প্রত্যেকদিন কাকাবাবুই আগে জেগে ওঠেন
প্রত্যেকদিন কাকাবাবুই আগে জেগে ওঠেন। আজ সন্তু আর জোজো সকালবেলা বাইরে বেরিয়ে দেখল, কাকাবাবুর ঘরের দরজা বন্ধ।
কচুরি আর জিলিপি কিনতে বেরিয়ে গেল দুজনে। দোকানটা একটু দূরে, সেখানে গরম গরম জিলিপি ভাজা হচ্ছে। দোকানেই বসে ওরা খেয়ে নিল ভাল করে, তারপর কাকাবাবুর জন্যে কিনে নিয়ে ফিরে এল।
কাকাবাবুর ঘরের দরজা তখনও বন্ধ।
এত বেলা পর্যন্ত কখনও ঘুমোন না কাকাবাবু। দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। একটু ইতস্তত করে সন্তু দুবার ধাক্কা দিল দরজায়, আলতো করে।
কোনও সাড়া নেই।
সন্তুর ভুরু কুঁচকে গেল। সামান্য শব্দে কাকাবাবুর ঘুম ভেঙে যায়। তবে কি তিনি বাথরুমে গিয়েছেন?
একটুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার দরজায় ধাক্কা দিল সন্তু। এবার একটু জোরে জোজো ডেকে উঠল, কাকাবাবু, কাকাবাবু!
তবুও কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না।
আরও কয়েকবার দুমদুম করা হল। কাকাবাবু বাথরুমে থাকলেও এ আওয়াজ শুনতে পাওয়ার কথা। তা হলে কি কাকাবাবু অসুস্থ হয়ে পড়েছেন?
হোটেলের সব ঘরেরই একটা ড়ুপ্লিকেট চাবি থাকে ম্যানেজারের কাছে। এ হোটেলের যিনি মালিক, তিনিই ম্যানেজার। সেই কান্তবাবু থাকেন পাশের বাড়িতে।
তাকে খবর দেওয়া হল। তিনি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে বললেন, কী ব্যাপার? রায়চৌধুরীবাবুর কী হয়েছে?
সন্তু বলল, কী হয়েছে, তা তো বোঝা যাচ্ছে না। কোনও সাড়াই পাওয়া যাচ্ছে না।
কান্তবাবু বললেন, ভিতর থেকে বন্ধ। ঘরেই আছেন নিশ্চয়ই।
সন্তু বলল, আপনার কাছে তো আর-একটা চাবি আছে?
কান্তবাবু জিভ কেটে বললেন, এই রে! আমার কাছে তো চাবি নেই। হয়েছে কী, এক মাস আগে এই সাত নম্বর ঘরে যে লোকটা ছিলেন, তিনি যাওয়ার সময় চাবিটা নিয়ে চলে গেছেন, ফেরত দিতে ভুলে গেছেন আর কী? এই এক মুশকিল, হোটেলের খদ্দেররা অনেকেই চাবি পকেটে নিয়ে চলে যায়। এ চাবির তো আর ড়ুপ্লিকেট করা হয়নি!
সন্তু বলল, তা হলে দরজা ভাঙতে হবে।
কান্তবাবু বললেন, দরজা ভাঙতে হবে? আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলে হয় না?
সন্তু দৃঢ়ভাবে বলল, না। উনি যদি অসুস্থ হয়ে থাকেন, তা হলে এখনই চিকিৎসার ব্যবস্থা করা দরকার।
কান্তবাবু বললেন, তা হলে, তা হলে, মানে, দরজা ভাঙতে গেলে তো আগে পুলিশে খবর দিতে হয়। পুলিশকে সাক্ষী রাখা দরকার।
জোজো বলল, পুলিশ ডাকতে ডাকতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। এখনই দরজা ভাঙুন!
সে নিজেই দড়াম করে এক লাথি মারল দরজায়।
কান্তবাবু আঁতকে উঠে বললেন, দাঁড়াও, দাঁড়াও ভাই, অমন করলে দরজাটা নষ্ট হয়ে যাবে। বরং তালাটা যদি ভাঙা যায়…
একজন বেয়ারাকে ডাকা হল। সে একটা ভ্রু ডাইভার এনে কিছুক্ষণ খোঁচাখুঁচি করার পর নষ্ট হয়ে গেল তালাটা। খুলে গেল দরজা।
সকলে ঢুকে পড়ল একসঙ্গে। বিছানা ফাকা। ঘরে কেউ নেই, বাথরুমের দরজাও খোলা।
কান্তবাবু খাটের তলায় উঁকিঝুঁকি মেরে বললেন, এখানেও তো নেই। কী আশ্চর্য, কী আশ্চর্য, ভিতর থেকে দরজা বন্ধ ছিল, অথচ মানুষটা উধাও হয়ে যায় কী করে? কী অদ্ভুত কাণ্ড! এরকম কখনও দেখিনি, শুনিনি!
সন্তু দেখল, কাকাবাবুর ক্রাচ দুটো পড়ে আছে। চটি জোড়াও রয়েছে। খাটের পাশে। বাইরে পরার পোশাকও রয়ে গেছে সব।
জোজো হাসিমুখে বলে উঠল, ও বুঝতে পেরেছি! কাকাবাবুর হঠাৎ অদৃশ্য হওয়ার শখ হয়েছে। তাই জানলা দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছেন। তাই না রে সন্তু?
সন্তু বলল, ঠিক বলেছিস! কান্তবাবু চোখ গোল গোল করে বললেন, কী বললে? অদৃশ্য? অ্যাঁ
জোজো বলল, হ্যাঁ। কাকাবাবু তিরস্করণী মন্ত্র জানেন। সেই মন্ত্রবলে ইচ্ছে করলে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারেন।
কান্তবাবু বললেন, যাঃ! অত বড় মানুষটা কি জানলা দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারেন?
জোজো বলল, আপনি জানেন না? অদৃশ্য হলে শরীরটা হাওয়ার মতো হয়ে যায়। তখন একটা ছোট্ট ফুটোর মধ্য দিয়েও বেরিয়ে যেতে কোনও অসুবিধে নেই। বাইরে গিয়ে ভাসতে ভাসতে চলে যাবেন। আগেও এরকম হয়েছে, তাই না সন্তু?
সন্তু বলল, বেশ কয়েকবার!
কান্তবাবু বললেন, তাই বলছ? তবে তো আমার হোটেলের কোনও দোষ নেই। তবু পুলিশকে খবরটা দিতেই হবে।
কান্তবাবুরা বেরিয়ে যাওয়ার পর সন্তু আর জোজো খাটের উপর বসে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ।
তারপর জোজো বলল, ঘরের চাবিটা কার কাছে ছিল? কান্তবাবুর কাছে, না অন্য কারও কাছে?
সন্তু বলল, যদি কান্তবাবুর কাছে থেকে থাকে, তা হলে বলতে হবে, ভদ্রলোক খুব ভাল অ্যাক্টিং করতে পারেন।
জোজো বলল, একটা বাংলা টিভি সিরিয়ালে এইরকম চেহারার একজন লোক অ্যাক্টিং করে মনে হচ্ছে। আমি দেখেছি। সে-ও হোটেলের মালিক।
সন্তু বলল, না না, সে অন্য লোক। তার বয়স অনেক কম।
জোজো বলল, আমরা রাত্তিরে কোনও আওয়াজ পাইনি। কেউ একজন সাবধানে চাবি দিয়ে এই ঘরের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকেছে। কাকাবাবু ঘুমিয়ে ছিলেন, ঝাঁপিয়ে পড়েছে তার উপরে।
সন্তু বলল, ঘরে কোনও রক্তের দাগ নেই। ধস্তাধস্তিরও চিহ্ন নেই। খুব সম্ভবত ওরা হঠাৎ কাকাবাবুর মুখ বেঁধে ফেলে নিয়ে গিয়েছে। সেদিক থেকে চিন্তার কিছু নেই।
জোজো বলল, এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ওরা মানে কারা?
সন্তু বলল, সেটাই আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। কিন্তু কোথা থেকে শুরু করা যায়?
জোজো বলল, প্রথমেই এই হোটেলের মালিকটাকে ভয় দেখাতে হবে?
কী করে ভয় দেখাবি? সে আমি জানি। তোকে ভাবতে হবে না।
আমার কী মনে হয় জানিস, জোজো। সব গন্ডগোলের মূলে আছে একটা ঘোড়া।
ঘোড়া?
হ্যাঁ, পরশুদিন গঙ্গার ধারে একটা ঘোড়া এসে হুড়মুড়িয়ে পড়ছিল কাকাবাবুর গায়ের উপর। ঘোড়াটা চালাচ্ছিল সেলিম। এইরকম কিছু হলে সকলে দুঃখ প্রকাশ করে কিংবা ক্ষমা চায়। এখানে সকলে বলছে, সেলিম খুব ভাল আর ভদ্রলোক। অথচ সে কাকাবাবুর কাছে একবারও সরি পর্যন্ত বলেনি।
তা ঠিক। এটা অদ্ভুত লাগে সত্যিই।
কাল দুবার সেলিমের সঙ্গে দেখা হল। খোশবাগে কাকাবাবু ওর সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বললেন। কিন্তু আমাদের কিছু জানালেন না। নিশ্চয়ই কিছু সিরিয়াস ব্যাপার!
হতে পারে, হতেই পারে। তা হলে কি আমরা সেলিমের সঙ্গেই দেখা করব?
আমাদের পাত্তা দেবে কিনা জানি না। তবু চেষ্টা করতে হবে।
তার আগে, মানে পুলিশ আসবার আগেই ঘরটা একবার সার্চ করা দরকার।
দেওয়ালের গায়ে একটা আলমারিতে কাকাবাবুর কিছু জামাপ্যান্ট রয়েছে। আর মানিব্যাগ, ক্রেডিট কার্ড, একটা টর্চ।
সন্তু বলল, কাকাবাবুর রিভলভারটা নেই শুধু।
জোজো বলল, যারা কাকাবাবুকে ধরে নিয়ে গিয়েছে, তারা রিভলভার তো নেবেই।
সন্তু বলল, এখন চতুর্দিকে যে অপহরণ চলছে, সেইরকমই কোনও দল হয়তো কাকাবাবুকে ধরে নিয়ে গিয়েছে। এরপর টাকা চাইবে। তা হলে আমরা সেলিমের কথা ভাবছি কেন? ওদের তো অগাধ টাকাপয়সা। ওরা নিশ্চয়ই এসব ছোট কাজ করবে না।
জোজো বলল, তুই যা বললি, তা ঠিকও হতে পারে, ভুলও হতে পারে। যাদের অনেক টাকা থাকে, তাদের আরও টাকার জন্য লোভও থাকে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন না, রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি। যাই হোক, সব দিকই ভেবে দেখতে হবে।
কাকাবাবুর মানিব্যাগ, ক্রেডিট কার্ড এইসব পকেটে ভরে নিল জোজো। তারপর বলল, চল, নীচে যাই।
হোটেলের অফিস ঘরে এসে ওরা দেখল, কান্তবাবু একমনে কার সঙ্গে যেন কথা বলছেন টেলিফোনে।
ওরা দাঁড়িয়ে রইল কয়েক মিনিট।
টেলিফোনের কথা শেষ হলে তিনি ওদের দিকে চেয়ে বললেন, কী কাণ্ড হল বলো তো? কিছুই বুঝতে পারছি না।
জোজো কাচুমাচু মুখ করে বলল, এখন আমাদের কী হবে? ওরা কাকাবাবুর টাকাপয়সা সব নিয়ে গিয়েছে। আমাদের কাছে কিছুই নেই। আমরা হোটেলের বিল মেটাব কী করে? বাড়ি ফিরবই বা কী করে?
কান্তবাবু চমকে উঠে বললেন, অ্যাঁ তোমাদের কাছে টাকা নেই?
জোজো বলল, সব তো ওঁর কাছেই ছিল।
কান্তবাবু বললেন, উনি তোমাদের ফেলে রেখে চলে গেলেন? আর ফিরবেন না?
জোজো বলল, হয়তো অনেক দূরে কারও বিপদের কথা টেলিপ্যাথিতে জেনে তাড়াহুড়ো করে চলে গিয়েছেন। কান্তবাবু বললেন, টেলিপ্যাথি?
জোজো বলল, মনে মনে টেলিফোন। ফিরবেন তো নিশ্চয়ই, তবে কতদিন লাগবে ঠিক নেই। আট-দশ দিনও লেগে যেতে পারে। আমাদের তো ততদিন এখানেই থেকে যেতে হবে।
কান্তবাবু বললেন, আট-দশদিন! যদি তারও বেশি হয়?
হঠাৎ উদার হয়ে গিয়ে তিনি বললেন, ঠিক আছে। তোমাদের বিল মেটাতে হবে না। সব ছেড়ে দিচ্ছি। তোমরাও ঘরটা ছেড়ে দিয়ে চলে যাও!
জোজো বলল, কোথায় চলে যাব? আমাদের ফেরার ভাড়াও নেই বললাম না? তা ছাড়া কাকাবাবুর জন্য অপেক্ষা করতে হবে!
কান্তবাবু বললেন, তোমরা কোথায় যাবে, তা আমি জানব কী করে? সেটা কি আমার দায়িত্ব। তোমাদের কাকাবাবু যদি আর না-ই ফেরেন, তা বলে কি আমি তোমাদের বসে বসে অনন্তকাল খাওয়াব! আমার হোটেলে তো আমি দানছত্তর খুলে বসিনি!
এবার সন্তু বলল, আপনি আমাদের তাড়িয়ে দেবেন?
কান্তবাবু মুখ গোমড়া করে বললেন, একে মোটেই তাড়িয়ে দেওয়া বলে। কোনও হোটেলে কেউ বিনা পয়সায় থাকতে পারে নাকি? পৃথিবীতে এরকম কথা কেউ শুনেছে?
সন্তু জানলার দিকে তাকিয়ে বলল, ওই তো পুলিশের গাড়ি এসে গিয়েছে। পুলিশই এসে ঠিক করে দেবে, আমরা থাকব না চলে যাব। এখানকার পুলিশ তো খুব চটপটে।
একটা জিপগাড়ি থেকে নামল সেই ইনস্পেক্টর জাভেদ।
ভিতরে এসে জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার? কাকাবাবুর কী হয়েছে?
কান্তবাবু বললেন, আরে দেখুন না ভাই, সকালবেলা এসে দেখছি, রায়চৌধুরীবাবু নেই। এদিকে ঘর ভিতর থেকে বন্ধ। আমাদের তালা ভেঙে ঢুকতে হল। ভিতরটা ফাঁকা। জলজ্যান্ত মানুষটা অদৃশ্য হয়ে গিয়েছেন। উনি নাকি কী মন্ত্র জানেন, তার জোরে অদৃশ্য হতে পারেন। অদৃশ্য হয়ে বেরিয়ে গিয়েছেন জানলা দিয়ে।
জাভেদ ভুরু কুঁচকে বলল, কী বলছেন? অদৃশ্য? তার মানে?
জোজো হা-হা করে হেসে উঠে বলল, জ্যান্ত মানুষ আবার অদৃশ্য হতে পারে নাকি? হা-হা-হা, পৃথিবীতে এরকম কথা কেউ শুনেছে?
কান্তবাবু চোখ পাকিয়ে বললেন, অ্যাই, অ্যাই, তোমরাই তো একথা বলেছ আমাকে?
সন্তু বলল, আমরা ছেলেমানুষ, আমরা যা খুশি বলতে পারি। তা বলে বুড়োমানুষ হয়ে আপনি তা বিশ্বাস করবেন? এই যুগে মন্ত্রফন্ত্র দিয়ে কোনও মানুষ অদৃশ্য হতে পারে? জানলা দিয়ে হাওয়ার মতো বেরিয়ে যেতে পারে?
কান্তবাবু আবার ধমক দিয়ে বললেন, তা হলে তোমরা ও কথা বললে কেন আমাকে?
জোজো বলল, বলেছি এইজন্য, আপনি ভেবেছিলেন, কাকাবাবু নেই দেখে আমরা ভেউভেউ করে কেঁদে ফেলব। আমরা সে ধাতুতে গড়া নই। আমরা জানি, কাকাবাবুকে আটকে রাখার ক্ষমতা পৃথিবীতে কারও নেই। আমরা মোটেই ঘাবড়াইনি।
কান্তবাবু বললেন, মোট কথা, আমার কোনও দায়িত্ব নেই। ঘর ঠিকঠাক ভিতর থেকে বন্ধ ছিল, তারপর মানুষটা সেখান থেকে কোথায় গেলেন, কী করে গেলেন, তা খুঁজবে পুলিশ!
জাভেদ বললেন, অবশ্যই আপনার দায়িত্ব আছে। যদি কেউ দরজা ভেঙে ঢুকত, তা হলে বোঝা যেত, চোর-ডাকাতের কারবার। কিন্তু চাবি দিয়ে দরজা খোলা হলে, সে চাবির দায়িত্ব হোটেল ম্যানেজারের। বাইরের লোক চাবি পাবে কী করে?
কান্তবাবু বললেন, হারিয়ে গিয়েছে। একটা চাবি…
জাভেদ বলল, বটে? একটা চাবি হারিয়ে গিয়েছে, একথা আপনি আগে কাউকে জানিয়েছেন? মোট কথা, আপনাকে থানায় যেতে হবে।
কান্তবাবু চোখ কপালে তুলে বললেন, থানায়?
জোজো জিজ্ঞেস করল, জাভেদস্যার, আমরা থানায় যাব না?
জাভেদ বলল, হ্যাঁ, তোমরাও যাবে, তোমাদের স্টেটমেন্ট নিতে হবে। আগে আমি উপরের ঘরটা একবার দেখে আসি।
জোজো বলল, তুই যা সন্তু, আমি এখানে বসছি।
কান্তবাবুও নিজে না গিয়ে দুজন বেয়ারাকে পাঠালেন।
জোজো একটা চেয়ারে বসে হাঁটু দোলাতে লাগল, আর চেয়ে রইল কান্তবাবুর দিকে।
কান্তবাবু জোজোর দিকে একেবারেই না তাকিয়ে, খাতাপত্র উলটে কাজের ভান করতে লাগলেন।
একটু পরে জোজো আদুরে গলায় জিজ্ঞেস করল, ম্যানেজারবাবু, আজ দুপুরে কী রান্না হবে?
কান্তবাবু দাত মুখ খিচিয়ে বললেন, কচু পোড়া আর কাচকলা সেদ্ধ!
জোজো তবু সরলভাবে বলল, কেন, মাছ হবে না? এখানকার গঙ্গায় ইলিশ মাছ পাওয়া যায় না?
কান্তবাবু বললেন, তোমার লজ্জা করে না? তোমাদের কাকাবাবুকে পাওয়া যাচ্ছে না। আর তুমি খাওয়ার কথা ভাবছ?
জোজো বলল, কেন, লজ্জা করবে কেন? কাকাবাবুই তো শিখিয়েছেন, খিদে পেলেই পেট ভরে খেয়ে নিতে হয়। না হলে ব্রেন কাজ করে না। আমার অবশ্য এখনও খিদে পায়নি। দুপুরের কথা ভাবছি!
কান্তবাবু বললেন, তোমাদের মতো খদ্দের এলে আমার হোটেলটাই তুলে দিতে হবে মনে হচ্ছে।
জোজো বলল, আপনার হোটেল এমনিতেই তুলে দিতে হবে বোধহয়।
কান্তবাবু বললেন, কেন, কেন, কেন? আমার হোটেল উঠে যাবে কেন?
জোজো বলল, আপনি বেশ ভাল রকমই ফেঁসেছেন। আপনার অ্যাক্টিং মোটেই ভাল হচ্ছে না। জাভেদসাহেব একবার থানায় নিয়ে গেলে আপনি সহজে ছাড়া পাবেন ভেবেছেন?
কান্তবাবু দারুণ রেগে গিয়ে বললেন, কী, যত বড় মুখ নয়, তত বড় কথা!
তিনি একটা পেপারওয়েট ছুড়ে মারতে গেলেন জোজোকে। শেষ মুহূর্তে সামলে নিলেন নিজেকে। পেপারওয়েটটা হাতেই ধরা রইল। এক দৃষ্টিতে জোজোর দিকে চেয়ে রইলেন, একটা ছবির মতো।
সেই সময় ফিরে এল জাভেদ আর সন্তু।
জাভেদ বলল, বিশেষ কিছু দেখবার নেই। তালাটা আজ সকালে ভাঙা হয়েছে, এই তো?
জোজো জিজ্ঞেস করল, ফিঙ্গার প্রিন্টের ছবি তুললেন না?
জাভেদ হেসে বলল, ওসব ভাই ডিটেকটিভ বইয়েই থাকে। আমাদের এই মফসসলে হাতের ছাপের ছবি তোলার কোনও ব্যবস্থাই নেই। যাই হোক, আমার যতদূর মনে হচ্ছে, ওই যারা টাকার জন্য অপহরণ করে, তাদেরই কাণ্ড। তবে দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ থাকাটাই ধাঁধায় ফেলেছে। চলুন কান্তবাবু, থানায় চলুন।
থানায় বসবার জন্য চেয়ার পাওয়া যায় না, লম্বা লম্বা টুলে বসতে হয়। কান্তবাবুকে নিয়ে যাওয়া হল পাশের একটি ঘরে, সেখানে অন্য একজন লোক তাকে জেরা করবে। সন্তু আর জোজোকে সামনে বসিয়ে জাভেদ বলল, এবার বলো তো, কাল সন্ধে থেকে কী কী ঘটেছে?
বিশেষ কিছু তো বলার নেই, ফুরিয়ে গেল একটুতেই।
জাভেদ জিজ্ঞেস করল, তোমরা রাত্তিরে কোনও আওয়াজ শোনোনি?
দুজনেই মাথা নেড়ে জানাল, না।
জাভেদ বলল, কাকাবাবুর মতো একজন দুর্দান্ত ধরনের মানুষকে হোটেলের দোতলা থেকে একেবারে নিঃশব্দে ধরে নিয়ে গেল। হোটেলের আর কেউ টের পেল না। এতেই সন্দেহ হয়, হোটেলের কেউ এ ব্যাপারে জড়িত।
এরই মধ্যে একজন লোক জাভেদের কানের কাছে এসে ফিসফিস করে কী যেন বলল।
সঙ্গে সঙ্গে জাভেদ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমাকে এখনই বেরোতে হবে। একজন অপহরণকারীর সন্ধান পাওয়া গিয়েছে, সে ব্যাটাকে ধরতে পারলে অন্যদেরও জালে ফেলা যাবে। হয়তো এরাই কাকাবাবুকে ধরে নিয়ে গিয়েছে। সন্তু, তোমরা এখানেই অপেক্ষা করো, আমি ঘুরে আসছি। হয়তো একটু দেরি হতে পারে।
সন্তু বলল, আমরা আপনার সঙ্গে যেতে পারি না?
জাভেদ একটু চিন্তা করে বলল, তোমরা যাবে? কিন্তু বিপদের ঝুঁকি আছে। ওরা অনেক সময় গুলি চালায়।
সন্তু বলল, সে তো যে-কোনও জায়গায় রাস্তা পার হওয়ার সময়ও অ্যাক্সিডেন্টের ঝুঁকি থাকে।
জোজো বলল, আমরা যাব।
জাভেদ বলল, ঠিক আছে, চলো, তা হলে।
ওরা দুজনে জাভেদের সঙ্গে একটা জিপগাড়িতে উঠল। সঙ্গে আরও তিনজন বন্ধুকধারী পুলিশ।
যেতে যেতে জাভেদ বলল, এখানে অপহরণের ব্যাপারটা খুব বেড়ে গিয়েছে। যতদূর মনে হচ্ছে, একটা দলই করছে এই কাজ। ওদের একজনকে ধরতে পারলেই বাকিদের খোঁজ পাওয়া যাবে।
তারপর সে পাশ ফিরে তার এক সহকারীকে জিজ্ঞেস করল, কেষ্টবাবু, আপাতত আমরা কোন দিকে যাচ্ছি? আমাদের লোক পাকা খবর দিয়েছে তো?
কেষ্টবাবু বলল, স্যার, আমাদের গোবিন্দ অপেক্ষা করছে লালবাগের একটা বাড়ির কাছে। গোবিন্দর খবর কখনও ভুল হয় না।
লালবাগে গিয়ে সে বাড়ি খুঁজবার আগেই গোবিন্দকে দেখা গেল বড় রাস্তায়। হাত তুলে সে গাড়ি থামাল।
জাভেদ মাথা ঝুকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার? গোবিন্দ বলল, আপনারা একটু দেরি করলেন স্যার। পাখি উড়ে গিয়েছে!
জাভেদ অত্যন্ত বিরক্তভাবে বলল, এই-ই হয়, সবসময়। আমরা মোটেই দেরি করিনি। খবর পাওয়ামাত্র বেরিয়ে পড়েছি, আর কত তাড়াতাড়ি আসব? আকাশ দিয়ে উড়ে আসব?
গোবিন্দ বলল, স্যার, ক্রিমিনালদের মতিগতি তো বলা যায় না। লোকটা বেশ বেলা করে ঘুমোচ্ছিল, হঠাৎ উঠে বেরিয়ে গেল।
জাভেদ আবার জিজ্ঞেস করল, কোথায় গেল, তার কোনও ধারণা আছে? লোকটার নাম কী?
গোবিন্দ বলল, ওর দলের লোক ওকে বলে বাঁটলো। ও তালা ভাঙার ওস্তাদ। এই বাঁটলোর আর-একটা আখড়া আছে আজিমগঞ্জে, খানিকটা দূর হবে। সেখানে গিয়ে দেখবেন?
জাভেদ বলল, ইয়েস, সেখানেই যাব। চলো চলো, তুমিও পিছনে উঠে পড়ো!
জিপ আবার মুখ ঘুরিয়ে ছুটল।
এর মধ্যে বেলা বারোটা বেজে গিয়েছে। আজও আকাশ মেঘলা, তেমন গরম নেই।
রাস্তায় এক জায়গায় একটা ট্রাক উলটে গিয়েছে। সেখানে অনেক মানুষের ভিড়, গাড়িটাড়ি যেতে পারছে না।
জাভেদ বিরক্ত হয়ে বলল, এইখানে আমরা আটকে থাকব নাকি? ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের কাছে বোধহয় এখনও কাকাবাবুর খবর পৌঁছোয়নি। এর মধ্যে যদি বাঁটলোকে ধরে ফেলতে পারি…
জাভেদ গাড়ি থেকে নেমে পড়ল।
রীতিমতো জ্যাম হয়ে গিয়েছে, কোনও গাড়ি পার হতে পারছে না। পাশেই ধানখেত। এখন অবশ্য ধান কাটা হয়ে গিয়েছে।
জাভেদ ড্রাইভারকে বলল, তুমি ওই খেতের উপর দিয়ে চালাতে পারবে? জিপগাড়ি তো…
রাস্তা আর খেতের মাঝখানে বেশ বড় গর্ত। তাই অন্য গাড়ি নামতে সাহস করছে না। জিপগাড়ির ড্রাইভার তবু নামিয়ে দিল গাড়ি, সেটা একপাশে অনেকটা হেলে পড়লেও ওলটাল না, কোনওরকমে জায়গাটা পেরিয়ে চলে এল অন্য দিকে।
সন্তু আর জোজোও জিপ থেকে নেমে পড়েছিল, ওরা দৌড়ে গিয়ে আবার উঠল।
আজিমগঞ্জে পৌঁছেও শহর ছাড়িয়ে একটা জংলামতো জায়গায় জিপটাকে নিয়ে এল গোবিন্দ। সেখানে একটা ভাঙাচোরা বাড়ি। এমনই ভাঙা যে, সেখানে কোনও মানুষ থাকে বলে মনে হয় না। আশপাশে আর কোনও বাড়িও নেই।
গোবিন্দ আঙুল তুলে বলল, ওই দেখুন, একটা সাইকেল। নিশ্চয়ই এখানে মানুষ আছে।
সত্যিই একটা সাইকেল ঠেস দিয়ে রাখা আছে একটা গাছের গায়ে।
জাভেদ বন্ধুকধারী পুলিশদের বলল, তোমরা দুজনে দুদিকে দাঁড়াও। চোখ-কান খোলা রাখবে। আর-একজন থাকবে এই দরজার কাছে।
জাভেদ রিভলভার হাতে নিয়ে সন্তু আর জোজোকে বলল, তোমরা গাড়িতেই বসে থাকো।
সন্তু বলল, না, আমরাও আপনার সঙ্গে যাব।
জাভেদ বলল, আসতে চাও? ঠিক আছে পিছনে পিছনে থাকো। যদি গুলিটুলি চলে, সঙ্গে সঙ্গে শুয়ে পড়বে?
সাবধানে এক-পা এক-পা করে এগোতে লাগল জাভেদ।
এককালে কোনও ধনী লোকের বাড়ি ছিল, এখন পরিত্যক্ত। সামনে অনেকখানি চওড়া বারান্দা, সেটা আগাছায় ভরা। দরজা-জানলা ভাঙা।
জোজো ফিসফিস করে বলল, ঠিক সিনেমার মতো মনে হচ্ছে, না রে?
সন্তু বলল, হ্যাঁ। সিনেমায় এরপর কী হয় বল তো? আসামি পালিয়ে যায়। সাবধানে থাকতে হবে।
জাভেদ ওদের দিকে ফিরে ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলল, চুপ!
প্রথম দুটো ঘর একবারে ফাঁকা। কোনও মানুষ থাকার চিহ্নই নেই।
তারপর একটা ঘরের কাছে আসতেই দ্যাখা গেল, ভিতরে একটা টেবিলে বসে একজন লোক কী যেন খাচ্ছে।
গোবিন্দ আঙুল দিয়ে দেখিয়ে মাথা নাড়ল, তার মানে, ওই লোকটাই বাঁটলো। একজন স্ত্রীলোক বাঁটলোকে কিছু একটা খাবার এনে দিল।
জাভেদ সেই ঘরের মধ্যে ঢুকতেই বাঁটলো উঠে দাঁড়াল।
জাভেদ ঠান্ডা গলায় বলল, ওঠবার দরকার নেই। খাচ্ছিস, খেয়ে নে। খাওয়ার মাঝখানে কোনও মানুষকে আমি অ্যারেস্ট করি না।
বাঁটলো আবার বসে পড়ে বলল, আপনারা…আপনারা আমাকে ধরতে এসেছেন কেন? আমি কী করেছি?
জাভেদ বলল, সে কথা পরে হবে। বলছি না, খেয়ে নে আগে!
বাঁটলো আবার খেতে শুরু করল। তার খাওয়ার শপশপ শব্দ হচ্ছে।
সন্তু বেরিয়ে গেল বাইরে।
জোজো জিজ্ঞেস করল, জাভেদদা, ও কী খাচ্ছে?
জাভেদ বলল, পান্তাভাত আর বেগুনপোড়া।
জোজো বলল, মাছ, মাংস কিছু নেই?
জাভেদ বলল, দেখছি না তো!
জোজো বলল, এরা নিশ্চয়ই অপহরণ করে অনেক টাকা পায়। তা দিয়ে কী করে? ভাল করে খায় না?
জাভেদ বলল, পান্তাভাত এখানে অনেকে খুব পছন্দ করে। আমিও খুব খাই। তবে এর সঙ্গে আলু দিয়ে চিংড়ি মাছের ঝাল থাকলে আরও ভাল।
বাঁটলো বলল, আমি তো স্যার ভ্যান রিকশা চালাই। আমায় কেন ধরতে এসেছেন। ওই গোবিন্দটা আপনাদের ভুল খবর দিয়েছে।
গোবিন্দ বলল, আমাকে চেনে দেখছি। ও আগেও একবার ধরা পড়তে পড়তে পিছলে গিয়েছিল।
জাভেদ ধমক দিয়ে বলল, তোর খাওয়া হয়েছে? শেষ কর, তাড়াতাড়ি শেষ কর। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকব?
বাঁটলো বলল, এই তো, হয়ে গেছে।
স্ত্রীলোকটি জিজ্ঞেস করল, আর ভাত নেবে না?
বাঁটলো বলল, নাঃ, পেট ভরে গিয়েছে। এবার একটু আঁচিয়ে নিই স্যার?
জাভেদ বলল, বাইরে যেতে হবে না। এখানেই হাত ধুয়ে নে।
বাঁটলো বলল, বাইরে যাব না, এই তো দরজার সামনে দাঁড়িয়ে…
অন্যদিকের পাল্লা-ভাঙা দরজার কাছে রাখা আছে একটা জলের জাগ।
সেটা তুলে নিয়েই হাত ধোওয়ার বদলে ছুড়ে মারল জাভেদের দিকে। ঠিক সময় মাথাটা সরিয়ে না নিলে জাগটা জাভেদের মাথা ফাটিয়ে দিত।
এরই মধ্যে বাঁটলো লাফিয়ে বাইরে নেমে লাগাল দৌড়।
দশ-বারো পায়ের বেশি যেতে পারল না। একটা দেওয়ালের আড়াল থেকে সন্তু বেরিয়ে এসে তার পায়ে একটা ল্যাং মারল।
বাঁটলো পড়ে গেল ধপাস করে।
ততক্ষণে জাভেদ নিজেকে সামলে নিয়ে বাইরে চলে এসেছে।
বাঁটলোর পিঠের উপর পা দিয়ে বলল, পালাতে চাইছিলি, তাই না? এই ছেলেটি তোর কী উপকার করেছে জানিস? তুই যদি আর-একটু দূরে যেতিস, আমার পুলিশ তোকে গুলি করে ঝাঝরা করে দিত। এই ছেলেটির জন্য তুই বেঁচে গেলি!
সন্তু বলল, পুলিশের গুলি ওর গায়ে না-ও লাগতে পারত।
জাভেদ বলল, ওকে বাঁচিয়ে রাখাই আমাদের দরকার। এই, ওঠ!
বাঁটলো উঠে দাঁড়াতেই জাভেদ তার চুলের মুঠি চেপে ধরে বলল, কাকাবাবুকে তোরা কোথায় নিয়ে রেখেছিস?
বাঁটলো অবাকভাবে বলল, কাকাবাবু? কার কাকাবাবু? আমি তো চিনি না!
জাভেদ বলল, কাল রাত্তিরে তোরা রত্নমঞ্জুষা হোটেল থেকে একজন খোঁড়া ভদ্রলোককে ধরে নিয়ে গিয়েছিস। তিনি এখন কোথায়?
বাঁটলো বলল, রত্নমঞ্জুষা? সে হোটেলে আমি জীবনে কখনও ঢুকিনি। কোনও খোঁড়া ভদ্রলোককে ধরে নিয়ে যাওয়ার কথা আমি কিছুই জানি
জাভেদ বলল, এঃ, তুই কিছুই জানিস না? সত্যি কথা বল, তা হলে কম শাস্তি পাবি। নইলে তোর কপালে অনেক দুঃখ আছে।
বাঁটলো এবার কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল, সত্যি বলছি স্যার। মা কালীর দিব্যি।
জাভেদ বলল, ওসব দিব্যিটিব্যি আমি বুঝি না। আমি দশ গুনব, তার মধ্যে যদি না বলিস… এক, দুই…
বাঁটলো বলল, সত্যি কথাটা শুনুন স্যার। আমরা ভাড়া খাটি। আমাদের একজন এসে বলে, অমুক লোকটাকে ধরে এনে দিতে হবে। আমরা তাকে ধরে এনে দিই। তার জন্য আমরা খুব কমই পয়সা পাই। তারপর সেই লোকটাকে নিয়ে ওরা কী করে, তা আমরা জানি না। এর মধ্যে শুধু এরকম একটা কেস করেছি, সে লোকটার নাম ফিরোজ শাহ। কাকাবাবু বলে কারও নাম শুনিনি।
জাভেদ বলল, কে তোদের এরকম লোক ধরে আনার বরাত দেয়?
বাঁটলো বলল, সে নাম কি আমি বলতে পারি স্যার। এ লাইনে একবার নামটাম বলে দিলে আমার দলের লোকরাই আমাকে খুন করে ফেলবে।
জাভেদ বলল, আর না বললে যে আমি তোকে খুন করে ফেলতে পারি? তোকে গুলি করে মেরে ফেলে তারপর রিপোর্ট লিখব, তুই আমাকে ছুরি দিয়ে মারতে এসেছিলি। ব্যস। মিটে গেল। বরং থানায় আমাদের কাছে রাখলে তোর দলের লোক কোনও ক্ষতি করতে পারবে না!
এরপর বাঁটলোকে জিপে তুলে এনে নিয়ে আসা হল থানায়।
সেখানে সারাদিন ধরে জেরা করা হল বাঁটলোকে।
কিছুতেই তার পেট থেকে কথা বের করা যায় না।
প্রায় সন্ধের সময় সে তার দলের একজনের নাম বলে ফেলল।
সন্তু আর জোজো সর্বক্ষণ বসে বসে সব শুনছিল। জাভেদ তাদের বলল, আমার মনে হচ্ছে, এ-লোকটা সত্যিই কাকাবাবু সম্পর্কে কিছু জানে না। এতক্ষণ ধরে জেরা করছি। জানলে একটা কিছু বলে ফেলত। ফিরোজ শাহর কেসটা স্বীকার করেছে। আমার ধারণা, কাকাবাবুর অপহরণের ব্যাপারটা অন্য কোনও দলের কাজ।
সন্তু বলল, সব শুনে আমারও মনে হল, বাঁটলো লোকটি সত্যিই কাকাবাবুর কথা জানে না। কতক্ষণ আর একটা লোক মিথ্যে কথা বলতে পারে?
জাভেদ বলল, তবু আর-একটা লোকের খোঁজ যখন পাওয়া গেছে, তাকে ধরতে পারি কিনা দেখি। তার কাছ থেকে হয়তো আরও কিছু খবর পাওয়া যাবে। তোমরা হোটেলে গিয়ে অপেক্ষা করো। আমি রাত্তিরে তোমাদের খবর দেব।
জোজো বলল, বাবা রে! সারাদিন ধরে শুধু একই কথা, একটি কথা শুনছি। মাথা ধরে গিয়েছে। আমি এখন হোটেলেই ফিরতে চাই!
সন্তু বলল, অন্য লোকটা যদি ধরা পড়ে, তাকে একবার দেখব না?
জাভেদ বলল, ধরা পড়লে তোমাদের খবর দেব। হোটেল থেকে ডাকিয়ে আনব।
সন্তু বলল, ঠিক আছে!
দুজনে বেরিয়ে পড়ল থানা থেকে।
জোজো বলল, তোর খিদে পায়নি সন্তু? দুপুরে তো প্রায় কিছুই খাইনি!
দুপুরে থানায় কয়েকখানা রুটি, ডাল আর কিমার তরকারি খেতে দেওয়া হয়েছিল দোকান থেকে আনিয়ে। তাতে জোজোর পেট না ভরারই কথা। কিংবা পেট ভরলেও মন ভরেনি। বারবার বলছিল, আমি কিমার তরকারি পছন্দ করি না। এর মধ্যে অনেক ভেজাল থাকে।
জোজো বলল, কাকাবাবুর মানিব্যাগ তো আমার কাছে আছে। চল, কোনও রেস্তরাঁয় গিয়ে ভাল করে খেয়ে নিই।
সন্তু বলল, কাকাবাবু কোথায় আছেন, তাকে কিছু খেতে দেওয়া হয়েছে। কিনা, তাই বা কে জানে!
জোজো বলল, সেই ভেবে কি আমরা না খেয়ে থাকব? তাতে কোনও লাভ হবে? কাকাবাবুই তো বলেছেন, খিদে পেলেই ভাল করে খেয়ে নিতে হয়, না হলে ব্রেন কাজ করে না?
একটা পাঞ্জাবির দোকানে ঢুকে ওরা কষা মাংস, রুটি আর মিষ্টি দই খেয়ে নিল।
জোজো তৃপ্তির সঙ্গে বলল, আঃ! এইবার আমার ব্রেন ভাল কাজ করছে। এখন আমাদের কী করা উচিত বল তো?
সন্তু বলল, তুই বল!
জোজো বলল, সকালে আমরা প্রথমে সেলিমের কথা ভেবেছিলাম। এখন একবার চল, সেলিম কিংবা আমির আলির সঙ্গে দেখা করে আসি। ওঁরা কাকাবাবুর খবরটা জানেন কিনা তাও বোঝা যাবে।
সন্তুও ঠিক এটাই ভাবছিল। সে মুখে কিছু না বলে একটা সাইকেল রিকশা ডাকল।
আমির আলি সাহেবের সেই সাদা রঙের বাড়ির সামনের গেট বন্ধ।
পাহারাদারটি ওদের কথা শুনে বলল, ভিতরে যাওয়া যাবে না। যখনতখন দেখা করার হুকুম নেই।
জোজো বলল, কাল আমাদের এখানে নেমন্তন্ন ছিল, আপনার মনে আছে তো? তারপর হয়েছে কী, পকেট থেকে আমার একটা আইডেন্টিটি কার্ড কখন পড়ে গেছে। সেটা হারিয়ে গেলে খুব মুশকিল হবে। একবার ভিতরে গিয়ে ম্যানেজারবাবুকে জিজ্ঞেস করব শুধু। যদি কার্ডটা এখানে থাকে…
পাহারাদার কিছুতেই শুনতে চায় না।
অনেক কাকুতিমিনতি করার পর গেটটা খুলে দিয়ে বলল, ঠিক আছে, পাঁচ মিনিটের মধ্যে চলে আসবে।
সামনের বাগানে কয়েকটা আলো জ্বলছে। তার মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে সেই সাদা ঘোড়াটা।
সন্তু ঘোড়াটার গলা চাপড়ে একটু আদর করতেই সেটা বেশ খুশি হয়েছে। মনে হল।
সন্তু বলল, বেশ ভাল জাতের ঘোড়া। ভদ্র।
জোজো বলল, সন্তু, যদি কুকুর দুটো আসে?
সন্তু বলল, এইসব বাড়ির কুকুর প্রথমেই কামড়ায় না। ট্রেনিং দেওয়া থাকে। কাছে এসে জোরে জোরে ডাকে। ভয় পাবি না, দৌড়োবি না, একদম চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবি। আমি সামলে নেব।
কুকুর দুটো অবশ্য দেখা গেল না।
বারান্দায় উঠে এসে সন্তু একটা দরজায় টোকা দিল। তারপর দেখল, পাশে একটা ডোরবেলও আছে।
দরজা খুলে মুখ বাড়ালেন সেই ম্যানেজারবাবু, যিনি কাল আমিরসাহেবের চিঠি নিয়ে গিয়েছিলেন।
তিনি ওদের দেখে বেশ অবাক।
শুকনো গলায় জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার?
জোজো বলল, আমরা একবার আমিরসাহেবের সঙ্গে দেখা করতে চাই।
ম্যানেজারবাবু মুখ ভেংচে বললেন, দেখা করতে চাই বললেই দেখা করা যায়? এ কি মামার বাড়ি পেয়েছ নাকি? ওঁর শরীর ভাল নেই।
সন্তু বলল, তা হলে কি সেলিমসাহেবকে একবার ডেকে দেবেন?
জোজো বলল, আমাদের কাকাবাবু সেলিমসাহেবকে একটা জরুরি কথা বলে পাঠিয়েছেন।
ম্যানেজার বললেন, বটে! খুব মিথ্যে কথা বলতে শিখেছ তো? তোমাদের কাকাবাবু সেলিমসাহেবকে জরুরি কথা বলে পাঠিয়েছেন! এমন হাসির কথা কখনও শুনিনি!
সন্তু বলল, আপনি এত রেগে যাচ্ছেন কেন? আমরা সেলিমসাহেবের সঙ্গে মাত্র দু-তিন মিনিট কথা বলব!
ম্যানেজারবাবু বললেন, সেলিমসাহেব যখন-তখন বাইরের লোকের সঙ্গে দেখা করেন না। যাও যাও, সরে পড়ো। তিনি দড়াম করে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন।
জোজো বলল, যাঃ বাবা! কাল দুপুরে অত যত্ন করে খাওয়াল এ বাড়িতে আর আজ এখানে মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিল!
সন্তু বলল, বাবু যত বলে পারিষদ দলে বলে তার শতগুণ। আমার মনে হয়, আমির আলি সাহেব কিংবা সেলিমসাহেবকে খবর দিলে নিশ্চয়ই একবার দেখা করতেন। এই ম্যানেজারই দেখা করতে দিল না।
জোজো বলল, ওই ম্যানেজার কেন বলল, কাকাবাবু সেলিমসাহেবকে একটা জরুরি কথা বলে পাঠিয়েছেন, সেটা একটা হাসির কথা?
সন্তু একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তার মানে বুঝলি না? আমি বুঝেছি। তার মানে হল, ম্যানেজারবাবু জানেন, কাকাবাবুর পক্ষে এখন কোনও খবর পাঠানো সম্ভব নয়। কাকাবাবু কোথাও বন্দি হয়ে আছেন।
জোজো বলল, অ্যাঁ তাই তো। এ বুড়ো জানল কী করে?
সন্তু বলল, সেটাই তো প্রশ্ন। তা ছাড়া জানিস জোজো, কেউ অকারণে অভদ্র ব্যবহার করলে আমার মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। আমরা আমিরসাহেব আর সেলিমসাহেবের সঙ্গে শুধু দেখা করতে চেয়েছি। যতই বড়লোক হোক, তাদের সঙ্গে অন্য কেউ দেখা করতে চাইতে পারে না? সেইজন্য মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেবে? আমার ইচ্ছে করে, এদের উপর একটা কিছু প্রতিশোধ নিতে।
জোজো বলল, কী প্রতিশোধ নিবি? দরজাই খুলবে না।
সন্তু বলল, একটা উপায় আছে। আমি কিছুদিন ঘোড়া চালানো শিখেছি। ভালই পারি। এই সাদা ঘোড়াটা নিয়ে যদি পালিয়ে যাই। সেলিমসাহেবের প্রিয় ঘোড়া, নিশ্চয়ই সেলিমসাহেব কষ্ট পাবে। ছোটাছুটি করবে এদিক ওদিক। সেটাই হবে ওর শাস্তি।
জোজো বলল, তুই ঘোড়াটা নিয়ে যাবি? আমি তা হলে কী করব?
সন্তু বলল, তুই আমার পিছনে বসে শক্ত করে ধরে থাকবি। পারবি না?
সন্তু কাছে গিয়ে ঘোড়াটাকে একটু আদর করে চড়ে বসল। ঘোড়াটা আপত্তি করল না।
জোজোকেও তুলে নিয়ে সন্তু টগবগিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে বেরিয়ে গেল খোলা গেট দিয়ে।