কালো সুতো
রবিবার সকালটা কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের ফ্ল্যাটে গিয়ে আড্ডা দিতেই কেটে যায়। অভিজ্ঞতার শেষ নেই ওঁর। সেই অভিজ্ঞতার টুকরো উপহার পেয়ে আমি কখনও খুশি হই। কখনও একঘেয়ে লাগে। যেমন গত রবিবার ওঁর তিব্বতে সাদা হরিণের ছবি তোলার অভিযানের কাহিনী। সাদা হরিণ ছেড়ে তিব্বতে লামাদের জন্মান্তরবাদ নিয়ে বেলা এগারোটা বাজিয়ে ছাড়লেন। সাদা হরিণের প্রতি তখন আমার প্রচণ্ড কৌতূহল জেগেছে। অথচ কর্নেল লামাতত্ত্ব নিয়ে ট্রেন ছুটিয়ে দিয়েছেন। অগত্যা ঘড়ি দেখে লাফ দিয়ে একটা অজুহাত দেখিয়ে কেটে পড়তে হল। নয়তো লাঞ্চে ভাগ বসাতে হত।
এই রবিবারে গিয়ে দেখি, কর্নেল গম্ভীর মুখে বসে আছেন। হাতে ভাজ করা একটা কাগজ। আমাকে দেখে ইশারায় বসতে বললেন।
এক মিনিট চুপচাপ বসে থাকার পর টের পেলুম, পরিচারক ষষ্ঠীচরণকে কী ব্যাপারে বকাবকি করছিলেন। আমি এসে পড়ায় এই গাম্ভীর্য জেগেছে। পর্দার ওপাশে পাশের ঘরে ষষ্ঠীচরণের কাঁচুমাচু মুখটা একবার দেখলুম। তারপর আমিও গম্ভীর মুখে বললাম–এপাড়ায় একটা কাজে এসেছিলাম। আচ্ছা উঠি।
অমনি কর্নেল আমার হাত ধরে বসিয়ে দিলেন। তারপর দেখলাম গাম্ভীর্য ভেঙে গেছে। মুখে হাসি ঝলমল করছে। বললেনবসো জয়ন্ত। এইমাত্র ভাবছিলাম তোমায় ফোন করব। যাকগে এসে পড়েছে। খুশি হয়েছি। ষষ্ঠী! যা হবার হয়েছে–এখন আমাদের কফি খাইয়ে দে!
বললাম–হয়েছেটা কী? ষষ্ঠীকে বকছিলেন কেন?
কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন–এই চিঠিটা। ভীষণ জরুরি এই চিঠিটা গতকাল শনিবার লেট আওয়ার্সে পিওন লেটার বক্সে দিয়ে গেছে। ষষ্ঠীচরণ কাল সন্ধ্যায় ওটা এনেছিল। আমি ছিলুম না তখন। সে চিঠিটা ওই টেবিলে রেখেছিল। কিন্তু আমাকে জানায়নি। এইমাত্র ঘর সাফ করার সময় কুড়িয়ে। পেয়েছে। বোঝ ব্যাপার। এমন একটা জরুরি চিঠি!
বললাম–চিঠিটা জরুরি তো অনেকবার বলেছেন!
কর্নেল মাথা দুলিয়ে বললেন–সত্যিই এই চিঠিটা কত জরুরি, তুমি একবার চোখ বুলিয়ে দেখ জয়ন্ত, তাহলেই বুঝবে।
চিঠিটার ভাজ খুলে দেখি, বলরামপুর নামে বিহারের পূর্ণিয়া জেলার একটা জায়গা থেকে দয়াময়ী রায়চৌধুরী নামে কোন মহিলা কর্নেলকে ইনিয়ে বিনিয়ে কী সব লিখেছেন। প্রথম কয়েকটা লাইন দ্রুত পড়ে বুঝলাম ওঁর স্বামী সত্যের রায়চৌধুরী কর্নেলের বন্ধু ছিলেন। সেই সুবাদে একটা অনুরোধ জানাচ্ছেন।
দ্বিতীয় প্যারায় চোখ বুলিয়ে চমকে উঠলাম।…আমার ধারণা, শীঘ্র আমাকে কেহ খুন করিবে। বাতাসে যেন ষড়যন্ত্র চলিতেছে। মাননীয় মহাশয়, অনুগ্রহ করিয়া শীঘ্র মদীয় ভবনে আসুন এবং আমার প্রাণরক্ষার ব্যবস্থা করুন। পুলিশের নিকট যাইতে সাহস পাই না। উহারা শুনিলে প্রমাণ দাবি করিবেন। কিন্তু প্রমাণ তো কিছুই নাই। আমার মনে যাহা সত্য বলিয়া বাজিতেছে, তাহার প্রত্যক্ষ প্রমাণ কী দিব? আমার বাটিতে যাহারা আছে, তাহারা আমার প্রতি নানা কারণে কৃতজ্ঞ। তাহারা কেন আমার ক্ষতি করিবে–কিসের স্বার্থে, বুঝি না, সাক্ষাতে
সব বলিব। আগামী ২৫ই সেপ্টেম্বর সোমবার আমার পরলোকগত স্বামীর বার্ষিক কৃত্য উপলক্ষে কিছু আত্মীয়-স্বজন আসিবেন। আপনাকেও নিমন্ত্রণ করিতেছি। ওঁর বন্ধু হিসাবেই যোগ দিন। ভগবানের দোহাই, এসব কথা ঘৃণাক্ষরেও প্রকাশ করিবেন না। আমি আমার স্বামীর মুখে আপনার কীর্তিকলাপ অবগত হইয়াছিলাম। তাই এই প্রার্থনা ..
ঘুরে দেখি, কর্নেল আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। বললাম–আশ্চর্য তো? কে এই মহিলা?
কর্নেল বললেনবলরামপুরের রাজা খেতাবধারী প্রাক্তন জমিদার গৃহিণী। এখন আর তেমন কিছু সম্পত্তি নেই বলেই আমার ধারণা। কুমার সত্যেশ্বর নামকরা শিকারী ছিলেন। সেই সূত্রে আমার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। বছর দশেক আগে উনি অপুত্রক অবস্থায় মারা যান। যতদূর শুনেছি, উইলে স্ত্রীর নামেই সব দিয়ে যান। আমার হিসেবে মহিলার বয়স ষাট-বাষট্টির কম নয়। সত্যেশ্বরের সঙ্গে যখন আমার আলাপ হয়, তখন উনি আমার চেয়ে বয়সে বড় এবং মাথার চুল পেকে গিয়েছিল। ওঁর স্ত্রী বার দুই আমার সঙ্গে আলাপ করেন। স্মৃতিতে ভুল থাকতেও পারে। আমার মনে হচ্ছে, কিছু একটা বাস্তব কারণ না ঘটলে উনি প্রাণহানির আশঙ্কা করতেন না।
বললাম–তাহলে নিশ্চয় বলরামপুর যাচ্ছেন? গোয়েন্দাঘুঘুটি মাথার মধ্যে। নিশ্চয় ডাকতে শুরু করেছে!
কর্নেল হেসে উঠলেন। ষষ্ঠীচরণ কফি এনে গম্ভীর মুখে রেখে গেল। কফিতে চুমুক দিয়ে কর্নেল বললেন–ডার্লিং! ঠিক এই ব্যাপারেই তোমায়। ফোন করার কথা ভাবছিলুম।
–তার মানে আমিও যাব?
–অবশ্যই।
–আমার তো নিমন্ত্রণ নেই।
ওটা কিছু নয়।…বলে কর্নেল সস্নেহে আমার কাঁধে হাত রাখলেন। জয়ন্ত, তোমারও কম লাভ হবে না। তুমি দৈনিক সত্যসেবকের রিপোর্টার। অতএব যদি বরাত খুলে যায়, চমৎকার একখানা স্টোরি পেয়ে যাবে। হেডিং দেবে? বলরামপুরে হত্যারহস্য! তাই না?
একটু ভেবে নিয়ে বললাম কখন বেরোচ্ছেন?
–আজ দুপুরেই। এক মিনিট। হওড়ায় ফোন করে আমার রেলের বন্ধুটিকে বলে রাখি যেভাবেই হোক, দুখানা বার্থের ব্যবস্থা যেন করে ফেলেন।
কর্নেল চায়ের কাপ হাতে ফোনের দিকে এগিয়ে গেলেন।…
হাওড়া-সাহেবগঞ্জ রেলপথে বলরামপুর এখন একটা বড় স্টেশন। দিনে দিনে সরকারি শিল্প প্রকল্প গড়ে উঠেছে প্রচুর। পাহাড়ী শহর। অভ্র আর লোহার খনিও আছে। ক্রমশ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে জনবসতি আর কারখানা।
আমরা যখন পৌঁছলাম, তখন রাত তিনটে। নিছক প্যাসেঞ্জার ট্রেন। প্রত্যেকটি স্টেশন ছুঁয়ে এসেছে। মেল ট্রেনে এলে রাত দশটায় পৌঁছে যেতুম। মধ্যে একটা স্টেশনে ট্রেন একঘণ্টা লেট করেছে।
বাকি রাতটুকু রেস্টরুমে কাটাতে হল। ছ’টায় চা খেয়ে আমরা বেরোলাম। রিকশায় চেপে চৌধুরী ভবনের উদ্দেশে রওনা হলুম। সঙ্গে মালপত্র বলতে তেমন কিছুই নেই। আমি একটি ছোট স্যুটকেস নিয়েছি মাত্র। কর্নেলের পিঠে প্রকাণ্ড কিটব্যাগ।
চারধারে পাহাড়। মধ্যিখানে উপত্যকায় এই বলরামপুর শিল্পনগরী গড়ে উঠেছে। চড়াই-উৎড়াই হয়ে আমাদের রিকশো শহর ছাড়িয়ে পাহাড়ের দিকে এগোল। কর্নেল বললেন-সত্যেশ্বর খুব চমৎকার জায়গায় বাড়ি করেছিলেন। গিয়ে দেখবে’খন। টিলার গায়ে ওঁর বাড়িটা কতকটা দুর্গের মতো। ভুল করে অনেকে ওটাকে দুর্গ মনে করে।
বলে উনি গলা থেকে ঝুলন্ত বাইনাকুলার চোখে রাখলেন। একটু পরে সেটা ফের ঝুলিয়ে দিয়ে বললেন-কাছাকাছি আরও কিছু বাড়ি হয়েছে দেখছি। খালি চোখেও দেখা যাচ্ছে অবশ্য। ওই যে–দেখতে পাচ্ছ?
একটু দূরে টিলার গায়ে সত্যিসত্যি দুর্গের মতো পুরনো বাড়ি দেখতে পেয়ে আবাক হলাম। কর্নেল না বললে আমি ঠিকই কোন ঐতিহাসিক কেল্লাবাড়ি বলে ভুল করতাম। টিলার গায়ে অনেক নতুন বাড়িও দেখা যাচ্ছিল। গাছপালাও প্রচুর ওখানে। টিলার মাথায় একটা সাদা মন্দিরও দেখতে পেলাম।
কিছুক্ষণের মধ্যেই টিলার কাছে পৌঁছে গেলাম। সমতলে অজস্ৰ একতলা বাড়িঘর রয়েছে। কর্নেল জানালেন কারখানার কর্মীদের কোয়ার্টার। তবে এটা অফিসার এলাকা মনে হচ্ছে। রিকশা ওখানে উঠবে না। মোটরগাড়ি হলে একেবারে বাড়ির দরজায় পৌঁছে যেতাম।
তখন সূর্য উজ্জ্বল হয়েছে অনেকটা। আমরা দুজনে নিজের নিজের বোঁচকা নিয়ে চড়াই ভেঙে যখন চৌধুরীভবনের ফটকে পৌঁছলাম, তখন গায়ে রীতিমতো ঘাম ঝরছে। অথচ. গাছপালায় কুয়াশা জড়িয়ে রয়েছে। শিশিরও চকচক করছে ঘসে।
বাড়ির ফটকের কাছে একটা লোক দাঁড়িয়ে ছিল। আমাদের দেখেই সেলাম দিয়ে লোহার রড বসানো গেট খুলে দিল। বুঝলাম, কুমার সত্যেশ্বরের বার্ষিক শ্রাদ্ধকৃত্যে আমন্ত্রিতরা আসতে শুরু করেছেন।
নুড়ি বিছানো প্রশস্ত ও বিশাল লন পেরিয়ে দোতলা বাড়ির গাড়িবারান্দায় গেলে আরেকজন লোক এসে আমাদের নিয়ে গিয়ে ড্রয়িং রুমে বসাল। ড্রয়িং রুমটা বিশাল। খানিকটা কাঠের পার্টিশান করা। তার ওপরে পর্দার ফাঁকে বইয়ের আলমারি দেখা যাচ্ছিল। ওটা তাহলে কুমারবাহাদুরের লাইব্রেরি ছিল। ড্রয়িং রুমের দেওয়ালে হরিণ আর বাঘের মাথা দেখে বোঝা যাচ্ছিল গৃহস্বামী শিকারী ছিলেন।
একটু পরেই অসম্ভব ফর্সা এক বৃদ্ধা আস্তে সিঁড়ি ভেঙে ড্রয়িং রুমে নামলেন। কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। পরস্পর অভিবাদন এবং কুশল বিনিময় হল। তারপর আমার পরিচয় পেয়ে খুব খুশি হলেন। বললেন–আমি জানতুম, আপনি না এসে পারবেন না কর্নেল! যাক গে, আপাতত বিশ্রাম করুন। ও পাশের একটা ঘর আপনার জন্যে আমি খালি রেখে দিয়েছি। অসুবিধে হবে না। জয়ন্তবাবুও ওখানে থাকুন–যদি কর্নেলের অবশ্য আপত্তি…
কর্নেল সশব্যস্তে বললেন–জয়ন্ত আমার সঙ্গে না থাকলেই বরং আমার আপত্তি উঠবে।
দয়াময়ী একটু খোঁড়াচ্ছেন মনে হল। সম্ভবত পায়ে বাতে কষ্ট পাচ্ছেন বললেন। জগাই, হাঁ করে কী দেখছিস। ঘরটা খুলে দে।
জগাই নামে প্রৌঢ় সেই লোকটা আমার নিয়ে গিয়ে সামনের একটা প্ল খুলে দিল।
কর্নেল বললেন–বাঃ! চমৎকার ঘর। পুবদিকটা যে ফাঁকা–এটাই আমার পক্ষে আনন্দের কারণ। ভোরে মুখের ওপর সূর্যের আলো না পড়লে আমার ঘুম। ভঙে না। অজস্র ধন্যবাদ মিসেস রায়চৌধুরী।
দয়াময়ী মৃদু হেসে জগাইকে চাপাস্বরে কিছু বললেন। জগাই চলে গেল। তখন উনি কর্নেলের কাছাকছি গিয়ে তেমনি, চাপা স্বরে দ্রুত বললেন–গত রাতে আমার ঘরের দরজায় কেউ টোকা দিচ্ছিল। আমি খুললেই আমাকে মেরে ফেলত! কর্নেল, আপনি এসে পড়ায় আমার মনের জোর খুব বেড়ে গেছে।
তারপর অকারণ গলা চড়িয়ে বললেন–আমার শরীরের অবস্থা তেমন ভাল নয়, কর্নেল! আপনার বন্ধু চলে গেলেন। তারপর থেকে শোকে দুঃখে তো। বটেইনানা ঝড়ঝাঁপটায় ভুগছি। আপনি বসুন। বাবা জয়ন্ত, তুমিও বসো। তুমি বলছি–কিছু মনে কোরো না যেন। তুমি আমার ছেলের মতো।
বললাম-না, না। কী মনে করব। বরং আপনি-টাপনি করলে খারাপ লাগত। জানলার ধারে সোফায় বসলাম। কর্নেল বললেন, যাদের আসার কথা, সবাই কি এসে গেছেন?
দয়াময়ী বললেন–হ্যাঁ সবাই এসেছে।
কারা এসেছেন, বলতে আপত্তি আছে?
–মোটেও না। কলকাতা থেকে এসেছে আমার বড় ভাশুরের ছেলে মৃগাঙ্ক আর তার বোন শমিতা। মুঙ্গের থেকে আমার বোনের ছেলে বিজন। দিল্লি থেকে মেজ ভাশুরের ছেলে শশাঙ্ক। ব্যস! চারজন মোটে। কর্নেল, সবাই ছেলেমেয়েদের পাঠিয়েছে নিজেরা আসেনি। কেন তা আশা করি, বুঝতে পারছেন?
কর্নেল জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন।
একটু হেসে দয়াময়ী বললেন আমার মনে বাৎসল্যের সঞ্চার যাতে হয় এবং আমি যাতে সবার ওপর সুবিচার করি, তাই। মানুষ যে এত স্বার্থের দাস, এতদিনে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি, কর্নেল।
কর্নেল বললেন–আপনার কাছে কারা থাকেন?
–দুজন চাকর। জগাই আর রূপলাল। আর আছে আমাদের দেওয়ানজীর ছেলে মাধব। ওকে আমি ছেলের মতো বরাবর কাছে রেখেছি। এছাড়া আমাকে দেখাশোনা করার জন্যে আছে মালতী নামে একটি মেয়ে। পরিচারিকা বলতে পারেন। আর…
–মালতীর স্বামী?
–ও অবিবাহিতা। বয়স বাইশ-তেইশ হবে।
এছাড়া আর কে আছে?
–আছে ননীগোপাল নামে এক ওড়িয়া রাঁধুনি। মন্দিরের একজন সেবাইতও এবাড়িতে থাকেন। তার নাম ব্রজমোহন। বুড়ো মানুষ। খুব অসুস্থ এখন। ঠাকুরঘরের পাশের একটা ঘরে থাকেন।
এবার বলুন, আপনার প্রাণনাশের ষড়যন্ত্র চলছে, কিসে বুঝলেন?
দয়ামীয় চাপা গলায় বললেন –দিন পাঁচেক আগে আমি রাত দশটায়…
কথায় বাধা পড়ল। একটি যুবতী সটান ঘরে ঢুকে বলল–কে এসেছেন কাকিমা কলকাতা থেকে? জগাইদা বলল।
যুবতীটি সৌন্দর্যময়ী। আমি হাঁ করে তাকিয়ে আছি দেখে কর্নেল চুপচুপি আমার উরুতে আঙুলের খোঁচা মারলেন। দয়াময়ী বললেন–এস শমিতা। আলাপ করিয়ে দিই–ইনি তোমার কাকুর বন্ধু কর্নেল নীলাদ্রি সরকার, আর এ হচ্ছে জয়ন্ত…
কর্নেল বললেন-জয়ন্ত চৌধুরী। দেনিক সত্যসেবকের রিপোর্টার।
শমিতা বিস্ময়ে ভুরু কুঁচকে বলল রিপোর্টার! কেন কাকিমা?
দয়াময়ী বিব্রত মুখে কী বলতে যাচ্ছিলেন, কর্নেল বললেন জয়ন্ত এসেছে ওর একটা অ্যাসাইনমেন্টে। আপাতত আমার সঙ্গে থাকছে। ইয়ে-শমিতা, আমি যদি ভুল না করে থাকি–বাই এনি চান্স, তুমি কি গতবার ভলিবল এবং সাঁতারে স্টেট চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলে?
শমিতার মুখ হাসিতে উজ্জ্বল হল। ঘাড় নেড়ে বলল–হ্যাঁ। আপনি জানেন?
–এ বুড়ো স্পোর্টসের খবরে খুব উৎসাহী। বসো শমিতা। তোমার সঙ্গে কিছুক্ষণ খেলাধুলোর চর্চা করা যাক।
শমিতা অমনি ঠোঁট উল্টে বলল–সরি কর্নেল! আমি এখন বড্ড ব্যস্ত।
মেয়েটি কি ছিটগ্রস্তা? যেমন এসেছিল তেমনি চলে গেল। দয়াময়ী ফিসফিস করে বললেন–খুব সরল মেয়ে ভাববেন না কর্নেল! বড্ড কুচুটে। গায়ে অসুরের মতো জোর। আমাকে খাট থেকে তুলে ফেলে দিতে যাচ্ছিল কাল! সব জায়গায় ওৎ পেতে ঘুরে বেড়ানো স্বভাব। দাদাটিও তেমনি। গোঁয়ারগোবিন্দ মস্তান-টাইপ ছেলে। বড় ভাসুর বুড়ো বয়সে বিয়ে করে কী কুকর্ম করেছেন এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন।
কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন–ওরা কবে এসেছে?
সাতদিন হল। আগে থেকে এসে বসে আছে। …দয়াময়ী বিকৃত মুখে। বললেন। যে আশায় এসেছে, সে আশায় ছাই দিয়ে…
আবার বাধা পড়ল। একটি যুবক ঘরে ঢুকে বলল কাকিমা কে এসেছেন শুনলাম? শমিতা বলল। কর্নেল না কে যেন?
দয়াময়ী মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন–এস শশাঙ্ক, আলাপ করিয়ে দিই।
শশাঙ্ক দাঁড়াল না। তক্ষুনি চলে গেল। ভারি অভদ্র তো! নাকি এও জ্যাঠতুতো বোনের মতো হাফ-পাগল? দয়াময়ী বিব্রত মুখে বললেন–আমার ভাশুরের ছেলেমেয়েরা কেমন, তা নিশ্চয় টের পাচ্ছেন কর্নেল?
কর্নেল বললেন শশাঙ্ক কবে এসেছে?
–গত মঙ্গলবার। ও মিলিটারিতে ঢুকেছে। ভীষণ ডানপিটে।…বলে দয়াময়ী ফের ফিসফিস করে বললেনরাতদুপুরে সেদিনই আমার জানালার ধারে বসে একটা কিছু করছিল ও। মালতী হঠাৎ বেরিয়ে দেখতে পায়। তখন ও একটা বাজে অজুহাত দেখিয়ে কেটে পড়ে। জানেন, ওর কাছে রিভলভার আছে?
কর্নেল সেকথায় কান না দিয়ে বললেন- বাকি রইল আপনার মুঙ্গেরের ভাশুরপো বিজন। সে কবে এসেছে?
বুধবার সকালে। এসেই আমার পা জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি!
–কেন?
–আমি নাকি ওকে বঞ্চিত করব শুনেছে কার কাছে।
–আচ্ছা মিসেস রায়চৌধুরী, আপনি যদি জীবিত অবস্থায় সম্পত্তি কাউকেও না দেন, আপনার অবর্তমানের সম্পত্তি নিশ্চয় ওদের মধ্যে বর্তাবে। তাহলে ওরা আপনাকে ইনসি করছে কেন?
একা সবটাই চায় প্রত্যেকে। তাই এত সাধাসাধি আর নেকনজরে থাকার চেষ্টা।
–সম্পত্তির পরিমাণ কত?
দয়াময়ী গম্ভীর মুখে বললেন–ব্যাঙ্কে লাখ পাঁচেক টাকা ফিক্সড ডিপজিট। এই বাড়িটা আর টিলার নিচে পাঁচবিঘে পোড়ো জঙ্গুলে জমি। ওটা সরকার দখল করে নিতেন। করেননি কারণ দফতরে ওঁর এক বন্ধু আছেন। তবে সম্প্রতি বেসরকারি একটা কোম্পানি জায়গাটা চাইছে স্টাফ কোয়ার্টার আর ওয়েলফেয়ার ওয়ার্কস করবে। আমি রাজি হচ্ছি না। কারণ আমার ইচ্ছা, মালতীকে জমিটা দেবো। যে তুক হিসেবেই দেব–মালতী এখনও দ্বিধায় ভুগছে। যার সঙ্গে ওর ইমোশনাল সম্পর্ক আছে–সে রেলের একজন কর্মী। মালতীকে বলছি–বিয়েটা করে নে শিগগির। হতভাগী মেয়ে ভাবছে আর ভাবছে। ওকে বলেছি কাল তুই বিয়ে রেজিস্ট্রি করে এসে আমায় বললে পরশু আমি জমিটা তোকে রেজিস্ট্রি করে দেব।
কর্নেল চুরুট বের করে বললেন–গতরাতে কী হয়েছে, বলছিলেন?
— দয়াময়ী বলবার জন্য ঠোঁট ফাঁক করতেই একটি মেয়ে চায়ের ট্রে আর খাবারের প্লেট নিয়ে ঢুকল। দয়াময়ী বললেন–এই হচ্ছে মালতী, কর্নেল!
মালতী গোলগাল পুতুল গড়নের মেয়ে। দেখতে মোটামুটিতবে যৌবনের স্বাভাবিক সৌন্দর্য ওর চেহারায় ঝলমল করছে। মুখটা কেমন গম্ভীর দেখাচ্ছিল ওর। ট্রে রেখে চলে যাচ্ছিল, দয়াময়ী ডেকে বললেন–ব্রজঠাকুরের কদ্দূর রে মালতী? ওকে তাড়া দে বরং। আমি যাচ্ছি।
মালতী বলল–মাধবদার সঙ্গে ঝগড়া করছে দেখুন গে।
অমনি দয়াময়ী উঠলেন। হন্তদন্ত বেরিয়ে গেলেন।
কর্নেল মিটিমিটি হাসছিলেন। বললাম–এ কোথায় এসে পড়লাম কর্নেল?
–কেন জয়ন্ত?
–আর কেন? এ বলে আমায় দেখ, ও বলে আমায় দেখ। তাছাড়া সম্পত্তির যা হিসেব পেলাম, ওইটুকুর জন্যে এতগুলো লোক এসে কামড়াকামড়ি শুরু করেছে ভাবতেই অবাক লাগে।
কর্নেল হো হো করে উঠলেন। তারপর উঠে দাঁড়ালেন। বাথরুমে যাওয়া দরকার। জয়ন্ত, বাথরুমটা কোথায়, তা দেখিয়ে দিতে ভুলে গেছেন মিসেস রায়চৌধুরী। এখন সেটা খুঁজে বের করা যাক।
পশ্চিম এবং উত্তরদিকের দরজা পরীক্ষা করে কর্নেল হতাশমুখে মাথা নাড়লেন। বললাম–অ্যাটাচড় বাথরুম থাকা তো উচিত। আমি দেখি, কাকেও পাই নাকি।
উঠে যে দক্ষিণের দরজা দিয়ে ঢুকেছি, সেই দরজার পর্দা তুলে দেখি ড্রয়িং রুমের এক কোনায় দোতলায় ওঠার সিঁড়ির কাছে এক অদ্ভুত দৃশ্য!
মালতীর হাত ধরে একটি অচেনা যুবক কী বোঝানোর চেষ্টা করছে, মালতী তাকে ঠেলে সরিয়ে যেতে চায়।
আমার চোখে চোখ পড়তেই যুবকটি অপ্রস্তুত হয়ে তক্ষুনি বেরিয়ে গেল। মালতী সিঁড়িতে উঠতে যাচ্ছিল, বললাম-ইয়ে মালতী! বাথরুমটা কোথায় খুঁজে পাচ্ছিনে!
মালতী নেমে এল এবং সিঁড়ির পাশে একটা দরজা দেখিয়ে বলল–এই যে! আপনাদের একটু কষ্ট করতে হবে আর কী!
একটু ইতস্তত করে বললাম–আচ্ছা মালতী, কিছু মনে করো না। ওই ভদ্রলোক কে?
উনি মাধববাবু। দেওয়ানজী ছিলেন তার ছেলে।
মালতী চলে গেল। আমি ভেতরের ঘরে ঢুকে কর্নেলকে বললাম–ড্রয়িং রুমে অ্যাটাচড বাথ আছে। এ ঘর থেকে বেরিয়ে ড্রয়িংরুমে ঢুকে বাঁদিকে সিঁড়ির তলায় আসুন।
কর্নেল পুবের জানালায় দাঁড়িয়ে কী যেন দেখছিলেন। সরে এসে একটু হেসে বললেন–তুমি ঠিকই বলেছ জয়ন্ত। এ বাড়িতে লোকগুলো দেখছি বড্ড অদ্ভুত! এই জানালায় দাঁড়িয়ে দেখলুম, সম্ভবত মিসেস রায়চৌধুরীর মুঙ্গেরের ভাশুরপো বিজন একটা ঝোপের মধ্যে বসে উঁকি মেরে কিছুর ওপর লক্ষ্য রেখেছে।
-বলেন কী! বলে জানালার দিকে এগোতেই কর্নেল বাধা দিলেন।
বললেন–ছেড়ে দাও। আমি চটপট বাথরুম সেরে আসি।
কর্নেল চলে গেলে কৌতূহল চাগিয়ে উঠল। তখন জানালার ধারে চলে গেলুম। কিন্তু তেমন কাউকে দেখলুম না। ঘাস আর আগাছায় রোদ ঝলমল করছে। ঝোপে কোথাও কোন লোক উঁকি দিয়ে বসে নেই। কর্নেল কি রসিকতা করলেন?
দুপুরে খাওয়াটা ভালই হল। ওপাশে ঠাকুরবাড়িতে বার্ষিক শ্রাদ্ধকৃত্যের অনুষ্ঠান হচ্ছিল। বাড়ির সবাই ওখানে রয়েছে। জগাই আর মালতী এ ঘরেই আমাদের খাবার দিয়ে গিয়েছিল। মিসেস রায়চৌধুরী একবার ব্যস্তভাবে এসে দেখাশুনা করে গেলেন। খাওয়ার পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে কর্নেল বললেন–চলো জয়ন্ত, আমরা বলরামপুর শহরটা চক্কর দিয়ে আসি।
কখনও পায়ে হেঁটে কখনও রিকশায় এদিক ওদিক ঘুরে সন্ধ্যায় আমরা ফিরলাম। দেখি, মিসেস রায়চৌধুরী উৎকণ্ঠিত মুখে আমাদের জন্য প্রতীক্ষা করছেন।
ঘরে ঢুকে সকালের মতো মুখোমুখি বসে চাপা গলায় বললেন কর্নেল! আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আর রাতেই একটা কিছু ঘটবে। এখন আমায় বলুন, কী করব! একে তো অসুখ বিসুখে শরীর দুর্বল। হার্টের অবস্থা ভাল নয়। সব সময়। মাথা ঘোরে। তার ওপর এসব মারাত্মক ষড়যন্ত্র!…
কর্নেল বললেন–আপনি দয়া করে খুলে বলুন মিসেস রায়চৌধুরী!
মিসেস রায়চৌধুরী ফিসফিস করে বললেন–কিছুক্ষণ আগে বিজন ফের আমার ঘরে গিয়ে পা ধরে কান্নাকাটি করছিল। ওর ধারণা, আমি ওকে বঞ্চিত করব। যাই হোক, ওকে বোঝাচ্ছি–হঠাৎ মৃগাঙ্ক ঢুকে ওকে আর আমাকে শাসাতে শুরু করল। ওকে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বললাম। সেই সময় শশাঙ্ক গিয়ে ঢুকল। শশাঙ্ক মৃগাঙ্ককে শাসিয়ে বললবদমাইশি করলে তোমাকে গুলি করে মারব। বুঝুন অবস্থা! অনেক কষ্টে সবাইকে বের করে দিয়ে মালতীকে বললাম, আমার ঘরের দরজায় তালা এঁটে দে। তুই আর মাধব পাহারায় থাক। আমি নিচে কর্নেলের কাছে যাচ্ছি।
মিসেস রায়চৌধুরীর মুখটা বিকৃত হয়ে উঠেছিল। হাঁফাচ্ছিলেন। কর্নেল বললেন–দয়া করে এত উত্তেজিত হবেন না মিসেস রায়চৌধুরী। এবার একটা কথার জবাব দিন–যেন গোপন করবেন না।
মিসেস রায়চৌধুরী সংযত হয়ে বললেনবলুন।
–আমার ধারণা, আপনার ভাশুরপোদের এসব কাজের পিছনে নিশ্চয় অন্য কোন ব্যাপার আছে। যা আপনি এখনও আমাকে বলতে দ্বিধায় ভুগছেন।
মিসেস রায়চৌধুরী মুখ তুলে নিষ্পলক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকলেন। তারপর ঘুরে চারদিক দেখে আরও ফিসফিস করে বললেন–হীরে! আমার শ্বশুর মশায়ের একটা হীরে।
–হীরে? কোথায় আছে সেটা?
–আমি সেটা এক জায়গায় লুকিয়ে রেখেছি। আমি ছাড়া কেউ তার পাত্তা পাবে না। হীরেটা খুব দামী। আমার স্বামীর কাছে শুনেছি, বেচলে সেটার দাম দশ লাখের কম নয়।
–আপনার ঘরেই কোথাও রেখেছেন বুঝি?
মিসেস রায়চৌধুরী মাথা দোলালেন শুধু।
কর্নেল বললেন–কিন্তু আপনাকে কেউ মেরে ফেললে সেটার খোঁজ তো কেউ পাবেই না। তাই না?
হ্যাঁ। পাওয়া সম্ভবই নয়।
–তাহলে কেন ভাবছেন আপনাকে মেরে ফেলবে?
রাগে কর্নেল, রাগে। প্রতিহিংসায়। বুঝলেন না? ওই শমিতা আজ চুপি চুপি ওর দাদা মৃগাঙ্কের সঙ্গে পরামর্শ করছিল। বলছিল কী জানেন? বুড়ি যদি হীরেটা না দেয়, ওকে তুলে ওপর থেকে নিচে ফেলে দেব!
কর্নেল একটু থামলেন। এই সময় জগাই ব্যস্তভাবে ঘরে ঢুকে বলল–মা! শিগগির আসুন! মৃগাঙ্কবাবু ব্ৰজঠাকুরকে চড় মেরেছেন। বুড়োথুড়ো হাঁপের রোগী! মরেই গেল হয়তো!
মিসেস রায়চৌধুরী হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেলেন ওর সঙ্গে। আমরা হতভম্ব হয়ে বসে রইলুম। তারপর কর্নেল একটু হেসে বললেন ব্যাপারটা ভেবে দেখ জয়ন্ত। আমরা এমন এক অদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্যে ঢুকে পড়েছি, যার পরিণতি কোথায় গড়াবে একটুও অনুমান করতে পারছি নে। বাড়িতে এখন অনেক লোক। হঠাৎ একটা কিছু মারাত্মক কাণ্ড ঘটলে খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার ব্যাপার হবে। মৃগাঙ্ক, শশাঙ্ক, বিজন, মাধব, ননীঠাকুর, ব্রজঠাকুর, জগাই, রূপলাল, মালতী আর শমিতা–মোট দশজন পাত্রপাত্রী…
কথা কেড়ে বললাম–মিসেস রায়চৌধুরীকে ধরুন। এগারোজন। এবং আমরা দুজন। মোট তেরজন একটা অদ্ভুত নাটকের কুশীলব।
কর্নেল হো হো করে হেসে বললেন–এবং আনলাকি থারটিন! অপয়া সংখ্যা তেরো!
চমকে উঠে বললাম–তাই তো! তেরোর কারবার!
কর্নেল হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বললেন–আমার কোন কুসংস্কার নেই। কিন্তু…
–কিন্তু কী কর্নেল?
কর্নেল কী ভাবতে ভাবতে চোখ বুজলেন। কোন জবাব দিলেন না।
রাত তখন দশটা। বাড়ি স্তব্ধ। আমরাও সবে পোশাক বদলে শুতে যাচ্ছি, এই সময় পাশে ড্রয়িংরুমেই কে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল–কে? কে ওখানে? সাড়া না দিলে গুলি করে মারব!
তারপর একটা ধস্তাধস্তি শব্দ হল। সঙ্গে সঙ্গে কে আবার চেঁচিয়ে উঠল, ওরে বাবা! মেরে ফেললে! বাঁচাও, বাঁচাও!
কর্নেল একলাফে দরজা খুললেন। আমিও বেরিয়ে পড়লুম। ড্রয়িংরুমে কোন আলো নেই। কে সেখানে প্রচণ্ড চেঁচাচ্ছে। ধস্তাধস্তি হচ্ছে। ওপরে সিঁড়ির মুখে কম ওয়াটের বাল্ব জ্বলছিল। তার আলোয় মেঝেয় জাপটাজাপটি করতে দেখলুম।
সেই সময় ওপরে সিঁড়ির মাথায় দয়াময়ীকে দেখা গেল। চেঁচিয়ে বললেন– কী হয়েছে ওখানে? মালতী! জগাই! কী হয়েছে?
নিচে যারা জাপটাজাপটি করছিল, তাদের একজন চেঁচিয়ে উঠল বাঁচাও! বাঁচাও!
কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার মাত্র। কর্নেল আর আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। তারপর কর্নেল পা বাড়িয়েছেন যুযুধান লোক দুটোর দিকে–আমিও এগোচ্ছি, দয়াময়ী হুড়মুড় করে নামতে গিয়ে আচমকা পড়ে গেলেন এবং সিঁড়ি দিয়ে গড়াতে গড়াতে এসে নিচে পড়লেন।
মালতী সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নামল। কত্রীকে ওঠাবার চেষ্টা করল। ওদিকে কর্নেল যুযুধান লোক দুটোকে দুই পেল্লায় ঘুষিতে পৃথক করে ফেললেন। তারপর কেউ আলো জ্বেলে দিল। দেখি, জগাইকে আক্রমণ করেছিল মাধব। তারা দুজনে হাঁফাচ্ছে। এবার কর্নেল দয়াময়ীর কাছে গেলেন। দয়াময়ী। সংজ্ঞাহীন। হঠাৎ কর্নেল দয়াময়ীর একটা হাত নিয়ে নাড়ি দেখলেন। চোখের পাতা ফাঁক করে কী পরীক্ষা করলেন। তারপর গম্ভীর মুখে বললেন মিসেস রায়চৌধুরী মারা গেছেন।
মালতী বুক ফেটে কেঁদে উঠল। সিঁড়িতে তখন দৌড়ে নামছে কারা…
দয়াময়ীর ডেথ সার্টিফিকেটে– ডাক্তার মৃত্যুর কারণ দেখালেন আকস্মিক দুর্ঘটনাজনিত পতনের ফলে হার্টফেল। দুর্বল শরীর, মানসিক উদ্বেগ ইত্যাদি কারণে দয়াময়ীর হার্টের অবস্থা ভাল ছিল না। কিন্তু আমার বৃদ্ধ বন্ধু ব্যাপারটা গোলমেলে করে তুললেন।
দয়াময়ীর পা দুটো দেখিয়ে ডাক্তার রাঘবেন্দ্র সিংকে বললেন–কিন্তু আপনি কি লক্ষ্য করেছেন ডাক্তার সিং, গোড়ালির ওপরে পায়ের সামনের দিকে ওই কালো দাগটা কিসের? দুই পায়েই ওই দাগ দেখা যাচ্ছে!
ডাঃ সিং দেখে নিয়ে বললেন–ঠিক বোঝা যাচ্ছে না! রঙটঙ হবে–দৈবাৎ পায়ে লেগেছিল।
কর্নেল সেই দাগে আঙুল ঘষে পরীক্ষা করে বললেন–হ্যাঁ। রঙই বটে।
বলে হঠাৎ পাগলের মতো লাফ দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলেন। সিঁড়ির প্রথম ধাপটার কাছে কী পরীক্ষা করে দেখে নেমে এলেন। ড্রইংরুমে আমরা সবাই দয়াময়ীর মৃতদেহ ঘিরে দাঁড়িয়ে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছি। হাঁ করে ওঁর কাণ্ড দেখছিলুম।
কর্নেল বললেন–শমিতা! এবাড়িতে ফোন আছে কি?
শমিতা বলল–আছে। কেন বলুন তো? কাকিমার ঘরে আছে।
–একবার ফোন করা দরকার। খুব জরুরি।
শমিতা বলল–মালতী! ওঁকে কাকিমার ঘরে নিয়ে যাও।
মালতী দয়াময়ীর ঘরে তালা দিয়ে এসেছিল ইতিমধ্যে। সে কর্নেলের সঙ্গে ওপরে গেল। ঘরে স্তব্ধতা থমথম করছে।
একটু পরে কর্নেল ফিরে এলেন। মালতী ফিরল না। লক্ষ্য করলাম, শমিতা মৃগাঙ্ক, শশাঙ্ক, বিজন উসখুস করছে আর ওপরের দিকে তাকাচ্ছে। কর্নেল বললেন–আপনারা ইচ্ছে করলে যে-যার ঘরে যেতে পারেন। আমি আর ডাক্তার সিং রইলুম, যতক্ষণ না পুলিশ আসে…
মৃগাঙ্ক চমকে উঠে বললেন–পুলিশ! কেন?
অন্যেরাও অবাক হয়েছে। সবাই কর্নেলের দিকে তাকাল।
কর্নেল বললেন–এটা একটা সুপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড!
ঘরে আবার চমক জাগল। তারপর বিজন চেঁচিয়ে উঠল–অসম্ভব!
কর্নেল একটু হেসে বললেন–পুলিশের হাতে ব্যাপারটা ছেড়ে দেওয়াই ভাল বিজনবাবু। ডাক্তার সিং তাজ্জব হয়ে বললেন কিন্তু ওঁর তো পড়ে গিয়েই হার্ট বন্ধ হয়েছে। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে।
কর্নেল বললেন–হ্যাঁ। সেটা সত্যি। তবে ওঁকে সিঁড়ি থেকে পড়ে যাবার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
শশাঙ্ক বলল–তার মানে?
–সিঁড়িতে কেউ লম্বালম্বি একটা মোটা সুতো টানটান করে বেঁধে রেখেছিল। ওতে পা লেগেই উনি পড়ে গিয়েছিল। সুতোটা গোলমালের সময় হত্যাকারী ঝটপট সরিয়ে ফেলেছে। আমরা তখন মিসেস রায়চৌধুরীকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। কেউ লক্ষ্য করিনি। দুপাশের পেরেক দুটো অবশ্য তার তোলা সম্ভব হয়নি এখনও আছে। দুটোর মাথায় কালো সুতোর গিঁট বাঁধা আছে। আপনারা গিয়ে দেখে আসতে পারেন।
মৃগাঙ্ক, শশাঙ্ক, বিজন আর মাধব একসঙ্গে সিঁড়িতে উঠে গেল। তাদের পিছনে শমিতাও গেল।
ওপর থেকে মৃগাঙ্ক চেঁচিয়ে উঠল–কে এখানে সুতো বেঁধেছিল?
শশাঙ্ক গর্জে উঠল–গুলি করে মারব তাকে।
শমিতা বলল–একি! এ তো সাদা সুতো! হাতে কালো রঙ লেগে যাচ্ছে!
মাধব বলল–এ সুতো তো আজই কেনা হয়েছিল শ্রাদ্ধের কাজের জন্যে। ব্রজঠাকুরের ঘরে ছিল এ সুতো।
এইরকম হইচই চলতে থাকল। তারপর পরস্পরের হাত পরীক্ষাও চলতে দেখলাম। যে সুতো বেঁধেছে, তার হাতে কাল রঙ নিশ্চয় লেগে থাকবে।
ওপরে যেন একদল পাগল হল্লা করছে। তারপর রূপলাল ঘরে ঢুকে জানাল, থানা থেকে পুলিশ এসে গেছে।
ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর প্রতাপনারায়ণ মালহোত্রার সঙ্গে কর্নেলের পরিচয় আছে দেখে আশ্বস্ত হয়েছিলাম। কারণ অনেক জায়গায় চেনাশোনা থাকায় কর্নেলকে বেমক্কা বিব্রত হতে দেখেছি। পুলিশ প্রাইভেট গোয়েন্দাদের নাক গলানো পছন্দ করে না। তার কারণও আছে। তবে কর্নেল বস্তুতপক্ষে নিজেকে প্রাইভেট গোয়েন্দা বলতে চান না। তিনি বলেন–জাস্ট একটুখানি কৌতূহল মাত্র। সেটা নিজের বুদ্ধিতে নিজেই মিটিয়ে নিই। এতে যদি পুলিশ এবং বিচার বিভাগের পক্ষে সাহায্য করা যায়, সেটা পরোক্ষ লাভ। আসলে এ আমার একটা বুদ্ধির খেলা। কতকটা তাসের পেশেন্স খেলার মতো।…
আমরা যে ঘরে উঠেছি, সেই ঘরেই রাত একটা পর্যন্ত প্রাথমিক জিজ্ঞাসাপর্ব চলল। প্রথমে ডাকা হল মাধবকে। তখন অবশ্য পুলিশ বাড়ি ঘিরে রেখেছে।
মাধব বিনীতভাবে নমস্কার করে দাঁড়াল।
মিঃ মালহোত্রা বললেন– বসুন মাধববাবু। আপনার পুরো নামধাম ইত্যাদি সবিস্তারে পরে দরকার হবে। আপাতত প্রিলিমিনারি ইনভেস্টিগেশান। আপনি অনুগ্রহ করে শুধু প্রশ্নের জবাব দিয়ে যান।
মাধব যেন একটু হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। ঘাবড়ে গিয়েছিল বেচারা। বলল– বলুন।
–আপনি জগাইকে মারধর করেছিলেন কেন?
মাধব উত্তেজিত হয়ে উঠল–আমি শুতে যাবার সময় নিচের ঘরের আলো নেভানো হয়েছে কি না–দরজা বন্ধ করা হয়েছে কি না দেখে নিই। আজ দেখি, আলো নিবিয়ে ব্যাটা সিঁড়ির কাছে ঘাপটি পেতে বসে রয়েছে। চোর ভেবে লাফিয়ে পড়লাম। তারপর উল্টে ও ব্যাটা আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে। দিল। তখন
কর্নেল হেসে উঠলেন–আপনি কোন্ ঘরে থাকেন মাধববাবু!
–নিচেই। ড্রইংরুমের পশ্চিমের লাগোয়া ঘরে।
মিঃ মালহোত্রা বললেন–ওই সুতো কে বেঁধে রেখেছিল জানেন কি?
–আজ্ঞে না। জানলে তো তখনই বলে দিতুম।
–আপনার হাত দুটো একবার দেখতে চাই মাধববাবু!
মাধব তার হাত দুটো টেবিলে বাড়িয়ে দিল। মি. মালহোত্রা একটা আতস কাঁচ নিয়ে ভালভাবে হাতদুটো পরীক্ষা করে দেখে বললেন–ঠিক আছে। আপনি আসুন।
এরপর এল জগাই। কাচুমাচু মুখে দাঁড়াল। কর্নেল বললেন-বসো জগাই!
জগাই বাড়ির চাকর। তাই চেয়ারে বসার সাহস পেল না। দাঁড়িয়ে রইল। মি. মালহোত্রা বললেন–আচ্ছা জগাই, ড্রইংরুমে তোমার সঙ্গে মাধববাবুর ধস্তাধস্তি হচ্ছিল কেন?
জগাই হাঁফাতে হাঁফাতে বলল–মাধববাবু লোকটা খুনে স্যার। আমি আলো নিভিয়ে সিঁড়ির কাছে সরে গেছি, আচমকা এসে ঝাঁপিয়ে আমার গলা টিপে ধরেছে!
থানার ওসি মুকুন্দ ওঝা হাসতে হাসতে বললেন–জাস্ট একটা ভুলবোঝাবুঝি আর কী!
জগাই বলল না স্যার। আমার গলা শুনেও তো বুঝেছে আমি চোর নই– তখনও তো ছাড়ছে না! আসলে বরাবর আমার ওপর প্রচণ্ড রাগ স্যার!
মি. মালহোত্রা বললেন–কেন?
–ওর ধারণা গিন্নিমাকে আমি ওর বিরুদ্ধে সাত-পাঁচ লাগাই।
হঠাৎ কর্নেল বললেন–জগাই, মালতী তোমার কেউ হয় শুনেছি।
জগাই ভ্যাবাচ্যাকা খেলে বলল–হ্যাঁ স্যার।
–কে হয়?
–মে-মেয়ে স্যার।
–মেয়ে! বল কী? গিন্নিমা জানতেন তো?
না স্যার! বলিনি।
–কেন?
–মালতীকে দশবছর আগে এবাড়িতে ঢুকিয়েছি। কিন্তু কর্তাগিন্নি জানতেন না আমার বউ-ছেলে-মেয়ে আছে। কর্তাগিন্নির ওই এক অদ্ভুত স্বভাব ছিল স্যার বাড়ির চাকরের বউ ছেলেমেয়ে থাকা পছন্দ করতেন না। ভাবতেন, মন বাড়িতে নিজের সংসারে পড়ে থাকলে ঠিকভাবে কাজ করবে না–চুরি-চামারি করবে। সে অনেক কথা স্যার!
–তাহলে রূপলাল, ননীঠাকুর, ব্রজঠাকুর–ওঁদেরও কারো বউ-ছেলেমেয়ে নেই জেনে এ বাড়িতে ঢোকানো হয়েছিল?
ঠিক বলেছেন স্যার।
–কিন্তু ওদের প্রত্যেকের বউ ছেলেমেয়ে আছে?
–আছে স্যার।
কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন–মিঃ মালহোত্রা, আমার আর জিজ্ঞাস্য নেই।
মি. মালহোত্রা বললেন–সিঁড়ির মুখে সুতো কে বেঁধেছিল জগাই?
-জানি না স্যার। আমি তো সন্ধ্যা থেকে নিচেই ছিলাম।
–তোমার হাত দুটো দেখি, জগাই!
যথারীতি হাত পরীক্ষা করে বিদায় দিলেন মিঃ মালহোত্রা। তারপর বললেনকর্নেল! মালতী যে জগাইয়ের মেয়ে, কীভাবে জানলেন?
জাস্ট অনুমান। দুজনের মুখের গঠনে কোথায় একটা মিল আছে। তাই আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ে দিলাম।
–ঢিলটা ব্যর্থ হয়নি! …বলে মিঃ মালহোত্রা হাসতে হাসতে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা একজন অফিসারকে বললেন-মালতীকে ডাকুন।
মালতী এল। চোখ দুটো লাল–ফুলো। নমস্কার করে দাঁড়াল। মিঃ মালহোত্রা বললেন-বসো মালতী!
মালতী বসল না। কর্নেল সস্নেহে বললেন–আচ্ছা মালতী, তুমি কোথায় শোও?
–গিন্নিমার পাশের ঘরে।
–আজ এই ঘটনার সময় তাঁর মানে গিন্নিমা বেরিয়ে সিঁড়ির মুখে আসার সময় তুমি কোথায় ছিলে?
–আমার ঘরে শুয়ে পড়েছিলাম।
–গিন্নিমা ঘর থেকে বেরুনোর পর বেরিয়েছিলে, জগাইয়ের চেঁচামেচি শুনে?
–গিন্নিমা বেরিয়ে যাওয়ার শব্দ শুনে বেরিয়েছিলাম।
–জগাইয়ের চেঁচানি শুনে বেরোওনি?
–আজ্ঞে না। এবাড়ির সবাই পাগল। যারা এসেছে, তারাও দেখছি পাগল। তাই বেরোইনি। মাধবদার সঙ্গে জগাইবুড়োর প্রায়ই ঝগড়াঝাটি হয় যে!
–কিন্তু জগাই তো তোমার বাবা!
মালতী চমকে উঠল। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।
কর্নেল একটু হেসে বললেন–তোমার বাবা সব স্বীকার করেছে মালতী!
মালতী তেমনি তাকিয়ে রইল। তারপর জোরে মাথা দুলিয়ে বলল– না। বাবা সুতো বেঁধে রাখেনি। আমিও রাখিনি। কী স্বীকার করবে বাবা?
মিঃ মালহোত্রা বললেন হাতদুটো দেখি মালতী।
মালতী ভয়ে ভয়ে হাত বাড়াল। মিঃ মালহোত্রা বললেন–ঠিক আছে তুমি এস। বাসু, শমিতাকে ডাকুন।
একটু পরে শমিতা স্মার্ট হয়ে ঢুকে পড়ল। তারপর বলল–দেখুন, আমি জানি–সুতো কে বেঁধেছে।
মালহোত্রা নড়ে বসলেন।–জানেন?
–হ্যাঁ। জানি, মানে এইমাত্র জানলাম। আমার দাদা গতরাত্রে–তখন রাত বারোটা হবে, বাইরে চাপা ঠকঠক শব্দ শুনেছিল। তখনই পেরেক দুটো পোঁতা হচ্ছিল। সুতো বেঁধেছে আজ রাতে আমরা শুতে যাবার পরে। কাকিমার রাতে বেরোনো অভ্যেস ছিল। ভেবেছিল বেরোলেই
বাধা দিয়ে মিঃ মালহোত্রা বললেন– আপনাকে আমাদের অন্য প্রশ্ন আছে, শমিতা!
–প্রশ্ন করতে হয়, করুন। কিন্তু আগে ননীঠাকুরকে গ্রেফতার করুন। ও সুতো বেঁধেছে।
তাই বুঝি?
–হ্যাঁ। গণ্ডগোলের সময় তো বেরোয়নি। একটু আগে দাদা ওর ঘরে গিয়ে মেঝেয় কালো রঙের একটা কৌটো পেয়েছে।
মিঃ মালহোত্রা সে কথায় আমল দিলেন না। বললেন–আপনি আজ সন্ধ্যার পর পুবদিকের ঝোপে টর্চ নিয়ে কী করছিলেন বলুন তো?
শমিতা চমকে উঠল। একটু চুপ করে থাকার পর বলল–কে বলেছে?
কর্নেল একটু হেসে বললেন–আমি দেখেছি, শমিতা।
শমিতা নার্ভাস হয়ে হাসবার চেষ্টা করল। বলল–আজ সকালে বিজনদা ওখানে কী করছিল দেখতে পেয়েছিলাম। তাই সন্দেহ হয়েছিল। বিজনদা হয়তো কাকিমার লুকুনো ডায়মন্ডটা চুরি করে ওখানে পুঁতে রেখেছিল। তাই–
–পরীক্ষা করতে গিয়েছিলে?
–আজ্ঞে হ্যাঁ।
–তেমন কিছু লক্ষ্য করেছিলে? কোন গর্ত বা কোন সন্দেহজনক কিছু?
না।
মিঃ মালহোত্রা, আমার আর জিজ্ঞাস্য নেই।
মিঃ মালহোত্রা যথারীতি শমিতার হাত দুটোও পরীক্ষা করলেন–তারপর বললেন–ঠিক আছে। আপনি আসুন। মিঃ বাসু, বিজনবাবুকে চাই।
শমিতা গেল, বিজন এল। সেও খুব স্মার্ট হয়ে বসে বলল–বলুন।
মালহোত্রা বললেন–আজ সকালে আপনি পুবদিকে বাগানে ঝোপের মধ্যে কী করছিলেন?
বিজন, একটুও চমকাল না! বলল–একটা ব্যাপারে লক্ষ্য রেখেছিলাম।
কী ব্যাপার?
–না শুনলে চলবে না? খুব প্রাইভেট ব্যাপার ব্যক্তিগত।
–প্রশ্নের জবাব আমি দাবি করব তবু।
–মালতী আর মাধবের মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে। ওরা ছাদে উঠে ব্যাপারটা অশ্লীল স্যার! ভেবেছিলাম কাকিমার কানে তুলব। কিন্তু
–ঠিক আছে। আপনার হাতটা পরীক্ষা করতে চাই, বিজনবাবু। বিজন হাত বাড়িয়ে বলল–স্বচ্ছন্দে।
সে চলে যাওয়ার পর এল ননীঠাকুর। মিঃ মালহোত্রা বললেন–তোমার ঘরে কালো রঙের পুরিয়া কোত্থেকে এল ননীঠাকুর?
ননীগোপাল হাউমাউ করে বলল–কে ফেলে দিয়েছে স্যার। নিশ্চয় কেউ আমাকে বিপদে ফেলার মতলব করেছে।
ঠিক এই সময় বাইরে একটা হট্টগোল শোনা গেল। তারপর দুজন পুলিশ অফিসার ব্রজঠাকুরকে টানতে টানতে ঘরে ঢোকালেন। মিঃ মালহোত্রা বললেন –কী ব্যাপার?
চুপিচুপি পালিয়ে যাচ্ছিল স্যার। ধরা পড়ে গেছে। সার্চ করে এই প্যাকেটটা পাওয়া গেল।
প্যাকেটটা খুলতেই ঘরের সবাই চমকে উঠলুম। ভেলভেটের ওপর বসানো একটা উজ্জ্বল পাথরের মতো সাদা জিনিস। তাহলে ওটাই সেই হীরে!
মিঃ মালহোত্রা বললেন–ব্রজবাবু! কী ব্যাপার বলুন তো?
ব্রজঠাকুরের মুখ সাদা। ঠোঁট কাঁপছে। বললস্যার!.খুলেই বলছি–আমি একটু আগে ওপাশের বারান্দায় কিছু পড়ার শব্দ শুনলুম। তখন বেরিয়ে গিয়ে দেখি প্যাকেটটা কেউ ফেলে দিয়েছে। তখন স্যার, খুলে ফেললাম চুপিচুপি। বুঝলাম–এটাই তাহলে সেই হীরে! তখন লোভ সামলাতে পারিনি স্যার!
মিঃ মালহোত্রা উঠে বললেন–চলো। কোথায় পড়েছিল দেখিয়ে দেবে।
সবাই ড্রয়িংরুম হয়ে পাশের করিডর দিয়ে পশ্চিমের বারান্দায় গেলাম। জায়গাটা দেখিয়ে দিল ব্রজঠাকুর। মিঃ মালহোত্রা সব দেখেশুনে বললেন ব্রজবাবুর কথা মানলে বলতে হয় এই ঘরটা থেকে কেউ প্যাকেট ফেলেছে। এ ঘরে কে থাকে?
ব্রজঠাকুর বলল–জগাই স্যার।
কর্নেল মিঃ মালহোত্রাকে ডেকে চুপিচুপি কিছু বললেন। তারপর দেখি মিঃ মালহো ওসি ভদ্রলোকের কানে কী বলছেন। তারপর পুলিশের মধ্যে একটা ব্যস্ততা পড়ে গেল।
কর্নেল আমার হাত ধরে বললেন–এস জয়ন্ত। আমরা ঘরে যাই। ওঁরা কাজ করুন।
অবাক হয়ে ওঁকে অনুসরণ করলাম। ঘরে গিয়ে দেখি কেউ নেই। কর্নেল বললেন–জয়ন্ত, ইচ্ছে করলে তুমি শুতে পারো। রাত আড়াইটে বাজে। আমি একটু পরে শুচ্ছি।
–কিন্তু ব্যাপারটা কী?
বুঝতে পারছ না? সে কী!
–সত্যি কর্নেল। কিছু বুঝছিনে।
মালতী মাধব আর জগাইকে গ্রেফতার করা হয়েছে এতক্ষণ। পুলিশের জেরার মুখে সব বেরিয়ে পড়বে। এ একটা সামান্য কেস। তবে দুর্ভাগ্যের বিষয়, মিসেস রায়চৌধুরীকে বাঁচাতে পারলাম না। আমি ভাবিইনি যে ওভাবে…
–আহা! খুলে বলুন না!
মালতী আর মাধবের মধ্যে প্রণয় আছে। জগাই হবু জামাই আর মেয়ের সাহায্যে সুপরিকল্পিতভাবে মিসেস রায়চৌধুরীকে সিঁড়ি থেকে ফেলে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করেছিল। তবে ওরা ভাবেনি হয়তো, ওতেই গিন্নিমা মারা পড়বেন। ওরা চেয়েছিল…জগাই আর মাধবের সাজানো সংঘর্ষ শুনে মিসেস রায়চৌধুরী বেরিয়ে আসুন এবং সুতোয় পা লেগে পড়ে যান। তখন ওরা সেই সুযোগে মিসেস রায়চৌধুরীকে ওঠাতে গিয়ে কোমরের কাছে রাখা চাবিটি হাতাবে। মালতী তৈরি ছিল। মিসেস রায়চৌধুরীর ঘরে কোন্ আলমারিতে হীরের প্যাকেট আছে, সে টের পেয়েছিল নিশ্চয়। কিন্তু আমরা থাকায় একটু অসুবিধেয় পড়েছিল ওরা। যদিও পরিকল্পনামতো চাবিটা ম্যানেজ করতে দেরি হয়নি।
সকালেই দুজনে বেরিয়ে পড়লাম। স্টেশনের দিকে যেতে যেতে কর্নেল বললেন–জগাই মালতীকে ওই উদ্দেশ্যেই এবাড়িতে এনেছিল। খুব সহজে কাজটা উদ্ধার হয়ে যেত। মিসেস রায়চৌধুরীর ভাশুরপোরা প্রত্যেকে সম্পত্তি হাতাতে চায়। কাজেই পরিবেশ পেয়েছিল অনুকূল। জগাই খুন করেও ফেলত মিসেস রায়চৌধুরীকে। কিন্তু আমি গিয়ে পড়ায় একটু ভড়কে যায়। তখন এইভাবে আছাড় খাইয়ে চাবি হাতানোর ফন্দি আঁটে।
বিরক্ত হয়ে বললাম–ছেড়ে দিন। বড় বাজে ব্যাপার। এতকাল কত জমকালো রহস্য ঘেঁটে আসার পর এই ব্যাপারটা আমার খুব ফিকে লাগছে।
কর্নেল একটু হেসে বললেন–জয়ন্ত, এটাও একটা জমকালো রহস্য হয়ে উঠতে পারত। যদি সত্যি মিসেস রায়চৌধুরীকে প্রত্যক্ষভাবে হত্যা করা হত, তাহলে কি জটিল রহস্য হয়ে উঠত না? দশজন সন্দেহজনক ব্যক্তি! ভেবে দেখ। কত জটিলতায় পড়ে যেতাম।
একটু চুপ করে থাকার পর বললেন–অবশ্য এটাও বেশ চমকপ্রদ। জগাই আর মাধব একটা দুর্দান্ত নাটক করে ফেলল! অথচ ওতেই আমার সন্দেহটা ওরা নিজেরাই খুঁচিয়ে জাগিয়ে দিল। কারণ কী জানো? চোর ভেবে মাধব জগাইয়ের ওপর সত্যি ঝাঁপিয়ে পড়লে অতক্ষণ চেঁচামেচি হবে কেন? আর বাঁচাও বাঁচাও বলে চেঁচামেচির কী যুক্তি আছে? ওতেই ওরা ধরা পড়ে গেছে।
কোন কথা বললাম না। কর্নেল এই কেসে কী কী ঘটতে পারত তাই নিয়েই বকবক করে গেলেন সমানে। আমার একটা কান অবশ্য সবটা শুনে যাচ্ছিল। সত্যি তো! এটা দারুণ প্যাঁচালো ব্যাপার হতে পারত। হল না এতেই বৃদ্ধ রহস্যভেদী নিরাশ হয়েছেন।