কলকাতায় ফেরার পথে
পরদিন কলকাতায় ফেরার পথে কাকাবাবুর একটু-একটু জ্বর হল।
বিমান আর দীপা বেশ চিন্তায় পড়ে গেল। মাথায় আর পায়ে চোট লাগার পর প্রথম দুদিন জ্বর আসেনি, এখন হঠাৎ জ্বর হল কেন? সেপটিক-টেপটিক হয়নি তো!
কাকাবাবু বললেন, না, না, চিন্তার কিছু নেই। ছাদের ঘরটা যখন ভাঙা হচ্ছিল, তখন প্রচুর ধুলো উড়ছিল তো। ধুলোতে আমার অ্যালার্জি আছে, তার জন্যই জ্বর হয়েছে। কমে যাবে একদিন বাদেই।
বিমান বলল, দেখলেন তো, শুধু-শুধু ছাদের ঘরটা ভাঙাতে হল আমাকে। আমার পয়সা খরচ হল, পাওয়া গেল কিছু?
দীপা বলল, মারবেল-টালিগুলো তো পাওয়া গেল কয়েকটা। ওরও কিছু দাম আছে। আগেকার দিনের ইটালিয়ান মারবেল, এখন অনেক দাম।
বিমান বলল, যাই হোক, এবার এসে মোটামুটি লাভই হল। বাড়িটা বিক্রি করে দেওয়ার পরেও পুরনো চেয়ার-টেবিল, কিছু পাথর, কিছু ভাঙা জিনিসপত্র মিলিয়ে আরও প্রায় হাজার পঁচিশেক টাকা পাওয়া যাবে। অসিত ধর যে ভাঙা ক্যামেরা আর ঘড়িগুলো কিনল, সেগুলোর জন্য আমি তো একটা পয়সাও পাব ভাবিনি।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, অসিত ধর কি নবাব সিরাজের দেওয়া চুনির মালার গল্পটা শুনেছিল?
বিমান বলল, ও-গল্প আমিই তো আগে শুনিনি। বাড়িতে গিয়েই মাকে জিজ্ঞেস করব।
কাকাবাবু হেসে বললেন, যাত্রার গল্পটা বেশ বানিয়েছে। মুর্শিদাবাদে খুন করা হল নবাব সিরাজকে, আর বীরভূমে তোমাদের বাড়িতে তাঁর দুঃখে মালা থেকে রক্ত ঝরতে লাগল।
দীপা বলল, রক্ত আর কান্না! এই যাত্রাটা কলকাতায় এলে আমি দেখব।
গাড়িতে বাকি রাস্তা আর বিশেষ কিছু কথা হল না। কাকাবাবু জ্বরের ঘোরে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লেন।
বাড়ির সামনে পৌঁছবার পরও কাকাবাবুর ঘুম ভাঙেনি। বিমান একটু ঠেলা দিয়ে বলল, কাকাবাবু, কাকাবাবু, এসে গেছি!
কাকাবাবু জেগে উঠে বললেন, ওহ! খুব ঘুমিয়েছি তো! তাতেই জ্বরটা কমে গেছে মনে হচ্ছে।
দীপা বলল, শরীর দুর্বল লাগছে? আপনি ওপরে উঠতে পারবেন, না বিমান আপনাকে তুলে দিয়ে আসবে?
কাকাবাবু বললেন, শরীর ঠিক আছে।
ক্রাচ দুটো বগলে নিয়ে তিনি গাড়ি থেকে নামলেন, তারপর বললেন, যাওয়ার সময় অসিত আমাদের সঙ্গে ছিল। ফেরার সময়েও সে সঙ্গে থাকলে ভাল লাগত। সে যে হঠাৎ আগেই ফিরে এল এটা তোমার কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়নি, বিমান?
বিমান বলল, না, না। সত্যি তার একটা জরুরি কাজের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। বিদেশ থেকে কেউ আসবে। আপনার সঙ্গে দেখা করে আসতে পারেনি বলে বারবার ক্ষমা চেয়েছে।
কাকাবাবু বললেন, না, না, এতে আর ক্ষমা চাইবার কী আছে। ঠিক আছে, নবাব সিরাজের চুনির হারটা সম্পর্কে তোমার মা কী বলেন আমাকে জানিও!
বিকেল চারটে, সন্তু এখনও ফেরেনি। কাকাবাবু নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লেন। কিন্তু তাঁর আর ঘুম এল না, শুয়ে-শুয়ে আকাশপাতাল চিন্তা করতে লাগলেন।
সন্ধের একটু আগেই সন্তু বাড়ি এল। কাকাবাবু ফিরে এসেছেন শুনেই সে ছুটে এল কাকাবাবুর ঘরে। ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছেন কাকাবাবু।
সন্তু ব্যগ্রভাবে জিজ্ঞেস করল, ওখানে কী হল, কাকাবাবু? পুরনো বাড়ি, কোনও গুপ্তধনের সন্ধান পাওয়া গেল?
কাকাবাবু এ-প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোর পরীক্ষা কেমন হচ্ছে রে?
বেশ ভালই। সোজা-সোজা কোশ্চেন এসেছে।
আর কটা পরীক্ষা বাকি আছে?
আর মোটে একটা। কালকেই শেষ!
ঠিক আছে, এখন পড়াশোনা কর। কাল পরীক্ষা হয়ে গেলে ওখানকার গল্প বলব।
একটুখানি বলল না। ওখানে মারামারি হয়েছিল?
এখন তোর মাথায় ওসব ঢোকাতে হবে না। মন দিয়ে পড়ে পরীক্ষা শেষ কর। তারপর তোকে কয়েকটা কাজ করতে হবে।
সন্তু চলে যাওয়ার পর কাকাবাবু পুলিশ কমিশনার আর হোম সেক্রেটারিকে দুটো ফোন করলেন।
তারপরেই বিমানের ফোন এল।
আপনার শরীর কেমন আছে, কাকাবাবু?
জ্বরটর বাড়েনি তো? না না, এখন একদম ভাল হয়ে গেছি। কোনও চিন্তা কোরো না।
সেই রক্তঝরা চুনির মালাটার কথা মাকে জিজ্ঞেস করলুম। মা আমাকে আগে বলেননি, এখন মার মনে পড়ল। ছোটবেলায় মা ওইরকম একটা মালার কথা শুনেছিলেন। তবে, মা নিজেও সেটা কখনও দেখেননি।
তা হলে নবাবের মালা তোমাদের বাড়িতে সত্যিই ছিল?
সত্যিও হতে পারে, গল্পও হতে পারে। মা ও বাড়ির মেয়ে, মা পর্যন্ত নিজের চোখে দেখেননি। সেরকম মালা থাকলেও পঞ্চাশ-ষাট বছর আগেই সেটা বিক্রি হয়ে গেছে।
ওইরকম একটা ঐতিহাসিক মালা কে কিনল? ওইসব জিনিস আমাদের মিউজিয়মে থাকা উচিত।
আমার কিন্তু এখনও ধারণা, ওটা গুজব।
ফোন রেখে দিয়ে কাকাবাবু কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। তাঁর ভুরু কুঁচকে গেল। কিছু একটা ধাঁধার যেন উত্তর খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি। রাত্তিরে তাঁর ভাল করে ঘুম হল না।
সকালে চা-টা খেয়েই তিনি বেরিয়ে পড়লেন ট্যাক্সি নিয়ে। এলগিন রোডে অসিত ধরের বাড়ির কাছে এসে থামলেন।
ট্যাক্সি ছেড়ে তিনি প্রথমে রাস্তা থেকে দেখলেন বাড়িটা। একটু পুরনো ধরনের তিনতলা বাড়ি। একতলায় সামনের দিকে কয়েকটা দোকান। দরজার পাশে তিন-চারটে নেম প্লেট। অসিত ধর থাকেন তিনতলায়।
সামনের গেটটা খোলা। কাকাবাবু সিঁড়ি ভেঙে তিনতলায় উঠে এলেন। দোতলায় তিনখানা ফ্ল্যাট, তিনতলায় মোটে একটা। সিঁড়ি দিয়ে উঠেই একটা ছোট বারান্দা, পাশের একটা জানলা দিয়ে দেখা যায় যে বাড়িটার পেছনে ছোট্ট বাগান রয়েছে।
দরজার বেলে আঙুল রাখলেন কাকাবাবু।
অসিত ধর নিজেই দরজা খুলল। কাকাবাবুকে দেখে সে একটুও অবাক হয়নি। হাসিমুখে বলল, মিঃ রায়চৌধুরী, আসুন, আসুন। কেমন আছেন এখন? মাথার চোটটা…
কাকাবাবু মাথার ব্যান্ডেজ খুলে ফেলেছেন কলকাতায় ফেরার আগেই। পায়ের আঙুলে সেলোটেপ জড়ানো, জুতো পরতে গেলে ব্যথা লাগে বলে আজও চটি পরে এসেছেন।
কাকাবাবু বললেন, কোনও খবর না দিয়ে এসে পড়লাম।
অসিত বলল, তাতে কী হয়েছে? আমি মোটেই ব্যস্ত ছিলাম না। আসুন, ভেতরে আসুন।
বসবার ঘরটি জিনসপত্রে ঠাসা। কোনওরকমে মাঝখানে একটা সোফা-সেট রাখা হয়েছে, আর সব দেওয়ালের ধারে-ধারে অনেকরকমের মূর্তি, পাথরের, ব্রোঞ্জের, পেতলের। মাটির ওপর জড়ো করে রাখা আছে প্রচুর স্ট্যাম্পের অ্যালবাম, বই, ছবি। কোনও কিছুই নতুন নয়, সবই পুরনো।
সাদা প্যান্ট আর নীল রঙের একটি টি-শার্ট পরে আছে অসিত, তার চেহারা সুন্দর, যে-কোনও পোশাকে তাকে মানায়। একটা সিগারেট ধরিয়ে প্যাকেটটা কাকাবাবুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, নেবেন?
কাকাবাবু বললেন, আমি অনেককাল ধূমপান ছেড়ে দিয়েছি।
অসিত বলল, তা হলে কী খাবেন? চা, কফি? আমার কাজের লোকটি বাইরে গেছে, আমি নিজেই অবশ্য বানিয়ে দিতে পারি। আমি এখানে একাই থাকি, বছরে ছ মাসের বেশি তো বিদেশেই কাটাতে হয়।
আপনি ব্যস্ত হবেন না, বসুন। আমি কিছু খাব না।
আপনারা কালকেই ফিরেছেন, খবর পেয়েছি। বিমান ফোন করেছিল। ওদের বাড়ি থেকে আমি যে ভাঙা ক্যামেরা আর ঘড়ি এনেছি, সেগুলো আপনি দেখতে চান?
না।
দেখতে চান না? বিমান বলছিল… আপনার সম্পর্কে আমি আগে বিশেষ কিছু জানতাম না। ওখানে গিয়ে বিমানের মুখেই শুনেছি, আপনি প্রচুর অ্যাডভেঞ্চার করেছেন, অনেক মিস্ত্রি সম্ভ করেছেন।
কাকাবাবু কড়া চোখে কয়েকপলক তাকিয়ে রইলেন অসিতের দিকে। এ পর্যন্ত তিনি অসিতের সঙ্গে আপনি বলে কথা বলছিলেন, এবার তিনি তুমিতে নেমে এলেন।
ধমকের সুরে বললেন, তুমি এটা শোনোনি যে, আমার গায়ে কেউ হাত তুললে আমি তাকে ক্ষমা করি না?
অসিত যেন বিস্ময়ের একটা ধাক্কা খেল। আস্তে-আস্তে বলল, তার মানে?
আমার একটা প্রতিজ্ঞা আছে, কেউ যদি আমার দিকে রিভলভার তোলে, কিংবা কেউ যদি আমাকে শারীরিকভাবে আঘাত করে, তবে তাকে আমি শাস্তি দিতে ছাড়ি না।
আমি আপনার দিকে রিভলভার তুলিনি, আপনার গায়ে হাতও ছোঁয়াইনি। তা হলে হঠাৎ এসব কথা আমাকে বলছেন কেন?
তুমি ফাঁদ পেতে আমাকে আঘাত দিয়েছ?
তার মানে?
তার মানে তুমি ভালই জানো। ছাদের ঘরটার মেঝেতে কয়েক জায়গায় গর্ত খোঁড়া ছিল। সেইরকম একটা গর্তের মুখে তুমি আলগা করে একটা পাথর চাপা দিয়ে রেখেছিলে। তুমি জানতে, সেখানে আমার ক্রাচটা পড়লেই উলটে যাবে। আমি যাতে সেদিকে তাড়াহুড়ো করে যাই, সেইজন্য তুমি জানলার ধারে একটা প্রিজমের টুকরো রেখেছিলে। রোদ পড়ে সেটা ঝকমক করছিল।
আমি এতসব করতে যাব কেন? আপনাকে আঘাত দিয়ে লাভ কী?
এর একটাই মাত্র কারণ হতে পারে। তিনতলার ঘরটা তুমি আমার আগে নিজে ভাল করে সার্চ করতে চেয়েছিলে। আগের রাত্তিরে তুমি ছাদে উঠে তালাটা ভাঙার চেষ্টা করেছিলে। পারোনি। পরের দিন সকালে তোমার একটা সুবিধা হয়ে গেল। একজন ইংরেজির মাস্টার আমার সঙ্গে দেখা করতে এসে অনেকটা সময় নিয়ে নিল। তুমি আমার আগে ঘরে ঢুকে গেলে। তুমি অ্যান্টিকের ব্যবসা করো, নিশ্চয় কোনও দামি জিনিস তোমার নজরে পড়ে গিয়েছিল। আমি যাতে সেটা দেখতে না পাই, সেইজন্যই তুমি আমাকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলে!
আমি যদি বলি, এ-সবই আপনার উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা? আপনি যা বললেন, এক বিন্দুও প্রমাণ করতে পারবেন? আপনার মাথায় চোট লেগেছিল, তারপর দেখছি, এখনও আপনার মাথা ঠিক হয়নি। আপনি ভাল করে ডাক্তার দেখান!
অসিত ধর, কথা ঘোরাবার চেষ্টা কোরো না! রাজা রায়চৌধুরীর চোখকে তুমি ফাঁকি দিতে পারবে না!
অসিত এবার হা-হা করে হেসে উঠল। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, মিঃ রাজা রায়চৌধুরী, আপনি নিজেকে খুব বুদ্ধিমান ভাবেন, তাই না? ঠিক আছে, আপনাকে আমি চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছি। আপনি যা বললেন, তা সবই সত্যি। তবে, এসব প্রমাণ করতে হলে আপনাকে জানতে হবে, ওই ছাদের ঘর থেকে আমি কী নিয়েছি! হ্যাঁ, সত্যিই আমি একটা মহা মূল্যবান জিনিস পেয়েছি। ওই ছাদের ঘর থেকে। বছরের পর বছর জিনিসটা ওই ঘরে রয়েছে, এর আগে যারা খুঁজেছে, কেউ সেটা চিনতে পারেনি। সেটা আবিষ্কারের কৃতিত্ব আমার। সুতরাং সেটা আমি নেবই নেব, এটা তো স্বাভাবিক। সেটা কী, আপনি হাজার চেষ্টা করলেও বুঝতে পারবেন না!
কাকাবাবু কয়েক মুহূর্ত চুপ করে গেলেন। তারপর বললেন, সেটা দেখলে।
আমিও হয়তো চিনতে পারতাম।
অসিত বলল, সে চান্স আমি দেব কেন? আপনি আর আমি দুজনেই বাইরের লোক। বিমানরা তো এত বছর ধরে খোঁজাখুঁজি করেও সেটা পায়নি!
কাকাবাবু আদেশের সুরে বললেন, সে জিনিসটা আমি একবার দেখতে চাই।
অসিত তা গ্রাহ্য না করে বলল, বাবা বাবা। আপনি চাইলেই সেটা আমি দেখাব? আপনাকে তো আমি চ্যালেঞ্জ জানালাম। অন্য কারও কাছে আমি স্বীকারই করব না যে, কিছু নিয়েছি। বিমান আপনার কাছে কোনও অভিযোগ করেছে? পুরনো ঘড়ি, ক্যামেরাগুলো আমি দাম দিয়ে কিনে নিয়েছি। সে জানে, আমি আর কিছু আনিনি।
তোমার জন্য আমার মাথা ফেটেছে। পায়ের নখ আধখানা উড়ে গেছে।
জানলার ধারে একটা ঝকঝকে কাচ দেখে আপনি লোভীর মতন সেটা ধরতে গেলেন কেন? আপনি অত তাড়াহুড়ো না করলে পড়ে যেতেন না! সুতরাং ওটা একটা অ্যাকসিডেন্ট।
আমি অজ্ঞান হয়ে যেতেই অন্যরা ব্যস্ত হয়ে পড়ল, সেই ফাঁকে তুমি জিনিসটা সরিয়ে ফেললে?
কী সরালাম?
কাকাবাবু আবার চুপ করে যেতেই অসিত হা-হা করে অবজ্ঞার হাসি হেসে উঠল।
এই সময় ফ্ল্যাটে একজন তাগড়া চেহারার লোক ঢুকল। লোকটি যেমন লম্বা, তেমনই চওড়া। নাকের নীচে মস্ত বড় গোঁফ।
অসিত বলল, কিষণ, এসেছিস? দু কাপ কফি বানা বেশ ভাল করে।
তারপর কাকাবাবুর দিকে ফিরে বলল, কিষণের হাতে কফি খেয়ে দেখুন, খুব ভাল করে। আমি যখন বিদেশে থাকি, তখন কিষণই আমার ফ্ল্যাটটা পাহারা দেয়। খুব বিশ্বাসী লোক।
কাকাবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, নাঃ, আমি কফি খাব না!
অসিত মিটিমিটি দুষ্টুমির হাসি দিয়ে বলল, আপনি কী ভাবছেন, বলে দেব? পুলিশ দিয়ে আমার ফ্ল্যাটটা সার্চ করাবেন, তাই তো? পুলিশের বড়কর্তাদের সঙ্গে আপনার চেনা আছে। কিন্তু পুলিশের বাপের সাধ্য নেই বিনা অভিযোগে কারও বাড়ি সার্চ করার। ঠিক আছে, ধরে নিলাম, আপনার কথা শুনে পুলিশ কোনও মিথ্যে অভিযোগ এনে আমার বাড়ি সার্চ করল। তা হলেও সেই জিনিসটা চিনতে পারার মতন বুদ্ধি পুলিশেরও নেই!
কাকাবাবু বললেন, আমার মনের কথা বোঝা এত সহজ? আমি জানি, এমনি-এমনি তোমার বাড়ি সার্চ করানো যাবে না। কিন্তু আমি আর-একটা ব্যবস্থা করে রেখেছি। সেই দামি জিনিসটা তুমি এদেশে রাখবে না, বিদেশে নিয়ে বিক্রি করবার চেষ্টা করবে। তুমি এদেশ ছেড়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে এয়ারপোর্টে যাতে তোমাকে তন্নতন্ন করে সার্চ কানো যায়, সে ব্যবস্থা করব। পুরনো আমলের দামি জিনিস বিদেশে নিয়ে যাওয়া বেআইনি, তা জানো নিশ্চয়ই?
অসিত ঠোঁট উলটে বলল, আই ডোন্ট কেয়ার! আমি প্লেনের টিকিট বুক করে রেখেছি। যেদিন যাওয়ার কথা, সেদিন ঠিক চলে যাব, কেউ আমায় আটকাতে পারবে না।
তিনতলা থেকে নেমে এসে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ট্যাক্সি খুঁজতে লাগলেন কাকাবাবু। বুকটা খালি-খালি লাগছে। অসিতের কাছে যেন তিনি হেরে গেলেন। ওকে তিনি যতটা চালাক ভেবেছিলেন, ও তার চেয়েও অনেক বেশি ধুরন্ধর। নিজেই চট করে স্বীকার করল যে, একটা খুব দামি জিনিস পেয়ে গেছে। কাকাবাবু ভেবেছিলেন, অনেক চাপ দিয়ে কথাটা আদায় করতে হবে। তার বদলে ও হাসতে-হাসতে চ্যালেঞ্জ জানাল!
জিনিসটা কী হতে পারে?
নবাব সিরাজের দেওয়া সেই চুনির মালা? ছাদের ঘরে একটা পুরনো গয়নার বাক্স ছিল ঠিকই। কিন্তু তার মধ্যে মালাটা থাকলে আগে আর কেউ নিশ্চয়ই দেখতে পেত! চুনি পাথর উজ্জ্বল লাল রঙের হয়। সাধারণ পুঁতির মালার সঙ্গে তার অনেক তফাত! বিমানের মামারা অনেককালের জমিদার বংশ, হিরে-মুক্তো-চুনি-পান্না চিনতে ওদের কোনও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। অনেকেই ওই ঘরটা খুঁজেছে, সেরকম দামি জিনিস কেউ-না-কেউ দেখতে পেতই!
ছোট কোনও মূর্তি? তিন-চারশো বছরের পুরনো কোনও মূর্তি হলে তার দামও অনেক হতে পারে। ও ঘরে দু-একটা ভাঙা মূর্তি ছিল যিশু খ্রিস্টের, সেগুলো মোটেই দামি নয়। খাটের তলায় আর কোনও মূর্তি পড়ে ছিল?
জিনিসটা যাই-ই হোক, সেটা উদ্ধার করা যাবে কী করে? বিমানরা কোনও অভিযোগ করেনি। জিনিসটা কী তা না জানলে অভিযোগ করবেই বা কী করে? অসিত ফাঁদ পেতে তাঁর মাথা ফাটিয়েছে, সেটাও তো প্রমাণ করা অসম্ভব। ছাদের ঘরটা একেবারে ভেঙে ফেলা হয়েছে। গর্তের ওপর পাথর চাপা দিয়ে রাখার ব্যাপারটাও এখন কেউ বিশ্বাস করবে না। সবাই বলবে, কাকাবাবুরই সাবধানে পা ফেলা উচিত ছিল।
ভাবতে-ভাবতে কাকাবাবুর চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। তিনি মনে-মনে বললেন, তবু অসিত ধরকে শাস্তি পেতেই হবে।
একটা ট্যাক্সি পেয়ে তখনই বাড়ি না ফিরে কাকাবাবু চলে এলেন লালবাজারে। পুলিশ কমিশনার তাঁর বন্ধুস্থানীয়, দুজনেই একবয়েসী।
কমিশনার সাহেবের ঘরে ভিড় ছিল, কাকাবাবু অপেক্ষা করতে লাগলেন। ভিড় ফাঁকা হলে কাকাবাবু বললেন, এক কাপ কফি দিতে বলল, তোমাকে মন দিয়ে কিছু কথা শুনতে হবে।
সব শোনার পর কমিশনার সাহেব বললেন, রাজা, আমি যে এর মাথামুণ্ড কিছু বুঝতে পারছি না। কী জিনিস চুরি করেছে, তা বুঝতে না পারলে একটা লোককে চোর বলি কী করে?
কাকাবাবু বললেন, সে নিজের মুখে আমার কাছে স্বীকার করেছে।
কমিশনার বললেন, হয়তো, সেটাও মিথ্যে কথা। তোমার সঙ্গে প্র্যাকটিক্যাল জোক করতে চাইছে। বাড়ির মালিকই বলছে, ও ঘরে দামি জিনিস কিছু ছিল না।
কাকাবাবু বললেন, আমার দৃঢ় বিশ্বাস ও কিছু একটা পেয়েছে। ঘরে ঢুকেই ওর অভিজ্ঞ চোখে সেটা নজরে পড়েছে। তাও ও আমাকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিল?
কমিশনার সাহেব বললেন, খুব ছোট জিনিস, মনে করো একটা স্ট্যাম্প, তাও খুব দামি হতে পারে। কিংবা খুব ছোট একটা মূর্তি। কিন্তু ডেফিনিট কোনও অভিযোগ না থাকলে তো এসব কিছু খোঁজ নেওয়া যায় না। আমি বরং একটা কাজ করতে পারি। আমি খোঁজখবর নিচ্ছি, অসিত ধর লোকটা কেমন। আগে কোনও বেআইনি কাজ করেছে কি না। আজ রাত্তিরের মধ্যেই তুমি সব জেনে যাবে।
কাকাবাবু বললেন, গোয়াতে এখন পুলিশের বড়কর্তা ডি সিম্বা না? তার ঠিকানা আর ফোন নাম্বারটা আমাকে দাও।
বাড়িতে ফিরে কাকাবাবু দেখলেন দীপা এসে তাঁর বউদির সঙ্গে গল্প করছে। কাকাবাবুকে দেখে সে বলে উঠল, এর মধ্যেই টো-টো করে বেড়াচ্ছেন? ডাক্তার আপনাকে বিশ্রাম নিতে বলেছিল না?
সন্তুর মা অবাক হয়ে বললেন, ডাক্তার… কেন, কী হয়েছিল?
কাকাবাবু হেসে বললেন, চিন্তার কিছু নেই বউদি। এবারে কোনও গুণ্ডা, ডাকাত কিংবা অপরাধচক্রের নায়কের পাল্লায় পড়িনি। এমনিই পড়ে গিয়ে মাথায় একটু চোট লেগেছিল।
তারপর তিনি দীপাকে বললেন, তুমি একবার আমাদের ঘরে এসো তো! তোমার সঙ্গে কয়েকটা কথা আছে।
ঘরে এসে দীপাকে তিনি একটা ইজিচেয়ারে বসতে বললেন। ঘরের সবকটা জানলা বন্ধ করে দিতে অন্ধকার হয়ে গেল। মাঝখানের একটা আলো জ্বেলে দিলেন। তারপর কাকাবাবু এককোণে দাঁড়িয়ে বললেন, দীপা, তুমি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকবে শুধু। আমি তোমাকে যা জিজ্ঞেস করব, তা মনে করবার চেষ্টা করবে। ছোটখাটো, খুঁটিনাটি সব কিছু। তোমাদের এই বাড়িটার ছাদের ঘরে সেদিন সকালবেলা তুমি আমার চেয়ে আগে ঢুকেছিলে। ঢুকে তুমি কী দেখলে?
দীপা বলল, অসিতবাবু আগে থেকেই সেই ঘরের মধ্যে ছিলেন।
সে কী করছিল?
অসিতবাবু খুব ব্যস্ত হয়ে সবকিছু উলটে পালটে দেখছিলেন।
সবকিছু মানে?
ঝিনুক, পুঁতির মালা, বই, ম্যাপ, টেবিলের ড্রয়ার…
সবগুলোই একসঙ্গে দেখছিলেন?
তাই তো মনে হল। অন্যদের আগেই তিনি সব দেখে নিতে চান।
কোনও জিনিসটা উনি নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলেন?
না। খালি বলছিলেন, বাজে, বাজে, ঝুটো মাল!
আর-একটু ভাল করে ভাবো। কোন জিনিসটা বেশি করে দেখছিলেন? ঝিনুক, বই… . .
পুঁতির মালা। প্রত্যেকটা মালা তুলে-তুলে চোখের সামনে দেখছিলেন আর ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছিলেন মাটিতে…
খাটের ওপর বিছানা-বালিশ ছিল। আমি পরের দিন গিয়ে দেখেছি, বালিশটা ফালাফালা করে ভেঁড়া। তুলো বার করা। তুমিও সেরকম দেখেছিলে, না বালিশটা তখন আস্ত ছিল?
বালিশটা ছেঁড়াই ছিল। অনেকদিন থেকেই ছেঁড়া।
তোশকও ছেঁড়া?
হ্যাঁ। ছেঁড়া ছিল।
ঘরের মেঝেটা কীরকম ছিল?
মাঝে-মাঝে গর্ত ছিল। পাথর তোলা ছিল।
আমি যেখানে পড়ে গেলাম, সেখানেও গর্ত ছিল, না পাথর বসানো ছিল?
মনে নেই।
মনে করার চেষ্টা করো।
আমি ওদিকটা ভাল করে দেখিনি।
কাকাবাবু এগিয়ে এসে দীপার চোখের সামনে একটা হাত রেখে খুব নরম গলায় বললেন, আর-একটু মনে করার চেষ্টা করো।
আর কিছু মনে পড়ছে না, কাকাবাবু! ভাবো। খুব একমনে ভাববা।
হ্যাঁ, আমি জানলার কাছে যাচ্ছিলাম, তখন অসিতবাবু আমার হাত ধরে টেনে বললেন, এদিকে দেখুন। এই আয়নার বাক্সটা দেখুন! আমাকে জানলার দিকে যেতে দেয়নি! জানলার দিকে গেলে আমিও আপনার মতন আছাড় খেয়ে পড়তাম।
তা হলে অসিত জানত যে ওদিকে গর্তের ওপর একটা পাথর আলগা করে বসানো আছে। কিংবা সেটা সে নিজেই বসিয়েছে।
কাকাবাবু এবার সব জানলাগুলো খুলে আলো নিভিয়ে দিলেন।
দীপা চোখ বিস্ফারিত করে বসে রইল কয়েক মুহূর্ত। তারপর বলল, অসিতবাবু জেনেশুনে ইচ্ছে করে আপনাকে আছাড় খাইয়েছে? কেন?
কাকাবাবু বললেন, আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ার পর তোমরা আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লে। সেই সুযোগে অসিত ঘর থেকে কোনও দামি জিনিস সরিয়ে ফেলতে পারে অনায়াসে, তাই না?
দীপা প্রায় আর্তনাদের ভঙ্গিতে চেঁচিয়ে উঠে বলল, কী সরিয়ে ফেলেছে? নবাবের দেওয়া সেই চুনির মালা?
কাকাবাবু বললেন, সেটা যদি অসিত ঘরে ঢোকামাত্র খুঁজে নিতে পারে, তা হলে সে দোষ তোমাদের। তোমরা অনেকে মিলে ওই ঘরে অনেকবার খোঁজাখুঁজি করেছ, কিন্তু দামি জিনিস কিছুই পাওনি। এমন কী, ওই চুনির মালাটার কথা তোমরা জানতেই না। সুতরাং অসিত যদি ওটা আবিষ্কার করে থাকে, তা হলে সেটা তার কৃতিত্ব!
দীপা বলল, পাগল দাদুটা হয়তো মালাটা এমন জায়গায় লুকিয়ে রেখেছিল, যা কেউ ধারণাই করতে পারেনি। পাগলদের মতিগতি কি বোঝা যায়? ইস, অমন দামি জিনিসটা অসিত ধর নিয়ে নিল? আমাদের ঠকাল? ওকে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়া যায় না?
কাকাবাবু হেসে বললেন, আরে, দাঁড়াও দাঁড়াও? সে যে নিয়েছে, তার কোনও প্রমাণ আছে? ওরকম একটা মালা ছিল কি না, তারই তো ঠিক নেই। হুট করে কি কাউকে চোর বলা যায়? তুমি এক কাজ করো। বাড়ি গিয়ে বিমানকে জিজ্ঞেস করো, ওই ঘরটায় কী কী জিনিস ছিল, তার কোনও লিস্ট বানানো আছে কিনা! যদি সেরকম না থাকে, তা হলে বিমানকে একটা লিস্ট বানাতে বলো—ও তো ওই ঘরে বেশ কয়েকবার ঢুকেছে, যা যা জিনিস দেখেছে সব মনে করে লিখতে বলো। যেসব জিনিসকে মনে হয় আজেবাজে, তাও যেন বাদ না দেয়! তুমি যেমন মেঝের গর্তটার কথা ভুলে গিয়েছিলে, সেরকম কিছুও ভুললে চলবে না।
দীপা ঠোঁট উলটে বলল, ওর আমার চেয়েও ভুলো মন।
দীপা চলে যাওয়ার পর কাকাবাবু নিজের টেবিলের কাগজপত্রের মধ্যে খুঁজে একটা টেলিগ্রামের ফর্ম বার করলেন। তারপর গোয়ার পুলিশের কর্তার কাছে কয়েকটা খবর জানতে চেয়ে লিখলেন অনেকখানি। বাড়ির কাজের লোকটির হাতে টাকা দিয়ে টেলিগ্রামটা পাঠিয়ে দিলেন পোস্ট অফিসে।
সন্ধেবেলাতে পুলিশ কমিশনার ফোন করলেন। হাসতে-হাসতে বললেন, রাজা রায়চৌধুরী, এবার তো মনে হচ্ছে, তোমার পুরো ব্যাপারটা ওয়াইল্ড গুজ চেইজ!
কাকাবাবু শুকনো গলায় বললেন, কেন?
কমিশনার-সাহেব বললেন, অসিত ধর সম্পর্কে সমস্ত খোঁজখবর নেওয়া হয়েছে। তার নামে কোনও অভিযোগ নেই। সে কখনও জেল খাটেনি, চুরি-জোচ্চুরি কোনও কেস তার নামে কখনও ওঠেনি। পাড়ার লোক তাকে নিঝঞ্ঝাট, ভদ্রলোক বলে জানে। যদিও সে পাড়ায় লোকদের সঙ্গে তেমন মেশে না। সে প্রায়ই বিদেশে যায়, সেখানে তার ব্যবসা আছে। তার পাসপোর্টেও কোনও গোলমাল নেই। শিগগিরই আবার বিদেশে যাবে, তার টিকিট কাটা আছে। এরকম লোককে তো পুলিশ কোনও কারণেই ধরতে পারে না!
আমি তো তোমাকে ধরতে বলিনি।
এরকম লোককে তুমিই বা সন্দেহ করছ কেন?
দ্যাখো, সন্দেহ যখন আমার মনে জেগেছে, তখন নিশ্চয়ই কোনও কারণ আছে।
আরও একটা ব্যাপার। আমি আজ বীরভূমের এসপি.-কে ফোন করেছিলাম। মজার কথা কী জানো, এসপির নাম চঞ্চল দত্ত, সে নাকি বীরভূমের ওই রাও-পরিবারের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। নবাবের উপহার দেওয়া পান্নার মালাটার কথা চঞ্চলও জানে।
পান্না নয়, চুনির মালা।
তাই নাকি? ও যে বলল, পান্না?
চুনি হচ্ছে লাল রঙের, আর পান্না সবুজ। দুটো একেবারে দুরকম।
তাই নাকি? আমি আবার অত চুনি-পান্না চিনি না। চঞ্চলও বোধ হয় গুলিয়ে ফেলেছে। যাই হোক, চঞ্চল ওই মালাটার কথা শুনেছে। এখন ওটার দাম হবে কয়েক কোটি টাকা। আজও কেউ মালাটা খুঁজে পায়নি। এখন তো বাড়িটা ভাঙা হচ্ছে, কোনও দেওয়ালের গর্ত থেকে কোনও মিস্তিরি-মজুর পেয়ে যেতে পারে। চঞ্চলকে বলেছি নজর রাখতে।
বেশ ভাল কথা।
শোনো রাজা, অসিত ধর যদি লোভের বশে ছোটখাটো কোনও জিনিস হাতসাফাই করে ওখান থেকে নিয়েও থাকে, তা নিয়ে তোমার মাথা ঘামাবার কী দরকার? বিমান তো কোনও অভিযোগ করেনি।
সেটা ঠিক। আমার মাথা ঘামাবার কোনও কারণ ছিল না। কিন্তু সে আমার চোখে ধূলো দেওয়ার চেষ্টা করেছে কেন, তা জানতে হবে না? সে কয়েক হাজার টাকা দিয়ে বিমানের কাছ থেকে কয়েকটা ভাঙা জিনিসপত্র কিনেছে। বিমান তাতেই খুশি। কিন্তু আমার পায়ের নখ আধখানা কেন উড়ে গেল, তা নিয়ে আমি মাথা ঘামাব না?
তোমার পায়ের নখ উড়ে গেছে? সেটা আবার কী ব্যাপার? কিছু বলোনি তো?
থাক, পরে বলব। এখন আপাতত আমি নিজেই মাথা ঘামাই।
সন্তু শেষ পরীক্ষা দিয়ে, বন্ধুদের সঙ্গে একটা সিনেমা দেখে ফিরল রাত সাড়ে আটটায়। এসেই কাকাবাবুর ঘরে ঢুকে বলল, এবার বলো! কী হল বীরভূমে।
কাকাবাবু একটা ইজি-চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেছিলেন ঘর অন্ধকার করে। উঠে আলো জ্বাললেন। তারপর বললেন, বলছি। কাল সকাল থেকে তোকে একটা কাজ করতে হবে, সন্তু। একটা লোককে সারাদিন ফলো করতে পারবি? পুলিশের সাহায্য পাওয়া যাবে না। লোকটি তোকে চেনে না, এই একটি সুবিধে আছে।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, কাকে ফলো করব? লোকটিকে আমি চিনব কী করে?
কাকাবাবু বললেন, আমি লোকটির বাড়ি আর লোকটিকে চিনিয়ে দেব। সারাদিনে ও কোথায় কোথায় যায়, কার কার সঙ্গে দেখা করে, সব তোকে নোট করতে হবে।
লোকটা যদি গাড়ি করে যায়?
সেও একটা সমস্যা বটে। তোকে ট্যাক্সি ভাড়ার জন্য টাকা দিতে পারি, কিন্তু কলকাতা শহরে যে ঠিক সময়মতন ট্যাক্সি পাওয়াই যায় না।
আমি মোটর সাইকেল চালাতে শিখে গেছি। বিমানদার মোটর সাইকেলটা চেয়ে নেব?
চালাতে শিখেছিস? তোর এখনও লাইসেন্স হয়নি? না।
তা হলে চালাতে হবে না। তা ছাড়া মোটর সাইকেলে বড্ড আওয়াজ হয়। সবাই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। এমনিই দ্যাখ যতটা পারিস। উপস্থিত বুদ্ধি খাটাবি।
এর পর কাকাবাবু প্রথম থেকে বলতে শুরু করলেন সন্তুকে। পুরনো আমলের বিশাল বাড়ি, ভূতের ভয়, ছাদের ওপর পাগলা দাদুর ঘর…।
অনেকটা যখন বলা হয়েছে, সেই সময় ঝনঝন করে বেজে উঠল টেলিফোন। সন্তুই ফোনটা ধরে বলল, কাকাবাবু, তোমাকে চাইছে।
কাকাবাবু রিসিভারটা নিয়ে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে একটা হাসির আওয়াজ ভেসে এল।
কাকাবাবুর ভুরু কুঁচকে গেল। তিনি আবার বললেন, হ্যালো, কে?
এবার ওদিক থেকে একজন বলল, সরি, মিস্টার রায়চৌধুরী। হঠাৎ হাসি পেয়ে গিয়েছিল। সকালে আপনি যখন রাগারাগি করছিলেন, সেই মুখখানা মনে পড়ে গেল কি না! যাই হোক, ভেবেচিন্তে কিছু পেলেন?
অসিত ধরের গলা!
কাকাবাবু বললেন, না, কিছু পাইনি।
অনেকের মুখেই শুনেছি, আপনার নাকি দারুণ বুদ্ধি। অনেক রহস্যের সমাধান করেছেন। এবার তা হলে আপনার ওপর টেক্কা দিলুম, কী বলুন!
আমার চেয়ে যাদের বুদ্ধি বেশি, তাদের আমি শ্রদ্ধা করি। তোমার কাছে আমি হেরে গেলে তোমাকে আমি অভিনন্দন জানাব। তবে, তিনতলার ঘরখানা তুমি আর আমি যদি একসঙ্গে দেখতাম, তা হলেই আসল বুদ্ধির পরীক্ষা হত। তুমি অন্যায়ভাবে আমাকে সরিয়ে দিয়েছ।
সে-চান্সটা আমাকে নিতেই হয়েছে। তবে আপনার চিন্তার বোঝাটা আমি একটু কমিয়ে দিচ্ছি। ওই যে সিরাজদ্দৌল্লার দেওয়া একটা চুনির মালার কথা এখন শোনা যাচ্ছে, সেটা কিন্তু আমি নিইনি! মালা জাতীয় কোনও কিছু আমি নিইনি, এ-বিষয়ে আপনাকে আমি ওয়ার্ড অব অনার দিতে পারি।
মালাটা ছিঁড়ে পাথরগুলো আলাদা করে নিলেও তার দাম একই থাকে। আলাদা-আলাদাভাবে পাথরগুলো লুকিয়ে রাখাও সোজা।
হা-হা-হা! মিস্টার রায়চৌধুরী, অত সোজা নয়! ভাবুন, ভাবুন, হাল ছেড়ে দেবেন না, ভাবুন, ভেবে যান!
কাকাবাবু আর কিছু বলার আগেই ফোন রেখে দিল অসিত।
অপমানে কাকাবাবুর মুখটা কালো হয়ে গেল।