Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » কাকাবাবু ও এক ছদ্মবেশী || Sunil Gangopadhyay » Page 3

কাকাবাবু ও এক ছদ্মবেশী || Sunil Gangopadhyay

বিয়াস নদীর ওপর এখানে কয়েকটা সেতু আছে। নদীর দু দিকেই শহর। অনেক হোটেল হয়েছে।

বাংলোর টিলাটা থেকে নেমে, নদী পার হয়ে যেতে হল উলটোদিকে। শহর ছাড়িয়ে ফাঁকা জায়গায় আর-একটা টিলার ওপর সেই মন্দির। খুবই ছোট মন্দির, শুধু পাথরের দেওয়াল, রং-টংও করা নেই। মন্দিরের সামনে অনেকখানি ফাঁকা জায়গা, সেইখান থেকে ধাপে ধাপে সিঁড়ি উঠে গেছে মন্দিরের দরজা পর্যন্ত।

গাড়িটা এসে সেই ফাঁকা জায়গাটায় থামল।

দুজন লোক সিঁড়ির ওপর বসে বিড়ি টানছিল, তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে কাকাবাবুদের দিকে চেয়ে রইল তীক্ষ্ণ চোখে। গাড়ির ড্রাইভার এগিয়ে গেল আগে আগে। সে লোকদুটির সঙ্গে কথা বলে সব বোঝাতে লাগল।

কাকাবাবু বললেন, সন্তু, তুই আর জোজো আগে উঠে যা। আমার তো সিঁড়ি দিয়ে উঠতে সময় লাগবে।

সন্তু বলল, আমরাও আস্তে-আস্তে উঠছি তোমার সঙ্গে।

কাকাবাবু বললেন, না, আমার পাশে থাকতে হবে না। তোরা এগিয়ে যা। পাহারাদারদের একজন সন্তুদের নিয়ে গেল ওপরে, আর একজন রইল কাকাবাবুর সঙ্গে।

উঁচু উঁচু সিঁড়ি, ক্রাচ নিয়ে উঠতে কাকাবাবুর অসুবিধে হচ্ছে। পেছনে যাতে না যায় সেজন্য তিনি সাবধানে ক্রাচ ফেলছেন। পাহারাদারটি তাঁর হাত ধরতে এলে তিনি হিন্দিতে বললেন, আমাকে সাহায্য করতে হবে না। আমি নিজেই উঠতে পারব। আরও তো অনেক লোক মন্দির দেখতে আসতে পারে, তাদের আপনারা আটকাচ্ছেন কী করে?

পাহারাদারটি বলল, আটকাচ্ছি না। মন্দিরের বাইরের দরজায় তালা দেওয়া আছে। তাই দেখে লোকেরা এসেও ফিরে যাচ্ছে।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, এই মন্দিরে তো অন্য দেবতাও আছে, তাই না? সেই দেবতার পুজো হয় না? এখানকার স্থানীয় লোক যারা এই মন্দিরে পুজো করে, তারা আসে না?

পাহারাদার বলল, এ মন্দিরে শুধু শনি আর মঙ্গলবার পুজো হয়, অন্যদিন কেউ সাধারণত আসে না। পরশু শনিবার।

আশপাশের গ্রাম থেকে কত দেবতার মূর্তি এসেছে?

তিনশোর বেশি। বড় বড় মন্দিরগুলোতে একসঙ্গে অনেক দেবতা রাখা হয়। এই মন্দিরে শুধু একটিই ছিল। ভূতেশ্বর দেবতা।

এর আগে কখনও দেবতা চুরি গেছে?

কোনওদিন শুনিনি।

এই ভূতেশ্বর দেবতা কখন থেকে পাওয়া যাচ্ছে না?

কাল দুপুর থেকে। তার আগেও হতে পারে। দেবতা পৌঁছেছেন আগের রাতে। যে দুজন পুরুত সঙ্গে থাকে, তারা ভাঙ খেয়ে অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়েছে। রাত্তিরে দেবতার যাতে শীত না লাগে তাই গায়ে একটা কম্বল চাপা দেওয়া থাকে। সকালে ওরা কম্বল তুলে দেখেনি। দুপুরে ওরা কম্বল সরিয়ে দেবতাকে খাবার দিতে গিয়ে দেখে, সেখানে দেবতা নেই। রয়েছে একটা পাথর।

তারপর কী হল?

প্রথমে ওরা বোঝেনি যে, দেবতা চুরি গেছে। ওরা ভেবেছিল, দেবতা ইচ্ছে করে পাথরের রূপ ধরেছেন। সেই পাথরকেই পুজো করতে লাগল। খাবার দিল। তারপর ওদের একজন এই মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করতে লাগল, সব লোগ শুনো, শুনো, ভূতেশ্বর দেওতা পাথর বয়া। এদের এমনই বিশ্বাস, এরা ভাবতেই পারে না যে, দেবতা চুরি হতে পারে। তাই ভেবেছে, এটা দেবতারই লীলা।

তার মানে অনেক লোক জেনে গেছে?

খুব বেশি লোক জানেনি। দুপুরে বেশি লোক তো থাকে না। দু-চারজন শুনে সেই পাথর দেখেও গেছে। তারা খুব অবাক হয়নি। পাথরও তো দেবতা হয়। খবরটা খুব তাড়াতাড়ি থানায় পৌঁছে যায়। থানার বড়বাবু সঙ্গে-সঙ্গে এখানে চলে এসে ব্যাপারটা বুঝতে পারেন। তিনি পুরুত দুজনকে আর বেরুতে দেননি। তাদের সঙ্গে এক ঘণ্টা সময় কাটান। তাদের বোঝান যে, দেবতা ইচ্ছে করে পাথর হয়েছেন। আবার শিবরাত্রির মেলায় আগে নিজের রূপ ধরবেন। এরকম দেখাও একটা পুণ্যের কাজ। সেই উপলক্ষে অনেক খাবারদাবার আনালেন, পুরুতদের সঙ্গে নিজেও খেলেন। শুধু পুরুতদের শরবতে খুব কড়া ঘুমের ওষুধ মেশানো ছিল। তারা এখনও জাগেনি।

থানার বড়সাহেব খুব বুদ্ধির কাজ করেছেন তো! এখন শেষ রক্ষা হলে হয়!

আপনি সার কোথা থেকে আসছেন? আপনি কি সেই মূর্তি উদ্ধার করতে পারবেন?

কাকাবাবু এবার হেসে ফেলে বললেন, চোর ধরার কোনও মন্ত্র আমি জানি। আপনাদের বড়সাহেব জোর করে আমাকে ধরে এনেছেন। দেখা যাক, কী করা যায়!

মন্দিরটার বাইরে একটা দেওয়াল, তার মাঝে-মাঝে ভাঙা। ভেতরে খানিকটা চত্বর। মন্দিরের সামনে একটা চৌকো রক, তাতে পাশাপাশি শুয়ে ঘুমোচ্ছে দুই পুরোহিত। নাক ডাকার পাল্লা দিচ্ছে।

ভেতরটা খুবই ছোট, অন্ধকার মতন। মাঝখানে একটা শিবলিঙ্গ। সেটাই এই মন্দিরের দেবতা। তার পাশে একটা বেশ বড় পাথর, এবড়োখেবড়ো মতন, কোনওরকম মূর্তি বানাবার চেষ্টাই নেই। দেখলেই মনে হয়, পাহাড়ের গা থেকে কুড়িয়ে আনা। ভূতেশ্বরের মূর্তির বদলে চোরেরা ওই পাথরটা রেখে গেছে।

কাকাবাবু ভেতরে এসে পাথরটা একবার শুধু ঠেলা দিয়ে দেখলেন। আর কিছুই দেখার নেই।

সন্তু আর জোজো তখন মন্দিরটার পেছনদিকে এসে শহরের দিকে তাকিয়ে আছে। এখান থেকে বিয়াস নদী অনেক নীচে, রাস্তা দিয়ে বাস আর ট্রাক যাচ্ছে, খেলনার মতন মনে হয়।

কাছে এসে কাকাবাবু বললেন, বেশ মজার ব্যাপার, তাই না? যে দুজন পুরুত ভূতেশ্বরের মূর্তিটার সঙ্গে ছিল, তারা এমন ঘুমোচ্ছে যে, সন্ধের আগে জাগবেনা। তাদের কোনও কথা জিজ্ঞেস করার উপায় নেই। ভূতেশ্বরের মূর্তিটা আমরা দেখিনি, এরাও কেউ ঠিক ঠিক বর্ণনা দিতে পারছে না। তা হলে সে মূর্তি আমরা খুঁজে বের করব কী করে, কিংবা চোরদেরই বা ধরার উপায় কী?

জোজো বলল, আমি লক্ষ করে দেখেছি, কারও পায়ের ছাপও নেই। পাথুরে জায়গা তো!

কাকাবাবু বললেন, পুরুতরা আসে, পুলিশের লোক এসেছে, আরও অন্য লোক এসেছে। পায়ের ছাপ থাকলেই বা কী হত?

জোজো বলল, ইস, কম্পাসটা যদি নিয়ে আসতুম, কোনও সমস্যাই ছিল না।

সন্তু বলল, কম্পাস? কম্পাস দিয়ে কী হত?

জোজো বলল, গ্রিসের একজন বিশপ বাবাকে একটা অদ্ভুত ধরনের কম্পাস উপহার দিয়েছেন। সেটা হাতে থাকলে কী হয় জানিস? কম্পাসটা যদি ওই পাথরটার গায়ে একবার ছোঁয়াতুম, তা হলেই কম্পাসটা কাঁটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়ে দিত, যে পাথরটা এনেছে, সে এখন কোথায় আছে। একবার গ্যাংটকে আমাদের হোটেলের ঘর থেকে বাবার একটা ঘড়ি চুরি গেল। সেই ঘড়িটা দিয়েছিলেন জাপানের সম্রাট, তাই বাবার খুব প্রিয়। আরও কিছু টাকাপয়সা, জিনিসপত্র চুরি গিয়েছিল, কিন্তু ঘড়িটাই আসল। চোরটা ঘরের শুধু একটা পোড়া দেশলাইকাঠি ফেলে গিয়েছিল। সেই আধখানা কাঠি ছোঁয়ানো হল কম্পাসটাতে। অমনি সেটা টিক টিক শব্দ করে উঠল। তারপর সেটা নিয়ে এগোতে হয়, ভুল দিকে গেলেই শব্দটা থেমে যায়। শব্দটা শুনতে শুনতে রাস্তা দিয়ে হেঁটে আমি চলে এলাম বাসডিপোতে। সেখানে পাঁচখানা বাস দাঁড়িয়ে। এক-একটা বাসের সামনে গিয়ে দাঁড়াই, অমনই আওয়াজটা থেমে যায়। তাতে একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলুম, এর পর কী করব! চতুর্থ বাসটার দরজার কাছে আসতেই টিক টিক শব্দটা খুব জোর হয়ে গেল। তারপর যা হল। তুই হয়তো শুনলে বিশ্বাস করবি না, কিন্তু একেবারে খাঁটি সত্যি কথা। বাসে তিন-চারজন লোক মোটে বসে ছিল। আমি উঠতেই কোণ থেকে একজন লোক হাউমাউ করে বলে উঠল, আমি ঘড়ি দিয়ে দিচ্ছি, সব দিয়ে দিচ্ছি, আমাকে দয়া করে পুলিশে ধরিয়ে দেবেন না!

সন্তু অম্লান মুখে বলল, বিশ্বাস করব না কেন? পুরোটা বিশ্বাস করেছি।

কাকাবাবু বললেন, সেই জাদুকম্পাস থাকলে তো সব ঝামেলাই মিটে যেত বুঝতে পারছি। সেটা যখন নেই, তখন এ চোরদের ধরার কোনও উপায় তোমরা বলতে পারো? আমার বুদ্ধিতে কুলোবে না বুঝতে পারছি!

সন্তু জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, তুমি চোরদের বলছ কেন? একটা চোরও তো হতে পারে?

কাকাবাবু বললেন, এই ধরনের চুরির পেছনে সাধারণত একটা দল থাকে। তা ছাড়া, ওই পাথরটা আমি নেড়েচেড়ে দেখেছি, একজন লোকের পক্ষে ওটা বয়ে

আনা সম্ভব নয়।

জোজো ফস করে জিজ্ঞেস করল, দুপুরে আমরা কী খাব?

সন্তু ভুরু তুলে বলল, হঠাৎ খাবার কথা? এর মধ্যে তোর খিদে পেয়ে গেল?

জোজো বলল, খিদে পাবে না? দুপুর আড়াইটে বাজে। না খেয়েদেয়ে আমরা চোরের পেছনে ছুটতে যাব কেন?

কাকাবাবু বললেন, তা অবশ্য ঠিক। এখানে অপেক্ষা করেও কোনও লাভ নেই। সন্ধেবেলা পুরুত দুজন জেগে উঠলে ওদের কাছ থেকে কিছু জানার চেষ্টা করা যেতে পারে।

জোজো বলল, তার মধ্যে নরেন্দ্র ভার্মা এসে পড়বেন। তাঁকে বুঝিয়ে বলুন। চোর ধরার মতন সামান্য কাজ আপনাকে মানাবে না।

কাকাবাবু বললেন, চলো, বাংলোতে ফেরা যাক।

ফেরার পথে অন্য একটা সেতুর কাছে এসে গাড়িটা থেমে গেল। এই সেতুটা পুরনো। একসঙ্গে দুদিকের গাড়ি যেতে পারে না। দুদিকে পুলিশ দাঁড়িয়ে থাকে, তারা এক-একবার এক একদিকের গাড়ি ছাড়ে।

উলটোদিক থেকে একটা গাড়ি আসছে, তাতে ড্রাইভার ছাড়া আর কোনও লোক নেই। ড্রাইভারটির দিকে তাকিয়ে কাকাবাবুর ভুরু কুঁচকে গেল। তিনি সন্তদের জিজ্ঞেস করলেন, তোরা এই লোকটিকে চিনিস?

এখানকার স্থানীয় লোকদের মতন লোকটির মাথায় সাদা রঙের মস্ত পাগড়ি। মুখভর্তি দাড়ি-গোঁফ, বেশ শক্তসমর্থ চেহারা, ডান হাতে একটা লোহার বালা।

সন্তু বলল, না, একে কখনও দেখেছি বলে তো মনে হয় না!

কাকাবাবু বললেন, আমার যেন মনে হচ্ছে, কোথাও একে দেখেছি আগে।

জোজো বলল, মনে হচ্ছে, মোহন সিং-এর কোনও চ্যালা। কালিকটে যখন আমাদের আটকে রেখেছিল, তখন এই লোকটাই খাবার দিতে আসত না?

সন্তু বলল, যাঃ, সে-লোকটার তো মাথায় টাক ছিল। মুখে দাড়ি-গোঁফও ছিল না।

জোজো বলল, এক বছরে দাড়ি-গোঁফ গজানো যায়। টাকও ঢাকা যায় পরচুলা দিয়ে।

সন্তু বলল, এক বছরে কি বেঁটে মানুষকে লম্বা করা যায়? সেই লোকটা ডেফিনিটলি এর চেয়ে বেঁটে ছিল।

জোজো বলল, হ্যাঁ, লম্বা হওয়াও যায়। আমার বাবার কাছে তিব্বতি ওষুধ আছে। তিব্বতের লোকরা সবাই কীরকম লম্বা হয় দেখিসনি? বাবা সেই ওষুধ

অবশ্য যাকে তাকে দেন না।

সন্তু বলল, তা হলে তুই সেই ওষুধ খেয়ে লম্বা হচ্ছিস না কেন?

জোজো বলল, আমার একুশ বছর বয়েস হোক, দেখবি আমি তোর চেয়ে অন্তত ছ সেন্টিমিটার বেশি লম্বা হয়ে গেছি।

কাকাবাবু চিন্তিত মুখে বসে রইলেন চুপ করে।

বাংলোতে এখন আর কোনও পুলিশ নেই। একজন চৌকিদারকে দেখে জোজো চেঁচিয়ে বলল, খানা দিজিয়ে জলদি! বহুৎ ভুখ লাগ গিয়া।

কাকাবাবু বললেন, আমি স্নানটা সেরে আসি চট করে। তোমরা স্নান করবে না? দুটো বাথরুম আছে।

জোজো বলল, আকাশে মেঘ জমেছে। মেঘলা দিনে স্নান করলে আমার গলায় ব্যথা হয়।

কাকাবাবু বললেন, গরম জল তো পেতে পারো।

জোজো বলল, গরম জলে স্নান করতে হয় ভোরবেলা। দুপুরবেলা আমার ঠিক সহ্য হয় না।

কাকাবাবু স্নান সেরে এসে দেখলেন, সন্তুর তখনও হয়নি, জোজো একলাই খাবার টেবিলে বসে আছে। টেবিলে তিনটে প্লেট ও জলের গেলাস সাজানো, খাবার তখনও দেয়নি। শুধু একটা প্লেট-ভর্তি স্যালাড। জোজো তার থেকেই পেঁয়াজ আর শসা খেতে শুরু করেছে। বেচারির খুবই খিদে পেয়েছে বোঝা যাচ্ছে।

একজন পরিচারক এসে কাকাবাবুকে জিজ্ঞেস করল, সার, আপনারা কি ঝিঙে-পোস্ত খান? আপনাদের জন্য রান্না করেছি। ঝিঙে এখানে সহজে পাওয়া যায় না।

লোকটির মুখে বাংলা কথা শুনে কাকাবাবু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি বাঙালি নাকি?

লোকটি বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ সার, আমার নাম নৃপেন হালদার।

কাকাবাবু বললেন, আপনার বাড়ি এখানেই?

নৃপেন বলল, না সার, আমার বাড়ি হুগলি জেলায়। চাকরিবাকরি পাইনি, তাই ঘুরতে ঘুরতে এখানে চলে এসেছি। আমি এই বাংলোর ইনচার্জ, রান্নাও করি।

কাকাবাবু বললেন, বাঃ, বাঙালির ছেলে এতদূরে এসে চাকরি করছেন, এ তো বেশ ভাল কথা। তা এখানে আপনার ভাল লাগছে তো?

নৃপেন বলল, এমনিতে তো সবই ভাল। লোজনেরাও ভাল, তবে কী জানেন সার। দিনের পর দিন বাংলায় কথা না বলতে পারলে বুকটা যেন শুকিয়ে যায়!

কাকাবাবু বললেন, এখানে আর বাঙালি নেই বুঝি?

নৃপেন বলল, শুনেছি, আছে আরও পাঁচ-ছ জন। দেখা তো হয় না। এখানকার কমিশনার সাহেবই তো বাঙালি, মিস্টার সুদৃপ্ত রায়, মস্ত বড় অফিসার, তিনি অবশ্য এখন এখানে নেই, দিল্লিতে কী কাজে গেছেন শুনেছি।

জোজো অধৈর্য হয়ে বলল, আমরা ঝিঙে-পোস্ত খাই, সব খাই। ভাত-রুটি কী আছে আগে আনুন তো!

নৃপেন টেবিলের ওপর খাবার সাজিয়ে দিল। অনেকরকম খাবার। ভাত-রুটি, ডাল, ঝিঙে-পোস্ত, মাছভাজা, মুরগির ঝোল।

সন্তু এর মধ্যে এসে যোগ দিয়েছে।

নৃপেন দাঁড়িয়ে আছে একপাশে। কাকাবাবু খেতে খেতে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, এখানে চুরি-ডাকাতি কেমন হয়?

নৃপেন বলল, না সার, চুরি-ডাকাতি খুবই কম। খুব শান্ত জায়গা।

কাকাবাবু বললেন, বাঃ, আমাদের দেশে এরকম জায়গা তো কমই আছে। এখানে শিবরাত্রির দিন খুব বড় মেলা হয়, তাই না? দেবতাদের মিছিল হয়। আপনি দেখতে যাবেন নিশ্চয়ই?

নৃপেন বলল, তা তো যাবই। সার, আমি সবুজ দ্বীপের রাজা সিনেমাটা দেখেছি। যখনই শুনলাম, এখানে রাজা রায়চৌধুরী আসছেন, তখনই বুঝেছি, আপনিই কাকাবাবু। এখানে কি কোনও রহস্য সমাধানে এসেছেন?

কাকাবাবু বললেন, না, না। শিবরাত্রির মিছিল দেখতে এসেছি।

নৃপেন জিজ্ঞেস করল, এই দুজনের মধ্যে সন্তু?

সন্তু মুখ নিচু করে জোজোর দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ওই যে ও!

জোজো সঙ্গে-সঙ্গে বলল, আমি নয়, ও!

কাকাবাবু নৃপেনকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি বুঝি জোজোর কথা শোনোনি? সন্তুর বন্ধু।

নৃপেন আর কিছু বলার আগেই একটা গাড়ির আওয়াজ পাওয়া গেল। সবাই তাকাল সেদিকে।

গাড়ি থেকে নামলেন নরেন্দ্র ভার্মা। লম্বা, ছিপছিপে চেহারা, সুট-টাই পরা। চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমাটা নতুন।

ধপ ধপ করে জুতোর শব্দ তুলে সরাসরি খাওয়ার ঘরে চলে এসে তিনি বললেন, ইস, সব খেয়ে ফেললে? আমার জন্য কিছু রাখোনি?

কাকাবাবু বললেন, অনেক আছে, এসো, বসে পড়ো নরেন্দ্র!

নরেন্দ্র বললেন, না, আমার খুব খিদে পেয়েছিল, রাস্তায় একটা পাঞ্জাবি ধাবাতে খেয়ে নিয়েছি। অনেকটা পথ গাড়িতে আসতে হয়েছে।

তারপর জোজো-সন্তুর দিকে তাকিয়ে বললেন, হ্যালো, ইয়াং ডেভিল্স, তোমরা কেমন আছ? জোজো, নতুন নতুন গল্প জমেছে?

জোজো বলল, অনেক! নৃপেন জিজ্ঞেস করল, সার, দই খাবেন তো? আর মিষ্টিও আছে।

কাকাবাবু বললেন, নাঃ, দই-মিষ্টি আর এখন খাব না। গুরুভোজন হয়ে গেছে। জোজো যদি ইচ্ছে করে তো খেতে পারে।

জোজো বলল, দই খাব না, মিষ্টি টেস্ট করে দেখতে পারি। নরেন্দ্র বললেন, এই লোকটি কি বাঙালি নাকি? এখানেও একজন বাঙালি জুটিয়েছ?

কাকাবাবু হেসে বললেন, বাঙালি কোথায় নেই! সারা ভারতের সব জায়গায় ছড়িয়ে আছে।

জোজো বলল, তেনজিং আর হিলারি যখন প্রথম এভারেস্টের চূড়ায় ওঠে, তখন দেখে যে, আগে থেকেই সেখানে কয়েকজন বাঙালি বসে বসে আড্ডা দিচ্ছে।

নরেন্দ্র বললেন, ইতিহাসে এই কথাটা লিখতে ভুলে গেছে, তাই না? চলো, হাত ধুয়ে নাও। আমরা অন্য ঘরে বসে কথা বলব।

সবাই মিলে বসা হল কাকাবাবুর ঘরে। নরেন্দ্র দরজাটা বন্ধ করে দিলেন।

কাকাবাবু এবার মেজাজের সঙ্গে বললেন, কী ব্যাপার বলো তো নরেন্দ্র? আমাকে কি একটু শান্তিতে থাকতে দেবে না? দিব্যি ছিলাম কসোল নামে একটা ছোট্ট জায়গায়, সেখান থেকে আমাদের ধরে আনাল? এখানে এসেই বা আমরা কী করব? চোর ধরা কি আমাদের কাজ? পুলিশগুলো সব অপদার্থ?

নরেন্দ্র মিটিমিটি হেসে শান্তভাবে বললেন, তুমি এলে কেন? ওদের না বলে দিলেই পারতে।

কাকাবাবু বললেন, আসতে চাইনি, ওদের অনেকবার না বলেছিলাম। তারপর তোমার নাম করে অনুরোধ জানাল। তোমার নাম শুনে তো আর ঠেলতে পারি না।

নরেন্দ্র এবার হাসিটা সারা মুখে ছড়িয়ে বললেন, জানতাম। আমার নাম শুনে তুমি আসবেই। তুমি বাই চান্স কাছাকাছি রয়েছ, অথচ তোমার সাহায্য পাব না, এ কখনও হয়?

কিন্তু এখানে চুরির ব্যাপারে আমি কী সাহায্য করব?

বুঝতেই পারছ, এটা সাধারণ চুরি নয়। দেবতার মূর্তি চুরি। কালকের মধ্যে মূর্তিটা উদ্ধার করতে না পারলে দারুণ গোলমাল হবে। দাঙ্গা লেগে যেতে পারে। এর মধ্যে জানাজানি হলেও বিপদ। তাই পুলিশকে এত সাবধানে চলতে হচ্ছে।

শোনো নরেন্দ্র, সাধারণ মানুষ পাপের ভয়ে দেবতার মূর্তিকে ছুঁতেই সাহস করে না, চুরি করা তো দূরের কথা। কিন্তু যারা চোরা কারবার করে, তাদের ওসব পাপের ভয়টয় নেই। ওরা বিদেশে অনেক পুরনো মূর্তি পাচার করে দেয়। সেইরকম কোনও দলের খবর পুলিশ রাখে না? তাদের ধরে জেরা করো। আমি খোঁড়া মানুষ, আমি তো আর দৌড়োদৗড়ি করতে পারব না?

এখানে এরকম ঘটনা আগে ঘটেনি। আসলে উড়িষ্যা, মধ্যপ্রদেশ কিংবা কর্নাটকে কত বড় বড় মন্দির, প্রচুর ভাল ভাল মূর্তি, ওসব জায়গা থেকে কিছু মূর্তি চুরি যায়। কিন্তু এখানে অত বড় কিংবা পুরনো মন্দির নেই, তেমন কিছু দামি মূর্তিও নেই। তাই চোরাকারবারিদেরও এদিকে নজর পড়েনি। মনে হচ্ছে, মূর্তি চুরি করে কেউ কিছু একটা গোলমাল পাকাতে চাইছে।

আমার কাছে তোমরা কী সাহায্য আশা করো। মূর্তিটা কেমন দেখতে তাই-ই জানি না।

কয়েকটা ছবি জোগাড় হয়েছে শুনেছি। গত বছরের মেলার সময় ভোলা। ছবিগুলো খুব পরিষ্কার নয়, তবু একটা আন্দাজ পাওয়া যাবে। একটু পরেই একজন ছবিগুলো নিয়ে আসবে এখানে।

সেই ছবি দেখে আর একটা দেবতার মূর্তি বানিয়ে নাও। এখন তো ঝাট মিটুক। আসল মূর্তি পরে খুঁজো।

এত তাড়াতাড়ি পঞ্চ ধাতুর মূর্তি গড়া সম্ভব নয়। তা ছাড়া পুরনোর সঙ্গে নতুনের তফাত বোঝা যাবেই। মেলার দিন এরা ফুল আর চন্দন দিয়ে মূর্তিটাকে সাজায়।

পুরুত দুজনকে তোমরা কতক্ষণ ঘুম পাড়িয়ে রাখবে? তিন দিন ধরে ঘুম পাড়িয়ে রাখা সম্ভব নাকি? যদি ওরা মরে যায়?

না, একটা অন্য ব্যবস্থা হয়েছে। ওদের তুলে নিয়ে রাখা হবে একটা নার্সিং হোমে। ওদের অসুস্থ সাজিয়ে চিকিৎসা করানো হত, ওখান থেকে বেরুতে পারবে না। আর দুজন লোককে পুরুত সাজিয়ে পাঠানো হবে ওই মন্দিরে।

সেই গ্রামের আর অন্য লোক নেই? তারা মূর্তিটা দেখতে আসবে না? অন্য পুরুতদের দেখে সন্দেহ করবে না?

লালপাথর গ্রামটা অনেক দূরে। দেবতার মূর্তি নিয়ে পুরুতরা অনেক আগে চলে আসে। আর গ্রামের লোক মেলা দেখলে আসবে ওইদিন সকালে কিংবা আগের রাতে। এর মধ্যে কেউ এসে পড়লে বলা হবে, মূর্তি ঢেকে রাখা আছে। কোনওরকমে ম্যানেজ করতে হবে আর কী?

নরেন্দ্রর কোটের পকেটে এই সময় কুরুরুং কুরুরুং শব্দ হল। তিনি একটা মোবাইল ফোন বের করে কার সঙ্গে যেন কথা বলতে লাগলেন হিন্দিতে।

কথা শেষ করে বললেন, ছবিগুলো নিয়ে আসছে ভূপিন্দার সিং। আর একজন লোক পাহারাদারদের ফাঁকি দিয়ে মন্দিরে ঢুকে পুরোহিতদের জাগাবার চেষ্টা করছিল, তাকে ধরে ফেলেছে, তাকেও নিয়ে আসছে এখানে।

কাকাবাবু হাত বাড়িয়ে বললেন, দেখি ফোনটা!

হাতে নিয়ে বললেন, কত ছোট্ট! এগুলোর উন্নতি হচ্ছে। ভারী কাজের জিনিস। আমি কখনও ব্যবহার করিনি।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, এখন কোনও লোককে বিশেষ দরকারে বাড়িতে না পেলেও যে-কোনও জায়গা থেকে খুঁজে বের করা যায়।

জোজো এতক্ষণ কিছু বলেনি, সে বলল, আমাদের বাড়িতে একটা মোবাইল ফোন আছে, সেটা দিয়ে পৃথিবীর যে-কোনও দেশের লোকেরা সঙ্গে কথা বলতে পারি, এত পাওয়ারফুল।

সন্তু সঙ্গে সঙ্গে বলল, কিছুদিনের মধ্যেই চাঁদ কিংবা মঙ্গলগ্রহের সঙ্গেও কথা বলা যাবে। বাড়ির টেলিফোন উঠেই যাবে, সবারই পকেটে পকেটে থাকবে ফোন।

নরেন্দ্র বললেন, রাজা, এটা তোমার কাছেই রাখো।

কাকাবাবু বললেন, না, না, আমি নিয়ে কী করব? নরেন্দ্র বললেন, যে কদিন এখানে থাকবে, ব্যবহার করো। আমি আর-একটা জোগাড় করে নেব।

কাকাবাবু তবু আপত্তি করলেন, কিন্তু নরেন্দ্র শুনলেন না, জোর করে সেটা গুঁজে দিলেন কাকাবাবুর পকেটে। একটা কাগজে লিখে দিলেন কয়েকটা প্রয়োজনীয় নম্বর।

একটু পরেই ভূপিন্দার সিং পৌঁছে গেলেন। সঙ্গে একটা লোক, তার হাত বাঁধা। লোকটির সাধারণ চেহারা, পাজামার ওপর একটা সোয়েটার পরে, মাথার চুল কদমছাঁট, চোখদুটো দেখলে মনে হয় বেশ বুদ্ধি আছে।

আরও দুজন পুলিশ অফিসার পেছনে দাঁড়িয়ে। নরেন্দ্র তাদের জিজ্ঞেস করলেন, এ লোকটা কিছু স্বীকার করেছে?

তাদের একজন বললেন, না সার, কোনও কথাই বলতে চায় না। অতি ধুরন্ধর লোক।

কাকাবাবু লোকটির পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে নরেন্দ্রকে জিজ্ঞেস করলেন, এর কোনও অপরাধ প্রমাণ হয়েছে?

নরেন্দ্র বললেন, শুনলে তো, কোনও কিছুই স্বীকার করেনি। আমি জেরা করে দেখব।

কাকাবাবু বললেন, শোনো নরেন্দ্র, অপরাধ প্রমাণ না হলে কারও হাত বেঁধে রাখা বেআইনি। মন্দিরে ঢুকে পুরুতের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা তো অপরাধ নয়। হয়তো ও কিছুই জানে না।

নরেন্দ্র বললেন, তা হতেও পারে। তবে, এখন পর্যন্ত সন্দেহজনক এই একজনকেই পাওয়া গেছে।

পুলিশদের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, ঠিক আছে, ওর হাতের বাঁধন খুলে দাও, বসিয়ে রাখো। আগে আমরা ছবিগুলো দেখে নিই।

লোকটি বসার সময় দুবার হুঁ হুঁ শব্দ করল।

ভূপিন্দার সিং ছবিগুলো বের করলেন। সবাই দেখতে লাগল একসঙ্গে।

গত বছরের মিছিলের ছবি। মোট চারখানা, তার মধ্যে তিনখানাতেই দেখা যাচ্ছে মিছিলের অনেকটা, কাঁধে করে ঠাকুরের সিংহাসন বয়ে নিয়ে যাচ্ছে লোকেরা, প্রত্যেকটাতে দেবতার মূর্তি, তার মধ্যে একটা ভূতেশ্বরের, কিন্তু স্পষ্ট বোঝা যায় না। একটাই শুধু ভূতেশ্বরের, তলার দিকটা ফুলে ঢাকা, হলদে রঙের মুখ, নাক, চোখ খুব পরিষ্কার নয়, তবে কপালের ওপর একটা চোখ দেখে বোঝা যায়, সেটা শিবের।

কাকাবাবু মূর্তিটা খুঁটিয়ে লক্ষ করে বললেন, মূর্তিটা ভাল। একটা বৈশিষ্ট্য আছে। কতদিনের পুরনো?

ভূপিন্দার সিং বললেন, গ্রামের লোক বলে আড়াইশো, তিনশো বছর। পরীক্ষা করে তো দেখা হয়নি।

কতটা উঁচু?

প্রায় দুফুট।

তার মানে বেশ ভারী। মাথার চুলে সাপ জড়ানো। এরকম একটা মূর্তির নকল চট করে বানানো সম্ভব নয় ঠিকই। যারা চুরি করেছে, তারা যদি এটা এর মধ্যেই মাণ্ডির বাইরে পাচার করে দিয়ে থাকে, তা হলেই তো মুশকিল।

খবর পাওয়ার পর থেকে আমরা মাণ্ডি থেকে যেসব গাড়ি যাচ্ছে, আর যেসব গাড়ি আসছে, চেক করে দেখছি। তার আগেও নিয়ে যেতে পারে।

সব গাড়ি কি আর তন্নতন্ন করে দেখা হয়। সেটা সম্ভবও নয়। এটার কত দাম হতে পারে?

খুব বেশি হলে চার-পাঁচ হাজার।

চোরাকারবারিদের কাছে এটা সামান্য টাকা। তারা এজন্য নজর দেবে না। ছিটকে চোরের কাজ হতে পারে। কিন্তু ছিচকে চোররা পাপের ভয়ে দেবতার মূর্তিতে হাত ছোঁয়ায় না।

বিদেশে অনেক বেশি দাম হতে পারে।

বিদেশে যারা পুরনো জিনিস সংগ্রহ করে, তারা অনেক টাকা দেয় বটে, কিন্তু তারা বোকা নয়। পুরনো বলা হলেই তো তারা মেনে নেবে না। কার্বন টেস্ট করে বয়েস জেনে নেবে। এটা যে আড়াইশো-তিনশো বছরের পুরনো, তার কি নিশ্চয়তা আছে? গ্রামের লোকেরা একটু পুরনো হলেই অনেক বাড়িয়ে বলে।

কিন্তু কেউ তো কোনও মতলবে মূর্তিটা সরিয়েছে ঠিকই!

হয়তো একটা গণ্ডগোল পাকানোই তার উদ্দেশ্য। ওই লালপাথর গ্রামের লোকদের ওপর কারও রাগ থাকতে পারে। অনেক সময় পাশাপাশি দুটো গ্রামের লোকদের মধ্যে ঝগড়া-মারামারি হয়। সেরকম কখনও কিছু হয়েছে কিনা, খোঁজ নেওয়া দরকার।

লালপাথর গ্রামটা খুব দূরে আর দুর্গম জায়গায়। পুলিশ খুব কম যায়। তবু দুজনকে পাঠাচ্ছি আজ রাতেই।

এবার দেখা যাক, এই লোকটি কোন গ্রামের লোক।

কাকাবাবু লোকটির দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন, তুমহারা নাম কেয়া?

লোকটি শব্দ করল, হুঁ হুঁ হুঁ হুঁ!

কাকাবাবু নরেন্দ্রকে বললেন, কী বলল বুঝলাম না। তোমরা কেউ প্রশ্ন করো।

নরেন্দ্র একজন পুলিশ অফিসারকে নির্দেশ দিলেন।

তিনি লোকটির থুতনি ধরে উঁচু করে রুক্ষভাবে বললেন, এই তোর নাম কী রে?

লোকটি বলল, হুঁ হুঁ হুঁ হুঁ!

তুই কোন গ্রামে থাকিস?

হুঁ হুঁ হুঁ হুঁ!

ঠিক করে উত্তর দে! তুই কোথা থেকে এসেছিস?

হুঁ হুঁ হুঁ হুঁ!

এবার মার খাবি! কথা বলছিস না যে! নাম বল!

হুঁ হুঁ হুঁ হুঁ!

পুলিশ অফিসারটি বিরক্ত হয়ে বলল, সার, মনে হচ্ছে লোকটা বোবা।

কাকাবাবু বললেন, বোবা কিনা তা পরীক্ষা করার একটা উপায় আছে। সন্তু, ওষুধটা দে তো।

সন্তু গিয়ে লোকটির পাশে দাঁড়িয়ে খুব জোরে তার কানে কু দিয়ে দিল।

লোকটি অমনই ছিটকে সরে গেল একদিকে। দুহাতে কান চাপা দিল।

কাকাবাবু বললেন, বোবারা কানেও শুনতে পায় না। এ যে শুনতে পায় তা বোঝাই যাচ্ছে।

জোজো বলল, আর-একটা ওষুধ আছে, দেব?

কাকাবাবু বললেন, সেটা একটু পরে।

পুলিশ অফিসারটি জোর করে লোকটির হাত সরিয়ে বললেন, এই, কথার উত্তর দে। নাম বল, না হলে কিন্তু সত্যি মারব।

লোকটি এবার মাথা নেড়ে নেড়ে শব্দ করল, হুঁ হুঁ হুঁ হুঁ হুঁ হুঁ ।

কাকাবাবু বললেন, এমন হতে পারে, এর নামই হুঁ হুঁ। হুঁ হুঁ বাবু!

নরেন্দ্র বললেন, লোকটা পাগল নয় তো!

ভূপিন্দার সিং বললেন, কিংবা ইচ্ছে করে পাগল সেজেছে!

জোজো বলল, পাগল সাজা খুব সোজা। আমি ইচ্ছে করলে এমন পাগল সাজতে পারি, কেউ বুঝতে পারবে না!

নরেন্দ্র বললেন, তুমি পাগল সাজলে ধরে কার সাধ্য!

পুলিশ অফিসারটি বললেন, ওর পাগলামি আমি ঘুচিয়ে দিচ্ছি। ঠাস করে এক চড় কষালেন লোকটির গালে। লোকটি চড় খেয়েও কোনও শব্দ করল না।

কাকাবাবু বললেন, এই মারধোর কোরো না। আমি দেখতে পারি না। বরং জোজো তোমার ওষুধটা এবার লাগাও।

জোজো উঠে গিয়ে লোকটিকে কাতুকুতু দিতে লাগল। লোকটি তাতে হাসল। মুখও খুলল না। জোজো অনেক চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিল।

কাকাবাবু বললেন, এই রে, মনে হচ্ছে লোকটি সত্যিই পাগল হতে পারে। পাগলরা সহজে হাসে না। এত কাতুকুতুতেও হাসল না!

নরেন্দ্র বললেন, যাঃ, কী যে বলো, অনেক লোকের কাতুকুতু লাগে না। আমারও তো হাসি পায় না একটুও?

ভূপিন্দার হেসে বললেন, আমার কিন্তু কেউ বগলের কাছে হাত আনলেই হাসি পেতে শুরু করে।

কাকাবাবু বললেন, নরেন্দ্র, তোমার কাতুকুতু লাগে না? বেশ, পরীক্ষা করে দেখা যাক। জোজো—

জোজো নরেন্দ্রকে কাতুকুতু দিতে শুরু করল। নরেন্দ্র মুখোনা কঠিন করে থেকে বলল, কই, দেখছ, একটুও লাগছে না।

কাকাবাবু বললেন, সন্তু, তুই দ্যাখ তো।

সন্তু বলল, জোজো, তুই আর আমি একসঙ্গে দুদিকে—

ওরা নরেন্দ্রর দু বগলে কাতুকুতু দিতেই নরেন্দ্র খিলখিল করে হেসে ফেলে বলতে লাগল, এই, এই, ছাড়ো, ছাড়ো।

পুলিশরা নরেন্দ্রর ওই অবস্থা দেখে হাসতে লাগল মুখ ফিরিয়ে।

কাকাবাবুও হাসতে হাসতে বললেন, ছাড়িস না, আর একটু দে!

সেই লোকটিও মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে হুঁ হুঁ হুঁ হুঁ করে উঠল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress