চালাঘরটায় ফিরে এসে
চালাঘরটায় ফিরে এসে কাকাবাবু দেখলেন, সন্তু আর জোজো বসে বসে একবাটি করে ক্ষীর খাচ্ছে।
কাকাবাবু বললেন, এ আবার কোথায় পেলি?
জোজো বলল, কুলসম দিয়ে গেল। খুব ভাল মেয়ে। আপনার জন্যও নিয়ে আসবে।
কাকাবাবু বললেন, কুলসুমকে আমিও দেখেছি। দেখলেই মনে হয়, মেয়েটির বেশ দয়ামায়া আছে। হাঁ রে সন্তু, তোদের নাকি বেঁধে রেখেছিল? হঠাৎ শুধু শুধু বাঁধতে গেল কেন?
জোজো বলল, শুধু শুধু? সন্তু যা কাণ্ড করেছিল!
কাকাবাবু সন্তুর দিকে চেয়ে রইলেন। সন্তু লাজুকভাবে বলল, সেরকম কিছু করিনি। আমরা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটছি, এই সময় কে যেন আমাদের চেঁচিয়ে কী বলল। লোকটাকে দেখতে পাচ্ছি না, ভাষাও বুঝতে পারছি না। আর একটু এগোতেই একটা লোক একটা ঝোপ থেকে বেরিয়ে এল, তারপর আমার গালে একটা চড় মারল। অমনই আমার রাগ হয়ে গেল, আমিও সঙ্গে সঙ্গে ওকে তুলে একটা আছাড় দিলাম!
জোজো বলল, অতবড় চেহারার লোকটাকে যে সন্তু তুলে ফেলে আছাড় দেবে, তা ও কল্পনাই করেনি। একেবারে কুংফু স্টাইল। তারপর আরও চারপাঁচজন লোক এসে ঘিরে ফেলে আমাদের হাত-পা বেঁধে ফেলল।
কাকাবাবু বললেন, বাকিটা আমি জানি। তোদের বেশিক্ষণ বাঁধা থাকতে হয়নি। কুলসম নামের ওই মেয়েটি এসে ছাড়িয়ে দিল।
জোজো বলল, কাকাবাবু আপনাকে আমি বলেছিলাম না, এরা জঙ্গলের ডাকাত? ঠিক তাই। এরা ডাকাতি করে আর চন্দনগাছ সব কেটে কেটে সাবাড় করে দিচ্ছে।
কাকাবাবু বললেন, শুধু তাই-ই নয়। এরা এক ধরনের মানুষ কেনাবেচার ব্যবসা করে। মোহন সিং আমাদের কুড়ি লাখ টাকায় বিক্রি করে দিয়ে গেছে। এরা এখন তার বদলে পঞ্চাশ লাখ টাকা আদায় করতে চায়।
সন্তু বলল, পঞ্চাশ লাখ টাকা? কে দেবে?
কাকাবাবু বললেন, কেউ দেবে না!
জোজো বলল, বাবাকে চিঠি লিখব? বাবা নেপালের রাজাকে বলে দিলে তিনি এককথায় দিয়ে দেবেন!
কাকাবাবু বললেন, খবরদার, ওরকম কথা উচ্চারণও কোরো না। নেপালের রাজার নাম শুনলেই এরা পঞ্চাশ লাখের বদলে পঞ্চাশ কোটি টাকা চাইবে!
সন্তু বলল, জোজো, তাদের সঙ্গে ইংল্যান্ডের রানি এলিজাবেথের চেনা নেই?
জোজো বলল, তিনবার দেখা হয়েছে। বাকিংহাম প্যালেসে ডিনার খেয়েছি। কাকাবাবু, এক কাজ করলে হয় না? নেপালের রাজা কিংবা ইংল্যান্ডের রানির কাছে টাকা চেয়ে চিঠি লেখা যাক। ওঁরা টাকা পাঠান বা না পাঠান, মাঝখানে কয়েকদিন সময় তো পাওয়া যাবে। সেই সুযোগে আমরা এখান থেকে পালাব!
কাকাবাবু বললেন, এটা গভীর জঙ্গল। এখান থেকে পালানো খুব সহজ হবে না।
একজন লোক কাকাবাবুর জন্য একবাটি ক্ষীর নিয়ে এল। এক চামচ মুখে দিয়ে কাকাবাবু বললেন, বাঃ, চমৎকার খেতে। অনেকদিন ক্ষীর খাইনি, খাওয়ার কথা মনেও পড়ে না। এরা যদি এত ভাল ভাল খাবার দেয়, তা হলে এখান থেকে। পালাবার দরকারটাই বা কী? দিব্যি আছি।
দুপুরবেলাও এল রুটি, মাংস আর দই।
বিকেলবেলা কফির সঙ্গে তিনরকম বিস্কুট।
সন্ধেবেলা অন্ধকারে ওরা তিনজন বাইরে বসে আছে একটা গাছের গুঁড়ির ওপর। একটা হ্যারিকেন নিয়ে এল কুলসম। ঘাঘরার বদলে সে এখন একটা কালো শাড়ি পরেছে।
কাকাবাবুর পাশে দাঁড়িয়ে সে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, বাবুজি, তুমি উর্দু বোঝো?
কাকাবাবু ঘাড় নাড়তে সে বলল, কাল খুব ভোরবেলা সূর্য ওঠার আগে তোমরা তৈরি থাকবে। আমি দুটো ঘোড়া জোগাড় করে আনব, তাইতে তোমরা পালাবে। সূর্য দেখেই তোমরা চিনতে পারবে পুব দিক। সোজা পুব দিকে ঘোড়া ছোটালে তোমরা পৌঁছে যাবে জঙ্গলের বাইরে।
কাকাবাবু খানিকটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি আমাদের পালাবার ব্যবস্থা করে দেবে? কেন?
কুলসম বলল, তুমি জানো না, এরা সাঙ্ঘাতিক লোক। যখন-তখন মানুষ খুন করতে পারে। আমি শুনেছি, টাকা না পেলে এরা তোমায় খতম করে দেবে।
কাকাবাবু বললেন, আমায় যদি খতম করে দেয়, তাতে তোমার আপত্তি হবে কেন? তুমিও তো এই দলেরই।
কুলসম কাতরভাবে বলল, না, বাবুজি, আমার খুব কষ্ট হয়। আমার তো আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। সর্দার আমাকে কোথাও যেতে দেবে না। তাই আমাকে এখানে থাকতেই হবে। তোমরা পালাও!
কাকাবাবু বললেন, তুমি আমাদের পালাতে সাহায্য করছ, এটা জানতে পারলে এরা তোমায় শাস্তি দেবে না?
কুলসম বলল, জানতে পারবে না। জানলেও সর্দার বড়জোর বকুনি দেবে, কিন্তু আমায় প্রাণে মারবে না। আমি সর্দারের তৃতীয় পক্ষের বউ!
কাকাবাবু সন্তুকে জিজ্ঞেস করলেন, কী রে, সন্তু, পালাবি নাকি?
সন্তু বলল, আমি জোজোকে আমার ঘোড়ায় তুলে নিতে পারি।
কাকাবাবু বললেন, ঠিক আছে, কাকভোরে তোরা তৈরি হয়ে থাকিস। আমি যাচ্ছি না। আমার এখানে এখনও কিছু কাজ আছে।
জোজো বলল, কাজ আছে? এখানে আপনার কী কাজ?
কাকাবাবু মুচকি হেসে বললেন, আছে আছে, পরে জানতে পারবে। তোমরা কালিকটের হোটেলে গিয়ে বিশ্রাম নাও।
সন্তু বলল, তা হলে আমরাও এখান থেকে যাচ্ছি না।
কাকাবাবু কুলসমকে বললেন, কালকেই দরকার নেই, বুঝলে। দু-তিনদিন পরে আমরা তোমাকে জানাব।
কুলসম খানিকটা নিরাশ হয়ে ফিরে গেল।
এর পর কেটে গেল দুদিন। কিছুই তেমন ঘটল না। দিব্যি তিনবেলা খাওয়া আর ঘুমনো। মাঝে মাঝে কাকাবাবু সন্তু আর জোজোকে নিয়ে বেড়াতে যান জঙ্গলে। কেউ কিছু বলে না। কোনও লোকও দেখা যায় না। জঙ্গলের মধ্যে একটা ছোট্ট নদী আছে, জল খুব কম, পায়ে হেঁটেই পার হওয়া যায়। সকালবেলা সন্তু সেই নদীতে নামতেই কোথা থেকে একটা লোক এসে হাজির হল। তার হাতে একটা বর্শা।
সে কাকাবাবুকে বলল, ওই ছেলেটি জলে নেমেছে নামুক। স্নানও করতে পারে। কিন্তু নদীর ওপারে যেন না যায়। আপনি দেখছেন। আপনি দায়ী রইলেন।
লোকটির ব্যবহার রুক্ষ নয়। নরমভাবে এই কথা বলে আবার একটা ঝোপের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল।
বিক্রম ওসমানকে এই দুদিন দেখতে পাওয়া যায়নি। তোকজনও কিছু কম। শুধু জঙ্গলের চন্দন গাছ কাটা চলছেই। রাত্তিরবেলা কারা যেন গাছগুলো নিয়েও চলে যাচ্ছে।
তৃতীয় দিন দুপুরবেলা একজন লোক এসে কাকাবাবুকে ডেকে নিয়ে গেল।
আজ আর দোলনা নয়। দুটো কাটা গাছের গুঁড়ির ওপর তক্তা পেতে টেবিল বানানো হয়েছে, তারা ওপর দাবার ছক পাতা। বিক্রম ওসমান সেই লাল আলখাল্লাটার বদলে এখন পরে আছে জিন্স আর টি শার্ট। কোমরে রিভলভার।
সে বলল, এসো বাঙালিবাবু, দেখা যাক তুমি কেমন দাবা খেলতে জানো।
কাকাবাবু বসে পড়লেন একদিকে। প্রথম চাল দিয়ে বললেন, তোমাদের এই জায়গাটা ভারী সুন্দর। শুধু গাছ কাটার শব্দে কান ঝালাপালা হয়ে যায়। এত যে গাছ কাটা হচ্ছে, এগুলো কেনে কারা?
ওসমান বলল, শহরের ব্যবসায়ীরা কেনে।
কাকাবাবু বললেন, এইসব গাছ কাটা বেআইনি জেনেও তারা কেনে?
ওসমান ফুঁসে উঠে বলল, কীসের বেআইনি? সরকারের জঙ্গল নিয়ে আইন বানাবার কী এক্তিয়ার আছে? সৃষ্টিকর্তা যেমন মানুষ সৃষ্টি করেছেন, সেইরকম গাছপালাও সৃষ্টি করেছেন। মানুষ তার প্রয়োজনে গাছ কাটবে। ব্যস!
কাকাবাবু বললেন, সৃষ্টিকর্তা এত গাছপালার সৃষ্টি করেছেন তো মানুষেরই প্রয়োজনে। গাছ কেটে ফেললে তো মানুষেরই ক্ষতি হবে!
ওসমান বলল, তার মানে? মানুষের কী ক্ষতি হবে?
কাকাবাবু বললেন, পৃথিবী থেকে সব গাছপালা যদি শেষ হয়ে যায়, তা হলে মানুষও আর বাঁচবে না।
কেন?
আমরা এই যে শ্বাস নিচ্ছি, তাতে অক্সিজেন থাকে। সেই জন্যই আমরা বেঁচে থাকি। গাছপালাই অক্সিজেন তৈরি করে দেয়। গাছপালা শেষ হয়ে গেলে অক্সিজেনও ফুরিয়ে যাবে, মানুষরা সব দমবন্ধ হয়ে মরবে!
ওসব তোমাদের বই পড়া কথা, আমি বিশ্বাস করি না।
আমাদের দেশে এমনিতেই অনেক গাছ কমে গেছে। তুমি তার ওপর এইসব বড় বড় গাছ কেটে সারা দেশের ক্ষতি করছ!
বাজে কথা রাখো। চাল দাও, তোমার রাজাকে সামলাও!
সেই দানটায় ওসমান বাজিমাত করে দিল, কাকাবাবু হারলেন।
আবার ঘুটি সাজানো হল।
ওসমান বলল, তিন দান খেলা হবে, তুমি প্রত্যেকবার হারবে। আমার সঙ্গে দাবা খেলায় কেউ পারে না।
কাকাবাবু একটু খেলার পর জিজ্ঞেস করলেন, ওসমানসাহেব, তুমি মোহন সিংকে কতদিন চেনো?
ওসমান বলল, অনেকদিন। দশ বছর হবে। আমার সঙ্গে অনেকবার কারবার করেছে।
লোক ধরে এনে তোমার কাছে বিক্রি করে দেয়?
আমরা নিজেরা কাউকে ধরি না। মোহন সিংয়ের মতন আরও লোক আছে। তারাই ধরে আনে।
মোহন সিং আগে যাদের বিক্রি করে গেছে, তোমরা তাদের জন্য বেশি টাকা পেয়েছ?
প্রত্যেকবার। ও যে-দামে বিক্রি করে, আমরা তার অন্তত তিনগুণ টাকা আদায় করি।
আমাদের জন্য মোহন সিংকে কুড়ি লাখ টাকা দিয়ে দিয়েছ?
দশ লাখ দিয়েছি, আর দশ লাখ পরে পাবে। আমরা কথার খেলাপ করি না।
তার মানে ওই দশ লাখ টাকাই তোমাদের লোকসান। আমাদের জন্য তোমরা তো এক পয়সাও পাবে না। মোহন সিং জেনেশুনেই তোমাদের ঠকিয়ে গেছে।
জেনেশুনে? তা হতে পারে না। আমাদের এই কারবারে কেউ বেইমানি করে না।
শোনো ওসমান সর্দার। তোমাকে একটা কথা বলি। একেবারে খাঁটি সত্যি কথা। মোহন সিংয়ের খুব রাগ আছে আমার ওপরে। ও আমাকে খুন করতে চেয়েছিল। তার বদলে তোমাকে দিয়ে খুন করাবে বলে এখানে পাঠিয়ে দিয়েছে। দশ লাখ টাকাও পেয়ে গেল, ওর হাতে রক্তও লাগল না। আমি খুন হলে পুলিশ এলে তোমাকেই এসে ধরবে, মোহন সিংকে কেউ সন্দেহও করবে না।
কোনও পুলিশের সাধ্য নেই আমাকে ছোঁয়।
সেকথা হচ্ছে না। দোষটা তোমার ঘাড়েই চেপে থাকবে। মোহন সিং তোমার মাথায় কাঁঠাল ভাঙল। তুমি তাকে কিছুই করতে পারবে না।
মোহন সিংকে আমি ডেকে জিজ্ঞেস করতে পারি, তুমি যা বলছ তা সত্যি কি!
তুমি ডাকলেই মোহন সিং আসবে? সে আর ধরাছোঁয়া দেবে না। তোমাকে দশ লাখ টাকা ঠকিয়ে গেল, এটা তো সত্যি? আমার মুণ্ডু কাটো আর যাই-ই করো, টাকাটা তো ফেরত পাচ্ছ না!
টাকা ফেরত দেবে না মানে? আলবাত ফেরত দেবে!
সে একবার মুম্বই চলে গেলে তারপর তুমি আর তাকে ছুঁতেও পারবে না।
আমি ইচ্ছে করলে তাকে মুম্বই থেকেও এখানে টেনে আনতে পারি।
এটা আমি বিশ্বাস করি না, ওসমানসাহেব। তুমি জঙ্গলের রাজা হতে পারো। কিন্তু মুম্বইয়ের মতন বড় শহরে তোমার জারিজুরি খাটবে না। মোহন সিংয়ের অনেক দলবল আছে।
তুমি কি ভাবছ, আমি জঙ্গলে থাকি বলে শহরের সঙ্গে আমার যোগাযোগ নেই? অনেক বড় বড় ব্যবসায়ী, পুলিশ অফিসার, মন্ত্রী পর্যন্ত আমায় খাতির করে। আমি ইচ্ছে করলেই মোহন সিংকে নাকে দড়ি দিয়ে টেনে আনতে পারি।
কিন্তু আমি যা দেখেছি, তোমার চেয়ে মোহন সিংয়ের ক্ষমতা অনেক বেশি!
বাঙালিবাবু, আমি তোমার চোখের সামনে এই জঙ্গলে মোহন সিংকে এনে হাজির করালে তুমি বিশ্বাস করবে, কার ক্ষমতা বেশি? খালি কথাই তো বলে যাচ্ছ, মন দিয়ে খেলো!
খেলছি, খেলছি! তবে, মুখে তুমি যতই বড়াই করো, মোহন সিংকে এখানে ধরে আনা তোমার ক্ষমতায় কুলোবে না, আমি জোর দিয়ে বলতে পারি!
ওসমান এবার রেগে গিয়ে বলল, ফের ওই এক কথা? তুমি খেলবে কি না বলো?
এর পর কাকাবাবু কিছুক্ষণ মন দিয়ে খেললেন, আবার হেরে গেলেন। তিনি বললেন, তুমি তো সত্যি বেশ ভাল খেলতে পারো দেখছি?
ওসমানের মুখে জয়ের হাসি ফুটে উঠল। গর্বের সঙ্গে বলল, দাবা খেলায় কেউ আমার সঙ্গে পারে না। আরও খেলার সাহস আছে?
কাকাবাবু বললেন, আর এক দান খেলে দেখি, তোমায় হারাতে পারি কি না!
কিন্তু সে খেলাটা আর হল না। দু-এক দান দিতে-না-দিতেই একজন লোক। ঘোড়া ছুটিয়ে এদিকে চলে এল। এক লাফ দিয়ে ঘোড়া থেকে নেমে ওসমানের কাছে এসে কানে কানে কিছু বলতে লাগল উত্তেজিতভাবে।
ওসমানও চঞ্চল হয়ে দাবার ছক গুটিয়ে ফেলে বলল, চলো বাঙালিবাবু, এ-জায়গা ছেড়ে এক্ষুনি চলে যেতে হবে। একটা বড় পুলিশবাহিনী আসছে, তুমি ঘোড়া চালাতে জানেনা বলেছিলে। ঘোড়ায় চেপে যেতে হবে।
কাকাবাবু বললেন, আমার সঙ্গের ছেলেদুটো? ওসমান বলল, ওদের ব্যবস্থা হবে। চিন্তা কোরো না।
সবাই ছোটাছুটি করে জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে লাগল। ভেঙে ফেলা হল কুঁড়েঘরগুলো।
কাকাবাবু চাপলেন একটা ঘোড়ায়। যতজন লোক তত ঘোড়া নেই, তাই এক ঘোড়ায় দুজন করে যেতে হবে। কাকাবাবুর ঘোড়ায় উঠে পড়ল ভুড়ু।
বনের মধ্যে ছুটল ঘোড়া। কাকাবাবুর পাশে পাশে আরও তিনটি ঘোড়া, তারাই রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে পার হতে হচ্ছে ছোট ছোট নদী, তারপর
পাহাড়ি রাস্তায় এসে ঘোড়ার গতি কমে এল।
ভুড়ু নিজে ঘোড়া চালাতে জানে না। সে সামনে খানিকটা সিঁটিয়ে বসে আছে।
কাকাবাবু এক সময় তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম ভুড়ু কেন?
ভুড়ু বলল, ওটা মোটেই আমার নাম নয়। আমার আসল নাম কাউকে বলি না।
কাকাবাবু বললেন, তোমার ইংরেজি শুনলে মনে হয়, তুমি বেশ লেখাপড়া জানো। তুমি এই ডাকাতের দলে ভিড়লে কেন?
ভুড়ু বলল, ডাকাত কী বলছেন মশাই। বড় বড় ব্যবসাদারদের মতন এরাও ব্যবসা করে। আমি এদের কাছে চাকরি করি।
কাকাবাবু বললেন, কিন্তু তুমি নিশ্চয়ই জানো, এইসব চন্দনগাছ কাটা বেআইনি। এরা মানুষ কেনা-বেচা করে। মানুষ খুনও করে।
ভুড়ু বলল, সেসব আমি কী জানি! আমি নিজের হাতে গাছও কাটি না, মানুষও খুন করি না। আমার কোনও দায় নেই।
বাঃ, বেশ কথা। কিন্তু যখন এরা পুলিশের হাতে ধরা পড়বে, তখন এদের দলের লোক হিসেবে তুমিও শাস্তি পাবে।
এরা কখনও ধরা পড়বে না। কিছু পুলিশকে টাকা খাওয়ানো আছে। তারাই আগে থেকে খবর দিয়ে দেয়।
তা হলে এখন পালাতে হচ্ছে কেন?
মাঝে মাঝে এরকম চোর-পুলিশ খেলা হয়। খবরের কাগজে লেখা হবে যে, পুলিশ কত চেষ্টা করছে ওসমানের দলকে ধরবার!
তবু এরকম দল বেশিদিন টিকতে পারে না। তুমি রবিন হুডের নাম শুনেছ?
শুনব না কেন? সিনেমাও দেখেছি।
রবিন হুডকেও দল ভেঙে দিতে হয়েছিল। তুমি শিক্ষিত লোক হয়ে এই খুনিদের সঙ্গে ভিড়ে আছ, তোমার লজ্জা করে না?
রায়চৌধুরীবাবু, তুমি আমাকে ধমকাচ্ছ? তুমি নিজের প্রাণটা আগে বাঁচাও। এখান থেকে তোমার পালাবার কোনও উপায় নেই। এরা হাসতে হাসতে মানুষ খুন করে। তুমি ভাবছ, ওসমান তোমার সঙ্গে দাবা খেলছে বলে তোমাকে দয়া করছে? মোটেই না। ঠিক দশদিন পর, লোককে দেখাবার জন্য সে এক কোপে তোমার মুণ্ডুটা কেটে ফেলবে। তিনদিন কেটে গেছে, মনে রেখো!
তুমি এর আগে কারও গলা ওইভাবে কাটতে দেখেছ?
হ্যাঁ। দুবার। ওসমানের যা হাতের জোর, এক কোপের বেশি দু কোপ লাগে।
আমার কী ইচ্ছে হচ্ছে জানো? এক ধাক্কা দিয়ে তোমাকে ঘোড়া থেকে ফেলে দিই, তারপর তোমার বুকের ওপর দিয়ে ঘোড়া চালিয়ে দিই।
তাতে কোনও লাভ নেই। অন্য ঘোড়সওয়াররা চাবুক মেরে মেরে তোমাকে তক্ষুনি শেষ করে দেবে।
একটা পাহাড়ের মাঝামাঝি জায়গায় সব ঘোড়া থামল।
এ-পাহাড়ে গাছ বেশি নেই। তবে পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে লুকোবার অনেক জায়গা। ওদের দলের সবাই এখনও এসে পৌঁছয়নি। ওসমানকে দেখা যাচ্ছে না। কাকাবাবু ঘোড়া থেকে নেমে সন্তু আর জোজোর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন।
খানিক পরে ওসমান এল কুলসমকে নিয়ে। সন্তু আর জোজোকে দেখা গেল না। আরও অনেকে আসেনি মনে হল।
তিনি ভুভুকে জিজ্ঞেস করলেন, বাকি লোকরা কোথায় গেল?
ভুড়ু বলল, সবাই একসঙ্গে আসে না। নানাদিকে ছড়িয়ে যায়। একটা দল পুলিশকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য অন্যদিকে নিয়ে যায়। একজন নতুন লোক পুলিশের বড়কর্তা হয়েছে, তাকে এখনও ঘুষ খাওয়ানো যায়নি। কয়েকদিন পরেই ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।
কাকাবাবু ওসমানের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আমার সঙ্গের ছেলেদুটি কোথায় গেল?
ওসমান তার সহচরদের কিছু নির্দেশ দিচ্ছিল, সংক্ষিপ্তভাবে উত্তর দিল, ওদের পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
কাকাবাবু বললেন, পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে মানে? কোথায়? ওসমান বলল, ওরা কালিকট পৌঁছে যাবে। কোনও চিন্তা নেই। কাকাবাবু রেগে গিয়ে বললেন, তার মানে? আমাকে কিছু না জানিয়ে ওদের পাঠিয়ে দিলে কেন?
ওসমান এবার চোখ গরম করে বলল, আমি কী করব না করব, তার জন্য তোমার অনুমতি নিতে হবে নাকি? ছোট ছেলেদের সঙ্গে নিয়ে ঘোরায় অনেক ঝামেলা!
কাকাবাবু বললেন, ওরা মোটেই ছোট নয়!
ওসমান বলল, মোহন সিং তোমাকে বিক্রি করে গেছে। ওই ছেলেদুটি ফাতু। ওদের আমি রাখতে যাব কেন?
কাকাবাবু বললেন, ওরা যদি আবার মোহন সিংয়ের খপ্পরে গিয়ে পড়ে? আমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য মোহন সিং ওদের ওপর অত্যাচার করবে। ওসমান সাহেব, তুমি এটা কী করলে? মোহন সিংকে ধরার ক্ষমতা তোমার নেই, তুমি আমার ছেলেদুটোকে ওর দিকে ঠেলে দিলে?
রাগে চোখ-মুখ লাল করে ওসমান বলল, বাঙালিবাবু, তুমি আমাকে ওই কথা বারবার বলবে না। আমি যা করেছি, বেশ করেছি!
কুলসম কাকাবাবুর কাছে এসে ব্যাকুলভাবে বলল, বাবুজি, আপনার ওই ছেলেদুটোর কোনও ক্ষতি হবে না। ওরা ভালভাবে পৌঁছে যাবে, আপনি বিশ্বাস করুন! আপনাকে ছেড়ে দেওয়ার কথা আমি সর্দারকে বলতে পারি না। সেটা ওদের ব্যবসার ব্যাপার। কিন্তু ওরা তো কোনও দোষ করেনি। এখানে থাকলে ওদের অনেক অসুবিধে হত। আমি কসম খেয়ে বলছি, ওদের নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে দেওয়া হবে।
কাকাবাবু একদৃষ্টিতে কুলসমের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।