আমরা দাঁড়িয়ে পড়লুম
আমরা দাঁড়িয়ে পড়লুম। তারপর টেনিদা মোটা গলায় বললে, হুঁ, উড়ম্বর।
উড়ম্বর?—আমি অবাক হয়ে বললুম, তার মানে কী?
মানে উড়ন্ত আক্রমণ—অম্বর হইতে। টেনিদা আরও গম্ভীর হয়ে বললে।
ষষ্ঠী তৎপুরুষ সমাস হতেই পারে না। আর অম্বর হইতে উড়ন্ত আক্রমণ—এ কিছুতেই উড়ম্বরের ব্যাসবাক্য নয়। তাছাড়া উড়ম্বর মানে—
শাটাপ-তক্কো করবি না আমার সঙ্গে। টেনিদা দুমদাম করে পা ঠুকল : আমি যা বলব তাই কারেকট, তাই গ্রামার। আমি যদি ক্যাবলা মিত্তির সমাস করে বলি, মিত্তির হইয়াছে যে ক্যাবলাসুপসুপা সমাস, তা হলে কে প্রতিবাদ করে তাকে একবার আমি দেখতে চাই।
বেগতিক বুঝে ক্যাবলা চশমাসুদ্ধ নাকটাকে আকাশের দিকে তুলে চিল-ফিল কী সব দেখতে লাগল, কোনও জবাব দিলে না। হাবুল সেন বললে, না, তারে দ্যাখতে পাইবা না। গাঁট্টা খাওনের লাইগা কারই বা চাঁদি সুড় সুড় কোরতেছে? কী কস প্যালা, সৈত্য কই নাই?
আমি হাবুলের মতোই ঢাকাই ভাষায় জবাব দিলুম, হঃ, সৈত্যই কইছস।
টেনিদা বললে, না, এখন বাজে কথা নয়। গোড়াতেই দেখছি ব্যাপার বেশ পুঁদিচ্চেরিমানে, দস্তুরমতো ঘোরালো। অথাৎ কম্বল মাস্টারের থাপ্পড়ের ভয়েই পালাক আর চাঁদে চড়বার চেষ্টাই করুক, সে নিশ্চয় কোনও গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে। তা না হলে একটা পচা আম অমন ভাবে আমার কান তাক করে ছুটে আসত না। বুঝেছিস, ওটা হল ওয়ার্নিং। যেন বলতে চাইছে, টেক কেয়ার, কম্বলের ব্যাপারে তোমরা নাক গলাতে চেয়ো না।
আমি বললুম, তা হলে আমটা ছুঁড়ল কে?
টেনিদা একটা উচ্চাঙ্গের হাসি হাসল, যাকে বাংলায় বলে হাই ক্লাস। তারপরে নাকটাকে কী রকম একটা ফুলকপির সিঙাড়ার মতো চোখা করে বললে, তা যদি এখুনি জানতে পারতি রে প্যালা, তা হলে তো রহস্যকাহিনীর প্রথম পাতাতেই সব রহস্য ভেদ হয়ে যেত। যেদিন কম্বলকে পাকড়াতে পারব, সেদিন আম কে ছুঁড়েছে তা-ও বুঝতে বাকি থাকবে না।
বললুম, আচ্ছা, ছাতে ওই যে কাকটা বসে রয়েছে, ওর মুখ থেকেও তো হঠাৎ আমটা—
ক্যাবলা বললে, বাজে বকিসনি। কাকে এক-আধটা আমের আঁটি ঠোঁটে করে হয়তো নিয়ে যেতে পারে, কিন্তু অত বড় একটা আম তুলতে পারে কখন? আর মনে কর, যদি ওই কাকটাকে ওয়েট লিফটিং চ্যাম্পিয়ন—মানে ওদের মধ্যেই ধরা যায়, তা হলেও কি আমটা ও বুলেটের মতো ছুঁড়ে দিতে পারে?
হাবুল ঘাড় নেড়ে বললে– যে কাগটা আম ফেইক্যা মারছে, সে হইল গিয়া ডিসকাস-থোয়িং-এর চ্যাম্পিয়ান।
টেনিদা হঠাৎ হাত বাড়িয়ে আমার আর হাবুলের মাথা কটাং করে একসঙ্গে ঠুকে দিলে। খুব খারাপ মুখ করে বললে, আরে গেল যা। এদিকে দিবা-দ্বিপ্রহরে কলকাতা শহরে আমার ওপর শত্রুর আক্রমণ আর এ দুটোতে সমানে কুরুবকের মতো বক বক করছে। শোন—একটাও আর বাজে কথা নয়। আমটা যে আমার দিকেই তাক করে ছোড়া হয়েছে। তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কোন্ বাড়ি থেকে ছুঁড়েছে সেটা বোঝা যাচ্ছে না বটে, কিন্তু খামকা আমার সঙ্গে লাগতে সাহস করবে, এমন বুকের পাটাও এ-পাড়ায় কারও নেই। টেনি শমাকে সকলেই চেনে। অতএব প্রতিপক্ষ অতিশয় প্রবল। সেইজন্যে মনে হচ্ছে, এখন। পচা আম পড়েছে, একটু পরে ধপাৎ করে একটা পেঁপেও পড়তে পারে। আর বড় সাইজের তেমন-তেমন একখানা পেঁপে যদি হয়, তা হলে সে চিজ যারই মাথায় পড়ক, আমরা কেউই অনাহত থাকব না।
হাবুল সেন বললে, আর দশ কিলো ওজনের একখানা পচা কাঁঠাল পড়লে সকলেরেই ধরাশায়ী কইর্যা দিব। যদি আত্মরক্ষা কোরতে চাও, অবিলম্বে এইখান থিক্যা পৃষ্ঠ প্রদর্শন কর।
যুক্তিটা অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী, আমরা আর দাড়ালুম না। চটপট পা চালিয়ে একেবারে চাটুজ্যেদের রকে।
টেনিদা কি বলতে যাচ্ছিল, ক্যাবলা বললে, না—এখানে নয়। রাস্তার ধারে বসে কোনও সিরিয়াস আলোচনা করা যায় না। চলো আমাদের বৈঠকখানায়। বাবা টুরে বেরিয়েছেন, কাকা গেছেন দিল্লিতে, বেশ নিরিবিলিতে বসে সব প্ল্যান ঠিক করা যাবে।
প্রস্তাবে আমরা একবাক্যে রাজি হয়ে গেলুম। সত্যিই তো, এখন আমাদের খুব সাবধানে চলাফেরা করতে হবে। শত্রুর চর সব সময় আমাদের গতিবিধির ওপর লক্ষ রাখছে কি না, কিছুই তো বলা যায় না। তা ছাড়া ক্যাবলার মা নানারকম খাবার করতে ভালোবাসেন, খাওয়াতেও ভালোবাসেন তাঁকেও তো একটু খুশি করা দরকার।
তা খাওয়াটা মন্দ জমল না। ক্যাবলার মা কেক তৈরি করছিলেন, গরম গরম আমাদের কেটে এনে দিলেন। হট কেকের সঙ্গে চাটা খেয়ে আমাদের মেজাজ খুলে গেল।
টেনিদা আমাদের লিডার বটে, কিন্তু সে অ্যাঁকশনের সময়। মাথা ঠাণ্ডা করে বুদ্ধি জোগাবার বেলায় ওই খুদে চেহারার ক্যাবলা মিত্তির। তা না হলে কি আর টপাটপ পরীক্ষায় স্কলারশিপ পায়!
ক্যাবলা প্রথমেই পকেট থেকে কম্বলের লেখার সেই নকলটা বের করল।
—টেনিদা, এই লেখাটার মধ্যে একটা সূত্র আছে মনে হয়।
টেনিদা বললে, আহা, সূত্র তো বটেই। পরিষ্কার লিখছে, নিরুদ্দেশ হচ্ছি। মাস্টারের ঠ্যাঙানি খাওয়ার ভয়ে যেদিকে হোক লম্বা দিয়েছে। কিন্তু কম্বলের মতো একটা অখাদ্য জীব চাঁদে গেছে, এ হতেই পারে না। আমি কখনও বিশ্বাস করব না—তা বদ্রীবাবুই বলুক আর কেদারবাবুই বলুক।
ক্যাবলা হিন্দী করে বললে, এ জী, জেরা ঠহরো না। আরে চাঁদ-উদ ছোড় দো, উতো বিলকুল দিল্লাগী মালুম হচ্ছে আমার, নীচের লেখাগুলোই একটু ভালো করে দেখা দরকার। ওদের কোনও মানে আছে।
আমি বললুম, ওই চাঁদ-চাঁদনিচক্রধর? তোর মাথা খারাপ হয়েছে ক্যাবলা। ওগুলো স্রেফ পাগলামি, ওদের কোনও মানেই হয় না।
বেশি ওস্তাদি করিসনি প্যালা, আমি কী বলছি তাই শোন। কম্বলকে আমরা সকলেই জানি। তার বিদ্যেবুদ্ধির দৌড়ও আমাদের অজানা নয়। সেদিনও সে আমায় জিজ্ঞেস করছিল, ইটালীর মুসোলিনী কি বেলাঘাটার মৃণালিনী মাসিমার বড় বোন? তার হাতের লেখা দেখলে উর্দু কিংবা কানাড়ী বলে মনে হতে থাকে। বন্ধুগণ একটু লক্ষ করলেই দেখা যাবে, যাকে স্রেফ পাগলামি বলে মনে হচ্ছে, তা হল লাইনের একটি কবিতা। তাতে ছন্দ আছে, মিলও আছে। কম্বলের সাধ্যও নেই ওভাবে ছন্দ মিলিয়ে, মিল রেখে, ছটা লাইন দাঁড় করায়।
হাবুল মাথা নাড়ল : হ, বুঝছি। আর কেউ লেইখ্যা দিছে।
ঠিক, আর কেউ দিয়েছে। কিন্তু খামকা লিখতে গেল কেন? নিশ্চয়ই ওর একটা মানে আছে।ক্যাবলা কাগজটা খুলে ধরে পড়তে লাগল : চাঁদ-চাঁদনিচক্রধর। চন্দ্রকান্ত নাকেশ্বর। নিরাকার মোষের দল—আচ্ছা টেনিদা?
টেনিদা বললে, ইয়েস।
আমার মাথায় প্ল্যান এসেছে একটা। একবার চাঁদনির বাজারে যাবে।
চাঁদনির বাজার!—আমরা তিনজনে একসঙ্গে চমকে উঠলুম। টেনিদা নাক কুঁচকে, মুখটাকে শোনপাপড়ির মতো করে বললে, কী জ্বালা, চাঁদনির বাজারে যেতে যাব কেন?
ক্যাবলা আরও বেশি গম্ভীর হল।
ধরো, সেখানে যদি চক্রধরকে পেয়ে যাই? কিংবা কে জানে চন্দ্ৰকান্তের সঙ্গেই দেখা হয়ে যেতে পারে হয়তো।
নাকেশ্বর বইস্যা থাকতে পারে—কেডা কইব?—হাবুল জুড়ে দিলে।
সবই হতে পারে-ক্যাবলা বললে, চলো না টেনিদা, ঘুরেই আসি একটু। যদি কোনও খোঁজ না-ই পাওয়া যায়, তাতেই বা ক্ষতি কী। ছুটির দিন, একটু বেড়িয়েই নয় আসা যাবে।
কিন্তু বেড়াবি কোথায়?—টেনিদা বিরক্ত হল : চাঁদনি তো আর একটুখানি জায়গা নয়। সেখানে চক্রধর বলে কেউ যদি থাকেই, তাকে কী করে খুঁজে পাওয়া যাবে?
এক পাল খড়ের ভেতর থেকে গোয়েন্দারা ছুঁচ খুঁজে বের করতে পারে, আর চাঁদনি থেকে একটা লোককে আমরা খুঁজে পাব না? এই কি আমাদের লিডারের মতো কথা হল? ছি-ছি, বহুৎ শরম কি বাত!
আর বলতে হল না তড়াক করে টেনিদা লাফিয়ে উঠল : চল তা হলে, দেখাই যাক একবার।
আমরা বেরিয়ে পড়লুম। চীনেবাদাম খেতে খেতে যখন চাঁদনির বাজারে যাওয়ার জন্যে ট্রাম চাপলুম, তখনও আমরা কেউ ভাবিনি যে সত্যি-সত্যিই আমরা এবার একটা রহস্যের খাসমহলের সামনে গিয়ে দাঁড়াব। আমাদের সামনে এমন দুরন্ত অভিযান ঘনিয়ে আসবে।
চাঁদনির বাজারে ঢুকে টেনিদা কেবল এক ভদ্রলোককে বোকার মতো জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল, মশাই, এখানে চক্রধর বলে কেউ-হঠাৎ হাবুল থাবা মেরে তাকে থামিয়ে দিলে। বললে– টেনিদা—টেনিদা—ওই যে! লুক দেয়ার!
একটি ছোট সাইনবোর্ড। ওপরে বড়বড় অক্ষরে : শ্রীচক্রধর সামন্ত। মৎস ধরিবার সর্বপ্রকার সরঞ্জাম বিক্রেতা। পরিক্ষা প্রার্থনীয়।
অবশ্য মৎস্যে য-ফল্য নেই, তাছাড়া লেখা রয়েছে পরিক্ষা প্রার্থনীয়। কিন্তু তখন বানান ভুল ধরার মতো মনের অবস্থা ক্যাবলার মতো পণ্ডিতেরও নেই। আমরা চারজনেই হাঁ করে সাইনবোর্ডটার দিকে চেয়ে রইলুম কেবল।