভাই দুই জনে।।
আরে দুষ্ট বানর পাপিষ্ঠ দুরাচার।
এখনি পাঠাই তোরে দেখ যমদ্বার।।
পৃথিবীতে হেন কার্য্য কে কোথায় করে।
আগে দিয়া ভরসা পশ্চাতে থাকে দূরে।।
রাম মিতা বলিয়া দিলেন কোল তোরে।
কত পুণ্য করেছিলি জন্ম জন্মান্তরে।।
স্বয়ং বিষ্ণু রঘুনাথ করিলেন দয়া।
তেঁই তোরে শ্রীরাম দিলেন পদছায়া।।
গুণের সাগর রাম, দয়ার নাই সন্ধি।
বালি মারি রাজ্য দিল সত্যে হৈয়া বন্দী।।
লক্ষ্মণের মহাক্রোধ বাড়িতে লাগিল।
ত্রাসেতে সুগ্রীব রাজা চিন্তিত হইল।।
ত্বরা করি কাতরা উঠিয়া তারা রাণী।
লক্ষ্মণের পায়ে ধরি বলে মৃদুবাণী।।
জ্যেষ্ঠের হইলে মিত্র হয় সে গর্ব্বিত।
জ্যেষ্ঠের সমান তারে মানিতে উচিত।।
সুগ্রীব রামের মিত্র জগতে বিদিত।
এত তিরস্কার প্রভু না হয় উদিত।।
ক্ষমা কর রাজপুত্র হও তুমি স্থির।
রামকার্য্য করিবে সকল কপি বীর।।
দূরদেশে পর্ব্বতেতে সমুদ্রের পারে।
যেখানে বানর যত আছে এ সংসারে।।
সম্বাদ করিয়া শীঘ্র আনি সে সবারে।
সম্বর সম্বর ক্রোধ লক্ষ্মণ আমারে।।
তথাপি শ্রীলক্ষ্মণের কোপ নাহি টুটে।
বসাইল যত্ন করি তারা স্বর্ণখাটে।।
তারার বিনয়-বাক্যে সুস্থির লক্ষ্মণ।
কৃত্তিবাস বিরচিল গীত রামায়ণ।।