Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

সমস্ত গ্রামে রটিয়া গেল

সমস্ত গ্রামে রটিয়া গেল, রামেশ্বর চক্রবর্তীর ছোট ছেলে অহীন্দ্র ইন্দ্র রায়ের নাক কাটিয়া ঝামা ঘষিয়া দিয়াছে; ইন্দ্র রায় সাঁওতালদের আটক করিয়া রাখিয়াছিলেন, অহীন্দ্র জোর করিয়া তাহাদের উঠাইয়া লইয়া আসিয়াছে। রটনার মূলে ওই অচিন্ত্যবাবুটি! তিনি একটু আড়ালে দাঁড়াইয়া দূর হইতে যতটা দেখা ও শোনা যায়, দেখিয়া শুনিয়া গল্পটি রচনা করিয়াছিলেন। তিনি প্রচণ্ড একটা দাঙ্গা-হাঙ্গামার কল্পনা করিয়া সভয়ে স্থানত্যাগ করিয়াও নিরাপদ দূরত্বের আড়ালে থাকিয়া ব্যাপারটা দেখিবার লোভ সংবরণ করিতে পারেন নাই।

সাময়িক দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দিয়া ইন্দ্র রায়ও লজ্জিত হইয়াছিলেন। মুহূর্তের দুর্বলতার জন্য সকলে তাঁহার মাথায় যে অপমানের অপবাদ চাপিয়া দিল, সে অপবাদ সংশোধন করা এখন কঠিন হইয়া উঠিয়াছে। চক্রবর্তী-বাড়ির বড়ছেলে মহীন্দ্র এবং বিচক্ষণ নায়েব যোগেশ মজুমদার আসিয়া পৌঁছিয়া গিয়াছে। কাল রাত্রেই আসিয়া পৌঁছিয়াছে। আজ প্রাতঃকালে তাঁহার লোক সাঁওতাল-পাড়ায় গিয়া ফিরিয়া আসিয়া বলিল, আজ চক্রবর্তী-বাড়ির নায়েব সাঁওতালপাড়ায় বসে রয়েছেন, লোকজনও অনেকগুলি রয়েছে। আমরা সাঁওতালদের ডাকলাম, তাতে ওঁদের নায়েব বললেন, আমি ওদের সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছি, বলগে বাবুকে।

ইন্দ্র রায় গম্ভীর মুখে মাথা নত করিয়া পদচারণা আরম্ভ করিলেন, মনে মনে নিজেকেই বার বার ধিক্কার দিতেছিলেন। তিনি দিব্যচক্ষে দেখিলেন, ও-পারের চর ও তাঁহার মধ্যে প্রবহমাণা কালিন্দী অকস্মাৎ আকূল পাথার হইয়া উঠিয়াছে। কিছুক্ষণ পরেই মজুমদার আসিয়া উপস্থিত হইল, তাহার পিছন পিছন সাঁওতালরাও আসিয়া প্রণাম করিয়া দাঁড়াইল। মজুমদার রায়কে প্রণাম করিয়া বলিল, ভাল আছেন?

রায় ইষৎ হাসিয়া বলিলেন, হ্যাঁ। তার পর বলিলেন, কি রকম? আবার নাকি চক্রবর্তীরা সাঁওতালদের নিয়ে দেশ জয় করবে শুনছি?

তাঁহারই কথার কৌতুকে হাসিতেছে, এমনি ভঙ্গিতে হাসিয়া মজুমদার বলিল, এসে শুনলাম সব। তা আমাদের ছোটবাবু অনেকটাই ওঁর পিতামহের মত দেখতে, এটা সত্যি কথা।

রায় ঠোঁট দুইটি ঈষৎ বাঁকাইয়া বলিলেন, তা সাঁওতালবাহিনী নিয়ে লড়াইটা প্রথম আমার সঙ্গেই করবে নাকি তোমরা?

লজ্জায় জিভ কাটিয়া মজুমদার বলিয়া উঠিল, রাম রাম রাম, এই কথা কি হয়, না হ’তে পারে? তা ছাড়া আপনার অসম্মান কি কেউ এ-অঞ্চলে করতে পারে বাবু?

রায় চুপ করিয়া রহিলেন, মজুমদার আবার বলিল, সেই কথাই হচ্ছিল কাল ওবাড়ির গিন্নীঠাকরুনের সঙ্গে। তিনি বলিলেন, এ-বিবাদ গ্রাম জুড়ে বিবাদ। এখনও কেউ এগোয় নি বটে, কিন্তু বিবাদ আরম্ভ হ’লে কেউ পেছিয়ে থাকবে না। আমি সেইজন্যে অহিকে ও-বাড়ির দাদার কাছে পাঠিয়েছিলাম। কাল তুমি একবার যাবে মজুমদার ঠাকুরপো, বলবে, তাঁর মত লোক বর্তমান থাকতে যদি এখন গ্রামনাশা বিবাদ বেঁধে ওঠে, তবে তার চেয়ে আর আক্ষেপের বিষয় কিছু হতে পারে না।

রায় শুধু বলিলেন, হুঁ।

মজুমদার আবার বলিল, আমাদের বড়বাবু– মহীন্দ্রবাবু একটু তেজিয়ান; অল্প বয়স তো! তিনি অবশ্য বলছিলেন, মামলা-মকদ্দমাই হোক; যার ন্যায্য হবে, সেই পাবে চর। আমাকেও বললেন, সাঁওতালদের কারও ডাকে যেতে নিষেধ করতে। কিন্তু গিন্নী-ঠাকরুন বললেন, তাই কখনও হতে পারে? আর আমাদের অহীন্দ্রবাবু তো অন্য প্রকৃতির ছেলে, তিনি বললেন, তা হ’তে পারে না দাদা, আমি মামাকে বলে তাদের ছুটি করিরে দিয়েছি। কড়ার করে ছুটি করিরে দিয়েছি, তিনি ডাকলেই ওদের যেতে হবে। আমি নিজে ওদের ওখানে হাজির করে দেব। তিনি নিজেই আসতেন, তা আজ স্কুল খুলবে, ভোরেই চলে গেলেন শহরে।

রায় একটু অন্যমনস্ক হইয়া উঠিলেন, এই ছেলেটি তাঁহার কাছে যেন একটা জটিল রহস্যের মত হইয়া উঠিয়াছে। আজ সমস্ত সকালটাই তিনি ওই ছেলেটির সম্পর্কে ভাবিয়াছেন, অদ্ভুত কুটবুদ্ধি ছেলেটির। সেদিনের মশালের আলো জ্বলিয়া সে যখন যায়, তখনও তিনি সেই কথাই ভাবিতেছিলেন। কিন্তু প্রত্যেক বারই ছেলেটি তাঁহাকে লজ্জিত করিয়া সহাস্যমুখে আসিয়া দাঁড়াইতেছে।

মজুমদার বলিল, আপনার মত ব্যক্তিকে আমার বেশী বলাটা ধৃষ্টতা। গ্রাম জুড়ে বিবাদ হ’লে তো মঙ্গল কারু হবে না। এদিকে কাগজপত্র, কার কি স্বত্ব, এখানকার সমস্ত হাল হদিস আপনার নখদর্পণে, আপনিই এর বিচার করে দিন।

রায় বলিলেন, রামেশ্বরের ছোট ছেলেটি সত্যিই বড় ভাল ছেলে। ক্ষুরের ধারের মত স্বচ্ছন্দে কেটে চলে, কোথাও ঠেকে যায় না। ছেলেটি ওদের বংশের মতও নয় ঠিক, চক্রবর্তীবংশের চুল কটা, চোখ কটা, কিন্তু গায়ের রংটা তামাটে। এ ছেলেটি বোধ হয় মায়ের রং পেয়েছে, না হে?

মজুমদার বলিল, হ্যাঁ, গিন্নী-ঠাকরুন আমাদের রূপবতী ছিলেন এক কালে, আর প্রকৃতিতেও বড় মধুর। ছেলেটি মায়ের মতই বটে, তবে আমাদের কর্তাবাবুর বাপের রং ছিল এমনি গৌরবর্ণ!

হ্যাঁ, সাঁওতালেরা সেইজন্যেই তাঁর নাম দিয়েছিল-রাঙাঠাকুর। একেও নাকি সাঁওতালেরা নাম দিয়েছে রাঙাবাবু?

মাঝির দল এতক্ষণ চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া ছিল, এবার সর্দার কমল মাঝি বলিল, হুঁ, আমি দিলাম সি নামটি। রাঙাঠাকুরের লাতি, তেমূনি আগুনের পারা গায়ের রং-তাথেই আমি বললাম, রাঙাবাবু।

রায় গম্ভীরভাবে চুপ করিয়া রহিলেন, সাঁওতালের কথার উত্তর তিনি দিলেন না। সুযোগ পাইয়া মজুমদার আবার বর্তমান প্রসঙ্গ উত্থাপন করিয়া বলিল, তা হ’লে সেই কথাই হ’ল। গ্রামের সকল শরিককে ডেকে চণ্ডীমণ্ডপে বসে এর মীমাংসা হয়ে যাক। চর যাঁর হবে তিনিই খাজনা নেবেন ওদের কাছে। ওরা এখন যা গরীব দুঃখী লোক, যতক্ষণ খাটবে ততক্ষণ ওদের অন্ন।–বলিয়া রায় কোন কথা বলিবার পূর্বেই মজুমদার মাঝিদের বলিয়া দিল, যা, তাই তোরা এখন বাড়ি গিয়ে আপন আপন কাজকর্মে করগে। আমরা সব নিজেরা ঠিক করি কে খাজনা পাবে, তাকেই তোরা কবুলতি দিবি, খাজনা দিবি।

মাঝির দল প্রণাম করিয়া তাহাদের নিজস্ব ভাষায় বোধ করি এই প্রসঙ্গ লইয়াই কলকল করিতে করিতে চলিয়া গেল। রায় গম্ভীর মুখে একই দিকে দৃষ্টি রাখিয়া বসিয়া ছিলেন বসিয়া রহিলেন। সাঁওতালের দল বাহির হইয়া গেলে তিনি বলিলেন, সেই ভাল মজুমদার, ও বেচারাদের কষ্ট দিয়ে লাভ কি, যাক ওরা। আগে এই বিবাদের মীমাংসাই হয়ে যাক

আজ্ঞে হ্যাঁ, একদিন গ্রামের সমস্ত শরিককে ডেকে

বাধা দিয়া রায় বলিলেন, শরিকরা তো তৃতীয় পক্ষ, সর্বাগ্রে হোক ছোট তরফ আর চক্রবর্তীদের মধ্যে।

বেশ, তাই হোক। একদিন প্রমাণ-প্রয়োগ দেখুন, তাতে যা বলে দেবেন, তাই হবে।

না। একদিন প্রমাণী লাঠি প্রয়োগ করে, তাতে শক্তিতে যার হবে, সেই নেবে চর। তারপর মামলা মকদ্দমা পরে কথা।

হাতজোড় করিয়া মজুমদার বলিল, না না বাবু, এ কথা কি আপনার মুখে সাজে? আপনি হলেন ও বাড়ির মুরব্বী; ছেলেদের

বাধা দিয়া রায় বলিলেন, ও কথা বলো না মজুমদার। বার বার আমার অপমান তুমি ক’রো না। ওকথা মনে পড়লে আমার বুকের ভেতর আগুন জ্বলে ওঠে।

মজুমদার স্তব্ধ হইয়া গেল; কিছুক্ষণ পর আবার সবিনয়ে বলিল, আপনি বিজ্ঞ বিবেচক ব্যক্তি, বড়লোক; আপনার চাকর বলেই সাহস করে বলছি, এ আগুন কি জ্বেলে রাখা ভাল বাবু?

অস্থির হইয়া বার বার ঘাড় নাড়িয়া রায় বলিল, রাবণের চিতা মজুমদার ও নিববে না, নেববার নয়।

মজুমদার আর কথা না বাড়াইল না, তাহার চিত্তও ক্ষুব্ধ হইয়া উঠিয়াছিল। আপন প্রভুবংশের মানমর্যাদা আর সে খাটো করিতে পারিল না, সবিনয়ে হেঁট হইয়া রায়কে প্রণাম করিয়া এবার বলিল, আজ্ঞে বেশ। আপনি যেমন আদেশ করলেন, তেমনি হবে।

রায় বলিলেন, ব’সো। বেলা অনেক হয়েছে, একটু শরবৎ খেয়ে যাও। না খেলে আমি দুঃখ পাব মজুমদার।

মজুমদার আবার আসন গ্রহণ করিয়া বলিল, আজ্ঞে, এ তো আমার চেয়ে খাবার ঘর।

মজুমদার চলিয়া গেল। রায় গভীর চিন্তায় মগ্ন হইয়া গেলেন। কুক্ষণে অহীন্দ্র তাঁহার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল। রাধারাণীর সুপ্ত স্মৃতি সুপ্তি ভাঙিয়া জাগিয়া উঠিয়াছে। সঙ্গে সঙ্গে চক্রবর্তীদের উপর দারুণ আক্রোশে ও ক্রোধে তিনি ফুলিয়া ফুলিয়া উঠিতেছেন। রামেশ্বরের মস্তিষ্কবিকৃতি দৃষ্টি রুগ্ন হওয়ার পর তিনি শান্ত হইয়াছিলেন। আবার ওই চর উপলক্ষ্য করিয়া অহীন্দ্র তাঁহার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইতেই সে আক্রোশ আবার জাগিয়া উঠিয়াছে। রাধারাণীর সপত্নীপুত্রের জন্য তিনি পথ ছাড়িয়া দিবেন? আজ এই ছেলেটি যদি রাধারাণীর হইত, তবে অমনি দ্বন্দের অভিনয় করিয়া তিনি গোপনে হাসিতে হাসিতে পরাজয় স্বীকার করিয়া ঘরে ঢুকিতেন। লোকে বলিত ইন্দ্র রায় ভাগিনেয়ের কাছে পরাজিত হইল। এ ক্ষেত্রে, পরাজয়ে রাধারাণীর গৃহত্যাগের লজ্জা দ্বিগুণিত হইয়া লোকসমাজে তাঁহার মাথাটা ধুলায় লুটাইয়া দিবে। আর তাঁহার সরিয়া দাঁড়ানোর অর্থই হইল রাধারাণীর সপত্নীপুত্রের পথ নিষ্কন্টক করিয়া দেওয়া।

অচিন্ত্যবাবু রায়বাড়ির ভিতর হইতেই বাহির হইয়া আসিলেন। রায়ের দশ বৎসরের কন্যা উমাকে তিনি পড়াইয়া থাকেন। উমাকে পড়াইয়া কাছারিতে আসিয়া রায়ের সম্মুখে তক্তপোশটার উপর বসিয়া বলিলেন, চমৎকার একটা প্ল্যান করে ফেলেছি রায় মশায়। দেশী গাছ গাছড়া সাপ্লাইয়ের ব্যবসা। চরটার ওপর নাকি হরেক রকমের গাছগাছড়া আছে। যা শুনলাম, তাতে শতকরা দু’শ লাভ। দেখবেন নাকি হিসেবটা

থাক এখন।

আচ্ছা, থাক। আর ভাবছি, পাঁচ রকম মিশিয়ে অম্বলের ওষুধ একটা বের করব। বাংলাদেশে এখন অম্বলটাই, মানে ডিসপেপ্ সিয়াটাই হ’ল প্রধান রোগ।

রায় ওকথা গ্রাহ্যই করিলেন না, তিনি ডাকিলেন নায়েবকে, মিত্তির! একবার ননীচোরা পালকে তলব দাও তো, বল জরুরী দরকার। আর–আচ্ছা, আমিই যাচ্ছি ভেতরে। রায় উঠিয়া কাছারি-ঘরের ভিতর চলিয়া গেলেন। নায়েবকে বলিলেন, দুখানা ডেমিতে একটা বন্দোবস্তির পাট্টাকবুলতি করে ফেল। আমরা ননী পালকে কুড়ি বিঘে চর বন্দোবস্ত করছি। ননী আমাদের বরাবর কবুলতি দিচ্ছে।

নায়েব বলিল, যে আজ্ঞে।

ননী পাল একজন সর্বস্বান্ত চাষী। দাঙ্গা-হাঙ্গামায়, ফৌজদারি মকদ্দমায় তাহার যথাসর্বস্ব গিয়াছে, জেলও সে কয়েকবার খাটিয়াছে। এখন করে পানবিড়ি-মুড়ি-মুড়কির দোকান। লোকে বলে, চোরাই মালও নাকি সে সামলাইয়া থাকে, বিশেষ করিয়া চোরাই ধান। একবার দারোগার নাকে কিল মারিয়া সে তাহার নাকটা ভাঙিয়া দিয়াছিল, একবার দুই আনা ধারের জন্য রায়েদেরই ফুলবাড়ির একটি ছেলের সহিত বচসা করিয়া তাহার কান দুইটা মলিয়া দিয়া বলিয়াছিল, এতেই আমার দুআনা শোধ হ’ল। এমনি প্রকৃতির লোক ননীচোরা পাল। রায় কন্টক দিয়া কন্টক তুলিবার ব্যবস্থা করিলেন। বিশ বিঘা জমির জন্য তাঁহাকে জমিদার স্বীকার করিয়া চক্রবর্তীদের সহিত বিবাদ করিতে ননী বিন্দুমাত্র দ্বিধা করিবে না।

এই লইয়া আরও দুই-চারিটি কথা বলিয়া রায় বাহিরে আসিলেন। অচিন্ত্যবাবু তখন কাছারিবাড়ি হইতে বাহির হইয়া যাইতেছিলেন, রায় বলিলেন, চললেন যে?

অচিন্ত্যবাবু সংক্ষেপে বলিলেন, হ্যাঁ।

রায় হাসিয়া বলিলেন, বসুন বসুন, আপনার প্ল্যানটা শোনা যাক।

আজ্ঞে না, দুর্জন আসবার আগেই স্থান ত্যাগ করা ভাল। ননী পালটা বড় সাংঘাতিক লোক। ব্যাটা মেরে বসে!

পাগল নাকি আপনি? দেখছেন, দেওয়ালে কখানা তলোয়ার ঝুলছে?

শিহরিয়া উঠিয়া অচিন্ত্যবাবু বলিলেন, খুলে ফেলুন, খুলে ফেলুন, ওগুলো বড় সাংঘাতিক জিনিস। বাঙালির হাতে অস্ত্র, গভর্মেন্ট অনেক বুঝেই আইন ক’রে কেড়ে নিয়েছে। ওগুলোর লাইসেন্স আছে তো আপনার?

বলিতে বলিতেই তিনি বাহির হইয়া গেলেন। অল্পক্ষণ পরেই কন্যা উমা আপন মনেই হারাধনের দশটি ছেলের ছড়া বলিতে বলিতে আসিয়া ওই ছড়ার সুরেই বলিল, বাবা, আপনাকে মা ডাকছেন, বেলা অনেক হয়েছে স্নান করুন।–বলিয়া খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল। আবার হাসি থামাইয়া গম্ভীরভাবে বলিল, কানে কানে একটা কথা বলি বাবা।

উমা মেয়েটি একটু তরঙ্গময়ী। রায় তাহার মুখের কাছে কান পাতিয়া দিলেন। সে ফিসফিস করিয়া বলিল, প-অন্তস্থায়- দন্ত্য সয়ে আকার।

হাসিয়া রায় বলিলেন, আচ্ছা আচ্ছা তুমি বাড়ির মধ্যে চল, আমার যেতে একটু দেরি হবে, তোমার মাকে বল গিয়ে।

উমা প্রশ্ন করিল, কয়ে একার দন্ত্য ন?

কাজ আছে মা।

না, চলুন আপনি।

ছি! ওরকম করে না, কাজ আছে শুনছ না? ওই দেখ লোক এসেছে কাজের জন্যে।

ননী পাল আসিয়া একটি সংক্ষিপ্ত প্রণাম করিয়া দাঁড়াইল। বেঁটেখাটো লোকটি, লোহার মত শক্ত শরীর, চওড়া কপালের নীচেই নাকের উপর একটা খাঁজ; ওই খাঁজটা একটা নিষ্ঠুর হিংস্র মনোভাব তাহার মুখের উপর ফুটাইয়া তুলিয়াছে।

গ্রামে কিন্তু ততক্ষণে ননী পালকে জমি-বন্দোবস্তের সংবাদ রটিয়া গিয়াছে। অচিন্ত্যবাবু গাছগাছড়ার ব্যবসার কল্পনা পরিত্যাগ করিয়া ফেলিয়াছেন।–সর্বনাশ, চরের উপর ব্যাটা কোন্ দিন খুন ক’রেই দেবে আমাকে।

.

হেমাঙ্গিনী স্বামীর জন্য প্রতীক্ষা করিয়া বসিয়া ছিলেন। কাজ শেষ করিয়া স্নান সারিয়া রায় যখন ঘরে প্রবেশ করিলেন, তখন প্রায় দুপুর গড়াইয়া গিয়াছে। স্বামীর পূজা-আহ্নিকের আসনের পাশে বসিয়া বাহিরের দিকে চাহিয়া হেমাঙ্গিনী কি যেন ভাবিতেছিলেন। রায়কে দেখিয়া বলিলেন, এত বেলা কি করে! খাবেন কখন আর?

রায় পত্নীর মনোরঞ্জনের জন্যই অকারণে একটু হাসিয়া বলিলেন, হ্যাঁ, দেরি একটু হয়ে গেল। জরুরী কাজ ছিল একটা।

বেশ, স্নান-আহ্নিক সেরে নাও দেখি আগে। এখন পর্যন্ত বাড়ির কারও খাওয়া হয় নি। উমাই কেবল খেয়েছে

স্নান সারিয়া রায় আহ্নিকে বসিলেন। তারা, তারা মা!

আহারাদির পর শয্যায় শুইয়া গড়গড়ায় মৃদু মৃদু টান দিতেছিলেন। সমস্ত বাড়িটা একরূপ নিশ্চিন্ত হইয়াছে। বাহিরে চৈত্রের রৌদ্র তরল বহ্ন্যুত্তাপের মত অসহ্য না হইলেও প্রখর হইয়া উঠিয়াছে, পাখিরা এখন হইতেই এ সময় ঘনপল্লব গাছের মধ্যে বিশ্রাম শুরু করিয়া দিয়াছে। বাড়ির বারান্দায় মাথায় ঘুলঘুলিতে বসিয়া পায়রাগুলি গুঞ্জন করিতেছে। মধ্যে মধ্যে রুদ্ধদ্বার জানলায় খড়খড়ি দিয়া উত্তপ্ত এক-একটা দমকা বাতাস আসিতেছে; উত্তপ্ত বাতাসের মধ্যে বয়রা ও মহুয়া ফুলের উগ্র মাদক গন্ধ। বাহিরে ঝরঝর সরসর শব্দে বাতাসে ঝরা পাতা উড়িয়া চলিয়াছে। সূর্য আর পবন দেবতার খেলা চলিতেছে বাহিরে। দুইটি কিশোরের মিতালির লীলা।

হেমাঙ্গিনী ভাঁড়ারে ও লক্ষ্মীর ঘরে চাবি দিয়া আসিয়া স্বামীর শয্যার পার্শ্বে বসিলেন। রায় প্রশ্ন করিলেন, সারা হ’ল সব?

হ’ল।

খুব ক্ষিদে পেয়েছিল, তোমার, না?

হ্যাঁ, খুব। মনে হচ্ছিল, বাড়ির ইঁট-কাট ছাড়িয়ে খাই-হ’ল তো?

রায় হাসিয়া বলিলেন, রাগটুকু আছে খুব!

হেমাঙ্গিনী বলিলেন, দেখ, একটা কথা বলছিলাম।

বল।

বলছিলাম, আর কেন?

রায় ওইটুকুতেই সব বুঝিলেন, তিনি একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া পাশ ফিরিয়া শুইলেন, কোন উত্তর দিলেন না। রামেশ্বরের প্রতি হেমাঙ্গিনীর স্নেহের কথা তিনি জানেন। সে স্নেহ হেমাঙ্গিনী আজও ভুলিতে পারেন নাই।

হেমাঙ্গিনী একটু অপ্রতিভের মতই বলিলেন, মুখ ফিরিয়ে শুলে যে? ভাল, ও কথা আর বলব না! এখন আর একটা কথা বলি, শোন। এটা আমার না বললেই নয়।

ফিরিয়াই রায় বলিলেন, বল।

দৃঢ়তার সহিত হেমাঙ্গিনী বলিলেন, বিবাদ করবে, কর, কিন্তু অন্যায় অধর্ম তুমি করতে পাবে না। আমার অনেকগুলি সন্তান গিয়ে অবশিষ্ট অমল আর উমা; ওদের অমঙ্গল আমি হ’তে দিতে পারব না।

রায় এবার সঙ্কুচিত হইয়া পড়িলেন। তাঁহার কয়েকটি সন্তানই শৈশব অতিক্রম করিয়া বালক হইয়া মারা গিয়াছে। তাহাদের অকালমৃত্যুর হেতু বিশ্লেষণ করিতে বসিয়া হেমাঙ্গিনী যখন তাহার পাপপুণ্যের হিসাব করিতে বসেন, তখন তাঁহার মাথাটা যেন মাটিতে ঠেকিয়া যায়।

হেমাঙ্গিনী বলিলেন, আমাকে ছুঁয়ে তুমি শপথ কর, কোন অন্যায় অধর্ম তুমি করবে না?

রায় দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, কেন তুমি প্রতি কাজে ওই কথা স্মরণ করিরে দাও, বল তো?

রুদ্ধকণ্ঠে হেমাঙ্গিনী বলিলেন, এতগুলো সন্তান যাওয়ার দুঃখ যে রাবণের চিতার মত আমার বুকে জ্বলছে। তুমি ভুলেছ, কিন্তু আমি তো ভুলতে পারি না। তাই তোমাকে মনে করিয়ে দিতে হয়।

রায় উঠিয়া বসিলেন, জানলাটা খুলে দাও দেখি। বেলা বোধ হয় পড়ে এল।

হেমাঙ্গিনী জানলা খুলিয়া দিলেন, রোদ অনেকটা পড়িয়া আসিয়াছে, পাখিরা থাকিয়া থাকিয়া সমবেত স্বরে ডাকিয়া উঠিতেছে, বিশ্রাম তাহাদের শেষ হইয়া গেল- এ ইঙ্গিত তাহারই। রায় জানলা দিয়া নদীর ওপারে ওই চরটার দিকে চাহিয়া ভাবিতে ছিলেন ওই কথাই। অমল-উমা, রাধারানী-রামেশ্বর, রায়-বাড়ি। এ কি দ্বিধার মধ্যে তাঁহাকে টানিয়া আনিয়া নিক্ষেপ করিল হেমাঙ্গিনী!

হেমাঙ্গিনী বলিলেন, বল।

রায় দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, তাই হবে। তিনি স্থির করিলেন, অপরাহ্নেই ননীকে ডাকাইয়া পাট্টা কবুলতি স্বহস্তে নাকচ করিয়া দিবেন।

হেমাঙ্গিনী চোখ মুছিতে মুছিতে বাহির হইয়া গেলেন, বোধ করি আবেগ তাঁর ধৈর্য্যের কূল ছাপাইয়া উঠিতে চাহিতেছিল। রায় নীরবে ওই চরের দিকে চাহিয়াই বসিয়া রহিলেন। মনটা কেমন উদাস হইয়া গিয়াছে। দীপ্ত সূর্যালোকের কালীর বালি ঝিকমিক করিতেছে। চরের উপরে বেনাঘাস দমকা বাতাসে হাজার হাজার সাপের ফণার মত নাচিতেছে। আকাশ ধূসর। এত বড় প্রান্তরের মধ্যে কোথাও একটা মানুষ দেখা যায় না। অথচ মাটি লইয়া মানুষের কাড়াকাড়ি সেই সৃষ্টির আদিকাল হইতে চলিয়া আসিতেছে, কোন কালেও বোধ করি এ কাড়াকাড়ির শেষ হইবে না। নাঃ, ভাল বলিয়াছে হেমাঙ্গিনী-কাজ নাই; রায়হাটের সঙ্গে রায়বাড়ি না হয় কালীর গর্ভেই যাইবে। ক্ষতি কি!

হেমাঙ্গিনী ফিরিয়া আসিলেন, অত্যন্ত সহজ স্বাভাবিকভাবে বলিলেন, অমলকে টাকা পাঠিয়েছ?

অমল মামার বাড়িতে থাকিয়া পড়ে। রায় অন্যমনস্কভাবেই বলিলেন, পাঠিয়েছি।

দেখ।

বল।

এ দিকে ফিরেই চাও। দোষ তো কিছু করি নি আমি।

অল্প একটু হাস্যের সহিত মুখ ফিরাইয়া রায় বলিলেন, না, তুমি ভালই বলেছ। আর কি হুকুম, বল?

উমাকে আমি দাদার ওখানে পাঠিয়ে দেব। শহরে থেকে একটু লেখাপড়া শিখবে, একটু সহবৎ শিখবে। জামাই আমি ভাল করব। এখানে থাকলে গেঁয়ো মেয়ের মত ঝগড়া শিখবে, আর যত রাজ্যের পাকামো।

রায় বলিলেন, হ্যাঁ, রায়-বাড়ির মেয়ের অখ্যাতিটা আছে বটে। তাঁহার মুখে এক বিচিত্র করুণ হাসি ফুটিয়া উঠিল। মনে পড়িয়া গেল সেদিনের কথা, রামেশ্বরের পিতামহী বলিয়াছিলেন রাধারানীর প্রসঙ্গে, রায় বাড়ির মেয়ের ধারাই ওই, চিরকেলে জাঁহাবাজ!

হেমাঙ্গিনী স্বামীর মুখের দেখিয়া বুঝিলেন, স্বামী কথাটায় আহত হইয়াছেন, তিনি অপ্রতিভ হইয়া স্বামীর মনোরঞ্জনের জন্য ব্যাকুল হইয়া দুই হাতে তাঁহার গলা জড়াইয়া ধরিয়া বলিলেন, রাগ করলে?

পত্নীর কণ্ঠে সাদরে একখানি হাত ন্যস্ত করিয়া রায় তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, না না, তুমি সত্য কথা বলেছ।

প্রৌঢ়-দম্পতির উভয়ের চোখে অনুরাগভরা দৃষ্টি। কিন্তু সহসা চমকাইয়া উঠিয়া দুইজনেই পরস্পরকে ছাড়িয়া দিলেন। এ কি, এত গোলমাল কিসের? গ্রামের মধ্যে কোথাও একটা প্রচণ্ড কলরব উঠিতেছে! কোথাও আগুন লাগলো নাকি? রায় বিছানা ছাড়িয়া নামিয়া ব্যস্ত হইয়া কাপড় চোপড় ছাড়িতে আরম্ভ করিলেন।

কর্তাবাবু!–নীচে কে ডাকিল, নায়েব মিত্র বলিয়াই মনে হইতেছে।

কে? মিত্তির?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

গোলমাল কিসের মিত্তির?

আজ্ঞে, রামেশ্বরবাবুর বড় ছেলে মহীন্দ্রবাবু ননী পালকে গুলি করে মেরে ফেলেছেন।

রায় কাপড় পরিতেছিলেন, সহসা তাঁহার হাত স্তব্ধ হইয়া গেল, তিনি অদ্ভুত দৃষ্টিতে হেমাঙ্গিনীর মুখের দিকে চাহিলেন। হেমাঙ্গিনীর চোখ দিয়া জল ঝরিয়া পড়িতেছিল, তিনি বলিলেন, তুমি করলে কি? ছি ছি!

রায় দ্রুতপদে নামিয়া গেলেন।

.

০৭.

মহীন্দ্র যোগেশ মজুমদারকে সঙ্গে লইয়া, পূর্বদিন রাত্রেই আসিয়া পৌঁছাইয়াছিল। বার্তা নাকি বায়ুর আগে পৌঁছিয়া থাকে- এ কথাটা সম্পূর্ণ সত্য না হইলেও মিথ্যা বলিয়া একেবারেই অস্বীকার করা চলে না। পঞ্চাশ মাইল দূরে বর্হিজগতের সহিত ঘনিষ্ঠসম্পর্কহীন একখানি পল্লীগ্রামেও কেমন করিয়া কথাটা গিয়া পৌঁছিল, তাহা ভাবিলে সত্যই বিস্মিত হইতে হয়। সুনীতির পত্রও তখন গিয়া পৌঁছে নাই। সরীসৃপ-সঙ্কুল জঙ্গলে পরিপূর্ণ চরটার নাকি সাঁওতালরা আসিয়া সব সাফ করিয়া ফেলিয়াছে, আশেপাশের চাষীরা নাকি চরের মাটি দেখিয়া বন্দোবস্ত লইবার জন্য পাগল হইয়া উঠিয়াছে; এমন কি শহর-বাজার হইতে সঙ্গতিপন্ন লোকেও চরের জমি বন্দোবস্ত পাইবার জন্য প্রচুর সেলাম দিতে চাহিতেছে-এমনিধারা স্ফীত-কলেবর অনেক সংবাদ। শেষ এবং সর্বাপেক্ষা গুরুতর সংবাদ-চর দখল করিবার জন্য রায়-বংশীয়েরা কৌরবের মত একাদশ অক্ষৌহিনী সমাবেশের আয়োজন করিতেছে; চক্রবর্তী-বাড়ির কাহাকেও নাকি ও-চরের মাটিতে পদার্পণ করিবার পর্যন্ত অধিকার দেওয়া হইবে না।

উত্তেজনায় মহীন্দ্র উৎসাহিত হইয়া উঠিল। এই ধরনের উত্তেজনায় মহীন্দ্রের যেন একটা অধীরতা জাগিয়া উঠে। সে মজুমদারকে বলিল, থাক এখানকার কাজ এখন। চলুন আজই বাড়ি যাব।

মজুমদার বলিল, সেখান থেকে একটা সংবাদ আসুক, সেখানে যখন মা রয়েছেন

মহীন্দ্র বিরক্ত হইয়া বলিল, মা কখনও সংবাদ দেবেন না, তিনি এসব বোঝেনই না, তা ছাড়া তাঁর একটা ভয়ঙ্কর ভয়-বিবাদ হবে। চরে একবার খানকয়েক লাঙল ফেরাতে পারলেই আমাদের কঠিন মামলায় পড়তে হবে। তখন সেই টাইটেল সুটে যেতে হবে।

মজুমদার আর আপত্তি করিতে পারিল না, সেই দিনই তাহারা রওনা হইয়া প্রায় শেষরাত্রে বাড়ি আসিয়া পৌঁছিল। অহীন্দ্র এবং সুনীতির কাছে চরের বৃত্তান্ত শুনিয়া মহীন্দ্র খুশী হইয়া উঠিল। মজুমদার হাসিয়া বলিল, তবে তো ও আমাদের হয়েই গিয়েছে; সাঁওতালরা যখন রাঙাবাবুকে ছাড়া খাজনা দেবে না বলেছে, তখন তো দখল হয়েই গেল। চরটায় নাম দিতে হবে কিন্তু রাঙাবাবুর চর, সেরেস্তাতে আমরা ওই বলেই পত্তন করব।

মহীন্দ্র বলিল, না, ঠাকুরদার নামেই হোক-রাঙাঠাকুরের চর। আর কাল সকালেই চাপরাসী নিয়ে যান ওখানে, বলে দিন সাঁওতালদের, কেউ যেন রায়েদের ডাকে না যায়। যে যাবে তার জরিমানা হবে, তাতে রায়েরা জোর করে, আমরা তার প্রতিকার করব।

অহীন্দ্র এবার বলিল, না, সে হবে না দাদা। মহীন্দ্রকে সে ভয় করে, কিন্তু এ-ক্ষেত্রে সে চুপ করিয়া থাকিতে পারিল না।

মহীন্দ্র রুক্ষদৃষ্টিতে তাহার দিকে চাহিয়া বলিল, কেন?

আমি ও-বাড়ির মামার কাছে কথা দিয়েছি

ও-বাড়ির মামা? কে ও-বাড়ির মামা? ইন্দ্র রায় বুঝি? সম্বন্ধটা পাতিয়ে দিয়েছেন বুঝি মা? বাঃ চমৎকার!

সুনীতি অহীন্দ্র দুজনেই নীরব হইয়া এ তিরস্কার সহ্য করিলেন। মহীন্দ্র আবার বলিল, তারপর-কথাই বা কিসের? আমাদের ন্যায্য সম্পত্তি, তিনি আমার অনুপস্থিতিতে সাঁওতালদের হুমকি দিয়ে দখল ক’রে নেবেন, আর তুমি একটা দুগ্ধপোষ্য বালক, তুমি না জেনে কথা দিয়েছ, সে কথা আমায় মানতে হবে?

অহীন্দ্র আবার সবিনয়ে বলিল, ওঁরাও তো বলেছেন, চর আমাদের।

ওঁরা যদি কাল এসে বলেন, এই বাড়িখানা আমাদের

অহীন্দ্র এ কথার জবাব দিতে পারিল না। সুনীতি অন্তরে অন্তরে অহীন্দ্রকে সমর্থন করিলেও মুখ ফুটিয়া মহীন্দ্রের কথার প্রতিবাদ করিতে পারিলেন না। মজুমদার কৌশলী ব্যক্তি, সে অহীন্দ্রের মুখ দেখিয়া সুকৌশলে একটা মিমাংসা করিয়া দিল, বেশ তো গো, অহিবাবু যখন কথাই দিয়েছেন, তখন কথা আমরা রাখব। ছোট রায় মশায় তলব পাঠালে আমি নিজে সাঁওতালদের নিয়ে যাব। দেখিই না, তিনি কি করতে পারেন।

মহীন্দ্র চুপ করিয়া রহিল; কথাটা সুসংগত এবং যুক্তির দিক দিয়াও সুযুক্তিপূর্ণ, তবু তাহার মন ইহাতে ভাল করিয়া সায় দিল না।

মজুমদার বলিল, তা ছাড়া মুখোমুখি কথা ক’য়েই দেখি না, কোন মুখে চরটা তিনি আপনার ব’লে ‘কেলেম’ (claim) করেন।

সুনীতি বলিলেন, এটা খুবই ভাল কথা মহীন, এতে আর তুমি আপত্তি ক’রো না।

মহীন্দ্র এবার অনিচ্ছাসত্ত্বেও বলিল, তাই হবে। কিন্তু অহী কালই চলে যাক স্কুলে, ওর এ-ব্যাপারে জড়িয়ে পড়া ঠিক নয়। আর একটা কথা, ওরকম-ধারার সম্বন্ধ পাতাবার চেষ্টা যেন আর করা না হয়; তিন পুরুষ ধ’রে ওরা আমাদের শত্রুতা করে আসছেন।

তাহাই হইল, অহীন্দ্র ভোরে উঠিয়া স্কুলে চলিয়া গেল। সকালেই মজুমদার সাঁওতালদের সঙ্গে লইয়া ইন্দ্র রায়ের কাছারিতে উপস্থিত হইল; এবং শেষ পর্যন্ত ইন্দ্র রায়ের দ্বন্দঘোষণা মর্যাদার সহিত গ্রহন করিয়া ফিরিয়া আসিল।

মজুমদারের মুখে সমস্ত শুনিয়া মহীন্দ্র প্রদীপ্ত হইয়া উঠিল, বলিল, খুব ভাল ব’লে এসেছেন। মায়ের যেমন, তিনি ভাবেন, দুনিয়াভোর মানুষের অন্তর বুঝি তাঁর মতন। ব’লে আসুন তাঁকে, তাঁর ও-বাড়ির দাদার কথাটা ব’লে আসুন।

মজুমদার বলিল, না না মহীবাবু, ও-কথা মাকে ব’লো না; তিনি আপনাদের ভালর জন্যই বলেন, আর ঝগড়া-বিবাদে তাঁর ভয়ও হয় তো।

মহীন্দ্র বলিল, সেটা ঠিক কথা। ভয়টা তাঁর খুবই বেশী, জমিদারি ব্যাপারটাই হ’ল ওঁর ভয়ের কথা, ওঁর বাপেদের তিন পুরুষ হ’ল চাকরে।

মজুমদার এ প্রসঙ্গে আর কথা বাড়াইল না। মহীন্দ্রকে সে ভাল করিয়াই জানে। প্রসঙ্গটা পরিবর্তন করিয়া সে বলিল, বাবুর সঙ্গে একবার পরামর্শ করা দরকার।

এবার একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া মহীন্দ্র বলিল, আজ সকালে আমি তাঁর ঘরে গিয়েছিলাম, তাঁকে দেখে আমার বুক ফেটে গেল মজুমদার-কাকা, তিনি বোধ হয় সম্পূর্ণ পাগল হয়ে গেছেন।

মজুমদার স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল, মহীন্দ্রও নীরব। এই স্তব্ধ অবসরের মধ্যে কলরব করিতে করিতে আসিয়া উপস্থিত হইল একদল সাঁওতালদের ছেলেমেয়ে। হাতে তীর ও ধনুক, একজনের ধনুকের প্রান্তে দুইটা সদ্যনিহত ছোট জন্তু ঝুলিতেছিল। এখনও জন্তু দুইটার ক্ষতস্থান হইতে রক্ত ঝরিতেছে। ছেলেদের পিছনে কয়টি তরুণী মেয়ে; মেয়েদের মধ্যে কমল মাঝির নাতনী, সেই দীর্ঘাঙ্গী তরুণীটি ছিল সকলের আগে। সমগ্র দলটি মহীন্দ্র ও মজুমদারকে দেখিয়া অকস্মাৎ যেন স্তব্ধ হইয়া গেল।

মজুমদার ও মহীন্দ্র একটু ব্যস্ত হইয়া উঠিল, ইহাদের আকস্মিক আগমনে তাহাদের মনে হইল, ইন্দ্র রায় আবার কোনও গোলমাল বাধাইয়া তুলিয়াছেন। মহীন্দ্র মজুমদারকেই প্রশ্ন করিল, আবার কি হ’ল? রায়েরা আবার কোনও গোলমাল বাধিয়েছে নিশ্চয়।

মজুমদার প্রশ্ন করিল সমগ্র দলটিকে লক্ষ্য করিয়া, কি রে, কি বলছিস তোরা?

সমগ্র দলটি আপনাদের ভাষায় আপনাদেরই মধ্যে কি বলিয়া উঠিল। মজুমদার আবার বলিল, কি বলছিস, বাঙালী কথায় বল কেনে?

দীর্ঘাঙ্গী তরুণীটি বলিল, বুলছি, আমাদের বাবুটি কুথা গো?

হাসিয়া মজুমদার বলিল, এই যে বড়বাবু রয়েছেন। বল না, কি বলছিলি?

উ কেনে হবে গো? সি আমাদের রাঙাবাবু, সি বাবুটি কুথা গো?

তিনি পড়তে চ’লে গেছেন ইস্কুলে, সেই শহরে। ইনি হলেন বড়বাবু, ইনি হলেন মালিক–মরংবাবু।

কেনে, তা কেনে হবে?

মজুমদার হাসিয়া বলিলেন, আচ্ছা একগুঁয়ে বোকা জাত! যা ধরবে, তা আর ছাড়বে না। তা কেনে হবে? তাই হয় রে, তাই হয়। ইনি বড় ভাই, তিনি ছোট ভাই। বুঝলি?

হুঁ, সিটি তো আমরা দেখছি। ইটিও সেই তেমুনি, সিটির পারা বটে। তা সিটিই তো আমাদের রাঙাবাবু। উয়ার লেগে আমরা সুসুরে মেরে এনেছি।

মহীন্দ্র উৎসাহিত হইয়া চেয়ার ছাড়িয়া উঠিয়া পড়িল, সুসুরে-খরগোশ! কই, দেখি দেখি!

তাহারা এবার খরগোশ দুইটা আনিয়া কাছারির বারান্দায় নামাইয়া দিল। ধূসর রঙের বন্য খরগোশ সাধারণ পোষা খরগোশ হইতে আকারে অনেকটা বড়। মহীন্দ্র বলিল, বাঃ, এ যে অনেক বড়, এদের রঙটাও মাটির মত। এ পেলি কোথায় তোরা? সেই মেয়েটি বলিল, কেনে, আমাদের ওই নদীর চরে, মেলাই আছে। শিয়াল আছে, খটাস ঘেঁকশিয়াল আছে, সুসুরে আছে, তিতির আছে, আমরা মারি, পুড়িয়ে খাই।

মহীন্দ্র আরও বেশী উৎসাহিত হইয়া উঠিল, শিকারে তাহার প্রবল আসক্তি, নেশা বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। সে বলিল তা হ’লে চলুন মজুমদার-কাকা, আজ বিকেলে যাব শিকার করতে; চরটাও দেখা হবে, শিকারও হবে, কি বলেন?

বেশ তো।

মেয়েটি বলিল, তু যাবি? বন্দুক নিয়ে যাবি? মারতে পারবি? খুঁজে বার করতে পারবি?

হাসিয়া মহীন্দ্র বলিল, আচ্ছা, সে তখন দেখবি তোরা। যা তোরা, সর্দার-মাঝিকে বলবি, আমরা বিকেলে যাব।

সে আমাদের রাঙাবাবুটি? তাকে নিয়ে যাবি না?

সে যে নেই এখানে।

কেনে, সে আসবে না কেনে? তুরা তাকে নিয়ে যাবি না কেনে?

মজুমদার হাসিয়া ফেলিলেন, কি আপদ!

কেন, কি করলাম আমরা? উ কেনে বলছিস তু?

আচ্ছা, বাবু এলে তাকে নিয়ে যাব। তোরা যা এখন।

এবার তারা আশ্বাস পাইয়া সোৎসাহে আপন ভাষায় কলরব করিয়া উঠিল। মেয়েটিই দলের নেত্রী, সে বলিয়া উঠিল, দেলা-দেলা বোঁ! অর্থাৎ চল্ চল্ চল্।

মহীন্দ্র কাছারি-ঘরে ঢুকিয়া বন্দুকটা বাহির করিয়া আনিল। নলের মুখটা ভাঁজিয়া ভিতর দেখিয়া বলিল, বড্ড অপরিষ্কার হয়ে আছে। সে বন্দুকের বাক্সটা বাহির করিয়া আনিয়া বন্দুকের পরিচর্যায় নিযুক্ত হইল।

.

ইন্দ্র রায়ের এই কাজটি অচিন্ত্যবাবুর মনঃপূত হয় নাই; তিনি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হইয়া উঠিয়াছিলেন। এই প্রাতঃকালে পর্যন্ত তিনি গাছ-গাছড়া চালানের লাভক্ষতি কষিয়া রায়কে বুঝাইয়াছেন, রায়ও আপত্তি করেন নাই, বরং উৎসাহই প্রকাশ করিয়াছেন। কিন্তু সেই লাভকে উপেক্ষা করিয়া অকস্মাৎ তিনি কেন যে চর বন্দোবস্ত করিলেন, তাহার কারণ তিনি খুঁজিয়া পাইলেন না।

আর ননী পালের মত দুর্দান্ত ব্যক্তিকে বিনা পণে চর বন্দোবস্ত করিয়া প্রশ্রয় দেওয়ার হেতুও তিনি বুঝিতে পারিলেন না। ওই লোকটার জন্য সমগ্র চরটা দুর্গম হইয়া উঠিল, কে উহার সহিত ঝগড়া করিতে যাইবে? তাহার সীমানা বাদ দিয়া চরে পদার্পণ করিলেও ননী বিবাদ করিবেই। সেই বিক্ষোভ প্রকাশ করিতে করিতেই তিনি পথ দিয়া চলিয়াছেন।

হ’ল, বেশই হ’ল, উত্তম হ’ল, খুব ভাল করলেন। ওখানে আর কেউ যাবে? থাকল ওই জায়গা প’ড়ে। গেলেই, ও গোয়ার চপেটাঘাত না ক’রে ছাড়বে না। বাব্বাঃ, আমি আর যাই! সর্বনাশ কোনদিন পাষণ্ড আমাকে একেবারে এক চড়ে খুনই করে ফেলবে। এক মনেই বকিতে বকিতে তিনি চলিয়াছিলেন। চক্রবর্তীবাবুদের কাছারির বারান্দায় মজুমদার হাসিয়া তাঁহাকে প্রশ্ন করিলেন, কি হ’ল অচিন্ত্যবাবু, হঠাৎ চটে উঠলেন কেন মশায়?

হঠাৎ? অচিন্ত্যবাবু যেন ক্ষিপ্ত হইয়া উঠিলেন, হঠাৎ? বলেন কি মশায়, আজ তিন দিন তিন রাত্রি ধরে, হিসেব ক’ষে লাভ-লোকসান দেখলাম, টু হান্ড্রেড পারসেন্ট লাভ। কলকাতার সাত-আটটা ফার্মকে চিঠি লিখলাম সাত-আট আনা খরচ করে; আর আপনি বলেন হঠাৎ?

মজুমদার বলিলেন, সে-সব আমরা কেমন ক’রে—

বাধা দিয়া অচিন্ত্যবাবু বলিলেন, ঠিক কথা, আমারই ভুল, কেমন ক’রে জানবেন আপনারা। তবে শুনুন, আপনাদের এই ইন্দ্র রায় মশায় একটা ‘ডেঞ্জারাস গেমে’ হাত দিয়েছেন। বাঘ নিয়ে খেলা, ননী পাল সাক্ষাৎ একটি ব্যাঘ্র।–বলিয়া সবিস্তারে সমস্ত ঘটনাটা বর্ণনা করিয়া পরিশেষে ক্ষোভে দুঃখে ভদ্রলোক প্রায় কাঁদিয়া ফেলিলেন–মশায়, তিনটি রাত্রি আমি ঘুমই নি। দশ রকম ক’রে দশবার আমি লাভ-লোকসান ক’ষে দেখেছি। বেশ ছিলাম, বদহজম অনেকটা কমে এসেছিল, এই তিন রাত্রি জেগে আমার বদহজম আবার বেড়ে গেল। কথা বলিতে বলিতেই যেন রোগটা তাঁহার বাড়িয়া গেল, সঙ্গে সঙ্গে গোটা কয়েক ঢেকুর তুলিয়া তিনি বলিলেন, ভাস্কর লবণ খানিক না খেলে এইবার গ্যাস হবে। যাই, তাই খানিকটা খাইগে। গ্যাসে হার্টফেল হওয়া বিচিত্র নয়। ভদ্রলোক উঠিয়া পড়িলেন এবং ক্রমাগত উদগার তুলিতে তুলিতে চলিয়া গেলেন।

মহীন্দ্র বন্দুক ফেলিয়া গম্ভীরভাবে বলিল, চাপরাসীদের ব’লে দিন–ননী পাল রায়েদের কাছারি থেকে বেরুলেই যেন ধ’রে নিয়ে আসে।


মজুমদার খুব ভাল করিয়াই বলিলেন- আদেশের সুরে নয়, অনুরোধ জানাইয়াই বলিলেন, দেখ ননী, এ-কাজটা করা তোমার উচিত হবে না। এ আমাদের শরিকে শরিকে বিরোধ, এর মধ্যে তোমার যোগ দেওয়া কি ভাল?

ননী নখ দিয়া নখ খুঁটিতে খুঁটিতে বলিল, তা মশায়, ইয়ের ভালমন্দ কি? সম্পত্তি রাখতে গেলেও ঝগড়া, সম্পত্তি করতে গেলেও ঝগড়া। সে ভেবে সম্পত্তি কে আর ছেড়ে দেয় বলুন?

মহীন্দ্র গম্ভীর স্বরে বলিল, দেখ ননী, ও সম্পত্তি হ’ল আমার, ওটা ইন্দ্র রায়ের নয়। তোমাকে আমি বারণ করছি, তুমি এর মধ্যে এসো না।

মহীন্দ্রের স্বরগাম্ভীর্যে ননী রুক্ষ হইয়া উঠিল, সে বলিল, সম্পত্তি আপনার, তারই বা ঠিক কি?

আমি বলছি।

সে তো রায় মশায়ও বলছেন, সম্পত্তি তেনার।

তিনি মিথ্যা কথা বলছেন।

আর আপনি সত্যি বলছেন!-ব্যঙ্গভরে ননী বলিয়া উঠিল।

মহীন্দ্র বলিল, চক্রবর্তী-বংশ তেমন নীচ নয়, তারা মিথ্যে কথা বলে না, বুঝলে?

ননী পাল প্রস্তুত হইয়াই আসিয়াছিল, ইন্দ্র রায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতায় মহীন্দ্রকে অপমান করিবার সঙ্কল্প লইয়াই ডাকিবামাত্র সে এখানে প্রবেশ করিয়াছিল। সে এবার বলিয়া উঠিল, হ্যাঁ হ্যাঁ, সে সব আমরা খুব জানি, চাকলাটার লোকই জানে; চক্রবর্তী-গুষ্ঠির কথা আবার জানে না কে?

মহীন্দ্র রাগে আরক্তিম হইয়া বলিল, কি? কি বলছিস তুই?

মুখভঙ্গী করিয়া ননী বলিল, বলছি তোমার সৎমায়ের কথা হে বাপু, বলি, যার মা চ’লে যায়

মুহূর্তে এক প্রলয় ঘটিয়া গেল। অশনীয় ক্রোধে মহীন্দ্র আত্মহারা হইয়া অভ্যস্ত হাতে ক্ষিপ্রতার সহিত বন্দুকটা লইয়া টোটা পুরিয়া ঘোড়াটা টানিয়া দিল। ননী পালের মুখের কথা মুখেই থাকিয়া গেল, রক্তাপ্লুত দেহে মুখ গুঁজিয়া সে মাটিতে লুটাইয়া পড়িল। বন্দুকের শব্দে, বারুদের গন্ধে, ধোঁয়ায়, রক্তে, সমস্ত কিছু লইয়া সে এক ভীষণ দৃশ্য। মজুমদার যেন নির্বাক মূক হইয়া গেল, থরথর করিয়া সে কাঁপিতেছিল। মহীন্দ্রও নীরব, কিন্তু সে-ই প্রথমে নীরবতা ভঙ্গ করিয়া বন্দুকটা হাতে লইয়াই উঠিয়া বলিল, আমি চললাম কাকা, থানায় সারেণ্ডার করতে।

মজুমদার একটা কিছু বলিবার চেষ্টায় বার কয়েক হাত তুলিল, কিন্তু মুখে ভাষা বাহির হইল না। মহীন্দ্র মায়ের সঙ্গে পর্যন্ত দেখা করিল না; চৈত্রের উত্তপ্ত অপরাহ্নে সে দৃঢ় পদক্ষেপেই ছয় মাইল দূরবর্তী থানায় আসিয়া বলিল, আমি ননী পাল বলে একটা লোককে গুলি করে মেরেছি।

.

০৮.

বজ্রের আঘাতের মত আকস্মিক নির্মম আঘাতে সুনীতির বুকখানা ভাঙিয়া গেলেও তাঁহার কাঁদিবার উপায় ছিল না। সন্তানের বেদনায় আত্মহারা হইয়া লুটাইয়া পড়িবার শ্রেষ্ঠ স্থান হইল স্বামীর আশ্রয়। কিন্তু সেইখানেই সুনীতিকে জীবনের এই কঠিনতম দুঃখকে কঠোর সংযমে নিরুচ্ছ্বাসিত স্তব্ধ করিয়া রাখিতে হইল। অপরাহ্নে কাণ্ডটা ঘটিয়া গেল, সুনীতি সমস্ত অপরাহ্নটাই মাটির উপর মুখ গুঁজিয়া মাটির প্রতিমার মত পড়িয়া রহিলেন, সন্ধ্যাতে তিনি গৃহলক্ষ্মীর সিংহাসনের সম্মুখে ধূপপ্রদীপ দিতে পর্যন্ত উঠিলেন না। সন্ধ্যার পরই কিন্তু তাঁহাকে উঠিয়া বসিতে হইল। মনে পড়িয়া গেল-তাঁহারই উপর একান্ত-নির্ভরশীল স্বামীর কথা। এখনও তিনি অন্ধকারে আছেন, দুপুরের পর হইতে এখনও পর্যন্ত তিনি অভুক্ত। যথাসম্ভব আপনাকে সংযত করিয়া সুনীতি রামেশ্বরের ঘরে প্রবেশ করিলেন। বন্ধ ঘরে গুমোট গরম উঠিতেছিল, প্রদীপ জ্বালিয়া সুনীতি ঘরের জানলা খুলিয়া দিলেন। এতক্ষণ পর্যন্ত তিনি স্বামীর দিকে ফিরিয়া চাহিতে পারেন নাই, স্বামীর মুখ কল্পনামাত্রেই তাঁহার হৃদয়াবেগ উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিবার উপক্রম করিতেছিল। এবার কঠিনভাবে মনকে বাঁধিয়া তিনি স্বামীর দিকে ফিরিয়া চাহিলেন, দেখিলেন গভীর আতঙ্কে রামেশ্বরের চোখ দুইটি বিস্ফারিত হইয়া উঠিয়াছে, নিস্পন্দ মাটির পুতুলের মত বসিয়া আছেন। সুনীতির চোখে চোখ পড়িতেই তিনি আতঙ্কিত চাপা কণ্ঠস্বরে বলিলেন, মহীনকে লুকিয়ে রেখেছ?

সুনীতি আর যেন আত্মসম্বরণ করিতে পারিলেন না। দাঁতের উপর দাঁতের পাটি সজোরে টিপিয়া ধরিয়া তিনি স্তব্ধ হইয়া রহিলেন। রামেশ্বর আবার বলিলেন, খুব অন্ধকার ঘরে, কেউ যেন দেখতে না পায়!

আবেগের উচ্ছ্বাসটা কোনমতে সম্বরণ করিয়া এবার সুনীতি বলিলেন, কেন, মহী তো আমার অন্যায় কাজ কিছু করে নি, কেন সে লুকিয়ে থাকবে?

তুমি জান না, মহী খুন করেছে-খুন!

জানি।

তবে! পুলিসে ধরে নিয়ে যাবে যে!

সুনীতির বুকে ধীরে ধীরে বল ফিরিয়া আসিতেছিল, তিনি বলিলেন, মহী নিজেই থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করেছে। সে তো আমার কোন অন্যায় কজ করে নি, কেন সে চোরের মত আত্মগোপন ক’রে ফিরবে? সে তার মায়ের অপমানের প্রতিশোধ নিয়েছে, সন্তানের যোগ্য কাজ করেছে।

অনেকক্ষণ স্তব্ধভাবে সুনীতির মুখের দিকে চাহিয়া থাকিয়া রামেশ্বর বলিলেন, তুমি ঠিক বলেছ। মণিপুর-রাজনন্দিনীর অপমানে তার পুত্র বভ্রুবাহন পিতৃবধেও কুণ্ঠিত হয় নি। ঠিক বলেছ তুমি!

গাঢ়স্বরে সুনীতি বলিলেন, এই বিপদের মধ্যে তুমি একটু খাড়া হয়ে ওঠ, তুমি না দাঁড়ালে আমি কাকে আশ্রয় ক’রে চলাফেরা করব? মহীর মকদ্দমায় কে লড়বে? ওগো, মনকে শক্ত কর, মনে করো কিছুই তো হয় নি তোমার।

রামেশ্বর ধীরে ধীরে খাট হইতে নামিয়া খোলা জানলার ধারে আসিয়া দাঁড়াইলেন। সুনীতি বলিলেন, আমার কথা শুনবে?

সম্মতিসূচক ভঙ্গিতে বার বার ঘাড় নাড়িয়া রামেশ্বর বলিলেন, হুঁ।

সুনীতি বলিলেন, হ্যাঁ, তুমি শক্ত হয়ে দাঁড়ালে মহীর কিছু হবে না। মজুমদার ঠাকুরপো আমায় বলেছেন, এরকম উত্তেজনায় খুন করলে ফাঁসি তো হয়ই না, অনেক সময় বেকসুর খালাস পেয়ে যায়।

বলিতে বলিতে তাঁহার ঠোঁট দুইটি থরথর করিয়া কাঁপিয়া উঠিল। তাঁহার চোখের সম্মুখে ভাসিয়া উঠিল-ননী পালের রক্তাক্ত নিস্পন্দ দেহ। উঃ, সে কি রক্ত! কাছারি-বাড়ির বারান্দায় রক্ত জমিয়া একটা স্তর পড়িয়া গিয়াছিল। সুনীতির মন হতভাগ্য ননী পালের জন্য হাহাকার করিয়া উঠিল। মহীন অন্যায় করিয়াছে, অপরাধ করিয়াছে। দণ্ড দিতে গিয়া মাত্রা অতিক্রম করিয়াছে। সেইটুকুর জন্য শাস্তি তাহার প্রাপ্য, এইটুকু শাস্তিই যেন সে পায়। আত্মহারা নির্বাক হইয়া তিনি দাঁড়াইয়া রহিলেন।

কিছুক্ষণ পর মানদা ঘরের বাহির হইতে তাঁহাকে ডাকিল, মা!

সুনীতির চমক ভাঙিল, একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া তিনি বলিলেন, যাই।

উনোনের আঁচ ব’য়ে যাচ্ছে মা।

আত্মসম্বরণ করিয়া সুনীতি স্বামীর দিকে ফিরিয়া চাহিলেন।

রামেশ্বর একদৃষ্টে বাহিরে অন্ধকারের দিকে চাহিয়া দাঁড়াইয়া ছিলেন। তাঁহার জন্য সন্ধ্যাকৃত্যের জায়গা করিয়া দিয়া সুনীতি বলিলেন, কাপড় ছেড়ে নাও, সন্ধ্যে ক’রে ফেল। আমি দুধ গরম করে নিয়ে আসি।

রামেশ্বর বলিলেন, একটা কথা বলে দিই তোমাকে। তুমি—

সুনীতি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিয়া বলিলেন, বল, কি বলছ?

তুমি একমনে তোমার দিদিকে ডাক–মানে রাধারাণী, রাধারাণী। সে বেঁচে নাই, ওপার থেকে সে তোমার ডাক শুনতে পাবে। বল- তোমার মান রাখতেই মহীন আমার এই অবস্থা, তুমি তাকে আশীর্বাদ করো, বাঁচাও।

সুনীতি বলিলেন, ডাকব, তাঁকে ডাকব বইকি।


সুনীতি নীচে আসিয়া দেখিলেন, মজুমদার তাঁহারই অপেক্ষায় বসিয়া রহিয়াছে। সে মহীন্দ্রের খবর জানিবার জন্য থানায় গিয়াছিল! তাহাকে দেখিয়াই সুনীতির ঠোঁট দুইটি থরথর করিয়া কাঁপিয়া উঠিল। তাঁহার চোখের সম্মুখে শৃঙ্খলাবদ্ধ মহীর বিষণ্ণ মূর্তি ভাসিয়া উঠিল। মুখে তিনি কোন প্রশ্ন করিতে পারিলেন না, কিন্তু মজুমদার দেখিল, উৎকণ্ঠিত প্রশ্ন মূর্তিমতী হইয়া তাহার সম্মুখে দাঁড়াইয়া আছে।

সে নিতান্ত মূর্খের মত খানিকটা হাসিয়া বলিল, দেখে এলাম মহীকে।

তবু সুনীতি নীরব প্রতিমার মত দাঁড়াইয়া রহিলেন। মজুমদার অকারণে কাশিয়া গলা পরিষ্কার করিয়া আবার বলিল, এতটুকু ভেঙে পড়ে নি, দেখলাম। আবার কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়াও সুনীতির নিকট হইতে সরব কোন প্রশ্ন আসিল না দেখিয়া বলিল, থানার দারোগাও তো কোন খারাপ ব্যবহার করে নি। আবার সে বলিল, আমি সব জেনে এলাম, থানায় কি এজাহার দিয়েছেন, তাও দেখলাম। একটাও মিথ্যে বলেন নি।

সুনীতি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলিলেন, আর কোন জীবন-স্পন্দন স্ফুরিত হইল না।

মজুমদার বলিল, দারোগা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন বরং, লোকটা কি বলেছিল বলুন তো? মহীবাবু সে কথা বলেন নি। দারোগা কথাটা জানতে চেয়েছিলেন, তাতে তিনি বলেছেন, সে কথা আমি যদি উচ্চারণই করব, তবে তাকে গুলি করে মেরেছি কেন? আমি বললাম সব।

সুনীতি এতক্ষণে কথা কহিলেন, ছি!

মাথা হেঁট করিয়া মজুমদার বলিল, না বলে যে উপায় নেই বউ-ঠাকরুণ, মহীকে বাঁচানো চাই তো!

দরদর করিয়া এবার সুনীতির চোখ দিয়া জল ঝরিয়া পড়িতে আরম্ভ করিল, মজুমদার প্রাণপণে তাঁহাকে উৎফুল্ল করিবার চেষ্টা করিয়া বলিল, ভাববেন না আপনি, ও-মামলায় কিছু হবে না মহীর। দারোগাও আমাকে সেই কথা বললেন।

অত্যন্ত কুণ্ঠিতভাবে সুনীতি প্রশ্ন করিলেন, মহী কিছু বলে নি?

দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া মজুমদার বলিলেন, বললেন–মাকে বলবেন, তিনি যেন না কাঁদেন। আমি অন্যায় কিছু করি নি। বড়মাকে দেখি নি, মা বললেই মাকে মনে পড়ে। সে শয়তান যখন মায়ের নাম মুখে আনলে, তখন মাকেই আমার মনে পড়ে গেল, আমি তাকে গুলি করলাম। আমার তাতে একবিন্দু দুঃখ নেই, ভয়ও করি না আমি। তবে মা কাঁদলে আমি দুঃখ পাব।

সুনীতি বলিলেন, কাল যখন যাবে ঠাকুরপো, তখন তাকে ব’লো, যেন মনে মনে তার বড়মাকে ডাকে, প্রণাম করে। বলবে, তার বাপ এই কথা বলে দিয়েছেন, আমিও বলছি।

কোঁচার খুঁটে চোখ মুছিয়া মজুমদার বলিল, অনেকগুলি কথা আছে আপনার সঙ্গে। স্থির হয়ে ধৈর্য ধরে আপনাকে শুনতে হবে।

সুনীতি বলিলেন, আমি কি ধৈর্য হারিয়েছি ঠাকুরপো?

অপ্রস্তুত হইয়া মজুমদার বলিল, না-মানে, মামলা-সংক্রান্ত পরামর্শ তো। মাথা ঠিক রেখে করতে হবে, এই আর কি!

আচ্ছা, তুমি একটু অপেক্ষা কর, আমি ওঁকে দুধটা গরম করে খাইয়ে আসি। যাইতে যাইতে সুনীতি দাঁড়াইলেন, ঈষৎ উচ্চকণ্ঠে মানদাকে ডাকিলেন, মানদা, বামুন-ঠাকরুনকে বল্ তো মা, মজুমদার ঠাকুরপোকে একটু জল খেতে দিক। আর তুই হাত-পা ধোবার জল দে।

মজুমদার বলিল, শুধ এক গ্লাস ঠাণ্ডা জল।

তৃষ্ণায় তাহার ভিতরটা যেন শুকাইয়া গিয়াছে।

স্বামীকে খাওয়াইয়া সুনীতি নীচে আসিয়া মজুমদারের অল্প দূরে বসিলেন। যোগেশ মাথায় হাত দিয়া গম্ভীরভাবে চিন্তা করিতেছিল। সুনীতি বলিলেন, কি বলছিলে, বল ঠাকুরপো?

একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া মজুমদার বলিল, মামলার কথাই বলছিলাম। আমার খুব ভরসা বউঠাকরুন, মহির এতে কিছু হবে না। দারোগাও আমাকে ভরসা দিলেন।

সে তো তুমি বললে ঠাকুরপো।

হ্যাঁ। কিন্তু এখন দুটি ভাবনা কথা, সে কথাই বলছিলাম।

কি কথা বল?

মামলায় টাকা খরচ করতে হবে, ভাল উকিল দিতে হবে। আর ধরুন, দারোগা-টারোগাকেও কিছু দিলে ভাল হয়।

সুনীতি প্রশ্ন করিলেন, ঘুষ?

হ্যাঁ, ঘুষই বৈকি। কাল যে কলি বউঠাকরুন। তবে আমরা তো আর ঘুষ দিয়ে মিথ্যা করাতে চাই না।

কত টাকা চাই?

তা হাজার দুয়েক তো বটেই, মামলা-খরচ নিয়ে।

আমার গহনা আমি দেব ঠাকুরপো, তাই দিয়ে এখন তুমি খরচ চালাও।

ইতস্তত করিয়া মজুমদার বলিল, আমি বলছিলাম চরটা বিক্রি করে দিতে। অপয়া জিনিস, আর খদ্দেরও রয়েছে। আজই থানার ওখানে একজন মারোয়াড়ী মহাজন আমাকে বলছিল কথাটা।

কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া সুনীতি বলিলেন, ওটা এখন থাক ঠাকুরপো, এখন তুমি গহনা নিয়েই কাজ কর। পরে যা হয় হবে। আর কি বলছিলে, বল?

আর একটা কথা বউঠাকরুন, এইটেই হ’ল ভয়ের কথা! ছোট রায় মশায় যদি বেঁকে দাঁড়ান।

সুনীতি নীরবে মাটির দিকে চাহিয়া বসিয়া রহিলেন, এ কথার উত্তর দিতে পারিলেন না।

মজুমদার বলিল, আপনি একবার ওদের বাড়ি যান।

সুনীতি নীরব।

মজুমদার বলিল, মহীর বড়মা ধরুন মা-ই, কিন্তু তিনি তো রায় মহাশয়ের সহোদরা। ননী পাল তাঁর আশ্রিত, কিন্তু সে কি তাঁর সহোদরার চেয়েও বড়?

সুনীতি ধীরে ধীরে বলিলেন, কিন্তু মহী তো তাঁর সহোদরার অপমানের শোধ নিতে এ কাজ করে নি ঠাকুরপো!

কিন্তু কথা তো সেই একই!

ম্লান হাসি হাসিয়া সুনীতি বলিলেন, একই যদি হয় তবে কৈফিয়ৎ দেবার জন্য কি আমার যাবার প্রয়োজন আছে ঠাকুরপো? তার মত লোক এ কথা কি নিজেই বুঝতে পারবেন না?

মজুমদার চুপ করিয়া গেল, আর সে বলিবার কথা খুঁজিয়া পাইল না। সুনীতি আবার বলিলেন, যে কাজ মহী করলে ঠাকুরপো, বিনা কারণে সে কাজ করলে ভগবানও তাকে ক্ষমা করেন না। কিন্তু যে কারণে সে করেছে, সেই কারণটা আজ বড় হয়ে কর্মের পাপ হালকা ক’রে দিয়েছে। এ কারণ যে না বুঝবে, তাকে কি ব’লে বোঝাতে যাব আমি? আবার কিছুক্ষণ পর বলিলেন, আর মহীর কাছে মহীর মা বড়। রায় মশায়ের কাছে তাঁর ভগ্নী বড়। মহী মায়ের অপমানে যা করবার করেছে; এখন রায় মশায় তাঁর ভগ্নীর জন্যে যা করা ভাল মনে করেন, করবেন। এতে আর আমি গিয়ে কি করব। বল?


গভীর রাত্রি; গ্রামখানা সুষুপ্ত। রামেশ্বর বিছানায় শুইয়া জাগিয়াই ছিলেন, অদূরে স্বতন্ত্র বিছানায় সুনীতি অসাড় হইয়া আছেন, তিনিও জাগিয়া মহীন্দ্রের কথাই ভাবিতেছিলেন। মায়ের অপমানের শোধ লইতে মহী বীরের কাজ করিয়াছে, এ যুক্তিতে মনকে বাঁধিলেও প্রাণ সে বাঁধন ছিঁড়িয়া উন্মত্তের মত হাহাকার করিতে চাহিতেছে; বুকের মধ্যে অসহ্য বেদনার বিক্ষোভ চাপিয়া তিনি অসাড় হইয়া পড়িয়া ছিলেন। শয়নগৃহে স্বামীর বুকের কাছে থাকিয়াও প্রাণ খুলিয়া কাঁদিয়া সে বিক্ষোভ লঘু করার উপায় নাই। রামেশ্বর জাগিয়া উঠিলে বিপদ হইবে, তিনি অধীর হইয়া পড়িবেন, বিপদের উপর বিপদ ঘটিয়া যাইবে।

পূর্বাকাশে দিক্‌চক্ৰবালে কৃষপক্ষের চাঁদ উঠিতেছিল। খোলা জানলা দিয়া আলোর আভাস আসিয়া ঘরে ঢুকিতেছে। রামেশ্বর অতি সন্তর্পণে খাট হইতে নামিয়া জানলার ধারে গিয়া দাঁড়াইলেন, ঘুমন্ত সুনীতির বিশ্রামে ব্যাঘাত না ঘটাইবার জন্যই তাঁহার এ সতর্কতা। জানলা দিয়া নীচে মাটির দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া তিনি কয়েক পা পিছাইয়া আসিলেন। মৃদুস্বরে বলিলেন, উঃ, ভয়ানক উঁচু!

সুনীতি শিহরিয়া উঠিয়া তাড়াতাড়ি কাছে আসিয়া তাঁহাকে ধরিলেন, বলিলেন, কি করছ?

রামেশ্বর ভীষণ আতঙ্কে চমকিয়া উঠিয়া বলিলেন, কে?

সুনীতি তাড়াতাড়ি বলিলেন, আমি, আমি, ভয় নেই, আমি!

কে? রাধারাণী?

না, আমি সুনীতি?

আশ্বস্ত হইয়া রামেশ্বর একটা নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, ও, এখনও ঘুমোও নি তুমি? রাত্রি যে অনেক হ’ল সুনীতি!

সুনীতি বিচিত্র হাসি হাসিলেন। বলিলেন, তুমিও ঘুমোও নি যে? এস, শোবে এস।

আমার ঘুম আসছে না সুনীতি। শুয়ে হঠাৎ রামায়ণ মনে প’ড়ে গেল।

রামায়ণ আমি পড়ব, তুমি শুনবে?

না। মেঘনাদ যখন অধর্ম-যুদ্ধে লক্ষণ বধ করলে, তখন রাবণের কথা মনে আছে তোমার? শক্তিশেল, শক্তিশেল! আমার মনে হচ্ছে- তেমনি শেল যদি পেতাম, তবে রায়বংশ, রায়-হাট সব আজ ধ্বংস করে দিতাম আমি। রামেশ্বর থরথর করিয়া কাঁপিতেছিলেন। সুনীতি বিব্রত হইয়া স্বামীকে মৃদু আকর্ষণ করিয়া বলিলেন, এস, বিছানায় বসবে এস, আমি বাতাস করি।

রামেশ্বর আপত্তি করিলেন না, আসিয়া বিছানায় বসিলেন। একদৃষ্টে জানলা দিয়া চন্দ্রালোকিত গ্রামখানির দিকে চাহিয়া রহিলেন। সুনীতি বলিলেন, তুমি ভেবো না, মহী আমার অন্যায় কিছু করে নি। ভগবান তাকে রক্ষা করবেন।

রামেশ্বর ও কথার কোন জবাব দিলেন না। নীরবে বাহিরের দিকে চাহিয়া থাকিতে থাকিতে সহসা পরম ঘৃণায় মুখ বিকৃত করিয়া বলিয়া উঠিলেন, অ্যাঃ, বিষে একেবারে ঝাঁঝরা করে দিয়েছে।

সুনীতি কাতর সুরে মিনতি করিয়া বলিলেন, ওগো, কি বলছ তুমি? আমার ভয় করছে যে!

ভয় হবারই কথা। দেখ, চেয়ে দেখ–গ্রামখানা বিষে একাবেরে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। কতকাল ধ’রে মানুষের গায়ের বিষ জমা হয়ে আসছে, রোগ শোক, কত কি! মনের বিষ, হিংসা-দ্বেষ মারামারি কাটাকাটি খুন! আঃ

চন্দ্রালোকিত গ্রামখানার দিকে চাহিয়া সুনীতি একটা দীর্ঘনিঃশাস ফেলিলেন; সত্যি গ্রামখানাকে অদ্ভুত মনে হইতেছিল। জমাট অন্ধকারের মত বড় বড় গাছ, বহুকালের জীর্ণ বাড়ি ঘর-ভাঙা দালান, ভগ্নচূড়া দেউলের সারি, এদিকে গ্রামের কোল ঘেঁষিয়া কালীন্দির সুদীর্ঘ সু-উচ্চ ভাঙন, সমস্ত দেখিয়া শুনিয়া, বিকৃতমস্তিষ্ক রামেশ্বরের মত বিষ-জর্জরিত মনে না হইলেও, দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিতে ইচ্ছা হয়।

সহসা রামেশ্বর আবার বলিলেন, দেখ।

কি?

কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া রামেশ্বর বলিলেন, আমার আঙুলগুলো বড় টাটাচ্ছে।

কেন? কোথাও আঘাত লাগল নাকি?

বিষণ্ণভাবে রামেশ্বর ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, উঁহু।

তবে? কই, দেখি!- বলিয়া অন্তরালে রক্ষিত প্রদীপটি উস্কাইয়া আনিয়া দেখিয়া বলিলেন, কই, কিছুই তো হয় নি।

তুমি বুঝতে পারছ না। হয়েছে-হয়েছে। দেখছ না, আঙ্গুলগুলো ফুলোফুলো আর লাল টকটক করছে?

হাত তো তোমাদের বংশের এমনই লাল।

না, তোমায় এতদিন বলি নি আমি। ভেবেছিলাম, কিছু না, মনের ভ্রম। কিন্তু। তিনি আর বলিলেন না, চুপ করিয়া গেলেন।

সুনীতি বলিলেন, তুমি একটু শোও দেখি, মাথায় একটু জল দিয়ে তোমায় আমি বাতাস করি।

রামেশ্বর আপত্তি করিলেন না, সুনীতির নির্দেশমত চুপ করিয়া শুইয়া পড়িলেন। সুনীতি শিয়রে বসিয়া বাতাস দিতে আরম্ভ করিলেন। চাঁদের আলোয় কালীর গর্ভের বালির রাশি দেখিয়া মনে কেমন একটা উদাস ভাব জাগিয়া উঠে। একপাশে কালীর ক্ষীণ কলস্রোত চাঁদের প্রতিবিম্ব, সুনীতির মনে ঐ উদাসীনতার মধ্যে একটু রূপের আনন্দ ফুটাইতে চেষ্টা করিয়াও পারিল না! তাহার ও-পারে সেই কাশে ও বেনাঘাসের ঢাকা চরটা, জোৎস্নার আলোয় কোমল কালো রঙের সুবিস্তীর্ণ একখানি গালিচার মত বিস্তীর্ণ হইয়া রহিয়াছে। সর্বনাশা চর! বাতাস করিতে করিতে সুনীতিও ধীরে ধীরে ঢলিয়া বিছানায় উপর পড়িয়া গেলেন। পড়িয়াই আবার চেতনা আসিল, কিন্তু দারুণ শ্রান্তিতে উঠিতে আর মন চাহিল না, দেহ পারিল না।

ঘুম যখন ভাঙিল, তখন প্রভাত হইয়াছে। রামেশ্বর উঠিয়া স্তব্ধ হইয়া বসিয়া আছেন। সুনীতিকে উঠতে দেখিয়াই তিনি বলিলেন, কবরেজ মশায়কে একবার ডাকতে পাঠাও তো।

কেন? শরীর কি খারাপ করছে কিছু?

এই আঙুলগুলো একবার দেখাব।

ও কিছু হয় নি, তবে বল তো ডাকতে পাঠাচ্ছি।

না, অনেকদিন উপেক্ষা করেছি, ভেবেছি, ও কিছু নয়। কিন্তু এইবার বেশ বুঝতে পারছি, হয়েছে হয়েছে।

রাত্রেও ঠিক এই কথা বলিয়াছিলেন। এ আর সুনীতি কত সহ্য করইবেন! বিরক্ত হইতে পারেন না, দুর্ভাগ্যের জন্য কাঁদিবার পর্যন্ত অবসর নাই, এ এক অদ্ভুত অবস্থা। তিনি বলিলেন, আঙুলে আবার কি হবে বল? আঙ্গুল তো

কুষ্ঠ-কুষ্ঠ।–সুনীতির কথার উপরেই চাপা গলায় রামেশ্বর বলিয়া উঠিলেন, অনেক দিন আগে থেকে সূত্রপাত, তোমায় বিয়ে করার আগে থেকে। লুকিয়ে তোমায় বিয়ে করেছি।

সুনীতা বজ্রাহতার মত নিস্পন্দ নিথর হইয়া গেলেন।

.

০৯.

এক বৎসরের মধ্যেই চক্রবর্তী-বাড়ির অবস্থা হইয়া গেল বজ্রাহত তালগাছের মত। তালগাছের মাথায় বজ্রাঘাত হইলে সঙ্গে সঙ্গেই সে জ্বলিয়া পুড়িয়া ভস্মীভূত হইয়া যায় না। দিন কয়েকের মধ্যেই পাতাগুলি শুকাইয়া যায়, তারপর শুষ্ক পাতাগুলি গোড়া হইতে ভাঙিয়া ঝুলিয়া পড়ে, ক্রমে সেগুলি খসিয়া যায়, অক্ষত-বহিরঙ্গ সুদীর্ঘ কাণ্ডটা ছিন্নকণ্ঠ হইয়া পুরাকীর্তির স্তম্ভের মত দাঁড়াইয়া থাকে। চক্রবর্তী-বাড়ির অবস্থাও হইল সেইরূপ। মহীন্দ্রের মামলাতেই চক্রবর্তী-বাড়ির বিষয়-সম্পত্তি প্রায় শেষ হইয়া গেল। থাকিবার মধ্যে থাকিল বজ্রাহত তালকাণ্ডের মত প্রকাণ্ড বাড়িখানা, সেও সংস্কার-অভাবে জীর্ণ, শ্রীহীনতায় রুক্ষ কালো। ইহারই মধ্যে বাড়িটার অনেক জায়গায় পলেস্তারা খসিয়া গিয়াছে, চুনকামের অভাবে শেওলায় ছাইয়া কালো হইয়া উঠিয়াছে। মহীন্দ্রের মামলায় দুই হাজারের স্থলে খরচ হইয়া গেল পাঁচ হাজার টাকা। মজুমদারের বন্দোবস্তে টাকার অভাব হয় নাই, হ্যাণ্ডনোটেই টাকা পাওয়া গিয়াছিল। কিন্তু টাকা থাকিতেও বাকি রাজস্বের দায়ে একদিন সম্পত্তিও নিলাম হইয়া গেল। ভাগ্যের এমনি বন্দোবস্ত যে নীলামটা হইল যেদিন মহীন্দ্রের মামলায় রায় বাহির হইল সেই দিনই। মামলার এই চরম উত্তেজনাময় সঙ্কটের দিনেই ছিল নীলামের দিন, মজুমদারের মত লোকও একথা বিস্মৃত হইয়া গেল। যখন খেয়ালে আসিল, তখন যাহা ঘটিবার তাহা ঘটিয়া গিয়াছে। রায়-বাড়ির অনেকে মনে মনে পুলকিত হইয়া উঠিলেও চক্রবর্তী-বাড়িতে এজন্য আক্ষেপ উঠিল না। বিদ্যুৎস্পৃষ্টের তো বজ্রনাদে শিহরিয়া উঠিবার অবকাশ হয় না। মামলায় মহীন্দ্রের দশ বৎসর দ্বীপান্তরের আদেশ হইয়া গিয়াছে, সেই আঘাতে চক্রবর্তী-বাড়ি তখন নিস্পন্দ হইয়া গিয়াছে।

সকলেই আশা করিয়াছিল, মহীন্দ্রের গুরুতর শাস্তি কিছু হইবে না। সমাজের নিকট মহীন্দ্রের অপরাধ, ননী পালের অন্যায়ের হেতুতে, মার্জনার অতীত বলিয়া বোধ হয় নাই; কিন্তু বিচারালয়ে সরকারী উকিলের নিপুণ পরিচালনায় সে অপরাধ অমার্জনীয় বলিয়াই প্রমাণিত হইয়া গেল। মায়ের অপমানে সন্তানের আত্মহারা অবস্থার অন্তরালে তিনি বিচারক ও জুরীগণকে দেখাইয়া দিলেন, জমিদার ও প্রজায় চিরকালের বিরোধ। সওয়ালের সময় তিনি ঈশপের নেকড়ে ও মেষশাবকের গল্পটির উল্লেখ করিয়া বলিলেন, এই অপরাধ যদি ওই অপমানসূচক কয়টি কথার ভারে লঘু হইয়া যায়, তবে ঈশপের নেকড়েরও মেষশাবক-হত্যার জন্য বিন্দুমাত্র অপরাধ হয় নাই। নেকড়েরও অভিযোগ ছিল যে, মেষশাবক নেকড়ের বাপকে গালিগালাজ করিয়াছিল। ওই অপমানের কথাটা ঈশপের গল্পের মত দুরাত্মার একটা ছল মাত্র; আসল সত্য হইল, উদ্ধত জমিদারপুত্র ওই হতভাগ্য তেজস্বী প্রজাটিকে দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হিসাবে হত্যা করিয়াছে এবং সে-কথা আমি যথাযথরূপে প্রমাণ করিয়াছি বলিয়াই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। আর যে কথা কয়টিকে মর্মান্তিক অপমানসূচক বলিয়া চরম উত্তেজনার কারণস্বরূপ ধরা হইতেছে, সে-কথাও মিথ্যা নয়, সে-কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্য। আসামীর–

কেন আপনি মিথ্যা বকছেন?-উকিলের সওয়ালে বাধা দিয়া মহীন্দ্র বলিয়া উঠিল। সে কাঠগড়ায় রেলিঙের উপর ভর দিয়া দাঁড়াইয়া ছিল। উকিলের বক্তব্যের প্রারম্ভ শুনিয়াই সে তৈলহীন রুক্ষ পিঙ্গল-কেশ আসামী পিঙ্গল চোখে তীব্র দৃষ্টি লইয়া মূর্তিমান উগ্রতার মত বলিয়া উঠিল, কেন আপনি মিথ্যা বকছেন? হ্যাঁ, উদ্ধত প্রজা হিসেবেই ওকে আমি গুলি করে মেরেছি।

সরকারি উকিল বলিলেন, দেখুন দেখুন, আসামীর মূর্তির দিকে চেয়ে দেখুন। প্রাচীন আমলের সামন্ততান্ত্রিক মনোভাবের জ্বলন্ত নিদর্শন।

ইহার পর চরম শাস্তি হওয়াই ছিল আইনসঙ্গত বিধান। কিন্তু বিচারক ওই অপমানের কথাটাকে আশ্রয় করিয়া এবং অল্প বয়সের কথাটা বিবেচনা করিয়া সে শাস্তি বিধানের হাত হইতে মহীকে অব্যাহতি দিলেন। ওদিকে সম্পত্তি তখন নিলামে বসিয়াছে। ডাকিয়াছেন চক্রবর্তী-বাড়ির মহাজন মজুমদার মশায়েরই শ্যালক। লোকে কিন্তু বলিল, শ্যালক মজুমদারের বেনামদার।

মহীন্দ্র অবিচলিত ভাবেই দণ্ডাজ্ঞা গ্রহণ করিল। সকলে বিস্মিত হইয়া দেখিল। রায় দিয়া এজলাস ভাঙিয়া বিচারক বলিলেন, I admire his boldness! সাহসের প্রশংসা করতে হয়।

সরকারি উকিল হাসিয়া বলিলেন, Yes Sir! এর পিতামহ সাঁওতাল-হাঙ্গামার সময় সাঁওতালদের সঙ্গে যোগ দিয়ে লড়াই ক’রে মরেছিল। সামন্তবংশের খাঁটি রক্ত ওদের শরীরে- true blood!

মহীন্দ্র সম্পত্তি নিলামের কথা শোনে নাই। সে শুধু আপন দণ্ডাজ্ঞাটাকেই তাহাদের সংসারের একমাত্র দুর্ভাগ্য বিবেচনা করিয়া মজুমদারকে ডাকিয়া বলিল, দুঃখ করবেন না। আপীল করবার প্রয়োজন নেই। আমি নিজে যেখানে স্বীকার করেছি, তখন আপীলে ফল হবে না। আর সর্বস্বান্ত হয়ে মুক্তি পেয়ে কি হবে? শেষে কি রায়-বাড়িতে ভিক্ষে ক’রে খেতে হবে?

কোর্টের জনতার মধ্যে একখানা চেয়ারে স্তম্ভিতের মত বসিয়া ছিলেন ইন্দ্র রায়। মহীন্দ্র শেষ কথাটা তাঁহারই দিকে লক্ষ্য করিয়া বলিল। কথাটা রায়ের কানেও গেল, কিন্তু কোনমতেই মাথা তুলিয়া তিনি চাহিতে পারিলেন না।

মহীন্দ্র আবার বলিল, পারেন তো বাবার কাছে খবরটা চেপে রাখবেন। মাকে কাঁদতে বারণ করবেন। বাবার ভার এখন সম্পূর্ণ তাঁর ওপর। আর অহিকে যেন পড়ানো হয়, যতদূর সে পড়তে চাইবে।

মাথা উঁচু করিয়া হাতকড়ি পরিয়া সে কস্টেবলের সঙ্গে চলিয়া গেল। সকলের শেষে ইন্দ্র রায় মাথা হেঁট করিয়া কোর্ট হইতে বাহির হইয়া আসিলেন। বাড়ি ফিরিয়া একেবারে অন্দরে গিয়া বিছানায় শুইয়া পড়িলেন। তাঁহার মুখ দেখিয়া হেমাঙ্গিনী শিহরিয়া উঠিলেন, অত্যন্ত কুণ্ঠিত এবং শঙ্কিত ভাবে প্রশ্ন করিলেন, কি হ’ল?

ইন্দ্র রায় কথার উত্তর দিলেন না।


সুনীতি সব সংবাদই শুনিলেন। মহীন্দ্রের সংবাদ শুনিলেন সেই দিনই তবে এ-সংবাদটা শুনিলেন দিন দুই পর–অপরের নিকট; গ্রামে তখন গুজব রটিয়া গিয়াছিল। সুনীতি এই দুঃসহ দুঃখের মধ্যেও উদাসীন হইয়া থাকিতে পারিলেন না, তিনি মজুমদারকে ডাকিয়া বলিলেন, ঠাকুরপো, এ কি সত্যি?

মজুমদার নিরুত্তর হইয়া অপরাধীর মত দাঁড়াইয়া রহিল।

সুনীতি বলিলেন, বল ঠাকুরপো বল। ভিক্ষে করতেই যদি হয় তবে বুক আগে থেকেই বেঁধে রাখি, আর গোপন করে রেখো না, বল।

মজুমদার এবার বলিল, কি বলব বউঠাকরুন, আমি তখন মহীর মামলার রায় শুনে—

সুনীতি অসহিষ্ণু হইয়া কথার মাঝখানেই প্রশ্ন করিলেন, সব গেছে?

চোখ মুছিয়া মজুমদার বলিল, আজ্ঞে না, দেবোত্তর সম্পত্তি, আমাদের লাখেরাজ, এই গ্রাম, তারপর চক আফজলপুর, তারপর জমিজেরাত-এসব রইল।

সুনীতি চুপ করিয়া রহিলেন, আর তাঁহার জানিবার কিছু ছিল না। মজুমদার একটু নীরব থাকিয়া বলিল, একটা কাজ করলে একবার চেষ্টা করে দেখা যায়। বিষয় হয়তো ফিরতেও পারে। ওই চরটার জন্য অনেক দিন থেকে একজন ধরাধরি করছে, ওটা বিক্রি ক’রে মামলা করে দেখতে হয়, বিষয়টা যদি ফেরে।

সুনীতি বলিলেন, না ঠাকুরপো, ও চরটা থাক। ওই চরের জন্যেই মহী আমার দ্বীপান্তর গেল, ও চর মহী না ফেরা পর্যন্ত প’ড়েই থাক।

মজুমদার একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিল, তবে থাক। তা হ’লেও আমি ছাড়ব না, যাব একবার আমি রবি ঘোষালের কাছে টাকা নিয়ে সে সম্পত্তি ফিরে দিক।

সুনীতি হাসিলেন, বলিলেন, তিনিও তো অনেক টাকা পাবেন; সে টাকাই বা কোথা থেকে দেবে বল? তুমি তো সবই জান।

মজুমদার আর কিছু বলিল না। যাইবার জন্যই উঠিয়া দাঁড়াইল। কিন্তু সুনীতি বাধা দিয়া বলিলেন, আর একটু দাঁড়াও ঠাকুরপো। কথাটা কিছুদিন থেকেই বলব ভাবছি, কিন্তু পারছি না। বলছিলাম, তুমি তো সবই বুঝছ; যে অবস্থায় ভগবান ফেললেন, তাতে ঝি, চাকর, রাঁধুনী সবাইকে জবাব দিতে হবে। তোমার সম্মানই বা মাসে মাসে কি দিয়ে করব ঠাকুরপো?

মজুমদার তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিল, তা বেশ তো বউঠাকরুন, আর কাজই বা এমন কি রইল এখন? লোকের দরকারই বা কি? তবে যখন যা দরকার পড়বে, আমি ক’রে দিয়ে যাব। যে আদায়টুকু আছে, সেও আমি না হয় গোমস্তা হিসেবে ক’রে দেব। সরঞ্জামি কেবল নগদীর মাইনেটাই দেবেন।

সুনীতি আর কোন কথাই বলিলেন না, মজুমদার ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেল। সেই দিনই সুনীতি মানদা, বামুনঠাকরুন, এমন কি চাকরটিকে পর্যন্ত জবাব দিলেন। কিন্তু জবাব দেওয়া সত্ত্বেও গেল না শুধু মানদা। সে বলিল, আমি যাব না। আজ পঁচিশ বছর এখানে রয়েছি, চোখও বুজব এই বাড়িতে। বাড়ি নাই, ঘর নাই, আমি কোথায় যাব? তা ঝাঁটাই মার আর জুতোই মার! হ্যাঁ!

ইন্দ্র রায় সেই যে কোর্ট হইতে আসিয়া বাড়ি ঢুকিয়াছিলেন, দুই তিন ধরিয়া আর তিনি বাহির হন নাই। অত্যন্ত গম্ভীর মুখে ঘরের মধ্যেই ঘুরিয়া বেড়ান, কাহাকেও কোন কথা বলেন না, এমন কি দিনের মধ্যে তামাক দিতেও কাহাকেও ডাকেন না। তাহার সে মুখ দেখিয়া চাকরবাকর দূরের কথা আদরিণী মেয়ে উমা পর্যন্ত সম্মুখে আসে না। সেদিন হেমাঙ্গিনী আসিয়া কুণ্ঠিতভাবে দাঁড়াইলেন। রায় তাঁহার দিকে চাহিয়া দেখিয়া চিন্তাকুল গম্ভীর মুখেই ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া বলিলেন, অ্যাঁ?

হেমাঙ্গিনী কুণ্ঠিত মৃদুস্বরে বলিলেন, একটা কথা জিজ্ঞেস করতে এসেছি।

রায়ের মাথাটা আরও একটু ঝুঁকিয়া পড়িল।

হেমাঙ্গিনী বলিলেন, শরীর কি তোমার

কথার মাঝখানেই রায় মাথা তুলিয়া উদ্ভ্রান্তস্বরে ডাকিয়া উঠিলেন, তারা-তারা মা!

হেমাঙ্গিনী দেখিলেন, রায়ের চোখ দুইটায় জল টলমল করিতেছে। হেমাঙ্গিনী মাথা নীচু করিলেন। রায় বলিলেন, লজ্জার বোঝা-শুধু লজ্জার বোঝা নয় হেম, এ আমার অপরাধের বোঝা-মাথায় নিয়ে মাথা আমি তুলতে পারছি না। রামেশ্বরের বড় ছেলে আমার মাথাটা ধুলোয় নামিয়ে দিয়ে গেল। তারা-তারা মা! আবার বার কয়েক অস্থিরভাবে ঘুরিয়া রায় বলিলেন, হেমাঙ্গিনী, আমি নিযুক্ত করেছিলাম ননী পালকে। শুধু চর দখল করাই আমার উদ্দেশ্য ছিল না। ননীকে আমি বলেছিলাম, চক্রবর্তীদের যদি প্রকাশ্যভাবে অপমান করতে পারিস, তবে আমি তোকে বকশিশ দেব। ননী অপমান করলে রাধারাণীর-আমার সহোদরার।

হেমাঙ্গিনীর চোখ দিয়া অশ্রুর বন্যা নামিয়া আসিল।

রায় আবেগভরে বলিতে বলিতে শিহরিয়া উঠিলেন, উঃ, আদালতে মহীন কি বললে জান? সরকারী উকিল বললেন, মৃত ননী পাল যার অপমান করেছিল, সে আসামীর সৎমা। মহীন তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদ ক’রে উঠল, যার নয়-বলুন যাঁর,–সে নয়–বলুন তিনি, সৎমা নয়–মা, আমার বড় মা।

গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া হেমাঙ্গিনী উদাস কণ্ঠে বলিলেন, দ্বীপান্তর হয়ে গেল?

দশ বৎসর! বার কয়েক ঘুরিয়া রায় অকস্মাৎ হেমাঙ্গিনীর হাত ধরিয়া বলিলেন, তুমি একবার মহীনের মায়ের কাছে যাবে হেম?

হেমাঙ্গিনী স্বামীর মুখের দিকে চাহিলেন।

রায় বলিলেন,আমার অনুরোধ! আমাকে এর প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে হেম। রামেশ্বরের স্ত্রীপুত্রকে রক্ষা করতে হবে।

হেমাঙ্গিনী এবার কাতর স্বরে বলিলেন, ওগো, কোন্ মুখে আমি গিয়ে দাঁড়াব? কি বলব?

রায় আবার মাথা নীচু করিয়া পদচারণ আরম্ভ করিলেন। হেমাঙ্গিনীর কথার জবাব তিনি খুঁজিয়া পাইলেন না। কিছুক্ষণ পর হেমাঙ্গিনী আত্মসম্বরণ করিয়া বলিলেন, উমাকে সঙ্গে নিয়ে যাই।

রায় বলিলেন, আমি তোমাকে পাঠিয়েছি হেমাঙ্গিনী, এ কথাটা গোপন করো। তুমি যেন আপনি— আমাকে লুকিয়ে গেছ। মহীনের মা যদি ফিরিয়ে দেন। মাথা নত করিয়া আবার বলিলেন- বলবে, যোগেশ মজুমদারকে যেন জবাব দেন আর চরের খাজনা আদায় করে নিন ওঁরা।

হেমাঙ্গিনী চলিয়া গেলেন। রায় এতক্ষণ অন্দর হইতে কাছারিতে আসিয়া একজন পাইককে বলিলেন, যোগেশ মজুমদারকে একবার ডাক দেখি। বলবি, জরুরি কাজ। সঙ্গে নিয়ে আসবি, বুঝলি?

মজুমদার তাঁহার কাছারির ফটকে প্রবেশ করিবামাত্র তিনি সাগ্রহে সম্ভাষণ জানাইয়া বলিলেন, আরে, এস, এস, মজুমদার মশায়, এস!

মজুমদার প্রণাম করিয়া বলিল, আজে বাবু, আশয়হীন লোককে মহাশয় বললে গাল দেওয়া হয়। আমি আপনাদের চাকর।

হাসিয়া রায় বলিলেন, বিষয় হ’লে আশয় হতে কতক্ষণ মজুমদার, এক দিনে এক মুহূর্তে জন্মে যায়।

মজুমদার চুপ করিয়া রায়ের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। রায় বলিলেন, জান মজুমদার, আজকাল বড় বড় লোকের মাথা বিক্রি হয়, মৃত্যুর পর তাদের মাথা নিয়ে দেখে, সাধারণ লোকের সঙ্গে তাদের মস্তিষ্কের কি তফাৎ। তা আমি তোমার খান-দুয়েক হাড় কিনে রাখতে চাই, পাশা তৈরি করাব।

মজুমদারের মুখ চোখ লাল হইয়া উঠিল কিন্তু মুখে কিছু বলিতে পারিল না। রায় আবার বলিলেন, রহস্য করলাম, রাগ ক’রো না। এখন একটা কাজ আমার করে দাও। চরটা আমাকে ব’লে ক’রে বিক্রি করিয়ে দাও। ওটার জন্য আমার মাথা আজও হেঁট হয়ে রয়েছে গ্রামে।

মজুমদার এবার গলা পরিস্কার করিয়া লইয়া বলিল, ওঁরা বিক্রি করবেন না রায় মশায়।

ওঁরা? ওঁরা কে হে? তুমিই তো এখন মালিক।

আমার জবাব হয়ে গেছে।

জবাব হয়ে গেছে! কে জবাব দিল? রামেশ্বরের এখন এদিকে দৃষ্টি আছে নাকি?

আজ্ঞে না। তিনি একেবারেই কাজের বাইরে গিয়েছেন। জবাব দিলেন গিন্নীঠাকরুণ।

রায় অনেকক্ষণ নীরব থাকিয়া বলিলেন, মেয়েটি শুনেছি বড় ভাল, সাবিত্রীর মত সেবা করেন রামেশ্বরের। এদিকে বুদ্ধিমতী ব’লেও তো বোধ হচ্ছে। না হ’লে তুমি তো বাকিটুকু অবশিষ্ট রাখতে না। বাঘে খানিকটা খেয়ে ইচ্ছে না হ’লে ফেলে যায়, কিন্তু সাপের তো উপায় নেই, গিলতে আরম্ভ করলে শেষ তাকে করতেই হয়। কিন্তু কাজটা তুমি ভাল করলে না মজুমদার।

এইবার মজুমদার বলিল, আজ্ঞে বাবু টাকাও তো আমি পাঁচ হাজার দিয়েছি।

তা দিয়েছ; কিন্তু মামলা- খরচের অজুহাতে তার অর্ধেকই তো তোমার ঘরেই ঢুকেছে মজুমদার। আমি তো সবই জানি হে। আমার দুঃখটা থেকে গেল, চক্রবর্তীদের আমি ধ্বংস করতে পারলাম না।

মজুমদার জবাব দিল, আজ্ঞে, পনের আনা তিন পয়সাই আপনার করা বাবু, ননী পালকে তো আপনিই খাড়া করেছিলেন।

রায় একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, ও কাজটাতে আমি সুখী হতে পারি নি যোগেশ। এত খানি খাটো জীবনে হই নি। রামেশ্বরের বড়ছেলে আমার গালে চুনকালি মাখিয়ে দিয়ে গেছে। সেই কালি আমাকে মুছতে হবে। সেই কথাটা তোমাকে বলবার জন্যেই আমি তোমাকে ডেকেছিলাম। আর লোভ তুমি ক’রো না। ওই চরের দিকে হাত বাড়িও না, ওগুলো রামেশ্বরের ছেলেদের থাক। ওরা না জানুক, তুমি জেনে রাখ, রক্ষক হয়ে রইলাম আমি।

মজুমদারের বাক্যস্ফূর্তি হইল না; সে আপনার করতলের রেখাগুলির দিকে চাহিয়া বোধ করি আপনার ভাগ্যলিপি অনুধাবনের চেষ্টা করিতে লাগিল। রায় সহসা বলিলেন, সাইকেলে ওটি-রামেশ্বরের ছোট ছেলে নয়?

সম্মুখ পথে কে একজন অতি দ্রুত সাইকেল চালাইয়া চলিয়াছিল, গতির দ্রুততা হেতু মানুষটিকে সঠিক চিনিতে না পারিলেও এ ক্ষেত্রে ভুল হইবার উপায় ছিল না। আরোহীর উগ্র-গৌর দেহবর্ণ, তাহার মাথার উপর পিঙ্গলবর্ণ দীর্ঘ চুলগুলো বাতাসে চঞ্চল হইয়া নাচিতেছে চক্রবর্তীদের বংশপতাকার মত। মজুমদার দেখিয়া বলিল, আজ্ঞে হ্যাঁ, আমাদের অহীন্দ্রই বটে।

রায় বলিলেন, ডাক তো, ডাক তো ওকে। এত ব্যস্তভাবে কোথা থেকে আসছে ও?

মজুমদারও চঞ্চল হইয়া উঠিল, সে বার বার ডাকিল, অহি! অহি! শোন, শোন।

গতিশীল গাড়ির উপর হইতেই সে মুখ ফিরাইয়া দেখিয়া একটা হাত তুলিয়া বলিল, আসছি। পরমুহর্তেই সে পথে মোড় ফিরিয়া অদৃশ্য হইয়া গেল। মজুমদার ব্যস্ত হইয়া বলিল, আমি যাই তা হ’লে বাবু। দেখি, অহি অমন করে কোথা থেকে এল, খবরটা কি আমি জেনে আসি।

আমার খবরটা জানিও যেন মজুমদার।


দ্রুতবেগে গাড়িখানা চালাইয়া বাড়ির দুয়ারে আসিয়া অহীন্দ্র একরূপ লাফ দিয়া নামিয়া পড়িল। গাড়ি হইতে নামিয়া বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করিবার জন্যও সে ছুটিয়া চলিয়াছিল। কিন্তু স্তব্ধ বাড়িখানার ভিতর হইতে একটি অতি মৃদু ক্রন্দনের সুর তাহার কানে আসিতেই তাহার গতি মন্থর এবং সকল উত্তেজনা ম্রিয়মাণ হইয়া গেল। ধীরে ধীরে বাড়িতে প্রবেশ করিয়া সে ডাকিল, মা।

দ্বিপ্রহরের নির্জন অবকাশে সুনীতি আপনার বেদনার লাঘব করিতেছিলেন, মৃদু মৃদু বিলাপ করিয়া কাঁদিতেছিলেন। অহির ডাক শুনিয়া তিনি চোখ মুছিয়া বাহিরে আসিলেন, বলিলেন, দেরি করলি যে অহি? কালই ফিরে আসবি ব’লে গেলি! কণ্ঠস্বরে তাঁহার শঙ্কার আভাস।

অহি বলিল, হেডমাস্টার মশায় কাল ফিরে আসেন নি মা, আজ সকাল নটায় এলেন ফিরে।

পরীক্ষার খবর বেরিয়েছে?

হ্যাঁ মা।

তোর খবর?

পাস হয়েছি মা।

তবে বলছিস না যে? সুনীতির ম্লান মুখ এবার ঈষৎ উজ্জ্বল হইয়া উঠিল।

বলতে ভাল লাগছে না মা। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া অহি বলিল, দাদা আমার বলেছিলেন, ভাল ক’রে পাস করলে একটা ঘড়ি কিনে দেবেন-একটা রিস্টওয়াচ।

সুনীতির চোখ দিয়া আবার জল ঝরিতে আরম্ভ করিল

অহি বলিল, আমি বড় অকৃতজ্ঞ মা। মাস্টার মশায় বললেন, কম্পিট তুমি করতে পার নি, তবে ডিভিশনাল স্কলারশিপ তুমি পাবেই। যে কলেজেই যাবে, সুবিধে অনেক পাবে। কোথায় পড়বে ঠিক ক’রে ফেল। আমি শুনে আনন্দে আত্মহারা হয়ে ছুটে এলাম। সমস্ত পথটার মধ্যে দাদার কথা একবারও মনে পড়ে নি মা; বাড়িতে এসে ঢুকতেই তোমার কান্নার আওয়াজে আমার স্মরণ হ’ল, দাদাকে মনে পড়ে গেল।

সুনীতি ছেলেকে বুকে টানিয়া লইয়া বলিলেন, তুই ভাল করে পড়ে টপ-টপ করে পাস করে নে। তারপর তুই জজ হবি অহি। দেখবি এমন ধারার অবিচার যেন কারও ওপর না হয়। ততদিনে মহী ফিরে আসবে। সে বাড়িতে বসে ঘর-সংসার দেখবে, তুই সেখান থেকে টাকা পাঠাবি।

অহি বলিল, একটা খবর নিলাম মা এবার। দশ বছর দাদাকে থাকতে হবে না। মাসে মাসে চার পাঁচ দিন করে মাফ হয়। বছরের দু মাস তিন মাসও হয় ভাল ব্যবহার করলে। তা হলে তিন দশে তিরিশ মাস আড়াই বছর বাদ যাবে, দশ বছর থেকে সাড়ে সাত বছর থাকতে হবে। আর দ্বীপান্তর লিখলেও আজকাল সকলকে আন্দামানে পাঠায় না। দেশেই জেলে রেখে দেয়।

উপরে রামেশ্বর গলা ঝাড়িয়া পরিস্কার করিয়া লইলেন। শব্দ শুনিয়া সচকিত হইয়া সুনীতি বলিলেন, বাবুকে প্রণাম করবি আয় অহি। ওঁকে খবর দিয়ে আসি, ওঁর কথাই আমরা সবাই ভুলে যাই।

মাটির পুতুলের মত একইভাবে রামেশ্বর সেই খাটের উপর বসিয়া ছিলেন। সুনীতি সত্য সত্যই একটু আনন্দের হাসি হাসিয়া বলিলেন, ওগো অহি তোমার পাস করেছে, স্কলারশিপ পেয়েছে।

অহি রামেশ্বরকে প্রণাম করিল। রামেশ্বর হাত বাড়াইয়া তাহাকে কাছে বসাইয়া বলিলেন, পাস করেছ, স্কলারশিপ পেয়েছ?

হ্যাঁ, ওকে আশীর্বাদ কর।

হ্যাঁ হ্যাঁ।

ও এবার কলেজে পড়তে যাবে। যে কলেজেই যাবে সেখানে ওকে অনেক সুবিধে দেবে।

বাঃ বাঃ, রাজা দিলীপের পুত্র রঘু-সমস্ত বংশের মুখ উজ্জ্বল করেছিলেন, তাঁরই নামে বংশের পর্যন্ত নাম হয়ে গেল রঘুবংশ। তুমি রঘুবংশ পড়েছ অহি, মহাকবি কালিদাসের রঘুবংশ? “বাগর্থাবিব সম্পৃক্তৌ। বাগর্থপ্রতিপত্তরে-জগতঃ পিতরৌ বন্দে পার্বতীপরমেশ্বরৌ।”

অহি এবার বলিল, স্কুলে তো এ-সব মহাকাব্য পড়ানো হয় না, এইবার কলেজে পড়ব।

ইংরেজদের এক মহাকবি আছেন, তাঁর নাম শেক্সপীয়ার। সে-সবও পড়ো।

হাঁ, শেক্সপীয়ার পড়তে হবে বি.এ-তে।

এ কথার উত্তরে রামেশ্বর আর কথা বলিলেন না। সহসা তিনি গম্ভীর হইয়া উঠিলেন, বলিলেন, যাও, তুমি এখন বেড়িয়ে এস।

সুনীতি বলিলেন, না না, ও এখনও খায় নি। তুই এখানেই বস্ অহি, আমি খাবার এখানেই নিয়ে আসি

রামেশ্বর তিক্তস্বরে বলিলেন, না না। যাও অহি, ভাল করে সাবান দিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে ফেল, স্নানই বরং কর। তারপর খাবে।

পিতার অনিচ্ছা অহীন্দ্ৰ বুঝিল, সে তাড়াতাড়ি ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। সুনীতি জলভরা চোখে বলিলেন, কেন তুমি ওকে এমন করে তাড়িয়ে দিলে? এর জন্যেই—

বাধা দিয়া রামেশ্বর আপনার দুই হাত মেলিয়া বলিলেন, ছোঁয়াচে, ছোঁয়াচে কুষ্ঠরোগ

সুনীতি আজ তারস্বরে প্রতিবাদ করিলেন, না না। কবরেজ বলেছেন, ডাক্তার বলেছেন, রক্তপরীক্ষা করে দেখেছেন, ও-রোগ তোমার নয়।

জানে না, ওরা কিছুই জানে না। বাইরের সিঁড়িতে পদশব্দ শুনিয়া রামেশ্বর নীরব হইলেন। দরজায় মৃদু আঘাত করিয়া অহীন্দ্র ডাকিল, মা!

যাই আমি অহি।–সুনীতি অভিমানভরেই চলিয়া যাইতেছিলেন, কিন্তু অহীন্দ্রই দরজা খুলিয়া ঘরে প্রবেশ করিল। তাহার পিছনে রায়গিন্নী হেমাঙ্গিনী-ইন্দ্র রায়ের স্ত্রী।

.

১০.

দীর্ঘকাল পরে হেমাঙ্গিনী রামেশ্বরকে দেখিলেন। রামেশ্বরের কথা মনে হইলেই তাঁহার স্মৃতিতে ভাসিয়া উঠিত রামেশ্বরের সেকালের ছবি। পিঙ্গল চোখ, পিঙ্গল চুল, তাম্রাভ গৌর বর্ণ, বিলাসী কৌতুকহাস্যে সমুজ্জ্বল একটি যুবকের মূর্তি। আর আজ এই রুদ্ধদ্বার অন্ধকারপ্রায় ঘরের মধ্যে বিষণ্ণ স্তব্ধ শঙ্কাতুর এক জীর্ণ প্রৌঢ়কে দেখিয়া তিনি শিহরিয়া উঠিলেন। চোখে তাঁহার জল আসিল। সুনীতির সহিত তাঁহার ঘনিষ্ঠ পরিচয় না থাকিলেও পরস্পর পরস্পরকে সামাজিক ক্ষেত্রে দেখিয়াছেন, সুতরাং তাঁহাকে চিনিতে সুনীতির বিলম্ব হইল না। তিনি অতি ধীরভাবে সাদর সম্ভাষণ জানাইয়া মৃদুকণ্ঠে বলিলেন, আসুন আসুন, দিদি আসুন। তাড়াতাড়ি তিনি একখানা আসন পাতিয়া দিলেন।

হেমাঙ্গিনী কুণ্ঠিতভাবে বলিলেন, এত খাতির করলে যে আমি লজ্জা পাব বোন, এ তো আমার খাতিরের বাড়ি নয়। তুমি তো আমার পর নও। তবে তুমি দিদি বলে সম্মান করে দিলে, আমি বসছি–বলিয়া আসনে বসিয়া সর্বাগ্রে তিনি চোখ মুছলেন। তারপর মৃদুস্বরে সুনীতিকে প্রশ্ন করিলেন, পুরনো কথা বোধ হয় ওঁর ভুল হয়ে যায়, না?

না না। আপনি রায়-গিন্নী, রায়-গিন্নী। মৃদুস্বরে বলিলেও হেমাঙ্গিনীর কথাটা রামেশ্বরের কানে গিয়াছিল, তিনি একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া অতি সকরুণ ভঙ্গিতে ঘাড় নাড়িয়া কথা কয়টা বলিলেন।

হেমাঙ্গিনীর চোখ আবার জলে ভরিয়া উঠিল। তিনি আত্মসম্বরণ করিয়া বলিলেন, না, চিনতে পারেন নি। কই, আমাকে আদর করে সম্মান করে যে নাম দিয়েছিলেন, সে নামে তো ডাকলেন না।

রামেশ্বর বলিলেন, ভুলে যান রায়-গিন্নী, ও কথা ভুলে যান! দুঃখই যেখানে প্রধান রায়-গিন্নী, সেখানে সুখের স্মৃতিতেই বা লাভ কি? ভগবান হলেন রসস্বরূপ, তিনি যাকে পরিত্যাগ করেছেন, সে ব্যক্তি পরিবেশন করবার মত রস পাবে কোথায় বলুন?

হেমাঙ্গিনী গভীর স্নেহ-অভিষিক্ত কণ্ঠস্বরে বলিলেন, না না, এ কি বলছেন আপনি? ভগবান পরিত্যাগ করলে কি সুনীতি আপনার ঘরে আসে? অহিকে দেখাইয়া বলিলেন, এমন চাঁদের মত ছেলে ঘর আলো করে?

রামেশ্বর হাসিলেন-অদ্ভুত হাসি। সে হাসি না দেখিলে কল্পনা করা যায় না। বলিলেন, সূর্যে গ্রহণ লেগেছে রায়-গিন্নী, ভরসা এখন চাঁদেরই বটে। দেখি, আপনাদের আশীর্বাদ।

প্রসাধন যতই সযত্ন এবং সুনিপুণ হোক, দিনের আলোকে প্রসাধনের অন্তরালে স্বরূপ যেমন প্রকাশ পাইয়া থাকে, তেমনই ভাবে রামেশ্বরের রূপক-উক্তির ভিতর হইতে সদ্য সংঘটিত মর্মান্তিক আঘাতের বেদনা আত্মপ্রকাশ করিল। একই সঙ্গে সুনীতি ও রায়-গিন্নীর চোখ হইতে টপটপ করিয়া জল ঝরিয়া পড়িতে আরম্ভ করিল, অহি আর সহ্য করিতে পারিল না, সে নিঃশব্দে ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেল।

রামেশ্বর সুনীতিকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, অহিকে খেতে দেবে না সুনীতি? ও তো এখনও খায় নি

হেমাঙ্গিনী ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন, সে কি! আমি তোমাকে বসিয়ে রেখেছি বোন? আর ছেলে এখনও পর্যন্ত খায় নি? মরে যাই!

এতক্ষণে সুনীতি প্রথম কথা বলিলেন, শহর থেকে এই মাত্র ফিরল। তাই দেরি হয়ে গেল। পরীক্ষার খবর বেরিয়েছে, তাই এই দুপুরেই না খেয়ে ছুটে এসেছে।

সস্নেহ হাসি হাসিয়া হেমাঙ্গীনি বলিলেন, বাছা আমার পাস করেছে নিশ্চয়? ও তো খুব ভাল ছেলে।

মুখ উজ্জ্বল করিয়া সুনীতি বলিলেন, হ্যাঁ দিদি, আপনার আশীর্বাদে খুব ভাল করে পাশ করেছে অহি; ডিভিশনের মধ্যে ফার্স্ট হয়েছে, স্কলারশিপ পাবে।

আকস্মিক প্রসঙ্গান্তরের মধ্য দিয়া অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে, পঙ্ক হইতে পঙ্কজের উদ্ভবের মত, দুঃখের স্তরকে নীচে রাখিয়া আনন্দের আবির্ভাবে সকলেই একটা স্নিগ্ধ দীপ্তিতে উজ্জ্বল হইয়া উঠিলেন। হেমাঙ্গিনী বলিলেন, শিবের ললাটে চাঁদের ক্ষয় নেই চক্রবর্তী মশায়, এ-চাঁদ আপনার অক্ষয় চাঁদ।

রামেশ্বর বলিলেন, মঙ্গল হোক আপনার, অমোঘ হোক আপনার আশীর্বাদ।

সুনীতি হেমাঙ্গিনীর পায়ের ধূলা লইয়া প্রণাম করিলেন। হেমাঙ্গিনী বলিলেন, যাও ভাই, তুমি ছেলেকে খেতে দিয়ে এস। আমি বসছি চক্রবর্তী মশায়ের কাছে।

সুনীতি চলিয়া গেলেন, যাইবার সময় হেমাঙ্গিনীকে সাবধান করিয়া চুপি চুপি বলিয়া গেলেন, মাঝে মাঝে দু-একটা ভুল বলেন, দেখবেন।

হেমাঙ্গিনী বলিলেন, কত দিন ভেবেছি, আসব, আপনাকে দেখে যাব, কিন্তু পারি নি। আবার ভেবেছি, যাক, মুছেই যখন গেছে সব, তখন মুছেই যাক। কিন্তু সেও হল না, মুছে গেল না। পাথরে দাগ ক্ষয় হয় মুছে যায় কিন্তু মনের দাগ কখনও মোছে না। আজ আর থাকতে পারলাম না। অপরাধ আমাদেরই। এর জন্য দায়ী যে উনি।

কে? ইন্দ্র? না না রায়-গিন্নী, দায়ী আমি। হেতু ইন্দ্র। সব আমি খতিয়ে দেখেছি। চিত্রগুপ্তের খাতায় মাঝে মাঝে আমি উঁকি মেরে দেখি কিনা।

হেমাঙ্গিনী একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া চুপ করিয়া রহিলেন, কিছুক্ষণ পরে বলিলেন, কিন্তু এমনভাবে ভেঙে লুটিয়ে পড়লে তো চলবে না আপনার চক্রবর্তী মশায়। সুনীতির দিকে, ছেলের দিকে একবার তাকিয়ে দেখুন তো তাদের মুখ।

বুক ফেটে যায় রায়-গিন্নী, বুক ফেটে যায়। কিন্তু কি করব বলুন, আমার উপায় নেই।

উপায় আপনাকে করতে হবে, উঠে দাঁড়াতে হবে।

কি করে উঠে দাঁড়াব? দিনের আলোতে আমার চোখে অসহ্য যন্ত্রণা, তার ওপরে, আপনার কাছে গোপন করব না, রায়-গিন্নী, হাতে আমার কুষ্ঠ হয়েছে।

হেমাঙ্গিনী স্তম্ভিত হইয়া গেলেন।

রামেশ্বর বলিলেন, এরা কেউ বিশ্বাস করে না; কবরেজ বলেন না, ডাক্তার বলেন, না। রক্তপরীক্ষা ক’রে তারা বলে, না; সুনীতি বলে, না। মূর্খ সব। রায়-গিন্নী, ভগবানের বিধানের দুর্জ্ঞেয় রহস্য এরা বোঝে না। আয়ুর্বেদে আছে কি জানেন? যেখানে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী, রোগ যেখানে কর্মফল, সেখানে চিকিৎসকের ভুল হবে। একবার নয়, শতবার দেখলে শতবার ভুল হবে।

হেমাঙ্গিনী সতর্ক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রামেশ্বরের সর্বাঙ্গ দেখিতেছিলেন, কোথাও একবিন্দু বিকৃতি তিনি দেখিতে পাইলেন না। তিনি শুনিয়াছিলেন, আজ প্রত্যক্ষ বুঝিলেন, রোগের ধারণাই মস্তিষ্কবিকৃতির উপসর্গ। বলিলেন, না চক্রবর্তী মশায়, এ আপনার মনের ভুল। কই কোথাও তো একবিন্দু কিছু নাই।

হাতের দশটা আঙুল প্রসারিত করিয়া দিয়া রামেশ্বর বলিলেন, এই আঙুলে আঙুলে।

অহীন্দ্রের খাওয়া প্রায় শেষ হইয়া আসিয়াছিল। সুনীতি একটা পাখা লইয়া বাতাস করিতেছিলেন। হেমাঙ্গিনী উপর হইতে নামিয়া আসিলেন, বলিলেন, আজ তা হ’লে আসি ভাই।

সুনীতি বলিলেন, সারাক্ষণ নন্দাইয়ের সঙ্গেই বসে গল্প করলেন, আমার কাছে একটু বসবেন না দিদি?

হেমাঙ্গিনী বলিলেন, তোমার সঙ্গে যে কত গল্প করতে সাধ, সে কথা আর একদিন বলব সুনীতি। চক্রবর্তী মশায় যখন তোমাকে বিয়ে করে আনলেন, তখন তোমার ওপরই রাগ হয়েছিল। অকারণ রাগ। তারপর যত দেখলাম, ততই তোমার সঙ্গে কথা বলে তোমাকে বুকে জড়িয়ে ধরতে সাধ হয়েছে। সে অনেক কথা, পরে একদিন বলব। আজ যাই, বুঝতেই তো পারছ লুকিয়ে এসেছি। তবে একটা কথা বলে যাই, যেটা বলতে আমার আসা। তুমি ভাই মজুমদারকে সরাও। ওঁর কাছে আমি শুনেছি, সম্পত্তি ও-ই নিজে বেনাম করে ডেকেছে।

সুনীতি একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, জানি দিদি। আমি ওঁকে জবাবও দিয়েছি। কিন্তু আশ্চর্যের কথা কি জানেন, তবুও উনি আসছেন, না বললেও কাজকর্ম করে দিয়ে যাচ্ছেন।

হেমাঙ্গিনী বলিলেন, সে ও বন্ধ করা দরকার বোন, যে এমন বিশ্বাসঘাতক হতে পারে, তাকে বিশ্বাস কি?

এখন বার বার বলছেন, চরটা বেচে ফেলুন, অনেক টাকা হবে।

না, এমন কাজও করো না ভাই। আমি ওঁর কাছে শুনেছি, চরটায় তোমাদের অনেক লাভ হবে, আয় বাড়বে।

কিন্তু চর নিয়ে যে গ্রাম জুড়ে বিবাদ দিদি, আমি কেমন করে সে সব সামলাব? আর বিবাদ না মিটলেই বা বন্দোবস্ত করব কি করে বলুন?

সাঁওতালদের ডেকে তোমরা খাজনা আদায় করে নাও সুনীতি। আমি এইটুকু বলে গেলাম যে, তোমার দাদা আর কোন আপত্তি তুলবেন না। আর কেউ যদি তোলে, তবে তাতেও তিনি তোমাকেই সাহায্য করবেন।

সুনীতি কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে হেমাঙ্গিনীর দিকে চাহিয়া বলিলেন, তাঁকে আমার প্রণাম দেবেন দিদি, বলবেন

বাধা দিয়ে হেমাঙ্গিনী বলিলেন, পারব না ভাই। বললাম তো লুকিয়ে এসেছি।


মানদা ঝি যায় নি, বাড়িঘর নাই বলিয়া এখানেই এখনও রহিয়াছে। আপনার কাজগুলি সে নিয়মিতই করে। সুনীতি আপত্তি করিলেও শোনে না। বরং কাজ তাহার এখন বাড়িয়া গিয়াছে, বাড়াইয়াছে সে নিজেই। সদর কাছারি বাড়ির চাকর চলিয়া গিয়াছে, নায়েবও নাই, কিন্তু তবুও অনেক পরিস্কারের প্রয়োজন আছে। সে প্রয়োজন সে নিজেই আবিস্কার করিয়া কাজটি আপনার ঘাড়ে লইয়াছে। তাহার উপর সকালে সন্ধ্যায় দুয়ারে জল, প্রদীপের আলো, ধূপের ধোঁয়া এগুলো তো না দিলেই নয়। হিন্দুর বাড়ি, মা লক্ষ্মী রুষ্ট হইবেন যে!

সুনীতি আপত্তি করিয়াছিলেন, কিন্তু মানদা বলিয়াছিল, যতদিন আছি আমি করি তারপর আপনার যা খুশি হয় করবেন। আপনি যদি তখন নিজে হাতে গোবর মেখে ঘুঁটে দেন পয়সা বাঁচাবার জন্যে–দেবেন, আমি তো আর দেখতে আসব না।

কাছারি বাড়ি সে পরিস্কার করে দিনে দ্বিপ্রহরে; খাওয়া-দাওয়ার পর মানুষের একটা বিশ্রামের সময় আছে, এই সময়টার বাহিরে লোকজন থাকে না, সেই অবসরে নিত্য কাজটা সারিয়া লয়। লজ্জাটা তাহার নিজের জন্য নয়, চাকরের বদলে ঝি কাছারি সাফ করিলে অন্য কেহ কিছু না বলুক, ওই রায়-বাড়ির ছেলেগুলি হয়তো ছড়া বাঁধিয়া বসিবে। সেদিন সে তক্তপোশের উপর পাতা ফরাশ হইতে আরম্ভ করিয়া মেঝে পর্যন্ত সমস্ত পরিপাটী করিয়া ঝাঁট দিতেছিল, আর গুনগুন করিয়া গান গাহিতেছিল। এতবড় নির্জন ঘরগুলোর মধ্যে একা একা কাজ করিতে করিতে কেমন গান পাইয়া বসে। দুই-একবার বড় আয়নাটার সম্মুখে দাঁড়াইয়া জিভ ও ঠোঁট বাহির করিয়া দেখে, পানের রসটা কেমন ঘোরালো হইয়াছে। স্নানের পর হইতেই চুল খোলা থাকে, খোলা চুলও এই সময়ে বাঁধিয়া লয়। আজ সহসা তাহার গান থামিয়া গেল, অনেক লোক যেন কাছারির বাহিরের প্রাঙ্গনে কথা বলিতেছে। ঝাঁট দেওয়া বন্ধ রাখিয়া উঠিয়া খড়খড়ি-দেওয়া দরজাটার খড়খড়ি তুলিয়া সে দেখিল, সাঁওতালেরা দল বাঁধিয়া দাঁড়াইয়া আছে। জনহীন রুদ্ধদ্বার কাছারির দিকে চাহিয়া তাহারা চিন্তিত হইয়া কি বলাবলি করিতেছে। মানদা ঘরের ভিতরে ভিতরেই অন্দরে চলিয়া গিয়া সুনীতিকে বলিল, সাঁওতালরা সব দল বেঁধে এসে দাঁড়িয়ে আছে মা, কি সব বলাবলি করছে। আমি এই গলি গলি গিয়ে ডাকব নায়েবকে?

সুনীতি বলিলেন, না। অহিকে ডাক্ তুই, ওপরে নিজের ঘরেই আছে সে।

অহীন্দ্র আসিয়া সম্মুখে উপস্থিত হইতেই মাঝির দল কলরব করিয়া উঠিল, রাঙাবাবু। অহীন্দ্র সাধারণতঃ এখানে থাকে না, তাহারা প্রত্যাশা করিয়াছিল মজুমদারকে। অপ্রত্যাশিত ভাবে তাহাদের রাঙাবাবুকে পাইয়া তাহারা খুব খুশি হইয়া উঠিল। অহীন্দ্র বলিল, কি রে, তোরা সব কেমন আছিস?

ঠকঠক তখন প্রণাম হইয়া গিয়াছে। কমল মাঝি জোড়হাত করিয়া বলিল, ভাল আছি আজ্ঞা। আপুনি কেমন করে এলি বাবু? আমরা সব কত বুলি, কত খুঁজি তুকে! বুলি, আমাদের রাঙাবাবু আসে না কেনে? মেয়েগুলা সব শুধায়।

হাসিয়া অহীন্দ্র বলিল, আমি যে পড়তে গিয়েছিলাম মাঝি।

ক খ অ আ সেই সব। রিংজী ফার্সী, নাকি বাবু?

হ্যাঁ, অনেক পড়তে হয়। তার পর তোরা কোথায় এসেছিস?

আপনার কাছে তো এলাম গো বুলছি আমাদের জমি কটির খাজনা তুরা লে, আমাদিগকে চেক-রসিদ দে। তা নইলে কি করে থাকবো গো?

খাজনা কে পাবেন, এখনও যে তার ঠিক হয় নি মাঝি। সে ঠিক

বাধা দিয়া কমল বলিল, না গো, সে সব ঠিক হয়ে গেল। দিলে সব ঠিক করে উই সেই রায়-হুঁজুর, আমাদিকে বুললে, চরটি তুদের রাঙাবাবুদেরই ঠিক হল মাঝি। খাজনা তুরা সেই কাছারিতে দিবি। তাথেই তো আজ ছুটে এলম গো।

দ্বিপ্রহরে হেমাঙ্গিনীর কথা অহীন্দ্রের মনে পড়িয়া গেল। সে এবার দ্বিধা না করিয়া বলিল, দে, তবে দিয়ে যা।

কিছুক্ষণ অবাক হইয়া চাহিয়া থাকিয়া মাঝি বিনয় করিয়া হাসিয়া বলিল, হা বাবু, ইটি আপনি কি বুলছিস? জমি কটি মাপতে হবে, তা বাদে হিসাব করতে হবে, তুদের খাতিতে নাম লিখতে হবে, সি সব কর আগে! লইলে কি করে দেব?

অহীন্দ্র বিব্রত হইয়া বলিল, সে তো আমি পারব না মাঝি, আমি তো জানি না ওসব। তবে আমি তার ব্যবস্থা করছি, বুঝলি?

মাঝি বিস্মিত হইয়া গেল, তবে আপনি কি বিদ্যে শিখলি গা?

হাসিয়া অহীন্দ্র বলিল, সে সব অনেক বই মাঝি, নানা দেশের কথা, কত বীরের কথা, কত যুদ্ধের কথা।

হাঁ, তা সি কোন গাঁয়ের কথা বটে গো?-বীর বুললি-কারা বটে সি সব?

সে সব পৃথিবী জুড়ে নানা দেশ আছে, সেই সব দেশ, আর সেই সব দেশের বড় বড় বীর-তাদের কথা মাঝি। আরও সব কত কথা-ওই আকাশে সূয্যি উঠছে, চাঁদ উঠছে, সেই সব কথা।

হ্যাঁ! মাঝির মুখ-চোখ বিস্ময়ে ভরিয়া উঠিল, সে মুখ ফিরাইয়া দলের সকলকে আপন ভাষায় বলিল, রাঙাবাবু কত জানে দেখ।

সঙ্গীর দল আপন ভাষায় রাঙাবাবুর তারিফ করিয়া মৃদু কলরব আরম্ভ করিয়া দিল, কমল বলিল, হ্যাঁ বাবু, এই যে পিথিমীটি, এই যি ধরতি-মায়ী-ইকে কে গড়লে? কি লেখা আছে পুঁথিতে তাদের?

অহীন্দ্র বলিল, পৃথিবী হল গ্রহ, বুঝলি? আকাশে রাত্রে সব তারা ওঠে না? এও তেমনি একটা তারা। আগে পৃথিবী দাউ দাউ করে জ্বলত। যেমন কড়াইতে গুড় কি রস টগবগ করে ফোটে তেমনি করে ফুটত।

মাঝি বিষণ্ণভাবে ঘাড় নাড়িয়া বলিল, উঁহু, তুকে এখনও অনেক পড়তে হবে। পিথিমীতে আগে ছিল জল। কিছুই ছিল না, শুধুই জল ছিল। তার পরে হল কি জানিস? বলি শোন্ বলিয়া সে মোটা গলায় আরম্ভ করিল

অথ জনম কু ধরতি লেণ্ডং
অথ জনম্ কু মানোয়া হড়
মান মান কু মানোয়া হড়
ধরতি কু ডাবাও আ-কাদা,
ধরতি সানাম্ কু ডাবাও কিদা।

গান শেষ করিয়া মাঝি বলিল, পেথমে ছিল জল-কেবল জল। তার পর হল-অথ জনম্ কু ধরতি লেণ্ডং; বুলছে, লেণ্ডং গায়ে থেকে মাটি বার করে ধরতিকে বানালে-মাটি করলে। লেণ্ডং হল-ওই যে মাছ ধরিস তুরা, কেঁচো গো, কেঁচো। দেখিস কেনে-আজও উহার গায়ে থেকে মাটি বার করে। তারপর হল- ‘অথ জম কু মানোয়া হড়’। বুলছে, মাটিতে হল মানুষ। ‘মান মান কু মানোয়া হড়’, কিনা মানুষ মানুষ-কেবলই মানুষ। তখন তুর ‘ধরতি কু ডাবাও আ-কাদা’ কিনা-মানুষ করলে ধরতি-মাটি খুঁড়ে চাষ;-ফসল হল। ‘ধরতি সানাম কু ডাবাও কিদা’- একেবারে তামাম ধরতিতে চাষ হয়ে অ্যানেক ফসল হল।

অহীন্দ্র হাসিল, কিন্তু বড় ভাল লাগিল এই গান ও গল্প। মাঝি আবার বলিল, ধরতি-মাটি বানালে তুর ‘লেণ্ডং’-কেঁচোতে, পোকাতে।

অহীন্দ্র তাহাকে উৎসাহিত করিয়া বলিল, এ সব কথা তো আমি জানি মাঝি।

উৎসাহ পাইয়া মাঝি জাঁকিয়া বসিয়া বলিল, তবে শুনো আপুনি, বুলি আপনাকে। ঠাকুর বুঝো তো বাবু, ঠাকুর-ভগোমান? সি পেথমে জল করলে–সব জল হয়ে গেল। তখুন ঠাকুর দুটি হাঁস-হাসিল বানালে। হাঁস-হাসিল হল পাখী, বুঝলিন বাবু? তা সি পাখী দুটি ঠাকুরকে বুললে, হাঁ ঠাকুর, আমাদিগে তো বানালি তা আমরা থাকব কুথা, খাব কি? ঠাকুর বললে, হেঁ, তা তো বেটে! তখন ঠাকুর ডাকলে তুর কুমীরকে। বুললে তুমি মাটি তুলতে পারিস? কুমীর বুললে, হেঁ, আপুনি বুললে পারি। কুমীর মাটি তুললে, সি-সব মাটি জলে গলে ফুরিয়ে গেল। তখন ঠাকুর ডাকলে-ইচা হাকোকে-বোয়াল মাছকে, তা উয়ার মাটিও গলে গেল। তার বাদে এল কাটকম। কি বুলিস তুরা উয়াকে? আ-হা!… কাটকমের বাংলা ভাবিয়া না পাইয়া মাঝি চিন্তিত হইয়া পড়িল।

কাঠের পুতুলের ওস্তাদ কথাটা যোগাইয়া দিল, কাঁকড়ি। কাঁকড়া বলে বাবুরা। সেই যি লম্বা লম্বা পা। হেঁ। কমল মাঝি বলিল, হেঁ। কাঁকুড়িকে ডাকলে তখুন। বুললে, মাটি তুলো তুমি! উ মাটি তুললে,

তা সিটোও গলে গেল। তখুন ঠাকুর ডাকলে লেণ্ডংকে-কেঁচোকে। শুধালে, তুমি মাটি তুলতে পারিস? উ। বললে, পারি; তা ঠাকুর, হারোকে সমেত ডাক আপুনি। হারো হল তুমার ‘কচ্ছপ’ গো। কচছপ এল। কেঁচো করলে কি- উয়াকে জলের উপর দাঁড় করালে, লিয়ে উয়ার পা কটা শিকল দিয়ে বেঁধে দিলে। তা বাদে, কেঁচো আপন লেজটি রাখলে উয়ার পিঠের উপর, আর মুখটি ডুবায়ে দিলে জলের ভিতর। মুখে মাটি খেলে আর লেজ দিয়ে বার করে কচ্ছপের পিঠের উপর রাখলে। তখুন আর গলে না। এমুনি করে মাটি তুলতে তুলতে পৃথিমী ভরে গেল।

সমস্ত কাহিনীটি বলিয়া কমল বিজ্ঞভাবে হাসিয়া বলিল, বুঝলি বাবু? ই সব তুকে শিখতে হবে।

সাঁওতালদের এই পুরাণকথা শুনিয়া অহীন্দ্র আশ্চর্য হইয়া গেল। ইহাদের এমন পুরাণকথা আছে, সে তাহা জানিত না। সে মুগ্ধ বিস্ময়ে নীরবে গল্পটি মনে মনে স্মরণ করিয়া আয়ত্ত করিয়া লইতে আরম্ভ করিল।

কমল মাঝিও নীরবে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া ছিল তাহার তারিফ শুনিবার প্রত্যাশায়। পিছন হইতে কাঠের পুতুলের ওস্তাদ বলিল, বাঃ, তুমি যে গল্পে মজিয়া গেলে গো সর্দার। জমির কথাটা বলিয়া কথাটা পাকা করিয়া লও! এই লোকটি জ্ঞানে-গরিমায় কমলের প্রতিদ্বন্দী। সর্দারের এই বিদ্যা জাহির করাটা তার সহ্য হয় না, তা ছাড়াও লোকটি খাঁটি সংসারী মানুষ, বিষয়বুদ্ধিতে পাকা। অন্য মাঝিরাও কাঠের পুতুলের ওস্তাদের কথায় সায় দিয়া উঠিল।

কমল একটু রুষ্ট হইয়াছিল, কিন্তু সকলের সমর্থন দেখিয়া সে কোন প্রতিবাদ করিল না। অহীন্দ্রের মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, বাবুমশায়!

অহীন্দ্র হাসিয়া বলিল, তোমার একথা খুব ভাল কথা মাঝি। ভারী সুন্দর।

হু গো, খুব ভাল বটে তা- হা বাবু, আমাদের তবে কি করবি?

বললাম তো লোক পাঠিয়ে দেব।

উঁ-হুঁ। তুকে নিজে যেতে হবে! উয়ারা সব চোর বটে।

কমলের চোখ দুইটি হঠাৎ জ্বলিয়া উঠিল, বলিল, শুন রাঙাবাবু, ইয়ার লেগ্যে একবার আমরা খেপলম। এই বড় বড় হাঁড়িতে ঘি নিয়ে যেতম, দোকানীরা ঘি লিথো, তা এক সেরের বেশী কখুনও হত না। মহাজনেরা কাই হড় বটে, পাপী মানুষ, মাঝিদের হাডিড চিবায়ে খেলে। গোমস্তাতে টাকা লিলে, রসিদ দিলে না। খাজনা লিলে আবার জমি লিলেম করালে। জমা বাড়ালে। বললম, জমি বাড়ুক, তবে জমা বাড়বে, লইলে কেনে বাড়বে? বাবা দাদা বন কেটে জমি করলে, আমরা খাজনা দিলম, তবে লিলেম হবে কেনে জমি? তা শুনলে না। তখন আমরা খেপলম। সিধু, কানু সুভা ঠাকুর (সুবেদার) হল- এক রাতে হল। জানিস বাবু, রাতেই লোক বড় হয়, আবার রাতেই লোক ছোট হয়। সুভা, সিধু, কানু হুকুম দিলে, আমরা খেপব। তুর দাদা-বাবার বাবা-রাঙাঠাকুর বললে, খেপ তুরা, খেপ। এই টাঙ্গি লিয়ে রাঙাঠাকুর খেপল, আমাদের বাবাদের সাথে। তখুন ধরলুম মহাজনদিকে, একটি করে আঙুল কাটলুম, আর বললাম, বাজা, টাকা বাজা! দাড়িওলা মহাজনকে জমিদারকে ধরলম, ভাল পাঁঠা বলে বোঙার কাছে কাটলম। একটো গোমস্তা জলে নামল, তীর দিয়ে তাকে বিঁধলম। তারপর টেনে তুলে- পেরথম কাটলাম পা। বললম, এই লে চার আনা সুদ। তারপর কাটলম কোমর থেকে, বললম, এই লে আট আনা, সুদ আর খাজনা। কাটলাম হাত দুটো, বললম, এই বারো আনা, সুদ, খাজনা, তোর তহুরী। তারপর কাটলাম মাথা, বললম, এই লে ষোল আনা, লিব্যাধি! ফারখত!

কমল চুপ করিল। সমস্ত বাড়িটা যেন স্তব্ধ হইয়া গেল; যেন সব উদাস হইয়া গিয়াছে। অহীন্দ্র নীরব বিস্ময়ে চাহিয়া ছিল স্তব্ধ আগ্নেয়গিরির মত ওই কমলের দিকে। সাঁওতালরাও নীরব। তাহাদের উপরেও যেন কেমন নীরব বিষণ্ণতা নামিয়া আসিয়াছে।

কমলই আবার বলিল-এবার তাহার মুখও বিষণ্ণ, কণ্ঠস্বরে মিনতির অনুনয়-বলিল, তাথেই বুলছি বাবু

অহীন্দ্র এতক্ষণে বলিল, আবার তোমাদের ঠকালে তোমারা খেপবে?

খেপব? কমল বিষণ্ণভাবে ঘাড় নাড়িয়া বলিল, না।

কেন?

রাঙাঠাকুর মল, সিধু সূভাঠাকুর মল, রাঁচিতে বিসরা মহারাজ ম’ল আর কে খেপাবে বল্? কে। হুকুম দিবে? আর বাবু

কমল আপনাদের সঙ্গীদের দেখাইয়া বলিল, ইহারা সব আর সি সাঁওতাল নাই। ইয়ারা মিছা কথা বলে, কাজ করতে গিয়ে গেরস্তকে ঠকায়, খাটে না, ইয়ারা লোভী হইছে। পাপ হইছে উয়াদের। উয়ারা খেপতে পারবে না। উয়ারা ধরম লস্ট করলে।

শেষের দিকে কমলের কণ্ঠস্বর সকরুণ হইয়া উঠিল। সব কথা শেষ করিয়া সে উদাস দৃষ্টিতে চাহিয়া কিছুক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। তাহার পিছনে মাঝির দল মাথা হেঁট করিয়া দাঁড়াইয়া ছিল। তাহাদের সর্দারের অভিযোগ তাহাদের লজ্জা দিয়াছে।

কথা বলিল সেই চূড়া মাঝি-পুতুল নাচের ওস্তাদ, সে লোকটা অনেকটা বাস্তবপন্থী, সে ঈষৎ হাসিয়া বলিল, টাকা লইলে কিছু হয় না বাবু, টাকা নাই, খেপে কি করব? আর বাবু খেপে মরেই যদি যাব তো খেপলম কেনে বল্? বুদ্ধি করলাম ইবার আমরা।

কমল তাহার মুখের দিকে ঘৃণার দৃষ্টি হানিয়া মুখ ফিরাইয়া লইল, তারপর অহীন্দ্রকে বলিল, আর উয়ারা খেপবে না বাবু। খেপলম, তারপর হাজারে হাজারে সাঁওতাল ম’ল গুলিতে। যারা বাঁচল, তারা ভাত পেলে না। সাঁয়ো ঘাস খেলে। বাবু, আমি তখন গিধরা-ছেলেমানুষ-তবু মনে লাগছে (পড়ছে), ইঁদুরের দড় (গর্ত) থেকে ধান বার করলম-গুণে চারটি ধান, জলে সিজলাম (সিদ্ধ করলাম), সেই জল খেলম, ফেন বলে। আর উয়ারা খেপবে না। তাথেই সাহস হচ্ছে না। বুলছে চেক রসিদটি না হলে উয়াদের চাষে মন লাগছে না। তা বাদে আমাদের বিয়া আছে। ওই যে আমার লাতিনটি-সেই লম্বা পারা, তারই বিয়া হবে। তাথেই সব মাতন আছে আমাদের, হাঁড়িয়া খাবে সব, নাচবে, গান করবে। তাথেই সব তাড়াতাড়ি করছে।

অহীন্দ্র বলিল, বেশ, তাড়াতাড়ি করে নেব- কাল কি পরও। কিন্তু তোর নাতনীর বিয়েতে আমাদের নেমন্তন্ন করবি না?

মাঝি শিহরিয়া উঠিয়া বলিল, বাবা রে, আমাদের রাজা তুমি, রাঙাঠাকুরের লাতি, তেমুনি আগুনের পারা রঙ, তেমনি চোখ, তেমনি চুল। আপোনাকে তাই বলতে পারি? আমরা সব কত কি খাই-মুরগী শুয়োর ছি!

সাঁওতালরা চলিয়া গেল। অহীন্দ্র মুগ্ধ হইয়া তখনও ওই বুড়া মাঝির কাহিনীর কথা ভাবিতেছিল। সে নিজে বিজ্ঞান ভালবাসে। বুড়োর কাহিনীর মধ্যে আদিম বর্বর জাতির বৈজ্ঞানিক মনকে সে আবিস্কার করিল। সৃষ্টিরহস্যভেদে অনুসন্দধিৎসু মন কল্পনার সাহায্যে কাহিনী রচনা করিয়া রহস্যভেদ করিয়াছে।

তাহার চিন্তার সূত্র ছিন্ন করিয়া দিয়া রংলাল ও নবীন আসিয়া প্রণাম করিয়া দাঁড়াইল- দাদাবাবু!

জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাহাদের দিকে অহীন্দ্র চাহিল, কোন কথা বলিল না।

একগাল হাসিয়া রংলাল বলিল, এই দেখেন, চর আপনাদেরই হল তো? আমি মশায়, বলেছিলাম কিনা? ছোট রায়-হুঁজুর সাঁওতালদের বলে দিয়েছেন তো, এই কাছারিতে খাজনা দিতে।

অহীন্দ্রের একটা কথা মনে হইল, সে নবীনকে বলিল, নবীন তুমি তো পুরনো লোক। সাঁওতালদের জমিটা মাপ করে দিতে পারবে?

সবিনয়ে নবীন বলিল, আজ্ঞে হ্যাঁ। মাপ-জোক সব করে দেব আমি।

সোৎসাহে রংলাল বলিল, আপনি চলুন, গিয়ে দাঁড়াবেন শুধু, বাস্। আমরা সব ঠিক করে দেব।

অহীন্দ্র বলিল, কাল ভোরে তা হলে এস তোমরা।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress