Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » কাকাবাবু ও ব্ল্যাক প্যান্থার || Sunil Gangopadhyay » Page 9

কাকাবাবু ও ব্ল্যাক প্যান্থার || Sunil Gangopadhyay

দুপুরবেলা খেতে দেওয়া হল দুখানা করে মোটাসোটা রুটি, আর খানিকটা বেগুন পোড়া।

গৌতমকাকু বললেন, এরা কি রোজ নিরামিষ খায়? চেহারাগুলো তো ভালই দেখছি।

কাকাবাবু বললেন, নিজেরা মাছ-মাংস খায় বোধ হয়। আমরা তো বন্দি, আমাদের তা দেবে কেন?

গৌতমকাকু বললেন, নিরামিষ খাওয়া অবশ্য ভালই। বেগুন পোড়াটার স্বাদ চমৎকার হয়েছে। আর একখানা রুটি পেলে বেশ হত। এখনও একটু খিদে রয়ে গেছে।

দূরে একজনকে দেখে হেঁকে বললেন, এই যে ভাই, শোনো, আর একখানা রুটি পেতে পারি কি?

লোকটি দুদিকে ঘাড় নেড়ে চলে গেল।

গৌতমকাকু বললেন, এরা তো ভারী চশমখোর। কুড়ি লাখ, পঞ্চাশ লাখ টাকা করে মুক্তিপণ চাইছে, অথচ ভাল করে খেতেও দেবে না!

কাকাবাবু হাসতে হাসতে বললেন, গোবর্ধন, তুই কি ভাবছিস, এরা আমাদের হোটেলে রেখেছে? এদের কোনও দয়ামায়া নেই।

গৌতমকাকু বললেন, ওদিকে এতক্ষণ কী হচ্ছে কে জানে। মিলি নিশ্চয়ই কেঁদে ভাসাচ্ছে। ছেলেটাও ঘাবড়ে গেছে।

কাকাবাবু বললেন, সন্তু ওদের সঙ্গে আছে। সন্তু কিছুটা সামলাবে।

একটা ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল মহাদেবী। তার মাথায় একটা পালকের মুকুট, হাতে একটা খোলা তলোয়ার। বেশ দেখাচ্ছে ভালই।

সে কাছে এসে তীক্ষ গলায় জিজ্ঞেস করল, আপনারা আরও রুটি চাইছিলেন? লজ্জা করে না? এ কি মামাবাড়ির আবদার পেয়েছেন? এখানে কি আমাদের অফুরন্ত খাবার আছে? চারখানা রুটি খেলে যথেষ্ট পেট ভরে যায়।

গৌতমকাকু বললেন, চারখানা! আমাদের তো মোটে দুখানা করে রুটি খেতে দেওয়া হয়েছে।

মহাদেবী ভুরু কুঁচকে বলল, দুখানা? সত্যি কথা বলছেন?

কাকাবাবু হেসে বললেন, আমার এই বন্ধুটি আমেরিকায় বহু টাকা রোজগার করে। সে মাত্র দুখানা রুটির জন্য মিথ্যে কথা বলবে?

মহাদেবী বলল, চারখানা করে রুটি দেওয়ার কথা। শম্ভুটা নিশ্চয়ই চুরি করেছে। সঙ্গে আর কী দিয়েছিল?

বেগুনপোড়া।

ডিমসেদ্ধ দেয়নি?

না।

বন মুরগির ডিম পাওয়া গেছে অনেক। শম্ভু তার থেকেও সরিয়েছে। এই তোরা শম্ভুকে এখানে ধরে নিয়ে আয় তো!

কাকাবাবুদের দিকে ফিরে সে আবার বলল, আই অ্যাম সরি। আমরা খুব একটা ভাল খাবার দিতে পারি না, তা বলে বন্দিদের আধ পেটা খাইয়েও রাখতে চাই না। এবার দেখুন, আমরা চোরদের কীরকম শাস্তি দিই!

কয়েকজন লোক টানতে টানতে নিয়ে এল শম্ভুকে। সে শুধু লুঙ্গির ওপর একটা গেঞ্জি পরে আছে। গেঞ্জিতে হলুদের দাগ।

একজন তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল মহাদেবীর পায়ের কাছে।

মহাদেবী তার বুকের ওপর একটা পা তুলে দিয়ে কর্কশ গলায় জিজ্ঞেস করল, এই হারামজাদা, তুই কবে থেকে রুটি চুরি করছিস?

শম্ভু হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি কিছু করিনি। আমি কিছু করিনি।

মহাদেবী বলল, বাকি রুটি কোথায় গেল? এঁদের ডিম দিসনি কেন?

অন্য লোকদের মধ্যে কয়েকজন বলল, আমরাও আজ ডিম পাইনি। দুজন বলল, আমাদের মাত্র তিনখানা করে রুটি দিয়েছে।

মহাদেবী বলল, আজ কুড়িটা ডিম রান্না হয়েছে। আমায় দুটো দিয়েছিল, একটা ফেরত দিয়েছি। তোমাদের রাজা ডিমই খান না। তা হলে কেন সবাই পাবে না? তুই বাকি ডিম বিক্রি করে দিস? শম্ভু বলল, আমি কিছু করি না। নিতাই আমার কাছ থেকে জোর করে নিয়ে যায়।

দলের মধ্য থেকে একজন চিৎকার করে বলল, না, না, না, ও আমার নামে মিথ্যে কথা বলছে!

মহাদেবী মুখ তুলে বলল, নিতাই, এদিকে আয়!

অন্যরা এবার টেনে এনে নিতাইকেও ফেলে দিল মহাদেবীর পায়ের কাছে। শম্ভুর তুলনায় নিতাই বেশ গাঁট্টাগোট্টা, ধুতির ওপরে সে একটা খদ্দরের কোট পরে আছে।

মহাদেবী এবার বক্তৃতার ঢঙে বলতে লাগল, আমরা এখানে স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করব, তোমরা সবাই তার সৈনিক। আমাদের রাজ্যে কেউ চুরি করবে না, কেউ মিথ্যে কথা বলবে না, কেউ অন্যকে ঠকাবে না। এখন থেকেই সেই শিক্ষা নিতে হবে। নিতাই, তুমি জানো, শাস্তি তোমাকে পেতেই হবে। তুমি এখন যত বেশি মিথ্যে কথা বলবে, তত তোমার শাস্তি বাড়বে। তুমি একজন অত্যন্ত সাহসী সৈনিক, রাজা তোমার ওপরে অনেকখানি নির্ভর করেন। তোমাকে আমি প্রাণদণ্ড দিতে চাই না। কী অন্যায় করেছ, খুলে বলো!

নিতাই কিন্তু শম্ভুর মতন কাদেনি। সে শান্ত গলায় বলল, হ্যাঁ, মহাদেবী, আমি দোষ করেছি। আপনার যা শাস্তি দিতে ইচ্ছে হয়, দিন। আসল কথাটা হল, চারখানা রুটি খেয়েও আমার পেট ভরে না। গায়ে শক্তি পাই না। তাই শম্ভুর কাছ থেকে আমি জোর করে, ভয় দেখিয়ে বেশি রুটি নিই।

কখানা রুটি খেলে তোমার পেট ভরে?

অন্তত দশ-বারোখানা?

কটা ডিম?

যত দেবেন। কুড়িটা ডিম আমি একাই খেয়ে হজম করতে পারি।

অন্যরা কেউ খাবে না। তুমি একাই সব খাবে?

সেটাই আমার অপরাধ হয়েছে। ভবিষ্যতে আর কোনওদিন এরকম করব না। আর যদি আমাকে মেরে ফেলতে চান, আমি ঘাড় পেতে দিচ্ছি।

নিতাই মহাদেবীর পায়ের কাছে মাথাটা নুইয়ে রাখল।

মহাদেবী বলল, সব মানুষের খিদে সমান হয় না। কেউ বেশি খায়, কেউ কম খায়। তোমাদের রাজা যেমন খুবই কম খাওয়া পছন্দ করেন। এখানে নিশ্চয়ই আরও অনেকের চারখানা রুটিতে পেট ভরে না। তার মানে, আমাদের খাদ্য বাড়াতে হবে। নিতাই, তুমি দশখানা রুটিই পাবে। আর অন্যরা, কার কখানা রুটি লাগবে, আজই জানিয়ে দাও। নিতাই, তুমি সত্যি কথা বলেছ তাই তোমার শাস্তি মকুব করা হল। কিন্তু শম্ভকে ক্ষমা করা হবে না। সে-ই আসল দোষী। সে কেন নিতাইকে ভয় পাবে, সে কেন সব কথা আগেই আমাকে কিংবা রাজাকে জানায়নি? রাজা যদি রাজ্যের সব কথা না জানে, তা হলে সে কীসের রাজা? চুরি করা ডিম-রুটি শম্ভুও নিশ্চয়ই খায়, কিন্তু সে কথা সে বলেনি। তা হলে কি শম্ভর একটা হাত কেটে নেওয়া হবে?

সবাই একসঙ্গে বলে উঠল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ।

মহাদেবী হুকুম করল, শম্ভু, ডান হাতটা মাটিতে পেতে রাখো!

সে তলোয়ার তুলতেই গৌতমকাকু বললেন, আরে আরে, সত্যি লোকটার হাত কেটে ফেলা হবে নাকি? সামান্য অপরাধে এমন শাস্তি? ওকে মাফ করে দিন!

শঙ্কর রায়বর্মন কখন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে, বোঝা যায়নি। এবার সে বলল, ইউ প্লিজ শাট আপ! আমাদের ব্যাপারে নাক গলাবেন না।

কাকাবাবু বললেন, ওকে অন্য শাস্তি দিন। হাত কেটে ফেলাটা বর্বর ব্যাপার!

শঙ্কর রায়বর্মন আবার বলল, বলছি না, শাট আপ!

মহাদেবী শঙ্কর রায়বর্মনের দিকে ফিরে বলল, কী রাজা, এর শাস্তি ঠিক আছে? তুমি কাটবে, না আমি কাটব?

শঙ্কর রায়বর্মন বলল, প্রথম অপরাধের জন্য ওর শাস্তিটা একটু কমিয়ে দিতে পারো। পুরো হাতটা কাটার বদলে ডান হাতের কড়ে আঙুলটা কেটে দাও!

শম্ভু এবার বাঁ হাতের উলটো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে বলল, আমার অপরাধের জন্য এত কম শাস্তি দিচ্ছেন, এজন্য আপনাদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকব। আর কখনও লোভ করব না। শুধু আর একটু যদি দয়া করেন, ডান হাতের বদলে বা হাতের একটা আঙুল নিয়ে নিন।

মহাদেবী বলল, বেশ, তাই হোক।

নিতাই মাথা তুলে বলল, মহাদেবী, শম্ভর বদলে আমার আঙুল কাটুন। শ্যু রোগা দুল্লা লোক, আমার একটা আঙুল গেলে কোনও ক্ষতি হবে না।

শম্ভ জোর দিয়ে বলল, না, না, আমার পাপের শাস্তি আমাকে পেতেই হবে। সারাজীবন আমি কাটা আঙুলটার দিকে তাকিয়ে ভাবব, আমি মহাদেবীর কাছে মিথ্যে কথা বলেছি। আর বলব না।

এবার অন্য একটি ছেলে এগিয়ে এসে বলল, মহাদেবী, ওদের দুজনকে ছেড়ে দিন, শাস্তি দিন আমাকে।

মহাদেবী বলল, কেন?

ছেলেটি বলল, ওই শম্ভু আমার কাকা। ছেলেবেলায় আমার বাবা মারা গেছেন, উনি আমাকে নিজের ছেলের মতন মানুষ করেছেন। কাকার বদলে আমার একটা আঙুল নিন। আমিও দু-একদিন চুরি করা ডিম খেয়েছি।

মহাদেবী বলল, তা হলে তো দেখছি তিনজনেরই আঙুল কাটতে হয়। আমাদের দলে এত আঙুলকাটা সৈন্য থাকলে তো চলবে না। তোমাদের আরও অনেক লড়াই করতে হবে। শম্ভুকেই একা শাস্তি দেব। শম্ভ, মাটিতে হাত পাতো।

শম্ভু বাঁ হাতটা মাটির ওপর পাততেই মহাদেবী তার কড়ে আঙুলে তলোয়ারটা রেখে চাপ দিল। চামড়া কেটে বেরোতে লাগল রক্ত।

শম্ভ একটুও মুখ বিকৃত করল না, ব্যথার শব্দও করল না।

মহাদেবী নরম গলায় বলল, ওরে, তোদের শাস্তি দিতে কি আমার ভাল লাগে? তোরা তো সবাই আমার ভাইয়ের মতন। স্বাধীন রাজ্য পাওয়ার পর তোরাই তো সেটা চালাবি।

তলোয়ারটা তুলে নিয়ে সে আবার বলল, রক্ত বেরিয়েছে, তাই যথেষ্ট। আঙুলটা আর কাটলাম না।

সবাই একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল, জয় জয় মহাদেবী! জয় জয় রাজা!

মহাদেবী কাকাবাবুদের দিকে ফিরে বলল, আমরা কিন্তু বন্দিদের প্রতি একটুও দয়াময়া দেখাই না। এক কোপে হাত কেটে উড়িয়ে দিই!

শঙ্কর রায়বর্মন এগিয়ে এসে বলল, সবাই শোনো, একটা ঘোষণা আছে। তোমরা জানো যে, একটা বন্দি-মুক্তিপণের টাকা পাওয়া গেছে। এই দুজনের জন্যও টাকা পাবই। এর বেশিরভাগ টাকাই অস্ত্র কেনার জন্য খরচ হবে। তবে তোমরা সবাই একপ্রস্থ নতুন জামাকাপড় পাবে। খাবারদাবারও বাড়িয়ে দেওয়া হবে আজ থেকে।

সবাই আবার চেঁচিয়ে উঠল, জয় জয় রাজা, জয় জয় মহাদেবী!

শঙ্কর রায়বর্মন তারপর বলল, শম্ভ, যাও, বন্দিদের জন্য আরও রুটি আর ডিমসেদ্ধ নিয়ে এসো!

কাকাবাবু বললেন, না থাক। যা কাণ্ড হল, এর পর আর এখন আমাদের কিছু খাওয়ার রুচি নেই।

শঙ্কর রায়বর্মন বলল, ঠিক আছে, এবারে চলুন আমার সঙ্গে।

মহাদেবীকে সে জিজ্ঞেস করল, তুমি যাবে নাকি আমাদের সঙ্গে? আমরা রাজপুরীতে যাচ্ছি।

মহাদেবী বলল, না, তুমি যাও, আমার অন্য কাজ আছে।

কাকাবাবুর দিকে তাকিয়ে সে মুচকি হেসে বলল, এবার পালাবার চেষ্টা করবেন নাকি? করে দেখুন না! আমাকে বাজিটা জিতিয়ে দিন।

কাকাবাবু বললেন, কী বাজি, তা তো এখনও শুনিনি। শুনলে না হয় চেষ্টা করা যেত।

মহাদেবী বলল, সেটা জানানো হবে না!

শঙ্কর রায়বর্মন ওঁদের হটিয়ে নিয়ে চলল ঝোপজঙ্গলের মধ্য দিয়ে। আজ আর চোখ বাঁধেনি।

ক্রাচ বগলে নিয়ে ঝোপ ঠেলে যেতে কাকাবাবুর অসুবিধে হচ্ছে। কোনও কোনও গাছে বেশ কাটা আছে। আবার ভারী সুন্দর দেখতে ফুলও ফুটে আছে অনেক। মাথার ওপর দিয়ে ডাকতে ডাকতে উড়ে যাচ্ছে টিয়াপাখির ঝাঁক।

খানিকটা দূরে ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে জিপগাড়িটা।

সেটাতে ওঠার পর শঙ্কর রায়বর্মন নিজে বসল ড্রাইভারের জায়গায়। তার পাশে একজন মাত্র গার্ড, তার হাতে একটা বর্শা।

জিপটা চালাতে চালাতে শঙ্কর রায়বর্মন গৌতমকাকুকে বলল, আপনার স্ত্রী কুড়ি লাখ টাকা পর্যন্ত দিতে রাজি হয়েছেন। তবে শর্ত দিয়েছেন, ওই টাকায় দুজনকেই ছেড়ে দিতে হবে। আমার পক্ষে তা মেনে নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। খবর পাঠিয়েছি, সত্তর লাখ থেকে বড় জোর পাঁচ লাখ কমাতে পারি।

গৌতমকাকু বললেন, মিলি অত টাকা পাবে কোথায়?

কাকাবাবু হঠাৎ রেগে উঠে বললেন, গৌতম, মিলিকে চিঠি লিখে দে, আমার জন্য যেন এক পয়সাও না দেয়। তোকে টাকা দিয়ে ছাড়াতে চায় তো ছাড়াক!

শঙ্কর রায়বর্মন বলল, বেশ তো, পঁয়তাল্লিশ লাখ পাঠাতে বলুন, আমেরিকান বাবুটিকে ছেড়ে দেব। রাজা রায়চৌধুরী এখানে থাকবেন।

গৌতমকাকু বললেন, পঁয়তাল্লিশ লাখ! জোগাড় করা অসম্ভব ব্যাপার!

শঙ্কর রায়বর্মন বলল, গয়না বিক্রি করতে বলুন। আপনার স্ত্রীর নিশ্চয়ই অনেক গয়না আছে। ডাক্তারের বউদের খুব গয়না থাকে।

গৌতমকাকু বললেন, আমেরিকায় মেয়েরা বেশি গয়না পরে না।

শঙ্কর রায়বর্মন বলল, আমেরিকায় বড়লোকের বউরা দামি দামি হিরের গয়না পরে না? আমাকে আমেরিকা শেখাচ্ছেন? সেসব এক-একটা গয়নারই দাম পঁচিশ-তিরিশ লাখ টাকা!

গৌতমকাকু জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কখনও আমেরিকায় ছিলেন?

শঙ্কর রায়বর্মন বলল, ছিলাম তো। অন্তত সাত-আট বছর।

ফিরে এলেন কেন?

নিজের রাজ্য উদ্ধার করতে। এখানে স্বাধীনভাবে থাকব। আমেরিকায় গোলামি করতে যাব কেন?

ওদেশ ছেড়ে এসে এরকম বনজঙ্গলের মধ্যে থাকা, সত্যি আপনার দারুণ জেদ আছে, স্বীকার করতেই হবে। তবে, আমাদের মতন কয়েকজনকে ধরে টাকা আদায় করে কত টাকাই বা তুলতে পারবেন। তাতে কি একটা রাজ্য পাওয়া যায়?

সে-ব্যাপারে আমার নিজস্ব প্ল্যান আছে। আপনাদের ধরে রাখতে হচ্ছে, এমনি এমনি চাইলে কি টাকা দিতেন?

সে আপনার যাই-ই প্ল্যান থাক। একটা কথা জেনে রাখুন, আমার এই বন্ধুকে ছেড়ে আমি কিছুতেই একা মুক্তি পেতে চাই না। আমাদের যত বেশিদিন ধরে রাখবেন, ততই আপনার বিপদ বাড়বে।

এ কথার উত্তর না দিয়ে শঙ্কর রায়বর্মন হা-হা করে হেসে উঠল। আরও কিছুক্ষণ পরে জিপটা থামল এক জায়গায়।

বিকেল হয়ে এসেছে। আকাশে মেঘ জমেছে বেশ। যে-কোনও সময় বৃষ্টি হতে পারে।

এখানেও জঙ্গলের মধ্যে খানিকটা জায়গা ফাঁকা। দেখা যাচ্ছে কয়েকটা ভাঙা ঘরবাড়ি। অনেককালের পুরনো, প্রায় ধ্বংসন্তুপ বলা যায়, প্রায় কোনও ঘরেরই ছাদ আস্ত নেই। একপাশে একটা মন্দিরও আছে, সেটা একটা অশ্বথ গাছের মোটা মোটা শেকড়ে ঢাকা।

শঙ্কর রায়বর্মন বলল, এইখানে ছিল আমাদের বংশের রাজধানী। এটা আবার নতুন করে গড়া হবে।

কাকাবাবু বললেন, এখানে একসময় কিছু লোকজনের বসতি ছিল বোঝা যাচ্ছে। হয়তো তখন এত ঘন জঙ্গল ছিল না। এককালে এখানে অনেক ছোট ছোট জমিদারি ছিল, তারা নিজেদের বলত রাজা। কিন্তু এটা যে আপনাদেরই ছিল, তা বোঝা যাবে কী করে?

শঙ্কর রায়বর্মন বলল, আমার কাছে দলিল আছে এ জায়গার। বংশলতিকা করা আছে। আমিই শেষ উত্তরাধিকারী।

কাকাবাবু বললেন, সেসব দলিল দেখিয়ে কি পুরনো জমিদারি ফেরত পাওয়া যায়? জমিদারি প্রথাই তো উঠে গেছে।

শঙ্কর রায়বর্মন সগর্বে বলল, জমিদারি নয়, স্বাধীন রাজ্য। ইংরেজরা কেড়ে নিয়েছিল। এখন ভারত সরকারের কাছ থেকে আদায় করে নেব।

এক জায়গায় অনেকখানি পাথরের বাঁধানো চাতাল, তার এক পাশে কয়েকটা ঘরের দেওয়াল।

কাকাবাবু কয়েক ধাপ সিঁড়ি দিয়ে সেই চাতালে উঠে দেওয়ালের ইট পরীক্ষা করে বললেন, মনে হচ্ছে, প্রায় দুশো বছরের পুরনো।

শঙ্কর রায়বর্মন বলল, ভেতরে যাবেন না। ওখানে দুটো ময়াল সাপ থাকে। ওরা অবশ্য আমাকে কিছু বলে না, কিন্তু বাইরের লোক দেখলে তাড়া করে।

গৌতমকাকু বললেন, সাপও মানুষ চেনে বুঝি?

কাকাবাবু চাতালের অন্য একদিকে গিয়ে বললেন, এর মধ্যে এটা নতুন করে গড়ার কাজ শুরু হয়ে গেছে?

শঙ্কর রায়বর্মন বলল, না, এখনও শুরু হয়নি। নকশা তৈরি হয়ে গেছে।

কাকাবাবু বললেন, তা হলে যে দেখছি, এখানে একটা জায়গা নতুন করে খোঁড়া হয়েছে।

শঙ্কর রায়বর্মন কাকাবাবুর কাছে গিয়ে ভুরু কুঁচকে বলল, তাই তো, এটা তো আগে ছিল না।

গার্ডকে ডেকে জিজ্ঞেস করল, মালু, এখানে কে খুঁড়েছে?

মালু বলল, জানি না তো স্যার। আগে দেখিনি।

শঙ্কর রায়বর্মন বলল, আমি দিনসাতেক আগে এসেছিলাম, তখন গর্ত ছিল। আমার এলাকার মধ্যে আমাকে না জানিয়ে কে এসে গর্ত খুঁড়বে?

কাছে গিয়ে দেখা গেল, শুধু এক জায়গায় গর্ত নয়। মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে লম্বা একটা নালার মতন কাটা হয়েছে। কোথাও-কোথাও সেটার ওপর আবার মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে। কোথাও কোথাও পুরোপুরি ভরেনি।

কাকাবাবু এক জায়গায় বসে পড়ে সেই নালার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দিলেন।

তারপর মুখ তুলে বললেন, মোটা মোটা তার রয়েছে এর ভেতরে।

গৌতমকাকু বললেন, এখানে কেউ ইলেকট্রিকের লাইন টানছে?

শঙ্কর রায়বর্মন বলল, এই জঙ্গলে কে ইলেকট্রিক আনবে? প্রথমত, সেটা বেআইনি। তা ছাড়া কোনও লোক ভয়ে এখানে আসে না।

কাকাবাবু সেই নালার ধার দিয়ে দিয়ে হাঁটতে লাগলেন।

সেটা চলেছে তো চলেইছে। এক-এক জায়গায় গাছপালা কেটে খোঁড়া হয়েছে। সেই নালা।

প্রায় পনেরো মিনিট যাওয়ার পর কাকাবাবু হাত তুলে অন্যদের থামতে বললেন।

এখানেও খানিকটা ফাঁকা জায়গায় রয়েছে দুখানা তাঁবু। ছোট ছোট গাছের ডাল কেটে সেই তাবুর ওপর এমনভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে যে, দূর থেকে ঠিক বোঝা যাবে না।

গৌতমকাকু বললেন, এখানে আর্মি ক্যাম্প করেছে?

শঙ্কর রায়বর্মন প্রবলভাবে মাথা নেড়ে বলল, হতেই পারে না। আর্মি মুভমেন্টের খবর আমি সবসময় পাই। আর্মির মধ্যেও আমাদের বংশের লোক আছে। তা ছাড়া, আর্মি ক্যাম্প করতে গেলে আগে রাস্তা বানাবে। এখানে কোনও রাস্তা নেই। গাড়িও নেই।

গৌতমকাকু বললেন, যদি কমান্ডো হয়? একটা তাবুর পাশে কয়েকটা সাইকেল রয়েছে।

কাকাবাবু বললেন, জঙ্গলের মধ্যে নিঃশব্দে চলাফেরার সব চেয়ে ভাল উপায় হচ্ছে সাইকেল। তবু যখন আছে, তখন মানুষও আছে নিশ্চয়ই। তাদের চেহারাটা দেখা দরকার। আমার একটা সন্দেহ হচ্ছে।

এর মধ্যে বৃষ্টি নেমে গেল ঝিরঝির করে।

শঙ্কর রায়বর্মন বলল, এখানে বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকে কী হবে? আমার ডেরায় ফিরে যেতে হবে। আমার লোকজনদের ডেকে এনে এসব তাঁবু ফাঁবু ভেঙে উড়িয়ে দেব।

কাকাবাবু বললেন, ওদের কাছে কী ধরনের অস্ত্র আছে, তা জানতে হবে না? আপনার তো সম্বল দুটো-একটা রিভলভার। বড় বড় অস্ত্রগুলোর গুলিই নেই।

আমার কুড়িজন লোক এনে একসঙ্গে ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ব।

ওদের যদি একটা লাইট মেশিনগান থাকে, তা হলে সেটার সামনে কুড়িজন লোক পোকামাকড়ের মতন শেষ হয়ে যাবে। তার আগে জানতে হবে, ওরা কারা? যদি আমাদের দেশের আর্মি হয়, তাদের সঙ্গে লড়াই করার প্রশ্নই ওঠে না।

আমার এলাকার মধ্যে আমি আর্মিকেও আসতে দেব না! আমি এখানকার রাজা।

আপনার রাজত্বটা আগে স্বাধীন হোক! এখনও তো হয়নি।

গৌতমকাকু বললেন, এখানে বৃষ্টির মধ্যে কতক্ষণ ভিজব? শীত করছে!

কাকাবাবু বললেন ভিজতেই হবে। আমার যেটা সন্দেহ হচ্ছে, সেটা সত্যি কিনা জানা দরকার।

মালু বলল, স্যার, আমি চুপি চুপি পেছন দিক দিয়ে গিয়ে দেখে আসব!

শঙ্কর রায়বর্মন বলল, যা তো, দেখে আয়।

কাকাবাবু বললেন, না, তুমি একা যাবে না।

ঠিক তখনই দুটো লোক একটা তাবু থেকে বেরিয়ে দৌড়ে অন্য তবুটাতে ঢুকে গেল।

লোকদুটো কালো রঙের টাইট প্যান্ট পরা, কালো জামা, মুখেও কালো মুখোশ। শুধু নাক আর চোখ দুটো খোলা আছে।

কাকাবাবু ফিসফিস করে বললেন, ব্ল্যাক প্যান্থার! আমি ঠিকই সন্দেহ করেছিলাম।

গৌতমকাকু বললেন, ব্ল্যাক প্যান্থার মানে?

কাকাবাবু বললেন, কিছুদিন আগেই একটা গোপন রিপোর্ট এসেছিল, কোনও শত্রু-দেশ থেকে এই ব্ল্যাক প্যান্থার বাহিনীকে আমাদের দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্যারাশুটে নামিয়ে দেবে। তারপর তারা আমাদের এয়ারপোর্ট, রেল স্টেশন ধ্বংস করবে। গত বছর আমি এরকম একটা দলকে ধরে ফেলেছিলাম। এবার আবার শুরু করেছে। মাটি খুঁড়ে যে তার টেনে নিয়ে গেছে, নিশ্চয়ই সেরকম কোনও উদ্দেশ্য আছে। এদিকে কোথাও এয়ার ফোর্সের বেস আছে।

গৌতমকাকু বললেন, কিন্তু দুটো তাঁবুতে আর কত লোক থাকবে! আমাদের পুলিশ বা আর্মি খবর পেয়ে গেলে ওরা নিজের দেশে পালাবে কী করে?

কাকাবাবু বললেন, ওরা পালাতে চায় না। এখন সব সুইসাইড স্কোয়াড শুরু হয়েছে জানিস না? ওরা মরবে জেনেই এসেছে। তাই সাঙ্ঘাতিক বেপরোয়া হতে পারে।

শঙ্কর রায়বর্মন বলল, ধুত! ব্ল্যাক প্যান্থার না ছাই! এমনি কোনও ডাকাতের দল কালো পোশাক পরে ভড়কি দিচ্ছে। ওরা বোধ হয় জানে না যে, আমার এলাকায় ঢুকে পড়েছে। আমার নাম শুনলেই ওরা ভয় পাবে! মালু, তুই যা তো, জিজ্ঞেস করে আয়, এখানে কেন তাঁবু গেড়েছে?

কাকাবাবু বললেন, না, না।

শঙ্কর রায়বর্মন বলল, শাট আপ! আমার হুকুমের ওপর কথা বলবেন না। আর একবার মুখ খুললেই একটা থাপ্পড় কষাব!

তারপর এক পা এগোতে গিয়ে একটা লতায় পা জড়িয়ে ঘুরে পড়ে যেতে লাগল সে। কোনওক্রমে একটা গাছের সরু ডাল ধরল, সে ডালটাও ভেঙে গেল।

সঙ্গে সঙ্গে তাঁবুর আড়াল থেকে সামনে এসে একজন ব্ল্যাক প্যান্থার এল এম জি থেকে গুলি চালাল। একঝাক গুলি।

কাকাবাবু তাঁর বন্ধুর হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে শুয়ে পড়লেন মাটিতে।

বিরাট জোরে মেঘ ডেকে উঠল, হয়তো বাজ পড়ল কাছাকাছি। বৃষ্টিও পড়ছে প্রবল তোড়ে। বৃষ্টির জন্যই সব দিক অন্ধকার হয়ে গেছে।

একটু পরে মুখ তুলে কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, গৌতম, তুই ঠিক আছিস?

গৌতমকাকু বললেন, হ্যাঁ, আমি ঠিক আছি। কিন্তু শঙ্করের বোধ হয় গুলি লেগেছে। নড়ছেটড়ছে না।

কাকাবাবু বললেন, এক্ষুনি এখান থেকে সরে পড়তে হবে। ওরা নিশ্চয়ই খুঁজতে আসবে। আমি শঙ্করের একটা দিক ধরছি, তুই অন্য দিকটা ধরে ওকে টেনে নিয়ে চল।

গৌতমকাকু বললেন, ইস, এর বুক রক্তে ভেসে যাচ্ছে। দুজনে মিলে প্রায় ছ্যাঁচড়াতে-ছ্যাঁচড়াতে শঙ্করকে নিয়ে দৌড়োলেন বনবাদাড় ঠেলে। এদিক-ওদিক তাকিয়েও ওঁরা মাল্লুকে দেখতে পেলেন না।

কোনওরকমে ওঁরা পৌঁছে গেলেন জিপটার কাছে। কেউ তাড়া করে আসছে কিনা এখনও বোঝা যাচ্ছে না। শঙ্করকে ভোলা হল জিপে।

কাকাবাবু বললেন, আমি জিপটা চালাচ্ছি। গৌতম, তুই দ্যাখ এ-লোকটা বেঁচে আছে কি না। কিংবা যদি বাঁচানো যায়!

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress