Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » কাকাবাবু ও সিন্দুক-রহস্য || Sunil Gangopadhyay » Page 8

কাকাবাবু ও সিন্দুক-রহস্য || Sunil Gangopadhyay

কাকাবাবু বসে আছেন রাজবাড়ির সামনে বাগানে। নটবর সিংহ তাকে একটা চেয়ার এনে দিয়েছে।

আকাশে গুমগুম শব্দ হচ্ছে মেঘের। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে মাঝে মাঝে। কিন্তু বৃষ্টি আসার নাম নেই।

হাওয়া বইছে বেশ জোরে। সেই হাওয়ায় ভেসে আসছে বনজঙ্গলের গন্ধ।

কাকাবাবু মাঝে মাঝে ঘড়ি দেখছেন। এখন রাত পৌনে নটা। সন্তু আর জোজো এখনও ফিরল না।

কাকাবাবুর দুশ্চিন্তা করা স্বভাব নয়।

গর্তটার মধ্যে পড়ে গিয়ে সন্তু আর জোজো আহত হয়নি, এইটুকু জানাই তো যথেষ্ট। ওরা উপরে উঠে কোথাও গেছে। ওরা নিজেদের দায়িত্ব নিতে পারে। তবু তিনি ঘড়ি দেখছেন ঠিকই।

কিরণচন্দ্র ভঞ্জদেওর জ্বর আবার বেড়েছে। কমলিকা বসে আছে তার পাশে। কাকাবাবু বারবার বলে দিয়েছেন, তার জন্য মোটেই ব্যস্ত হতে হবে না। কমলিকা এখন তার বাবার কাছেই থাকুক।

প্রবীর গেছে একজন বড় ডাক্তারকে ডেকে আনতে।

মাঝে মাঝে একা থাকতে ভালই লাগে কাকাবাবুর। অনেকরকম আকাশ তাল চিন্তা করা যায়।

সন্তু আর জোজোকে যে গর্তটায় ফেলে দেওয়া হয়েছিল, সেটার কথাই মনে পড়ছে বারবার।

কমলিকা বলেছিল, ওই গর্তটার নাম বাঘের ফাঁদ। কাকাবাবুর সেটা বিশ্বাস হচ্ছে না। বাড়ির অত কাছে তো বাঘের জন্য ফাঁদ পাতা হয় না, সেরকম ফাঁদ পাততে হয় জঙ্গলের মধ্যে। বাড়ির অত কাছাকাছি বাঘ আসবে কেন? মানুষ যেমন বাঘ দেখে ভয় পায়, বাঘও তো মানুষকে দেখে ভয় পায়। খুব হিংস্র, মানুষখেকো বাঘও মানুষকে সামনাসামনি আক্রমণ করতে আসে না! লুকিয়ে লুকিয়ে পিছন দিক থেকে এসে ধরে। আর অধিকাংশ বাঘই মানুষখেকো নয়, তারা মানুষ দেখলে দূরে সরে যায়।

তা হলে ওই গর্তটা কীসের?

তার ক্রমশ দৃঢ় ধারণা হচ্ছে, ওটা একটা সুড়ঙ্গের বাইরের দিকের মুখ। দুপুরে একটা বাড়িতে সুড়ঙ্গ দেখা গিয়েছিল। এই রাজবাড়িতেও ওরকম পালানোর সুড়ঙ্গ থাকা স্বাভাবিক।

কিন্তু কমলিকা যে বলল, ওই গর্তটা দিয়ে আর কোথাও যাওয়া যায় না। ও মিথ্যে বলেনি। নিশ্চয়ই অনেকদিন আগে ভিতরের দিকে যাওয়ার রাস্তাটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এসব সুড়ঙ্গ এখন আর কেউ ব্যবহার করে না। মুখটা খোলা রাখলে, সাপটাপ, অন্য জন্তু-জানোয়ার বা চোরেরা ঢুকে। পড়তে পারে।

কাকাবাবু আবার ঘড়ি দেখলেন। নটা পাঁচ। খাবারের সময় হয়ে গেল, জোজো তো কখনও এত দেরি করে না। খিদেয় ছটফট করে। হয়তো কোনও দোকানে টোকানে কিছু খেয়ে নিয়েছে।

রাজবাড়ির দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল একজন লম্বা, স্বাস্থ্যবান পুরুষ। জিন্স আর টি-শার্ট পরা, ঠোঁটে সিগারেট। হাতে একটা মোবাইল ফোন।

কাকাবাবু চিনতে পারলেন, এ-বাড়ির ছোট রাজকুমার রুদ্রকুমার ভঞ্জদেও।

কাছে এসে সে বলল, নমস্কার, নমস্কার রায়চৌধুরীবাবু, কেমন আছেন? সারাদিন আপনার সঙ্গে দেখা করতে পারিনি। সেজন্য আমি লজ্জিত। দাদা অসুস্থ, আমারই উচিত ছিল আপনাদের দেখাশুনো করার। কিন্তু এমন ঘুম পেয়ে গেল, সারা দুপুর পড়ে পড়ে ঘুমিয়েছি।

কাকাবাবু বললেন, না, না, আমাদের কোনও অসুবিধে হয়নি। কমলিকা আর প্রবীর আমাদের যথেষ্ট দেখাশুনো করেছে।

রুদ্রকুমার জিজ্ঞেস করল, কিছু ঘুরেটুরে দেখলেন?

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, মন্দিরের ওদিকটায় গিয়েছিলাম। যা গরম ছিল আজ, আর কোথাও যাওয়া হয়নি।

রুদ্রকুমার বলল, যা বলেছেন, বিচ্ছিরি গরম চলছে কয়েকদিন ধরে। বছরের এই সময়টায় এরকম হয়। তারপর নিয়মিত বৃষ্টি হয়ে গেলে ওয়েদারটা এত চমৎকার হয়ে যায়, তখন আর অন্য কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না।

কাকাবাবু বললেন, কাল যদি গরমটা কম থাকে, তা হলে জঙ্গলের দিকে যাব ভাবছি।

রুদ্রকুমার বলল, যেতে ইচ্ছে হলে আমাকে বলবেন। আমি নিজে আপনাদের নিয়ে যাব। আমার চেয়ে জঙ্গল কেউ ভাল চেনে না। মাঝে মাঝে আমি একা একা জঙ্গলে চলে যাই। কোনও গাছতলায় চুপ করে বসে থাকি। কতরকম পাখির ডাক শুনি। সামনে দিয়ে হরিণের পাল চলে যায়, বুনো শুয়োর, খরগোশ। ময়ূরও আছে।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, বাঘটাঘ দেখতে পান না?

রুদ্রকুমার বলল, নাঃ! বাঘ এখন অনেক কমে গেছে। খুব কমই দেখা যায়। আপনার ভাইপো আর তার বন্ধু গেল কোথায়?

কাকাবাবু বললেন, গেছে কোথাও বেড়াতে।

রুদ্রকুমার বলল, এখানে অবশ্য তেমন ভয়টয় কিছু নেই। চোরডাকাতের উপদ্রবও প্রায় নেই বললেই চলে। তবে, কাল রাত্তিরে অত বড় ডাকাতি কী করে হল, সেটাই আশ্চর্য ব্যাপার। অমন ভারী সিন্দুকটা নিয়ে চলে গেল, নিশ্চয়ই ট্রাক নিয়ে এসেছিল। এরকম আগে কখনও ঘটেনি। কী লজ্জার ব্যাপার বলুন তো! আমাদের বাড়ি থেকেই জিনিসটা চলে গেল। তাও আপনি থাকতে থাকতে। দাদা আপনার উপর খুব ভরসা করেছিলেন। বারবার বলেছিলেন, আপনি এলেই সিন্দুকের রহস্যভেদ হয়ে যাবে!

কাকাবাবু একটুখানি বিরক্তভাবে বললেন, সবাই এই একই কথা বলছে। কেন, বুঝতে পারছি না। আপনার দাদা আমাকে সিন্দুকটার কথা ঘুণাক্ষরেও জানাননি। সিন্দুকের রহস্যভেদ করার জন্যও এখানে আসিনি। আপনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন, একটা চেয়ার আনতে বলুন না।

রুদ্রকুমার বলল, না, আমার চেয়ার লাগবে না। আপনি সম্মাননীয় অতিথি, আপনি দেশবিদেশে কত রহস্যের সমাধান করেছেন। সবাই ভাবছে, আপনি চেষ্টা করলে কি সিন্দুকটা উদ্ধার করতে পারতেন না?

কাকাবাবু বললেন, আমি সিন্দুকটা নিয়ে মোটেই মাথা ঘামাতে চাইনি। তবে, ইচ্ছে করলে অবশ্যই সেটা উদ্ধার করতে পারতাম। এমন কিছু শক্ত ব্যাপার নয়।

রুদ্রকুমার দারুণ অবাক হওয়ার ভান করে, খানিকটা ঠাট্টার সুরে বলল, আপনি ইচ্ছে করলে পারতেন? তা হলে একটু ইচ্ছে করুন না প্লিজ! আমাদের খুব উপকার হয়।

ঠাট্টার সুরটা লক্ষ করে কাকাবাবু এবার কড়া গলায় বললেন, সিন্দুকটা কোথায় আছে, তাও আমি জানি!

রুদ্রকুমার এবার সত্যি সত্যি অবাক হয়ে বলল, তাও জানেন সত্যি? কোথায় আছে? ডাকাতদের আস্তানাটা আপনি চিনে ফেলেছেন?

কাকাবাবু বললেন, ডাকাতদের আস্তানায় যাওয়ার দরকার হয়নি। কেউ কেউ নিজেকে খুব বুদ্ধিমান মনে করে। একটা ক্রাইম করার পর ভাবে, আমার এই নিখুঁত প্ল্যান কেউ বুঝতে পারবে না। তাই সে চুপচাপ না থেকে প্রকাশ্যে বুক ফুলিয়ে বেড়াতে চায়। তাই ধরা পড়ে যায়।

রুদ্রকুমার ব্যগ্রভাবে জিজ্ঞেস করল, সিন্দুকটা কোথায় আছে বলুন না!

কাকাবাবু বললেন, এ-বাড়িতেই আছে। বাইরে কোথাও যায়নি। কাল রাতে ট্রাক নিয়ে কোনও ডাকাতের দল আসেনি।

রুদ্রকুমার এবার হেসে ফেলে বলল, এটা আপনি কী বলছেন? আপনি যত বড়ই রহস্যসন্ধানী হন না কেন, আপনার এ-কথাটা বিশ্বাস করা যায় না। এ-বাড়িতেই সিন্দুকটা কী করে থাকবে? পুলিশ তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখেছে। আমরাও খুঁজেছি। সিন্দুকটা বাইরে টেনে নিয়ে যাওয়ার দাগ রয়েছে।

কাকাবাবু বললেন, আপনি খুব ভাল থিয়েটার করেন, তাই না। আপনার থিয়েটারের দল আছে শুনলাম!

রুদ্রকুমার বলল, হ্যাঁ, আছে। কিন্তু তার সঙ্গে এর কী সম্পর্ক?

কাকাবাবু বললেন, ভাল অভিনয়ের নিয়ম হচ্ছে, স্টেজে দাঁড়িয়ে অ্যাকটিং করার সময় সব কিছুই বেশি বেশি করতে হয়। বেশি জোরে হাসতে হয়। বেশি জোরে কাদতে হয়। অনেকখানি ভুরু তুলতে হয় অবাক হলে। কিন্তু মাটিতে দাঁড়িয়ে, সামনাসামনি অন্য কারও সামনে ওরকম সবকিছু বেশি করলেই লোকে সন্দেহ করে।

রুদ্রকুমার বলল, হঠাৎ একথা বলছেন কেন? আমাকে অভিনয় শেখাচ্ছেন?

কাকাবাবু বললেন, না। আমি শেখাব কেন? আজ সকালে আপনি আমার সামনে স্টেজের অভিনয় করছিলেন। সিন্দুকটা চুরি হয়ে গেছে শুনে এমন অবাক হলেন যে, বোঝা গেল, ওটা অভিনয়। অর্থাৎ ওই চুরির কথা আপনি আগেই জানতেন। জিপগাড়ি থেকে নেমে এমন ব্যস্ততার ভান করলেন, যেন অনেক দূর থেকে আসছেন, বোঝা গেল সেটা অভিনয়। অর্থাৎ রাত্তিরে আপনি এ-বাড়িতেই ছিলেন। সারারাত জাগতে হয়েছিল। সিন্দুকটা টেনে বাইরে নিয়ে যাওয়ার দাগটা বারবার আমাকে দেখাতে চাইলেন। কিন্তু আমি আগেই দেখে নিয়েছি, ওই দাগ কেউ হাত দিয়ে করেছে। আপনিই রটিয়ে দিয়েছেন যে, বাইরে থেকে কেউ এসে ট্রাকে করে সিন্দুকটা নিয়ে গেছে।

রুদ্রকুমার বলল, আপনি তো অভিনয়ের খুব সমঝদার দেখছি। আপনার একটা কথাও মেলেনি। সিন্দুকটার গতিবিধি সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। আপনার মতে যদি সিন্দুকটা এ-বাড়িতেই থেকে থাকে, তা হলে কোথায় আছে, আপনি দেখিয়ে দিতে পারবেন? তা হলে বুঝব আপনার মুরোদ।

কাকাবাবু এবার চওড়া করে হাসলেন।

তারপর উঠে দাঁড়িয়ে রুদ্রকুমারের বাহুতে চাপড় মেরে বললেন, ছোটকুমার, আপনি আমার সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানেন না। রাজা রায়চৌধুরীকে কেউ চ্যালেঞ্জ করে না। আমাকে এর মধ্যে জড়িয়ে আপনি খুব ভুল করছেন।

রুদ্রকুমার তবু তেরিয়াভাবে বলল, আমি আপনাকে চ্যালেঞ্জ করছি। সিন্দুকটা দেখিয়ে দিতে পারলে আপনাকে দশ হাজার টাকা দেব।

কাকাবাবু আবার হেসে বললেন, আমার নিজের অনেক টাকা আছে। দশ হাজার তো নস্যি! আমি অন্যের কাছ থেকে টাকা নিই না। চলুন, সিন্দুকটা কোথায় দেখা যাক। এখন আমার নিজেরও একটু একটু আগ্রহ হচ্ছে জানার জন্য, সিন্দুকটার মধ্যে কী আছে।

ক্রাচ বগলে নিয়ে কাকাবাবু এগিয়ে গেলেন বাড়ির দিকে। দরজার কাছে। একটা টুলে বসে নটবর সিংহ ঘুমোচ্ছে যথারীতি।

একতলায় যে-ঘরটায় সিন্দুকটা ছিল, কাকাবাবু সোজা চলে এলেন সেখানে। সারাদিন দুজন পুলিশ পাহারা দিচ্ছিল এই ঘরের বাইরে, তারা চলে গেছে সন্ধের পর। এখন ঘরটা একেবারে ফাঁকা।

একটা আলো জ্বলছে টিমটিম করে।

কাকাবাবু রুদ্রকুমারকে বললেন, এইখানে অত বড় সিন্দুকটা ছিল তো? কাল রাত্তিরে আমি নিজের চোখে দেখে গেছি। আজ সকালে, কারও ঘুম ভাঙার আগেই সেটা অদৃশ্য হয়ে গেছে। এই যে সিন্দুকটা টেনে নিয়ে যাওয়ার ঘষটানো দাগ। এই দাগটা আসল। দাগটা চলে গেছে ঘরের বাইরে।

কাকাবাবু চলে এলেন ঘরের বাইরে।

মাটির দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, দাগটা চলে গেছে বাইরের গেটের দিকে। ঘরের ভিতরের দাগ আর বাইরের দাগটা একরকম নয়। ভাল করে দেখুন। পুলিশ ভাল করে নজর করলেই বুঝতে পারত।

ডান দিকে খানিকটা সরে গিয়ে কাকাবাবু বললেন, এদিকেও একটা ঘষটানির দাগ ছিল, কেউ সেটা মুছে ফেলার চেষ্টা করেছে, কিন্তু পুরোপুরি মুছতে পারেনি, এখনও একটু একটু বোঝা যায়। তার মানে, এখান থেকেই বোঝাবার চেষ্টা হয়েছে যে, সিন্দুকটা গেছে বাড়ির বাইরে, আসলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ভিতরের দিকে। এটা যে আপনারই কাজ, তার প্রমাণ, আপনি

আমাকে বাইরের নকল দাগটা দেখাতে চাইছিলেন বারবার।

প্যান্টের পকেট থেকে একটা ছোট টর্চ বের করে কাকাবাবু সেই অস্পষ্ট দাগটার উপর ফেলে ফেলে এগোতে লাগলেন ডান দিকে।

দাগটা ঢুকে গেছে আর-একখানা ঘরে। সে-ঘরটাও একদম ফাঁকা।

রুদ্রকুমার বলল, তারপর কী হল? এ ঘর থেকে আবার সিন্দুকটা অদৃশ্য হয়ে গেল?

কাকাবাবু বললেন, বারবার অত বড় জিনিসটা অদৃশ্য হবে কেন? এই ঘরে নিয়ে আসার নিশ্চয়ই কোনও কারণ আছে।

কাকাবাবু টর্চের পিছন দিকটা দিয়ে ঘরের দেওয়ালে ঠুকতে লাগলেন। বেশি ঠুকতে হল না, একটা দেওয়ালের প্রায় আধখানা জুড়ে ঠকঠকের বদলে ঢ্যাপ ঢ্যাপ আওয়াজ হতে লাগল। অর্থাৎ সেটা ফাঁপা।

কাকাবাবু রুদ্রকুমারের দিকে ফিরে হাসিমুখে বললেন, এইখানে আছে সুড়ঙ্গের রাস্তা। সে সুড়ঙ্গটা শেষ হয়েছে ভাঙা দুৰ্গটার কাছে। ওদিকের মুখটার নাম বাঘের ফাণ, তাই না? এ দেওয়ালটা কি আপনি সরাবেন, না আমাকেই সরাতে হবে?

রুদ্রকুমার খুবই অবাক হয়ে চেয়ে আছে, কোনও উত্তর দিল না।

কাকার দেওয়ালটার দুদিকে কিছুটা ঠেলাঠেলি করতেই সেটা হঠাৎ স্লাইডিং দরজার মতন একপাশে সরে গেল। এ দেওয়ালটা আসলে কাঠের, বাইরের দিকে প্লাস্টার করা।

ওপাশে বেশ চওড়া সুড়ঙ্গ, অনেকটা দূরে দেখা যাচ্ছে অস্পষ্ট আলো।

ভিতরে পা দিয়ে কাকাবাবু বললেন, আসুন, ছোট রাজকুমার। আপনার বাড়িতে আপনাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। এবার দেখা যাক, সিন্দুকটা খুলে কী কী পাওয়া গেছে!

রুদ্রকুমারও সুড়ঙ্গের মধ্যে এসে বলল, সত্যি, আপনার যে এতখানি ক্ষমতা, আমার ধারণা ছিল না। সত্যি আশ্চর্য! আপনি ছাড়া এখানকার পুলিশ টুলিস কারও সাধ্য ছিল না এ ব্যাপারটা বোঝার।

সামনের দিকে এগোতে এগোতে কাকাবাবু বললেন, আপনার দাদা অত্যন্ত সৎ লোক, তিনি জানিয়ে দিয়েছিলেন, সিন্দুকটার মধ্যে যদি ধনরত্ন, সোনাদানা কিছু থাকে, তা কেউ নিতে পারবে না, সব জমা দেওয়া হবে গভর্নমেন্টের কাছে। সেটাই নিয়ম। কিন্তু আপনার লোভ হয়েছিল। আপনি ওসব ছাড়তে রাজি নন। তাই এই প্ল্যানটা করলেন। সিন্দুকটা রাখা হল আপনাদের বাড়িতে। সেটা খোলার আগেই চুরি হয়ে গেল। ডাকাতরা নিয়ে গেল ট্রাকে চাপিয়ে। ব্যস, আপনার উপরে কেউ কিছু সন্দেহ করবে না।

রুদ্রকুমার বলল, দেখুন, দাদা যেমন অসুস্থ, কিছুদিনের মধ্যেই মারা যাবেন। তখন এই বাড়ির মালিক হব আমি। এই ভাঙা বাড়ি ছাড়া আমাদের

আর কিছুই নেই। আমি কলকাতায় থাকতে চাই না। এই বাড়ি সারাতে অনেক অনেক টাকা লাগবে। সে টাকা পাব কোথায়? হঠাৎ যদি একটা গুপ্তধনের সন্ধান পাওয়া যায়, সেটা কেউ ছাড়ে? আমি দাদার মতন অমন ধার্মিক নই।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, সিন্দুক খুলে কী পেলেন?

রুদ্রকুমার বলল, সেটা এখনও কোলা যায়নি!

কাকাবাবু বললেন, আঁ! এখনও খোলা যায়নি? দুটো তালা ভাঙা গেল না?

রুদ্রকুমার বলল, তালা ভাঙা গেছে, তবু খুলছে না। মনে হচ্ছে মন্ত্র দিয়ে আটকানো। আপনার তো এত বুদ্ধি, দেখুন না, আপনি যদি খুলে দিতে পারেন, তা হলে ভিতরের জিনিসের ওয়ান ফোর্থ আপনার হবে।

কাকাবাবু বললেন, বললাম না, আমি অন্যের জিনিস কখনও নিই না। আর সিন্দুক টিক খোলার ক্ষমতাও আমার নেই। তবু একবার দেখি গিয়ে।

সুড়ঙ্গটা এখন বেশ চওড়া তো বটেই, এক এক জায়গায়, দুদিকে আরও বেড়ে গিয়ে ঘরের মতন হয়ে গেছে। এখানে কোনও মানুষ বা অনেকে মিলে কয়েকদিন থাকতেও পারে।

সেরকমই একটা চওড়া জায়গায় দুটো হ্যাজাক বাতি জ্বলছে। সিন্দুকটা রয়েছে মাঝখানে। সেটাকে ঘিরে বসে আছে কয়েকজন মানুষ। একটু দূর থেকে তাদের ছায়ামূর্তির মতন দেখাচ্ছিল, কাছে এসে তাদের এক-এক জনকে চিনতে পেরে কাকাবাবু চমকে চমকে উঠতে লাগলেন।

প্রথমেই একজন হাত তুলে বলল, নমস্কার, নমস্কার রায়চৌধুরীবাবু। ভাল আছেন তো?

এ লোকটির সঙ্গে দেখা হয়েছিল বাদামপাহাড় স্টেশনে। যেচে এসে কথা বলেছিল। যাকে দেখে জোজোর মনে হয়েছিল, জ্যোতিষী।

আর-একজন বলল, চিনতে পারছেন তো স্যার। আমি আব্দুল লতিফ। ভূতের সুড়ঙ্গের কাছে মোম বিক্রি করি।

আর-একজন সেই ট্রেনের কামরার চোখ-বোজা সাধু। এখন অবশ্য দিব্যি চোখ-খোলা। সে একটা হাতুড়ি দিয়ে সিন্দুকটা পিটছে। সেও নমস্কার করল।

একটি মেয়েও রয়েছে সেখানে, চব্বিশ-পঁচিশ বছর বয়স, তার হাতে একটা ছুরি। কাকাবাবুর মনে হল, একেও খুব সম্ভবত তিনি দেখেছেন আজ দুপুরে মন্দিরের কাছে।

রুদ্রকুমার বলল, এদের ডাকাতের দল বলে ভাববেন না। আমিই একমাত্র ডাকাত। এরা থিয়েটার পার্টির লোক। আমাকে সাহায্য করছে। দেখুন না, সিন্দুকটা এখনও খোলা যায়নি। তালা দুটো ভাঙা হয়েছে, কিন্তু অনেক বছর জলের তলায় থেকে ডালাটা এমন জ্যাম হয়ে গেছে যে খুলছে না কিছুতেই। কাকাবাবু বললেন, ছুরি দিয়ে চাড় দিয়ে দেখা হয়েছে?

আব্দুল বলল, সবরকম চেষ্টা করা হয়েছে। মনে হচ্ছে, আগুন দিয়ে গালিয়ে ফেলা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।

কাকাবাবু একটু হেসে বললেন, অনেক সময় লাথি মারলে কাজ হয়। রুদ্রকুমার ঠিক শুনতে না পেয়ে জিজ্ঞেস করল, কী মারলে?

কাকাবাবু বললেন, একবার আমার একটা রেডিয়ো খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কিছুতেই সারানো যায় না, মেকানিকও কিছু করতে পারল না। আমি তখন রেগেমেগে রেডিয়োটায় এক লাথি কষালুম। অমনি সেটা চলতে শুরু করল।

রুদ্রকুমার সঙ্গে সঙ্গে লাথি মারল সিন্দুকে। কিছুই হল না।

কাকাবাবু বললেন, এত বড় লোহার সিন্দুক, একজনের লাথিতে কিছু হবে না। সবাই মিলে মারুন।

এবার সবাই সিন্দুকটা ঘিরে দাঁড়িয়ে দমাদ্দম করে লাথি মারতে লাগল।

চার-পাঁচবারের পর সিন্দুকের ডালাটা সত্যি সত্যি একটু উঁচু হয়ে উঠল।

সবাই আনন্দে চিৎকার করে উঠল একসঙ্গে।

আব্দুল ডালাটা টেনে তোলার চেষ্টা করতে সেটা ভেঙেই গেল একেবারে।

আব্দুল বলল, স্যার, আপনি কি ম্যাজিক জানেন? রুদ্রকুমার বলল, দাড়াও, কেউ ভিতরে হাত দেবে না। আগে আমি দেখব।

সবাই তবু ঝুঁকে পড়ল, কাকাবাবু পঁড়িয়ে রইলেন একটু দূরে।

সিন্দুকটা বেশ বোঝাই করা, উপরটা অয়েল ক্লথ দিয়ে মোড়া।

সেটা সরানোর পর দেখা গেল নীল রঙের অয়েল ক্লথ মোড়া কয়েকটা প্যাকেট দড়ি দিয়ে বাঁধা।

দড়ি ছিঁড়ে একটা প্যাকেট খুলতেই দেখা গেল, তার মধ্যে রয়েছে ভাঁজ করা সব কাগজ।

রুদ্রকুমার অধৈর্য হয়ে কাগজগুলো না দেখেই একপাশে ফেলে দিয়ে আর-একটা প্যাকেট খুলল।

কাকাবাবু সেই কাগজগুলো তুলে নিলেন।

পরপর সাতখানা প্যাকেট ভরতি শুধু কাগজ। প্রত্যেকটা খুলে খুলে ফেলে দেওয়ার পর রুদ্রকুমার সিন্দুকটার প্রায় তলা থেকে টেনে তুলল একটা মুক্তোর মালা!

খুশির চোটে সে বলে উঠল, হুররে!

সে আর-একটা ওইরকম মালা বের করতেই সবাই প্রায় নাচতে শুরু করে দিল।

এরপর আরও অনেক জিনিস বেরোতে লাগল সেই সিন্দুক থেকে, নানারকম গয়না, হিরে-মুক্তো, একটা সোনার জাঁতি, সোনার দোয়াত-কলম, চুনি-পান্না বসানো কয়েকটা কৌটো, তার মধ্যে মোহর।

কাকাবাবু সেসব কিছুই দেখছেন না, তিনি একটা হ্যাজাকের কাছে গিয়ে এক মনে কাগজগুলো পড়ছেন। সংস্কৃত ভাষায় কালো কালি দিয়ে লেখা, অক্ষরগুলো কিছু কিছু ঝাপসা হয়ে গেছে। কষ্ট করে পড়তে হচ্ছে, তবু কাকাবাবুর মুখে অন্যরকম আনন্দ ফুটে উঠেছে।

সিন্দুক থেকে সব কিছু বের করবার পর রুদ্রকুমার বলল, রায়চৌধুরীবাবু, আপনি আমাদের একটুখানি সাহায্য করেছেন। আপনাকে একটা উপহার দেওয়া উচিত। আপনি এর থেকে আপনার পছন্দ মতন যে-কোনও একটা মালা তুলে নিন।

কাকাবাবু তার দিকে এক দৃষ্টিতে কয়েক পলক তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বললেন, এর কোনও কিছু নেওয়ার অধিকার আমার নেই। আপনাদেরও নেই। এসব কার সম্পত্তি তা স্পষ্টভাবে এইসব কাগজে লেখা আছে।

রুদ্রকুমার ভুরু নাচিয়ে বলল, তাই নাকি? কার সম্পত্তি?

কাকাবাবু বললেন, ধুন্ধুপন্থ নানাসাহেবের।

রুদ্রকুমার বলল, সে আবার কে?

কাকাবাবু বললেন, আপনার বোধহয় ভাল করে ইতিহাস পড়া নেই। পলাশির যুদ্ধের ঠিক একশো বছর পর ভারতীয় সৈন্যরা ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু করেছিল। তাদের একজন প্রধান নেতা ছিলেন এই কানপুরের ধুন্ধুপন্থ নানাসাহেব। ইংরেজদের অস্ত্রশক্তি বেশি ছিল, তাই শেষ পর্যন্ত তারাই জিতে যায়। বিদ্রোহের নেতাদের মধ্যে অনেকেই ধরা পড়েন। কিন্তু নানাসাহেব কিছুতেই ধরা দেননি। তিনি কয়েকজন সঙ্গীকে নিয়ে কোথায় উধাও হয়ে গেলেন, তা এ-পর্যন্ত কেউ জানত না। এখন জানা গেল। তিনি এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন এই রাজ্যে।

রুদ্রকুমার মুখ বিকৃত করে বলল, ধুর, ওসব বাজে ইতিহাস কে শুনতে চায়? এবার তা হলে…

চোখ-বোজা সাধুটি বলল, রাজকুমার একটু দাড়ান না। বাকি গল্পটা শুনে তো নিই। তারপর কী হল?

কাকাবাবু বললেন, ওঁদের থাকার জন্য একটা বাড়ি দেওয়া হয়েছিল। সম্ভবত পুকুরটার ধারে যে বাড়িটাকে এখন বলে ভূতের বাড়ি, সেখানে। সে বাড়িতে ওঁরা ছিলেন প্রায় দেড় মাস। সেসব কথা লেখা আছে। তারপর কিছু একটা হয়। নানাসাহেবের কাছে অনেক ধনরত্ন আছে, এরকম অনেকেই ধারণা করেছিল। একরাতে ডাকাতের দল সেই বাড়ি আক্রমণ করে, ডাকাত না হয়ে এখানকার রাজার সৈন্যরাও হতে পারে। নানাসাহেবের অতি বিশ্বাসী সঙ্গীরা প্রাণপণ লড়াই করে সেই আক্রমণকারীদের রুখে দেয়, তাদের মধ্যে সাতজনই মারা যায়। অবশ্য, সেই অবসরে বাকি তিনজনের সঙ্গে নানাসাহেব পিছন দিক দিয়ে পালিয়ে যান। এত বড় ভারী সিন্দুকটা সঙ্গে নেওয়া সম্ভব নয় বলে ফেলে দিয়ে গিয়েছিলেন পুকুরের জলে। হয়তো ভেবেছিলেন, কোনও এক সময় আরও দলবল নিয়ে ফিরে এসে সিন্দুকটা উদ্ধার করবেন। তা আর আসতে পারেননি।

রুদ্রকুমার বলল, এসব তো কবেকার কথা। এখন তা নিয়ে কে মাথা ঘামাতে চায়। এই কয়েক কোটি টাকার সম্পত্তি এখন আমার।

কাকাবাবু বললেন, ওগুলোর দাম কয়েক কোটি টাকা নয়। তার চেয়ে অনেক বেশি। ঐতিহাসিক জিনিস হিসেবে ওগুলো অমূল্য। ওই সবই মিউজিয়ামে থাকবে।

রুদ্রকুমার হা হা করে হেসে উঠে বলল, মিউজিয়ামে থাকবে? লোকটা বলে কী? মাথা খারাপ নাকি? এই সম্পত্তি পেয়ে আমি ছেড়ে দেব? এসব বিক্রি করে সেই টাকায় আমি এখানকার রাজা হব।

আব্দুল বলল, আমাদের থিয়েটার পার্টিটা, ভালভাবে গড়া যাবে।

মেয়েটি বলল, কিন্তু কুমারসাহেব, এ-লোকটি বাইরে গিয়ে যদি পুলিশকে সব কিছু বলে দেয়? আজ সন্ধেবেলা ভুবনেশ্বর থেকে একজন পুলিশের বড়কর্তা এসেছেন শুনেছি।

রুদ্রকুমার বলল, সে-কথা কি আর আমি ভাবিনি? ওকে বাইরে যেতে দিচ্ছে কে? ওকে মেরে এইখানে পুঁতে রাখলে কেউ কিছুই টের পাবে না।

লম্বা লোকটি বলল, পুলিশ কিন্তু এই সুড়ঙ্গের মধ্যেও খোঁজ করতে পারে। এখানে কোনও প্রমাণ রাখা ঠিক হবে না। অন্য কিছু ভেবে দেখতে হবে।

রুদ্রকুমার চেঁচিয়ে ডাকল, গুরুপদ! এই গুরুপদ! ব্যাটা এখনও ঘুমোচ্ছে। নাকি?

একটু দূরে সত্যিই মাটিতে শুয়ে ঘুমোচ্ছিল একজন লোক। ডাক শুনে সে চোখ মুছতে মুছতে উঠে এল।

রুদ্রকুমার তাকে জিজ্ঞেস করল, এই বুড়োর সঙ্গে যে ছেলে দুটো এসেছিল, তাদের বেঁধে রেখেছিস তো?

লোকটি নাক দিয়ে ঘেতমতন শব্দ করল।

লম্বা লোকটি বলল, হ্যাঁ, জালে বাঁধা আছে। সাধুচরণ ওদিক দিয়ে বেরিয়ে গর্তের মুখটা ঠিক মতন বন্ধ করে যায়নি, তাই ছেলে দুটো বাঘের ফঁদে নেমে ঠিক কঁকটা দেখে ঢুকে পড়েছিল।

সাধু সাজা লোকটি বলল, তখন যে বড় হাতুড়ি আনতে গেলাম। তাড়াহুড়োতে খেয়াল করিনি।

রুদ্রকুমার বলল, গুরুপদ, এই খোঁড়া লোকটাকে বেঁধে ফেল।

কাকাবাবু বললেন, এই সেই গুরুপদ। আমাদের ড্রাইভার। গাড়িতে অ্যাকসিডেন্ট করিয়ে এ আমাদের জঙ্গলের মধ্যে ফেলে পালিয়ে ছিল। আমাদের অনেক বিপদ হতে পারত। একে সেজন্য শাস্তি পেতে হবে।

রুদ্রকুমার আবার অট্টহাস্য করে বলল, কে শাস্তি দেবে? তুমি? তোমার আয়ু ফুরিয়ে এসেছে, রায়চৌধুরী!

গুরুপদ কাকাবাবুকে ধরার জন্য দুহাত বাড়াতেই তিনি প্রচণ্ড এক ঘুসি কষালেন তার মুখে।

সে ছিটকে পড়ে গেল দেওয়ালের কাছে। রুদ্রকুমার বলল, হু, তোমার হাতে বেশ জোর আছে দেখছি! ওকে মারলে কী হবে, আমিই তো ওকে পাঠিয়েছিলাম তোমাদের জঙ্গলে ফেলে আসতে। আমাকে মারো দেখি। আমি এ জেলার বক্সিং চ্যাম্পিয়ন।

সে এগিয়ে এসে কাকাবাবুর মুখ লক্ষ করে ঘুসি চালাল দুবার। কাকাবাবু দুবারই ঠিক সময় মাথা সরিয়ে নিলেন, তার লাগল না। তারপর নিজে

আচমকা একটা ঘুসি কষালেন রুদ্রকুমারের পেটে।

সে দুহাতে পেট চেপে বসে পড়ল।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সে আবার উঠে দেওয়ালে ঝোলানো একটা তলোয়ারের খাপ খুলে বলল, এবার?

কাকাবাবু বললেন, দেওয়ালে আর-একটা তলোয়ার আছে দেখছি। ওটা আমাকে দাও। তারপর দ্যাখো, তুমি কতক্ষণ আমার সামনে দাড়াতে পারো। তোমার ওই মুঠো করে ধরা দেখেই বুঝতে পারছি, তুমি তলোয়ার চালানো ভাল করে শেখোনি।

রুদ্রকুমার ভেংচি কেটে বলল, আর-একটা তলোয়ার তোমাকে দেব? এ কি খেলা হচ্ছে নাকি! তুমি এক্ষুনি খতম হয়ে যাবে। তা বুঝতে পারছ না?

কাকাবাবু বললেন, তুমি একটা কাপুরুষ। রাজবংশের লোক হলে কী হবে, তুমি এটা জানো না যে, তলোয়ার হাতে নিলে অন্য পক্ষকে লড়াইয়ের সুযোগ দিতে হয়। ঠিক আছে, মারো দেখি, আমাকে কীভাবে মারবে?

কাকাবাবু ডান হাত দিয়ে একটা ক্রাচ উঁচু করে তুলে ধরলেন।

রুদ্রকুমার এলোপাতাড়ি তলোয়ার চালাতে চালাতে এগোনোর চেষ্টা করল। কয়েকবার আটকে আটকে একবার কাকাবাবু এমন জোরে তার হাতে ক্রাচ দিয়ে মারলেন যে, তলোয়ারটা ছিটকে গিয়ে পড়ল অনেক দূরে।

কাকাবাবু বললেন, কিছুই শেখোনি।

লম্বা লোকটি দেওয়াল থেকে খুলে নিল অন্য তলোয়ারটা। আব্দুল মাটি থেকে কুড়িয়ে নিল আগেরটা। সেটা এনে দিল রুদ্রকুমারকে।

কাকাবাবু বললেন, এবার দুজন। ঠিক আছে।

তিনি ক্রাচ দুটোই মাটিতে ফেলে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালেন। তার দুটো হাতই খালি।

রুদ্রকুমার হঠাৎ খুব ভয়-পাওয়া গলায় চেঁচিয়ে উঠল, এই, এই, ও এবার পকেটে হাত দেবে। আমার বন্দুকটা কোথায়, বন্দুকটা নিয়ে আয়, শিগগির শিগগির…

কাকাবাবু চোখের নিমেষে পকেট থেকে বের করে ফেলেছেন রিভলভার।

ঠান্ডা গলায় বললেন, না, তোমার বন্দুকটা আর আনা চলবে না। যে যেখানে আছ, চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকো, কেউ নড়বে না।

লম্বা লোকটি তখনও তলোয়ার উঁচিয়ে আছে দেখে কাকাবাবু বললেন, এটা যে খেলনা পিস্তল নয় আর আমার হাতের টিপ কত ভাল, সেটা তোমাদের বুঝিয়ে দেওয়া দরকার।

তিনি একবার গুলি চালালেন, সুড়ঙ্গের মধ্যে তার প্রচণ্ড শব্দ হল।

গুলিটা লেগেছে লম্বা লোকটির ডান হাতের মুঠোয়, তলোয়ারটা ঝনঝন করে পড়ে গেল মাটিতে। লোকটি যন্ত্রণায় চেঁচিয়ে উঠল।

কাকাবাবু বললেন, তোমরা সবাই মিলে আমাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছিলে, সেইজন্য তোমাদের সবাইকে জেলে যেতে হবে। নানাসাহেবের সব জিনিসপত্র যাবে সরকারের কাছে। সবাই একদিকে পাশাপাশি দাড়াও।

কেউ নড়ছে না দেখে কাকাবাবু ধমক দিয়ে বললেন, আবার গুলি করতে হবে নাকি? সব সরে যাও একদিকে!

এবার সবাই হুড়োহুড়ি করে রুদ্রকুমারের পাশে গিয়ে দাঁড়াল।

শুধু ড্রাইভার গুরুপদ তখনও মাটিতে বসে আছে দেখে কাকাবাবু বললেন, ওঠো, ওঠো, যাও ওদিকে। তোমাকে দেখেই আমার রাগ হচ্ছে। দেরি করলে গুলি চালিয়ে দিতে পারি। জঙ্গলে তোমার জন্য আমাদের হাতপা ভাঙতে পারত। তোমার একটা পা খোঁড়া করে দেবার খুব ইচ্ছে হচ্ছে।

গুরুপদ এবার তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল ওদের পাশে।

এই দলে যে একটি মাত্র মেয়ে, সে হঠাৎ কাঁদতে শুরু করল।

কাকাবাবু তাকেও ধমক দিয়ে বললেন, কান্নার কী আছে! তুমিও আমাকে মেরে ফেলার কথা বলেছিলে। যাও, ওদের পাশে যাও!

মেয়েটি ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, না, না। আমি ওকথা বলিনি। আমি কোনও দোষ করিনি। আমি কিছুই জানি না!

কাকাবাবু বললেন, ওসব কথা পরে হবে। যাও ওদিকে। তারপর সবাই মিলে লাইন করে ভিতরের দিকে চলো।

মেয়েটি চেঁচিয়ে বলল, না, না, আমি ওদের সঙ্গে যাব না। আমি আপনার কাছে থাকব। আপনি আমাকে বাঁচান।

মেয়েটি দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল কাকাবাবুর বুকে। দুহাতে তার গলা জড়িয়ে ধরল।

হঠাৎ ওইভাবে মেয়েটি বুকের উপর পড়ায় কাকাবাবু প্রথমটায় হকচকিয়ে গেলেন। পরেই বুঝলেন, এ-মেয়ের অন্য মতলব আছে। কান্নাটা ওর

অভিনয়।

কিন্তু এক হাতে তিনি ওকে দূরে সরিয়ে দিতে পারলেন না। মেয়ে বলেই তার গায়ে গুলি চালাতেও পারলেন না কাকাবাবু। শুধু বলতে লাগলেন, সরো, সরো, এ কী করছ!

মেয়েটি এবার খুব জোরে কামড়ে দিল কাকাবাবুর ডান হাত।

কাকাবাবু রিভলভারটা আর ধরে রাখতে পারলেন না। সেটা পড়ে গেল মাটিতে।

সঙ্গে সঙ্গে অন্য সবাই ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল কাকাবাবুকে। খিলখিল করে হেসে উঠল মেয়েটি।

রুদ্রকুমার রিভলভারটা কুড়িয়ে নিয়ে বলল, এবার?

অন্যরা কাকাবাবুকে মাটিতে শুইয়ে ফেলে চেপে বসেছে তার বুকে। গুরুপদ ঘুসি মারছে তার মুখে। কাকাবাবু চোখ বুজে ফেললেন।

রুদ্রকুমার মেয়েটিকে বলল, তুই দারুণ কাজ করেছিস রে চামেলি। লোকটা সত্যি আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। তোকে কিছু পুরস্কার দিতে হবে।

মেয়েটি বলল, আমায় দুছড়া মুক্তোর মালা দিতে হবে।

রুদ্রকুমার বলল, পাবি, পাবি। দুখানা হিরেও দেব।

তারপর সে তার দলের লোকদের বলল, আর মারিস না। এবার ওকে বেঁধে ফেল। গুরুপদ, দড়ি নিয়ে আয়।

গুরুপদ সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে এল অনেকখানি মোটা দড়ি।

রুদ্রকুমার বলল, ভাল করে বাঁধ। যেন আর কোনও কেরামতি না করতে পারে। শুনেছি, এই রায়চৌধুরী নাকি অনেক জায়গায় অনেকরকম বিপদ থেকে বেঁচে গেছে। এবারেই ওর খেলা শেষ।

কাকাবাবু জ্ঞান হারাননি। কোনও কথা বলছেন না। তার নাক দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে। একটা চোখেও লেগেছে খুব।

রুদ্রকুমার লম্বা লোকটিকে জিজ্ঞেস করল, কী করব? এখানেই খতম করে দেব ওকে?

সে বলল, তা হলে লাশটা ফেলবেন কোথায়! এখানে রাখা যাবে।

রুদ্রকুমার বলল, সেটা ঠিক কথা। এক কাজ করা যাক। ওকে গর্জনতলা নিয়ে যা কয়েকজন মিলে। ওখানে একটা বিরাট খাদ আছে জানিস তো? সেখানে ওকে ঠেলে ফেলে দিবি নীচে। অত উঁচু থেকে পড়লে কোনও মানুষের পক্ষেই বাঁচা সম্ভব নয়। ঠেলে ফেলার আগে ওর দড়ির বাঁধন খুলে দিবি। তা হলে মনে হবে অ্যাকসিডেন্ট। ছেলে দুটোও তো বাঁধা আছে। তাদেরও নিয়ে যা। একইরকমভাবে ফেলে দিবি নীচে। পুলিশ বুঝবে ওরা নিজেরাই কোনওভাবে পড়ে গেছে। আমাদের কোনও দায়িত্ব নেই। আমার দাদাকে সেই কথা বুঝিয়ে দেব।

লম্বা লোকটি বলল, আপনি যাবেন তো সঙ্গে?

রুদ্রকুমার বলল, না, না, আমি কী করে যাব? এত সব জিনিসপত্র এখানে পড়ে থাকবে? তোরা কয়েকজন মিলে যা। তুই, সাধুচরণ, আরএকজন অন্তত।

আব্দুল লতিফ বলল, আমি এখানেই থাকতে চাই।

রুদ্রকুমার বলল, তা হলে গুরুপদ যাক। তিনজনই যথেষ্ট। এর হাতপায়ের বাঁধন যখন খুলবি, তখন কিন্তু খুব সাবধান। এক কাজ করতে পারিস। একটা লোহার ডান্ডা কিংবা হাতুড়ি নিয়ে যা। বাঁধন খোলার আগেই হাতুড়ি মেরে ওর মাথাটা একেবারে ভেঙে দিবি। খাদের নীচে পড়লে মাথাটা তো এমনিতেই ছাতু হয়ে যাবে। ছেলে দুটোরও ওই একই ব্যবস্থা করিস। বাঁধন খোলার আগেই খতম করে দিলে একেবারে নিশ্চিন্ত।

লম্বা লোকটি বলল, গর্জনতলা তো অনেকটা দূরে। কী করে যাব?

রুদ্রকুমার বলল, গাড়িতে যাওয়া চলবে না। তা হলে ড্রাইভার সাক্ষী থাকবে। হেঁটেই চলে যা। ভাবিস না, তোদের সবাইকেই আমি ভাল মতন পুরস্কার দেব। আর দেরি করে লাভ নেই! এত রাত্তিরে বাইরে কেউ থাকবে না, তোদের কেউ দেখতেও পাবে না।

দু-তিনজন মিলে কাকাবাবুকে দাড় করিয়ে দিল।

রুদ্রকুমার বলল, গুডবাই, রায়চৌধুরী। কেন আমাদের ব্যাপারে নাক গলাতে এসেছিলে? তোমার কপালে এইরকম মৃত্যুই লেখা ছিল, বুঝলে তো!

এতক্ষণ বাদে কাকাবাবু বললেন, আমার ক্রাচ দুটো সঙ্গে দাও!

রুদ্রকুমার হেসে বলল, তুমি যেখানে যাচ্ছ, সেখানে আর ক্রাচ লাগবে। এ দুটোর মধ্যে কোনও অস্ত্র লুকোনো আছে কি না কে জানে? পরে ভাল করে পরীক্ষা করে আগুনে পুড়িয়ে দেব। কোনও প্রমাণ রাখব না।

ওরা তিনজন কাকাবাবুকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে চলল।

খানিকটা যাওয়ার পর রেলের কামরায় সেই চোখ-বোজা সাধুটি বলল, তোমার ভাইপো না ভাগনে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, আমি সাধু হয়েছি কেন? বাবা-মা-ই আমার নাম রেখেছে সাধুচরণ। আমাদের নাটকে আমাকে সাধুর পার্ট দেওয়া হয়েছে। তাই মাঝে মাঝে সাধু সেজে ঘুরে বেড়াই। সাধু সাজলে রেলের ভাড়াও লাগে না।

লম্বা লোকটি বলল, আমাদের নাটকে সেই সাধু আবার ছদ্মবেশী এক খুনি।

সাধুরচণ বলল, সে পার্টটাও আমি ভালই করছি। কী বলো?

লম্বা লোকটি বলল, আমার নাম হরকুমার। কাল রেল স্টেশনে তোমাকে আমি সাবধান করে দিয়েছিলাম। সিন্দুকটা নিয়ে মাথা না ঘামালে তোমার এই অবস্থা হত না।

কাকাবাবু এদের সঙ্গে কথা বলার কোনও প্রয়োজনীয়তা বোধ করলেন না।

সুড়ঙ্গটা ক্রমশ সরু হয়ে আসছে। তলাটা এবড়োখেবড়ো। ক্রাচ ছাড়া হাঁটতে খুবই অসুবিধে হচ্ছে কাকাবাবুর। সামনে সামনে যাচ্ছে সাধুচরণ। তার হাতে একটা মশাল। পিছন থেকে দুজন তাকে নিয়ে যাচ্ছে ঠেলতে ঠেলতে।

এক জায়গায় সাধুচরণ জিজ্ঞেস করল, ছেলে দুটো কোথায় রে? এই গুরুপদ, আর কতটা দূরে?

গুরুপদ বলল, দূর নেই।

কয়েক মিনিট যাওয়ার পর সুড়ঙ্গটা আবার চওড়া হয়ে গেল। প্রায় একটা গোল ঘরের মতন।

এখানে দেওয়ালের গায়ে অনেক গর্ত। ওদের পায়ের শব্দ পেতেই সেইসব গর্ত থেকে কিচকিচ করে উঠল কয়েকটা ইঁদুর।

সাধুচরণ বলল, এখানেই তো থাকার কথা।

হরকুমার বলল, দড়ির জালটা তো এখানেই উপরে বাঁধা থাকে। গেল কোথায়?

মশালটা নিয়ে একটু খুঁজতেই দেখা গেল এক জায়গায় জালটা ছেঁড়াখোঁড়া অবস্থায় পড়ে আছে। প্রায় টুকরো টুকরো অবস্থা।

সাধুচরণ দারুণ হতাশভাবে বলল, যাঃ, ছেলে দুটো পালিয়েছে?

হরকুমার বলল, জালটা অনেকদিন ব্যবহার হয়নি। তাও তো বেশ মজবুত ছিল। ছিড়ল কী করে?

সাধুচরণ বলল, কী করে ছিড়ল, সে চিন্তা করে লাভ নেই। ছেলে দুটো পালিয়েছে, এটাই আসল কথা। এখন কী হবে? ছোটবাবুকে জানাতে গেলেই তো দারুণ চটে যাবে।

হরকুমার বলল, একেই তো দারুণ রগচটা। তার উপর হাতে রয়েছে পিস্তল। রেগেমেগে হয়তো গুলিই করে দেবে!

সাধুচরণ বলল, এই ব্যাটা গুরুপদরই তো পাহারা দেওয়ার কথা। শুধু পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছিল বোধহয়। এখন তুই যা, খবর দে ছোটকুমারকে। জিজ্ঞেস করে আয়, আমরা শুধু একেই নিয়ে যাব কিনা গর্জনতলায়।

গুরুপদ ভয়ে সিঁটিয়ে গিয়ে, দুহাত নাড়তে নাড়তে বলতে লাগল, না,, না!

সাধুচরণ বলল, এ যাবে না। আমিও যেতে রাজি নই।

হরকুমার বলল, আমার একা যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তা হলে এক কাজ করা যাক। এখন রায়চৌধুরীকে একাই গর্জনতলায় ফেলে আসা যাক। ছেলে দুটো তো সিন্দুকের মধ্যে কী আছে, তা জানে না, কোনওদিন জানতেও পারবে না। ওদের এখন না মারলেও চলবে। ওরা জানবে, ওদের কাকাবাবু অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছে। চল তা হলে!

ওরা আবার কাকাবাবুকে ঠেলতে শুরু করল।

এরপর সুড়ঙ্গটা আবার খুব সরু হয়ে গেল। মাথা নিচু করে দেওয়াল ধরে ধরে এগোল। এক জায়গায় সাধুচরণ একটা দরজা খুলে ফেলল, তারপরেই বাঘের ফাঁদের সেই গর্ত।

সাধুচরণ হরকুমারকে বলল, আগে তুই উপরে উঠে উঁকি মেরে দ্যাখ, বাইরে কেউ আছে কি না।

হরকুমার খাঁজ দিয়ে উপরে গিয়ে বলল, না, কেউ নেই। সব শুনশান।

সাধুচরণ কাকাবাবুকে বলল, ওঠো। পা বাঁধা অবস্থায় তবু লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটা যায়, কিন্তু খাঁজ বেয়ে উঠবেন কী করে কাকাবাবু। হাতও বাঁধা।

গুরুপদ আর সাধুচরণ তাকে ঠেলে তুলল, উপর থেকে হরকুমার তার কঁধ ধরে টেনে নিল।

এখানটা এখন সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ আর নির্জন। আকাশে রয়েছে জ্যোৎস্না, আকাশটা ঠিক যেন পাউডার মাখানো। বড় বড় গাছগুলো পঁড়িয়ে আছে। আলোছায়ার মধ্যে।

হরকুমার বলল, গর্জনতলা অনেকটা দূর। এইরকমভাবে ও লাফিয়ে লাফিয়ে যাবে? অসম্ভব।

সাধুচরণ বলল, পায়ের বাঁধনটা খুলে দিতেই হবে। তবু খোঁড়াতে খোঁড়াতে যাবে। দে, গুরুপদ, পা-টা খুলে দে।

তারপর সে কাকাবাবুকে বলল, খবরদার, তেড়িবেড়ি করতে যেয়ো না। দৌড়োতে তো পারবে না। পালানোর চেষ্টা করলেই এই হাতুড়ির ঘা মারব মাথায়?

হরকুমার বলল, এক কাজ কর না। এখানেই ওর মাথাটা ভেঙে দে। তারপর ওর দেহটা আমরা কাঁধে করে নিয়ে যাব। সেটাই সুবিধে।

সাধুচরণ বলল, কাধে করে মড়া নিয়ে যাব? ওসব আমি পারব না। তা ছাড়া, ছোটকুমার যা বলেছে, তাই করতে হবে। চল, চল।

ঠিক তক্ষুনি কাকাবাবু শুনতে পেলেন একটা পাখির ডাক। মনে হল যেন একটা দোয়েল পাখির শিস।

কী সুন্দর সেই সুর। ঠিক যেন অসহ্য গরমের পর এক ঝলক ঠান্ডা বাতাস। মনটা জুড়িয়ে যায়।

কাকাবাবু দাঁড়িয়ে পড়লেন।

হরকুমার বলল, রাত্তিরবেলা পাখি ডাকছে?

সাধুচরণ বলল, এগো না। এখন পাখির ডাক শুনতে হবে না।

কাকাবাবুর মুখে ছড়িয়ে গেছে হাসি।

তিনিও অবিকল সেই পাখির ডাকের মতন শিস দিতে লাগলেন।

এবারে সাধুচরণের কিছু একটা সন্দেহ হল। সে বলল, কী ব্যাপার, কী ব্যাপার? এ লোকটা শিস দিচ্ছে কেন? নিশ্চয়ই কোনও মতলব আছে। মাথাটা গুঁড়িয়ে দেব।

সে হাতুড়িটা উঁচু করতেই কাকাবাবু এক পা তুলে তার পেটে মারলেন লাথি। সে মাটিতে আছড়ে পড়ে গেল।

ভাঙা দুর্গটির ভিতর থেকে একলাফে বেরিয়ে এল সন্তু। হাতে তার একটা লম্বা বন্দুক।

সন্তু চিৎকার করে বলল, সাবধান, গুলি চালাব।

কাকাবাবু বললেন, ওর হাতের টিপ কিন্তু খুব ভাল। সন্তুর পিছন পিছন ছুটে এসেছে জোজো আর কমলিকা।

সন্তু বলল, কাকাবাবুর দড়ির বাঁধন আগে খুলে দে জোজো।

জোজো কাকাবাবুর কাছে এসে বাঁধন খোলার চেষ্টা করতে করতে বলল, ইস, একটা ছুরি থাকলে ভাল হত। যাক গে, অনেক দিন নখ কাটিনি, বড় নখ থাকলে গিট খোলার সুবিধে হয়।

কমলিকা কাছে এসে বলল, কাকাবাবু, আপনার কোথাও লাগেনি তো?

কাকাবাবু বললেন, আমার নাক দিয়ে রক্ত পড়ছিল, এখন একটা চোখ দিয়ে খুব জল পড়ছে। তা বলে ভেবো না যেন আমি কাঁদছি! সন্তু বন্দুকটা পেল কোথায়?

কমলিকা বলল, আমাদের বাড়ির বন্দুক! সন্তু চাইল। আমার দাদা বন্দুক চালানো শেখেনি।

বাঁধন মুক্ত হয়ে কাকাবাবু ওদের তিনজনের সামনে এসে বললেন, তোমরা যারা আমার মুখে ঘুসি মেরেছ, তাদের প্রত্যেককে ওইরকম ঘুসি খেতে হবে। আমার গায়ে কেউ হাত তুললে তাকে আমি ক্ষমা করি না।

রাজবাড়ির দিক থেকে ছুটে এল তিনজন পুলিশ, আগে আগে রয়েছে বিনয়ভূষণ মহাপাত্র।

তিনি হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, এখানে কী হয়েছে? স্যার, আপনার কোনও ক্ষতি হয়নি তো? আমাদের বড়সাহেব এসেছেন, ওদিকের সুড়ঙ্গের মুখটা এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি।

কাকাবাবু বললেন, এই তিনজনকে বাঁধুন। আমি ওদিকে যাচ্ছি। এখান থেকে আর কেউ বেরোনোর চেষ্টা করলেই ধরবেন!

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress