সন্ধের পর সত্যিই গরম
সন্ধের পর সত্যিই গরম অনেক কমে গেল।
বৃষ্টি একেবারে থামেনি, মাঝে মাঝেই পড়ছে। আটটা বাজার পর ওঁরা হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়লেন।
অ্যান্টনি জিজ্ঞেস করল, সার, একটা চার্চ দেখতে যাবেন? একটু দূরে একটা ভাল চার্চ আছে।
কাকাবাবু বললেন, চার্চ কাল দেখব। একবার চলো তো বন্দরটা দেখে আসি।
অ্যান্টনি বলল, সেখানে তো দেখার কিছু নেই। এই পোর্টে এখন আর কোনও বড় জাহাজ থামে না। মাছধরার কিছু বোটের জন্য ব্যবহার করা হয়।
কাকাবাবু বললেন, তা জানি। তবু একবার দেখে আসতে চাই।
কালিকট যে এককালে বিখ্যাত বন্দর ছিল, তা এখন দেখে কিছুই বোঝা যায়। কেমন যেন নিষ্প্রাণ অবস্থা। টিম টিম করে আলো জ্বলছে, লোকজন প্রায় দেখাই যায় না। বেশ কিছু নৌকো আর দু-একটা স্টিমার রয়েছে।
কাকাবাবু অন্যমনস্কভাবে বললেন, হু।
তারপর গাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করে বললেন, মাঝরাত্তিরে আর একবার আসতে হবে। ভূতের দেখা না পেলেও অন্য কারও দেখা পাওয়া যেতে পারে। চলো, এখন খেয়ে নেওয়া যাক।
অ্যান্টনি এবার অন্য একটা হোটেলে নিয়ে গেল। সেখানে মাছ-মাংস সবই পাওয়া যায়।
কাকাবাবু বললেন, আগে দেখা যাক, জোজোর জন্য চিংড়ি মাছ।
জোজো বলল, চিংড়ি মাছ আমি একাই ভালবাসি না। সন্তুও ভালবাসে। এখানে কাঁকড়া পাওয়া যায় না?
কাকাবাবু বললেন, মেনুতে তো কাঁকড়া দেখছি না।
সন্তু বলল, কাকাবাবু, এখানে দেখছি, হোটেলের বেয়ারা আর ম্যানেজার, সবাই লুঙ্গি পরে!
জোজো বলল, লুঙ্গিটাই এদের জাতীয় পোশাক।
সন্তু বলল, লক্ষ করেছিস, এখানে কেউ পাঞ্জাবি পরে না। লুঙ্গির ওপর শার্ট।
জোজো বলল, পাঞ্জাবি পরে না?
সন্তু বলল, আমি সারাদিনে একজনও পাজামা পাঞ্জাবি পরা লোক দেখিনি। এখানে বোধ হয় কেউ পাজামা পরে বাইরে বেরোয় না।
জোজো নিজেই সন্ধেবেলা পাজামা আর লাল পাঞ্জাবি পরে বেরিয়েছে। সে অন্য টেবিলের লোকদের দেখে নিয়ে বলল, তাই তো!
বেয়ারা টেবিলে খাবার সাজিয়ে দিচ্ছে, এই সময় কিছু দূরে খুব জোরে দুম দুম করে দুবার শব্দ হল। বোমা কিংবা কামান দাগার মতন।
কাকাবাবু বেয়ারাটিকে জিজ্ঞেস করলেন, ও কীসের শব্দ?
বেয়ারাটি বলল, সিনেমার শুটিং হচ্ছে সার। হিন্দি সিনেমা। দুজন হিরোইন।
সন্তু জোজোর দিকে তাকিয়ে বলল, তোর বদলে অন্য একজনকে পেয়ে গেছে।
জোজো বলল, আমার সিনে তো কামান দাগা ছিল না। এটা অন্য সিন।
অ্যান্টনি অন্য টেবিলে বসে খেয়ে নিয়েছে। কাকাবাবু তাকে বললেন, তুমি আবার সাড়ে এগারোটার সময় এসো। এখন আমরা কিছুক্ষণ হেঁটে বেড়াব।
বৃষ্টি থেমে গেছে, গরমও নেই। খাওয়ার পর খানিকটা হাঁটতে ভালই লাগে।
রাস্তায় লোকজন প্রায় দেখাই যাচ্ছে না। আলোও জোরালো নয়। আকাশ মেঘলা, চাঁদ আছে কি না বোঝার উপায় নেই।
ওঁরা গল্প করতে করতে হাঁটতে লাগলেন। এক জায়গায় পথ একেবারে নির্জন, কাকাবাবুর ক্রাচের খট খট শব্দ ছাড়া আর কোনও শব্দও শোনা যাচ্ছে না।
হঠাৎ দুটো গাড়ি এসে থামল ওঁদের সামনে আর পেছনে। টপাটপ নেমে পড়ল পাঁচ-ছজন লোক, তাদের মুখে কালো রুমাল বাঁধা, হাতে রিভলভার। একজন ইংরেজিতে বলল, হাত তোলো!
কাকাবাবু বললেন, কী ব্যাপার? তোমরা কারা?
লোকটি কোনও উত্তর না দিয়ে এগিয়ে এসে কাকাবাবুর পকেট থাবড়াতে লাগল।
কাকাবাবু নিজের রিভলভার সবসময় সঙ্গে রাখেন। বার করার সময়ই পেলেন না। লোকটি কাকাবাবুর রিভলভারটা নিয়ে বলল, গাড়িতে ওঠো।
অন্য দুজন সন্তু আর জোজোকে ঠেলতে শুরু করেছে।
বাধা দেওয়ার প্রশ্ন নেই। হুড়মুড়িয়ে গাড়িতে উঠতে হল। কাকাবাবুর একটা ক্রাচ পড়ে গেল বাইরে, তিনি বললেন, আরে, আরে, ওটা তুলতে হবে।
সন্তু কোনওরকমে ক্ৰাচটা তুলে নিল। গাড়িটা একটা ভ্যানের মতন। ভেতরটা অন্ধকার। কাকাবাবুদের ভেতরে ঠেলে দিয়ে দুজন রিভলভারধারী বসল দরজার কাছে।
কাকাবাবু বললেন, ব্যাপারটা কী হল বল তো? আমাদের এখানে কোনও শত্রু নেই, কারও কোনও কাজে বাধা দিতেও আসিনি। তবে শুধু শুধু আমাদের ধরে নিয়ে যাবে কেন?
সন্তু বলল, এক হতে পারে। জোজোকে দিয়ে জোর করে সিনেমায় পার্ট করাবে।
জোজো বলল, ইস! হাজার জোর করলেও আমি ওই ছোট পার্ট করব না!
সন্তু বলল, যদি কপালের কাছে রিভলভার ছুঁইয়ে সেটে নিয়ে যায়?
জোজো বলল, ওই অবস্থায় কেউ পার্ট করতে পারে নাকি? মুখ দেখেই তো বোঝা যাবে।
কাকাবাবু পাহারাদারদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ওহে, তোমরা আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? আমাদের কাছে কিন্তু টাকা পয়সা বিশেষ কিছু নেই।
একজন বলল, শাট আপ! গাড়িটা চলল অনেকক্ষণ। আন্দাজে মনে হল এক ঘণ্টার বেশি। তারপর থামল এক জায়গায়।
পেছনের দরজা খুলে একজন হুকুম দিল, নামো!
একটা দোতলা বাড়ি, সামনে বাগান। বাইরে একটা আলো জ্বলছে। ওদের দোতলায় উঠিয়ে একটা ঘরে এনে দরজা বন্ধ করে দেওয়া হল বাইরে থেকে।
সেই ঘরের মেঝেতে দুটো বড় শতরঞ্চি পাতা। খাট বা চেয়ার-টেবিল কিছু নেই। অন্য দিকে আর একটা দরজা, সেটা খুলে দেখা গেল বাথরুম। জানলায় লোহার গরাদ।
সন্তু বলল, সিনেমায় পার্ট করতে গেলে মুখে রং-টং মেখে মেক আপ নিতে হয়। জোজো, এবার বোধ হয় তোকে মেক আপ দিতে নিয়ে যাবে।
জোজো বলল, তোর অত গরজ, তুই ওই পার্ট কর না। আমি তো করবই না বলে দিয়েছি।
বসে থাকতে থাকতে এক সময় তিনজনেরই ঘুম পেয়ে গেল। আর কেউ এল।
জানলা দিয়ে ভোরের আলো এসে ওদের ঘুম ভাঙাল।
বেলা বাড়তে লাগল, তবু কারও দেখা নেই। কোনও সাড়াশব্দও পাওয়া যাচ্ছে।
দুদিকের দুটো জানলা দিয়ে বাগান আর দূরে অসংখ্য নারকোল গাছ দেখা যায়।
জোজো বলল, টুথপেস্ট-টুথব্রাশ নেই, মুখ পোব কী করে?
সন্তু বলল, শুধু জল দিয়ে ধুয়ে নে।
জোজো বলল, সকালবেলা ব্রেকফাস্ট দেবে না?
কাকাবাবু বললেন, আর কিছু না হোক, এক কাপ চা কিংবা কফি বিশেষ দরকার।
সন্তু বলল, জোজো, তোর দিবাস্বপ্নটা সত্যি কি না মিলিয়ে দেখা হল না!
কাকাবাবু বললেন, ঠিক বলেছিস। এতদূর এলাম, ভূতের গল্পটা কতখানি বানানো কিংবা কারা বানিয়েছে, সেটাও জানা গেল না।
ভাল করে রোদুর উঠতেই আবার গরমে গা চিটচিট করতে লাগল। দশটার সময় দরজা খুলল।
দুজন লোকের হাতে রিভলভার, তাদের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে সেই বড় জুলপিওয়ালা লোকটি।
কাকাবাবু বললেন, তা হলে সিনেমাওয়ালাদেরই ব্যাপার! মিস্টার প্রসাদ, আমাদের জোর করে আটকে রাখবার দরকার নেই। সন্তু রাজি হয়েছে, ওকে দিয়ে কাজ চালিয়ে নিন। সন্তু মোটেই তোতলা নয়।
প্রসাদ বলল, শাট আপ!
আর একজন তোক একটা ট্রে-তে করে কিছু পরোটা আর ঢ্যাঁড়স-টম্যাটোর তরকারি রেখে গেল।
জোজো বলল, আমি ঢ্যাঁড়স খাই না। আমার জন্য টোস্ট আর ডিম সেদ্ধ আনতে বলুন।
প্রসাদ বলল, শাট আপ!
কাকাবাবু বললেন, আপনারা সিনেমা কোম্পানির লোক। কাউকে জোর করে রাস্তা থেকে ধরে আনা যে বেআইনি, তা জানেন না?
প্রসাদ একই সুরে আবার বলল, শাট আপ!
কাকাবাবু বললেন, শুধু শাট আপ, শাট আপ বললে চলবে কী করে? কাল তো বেশ নরম সুরে কথা বলছিলেন।
কাকাবাবু দরজার দিকে একটু এগোতেই প্রসাদ হিংস্র গলায় বলল, আর এক পা কাছে এলে আমি গুলি করতে বাধ্য হব!
কাকাবাবু থমকে গেলেন।
তারপর খানিকটা হালকাভাবে বললেন, হঠাৎ কী অপরাধ করলাম আমরা। যে-জন্য এত খারাপ ব্যবহার? মশাই, একটা কিছু কারণ জানাবেন তো!
প্রসাদ কোনও উত্তর না দিয়ে দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিল।
কাকাবাবু দু কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, অদ্ভুত! কারও সঙ্গে শত্রুতা হয়, তা হলেও বুঝি! আমরা তো কিছুই করিনি।
সন্তু একটা পরোটা তুলে নিয়ে বলল, নে জোজো, খেতে শুরু কর।
জোজো বলল, বললাম না, আমি ঢ্যাঁড়স খাই না!
সন্তু বলল, তুই যে সিনেমা স্টারের মতন হুকুম করলি, তোকে টোস্ট আর ডিম দিতে হবে। আমরা তো বন্দি, যা দেয় তাই খেতে হবে।
জোজো বলল, ওসব বাজে জিনিস আমি খাব না।
সন্তু বলল, দ্যাখ, আমরা এইরকমভাবে আরও অনেক জায়গায় বন্দি হয়েছি। এই অবস্থায় যা খাবার পাওয়া যায়, তাই খেয়ে নিতে হয়। পরে যদি আর কিছুই না দেয়?
কাকাবাবুও খেতে শুরু করেছেন।
সন্তু একটা পরোটার মধ্যে খানিকটা তরকারি দিয়ে রোল বানিয়ে জোজোকে বলল, নে, একটু খেয়ে দ্যাখ।
জোজো একটা কামড় দিয়ে মুখ বিকৃত করে বলল, এঃ! একে তো ঢ্যাঁড়স, তাতে আবার নুন বেশি!
তারপর অবশ্য সে পর পর তিনটে পরোটা খেয়ে ফেলল।
সন্তু বলল, দিব্যি তো খেয়ে নিলি দেখছি। জোজো গম্ভীরভাবে বলল, খিদে পেলে বাঘেও ঘাস খায়।
সন্তু বলল, তোকে বাঘের মতনই দেখাচ্ছে বটে। জোজো কাকাবাবুর দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, আমরা কতক্ষণ এইভাবে বন্দি থাকব?
কাকাবাবু গোঁফ পাকাতে পাকাতে বললেন, কিছুতেই বুঝতে পারছি না, এরা আমাদের ধরে এনেছে কেন? তোমরা সিনেমায় পার্ট করতে রাজি হওনি বলে জোর করে গুম করবে, এ কখনও হয়? ব্যাপারটা এখনও আমার কাছে ধাঁধা মনে হচ্ছে।
সন্তু বলল, সিনেমায় পার্ট করার ব্যাপারটাই বোধহয় বাজে কথা। প্রথমে ওই লোভ দেখিয়ে আমাদের ধরে নিয়ে যেতে চাইছিল।
কাকাবাবু বললেন, তা হতে পারে। কিন্তু আমাদের ধরে এনে ওদের কী লাভ? ওই প্রসাদ নামের লোকটিকে আগে কখনও দেখিনি। আমরা ওর কোনও ক্ষতিও করিনি।
জোজো বলল, কাকাবাবু একটা কিছু করুন। আমার এখানে থাকতে একটুও ভাল লাগছে না।
কাকাবাবু বললেন, কী করা যায় বলো তো? লোকটা তো কোনও কথারই উত্তর দিচ্ছে না। রিভলভার তুলে ভয় দেখাচ্ছে।
জোজো বলল, ওই রিভলভারটা ফল্স। সিনেমার লোকদের কাছে আসল রিভলভার থাকে নাকি? খেলনা পিস্তল থাকে।
সন্তু বলল, যদি এরা সিনেমার লোক না হয়? আমার কিন্তু রিভলভারটা দেখে আসলই মনে হল।
জোজো বলল, একটা কাজ করতে হবে। এর পর যখন লোকটা আসবে, সন্তু তুই আর আমি দরজার দুপাশে লুকিয়ে থাকব। কাকাবাবু কথায় কথায় ভুলিয়ে লোকটাকে ঘরের মধ্যে নিয়ে আসবেন, আমরা দুজনে দুদিক থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর হাত থেকে রিভলভারটা কেড়ে নেব!
কাকাবাবু বললেন, অনেক গল্পের বইয়ে এরকম থাকে। অনেক সিনেমাতেও দেখা যায়। এরা কি সেইসব সিনেমা দেখে না?
জোজো বলল, আপনি কথা বলে বলে লোকটাকে ভুলিয়ে দেবেন। তারপর আমরা ঠিক ওকে ঘায়েল করে ফেলব।
কাকাবাবু বললেন, ঠিক আছে, আমি আমার পার্ট যতদূর সম্ভব ভাল করার চেষ্টা করব। আসুক লোকটা।
এর পর ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে গেল, আর কারও দেখা নেই। কোনও সাড়াশব্দও পাওয়া যাচ্ছে না। জানলা দিয়ে তাকিয়ে থেকেও একটা লোককেও দেখা যায় না।
জোজো কয়েকবার দরজার ওপর দুম দুম করে ধাক্কা দিল, তাতেও এল না কেউ।
সন্তু বলল, জোজো অন্ত্যাক্ষরী খেলবি? গানের লাইনের শেষ কথাটা দিয়ে—
জোজো বলল, ধ্যাত, কিছু ভাল লাগছে না।
কাকাবাবু বললেন, মেজাজ খারাপ না করে অন্যদিকে মন ফেরানোই ভাল, আমি বেশি গান জানি না। অন্য খেলা করা যাক, সময় কাটাবার জন্য। কে এটা দশবার ঠিক ঠিক বলতে পারবে? জলে চুন তাজা, তেলে চুল তাজা।
জোজো প্রথমেই বলল, কী বলতে হবে? জলে চুল তাজা, তেলে চুন তাজা?
কাকাবাবু বললেন, না, ঠিক এর উলটো।
সন্তু আর জোজো দুজনেই চেষ্টা করল বলতে। পর পর দশবার তাড়াতাড়ি ঠিক বলা মোটেই সহজ নয়। নানারকম মজার মজার ভুল হয়। জোজো একবার বলল, জলে তুন তাজা তেলে চুল চাজা!
কাকাবাবুই জিতলেন এ খেলায়। তারপর বললেন, ইংরেজিতে একটা আছে, সেটা চেষ্টা করে দ্যাখো। She sells sea-shells on the sea-shore. এটাও, তাড়াতাড়ি বলতে হবে দশবার। শি সেক্স সি-সেল অন দ্য সি-শোর।
দু-তিনবার বলতে বলতেই দরজাটা খোলার শব্দ হল। সঙ্গে সঙ্গে জোজো আর সন্তু তড়াক করে লাফিয়ে উঠে দরজার দুপাশে গিয়ে লুকোল।
এবারেও রিভলভার হাতে প্রসাদ, দুজন গাঁট্টাগোট্টা লোক।
কাকাবাবু কিছু বলার আগেই প্রসাদ বলল,ছেলেদুটো গেল কোথায়? দরজার পাশে লুকিয়েছে? সামনে আসতে বলুন। বেশি চালাকি করলে কিন্তু আমি সত্যি সত্যি গুলি চালাব!
কাকাবাবু হেসে ফেলে সন্তু আর জোজোর দিকে তাকিয়ে বললেন, ওরে আয় রে, আমাদের জন্য খাবার এনেছে।
একজন লোক দুটো প্লেট নামিয়ে রাখল। একটাতে একগোছা রুটি, আর একটাতে সেই সকালবেলারই মতন তরকারি।
জোজো আর্তনাদ করে উঠল, আবার ঢ্যাঁড়স! এ দেশে কি আর কিছু পাওয়া যায় না?
প্রসাদ বলল, শাট আপ!
কাকাবাবু বললেন, ওগো শাট আপ বাবু, একটু খাবার জলও কি পাওয়া যাবে না?
প্রসাদ বলল, বাথরুমের কলে জল আছে। সেই জল খাবে। দরজা বন্ধ হয়ে গেল আবার।
জোজো বলল, আমি খাব না। খাব না, খাব না, কিছুতেই আর ঢ্যাঁড়স খাব।
সন্তু বলল, খিদে পেলে বাঘ ঢ্যাঁড়স খায়!
জোজো বলল, কলের জল খেলে আমার পেট খারাপ হবে।
সন্তু বলল, তেষ্টা পেলে বাঘে কাদাজলও খায়।
জোজো বলল, তুই বারবার বাঘ বাঘ করবি না তো?
সন্তু বলল, তুই-ই তো প্রথমে বলেছিস।
জোজো রাগ করে বলল, তুই ফ্যাক ফ্যাক করে হাসছিস? আমরা এখানে দিনের পর দিন বন্দি হয়ে থাকব?
কাকাবাবু বললেন, এরা দিনের পর দিন আমাদের রুটি-তরকারি খাইয়ে আটকে রাখবে, এরকম মনে হয় না। একটা কিছু ঘটবেই।
জোজো বলল, কাকাবাবু, আপনি তো হিপনোটিজম জানেন। হিপনোটাইজ করে ওই জুলপিওয়ালাটাকে ঘুম পাড়িয়ে রিভলভারটা কেড়ে নিতে পারেন না?
কাকাবাবু বললেন, তা হয়তো পারা যায়। কিন্তু মুশকিল কী জানো, আমি যাঁর কাছে ওই বিদ্যেটা শিখেছি তাঁর কাছে প্রতিজ্ঞা করা আছে, আমি নিজে থেকে আগে কারও ওপর ওটা প্রয়োগ করব না! কেউ আমাকে হিপনোটাইজ করার চেষ্টা করলে তবেই আমি-
জোজো বলল, বাঃ, নিজের প্রাণ বাঁচাবার জন্য ওই প্রতিজ্ঞা ভাঙা যায় না? বিপদে পড়লে মানুষ সব কিছু করতে পারে।
কাকাবাবু বললেন, প্রতিজ্ঞা ভাঙলেও এখানে বিশেষ কিছু সুবিধে হবে না। ওরা তিনজন ছিল। একসঙ্গে তিনজন লোকের দিকে তাকিয়ে হাত ঘুরিয়ে অজ্ঞান করে দেওয়া সম্ভব নয়। ওটা গাঁজাখুরি ব্যাপার। একজন-একজন করে করতে হয়, তাও সময় লাগে। প্রসাদের সঙ্গের একটা লোকের হাতে লোহার ডাণ্ডা ছিল। আমি প্রসাদকে হিপনোটাইজ করতে গেলে ওই লোকটা যদি ডাণ্ডা দিয়ে আমার মাথায় মারত, তা হলেই আমার সব জারিজুরি ভেঙে যেত।
জোজো অসহায় ভাবে বলল, তা হলে কি কোনওই উপায় বার করা যাবে না?
সন্তু বলল, আয়, আগে খেয়ে নিই। তারপর একটু ঘুমোই। তারপর বুদ্ধি খেলাতে হবে। দরজার পাশে লুকিয়ে থাকার বুদ্ধিটা তো খাটল না।
এক ঘণ্টা পরে আবার দরজা খুলে গেল।
এবারেও প্রসাদ, আর তার সঙ্গে দুজন লোক। তীক্ষ্ণ নজরে সারা ঘরটা দেখে নিয়ে সে কাকাবাবুকে বলল, তুমি বেরিয়ে এসো। শুধু তুমি। ছেলেদুটো এখানেই থাকবে।
কাকাবাবু বললেন, যাক বাঁচা গেল। বন্ধ ঘরে বসে থেকে থেকে দম আটকে আসছিল। চলো, কোথায় যেতে হবে?
কাকাবাবু বেরিয়ে এলেন। আবার বন্ধ হয়ে গেল দরজা।