Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

বাসায় এসে তপু এবং টুশি আবিষ্কার করল তপুর নানি বাইরের ঘরের সোফায় দুই পা তুলে বসে আছেন। তপুর নানি আগেও এক দুইবার এই বাসায় এসেছেন, একেবারে থুরথুরে বুড়ো, মাথার চুল শনের মতো সাদা কিন্তু খুব হাসিখুশি। টুশি আগেও লক্ষ করেছে মানুষ দুরকমভাবে বুড়ো হয়, এক ধরনের মানুষকে দেখে মনে হয় বুড়ো অন্য ধরনের মানুষকে দেখে মনে হয় শিশু। তপুর নানি দ্বিতীয় ধরনের তাকে দেখে কেমন যেন ছোট বাচ্চার মতো মনে হয়। টুশির বয়সী ছেলেমেয়েরা সাধারণত বুড়ো মানুষদের পছন্দ করে না, কিন্তু টুশির কথা আলাদা। প্রায় সারাটা জীবনই সে তার নানার সাথে কাটিয়েছে তাই বুড়ো মানুষদের তার খুব ভালো লাগে। তাই নানিকে দেখে তপু যেটুকু খুশি হলো টুশি খুশি হলো আরও বেশি! সে ছুটে গিয়ে নানিকে জড়িয়ে ধরে বলল, “নানি–তোমাকে দেখতে আজকে কত। সুইট লাগছে।”

নানি দাঁতহীন মাঢ়ি বের করে হেসে বললেন, “সুইট লাগবে না! দেখছিস না ঠোঁটে লিপস্টিক দিয়েছি, গায়ে পাউডার দিয়েছি, কপালে টিপ দিয়েছি, লাল শাড়ি পরেছি!”

টুশি বলল, সত্যি সত্যি একদিন তোমার ঠোঁটে লিপস্টিক, গালে পাউডার, কপালে টিপ দিয়ে লাল শাড়ি পরিয়ে দেব!”

তপু বলল, “তোমার নাকি শরীর খারাপ নানি?”

নানি একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, “জোর করে সবাই যদি শরীর খারাপ করিয়ে দেয় তা হলে শরীর ভালো থাকবে কেমন করে?”

টুশি বলল, “তোমাকে দেখে কিন্তু একেবারেই মনে হচ্ছে না তোমার শরীর খারাপ!”

তপু বলল, “আ-আ-আব্বু বলছিল–”

আব্দু কী বলেছিল টুশি তপুকে সেটা বলতে দিল না, বাধা দিয়ে বলল, “নানি তুমি কিন্তু রাত্রে আমার সাথে ঘুমাবে।”

তপু বলল, “না-না–আমার সাথে!”

টুশি বলল, “নানি তুমি যদি তপুর সাথে শোও–সারারাত ঘুমাতে পারবে না। তপু বিছানায় টাকি মাছের মতো লাফায়”

নানি বললেন, “আমার কি আর ঘুম আছে? সারারাত বসে কুটুর কুটুর করি, উলটো তোরাই ঘুমাতে পারবি না।”

বাইরের ঘরে যখন নানির সাথে টুশি আর তপু গল্প করছে তখন শোবার ঘরে দরজা বন্ধ করে চাচা-চাচি ফিসফিস করে কথা বলছিলেন। চাচা বললেন, “যাক! বুড়িকে তো নিয়ে আসা গেল। আমি ভেবেছিলাম বুড়ি না আবার বেঁকে বসে।”

চাচি বললেন, “বেঁকে বসবে কেন? নাতির জন্যে মায়ের জান। আর টুশি নিজের নাতনি নামায়া তার জন্যে মনে হয় আরও এক ডিগ্রি বেশি। বললেই চলে আসেন।”

“ভেরি পিকিউলিয়ার। যে-ই দেখে এই মেয়েটাকে পছন্দ করে ফেলে। চেহারায় কোনো ছিরি ছাঁদ নাই কিন্তু তাতে কোনো সমস্যা হয় না, দেখেছ?”

“হুঁ।” চাচি গম্ভীর মুখে বললেন, “ছেলেটাও কেমন বাধ্য দেখেছ? টুশির কথায় ওঠে বসে!”

“যা-ই হোক—-” চাচা ষড়যন্ত্রীদের মতো মুখ করে বললেন, “এখন প্ল্যানের সেকেন্ড পার্ট।”

চাচি শুকনো মুখে বললেন, “আমার কিন্তু কেমন জানি ভয় ভয় করছে!”

চাচা হাত নেড়ে বললেন, “আরে! ভয় কিসের?”

“যদি কিছু-একটা হয়ে যায়?”

“কী হবে? কিচ্ছু হবে না। এরা প্রফেশনাল। এতগুলো টাকা খামোখা দিচ্ছি?”

“তবুও” চাচি ইতস্তত করে বললেন, “মা বুড়ো মানুষ–”

“সেটাই তো কথা!” চাচা উত্তেজিত গলায় বললেন, “তোমার মায়ের যদি বয়স থাকত, সম্পত্তি ভোগ করতে চাইতেন, আমরা কি আপত্তি করতাম? এখন বয়স হয়েছে, এইসবের মায়া ছেড়ে দিতে হবে না?”

“ঠিকই বলেছ।”

“এত বড় একটা বাড়ি এরকম একটা সেন্ট্রাল লোকেশানে, সেইটা নাকি এতিমখানায় দিয়ে দেবে। ভিমরতি আর কারে বলে!”

“তা হলে ঠিক কীভাবে করা হবে?”

“টুশি আর তপু স্কুল থেকে বাসায় আসবে দুইটা তিরিশে। তুমি তাদেরকে খাইয়ে তিনটার ভিতরে বের হয়ে যাবে বাসায় থাকবে খালি বুড়ি, তপু আর টুশি।”

চাচি একটু অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন, “আমার মাকে তুমি সবসময় বুড়ি ডাকো– এটা ঠিক না!”

“বুড়িকে বুড়ি ডাকব না তো কী ডাকব?”

“নিজের শাশুড়িকে কেউ বুড়ি ডাকে?”

চাচা হাত নেড়ে বললেন, “ঠিক আছে, ঠিক আছে, এখন এটা নিয়ে একটা ঝগড়া শুরু করে দিও না।”

“হ্যাঁ, বলো তারপর।”

“ঠিক সাড়ে তিনটার সময় পার্টি আসবে। চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকবে। আমি একটা চাবি দিয়ে রাখব আগে থেকে।”

“কজয়ন ঢুকবে?”

“তিনজন।” চাচা দাঁত বের করে হেসে তার সিরাজদ্দৌলার মতো গোঁফে হাত বুলিয়ে বললেন, “তিনজনের চেহারা দেখেই বুড়ি–আই মিন তোমার মায়ের না হার্ট অ্যাটাক হয়ে যায়! এই সাইজ একেকজনের, চোখে কালো চশমা, স্কিনটাইট টিশার্ট, হাতে কাটা রাইফেল।”

“তারপর?”

“একজন ধরবে তপুকে, একজন টুশিকে–আরেকজন সেই কাগজ নিয়ে যাবে বুড়ি–আই মিন তোমার মায়ের সামনে। বলবে এই মুহূর্তে সাইন করো, তা না হলে তোমার নাতি আর নাতনির মাথার মাঝে গুলি করে দেব। বুড়ি সুড়সুড় করে সাইন করে দেবে। নিজের মাথায় গুলি করলে বুড়ি ঢিট লেগে থাকবে, কিন্তু নাতির গায়ে হাত দিলে উপায় আছে?” চাচা আনন্দে হা হা করে হাসলেন।

চাচি শুকনো মুখে বললেন, “সব এখন ভালোয় ভালোয় হয়ে গেলে হয়। লোকগুলো কারা? সত্যিকার সন্ত্রাসী না তো?”

“এই কাজের জন্যে কি আর ইউনিভার্সিটির প্রফেসর পাব? তবে চিন্তা করো না, সব নিজেদের লোক।”

“দেখো আবার”।

“বলতে পার পুরো ব্যাপারটা হবে একটা নাটকের মতো। আগে হলে তপুকেও বলে রাখা যেত, যেন ভয় না পায়। এখন এই টুশি মেয়েটা এসে হয়েছে মুশকিল! তপুর আবার নিজের একটা পার্সোনালিটি হয়ে গেছে! ভালোমন্দ বোঝ আরম্ভ করেছে। কী মুশকিল!”

“যা-ই হোক–এখন তো আর কিছু করার নাই! দেখা যাক কী হয়!”

রাত্রিবেলা ঘুমানোর আগে টুশি আর তপু তাদের নানির দুই পাশে বসল গল্প শোনার জন্যে। টুশি বলল, “নানি, নানার সাথে তোমার প্রথম দেখা হল কেমন করে সেটা আবার বলো না, প্লিজ!”

নানি মাঢ়ি বের করে হেসে বললেন, “ধুর পাগলি মেয়ে, এক গল্প কতবার বলে!”

টুশি বলল, “শোনা গল্প শুনতেই তো বেশি মজা–আগে থেকে জানি কোন জায়গাটা সবচেয়ে বেশি ইন্টারেস্টিং–”

নানি বললেন, “ধুর বোকা।”

তপু বলল, “তা হলে একটা ভূ-ভূ-ভূতের গল্প বলো।”

টুশি বলল, “হ্যাঁ নানি বলো না। সুইট একটা ভূতের গল্প।”

নানি বললেন, “এই রাতে জিন-ভূতের গল্প শুনলে ভয় পাবি।”

টুশি আর তপু একসাথে বলল, “জিন?” তারা দুজন চোখ বড় বড় করে একজন আরেকজনের দিকে তাকাল। টুশি ঘুরে নানির দিকে তাকিয়ে বলল, “নানি? তুমি কখনও জিন দেখেছ?”

নানি বললেন, “দেখি নাই আবার!”

“দেখতে কেমন হয়?”

“এই লম্বা লম্বা দাড়ি। এইরকম ছোট। পায়ের মুড়া হয় উলটো দিকে।”

“তাদের মেজাজ কেমন হয়?”

“সব্বোনাশ! খুব রাগী হয়। চোখ দিয়ে একেবারে আগুন বের হয়।”

“নানি, এরকম কি হতে পারে যে তারা খুব ঠাণ্ডা মেজাজের হয়? খুব সুইট হয়? জোকারের মতন?”

নানি চোখ বড় বড় করে বললেন, “কী বলিস তুই? ঠাণ্ডা মেজাজ! কখনও না!”

“কেন নানি? তুমি আরব্যরজনী পড় নাই? জিনেরা এরকম বড় বড় কলসি ভরা সোনার মোহর নিয়ে আসত?”

নানি মাঢ়ি বের করে হেসে বললেন, “ঐগুলো তো গল্প-গল্পে কতকিছু হয়!”

টুশি বলল, “কিন্তু সত্যি সত্যি কি জিন থাকতে পারে না যেটা খুব ভালো?”

নানি একটু চিন্তার মাঝে পড়ে গেলেন, শনের মতো পাকা চুলে হাত দিয়ে বিলি কেটে বললেন, “সেটা মনে হয় থাকতে পারে।”

“সেই জিনকে আমরা যদি কিছু-একটা করতে বলি সেটা কি করবে?”

নানি হেসে বললেন, “তুই জিন পাবি কোথায়? ঢাকা শহরে কী আর জিন আছে? আর থাকলেই কি সেটা তোর কথা শুনবে?”

তপু জ্বলজ্বলে চোখে টুশির দিকে তাকাল, কাবিল কোহকাফীর কথা বলার জন্যে নিশ্চয়ই তপুর মুখ সুড়সুড় করছে। টুশি অবশ্যি তপুকে চিমটি কেটে থামাল। এখনও এটা বলার সময় হয় নাই এবং বললেও নানি বিশ্বাস করবেন না।

নানি মুখে ভয়ের একটা চিহ্ন ফুটিয়ে বললেন, “জিন বন্দি করার দোয়া আছে। অনেক কঠিন দোয়া–সেই দোয়া পড়ে জিন বন্দি করা যায়। তখন জিনকে যেটা বলা যায় জিন সেটা করে।”

তপু বলল, “জিনকে বন্দি করে কি বো-বোতলে ভরতি করা যায়?”

“বোতল? বোতলে কেন?”

“এই ইয়ে মা-মানে এমনি?”

নানি হি-হি করে হেসে বললেন, “জিন কি আমের আচার, নাকি ওষুধের ট্যাবলেট যে বোতলে আর শিশিতে ভরতে চাস!”

টুশি বলল, “আচ্ছা নানি মনে করো একটা জিনের সাথে আমার খুব খাতির হল। তা হলে কি সেই জিনটাকে আমি যেটাই বলি সেটাই করবে?”

নানি তাঁর পাকা শনের মতো চুলে হাত বুলিয়ে বললেন, “তা নিশ্চয়ই করবে!”

“আমি যদি বলি, আমার চোহরাটা সুন্দর করে দাও–তা হলে কি সুন্দর করে দেবে?”

নানি টুশির থুতনি ধরে আদর করে বললেন, “ওমা! কী বলিস তুই? তোর চেহারা তো এখনই কত সুন্দর!”

“ছাই সুন্দর। তুমি আগে বলো জিন কী সুন্দর করে দিতে পারবে?”

নানি গম্ভীর মুখে মাথা নাড়লেন, বললেন, “নিশ্চয়ই পারবে। জিনেরা সবকিছু পারে।”

তপু চোখ বড় বড় করে টুশিকে বলল, “আপু তু-তুমি কি কা-কাবিলকে তাই বলবে?”

নানি বললেন, “কাবিল? কাবিলটা কে?”

টুশি তাড়াতাড়ি বলল, “না-না, কেউ না।” নানি ব্যাপারটি নিয়ে বেশি মাথা ঘামালেন না দেখে টুশি একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে তাড়াতাড়ি কথা ঘোরানোর জন্যে বলল, “নানি তোমার চুলে একটু তেল দিয়ে দিই?”

নানি বললেন, “দে দেখি বোনডি। মাথা দেখি খালি কুটকুট করে।”

তপু বলল, “আমি? আ-আমি তা হলে কী করব?”

টুশি বলল, “তুই নানিকে পান ঘেঁচে দে।”

তপু মনের মতো একটা কাজ পেয়ে খুব খুশি হয়ে উঠল।

একটু পরে দেখা গেল টুশি নানির মাথায় তেল দিয়ে চিরুনি দিয়ে তাঁর শনের মতো সাদা চুল চিরুনি দিয়ে আঁচড়ে দিচ্ছে–তার কাছে বসে তপু মহা উৎসাহে একটা ছোট পিতলের হামানদিস্তায় পান ঘেঁচে দিচ্ছে।

রাত্রিবেলা টুশির বিছানায় নানি যখন ঘুমিয়ে গেছেন তখন তপু এসে টুশিকে ফিসফিস করে বলল, “টু-টু-টুশি আপু।”

“কী হল?”

“কা-কাবিল কোথায় গেছে?”

“আমি কেমন করে বলব! মনে নাই সে ঘুরতে বের হল!”

“অ্যাকসিডেন্ট হয় নাই তো!”

“চিন্তার মাঝে ফেলে দিলি!” টুশি চিন্তিত মুখে বলল, অ্যাক্সডিন্টে হলে কেউ দেখতে পারবে না, হাসপাতালেও নিতে পারবে না।”

টুশির চিন্তার অবসান হল সাথে সাথে দরজায় ধুম ধুম করে কে যেন শব্দ করল। চাচা দরজা খুলে দেখলেন কেউ নেই, এদিক-সেদিক তাকিয়ে কাউকে না দেখে ফিরে এসে বিরক্ত হয়ে চাচিকে বললেন, “ফাজিল ছেলে-ছোঁকড়ার কাজ দেখেছ? এই এত রাতে দরজায় শব্দ করে পালিয়ে গেল!”

চাচি বললেন, “নিশ্চয়ই দোতালার ছেলেটা, চোহরা দেখলেই মনে হয় মহা বদমাইস।”

টুশি আর তপু বুঝতে পারল এটা মোটেও দোতলার পাজি চেহারার ছেলেটা না–এটা কাবিল কোহকাফী, সারা শহর ঘুরে এখন ফিরে এসেছে।

টুশি আর তপু নিশ্বাস বন্ধ করে বসে রইল, দেখল গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে কাবিল কোহকাফী এসে ঢুকছে। তাকে এখন আর চেনা যায় না–তার পরনে একটা রংচঙে টিশার্ট, জিন্সের প্যান্ট এবং টেনিস শু। মাথায় লাল রঙের একটা বেসবল ক্যাপ। টুশি আর তপুর দিকে তাকিয়ে চোখ মটকে বলল, “হা হা হা। আজকে কী মজা হয়েছে শুনলে তোমরা হাসতে হাসতে মারা যাবে”

টুশি আর তপু দুজনেই জানে যে কাবিল কোহকাফীর কথা কেউ শুনতে পাচ্ছে না, তাকে কেউ দেখতেও পাচ্ছে না, তার পরেও তারা ভয়ে সিঁটিয়ে রইল, নানি তার গলার স্বর শুনে জেগে ওঠেন কি না সেই ভয়ে বারবার তার দিকে তাকাতে লাগল। নানি বা চাচা-চাচি কেউই অবশ্যি কাবিল কোহকাফীর কথা শুনতে পেলেন। না–কাবিল তাই বলে যেতে লাগল, “বুঝলে তোমরা–আমি রাস্তা দিয়ে হাঁটছি, হঠাৎ দেখি এক মাস্তান–”

কাবিল হঠাৎ নানিকে দেখে চমকে উঠে গলা নামিয়ে বলল, “ওরে বাবা! এখানে ডাইনি বুড়ি কোথা থেকে এসেছে?”

টুশি রেগে গিয়ে ফিসফিস করে বলল, “ডাইনি বুড়ি কেন হবে? আমাদের নানি!”

কাবিল কিন্তু পুরোপুরি বিশ্বাস করল না, কাছে এসে নানিকে দেখে পিছিয়ে গেল, বলল, “সব্বোনাশ! দেখে ভয় লাগে।”

টুশি চাপা গলায় বলল, “ভয় লাগার কী আছে? এত সুইট আমাদের নানি।”

“আমি যখন বাগদাদে ছিলাম, শাহজাদি দুনিয়ার সাথে এইরকম একজন ডাইনি বুড়ি ছিল। আমাকে জাদু করে দিল। একেবারে হাত-পা নাড়াতে পারি না

হাত-পা নাড়াতে না পারার কারণে তার কী অবস্থা হয়েছিল সেটা কাবিল তাদের অভিনয় করে দেখাল।

কাবিল আবার কাছে এসে নানিকে দেখে আবার লাফিয়ে পিছনে সরে গেল, বলল, “বাবারে বাবা! আমি এই ঘরে এই বুড়ির সাথে ঘুমাতে পারব না!”

তপু ফিসফিস করে বলল, “কো-কো-কোথায় ঘুমাবে তা হলে?”

“বাইরের ঘরে। গদিওয়ালা চেয়ারে।” কাবিল কোহকাফী মাথা নাড়তে নাড়তে বের হয়ে গেল। একটু পরেই তারা তার নাকডাকার শব্দ শুনতে পেল, মনে। হল সারা বাড়ি বুঝি থরথর করে কাঁপছে।

ভাগ্যিস কেউ তার নাক ডাকার শব্দ শুনতে পায় না–তা হলে কী যে সর্বনাশ হত! টুশি অবশ্যি খুব দুশ্চিন্তা নিয়ে ঘুমাল–চাচা প্রতিদিন সকালে উঠে সোফায় বসে খানিকক্ষণ টেলিভিশন দেখেন। কাল সকালে যখন সোফায় বসতে গিয়ে কাবিল কোহকাফীর ভুড়িতে বসে যাবেন তখন কী যে একটা কেলেঙ্কারি হবে সেটা নিয়ে তার ঘুম হারাম হয়ে গেল। সকালে তার নিশ্চয়ই ঘুম ভাঙবে চেঁচামেচি এবং হইচই দিয়ে।

সত্যি সত্যি সকালে টুশি এবং তপুর ঘুম ভাঙল চেঁচামেচি এবং হইচই দিয়ে তবে কারণটা একটু ভিন্ন, চাচি চিৎকার করছেন চাচার উপরে, কারণ সকালে উঠে আবিষ্কার করেছেন যে বাইরের ঘরের দরজা খোলা। রাত্রিবেলা চাচা শেষবার দরজা খুলেছিলেন কাজেই তিনি নিশ্চয়ই দরজা খোলা রেখে ঘুমিয়েছেন। চাচা দুর্বল গলায় বললেন, “আমার স্পষ্ট মনে আছে দরজা বন্ধ করেছি।”

“ছাই মনে আছে!” চাচি মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, “তোমার ঐ মোটা মাথায় ব্রেন কতটুকু যে এতকিছু মনে রাখতে পারবে?”

অন্য কোনোদিন হলে ঝগড়া অবশ্যি অনেকক্ষণ ধরে চলত–আজকে চাচা চাচি ইচ্ছে করেই সেটা বন্ধ করে ফেললেন। দিনটা খুব গুরুত্বপূর্ণঝগড়াঝাটি দিয়ে সেটা কেউই শুরু করতে চাচ্ছে না।

সকালবেলা নাস্তার টেবিলে সবাই তাড়াহুড়ো করে নাস্তা করছে। টুশি আর তপু যাবে স্কুলে, চাচা যাবেন অফিসে–অন্যদিন হলে চাচিও যেতেন, আজ নানির জন্যে চাচি বাসায় থাকছেন, টুশি আর তপু বাসায় ফেরত এলে কাজে যাবেন। সকালবেলা টুশির একেবারেই খেতে ইচ্ছে করে না, খুব কষ্ট করে রুটি টোস্ট জেলি মাখিয়ে খাচ্ছে, তখন হঠাৎ চাচা খবরের কাগজ দেখতে দেখতে বললেন, “ভেরি পিকিউলিয়ার!”

চাচি জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে?”

“খুব আশ্চর্য একটা খবর ছাপা হয়েছে।”

“কী খবর?”

“শোনো আমি পড়ছি।” চাচা পড়তে লাগলেন, “চান্দিছোলা জব্বর গ্রেফতার। ঢাকা বারোই অক্টোবর–ফার্মগেট এলাকা থেকে অপরাহু তিনটা পঁয়তাল্লিশ মিনিটে কুখ্যাত সন্ত্রাসী চান্দিছোলা জব্বরকে গ্রেফতার করা হয়েছে। খবরে প্রকাশ চান্দিছোলা জব্বর ফার্মগেটের সামনে একটি গাড়ি থেকে কিছু অর্থ ছিনতাই করে পলায়ন করার সময় হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে পড়ে এবং তাকে বিচিত্র অঙ্গভঙ্গিসহকারে নৃত্য করতে দেখা যায়। সে শূন্যে ঝুলে থাকে এবং হাত-পা নেড়ে নিজেকে আঘাত করে এবং বিকট গলায় আর্তনাদ করতে থাকে। চান্দিছোলা জব্বর এক পর্যায়ে তার রংচঙে টিশার্ট, জিন্সের প্যান্ট, টেনিস শু এবং মাথার বেসবল ক্যাপ খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে শুধুমাত্র একটি অন্তর্বাস পরে অপ্রকৃতস্থের মতো ক্রন্দন করতে থাকে। ফার্মগেটের মোড় থেকে পুলিশ এসে তখন তাকে অস্ত্রসহ গ্রেফতার করে। তার খুলে ফেলা কাপড়, প্যান্ট এবং টিশার্ট উদ্ধার করা সম্ভব হয় নি বলে তাকে শুধু অন্তর্বাস পরা অবস্থায় থানা-হাজতে প্রেরণ করা হয়। এই ব্যাপারে জোর পুলিশি তদন্ত চলছে।”

চাচা খবরটি পড়ে শেষ করার আগেই টুশি এবং তপু একজন আরেকজনের দিকে তাকাল। চান্দিছোলা জব্বরের এই দুর্গতি কে করেছে এবং কাবিল কোহকাফী কোথা থেকে তার বিচিত্র পোশাক পেয়েছে বুঝতে তাদের বাকি থাকে না। কাল রাতে সে কী মজার ঘটনা বলতে চেয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত বলতে পারে নি সেটাও এখন পরিষ্কার হয়ে গেল।

খবরটি শুনে চাচি হাসি হাসি মুখে বললেন, “বড় বড় ক্রিমিনালরা যদি নিজেরাই নিজেদের কিল ঘুসি মেরে অ্যারেস্ট হয়ে যায় তা হলে তো মন্দ হয় না!”

চাচা বললেন, “কিন্তু আমি খবরের মাথা-মুণ্ডু কিছু বুঝতে পারলাম না! একজন মানুষ নিজে নিজে শূন্যে ঝুলে থাকে কেমন করে?”

চাচি হাত নেড়ে বললেন, “ওগুলো হচ্ছে খবরের কাগজের বিক্রি বাড়ানোর ফন্দি!”

টুশি আর তপু একজন আরেকজনের দিকে তাকাল–শুধু তারা দুজনেই জানে এটা খবরের কাগজের বিক্রি বাড়ানোর ফন্দি নয়। শুধু তা-ই নয়, শুধু তারাই জানে সত্যি সত্যি খবরে কাগজের বিক্রি বাড়ানোর খবরটি কী হতে পারে!

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *