Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » কহেন কবি কালিদাস – মিসির আলি || Humayun Ahmed » Page 5

কহেন কবি কালিদাস – মিসির আলি || Humayun Ahmed

মৃত্যু ভয়াবহ একটি ব্যাপার। মৃত্যুর চেয়েও ভয়াবহ ব্যাপার কি আছে? অবশ্যই আছে। মৃত্যুর চেয়েও ভয়াবহ ব্যাপার আমি ঘটতে দেখলাম। ইথেন মারা গেল সন্ধ্যাবেলায়। রাত দশটায় পুলিশ এসে বাবাকে অ্যারেক্ট করে নিয়ে গেল। রমনা থানার ওসি জানালেন, থানায় এক মহিলা টেলিফোন করে জানিয়েছেন যে তিনি স্পষ্ট দেখেছেন ঘিয়া রঙের পাঞ্জাবি পরা দাড়িওয়ালা এক লোক ইথেনকে ধাক্কা দিয়ে ছাদ থেকে ফেলেছে। আমাদের বাড়ির পাশের অ্যাপার্টমেন্ট হাউসে তিনি থাকেন। তিনি তার পরিচয় জানাতে চান না। এবং এই বিষয়ে আর কিছু বলতেও চান না। তিনি চান পুলিশ তদন্ত করে বিষয়টা বের করুক। মহিলার টেলিফোন কলের পরপরই পুলিশ একজন পুরুষ মানুষের কল পায়। তিনিও একই কথা বলেছেন।

আমি ওসি সাহেবকে বললাম, ঘটনাটা যখন ঘটে তখন বাবা নামাজ পড়ছিলেন। আমিও একই ঘরে নামাজ পড়েছি। শব্দ শোনার পর দুজন একসঙ্গে ছুটে গেছি।

ওসি সাহেব বললেন, আপনার কথা বুঝতে পারছি কিন্তু আমাদের তদন্ত করতেই হবে।

আমি বললাম, যে-মানুষটার মেয়ে মারা গেছে তাকে আপনি ধরে নিয়ে যাবেন। আজই নিতে হবে? দুই-একদিন পরে নিয়ে যান।

আজই নিতে হবে। তদন্ত দ্রুত হতে হয়।

ওসি সাহেবকে কিছু টাকা পয়সা দিলে কাজ হত। আমার মাথায় আসে নি। তারা বাবাকে নিয়ে গেল। শুধু যে বাবাকে নিয়ে গেল তা-না, ইথেনকে নিয়ে গেল। তার মৃত্যু অস্বাভাবিক। কাজেই পোষ্টমর্টেম করা হবে।

আমি এক বাসায় রইলাম। দুনিয়ার লোকজন ঘরে ঢুকছে। ঘর থেকে বের হচ্ছে। সবাই অপরিচিত। এর মধ্যে ক্যামের গলায় সাংবাদিকও আছে। সাংবাদিক ফ্ল্যাশ দিয়ে আমার একটা ছবি তুলল। তখন আমার মাথা খারাপের মতো হয়ে গেল। আমি চিৎকার করে বললাম, কেন আপনি আমার ছবি তুললেন? কোন সাহসে আপনি আমার ছবি তুললেন? কেউ আমার বাড়িতে থাকতে পারবেন না। কেউ না। যে বাড়িতে ঢুকবে তাকেই আমি খুন করে ফেলব।

সত্যি-সত্যি আমি রান্নাঘর থেকে বঁটি নিয়ে এলাম। আমার উন্মাদ চেহারা দেখে ভয়েই লোকজন বের হয়ে গেল। তবে পুরোপুরি গেল না। গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে জটলা পাকাতে লাগল। কিছু রিকশা দাঁড়িয়ে গেল। রিকশার যাত্রীরা সিটের উপর দাঁড়িয়ে দেখার চেষ্টা করছে। দর্শকদের কেউ কেউ আবার ঢ়িল ছুড়ছে। বাবাকে নিয়ে যাবার সময় ওসি সাহেব একটা ভদ্রতা করলেন। বাড়ির সামনে দুজন পুলিশ রেখে গেলেন। তাদের দায়িত্ব কাউকে ঘিরে ঢুকতে না দেওয়া।

ওসি সাহেব যখন বাবাকে নিয়ে যাচ্ছেন তখনো আমি বাবার মধ্যে তেমন কোনো অস্থিরতা দেখলাম না। তিনি সারাক্ষণই মাথা নিচু করে রাখলেন। আমাকে একসময় চাপা গলায় বললেন, ইবলিশের কাজ কেমন পরিষ্কার দেখলি? সে আরো অনেক কিছু করবে। সাবধান থাকবি।

আমি বললাম, কীভাবে সাবধান থাকব?

বাবা বললেন, দমে-দমে আল্লাহ্‌র নাম নিবি। কিছুক্ষণ পরে-পরে আয়তুল কুরাসি পড়ে হাততালি দিবি। হাততালির শব্দ যতদূর যাবে ততদূর পর্যন্ত ইবলিশ আসবে না। ঘরে সব বাতি জ্বালিয়ে রাখবি। ঘর যেন অন্ধকার না থাকে। ইলেকট্রিক বালু। জুলছে। জুলুক। হারিকোনও জ্বালিয়ে রাখ।

আমি চাচ্ছিলাম ইবলিশ শয়তান আসুক। তার সঙ্গে কথা বলি। দেখি সে আসলে কী চায়। আজ তার আসতে সমস্যা নেই। বাড়ি খালি। খালি বাড়িতে আমি একা হাঁটছি।

ইবলিশ শয়তান এল না। রাত বারোটার দিকে বাবা ফিরলেন। পুলিশের জিপ এসে বাবাকে নামিয়ে দিয়ে গেল। রমনা থানার সেকেণ্ড অফিসার ছিল বাবার ছাত্র। তার কারণেই বাবা বিনা ঝামেলায় ছাড়া পেয়ে গেলেন। ইথেনের ডেডবডি পাওয়া গেল না। তাকে রাখা হয়েছে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মৰ্গে। তার পোষ্টমর্টেম হবে। পরদিন সকাল দশটায়। পোষ্টমর্টেম হবার আগে আমাদের কিছু করার নেই।

বাবা প্রতি বৃহস্পতিবার যে পীর সাহেবের কাছে যেতেন। ওনার কাছে খবর পৌছেছিল। উনি রাত একটার দিকে চলে এলেন। দোয়া-দরুদ পড়ে বাড়ি বন্ধন করলেন। বসার ঘরের মেঝেতে বিছানা করা হল। বিছানায় জয়নামাজ বিছানো হল। আগরবাতি জ্বালানো হল। বাবা তাঁর পীর সাহেবকে নিয়ে কোরান শরিফ পাঠ করা শুরু করলেন। বাবার এই পীর সাহেবকে আমার পছন্দ হল। তিনি সত্ত্বনাসূচক কোনো কথাবার্তায় গেলেন না। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল তিনি একটা কাজ হাতে নিয়ে এসেছেন। কাজটা সুন্দর মতো করবেন। এর বেশি কিছু না। আমাকে তিনি শুধু একটি কথাই বললেন, মাগো! সবই আল্লাহর ইচ্ছা।

রাত কত হয়েছে আমি জানি না। আমি বসে আছি ইথেনের ঘরে। টেবিলল্যাম্প জুলছে। টেবিলল্যাম্পের আলো ছাড়া ঘরে আর কোনো আলো নেই। ইথেনের বিছানা এলোমেলে। দুটা বালিশের একটা মেঝেতে। খাটের নিচে গাদা করে রাখা কাপড়। ধোপার বাড়িতে যাবার জন্য আলাদা করে রাখা। দেওয়ালে ইথেনের ছোটবেলার আঁকা ছবি। চারটা ছবি। ফ্রেম করে বাঁধানো। গ্রাম ঘর বাড়ি। নদীতে সূৰ্য অস্ত যাচ্ছে। রাখাল বালক বাঁশি বাজাচ্ছে। আমাদের দু বোনের একটা ফটোগ্রাফও আছে। কক্সবাজারে সমুদ্রে নেমেছি। তার ছবি। ইথেন সমুদ্রের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য শাড়ি সামান্য উঁচু করছে। তার সুন্দর ফরসা পা দেখা যাচ্ছিল। এখন অবিশ্যি দেখা যাচ্ছে না। বাবা কালো স্কচ টেপ দিয়ে পায়ের এই অংশ ঢেকে দিয়েছেন।

আমার অদ্ভুত লাগছে। আমি একজন মৃত মানুষের ঘরে বসে আছি। এখনো তার শরীরের গন্ধ ঘরে ভাসছে অথচ সে নেই। পাশের ঘর থেকে কোরান পাঠের আওয়াজ আসছে। মাঝে-মাঝে আসছে আগেরবাতির গন্ধ। এই গন্ধটা মনে করিয়ে দিচ্ছে এই বাড়িতে মৃত্যু এসেছে।

কোথায় রেখেছে ইথেনকে? এই চিন্তাটা অস্পষ্টভাবে আমার মাথায় আসছে! চিন্তাটা দূর করতে চাচ্ছি কিন্তু পারছি না। ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গ কেমন আমি জানি না। আরো অনেক বেওয়ারিশ লাশের সঙ্গে সে শুয়ে আছে? নাকি তাকে আলাদা রাখা হয়েছে? সে কি শুয়ে আছে ঠাণ্ডা মেঝেতে? নাকি টেবিলে রাখা হয়েছে? সকালবেলা ডাক্তাররা আসবেন। কাটাকুটি করবেন।

দরজায় টোকা পড়ছে। কেউ যেন খুব সাবধানে দরজা টানছে। আমি বললাম, কে?

দরজার ওপাশ থেকে চাপা গলায় কেউ একজন বলল, আপা আসব?

আমি এই গল চিনি। ইথেনের গলা। সামান্য ভাঙা ভাঙা। ঠাণ্ডা লাগলে ইথেনের গলা সামান্য ভেঙে যায়। আমি আবারো বললাম, কে?

দরজার ওপাশ থেকে ইথেন বলল, আপা তুমি যদি ভয় না পাও তা হলে আমি ঘরে আসব। আসি?

আমি জবাব দিলাম না। আমার মাথা কাজ করছে না। ইথেনের ঘরে বসে তার কথা ভাবছিলাম বলেই কি আমি প্রবল ঘোরের জগতে চলে গেছি? হেলুসিনেশন হতে শুরু করেছে? আমার এখন কী করা উচিত? বাবাকে ডাকা উচিত। নাকি আমি ইথেনকে ঘরে ঢুকতে বলব?

দরজায় ইথেনের হাত দেখা যাচ্ছে। চুড়ি পরা ফরসা হত। সবুজ কাচের চুড়ি। কত উঁচু থেকে সে পড়েছে। হাতের সব চুড়ি ভেঙে যাওয়ার কথা! অথচ এখনো হাত ভর্তি চুড়ি। সে দরজা আস্তে করে ভেতরের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই তো ইথেনকে দেখা যাচ্ছে। তার বড় বড় চোখ ফরসা শান্ত চেহারা।

আপা তুমি কি ভয় পাচ্ছ?

না।

ওরা আমাকে ঠাণ্ডা একটা বাক্সে ভরে রেখেছে। ভয় লাগছিল বলে চলে এসেছি। বেশিক্ষণ থাকব না। আপা বসব?

বোস।

বাতিটা নিভিয়ে দেবে? বাতির জন্য তাকাতে পারছি না। আলো চোখে লাগছে। আমি যন্ত্রের মতো হাত বাড়িয়ে বাতি নিবালাম। ঘর পুরোপুরি অন্ধকার হল না। বারান্দার বাতি জুলছে। তার আলো খোলা দরজা দিয়ে আসছে। সেই আলোয় ইথেনকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আমার ক্ষীণ সন্দেহ হল সে কি আসলেই ইথেন? নাকি ইবলিশ শয়তান ইথেনের রূপ ধরে এসেছে? নাকি পুরো ব্যাপারটাই একটা প্রবল ঘোর।

আপা বাবার সঙ্গে ঐ লোকটা কে?

ওনার পীর সাহেব।

তোকে একটা কথা বলতে এসেছি আপা! কথাটা বলে চলে যাব।

বল কী কথা?

তুই সাবধানে থাকিস। ইবলিশ শয়তান তোকে মারবে। সামান্য অসাবধান হলেই মারবে।

কীভাবে সাবধানে থাকব?

তাকে তুই ধাঁধার মধ্যে রাখবি। সে যেন তোকে পরিষ্কার কখনো বুঝতে না পারে।

কী রকম ধাঁধা?

তুই যে তার মতলব জানিস এটা তাকে বুঝতে দিবি না। আমার বুদ্ধি কম আমি তার কাছে ধরা খেয়ে গেছি। তোর বুদ্ধি বেশি তুই পারবি।

ইথেন আমার বুদ্ধি কিন্তু বেশি না।

তা হলে এক কাজ কর। খুব বুদ্ধি আছে এমন কারোর কাছে যা।

খুব বুদ্ধি আছে এমন কাউকে আমি চিনি না।

এখন চিনিস না পরে চিনবি। অতি বুদ্ধিমান একজন মানুষের সঙ্গে তোর পরিচয় হবে। তার সাহায্য চাইবি।

বুঝব কী করে সে অতি বুদ্ধিমান?

তাকে ধাঁধা জিজ্ঞেস করবি! ব্দুখবি ধাঁধার জবাব দিতে পারে কি না। প্রথম শুরু করবি সহজ ধাঁধা দিয়ে তারপর কঠিনের দিকে যাবি। আপা এই ধাঁধাটা দিয়ে শুরু কর–

কহেন কবি কালিদাস
পথে যেতে যেতে
নাই তাই খাচ্ছ
থাকলে কোথায় পেতে?

ইথেন হাসছে। সে আগের মতো হয়ে যাচ্ছে। হাসিখুশি গল্পবাজ মেয়ে। সে শব্দ করেই হাসছে। পাশের ঘরে নিশ্চয়ই সেই হাসির শব্দ পৌঁছেছে। বাবা এবং তার পীর সাহেব কোরান পাঠ বন্ধ করেছেন। বাবা উঠে আসছেন। তাঁরা পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। ইথেন বলল, আপা যাই।

বাবা ঘরে ঢুকে ক্লান্ত গলায় বললেন, হাসছিস কেন মাঃ শরীর খারাপ লাগছে? মাথায় যন্ত্রণা? দুটা ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে শুয়ে থাক মা। তিনি আমার পাশে বসে মাথায় হাত বুলাচ্ছেন। আমি কাঁদতে শুরু করেছি। কিন্তু আমার কান্নার শব্দ হাসির মতো শুনাচ্ছে।

বাবা বিড়বিড় করে বললেন, তুই কঁদেছিলি? অথচ আমার কাছে মনে হচ্ছিল কেউ একজন হাসছে। বিপদে-আপদে মানুষের মাথা ঠিক থাকে না। কী শুনতে কী শোনে।

আমি বললাম, বাবা একটা কাজ করবে? আমাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিয়ে যাবে? আমি মর্গের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকব।

বাবা বললেন, ঠিক হবে না রে মা।

আমি বললাম, কেন ঠিক হবে না? অবশ্যই ঠিক হবে। তোমার মেয়েটা একা পড়ে আছে। একা-এক ভয় পাচ্ছে।

বাবা বললেন, এত রাতে কীভাবে যাব?

আমি বললাম, রিকশা নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। আর যদি না পাওয়া যায় আমরা হেঁটে यांदा!

বাবা বললেন, পীর সাহেবকে জিজ্ঞেস করে দেখি।

আমি বললাম, ওনাকে জিজ্ঞেস করার কিছু নেই বাবা। ওনার মেয়ে মর্গে পড়ে নেই। তোমার মেয়ে পড়ে আছে। বাবা তুমি আমার কথা বিশ্বাস কর সে খুবই ভয় পাচ্ছে।

তুই ওখানে গিয়ে কী করবি?

আমি একটা জায়নামাজ নিয়ে যাব। মর্গের বারান্দায় জায়নামাজ বিছিয়ে সূরা ইয়াসিন পড়ব।

রাত তিনটায় আমরা ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে উপস্থিত হলাম। দারোয়ান গেট খুলে দিল। সে আমাদের দেখে মোটেই অবাক হল না। সে নিশ্চয়ই আমাদের মতো অনেককে এভাবে আসতে দেখেছে। সে সহজ স্বাভাবিক গলায় পশ্চিম কোনদিকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, অজুর পানি লাগব? আমি বললাম, আমার বোনের ডেডবডি মর্গে আছে। তাকে একনজর দেখা কি সম্ভবঃ দারোয়ান বলল, নিয়ম নাই। আমি বললাম, ভাই একটা খোঁজ নিয়ে দেখেন না সম্ভব কি না।

সুপারভাইজার সাব হুকুম দিলে তালা খুলতে পারি। কাছে যাইতে পারবেন না দূর থাইক্যা দেখবেন। তালা খুলনের জন্য খরচ দিবেন।

খরচ কত?

পাঁচ শ টেকা লাগব।

পাঁচ শ টাকা আমি দেব।

দেখি সুপারভাইজার সাব আছে কি না। উনার হুকুম বিনা পারব না। এক হাজার টাকা দিলেও পারব না। আমার চাকরি বিলা হয় যাইব।

বাবা জায়নামাজ বিছিয়ে সূরা ইয়াসিন পড়া শুরু করেছেন। তাঁর পীর সাহেব চোখ বন্ধ করে তসবি টানছেন। আমি অপেক্ষা করছি সুপারভাইজারের জন্য।

সুপারভাইজার সাহেবকে পাওয়া গেল। তিনি চাবি হাতে দরজা খুলে দিতে এলেন। আমি পাঁচ শ টাকার একটা নোট তার হাতে দিলাম। তিনি বললেন, আরো দুই শ লাগবে। আমার পাঁচ শ দারোয়ানের দুই শ।

আমি আরো দুশ টাকা দিলাম। সুপারভাইজার সাহেবের সঙ্গে মৰ্গে ঢুকলাম। মর্গে এক শ পাওয়ারের একটা বাতি জুলছে। মর্গে তিনটা ডেডবডি। তিনটাই তিনটা আলাদাআলাদা টেবিলের উপর। প্রতিটা ডেডবডি সাদা কাপড়ে ঢাকা! ইথেন বলেছিল তাকে রাখা হয়েছে একটা বাক্সের ভেতর এটা ঠিক না। ঘরের ভেতর ফিনাইলের কড়া গন্ধ।

সুপারভাইজার বললেন, ইথেন আছে মাঝখানের টেবিলে।

আমি চমকে সুপারভাইজারের দিকে তাকলাম। ইথেন নাম সুপারভাইজারের জানার কথা না। আমি চাপা গলায় বললাম, আপনি কে?

সুপারভাইজারের ঠোঁটের কোণে হাসি। আমি বললাম, আপনি কে?

বোনকে দেখতে আসছেন দেখেন। এত প্রশ্ন কী জন্য? তবে না দেখলে ভালো করবেন।

আপনি কে?

আমি তোমার স্যার। আমার নাম রকিব। আমি তোমার সঙ্গে ঘষাঘষি খেলা খেলতাম। এখন চিনেছ?

হ্যাঁ চিনেছি।

মরা মানুষের সাথে আমার কোনো ব্যবসা নাই! আমার ব্যবসা জীবিত মানুষের সাথে তারপরেও তোমার খাতিরে আসছি। বোনকে দেখার যখন এত শখ তখন দেখ।

এই সময় একটা ভয়ংকর ব্যাপার ঘটল। সাদা চাদরের ভেতর থেকে ইথেন বলল, আপা খবরদার আমাকে দেখিস না। খবরদার না।

আমি অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে পড়ে গেলাম। যখন জ্ঞান ফিরল তখন দেখি আমি ইথেনের বিছানায় শুয়ে আছি! আমার গায়ে চান্দর। মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে। পাশের ঘর থেকে বাবার সুরা ইয়াসিন পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে। বাবার পীর সাহেব একমনে জিগির করছেন। হাসপাতালের মৰ্গে আমার যাওয়া, ইবলিশের সঙ্গে দেখা হওয়া, অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাওয়া, সবই আমার কল্পনা কিংবা স্বপ্ন।

এখানেও সামান্য সমস্যা আছে। সামান্য সমস্যা বলা ঠিক হবে না বেশ বড় সমস্যা। হাসপাতালের মৰ্গে আমি বাবাকে নিয়ে পরদিন তোরে যাই। যে দারোয়ানকে রাতে দেখেছিলাম। তাকেই দেখি। সে ঠিক রাতে যেরকম বলেছে সেইভাবে বলেসুপারভাইজার সাব হুকুম দিলে তালা খুলতে পারি। কাছে। যাইতে পারবেন না। দূর থাইকা দেখবেন। তালা খুলনের জন্য খরচ দিবেন।

আমি বললাম, খরচ কত?

সে বলল, পাঁচ শ টাকা।

সুপারভাইজারের সঙ্গে দেখা হল। রাতে আমি এই মানুষটাকেই দেখেছিলাম। তালা খোলার পর সে বাড়তি দুশ টাকা নিল।

রাতে আমি একা মৰ্গে ঢুকেছিলাম। দিনে বাবাকে সঙ্গে নিয়ে ঢুকলাম। মর্গের দৃশ্যও রাতের দৃশ্যের মতো। ছোট-ছোট তিনটা টেবিলে তিনটা ডেডবডি পড়ে আছে। সাদা চাদর দিয়ে ঢাকা। বাবা চাপা গলায় বললেন, কোনটা আমার মেয়ে?

সুপারভাইজার বিরক্ত গলায় বলল, মাঝখানেরটা। আপনার কাছে যাবেন না। যেখানে দাঁড়ায়ে আছেন সেখানে দাঁড়ায়ে থাকেন। আমি চাদর খুলে মুখ দেখায়ে দিতেছি। তাড়াতাড়ি বিদায় হন। রিপোর্টিং হয়ে গেলে চাকরি যাবে।

আগে একবার লিখেছি পোষ্টমর্টেম রিপোর্টে ইথেনের গর্ভে কোনো সন্তান ছিল এমন কিছুই পাওয়া যায় নি। শুধু লেখা ছিল—উচ্চ স্থান হইতে পতন জনিত কারণে মৃত্যু। কোথায় কোথায় আঘাত লেগেছে তার বর্ণনা। তা হলে ইথেন এই কাজটা কোন করল? কোন ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ল? সে কি মানসিকভাবে অসুস্থ ছিল? সে কি ধরে নিয়েছিল সে প্ৰেগনেন্ট? মনোবিদ্যায় এরকম রোগের উল্লেখ আছে।

আমি ইথেনকে নিয়ে এরকম একটা ছবি দেখেছিলাম। ছবির নাম The Yellow Snake, সেই ছবিতে এক মহিলার হঠাৎ ধারণা হল তিনি প্রোগনেন্ট। তার ভেতর প্রোগনেসির সমস্ত লক্ষণ প্ৰকাশিত হল। ডাক্তারের কাছে ইউরিন টেস্ট করালেন। সেই টেস্ট্রেও পজিটিভ পাওয়া গেল। তখন মহিলা স্বপ্নে দেখলেন তাঁর পেটে যে সন্তান এসেছে সে কোনো মানবশিশু না। একটা সাপ। ভয়াবহ ছবি।

ইথেনের কি একই সমস্যা ছিল? ভুক্তিার পেটে সন্তান এই বিষয়ে সে যে নিশ্চিত ছিল তার একটা প্ৰমাণ আমার কাছে আছে। সে তার সন্তানকে একটি চিঠিও লিখে রেখে গিয়েছিল। চিঠিটা আমি হুবহু তুলে দিচ্ছি।

প্রিয় HCHO,

হ্যালো। তোমার নাম পছন্দ হয়েছে? ফরম্যালডিহাইড়। আমি তোমার মা আমার নাম ইথেন। আমি সাধারণ হাইড্রোকার্বন। অথচ তুমি হলে সুপার রিঅ্যাকটিভ ফরমালডিহাইড। পানিতে যদি ইথেন ছেড়ে দাও পানির কিছুই হবে না। পানি পানির মতো থাকবে। ইথেন থাকবে ইথেনের মতো। আর যদি পানিতে ফরমালডিহাইড ছাড়া-কত না কাণ্ড হবে।

তুমি পৃথিবীতে আসবে কত না কাণ্ড ঘটানোর জন্য। আফসোস তোমার এই কত না কাণ্ড দেখার সুযোগ আমার হবে না। কারণ আমি বেঁচে থাকব না।

ইতি তোমার মা।

মিসির আলি খাতা বন্ধ করলেন। ঘড়ির দিকে তাকালেন। রাত এগারোটা দশ।

তাঁর খাটের মাথায় নাসরিন বই-খাতা নিয়ে বসেছে। মিসির আলি যখন পড়েন। সেও তখন পড়ে। মিসির আলি আঁকে এর মধ্যেই বর্ণ পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। ছোট ছোট শব্দ সে এখন পড়তে পারে। লেখাপড়া শেখার প্রতি তার প্রবল আগ্রহ মিসির আলিকে মুগ্ধ করেছে।

নাসরিন বলল, খালুজান চা খাবেন? চা বানাব?

মিসির আলি বললেন, চা এক কাপ খাওয়া যেতে পারে।

নাসরিনের চোখে-মুখে আনন্দের আভাস দেখা গেল। এই মানুষটার জন্য যে কোনো কাজ করতে পারলেই তার ভালো লাগে।

নাসরিন।

জি খালুজান।

তোমার বুদ্ধি কেমন নাসরিন?

বুদ্ধি ভালো খালুজান।

কেমন বুদ্ধি পরীক্ষা হয়ে যাক। একটা ধাঁধা জিজ্ঞেস করব দেখি জবাব দিতে পার কি না।

কহেন কবি কালিদাস
পথে যেতে যেতে
নাই তাই খাচ্ছ
থাকলে কোথায় পেতে?

পারব না খালুজান।

তা হলে তো বুদ্ধি কম। আমি নিজেও পারছি না। আমারও তোমার মতোই বুদ্ধি কম।

নাসরিন গম্ভীর গলায় বলল, বুদ্ধি কম থাকন ভালো খালুজান।

মিসির আলি বললেন, বুদ্ধি কম থাকা মোটেই ভালো না। মানুষের বুদ্ধি হওয়া উচিত ক্ষুরের মতো।

ক্ষুরের মতো বুদ্ধি করে বলে?

ক্ষুরে যেমন ধার থাকে বুদ্ধিতেও থাকবে সেরকম ধার। যেমন সায়রা বানু। তোমার কি মনে হয় মেয়েটার বুদ্ধি বেশি না?

উনার বুদ্ধি খুবই ভালো কিন্তু উনার মাথাত গণ্ডগোল আছে। উনারে আমি বেজায় ভয় পাই।

কেন?

উনি রাইতে কেমন জানি করে। ঘুমায় না। কার সাথি যেন কথা কয়। পুরুষের মতো গলায় কথা কয়।

তুমি জান কীভাবে?

প্রথমে আমি উনার ঘরেই ঘুমাইতাম। আপা থাকে একা। উনার ঘরের মেঝেতে কম্বলের একটা বিছানা ছিল আমার জন্য। শেষে অ্যাপারে বলেছি আমি এইখানে থাকব না। আমার ভয় লাগে। তখন আপা আমারে অন্য ঘরে পাঠায়ে দিয়েছিল।

সায়রা মাঝে মাঝে পুরুষের গলায় কথা বলত?

জি।

কী বলত?

কী বলত জানি না। ইংরেজিতে কথা বলত। খালুজান আমারে ইংরেজি পড়া শিখাইবেন?

অবশ্যই শিখাব। তার আগে আসি চেষ্টা করে দেখি দুজনে মিলে ধাঁধার অর্থ বের করতে পারি কি না। কাহেন কবি কালিদাস … এই বাক্যটার কি কোনো রহস্য আছে? তিনটা শব্দই শুরু হয়েছে ক দিয়ে। কয়ের অনুপ্রাস। তিনটা ক। অঙ্কের কোনো ধাঁধা না তো?

খালুজান কালিদাস কে?

কালিদাস ছিলেন বিরাট কবি। মেঘদূত, শকুন্তলা এই রকম ছয়টা অতি বিখ্যাত কবিতার বই লিখেছিলেন। উনি মহারাজ বিক্রমাদিত্যের সভাকবি। বিক্ৰমাদিত্যের আরেক নাম দ্বিতীয় চন্দ্ৰগুপ্ত। বিক্রমাদিত্য নিজে ছিলেন পিশাচসিদ্ধ। একবার এক পিশাচ তাকে তিনটা প্রশ্ন করেছিল। পিশাচ বলেছিল এই তিনটা প্রশ্নের কোনো একটার জবাব ভুল দিলে আমি তোমাকে হত্যা করব। আর যদি তিনটা প্রশ্নেরই সঠিক জবাব দিতে পার আমি তোমাতে বশ হব। বিক্ৰমাদিত্য তিনটা প্রশ্নেরই জবাব দিতে পেরেছিলেন।

প্রশ্নগুলি কী খালুজান?

প্রশ্নগুলি এই মুহুর্তে মনে নাই। এইটুক মনে আছে প্রশ্নগুলি ছিল রহস্যময়। মহারাজা বিক্ৰমাদিত্যের উত্তর ছিল সহজ-সরল।

নাসরিন গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল, পিশাচ আপনেরে প্রশ্ন করলে পার পাইব না। আপনে পারবেন।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *