Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » কিছু কিছু সুর আমার ভেতরে ঢোকে না || Humayun Azad

কিছু কিছু সুর আমার ভেতরে ঢোকে না || Humayun Azad

নানান রকম সুর ওঠে চারপাশে। কিছু কিছু সুর গোলগাল,
কিছু সুর চারকোণা, ত্রিভুজ আর সরল রেখার মতো সুর শোনা যায়
কখনো কখনো। সিল্ক, গোলাপপাপড়ি, ধানের অঙ্কুর, গমবীজ,
পেপারওয়েট, ডাস্টবিন, সাঁকো, ইস্ত্রি, বিষণ্ণ বালিকার মতো
সুর ওঠে মাঝে মাঝে। কিছু সুর রক্তাক্ত, অশ্রুসিক্ত, ভেজা, গাদা ফুলের মতোই
অত্যন্ত হলদে, গোলাপের মতো লাল আর পাখির বুকের মতো
কোমল মসৃণ কিছু সুর। প্রথাগতভাবে একটি নির্দিষ্ট ইন্দ্রিয় দিয়ে
আমরা ভেতরে গ্রহণ করি ওইসব স্বরসুর। অর্থাৎ আমরা সুর শুনি।
শোনা একটি অক্রিয় ক্রিয়া–শোনার জন্যে সক্রিয় হতে হয় না
আমাদের। শব্দের সীমার মধ্যে থাকলে শব্দ নিজেই সংক্রামিত হয়ে
যায় আমাদের রক্তের ভেতরে। তবে কিছু কিছু সুর আমার ভেতরে
ঢোকে না। তা ছাড়া আমি শুধু শ্রুতি দিয়ে শুনি না সর্বদা। চোখ দিয়ে
আমি নিয়মিত সুর শুনি–সূর্যাস্তের চেয়েও রঙিন তরুণীদের চিবুক,
ওষ্ঠ থেকে যে-সুর বেরিয়ে আসে, তা শোনার জন্যে আমার অজস্র
চোখ আছে। কাউকে নিবিড়ভাবে ছুঁলে শোনা যায় শোনা-অসম্ভব
স্বরসুর, ওই সুর এতো উচ্চ, এতো তীব্র, এতো দীর্ঘ, এতোই রঙিন
আর গভীর যে ওই সুর কান দিয়ে শোনার চেষ্টা করলে কানের পর্দা
ফেটে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। শুধু স্পর্শেরই রয়েছে অশ্রুতকে
শোনার প্রতিভা। লিলিআনকে প্রথম ছোঁয়ার কালে আমি যে-সুর শুনতে পাই
তা আমি কানে শোনার সাহস করি না। আমি কি অসংখ্য আণবিক বিস্ফোরণ
সম্ভোগের শক্তি রাখি? বহু সুর ঢোকে আমার ভেতরে, কিন্তু কিছু কিছু
সুর কিছুতেই আমার ভেতরে ঢোকে না। বীজ ছড়ানোর পর জমি যখন সবুজ
সুরে মেতে ওঠে খুবই নীরবে, আমার ভেতরে সে-সুর সহজে ঢোকে।
নিঃসঙ্গ দিঘির পারে হিজলের সুর শুনি আমি প্রতিদিন হিজলের ছায়া
থেকে পঁচিশ বছর ধরে সুদূরে থেকেও। মাঝিদের গলা থেকে ঝরে-পড়া
ভাটিয়ালি আমার শরীরে ঢোকে জোয়ারের জলের মতোই। কিন্তু ধ্রুপদী
সুরমালা কিছুতেই ভেতরে ঢোকে না। আমি একবার সন্ধ্যে থেকে
সারারাত চেষ্টা করেছি আমার শরীর বা আত্মার ছিদ্র দিয়ে ওই
অলৌকিক স্বরমালা ভেতরে ঢোকাতে। সারারাত আমার শরীর,
আমার নির্বোধ আত্মা বন্ধ ও বধির হয়ে থাকে। ট্রাকের চাকার সুর
আমার ভেতরে ঢোকে অনায়াসে–মৃত্যু, মৃত্যু, মৃত্যু, সুর শহর–নগর
মহাকাল চুরমার করে ঢোকে অত্যন্ত ভেতরে; যেমন অনন্তকাল ভালোবাসি,
ভালোবাসি, ভালোবাসি সুর তুলে আমার ভেতরে ঢোকে গীতবিতানের
পাতা। উদ্ভট, অসম্ভব, পাগল-মাতাল কবিতার সুর আমার ভেতরে,
ঢোকে, কিন্তু প্রথাগত জীর্ণ পদ্যের সুর কিছুতেই ভেতরে ঢোকে না।
জীর্ণ পদ্যের মতো একনায়কের গলা থেকে কেরোসিন, কংক্রিট, পিচ,
কাঠের মতোন বের হয়ে আসা সুরও আমার ভেতরে ঢোকে না। বন্দুকের
নলে যুগ যুগ কান পেতে থেকেও কখনো আমি কোনো সুর শুনতে পাই নি।
বন্দুকের সম্ভবত কোনো সুরতন্ত্রি নেই। কিছু কিছু বিখ্যাত বইয়ের
সুরও আমার ভেতরে ঢোকে না। ওই সব বই খুলে পাতায় পাতায় আমি
কান পেতে থেকেছি কয়েক জন্ম কিন্তু আমার ভেতরে সে-সবের কোনো
সুরই ঢোকে নি। সুর ওঠে, সুর ওঠে, সুর ওঠে চারদিকে
নারীর সোনালি সুর, শস্যের রক্তিম সুর, শিল্পের আশ্চর্য সুর, প্রগতির
মানবিক সুর, মাটির মধুর সুর, প্রতিক্রিয়া-শোষণের দানবিক সুর।
সুর ওঠে, সুর ওঠে, সুর ওঠে চারপাশে–মাংসের কাতর সুর,
রক্তের পাগল সুর, শজির সবুজ সুর, ঠোঁটের তৃষ্ণার্ত সুর, রাত্রির গোপন
সুর, প্লাস্টিকের শুষ্ক সুর, হোটেলের হাহাকার করা সুর। আমি
অনেক দেখেছি প্রায় সব সুরই আমার ভেতরে ঢোকে, শুধু প্রথা
ও প্রতিক্রিয়ার কালো দানবিক সুরগুলো কিছুতেই আমার ভেতরে ঢোকে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *