Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » কল্যাণী || Jibanananda Das » Page 5

কল্যাণী || Jibanananda Das

বাস্তবিক কল্যাণীদের বোর্ডিংটা মন্দ নয় —

মিশনারি মেমদের কেয়ারে মস্ত বড় নিরিবিলি বাড়িতে—আলো বাতাস মাঠ খেলা উঁচু উঁচু গাছ ক্রোটন ফার্ণ লতাপাতার ভিতর মন্দ থাকে কি তারা?—বিশেষত বাবা যখন দেড়শো টাকা করে মাসে পাঠান—ছোড়দা যখন সব সময়ই মোতায়েন—গল্পগুজব বন্ধুসংসর্গের আঁটি চুষতে কল্যাণী যখন এত ভালোবাসে।

কিন্তু এবার কলকাতায় এসে প্রথম দিনটা কল্যাণীর খুব কষ্ট লাগল-শালিখবাড়ি ছেড়ে স্টিমারে উঠে অব্দি তার মন চুনমুন করছে—ভালো লাগছে না কিছু—আবার বাড়ি ফিরে যেতে ইচ্ছে করে—বাবা মার জন্য কষ্ট হয়।

স্টিমারে কাঁদল সে।

কিশোর যখন স্টিমারে সেলুনে নিয়ে গিয়ে কল্যাণীকে ডিনার খাওয়াল—নিজে খেলে তখন মনটা তার কিছুক্ষণের জন্য তাজা হয়ে উঠেছিল—

কিশোর হুইস্কি খেলে— সোডার সঙ্গে মিশিয়ে কল্যাণীকে বললে— দেখ কি খাই

কল্যাণী বললে— ছোড়দা, ছিঃ!

কিশোর বললে—তুই খাবি? খা না—

কল্যাণীকে সোডার গেলাসটা এগিয়ে দিল সে—আধ পেগ আন্দাজ হুইস্কি ঢেলে।

কল্যাণী আগুন হয়ে উঠে বললে—ছোড়দা তোমার মাথা খারাপ হয়েছে! আমাকে তুমি এ সব কি দিচ্ছ!

—খুব ভালো জিনিস

কল্যাণী বললে—আমি নদীর মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দেব

—আহা, তা আর করতে হবে না—আহা হা

কিশোর এক চুমুকে গেলাসটা ফুরিয়ে ফেলল,

কল্যাণী বললে—–বাবাকে আমি লিখে দেব

কিশোর বাঁ চোখের ভুরু কুপনের দিকে খানিকটা তুলে নিয়ে বললে—হুম্—দিস্— কাটলেট চিবুচ্ছিল কিশোর।

–মেজদাকেও লিখব

শিকেয় তুলে রেখে দে! মেজদা? হুইস্কি না খেয়ে কোর্টে যায় কোনো দিন।

—মেজদা?

—হ্যাঁ তোমার ধর্মদাদা—

—মাইরি বলছ?

—মাইরি বলছি।

—আমি বিশ্বাস করি না।

—তুই নাই করলি যা

কিশোর (গেলাসে) আর একটা সোডার বোতল খসাল—

কল্যাণী বললে——ছোড়দা?

কিশোর হ্যা হ্যা করে হাসতে হাসতে বললে—এটা স্টিমারের সেলুন—এখানে বাবাও নেই—মাও নেই।

কল্যাণী আঘাত পেয়ে বাইরের দিকে তাকাল—অন্ধকার; বর্ষার শেষের খরস্রোতা নদী তিমিরাবৃত হয়ে কোন দিকে চলেছে যে—তার মুখ দেখতেও ভয় করে—স্টিমারের চাকার সেই জলেজলাকার মূর্তি ছিন্নবিচ্ছিন্ন ভীষণ হাহাকারে হৃদয় এমন বিহ্বল হয়ে ওঠে— নিজেকে এমন নিঃসহায় মনে হয়—

কিন্তু কল্যাণী দেখল ছোড়দার একেবারেই অন্য বরণ; বাইরের দিকে সে তাকাচ্ছেও না, না দেখছে নদীর মুখ, না শুনছে জলের দীর্নবিদীর্ণ রব, না পাচ্ছে মাঠ প্রান্তর আলেয়ার একটুখানি আভাস—বাপ মা ঢের দূরে পড়ে আছে বলে ছোড়দার ভালোই লাগছে। কেন যে এত ভালো লাগে ছোড়দার—কি যে তার প্রফুল্লতা—কোত্থেকে যে সে এত আমোদ পায় এত হৃদয়হীনভাবে ফুর্তি করে, কথা বলে, চীৎকার পাড়ে কিছুই বুঝে উঠতে পারল না কল্যাণী। ইলেকট্রিক বাতির নিচে, স্টিমারের সেলুন, হুইস্কি ও চুরুটের মধ্যে ছোড়দাকে যেন একটা বাঁদরের মত দেখাচ্ছে—সে যেন আর মানুষ নয়—মানুষের স্বাভাবিক হারিয়ে ফেলেছে যেন সে—ছোড়দার প্রাণে তাই কোনো ব্যথা নেই—আকুলতা নেই—ভাবনা নেই—স্বপ্ন নেই— নিস্তব্ধতা নেই—

কল্যাণী অবলম্বনহীন হয়ে কিশোরের দিকে তাকিয়ে রইল—

কিশোর বললে—বৃষ্টি পড়ছে না কি?

কল্যাণী বাইরের দিকে তাকিয়ে বললে—হ্যাঁ

—তোর শীত করছে?

—একটু একটু

কিশোর বললে—তাহ’লে নে–একটু খা

অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে সোডা হুইস্কি কল্যাণীকে এগিয়ে দিল কিশোর—

কল্যাণী আড়ষ্ট হয়ে বললে—আমি না তোমার বোন?

—তাহলেই বা

একটু পরে? তুই দেখছি বাবার মত হ’লি কল্যাণী

আরো একটু পরে; বাদলার দিনে একটু আধটু হুইস্কি খাওয়া আমি অপরাধ মনে করি না। আমার বৌকেও আমি খাওয়াব। তুমি বোন-আমার বৌয়ের চেয়েও বেশি কি?

অত্যন্ত কঠিন ক্ষমাহীন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কল্যাণীর দিকে তাকাল কিশোর। তারপর বাকীটুকু গেলাস চুপে চুপে ফুরোল!

কিশোরের শেষ হয়ে গিয়েছিল—

কল্যাণীকে বললে—চল্‌—একটু নিচে গিয়ে থার্ড ক্লাসের ফ্ল্যাটের থেকে ঘুরে আসি

কল্যাণী বললে—চল

কিশোর চুরুট মুখে দিল, কেবিনে ঢুকে রেন-কোটটা গায় দিয়ে দিয়ে বললে—তুইও কি ম্যাকিনটোশ নিবি?

কল্যাণী ঘাড় নেড়ে বললে—না

—শীত করছিল না?

—এখন আর করছে না।

—বৃষ্টি থেমে গেছে বুঝি

দু-জনে নিচে গেল

ইতস্ততঃ যথেষ্ট ভিড় ছড়িয়ে রয়েছে—গুদামের আশে পাশে কেরানীবাবুর ঘরের কিনারে—থার্ড ক্লাসের ল্যাবরেটরিগুলোর খানিক তফাতে মেয়ে পুরুষ ছোট ছোট ছেলেপিলেরা বিছানা মাদুর চট শতরঞ্চি পেতে হা করে কল্যাণী আর কিশোরকে দেখছিল

কিশোর বললে হ্যাংলা যত সব

দু’জন আধবয়সী বৈষ্ণবীকে কল্যাণী বললে—তোমাদের গায় জলের ছাঁট লাগছে যে! তার আপ্যায়িত হয়ে উঠল।

বললে–কি আর করা

কল্যাণী বললে—কোথায় যাচ্ছ

—নবদ্বীপ

—সেইখানে তোমাদের বাড়ি বুঝি?

—না, মা, তীথ্যি করতে

কিশোর বললে—কল্যাণী তুই ট্যালা হয়ে গেলি যে

কল্যাণী বললে—এই যে চেপে জল এল, এইবার বোষ্টমী তোমরা কি করবে—

দু’জন বৈষ্ণবঠাকুর কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়েছিলেন—উঠে বসে বললেন—কার আর কি রাধাবল্লভ যা করেন।

একটা বিড়ি জ্বালিয়ে বললে—রাধাবল্লভ এবার বড় হেনেস্থা করছে, বড় নিদয় এবার ঠাকুর।

বৃষ্টির মধ্যে তারা ভিজতে লাগল।

ক্যাক করে একটা শব্দ হ’ল।

কল্যাণী বললে—ও কি ছোড়দা

—আর কি মুরগি জবাই হচ্ছে

প্যানট্রির কাছ দিয়ে যেতে যেতে তারা দেখল গলাকাটা দু’টো মুরগিকে ছাড়ানো হচ্ছে—

কল্যাণী বললে—আহা, এই রকম করে এরা কাটে!

চলতে চলতে কিশোর বললে—এই দেখ হাঁস-মুরগির খাঁচা

কল্যাণী তাকিয়ে দেখল : অন্ধকারে—বাদলায় পাখিগুলো জড়সড় জীবস্মৃত হয়ে পড়ে—ভিজছে পাখিগুলো—

এই নিঃসহায় প্রাণীদের পাশে এসে কল্যাণী বাপ মা বাড়ির কথা ভুলে গেল সব; মনের ভিতর তার কেমন করছিল যেন; অন্ধকার—বৃষ্টি—বাইরের জলের কলরোল—মাঠ— তেপান্তর—পাড়াগাঁ—শ্মশান তার করুণ কল্পনাকে আরো কাতরতর প্রচুর খোরাক যোগাচ্ছিল।

এ রকম সব অভিজ্ঞতা তার জীবনে বড় একটা হয়নি।

এই সবের নতুনতা কল্যাণীকে অভিভূত করে ফেলতে লাগল।

কিশোর বললে—এই ট্যালা, লাল লাল ঝুঁটি বুঝি দেখিসনি কোনো দিন

—কল্যাণীর মুখে কথা জুয়াল না।

কিশোর বললে— চল

কল্যাণী ছোড়দার পিছে পিছে হাঁটতে লাগল—

একটি দাড়িআলা মুসলমান ছুরি দিয়ে আনারস কেটে যাচ্ছিল—সমস্ত বৈষ্ণব পরিবারটা হাপিত্যেশ করে সেই আনারসের দিকে তাকিয়ে—একটি তিন মাসের শিশুকে তার মা মাই দিচ্ছে। শিশুকে একেবারে উলঙ্গ রাখা হয়েছে—সোঁ সোঁ করে বাতাস বৃষ্টি তার কোনো ক্ষতি করছে না কি? নিউমোনিয়া যদি হয়? পাশেই একটা ফর্সা ছিপছিপে হাঁপিকাশের রুগীর বুকের দু’ দিকটার দু’টো পাঁজর ঝপট্ নির্বিবাদে ফ্ল্যাটের যে দিকে খুশি সে দিকে কাশি কফ।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *