মায়ের চিঠি
দ্বিতীয় অধ্যায়
০১.
মায়ের চিঠির মধ্যে একটা অন্য চিঠিও এসেছে। অচেনা হাতের লেখা।
চিঠি লেখার অভ্যেস তো চলেই যাচ্ছে, হয় টেলিফোন, নয়তো ই-মেইল। টেলিফোনের চেয়েও ই-মেইল সস্তা। অবশ্য বাংলা ই-মেইল এখনও চালু হয়নি।
মায়ের সঙ্গে সপ্তাহে একদিন কথা হয় ফোনে। তবুমা চিঠি লেখেন। মা চিঠি লিখতে ভালবাসেন। সে-চিঠির উত্তর টেলিফোনে দিলে চলবে না। প্রত্যেক চিঠিতে লেখা থাকে, উত্তর দিবি। টাইপ করে নয়, নিজের হাতে লিখে উত্তর দিবি।
মা কেন হাতে লেখা চিঠি চান, তা বুঝতে পারে অবনী।
টেলিফোনের কথা চার-পাঁচ মিনিটে শেষ হয়ে যায়। কিন্তু প্রবাসী ছেলের হাতের লেখা চিঠি মা বার বার পড়েন। প্রত্যেকটা চিঠি জমিয়ে রাখেন তার গয়নার বাক্সে। এর আগে অবনী একবার শ্রীলঙ্কা গিয়েছিল, সেখান থেকে দু’খানা চিঠি লিখেছিল মাকে। সে বেশ কয়েক বছর আগের কথা। সেই চিঠি দুটোও মা জমিয়ে রেখেছেন।
আমেরিকায় বসে দিনের পর দিন বাংলা কথা বলারই সুযোগ হয় না। শনি-রবিবার দেখা হয় বাঙালি বন্ধুদের সঙ্গে। বাংলায় কিছু লেখার তো প্রশ্নই নেই।
মা অবশ্য মোটামুটি ইংরেজি জানেন। ইংরেজি ডিটেকটিভ গল্পের বই পড়েন। তবু মাকে ইংরেজিতে চিঠি লেখার কোনও মানে হয় না। মাকে লেখা চিঠিতেই অবনী কোনও ক্রমে বাংলা লেখার অভ্যেসটা বজায় রাখতে পেরেছে।
কিন্তু আজ একই খামে দুটো চিঠি।
অবনী মায়ের চিঠি পড়ার আগে অন্য চিঠিটাই পড়তে গেল। তলায় নাম লেখা, নিশা।
নিশা? এই নামে তো কারুকে চেনে না অবনী!
চিঠিটা এই রকম :
অবনীদা,
আপনি আমার চিঠিটা পেয়ে নিশ্চয়ই অবাক হবেন। আমাকে নিশ্চয়ই মনে নেই আপনার। মনে থাকার কথাও নয়। আপনার মাসতুতো বোন পৃথার আমি বন্ধু, এক সঙ্গে কলেজে পড়েছি। বছর পাঁচেক আগে আমরা চার বন্ধু মিলে আপনাদের বর্ধমানের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। ছিলাম দুদিন। আপনি তখন আমাকে দেখেছেন। আমার ডাকনাম খুকু, বন্ধুরা সবাই এই নামেই ডাকে।
এবারে আসল কথায় আসি। জানি, আপনি খুবই ব্যস্ত। তবু বাধ্য হয়েই আপনাকে এই চিঠি লিখছি। আমার বিয়ে হয়েছে সাড়ে চার বছর আগে। আমার স্বামীর নাম অরূপরতন দাস। বিয়ের দু’বছর পর তিনি একটি চাকরি পেয়ে আমেরিকায় চলে যান। চাকরির জন্য তাকে প্রায়ই জায়গা বদল করতে হয়। আমেরিকার বিভিন্ন শহর থেকে তার চিঠি পেয়েছি। শেষ চিঠি পেয়েছি নিউ ইয়র্ক স্টেটের বাফেলো শহর থেকে। পাঁচ মাস আগে। তারপর তার আর কোনও চিঠি আসেনি। ওঁর কোনও খবরই পাওয়া যাচ্ছে না। আমার শ্বশুর-শাশুড়ি জীবিত নেই, শুধু ওঁর এক দাদা-বউদি আছেন, তারাও কোনও খবর জানেন না। এজন্য আমরা দারুণ দুশ্চিন্তায় আছি। দাদা, আপনাকে বিরক্ত করার জন্য আমি লজ্জিত। ও-দেশে আমার চেনা আর কেউ নেই। আপনি যদি খোঁজখবর নিয়ে ওঁর সন্ধান পান, আমাকে জানালে চিরকৃতজ্ঞ থাকব।
ইতি
প্রণতা নিশা
চিঠিটা পড়ে প্রথমে খানিকটা বিরক্তিতে ভুরু কুঁচকে গেল অবনীর। আমেরিকা দেশটা যে কত বড় তা আমাদের দেশের অনেকেরই ধারণা নেই। আমেরিকা-কানাডা মিলিয়ে একটা মহাদেশ, এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে যেতে তিন ঘন্টা সময় বদলে যায়। এখানে লক্ষ লক্ষ বাঙালি, তার মধ্যে এক জনকে খুঁজে বার করা সম্ভব? এই অরূপ দাস আবার বিভিন্ন শহরে ঘুরে বেড়ায়।
মাঝে মাঝে শোনা যায় এ-রকম কাহিনি। এক-এক জন কীর্তিমান দেশে বিয়ে করে বউকে ফেলে এসে এখানে কোনও বিড়ালাক্ষী বিধুমুখীর সঙ্গে বসবাস শুরু করে। বেচারি স্ত্রীটি কিছু জানতেও পারে না।
এ-ও সেরকম কিছু ব্যাপার নাকি?
অবনীর ভুরু সোজা হয়ে গেল আবার। মেয়েটির মুখটা মনে করার চেষ্টা করল কয়েক মুহূর্ত। তার মাসতুতো বোন পৃথার কয়েকটি মেয়েবন্ধু একবার বর্ধমানের বাড়িতে এসেছিল বটে, তাদের মধ্যে এই মেয়েটি ঠিক কোনটি তা এখন বোঝা মুশকিল। কারুরই নাম মনে নেই।
মায়ের প্রত্যেক চিঠিই ঠিক তার আগের চিঠির মতো। নতুন কথা বিশেষ কিছু থাকে না। তুই কেমন আছিস, ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া হচ্ছে তো, শরীরের যত্ন নিবি ইত্যাদি। দেশের খবর এখন আর চিঠি পড়ে জানতে হয় না। ইন্টারনেটে সব খবর পাওয়া যায়।
এবারের চিঠিতে মা নিশার কথা লিখেছেন। তুই একটু খোঁজখবর নিস। মেয়েটা চিন্তায়-ভাবনায় রোগা হয়ে যাচ্ছে। আমার কাছে এসে কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলেছিল। নিশা খুব ভাল মেয়ে, ওর জন্য আমারও কষ্ট হয়। আমি যা চেয়েছিলাম, তা তো আর হল না।
মায়ের শেষ বাক্যটির মানে কী?
হঠাৎ বিদ্যুচ্চমকের মতো একটা কথা মনে পড়ে গেল।
মা কতবার যে অবনীর বিয়ের সম্বন্ধ করতেন, তার ইয়ত্তা নেই। একবার একটি মেয়েকে নিয়ে করা জন্য খুব ঝুলোঝুলি করেছিলেন। সে পৃথারই কোনও সহপাঠিনী। এই মেয়েটিই নয় তো? হ্যাঁ, খুব সম্ভবত এই নিশাই।
অবনী বিয়ের প্রসঙ্গ পাত্তাই দেয়নি কখনও। সেই সময় সে পিএইচডি নিয়ে ব্যস্ত ছিল খুব।
এবারে অবনীর মুখে একটা পাতলা হাসি ফুটে উঠল।
মজারই তো ব্যাপার। যে-মেয়ে তার বউ হলেও হতে পারত, সে এখন তার স্বামীকে খোঁজার জন্য অবনীর সাহায্য চাইছে।
নিশার স্বামী অরূপরতন দাস শেষ চিঠি লিখেছিল বাফেলো থেকে। বাফেলোতে গিয়ে তার খোঁজখবর করা অবনীর পক্ষে সম্ভব নয়। তার এখন দারুণ কাজ। পোস্ট ডক্টরেট করার সঙ্গে সঙ্গে তাকে এখন পড়াতেও হচ্ছে। এক দিনও ছুটি পাবার উপায় নেই।
চেনাশুনোর মধ্যে একমাত্র রেহানা থাকে বাফেলোতে। কয়েক মাসের মধ্যেই ও চলে যাবে ইস্ট কোস্টে। ওর স্বামীর সঙ্গে থাকতে পারবে এক শহরে। এখন ওরা দুজনে দুই প্রান্তে, টেলিফোনে খরচ হয় প্রচুর।
রেহানাকে তো আর বলা যায় না, তুমি অরূপরতন দাসকে খুঁজে বার করো।
একটা বিয়ারের ক্যান খুলে টিভির সামনে বসল অবনী। এদেশে এসে নিজের অজান্তেই টিভির নেশা হয়ে গেছে তার। কয়েকটা বিশেষ সোপ-সিরিয়াল না দেখলে ভাত হজম হয় না। এক্ষুনি শুরু হবে খবর। অনেকগুলো চ্যানেলেই খবর শোনা যায়, কিন্তু সি বি এস-এ পিটার ফিঞ্চের খবরই বেশি ভাল লাগে অবনীর। এটাও একটা নেশা।
আজ আর রান্নাবান্নার ঝামেলা নেই। কালকের অনেকখানি মাংস রয়ে গেছে। সেটা গরম করে পাঁউরুটি দিয়ে খেয়ে নিলেই হবে।
ফোনটা বেজে উঠতেই টিভি’র আওয়াজ কমিয়ে দিল অবনী।
কী করছিলেন? ব্যস্ত? রেহানার গলা।
অবনী বলল, একেই বলে টেলিপ্যাথি। আমি একটু আগেই তোমার কথা ভাবছিলাম।
ঝির ঝির করে হেসে উঠল রেহানা। হাসতে হাসতে বলল, জানি, কথাটা মোটেই সত্যি নয়। তবু শুনতে ভাল লাগে। একে বলে মধুর মিথ্যে। আপনি বেশ শিখে গেছেন তো।
রেহানা আর তার স্বামী এখানে এক রাত থেকে যাবার পর ওদের সঙ্গে সম্পর্কটা অনেক স্বাভাবিক হয়ে গেছে। আনোয়ারই জমিয়ে তুলেছিল। এখন বেশ স্বচ্ছন্দে ইয়ার্কি-ঠাট্টা করা যায়। আনোয়ারও ফোন করে মাঝে মাঝে।
অবনী বলল, না, এখনও ভাল করে শিখিনি। যা বললাম, সেটা কিন্তু সত্যি।
রেহানা বলল, সত্যি? তাহলে তো সেটা মোটেই ভাল কথা নয়। সন্ধ্যেবেলা এক জন বিবাহিতা মহিলাকে ধ্যান করা স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। এর মধ্যে কোনও গার্ল ফ্রেন্ড জোটাতে পারলেন না?
অবনী বলল, আমার সে-এলেম নেই। মেয়েদের সঙ্গে ভাল করে কথাই বলতে পারি না। তুমি তো কারুর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলে না!
আমি এত দূর থেকে কী করে আলাপ করাব? আপনি তো জহির সাহেবের আড্ডায় যান, ওখানে অনেক মেয়ে আসে শুনেছি। কারুর সঙ্গে ভাব জমাতে পারলেন না?
দু’এক জনের সঙ্গে একটু একটু ভাব হয়। তার পরই অন্য কেউ তাদের নিয়ে চলে যায়। আমি সকলের সঙ্গেই কমপিটিশানে হেরে যাই।
আহা রে, কী দুঃখের কথা! এ-দেশে কারুকেই তো একা থাকতে দেখি না। একা থাকলেই নাকি ডিপ্রেশান হয়। আপনি এক কাজ করুন, দেশে গিয়ে একটি শান্ত-শিষ্ট মেয়েকে বিয়ে করে আনুন।
কিন্তু আমি যে এক সময় প্রতিজ্ঞা করে ফেলেছি, সম্বন্ধ-করা বিয়েতে কখনও রাজি হবনা!
সে-প্রতিজ্ঞা ভেঙে ফেলুন। আপনার দ্বারা নিজে নিজে বিয়ে করা কোনও দিন সম্ভবহবে না। সে আমি বুঝে গেছি।
তুমি এরমধ্যে এতখানি বুঝে ফেলেছ? যাকগে, তুমি ফোন করলে…বিশেষ কোনও কারণ আছে কী?
বিনা কারণে বুঝি ফোন করা যায় না? মানুষ মানুষের খবর নেয় না? আপনি তো ভুলেও কখনও নিজে থেকে ফোন করেন না।
আমার অভ্যেস নেই। মনে মনে ভাবি, কিন্তু ফোন আর করা হয়ে ওঠে না।
মনে মনে ভাবলে লোকে জানবে কী কবে? টেলিপ্যাথি?
তা-ও তো হয়। এই তো আমি তোমার কথা চিন্তা করছিলাম, অমনি তুমি ফোন করলে।
এবার বলুন, কেন আমার কথা চিন্তা করছিলেন?
সেটা শুনলে তুমি বোধহয় রেগে যাবে।
রেগে যাব? কেন?
মানে ব্যাপারটা অতি সাধারণ। একজন একটা চিঠিতে বাফেলো শহরের কথা লিখেছে। বাফেলো নামটা দেখেই মনে পড়ল তোমার কথা। কারণ, ওখানে শুধু তোমাকেই চিনি।
কোয়াইট ওবভিয়াস। আমার সামনে যদি কেউ বর্ধমান শব্দটা উচ্চারণ করে, আপনার কথাই মনে পড়বে আগে। একে বলে অ্যাসোসিয়েশান! কী লিখেছে বাফেলোর কথা?
সেখানে এক জন থাকে। রেহানা, তুমি কি বাই এনি চান্স ওখানকার অরূপরতন দাস নামে কারুকে চেনো?
ভদ্দরলোক কি গান করেন?
তা আমি জানি না। ইন ফ্যাক্ট, আমি ভদ্রলোককে কখনও দেখিনি। চিনি না। আমার মা এর সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে বলেছেন।
এখানে রফিক নামে আমাদের নারায়ণগঞ্জের একটি ছেলে থাকে। তার ওখানে প্রায়ই গান-বাজনা হয়। সেখানে কলকাতার এক ভদ্রলোক এক দিন অনেকগুলি গান শোনালেন, বেশ ভাল গান করেন, নামটা বোধহয় অরূপ না অপূর্ব কী যেন ঠিক মনে নেই।
তাহলে তুমি কি একবার ওই রফিককে জিজ্ঞেস করবে, সেই গায়কটির নাম অরূপরতন কিনা, আর সে এখনও বাফেলোতে আছে কিনা? যদি তোমার খুব অসুবিধে না হয়– ।
খুবই অসুবিধা হবে। ভূতের ব্যাগার কাকে বলে জানেন?
ঠিক আছে, ঠিক আছে, তোমাকে খোঁজ নিতে হবে না।
এবার আমি কেন ফোন করেছি, বলি? আমি এই শনিবার ওয়াশিংটন ডি সি যাচ্ছি। আনোয়ারও আসবে সেখানে। আনোয়ার আপনাকে জিজ্ঞেস করতে বলেছে, আপনি যাবেন? আপনি তো আমেরিকায় এসে এ পর্যন্ত কিছুই দেখলেন না। এমনকী নায়েগ্রা ফল্সও দেখতে এলেন না।
এই শনিবার? নাঃ, সম্ভব না। অনেক কাজ।
উইক এন্ডেও কাজ? সোমবারও ছুটি। এটা লং উইক এন্ড।
আমার প্রফেসরের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা আছে। রবিবার সারা দিন কাটাতে হবে ওঁর সঙ্গে।
তাহলে আপনি কাজই করুন। যেতে হবে না। আজ কী রান্না করেছেন? নাকি আজও খিচুড়ি।
না, কালকের মাংস লেফট ওভার আছে। এবার আমার জিজ্ঞেস করা উচিত, তুমি কী রান্না করেছ, তাইনা?
আমি কিছুই রান্না করিনি। অর্ডার দিয়েছিলাম, এইমাত্র পিৎসা ডেলিভারি দিয়ে গেল।
তাহলে খেয়ে নাও। পিৎসা ঠাণ্ডা হয়ে গেলে খাওয়া যায় না।
ঠিক আছে, বাই-ই।
ফোন রেখে দিল অবনী। এর মধ্যে খবর শেষ হয়ে গেছে টিভিতে। এখন দেখানো হচ্ছে ফুটবল। এই খেলাটা অবনী একেবারে পছন্দ করে না। হাত দিয়ে খেলে, তবু এর নাম ফুটবল?
বিয়ারের ক্যানটা ফুরিয়ে গেছে। আর একটা বিয়ার খাবে কি খাবেনা এই দোনামনা করতে করতে অবনী রান্নার জায়গায় গিয়ে স্টোভটা জ্বালাল। মাংসটা গরম করতে হবে।
প্রবাস জীবনে সব চেয়ে কষ্টকর, এই একা একা খাওয়া।
দেশে খাবার সময় খেতে বসলে মা পাশে দাঁড়াবেনই। তাছাড়াও কেউ না-কেউ এক সঙ্গে বসেই।
এখানে দিনের পর দিন একই রকম নিঃসঙ্গতা। সেই জন্যই যারা একা থাকে, তার সবসময় টিভি চালিয়ে রাখে। তবু তো মানুষের কণ্ঠস্বর শোনা যায়।
এর মধ্যে অন্য মনস্ক ভাবে অবনী আর একটা বিয়ার খুলে ফেলেছে।
দেশে থাকতে তার এসব অভ্যেস ছিল না। কিন্তু এখানে বিয়ারকে কেউ মদ বলে গণ্য করেনা। আমেরিকান বিয়ার অবশ্য খুব পাতলা, অ্যালকহল কনটেন্টও কম। অনেকটা জলেরই মতো।
মিনিট দশেকের মধ্যে আবার টেলিফোন বাজল। আবার রেহানা।
সে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল, এবার শুধু কাজের কথা। রফিককে জিজ্ঞেস করলাম। সেই গায়ক ভদ্রলোকের নাম অরূপরতন দাস ঠিকই। রফিকের সঙ্গে একই বাড়িতে অন্য অ্যাপার্টমেন্টে থাকেন। কদিন আগে ভদ্রলোকের পা ভেঙে গেছে, প্লাস্টার করে শুয়ে আছেন বাড়িতে। আর কিছু খোঁজ নিতে হবে?
থ্যাঙ্কস। হঠাৎ তুমি ভূতের ব্যাগার খাটতে গেলে কেন?
আপনার মা খোঁজ নিতে বলেছেন, সেটা ভূতের ব্যাগার?
তুমিই তো বললে?
আপনি কেন জিজ্ঞেস করলেন, আমার অসুবিধে হবে কিনা? বেশি বেশি ভদ্রতা! খুব আমেরিকান কায়দা শিখে গেছেন, না?
আমেরিকায় থাকতে গেলে তো কিছু কিছু কায়দা শিখে যেতেই হয়। এসব কথা এমনিই মুখে এসে যায়।
বাঙালিদের মুখে থ্যাঙ্কস শুনতেও আমার ভাল লাগে না।
তুমি কিন্তু সত্যি খুব উপকার করলে রেহানা। শনিবার মাকে ফোন কবব।
আপনার মা ওই ভদ্রলোক সম্পর্কে… বিয়ে-টিয়ের ব্যাপার নাকি?
না না, ভদ্রলোক বিবাহিত। অনেকদিন বাড়িতে চিঠিপত্র লেখেন না। গায়ক মানুষ, খেয়াল থাকে না বোধহয়। তাছাড়া পা ভেঙে শুয়ে আছেন।
পা ভাঙলে চিঠি লেখা যায় না, এমন কখনও শুনিনি। তাছাড়া পা ভাঙলে ফোন করাও যেতে পারে।
তুমি ভদ্রলোকের ফোন নাম্বারটা জোগাড় করে দিতে পারো?
আবার আমার ওপর দায়িত্ব চাপানো হচ্ছে? আমি রফিকের ফোন নাম্বার দিয়ে দিচ্ছি, বাকিটা আপনি নিজে ব্যবস্থা করুন মশাই।
সেই ভাল। রফিককে আমি চিনি না। তাকে ফোনে এসব কথা জিজ্ঞেস করলে কিছু মনে করবেন না আশা করি।
রফিকের সঙ্গে আলাপ হলে বুঝবেন, সে হচ্ছে ভদ্রতার প্রতিমূর্তি। খাঁটি জেন্টলম্যান। সেই জন্য বন্ধুরা তার নাম দিয়েছে জেন্টু। বিশ্বসুদ্ধ মানুষের উপকার করার দায়িত্ব সে নিজের কাঁধে নিয়েছে। দেশ থেকে যারা প্রথম আসে, অনেকেই রফিকের কাছে ওঠে। দু’তিন মাস বিনা পয়সায় খায়-দায়। এখনও তো একটা ছেলে ওর বাসায় আছে।
তাহলে তো ওঁর সঙ্গে আলাপ করতেই হবে। পিৎসা খাওয়া শেষ হয়ে গেছে তোমার?
এখনও খাচ্ছি।
খাওয়ায় মন দাও। তোমার স্বামীটিকে বলো, এবার যেতে পারলাম না। পরে একবার এক সঙ্গে বেড়াতে যাব। তুমি ভাল করে ঘুরে এসো।
খোদা হাফেজ।
এত সহজে কাজ উদ্ধার হয়ে যাবে, অবনী আশা করেনি। খবরটা না দিতে পারলে মা প্রত্যেক চিঠিতে একই কথা লিখবেন। নিশা নামের মেয়েটিকে যেন একটু একটু মনে পড়ছে। বেশ লম্বা, প্রায় ছেলেদের মতো ছোট করে চুল কাটা, চোখ দুটোতে ঘুম ঘুম ভাব। বর্ধমানে বেড়াতে এসে সে-ই তো গান গেয়েছিল।
প্রবাসী স্বামী যদি চিঠি না লেখে, অনেকদিন খোঁজখবর না নেয়, সেটা মেয়েদের পক্ষে অপনামজনক ব্যাপার। লোকে নানা রকম ভাবতে পারে। অরূপরতনের ফোন নাম্বার জানিয়ে দেবে, তারপর নিশা নিজেই ফোন করতে পারবে। এরপর আর অবনী ওদের ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাতে চায় না।
খাবারের প্লেটটা হাতে নিয়ে অবনী জানলার কাছে এসে দাঁড়াল।
শীত শেষ হয়ে গেছে। কাগজে-কলমে এখন বসন্ত। তবু দু’দিন আগে হঠাৎ কিছুক্ষণ তুষারপাত হয়েছিল। এখন অবশ্য আর কোথাও বরফ জমে নেই। ফুল ফুটতে শুরু করেছে।
আকাশ খুব নীল। এখানকার বসন্তকালেও গায়ে সোয়েটার পরতে হয়। কলকাতায় নিশ্চয়ই এর মধ্যে বেশ গরম পড়ে গেছে। কত দূরে কলকাতা!
.
০২.
একটা পায়ে পুরো প্লাস্টার, হাঁটতে হয় ক্রাচ নিয়ে। বেশিক্ষণ শুয়ে থাকার ধৈর্য নেই অরূপের। পাঁচমিনিট বই পড়ার পরই উঠে বসে। টিভি খোলে, চ্যানেল বদলে বদলে পছন্দমতো প্রোগ্রাম না পেলে একটা গানের সিডি চালিয়ে দেয়। অন্য সময় সর্বক্ষণ এখানে-সেখানে ঘোরাঘুরি করা অভ্যেস, এখন বাধ্য হয়ে নিজের ঘরে বন্দি।
একখানা ঘর, সঙ্গে বাথরুম আর রান্নার জায়গা। শোওয়ার আলাদা খাট নেই, সোফাকাম-বেড, এ-দেশে তাকে বলে ড্যাভেনপোর্ট। দিনেরবেলা সেটা গুটিয়ে রাখতে হয়। ঘরের সব কিছুই এলোমেলে। এরকমই অরূপের স্বভাব। মুখ মোছার পর তোয়ালেটা হাত থেকে মেঝেতে পড়ে গেলে সেখানেই পড়ে থাকে।
বাথরুমে বসে দরজার বেল শুনতে পেল অরূপ।
একা থাকে বলে বাথরুমের দরজা বন্ধ করে না। দরজা বন্ধ থাকলে শুনতে পেত না বেলের আওয়াজ।
ক্রাচ না নিয়েই এক পায়ে লাফাতে লাফাতে এসে সে দরজা খুলে দিল।
খোলার পর এক মুহূর্তের জন্য তার মুখে একটা ছায়া খেলে গেল। সে অন্য এক জনকে প্রত্যাশা করেছিল।
পরের মুহূর্তেই ঝলমলে হাসি দিয়ে বলল, আসুন, আসুন রফিক সাহেব।
রফিক অরূপের প্রতিবেশী, থাকে নিচের তলার অ্যাপার্টমেন্টে। তার সুন্দর স্বাস্থ্যবান চেহারা, মাথার চুল পাট করে আঁচড়ানো, সারা বছরই সে পুরো মোজা-জুতো না পরে সে ঘর থেকে বেরোয় না।
তার তুলনায় অরূপ যেন ঠিক বিপরীত। সে বেশ রোগা ও লম্বা, নাকটাও বড়, তবে মুখখানি অসুন্দর নয়, বুদ্ধির ছাপ আছে। মনে হয় যেন চুল আঁচড়ায় না সাতজন্মে, কপালের ওপর এসে পড়ে চুল, কথা বলতে বলতে আঙুল দিয়ে চুল সরানো তার মুদ্রাদোষ। সে বাড়ি থেকে চটি পায়ে বেরিয়ে পড়তে পারে অনায়াসে।
এখন তার মুখে কয়েক দিনের খোঁচা খোঁচা দাড়ি।
ভেতরে এসে রফিক বলল, আপনি আমাকে সাহেব সাহেব বলেন কেন? শুধু রফিকই তো যথেষ্ট।
অরূপ বলল, ঠিক। তাহলে তো আপনি বলাও তো চলে না। এখন থেকে তুমি বলব আমরা।
রফিক বলল, আপনাকে অরূপদা বলে ডাকব। আপনি আমার চেয়ে বয়সে বড়।
অরূপ বলল, আরে, ও-সব বয়স-টয়স ছাড়ো। এ-দেশে সবাই সবাইকে নাম ধরে ডাকে। প্রথম এ-দেশে এসে বাবা-জ্যাঠামশাইয়ের বয়সী লোকেরা যখন কত শুধুনাম ধরে পল কিংবা হ্যারি বলে ডাকতে, খুবঅ স্বস্তি হত। দাঁড়িয়ে কেন, বোসো রফিক!
রফিকের হাতে একটার বড় পেপার ব্যাগ। সেটা নামিয়ে রেখে বলল, আপনার জন্য আলু ফুলকপি, কিছু ভেজিটেবল, কিছু মাছ আর চিকেন নিয়ে এসেছি। আপনি তো শপিং করতে যেতে পারছেন না।
ব্যাগটার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে অরূপ বলল, ওরে বাবা, এ তো অনেক জিনিস। বিয়ারও রয়েছে কয়েকটা। সত্যি, তোমার তুলনা নেই। ঠিক মনে করে এসব নিয়ে এসেছ।
আপনি আটকা পড়ে আছেন ঘরের মধ্যে।
আমার স্টক ছিল, ফুরিয়ে এসেছে। আজ সকালেই ভেবেছিলাম তোমাকে রিকোয়েস্ট করব। তার আগেই তুমি নিয়ে এলে? আমার প্রতিবেশী ভাগ্য এমন ভাল। হ্যাঁ, সব মিলিয়ে কত লেগেছে?
সে ঠিক আছে, এমন কিছু নয়।
না, রফিক, তুমি মনে করে নিয়ে এসেছ, এ-জন্যই আমি গ্রেটফুল। দাম নিতে হবে।
ঠিক আছে, পরে দেবেন। আপনি তো দু’চার দিনের মধ্যে বেরুতে পারছেন না। আরও তো কিছু কিছু বাজার লাগবে। আমি হিসেব রাখব।
ঠিক হিসেব রাখতে হবে কিন্তু! দু’বোতল স্কচ এনে দিও। একদম ফুরিয়ে গেছে।
সন্ধের সময় পেলে চলবে?
হ্যাঁ হ্যাঁ, আজ না হয় কাল পেলেও।
আপনার প্লাস্টার কবে কাটবে?
আরও এক মাস তো লাগবেই। কম্পাউন্ড ফ্র্যাকচার। খুব জোর বেঁচে গেছেন। গাড়িটায় যদি স্পিড বেশি থাকত। আমার আরও এ-রকম অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে আগে। প্রত্যেক বারই বেঁচে যাই। মুচকি মুচকি হাসতে লাগল অরূপ। যেন অ্যাকসিডেন্ট হওয়াটা একটা আনন্দের ব্যাপার। তারপর দুটো বিয়ারের ক্যান তুলে নিল।
রফিক বলল, আমি কিন্তু খাব না এখন।
অরূপ বলল, আরে বোসো, বোসো। অত তাড়া কীসের?
রফিক বলল, একটু তাড়া আছে ঠিকই। তাছাড়া দিনেরবেলা আমি পান করি না।
অরূপ বলল, এ-সবের আবার দিন আর রাত্তির কী! অমৃতে কখনও অরুচি হয়?
দু’জনেই হেসে উঠল। কিন্তু রফিক বসল না।
দরজার কাছে গিয়ে বলল, যখন যা কিছু লাগবে, আমাকে জানাবেন। প্লিজ ডোল্ট হেজিটেট।
অরূপ বলল, আবার আপনি?
রফিক বলল, অভ্যেস হতে দু’এক দিন সময় লাগবে।
রফিক চলে যাবার পর দরজা বন্ধ করেও আবার ব্যস্ত হয়ে দরজা খুলে মুখ বাড়িয়ে চেঁচিয়ে বলল, রফিক, রফিক, প্লিজ, আর একটা কাজ করে দিতে হবে।
সিঁড়ি থেকে ফিরে এল রফিক।
ড্রয়ার খুলে একটা চেক বার করে রফিকের হাতে দিয়ে বলল, এটা আমার ব্যাঙ্কে জমা করে দেবে প্লিজ?
স্বাভাবিক ভাবেই চেকটায় চোখ বোলাল রফিক। এবং চমকে উঠল। কুড়ি হাজার পাঁচশো ডলার। একসঙ্গে এত টাকা?
অরূপের মুখের দিকে তাকাল।
কিন্তু অরূপ কোনও ব্যাখা দিল না বলে রফিকও ভদ্রতা বজায় রেখে জিজ্ঞেস করল না কিছু।
আবার দরজা বন্ধ করে বিয়ারের ক্যান খুলে সিগারেট ধরাল অরূপ। ঘণ্টা খানেক পরে আবার বেল বাজল। এবারে এসেছে আকাঙিক্ষত অতিথি। উজ্জ্বল হয়ে উঠল অরূপের মুখ।
একটি তরুণী, এ ও বেশ দীর্ঘাঙ্গিনী, একটা সবুজ ঢোলা পোশাক পরা, চুলের রঙ সোনালি, ঠোঁটেও প্রায় ওই রকম কাছাকাছি রঙের লিপস্টিক, দু’দিকে কাঁধে তিনটে ঝোলা ব্যাগ।
অরূপ বলল, হাই সুইটি!
মেয়েটির নাম লিজ, সে-ও হাই বলে নিজের গালটা ফেরাল অরূপের ঠোঁটের দিকে।
তারপর ভেতরে এসে ঝোলা ব্যাগগুলো ছুঁড়ে ফেলে বলল, আই অ্যাম স্টার্ভিং! দারুণ খিদে পেয়েছে। আমি কলিফ্লাওয়ার ফ্রায়েড খাব। আই লাইক ইট সো মাচ!
অরূপ বলল, ফুলকপি ভাজা।
লিজ ইংরিজিতে বলল, হ্যাঁ, পুল-কো-প্পি বাজা! আমি এত ভালবাসি, আগে কখনও খাইনি, এত ভাল লাগে, রাস্তা দিয়ে আসতে আসতে ভাবছি, অরূপের কাছে গিয়ে ফুলকপি ভাজা খাব।
অরূপ বলল, এই রে, ফুলকপি কি আছে আমার ফ্রিজে?
লিজ বলল, না থাকলে আমি এক দৌড়ে সুপার মার্কেট থেকে কিনে আনব।
অরূপ বলল, না না, আছে।
রফিক একটু আগে দিয়ে গেল।
লিজ বলল, তুমি চুপ করে বসে থাকো। আমি ভেজে ফেলছি।
অরূপ বলল, তুমি পারবে না। আমরা দু’রম ফুলকপি ভাজা খাই। সোজাসুজি ভাজা আর ব্যাসনে ডুবিয়ে ভাজা। তুমি তো দ্বিতীয়টাই পছন্দ করো। তুমি ব্যাসন গুলতে পারবে না।
লিজ বলল, ঠিক পারব। আগের দিন দেখেছি। আমার মাকে ফোন করেছিলাম। তখন বললাম, মা, তুমি কখনও কলিফ্লাওয়ার ফ্রাই করে খেয়েছ? গ্রেট, গ্রেট! মা জিজ্ঞেস করল, রেসিপি কী রে? মা ব্যাসন কাকে বলে বুঝতে পারল না।
অরূপবলল, ব্যাসন তো ইন্ডিয়ান স্টোর ছাড়া পাওয়া যায় না। তোমার মাকে খানিকটা পাঠিয়ে দেব বরং।
রান্নাঘর বলতে কিছু নেই। বাথরুমের পাশে এক চিলতে রান্নার জায়গা, দুটো গ্যাস স্টোভ, সামান্য কিছু বাসনপত্র।
লিজ টপাটপ ফুলকপি কুটে, ব্যাসন গুলে ফেলল। তারপর স্টোভ জ্বেলে কড়াই চাপিয়ে বলল, ডু য়ু মাইন্ড, যদি আমার পোশাকটা খুলে রাখি? তেল ছিটকে লাগতে পারে।
অরূপ বলল, হ্যাঁ, খুলে রাখো।
লিজ তার লম্বা পোশাকটা খুলে ভাঁজ করে রাখলো সযত্নে। তলায় প্যান্টি ছাড়া আর কিছু নেই। সে ব্রা পরে না, তার স্তন দুটি অতিরিক্ত বড়।
বুক খোলা, তাতে সামান্যতম লজ্জার ভাবও নেই তার। কড়াইতে তেল ঢালতে ঢালতে লিজ বলল, আজ আমাকে পর পর তিনটে ক্লাস নিতে হয়েছে। আ অ্যাম সো টায়ার্ড অ্যান্ড হাংগ্রি।
অরূপ বলল, এই, কপিতে নুন মাখাবে না?
লিজ বলল, ব্যাক সিট ড্রাইভিং-এর মতো তুমি ওখান থেকে নির্দেশ দিও না প্লিজ। ওদিকে গিয়ে বসো। আমি ভেযে নিয়ে আসছি। ব্যাসনে একটু নুন দিয়ে দিয়েছি, তাতে ভাল স্বাদ হয়।
তবু গেল না অরূপ। পেছন থেকে লিজকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে তার ঘাড়ে চুমু খেতে খেতে বলল, তোমার কাছ থেকে যে সরে যেতে ইচ্ছে করে না!
লিজ বলল, এই, এই দুষ্টু ছেলে, ও-রকম করলে কি রান্না হয়? বিরক্ত কোরো না।
অরূপ গান গেয়ে বলল, একটি চুম্বন দাও, সখী একটি চুম্বন দাও।
লিজ মুখ ফেরাল। তার ঠোঁটের বাঁ-কোণে একটি বড় আঁচিল, সেটা ঘিরে কিছু ছোট ছোট লোম। তার মুখখানি অসুন্দর নয়, শুধু ওই একটাই খুঁত। ওইটুকুর জন্যই আমেরিকান যুবকেরা তার সঙ্গে ডেট করে না।
চুম্বনটি সমাপ্ত করার পর লিজ বলল, যাও এবার, আমার ব্যাগটা খুলে দেখো, তোমার জন্য কী এনেছি!
অরূপ ঠিক বুঝতে পেরেছে, সে শুদ্ধভাবে এক পায়ে লাফাতে লাফাতে গিয়ে নিজের ব্যাগ ঘাঁটতে লাগল। দুটো ঝোলা ব্যাগই বই-খাতাপত্রে ভর্তি। লিজ দারুণ পড়াশুনো করে। সোসাল সায়েন্সে পিএইচডি করার পর সে আবার সাইকোলজির কোনও একটা বিষয় নিয়ে পিএইচডি শুরু করছে।
ছোট হ্যান্ডব্যাগটায় পাওয়া গেল একটা পুরিয়া। অরূপ উল্লসিত ভাবে জিজ্ঞেস করল, কোথা থেকে জোগাড় করলে?
লিজ বলল, নিক নামে ছেলেটাকে মনে আছে? সে দিয়েছে। নিয়মিত সাপ্লাই দেবে বলেছে।
অরূপ একটা সিগারেট নিয়ে টিপে টিপে ভেতর থেকে বার করে ফেলল সব তামাক। তারপর তার মধ্যে ভরতে লাগল গাঁজা।
গরম তেলে ফুলকপি ভাজার চড়বড় শব্দ হচ্ছে, আর অরূপ গুন গুন করে গান করতে করতে গাঁজা সাজছে।
সম্পূর্ণ হবার পর সেটা ধরিয়ে লিজের কাছে এসে বলল, এই নাও!
প্রথম টানটা লিজ দেবে। হাত মুঠো করে সে বেশ জোরে টানতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে তার চোখ দুটো লাল হয়ে যায়।
লিজ জিজ্ঞেস করল, তুমি উডস্টফের কথা জানো?
অরূপ বলল, হ্যাঁ, জানবনা কেন?
লিজ বলল, উডস্টফের মতোই একটা বিরাট গান-বাজনার আসর হচ্ছে ক্লিভল্যান্ডে, তুমি গান এত ভালবাসো, ওখানে গেলে তোমার খুব ভাল লাগত! কিন্তু ভাঙা পা নিয়ে যাবে কী করে?
অরূপ বলল, ভাঙা পা তো কী হয়েছে? তোমার গাড়িতে যেতে পারি।
পারবে?
অফ কোর্স পারব। কাল সিঁড়ি দিয়ে একবার নিচে নেমেছিলাম। কোনও অসুবিধে হয়নি।
তাহলে চলো, চলো!
তুমি ছুটি পাবে?
অরূপ, আমি ছুটি-ফুটি গ্রাহ্য করিনা। ইচ্ছে হয়েছে, যাব, ব্যাস, সোজা কথা! শুধু একটাই মুশকিল, বেশ কিছু টাকা-পয়সা লাগবে, টিকিটই তিনশো ডলার, তাছাড়া অত দূরে যাওয়া, গাড়ির গ্যাস, খাওয়া-দাওয়া।
টাকার জন্য চিন্তা? কত টাকা লাগবে? আমার হাতে এখন অঢেল টাকা। তুমি টাকার জন্য একদম চিন্তা করবে না লিজ।
তুমি কোথা থেকে টাকা পেলে?
চেকটা এসে গেছে।
এসে গেছে? এত তাড়াতাড়ি। ও গ্রেট, গ্রেট!
একহাতে খুন্তি, সেটা নিয়েই লিজ জড়িয়ে ধরল অরূপকে। দুজনের শরীরে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। যেন একটা দারুণ ষড়যন্ত্র সফল হয়েছে, এই ভাবে হাসতে লাগল ওরা।
অরূপ জিজ্ঞেস করল, ক্লিভল্যান্ডের উৎসবটা শুরু হচ্ছে কবে?
লিজ বলল, পরশু দিন। চলবে তিন দিন। তাহলে কবে যেতে চাও?
অরূপ বলল, আজই। দেরি করে কী লাভ?
লিজ বলল, কিছু জিনিসপত্র কিনে নিতে হবে। কাল সকালে স্টার্ট করা যায়।
অরূপ বলল, না না, আজই। এক্ষুনি! জিনিসপত্র আবার কী? চেকটা জমা পড়ে গেছে। ক্রেডিট কার্ড নিয়ে বেরিয়ে পড়লেই হবে। জিনিসপত্র সব পাওয়া যাবে রাস্তায়। চলো, চলো লিজ। ঘরে আটকে থাকতে আমার আর একটুও ভাল লাগছে না।
পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মধ্যে ওরা দুজন বেরিয়ে পড়ল দীর্ঘ যাত্রায়।
.
০৩.
ফোনটা বাজতেই অবনী ভাবল রেহানার কথা। এই রকম সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরে অবনী রান্নাবান্নার জোগাড় করে, তখনই রেহানা ফোনে নানা রকম উপদেশ দেয়।
ফোনটা তুলে প্রথম গলা শুনে অবনী দারুণ চমকে উঠল। অন্য মেয়ের কণ্ঠস্বর। এ পর্যন্ত রেহানা ছাড়া আর কোনও মেয়ে তাকে নিজে থেকে ফোন কবেনি।
দাদা, আমি নিশা।
নিশা! নিশা মানে?
আপনাকে আমি চিঠি লিখেছিলাম। আপনি উত্তরও দিয়েছিলেন।
ও হ্যাঁ, তুমি কোথা থেকে কথা বলছ?
বোস্টন থেকে।
বোস্টন থেকে! তুমি এখানে কবে এলে?
আজই। এই মাত্র। গ্রে হাউন্ড বাস স্টেশনে এখন রয়েছি।
তুমি আমেরিকায় কবে এসেছ? কিছু খবর পাইনি তো।
আজ সকালেই নিউইয়র্ক পৌঁছেছি। খবর দিতে পারিনি আগে। দাদা, খুব বিপদে পড়ে আপনার সাহায্য চাইছি।
ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছি না। তুমি হঠাৎ আমেরিকা এলে, নিউ ইয়র্ক থেকে এখানে এলে কেন?
সব আপনাকে বুঝিয়ে বলব। এখন কি একবার আপনার বাড়িতে যেতে পারি?
কী করে যাব যদি বুঝিয়ে দেন। ঠিকানাটা আছে আমার কাছে। ট্যাক্সি ড্রাইভারকে বললে…।
দাঁড়াও, দাঁড়াও, আমার বাড়ি খুঁজে পাওয়া একটু মুশকিল। ট্যাক্সি অনেক ঘোরাবে। তুমি গ্রে হাউন্ড স্টেশনেই থাকো। আমি আসছি।
দাদা, ঠিক আসবেন তো? আমার ভয় করছে।
আরে, ভয়ের কী আছে। গ্ৰেহাউন্ড স্টেশনে ভয়ের কিছু নেই। আমার পৌঁছতে বড় জোর আধ ঘন্টা লাগবে।
ফোন ছেড়ে দিয়ে জেট বিমানের গতিতে চিন্তা করতে লাগলো অবনী।
এ কী অভাবনীয় ব্যাপার! মেয়েটা হুট করে চলে এল আমেরিকায়? তা ইচ্ছে হলে আসতে পারে, কিন্তু বোস্টনে কেন? ওর স্বামীর টেলিফোন নাম্বার দিয়ে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানেই তো যাওয়া উচিত ছিল।
অবনী এখন কী করবে? সন্ধে হয়ে গেছে, মেয়েটি থাকবে কোথায়?
দেশ থেকে যারা আসে, তারা অনেকেই বোঝেনা যে, এখানে অনেকেই থাকে একঘরের ফ্ল্যাটে। সেখানে কি কোনও অনাত্মীয় মেয়েকে আশ্রয় দেওয়া যায়?
রেহানা এক দিন এখানে ছিল, সে-দিন সঙ্গে তার স্বামীও ছিল। কষ্ট করে শুতে হয়েছে, সেআর কী করা যাবে। কিন্তু একটি বিবাহিতা মেয়ে একা এসেছে, অবনীর ঘরে তাকে আশ্রয় দেবার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। দুজনেরই মন পরিশুদ্ধ থাকলেও অন্য কেউ যে তা মানবে না। ওর স্বামী কী মনে করবে? মেয়েটিরই ক্ষতি হবে বেশি।
কিন্তু কথা যখন দিয়ে ফেলেছে, তখন যেতেই হবে গ্রে হাউন্ড স্টেশনে।
এই সময় বাড়ি থেকে বেরুতে ইচ্ছে করেনা একেবারে। জামা-জুতো-মোজা খুলে ফেলা হয়েছে। পরতে হবে আবার।
অবনী যখন গ্রে হাউন্ড বাস স্টেশনে পৌঁছল, তখনও তার চোখে-মুখে বিরক্তি মাখান।
ওয়েটিং রুমে পাঁচ-সাত জন ভারতীয় বা বাংলাদেশি বা পাকিস্তানি রয়েছে, শুধু একজন রমণীর সামনেই একটি বড় সুটকেস। দূর থেকে দেখে অবনী চিনতেও পারল নিশাকে।
প্রথম বার যারা এ-দেশে আসে, তাদের চেহারার মধ্যেই কিছুটা ভয়, উদ্বেগ, অস্বস্তি মিশে থাকে। এয়ারপোর্টে পরিচিত কারুকে না দেখলে সে সব আরও বেড়ে যায়। সেই তুলনায় এই মেয়েটিকে বেশ সপ্রতিভই বলতে হবে।
একা এসেছে নিউইয়র্কে, সেখানে কেউ তাকে অভ্যর্থনা জানায়নি। তারপর সে খোঁজখবর নিয়ে একাই বাসে চেপে বোস্টনে এসেছে। নিশার পরনে সালোয়ার-কামিজ, একটা সাদা রঙের শাল গায়ে জড়ানো।
অবনী সামনে আসতেই নিশা উঠে দাঁড়িয়ে আবেগের সঙ্গে বলল, এসেছেন? অবনীদা, আপনাকে বিরক্ত করার জন্য আমি খুবই লজ্জিত। যদি আপনি সব শোনেন—।
অনেক ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল নিশার দিকে।
পাশের একটি চেয়ার খালি, সেখানে বসে পড়ে অবনী বলো, ঠিক আছে, সব শুনব। একটু আস্তে কথা বলো, এ-দেশে কেউ পাবলিকলি চেঁচিয়ে কথা বলে না। তুমি হঠাৎ চলে এলে, তোমার স্বামীকে জানাওনি? তিনি রিসিভ করতে আসেননি?
নিশা মৃদু গলায় বলল, আপনি আমার চিঠি পাননি?
অবনী বলল, চিঠি… মানে সেই একটা আমার মায়ের চিঠির সঙ্গে…।
নিশা বলল, এখানে আসার কথা জানিয়ে যে একটা চিঠি দিয়েছি দশ দিন আগে।
না, সেটা এখনও পৌঁছয়নি। অনেক সময় দেরি হয়।
আপনাকে টেলিফোন করে পাইনি। টেলিফোনে অনেক খরচ। আজ সকালে নিউইয়র্কে পৌঁছেও চেষ্টা করেছি দু’বার, ফোন বেজেই গেল।
আমি সকালে সাড়ে সাতটার মধ্যে বেরিয়ে যাই। ছুটির দিন ছাড়া পাবে কী করে?
কথা বলতে বলতেও অবনী খুব অস্থির বোধকরছে। নিশা তাকে চিঠি লেখা, তাকে ফোন করার ওপর জোর দিচ্ছে কেন? তার সঙ্গে তো নিশার সেরকম কিছু সম্পর্ক নেই। যোগাযোগ করার কথা তো ওর স্বামীর সঙ্গে। অবনী ওর স্বামীর ঠিকানা ও ফোন নম্বর জানিয়ে দিয়েছে।
অবনী এবার সোজাসুজি জিজ্ঞেস করল, তুমি কি অরূপবাবুকে কিছু না জানিয়েই চলে এসেছ?
সরাসরি অবনীর মুখের দিকে তাকাল নিশা। হঠাৎ জলে ভরে গেল তার দু’চোখ। ফুঁপিয়ে উঠল একবার।
এ-রকম অবস্থায় যে কী করতে হয়, তা অবনী জানেইনা।
অন্য লোকরা কী ভাবছে, এই তরুণীটি তার প্রেমিকা? কী মুশকিল।
ইংরেজি সিনেমায় এই রকম সময়ে পুরষরা একটা রুমাল এগিয়ে দেয় মেয়েটির দিকে। সিনেমার নায়িকারা কান্নার পরেও চোখ মোছেনা, সেই রুমালে নাক ঝাড়ে।
একটু সামলে নিয়ে নিশা বলল, আপনি নাম্বার দিয়েছিলেন, ওর সঙ্গে ফোনে একবার কথা হয়েছে। পা ভেঙে গিয়েছিল তখন ওর। শরীরটাও খারাপ ছিল। তারপর থেকে যতবার ফোন করেছি, ওকে পাইনি। একটা রেকর্ড করা কথা শোনা গেছে, ও বাড়িতে নেই। অন্তত দশবার, প্রত্যেক বার ওই একই কথা।
অবনী বলল, আনসারিং মেশিন। তাতে কোনও মেসেজ রাখোনি? বিপ বিপ শব্দ হওয়ার পর…
নিশা বলল, হ্যাঁ তা-ও রেখেছি। ও নিজে থেকে একবারও ফোন করেনি।
অবনী মাথা নাড়ল। এটা ইদানীং একটা নতুন কায়দা হয়েছে। অনেকে বাড়িতে থাকলেও ফোন ধরেনা। কয়েক বার রিং হবার পর নিজে থেকেই চালু হয়ে যায় আনসারিং মেশিন, যে ফোন করছে শোনা যায় তার কণ্ঠস্বর। তখন ইচ্ছে করলে রিসিভার তুলে কথা শুরু করা যায়। পাওনাদার কিংবা বিরক্তিকর কেউ ফোন করলে, তার কথা শুনতে পেয়েও ফোন না ধরার সুবিধে হয়েছে এখন।
নিশা বলল, নিউ ইয়র্কে পৌঁছেছি ভোর সাড়ে ছ’টায়। তখন থেকে তিনবার ওকে বাফেলোর নাম্বারে ফোন করেছি, কোনও উত্তর নেই। তখন আমার ভয় হল। অরূপ যদি বাফেলো শহরেই না থাকে এখন, তাহলে আমি ওখানে পৌঁছে উঠব কোথায়? আর তো কারুকে চিনি না।
অবনী মনে মনে বলল, ফোন না ধরলেও বাড়িতে থাকতে পারে।
নিশাকে জিজ্ঞেস করল, অরূপবাবুর সঙ্গে ডেফিনিট যোগাযোগ না করেই তুমি এত দূর চলে এলে? এ যে বিরাট ঝুঁকি!
নিশা আর কাঁদবেনা ঠিক করে ফেলেছে।
ওড়না দিয়ে মুখ মুছে বলল, সবাই বলেছিল, ভিসা পাওয়া খুব শক্ত। আমি আশ্চর্য ভাবে এক চান্সেই ভিসা পেয়ে গেলাম। আমার এক বান্ধবীর দাদার ট্রাভেল এজেন্সি আছে, তিনি আমাকে একটা টিকিট দিয়ে বললেন, একবছরের মধ্যে টাকা শোধ করলেও চলবে।
অবনী বিরক্তি গোপন না করে খানিকটা ধমকের সুরে বলল, শুধু ভিসা আর ফ্রি টিকিট পেলেই হল? অরূপবাবু যদি সত্যিই বাফেলো থেকে অন্য কোথাও চলে গিয়ে থাকেন, তাহলে তুমি থাকবে কোথায়? থেকেই-বা কী করবে?
নিশা বলল, তা বলে একটা মানুষ নিরুদ্দেশ হয়ে গেলে তার কোনও খোঁজ করা হবে না? যদি সত্যি তার কোনও গুরুতর অ্যাকসিডেন্ট হয়ে থাকে? মাসের পর মাস আমি কোনও খবর পাবনা, অথচ নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকব? অরূপদের বাড়িতে, মানে আমার শ্বশুর বাড়িতে আমি কীভাবে থাকি, তা আপনারা বুঝতে পারবেন না। আমার মা-বাবা কেউ নেই, দাদার কাছ থাকতাম। বিয়ের পরেও কোনও মেয়ে যদি দাদার বাড়িতে ফিরে গিয়ে আশ্রয় চায়, সেটা তার পক্ষে কত অপমানজনক, সেটুকু অন্তত বুঝবেন আশা করি। শ্বশুর বাড়িতে একগাদা লোক, এখন সবাই ভাবছে, আমার সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে অরূপের, সেই জন্য সে আর কারুর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেনা। অথচ বিশ্বাস করুন, কোনও দিন ঝগড়া হয়নি। বরং ও আমাকে কত রকম প্রমিজ করেছিল। বলেছিল এক বছর বাদেই ডেফিনিটলি আমাকে এ-দেশে নিয়ে আসবে।
তুমি কলকাতায় কিছু কাজ-টাজ করতে?
হ্যাঁ, একটা মিশনারি স্কুলে পড়াতাম। ভাল কাজ ছিল। বিয়ের পর জোর করে ছাড়িয়ে দিল। তখন আপত্তি করিনি। এখন আবার নতুন করে খুঁজতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু সহজে কি চাকরি পাওয়া যায়। এর মধ্যে গত মাসে, অরূপ দুম করে ওর মায়ের নামে এক হাজার ডলার পাঠিয়ে দিয়েছে। চিঠি-টিঠি কিছু নেই, শুধু একটা চেক। তাতেই আরও ওদের ধারণা হয়েছে, অরূপ ওর মায়ের প্রতি কর্তব্য পালন করতে এখন রাজি, কিন্তু স্ত্রীর প্রতি কোনও কর্তব্য নেই। সবই যেন আমার দোষ। আমার সত্যিই কী দোষ, সেটাই আমি জানতে চাই। সেটা না জেনে আমি মরতেও রাজি নই।
অরূপের যদি খোঁজ না পাওয়া যায়, এ-দেশে একা একা তোমার পক্ষে বেশি দিন থাকা খুবই কঠিন ব্যাপার। তুমি টুরিস্ট ভিসা নিয়ে এসেছ নিশ্চয়ই?
হ্যাঁ। দুমাসের।
তার মানে তুমি এ-দেশে কোনও কাজও করতে পারবে না। টাকা-পয়সা কিছু আনতে পেরেছ?
চারশো ডলার। দু’খানা গয়না বিক্রি করে।
নস্যি! ও-টাকায় আর কত দিন চলবে।
আমার রিটার্ন টিকিট আছে। সে-রকম হলে ফিরে যাব। দাদা, আমি আপনার ওপর কোনও দায়িত্ব চাপাতে চাইনা। শুধু পরামর্শ চাইছি। কোথা থেকে আমার শুরু করা উচিত।
আপাতত আজকের রাতটা তুমি কোথায় কাটাবে, সেটা ঠিক করা দরকার। আমার অ্যাপার্টমেন্টে তোমাকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আমি ছোট্ট একটা একখানা ঘরের অ্যাপার্টমেন্টে থাকি।
ছোট হলেও আমার কোনও অসুবিধা নেই। আমি মেঝেতেও শুয়ে থাকতে পারি।
তুমি বুঝতে পারছ না, অসুবিধেটা অন্য রকম। কাছাকাছি কিছু সস্তার মোটেল আছে, চলো দেখি, কোনওটাতে যদি ঘর পাওয়া যায়।
ঠেলাগাড়িতে মালপত্র চাপিয়ে নিশাকে নিয়ে বেরিয়ে এল অবনী। ট্যাক্সি নিয়ে মোটেল খুঁজতে গেলে অনেক খরচ হয়ে যাবে। সে নিশাকে বলল, তুমি এখানে দাঁড়িয়ে থাক, এমনিতে ভয়ের কিছু নেই, শুধু মালপত্রের কাছ থেকে একমুহূর্তের জন্যও নড়বে না। এটা হাত দিয়ে ধরে থাকো। কেউ কোনও কথা বলতে এলেও মাথা নাড়বে, অন্য দিকে তাকাবে না। ভিখিরি এলেও পয়সা দেবেনা। আমি পায়ে হেঁটে গিয়ে ঘর ঠিক করে আসছি।
আধ ঘণ্টার মধ্যেই সে ফিরে এল। ঠেলাগাড়িটা দুহাতে চেপে একই জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে আছে নিশা। একটু দূর থেকে তাকে দেখে মনে হল কোনও ট্র্যাজেডির নায়িকা। মুখে গাঢ় অভিমানের রঙ।
এবারে অবনীকেই হাতে করে সুটকেসটা বয়ে নিয়ে যেতে হল। বেশ ভারি।
একেবারেই সস্তার মোটেল, তা-ও কাল দুপুর বারোটা পর্যন্ত। ঘরভাড়া পঁয়তাল্লিশ ডলার। একচিলতে ঘর, অবশ্য সংলগ্ন টয়লেট আছে। মোটেলটির মালিক এক গুজরাটি, কর্মচারীরা সবাই কালো।
ঘরটার চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিশা বলল, কোনও দিন হোটেলে একা একা থাকিনি।
অবনী বলল, দরজা বন্ধ করে রাখবে। এখানে খাবার-টাবার পাওয়া যায় না। কেউ এসে তোমাকে ডাকবেও না। তোমার খিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই?
না, আমার একটুও খিদে নেই।
খিদে না পেলেও খেতে হবে। এখানকার কলের জল খাওয়াও ঠিক নয়। তোমার জেট ল্যাগ হবে, যখন-তখন ঘুম পাবে। আমি কিছু খাবার আর জলের বোতল নিয়ে আসছি। ফিরে এসে আমি তিনবার বেল দেব, তখন দরজা খুলবে।
নিশা হ্যান্ডব্যাগ খুলে টাকা বার করতে গেল।
অবনী বলল, এখন থাক।
নিশা বলল, অবনীদা, আমার জন্য আপনাকে টাকা-পয়সা খরচ করতে হবে না। প্লিজ, কত লাগবে বলুন।
অবনী বলল, শোনো নিশা, আমার উপার্জন বেশি নয়। চাকরি তো করি না। এই হিসেবে এখন আমি ছাত্র। তবে বিদেশ থেকে কোনও অতিথি এলে একসন্ধে তাকে কিছু খাওয়ার সামর্থ্য নিশ্চিত আমার আছে।
কাছেই একটা বার্গার কিং-এর দোকান দেখে এসেছে অবনী। দুটো বড় হ্যামবার্গার, আলুভাজা, দুটো কফি ও দুটো জলের বোতল কিনে নিল। এরা চা কিংবা কফিও এমন ঢাকনা দেওয়া গেলাসে দেয় যে, বয়ে নিয়ে যেতে অসুবিধে হয় না।
এর মধ্যে পোশাক বদলে ফেলেছে নিশা। শাড়ি পরেছে। পোশাক বদলালেই মেয়েদের চেহারা ও রূপও যেন বদলে যায় অনেকখানি। নিশাকে বেশ সুশ্রীই বলতে হবে। তার কথা বলার ভঙ্গিতেও ন্যাকামি নেই, অনেক পুরুষই আকৃষ্ট হতে পারে তার দিকে। তবু এমন একটি মেয়েকে কেন অবহেলা করছে তার স্বামী? সেই লোকটির মনের কথা কী করে বুঝবে অবনী?
একটা কথা স্বীকার করতেই হবে যে, এ মেয়েটির সাহস আছে। জীবনে যে কখনও বিদেশে যায়নি, সে একা একা, কারুর সঙ্গে সঠিক যোগযোগ না করে আমেরিকায় চলে এল, ক’জন বাঙালি মেয়ে এটা পারবে?
ঘরের মাঝখানে একটি খাট ছাড়া আর কোনও আসবাব নেই। সেই খাটের ওপর বসেই খাবার খেতে শুরু করল।
হ্যামবার্গারে প্রথম কামড় দিয়ে নিশা জিজ্ঞেস করল, বিফ না পর্ক?
অবনী বলল, কোনওটাই নয়। মুর্গি। তোমার ওই সব মাংসে আপত্তি আছে? এ-দেশে ও-সব সংস্কার থাকলে মেনে চলা খুব মুশকিল। খাচ্ছ নিরীহ আলুভাজা, কিন্তু সেটা যে লার্ড দিয়ে ভাজা, সেটা হয়তো গরুর চর্বি।
নিশা বলল, বিয়ের পর আমার স্বামী কলকাতায় আমাকে পার্ক স্ট্রিটের কয়েকটা রেস্তোরাঁয় খাওয়াতে নিয়ে যেত। প্রায় জোর করেই আমাকে বিফস্টেক খাইয়েছে। অলিম্পিয়াতে এগ অ্যান্ড সসেজও খেয়েছি, সসেজ তো শুয়োরের। যে-কোনও মাংসই আমার ভাল লাগে। শুনেছি, এ-দেশে নাকি পাঠার মাংস পাওয়া যায় না।
অবনী বলল, চেষ্টা করলে পাওয়া যায়। আরও অনেকরকম মাংস পাওয়া যায় এ-দেশে। তোমার সঙ্গে কি অরূপবাবুর সম্বন্ধ করে বিয়ে হয়েছে? নাকি তোমরা নিজেরা পছন্দ করে ।
মুখ নিচু করে নিশা বলল, বলতে পারেন, অরূপই আমাকে পছন্দ করেছিল। আমি মাঝে মাঝে কবিতা আবৃত্তি করতাম। একটা আসরে আমার কবিতা শুনে ওর ভাল লাগে। যেচে এসে আলাপ করে আমার সঙ্গে। আমাদের বাড়িতেও আসতে শুরু করে। আমাকে নিয়ে গেছে কয়েকটা গানের আসরে, ও নিজে খুব ভাল গান করে, আমার ভাল লেগেছিল। তারপর যেমন হয় আর কী।
ওর গানের খ্যাতি এখানেও ছড়িয়েছে।
গান কিন্তু শেখেনি কোথাও। কিন্তু গান-পাগল যাকে বলে।
এখানে উনি কী চাকরি নিয়ে এসেছেন?
তা ঠিক জানি না। বলেছিলেন ঘুরেঘুরে বেড়াবার চাকরি। কোনও ইন্ডিয়ানমালিকের কোম্পানিতে।
ওঁর ডিসিপ্লিন কী ছিল?
সোসিওলজিতে এমএ করেছিল। তারপর আরও কী কী ট্রেনিং নিয়েছিল।
উনি শিক্ষিত লোক, তোমার স্কুলে পড়ানোটা বন্ধ করে দিয়েছিলেন কেন?
ও দেয়নি। ওর মায়ের আপত্তি ছিল খুব।
খুব মাতৃভক্ত ছেলে?
ঠিক তা নয়। আমাদের তো জাতের মিল নেই, তাতেই ওর মা প্রথমে আপত্তি করেছিলেন। পরে অবশ্য মেনে নেন। সেই জন্যই চাকরির ব্যাপারে আর মায়ের ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোর করা যায়নি। একটা কোনও কাজ থাকলে তবু আমি…।
আমি তাহলে এখন উঠি?
আমার এখন কী করা উচিত, তা বললেন না তো!
বাফেলোয় অন্য দু’এক জনকে আমি চিনি। তাদের সঙ্গে কথা বলে দেখি। যদি কেউ কিছু খবর দিতে পারে।
ওখানে আমাকে তো প্রথমে যেতেই হবে।
তা যাবে। কিন্তু অরূপ যদি না-ই থাকে সেখানে, তুমি একলা গিয়ে আরও মুশকিলে পড়ে যাবে।
আমি কাল সকলে কী করব?
উমম… আমি তো কাল সকালেই আসতে পারব না। তুমি ঘুম থেকে উঠে তৈরি-টেরি হয়ে নিয়ে ঘর বন্ধ করে বেরুবে। রাস্তাটা ক্রস করলেই দেখবে ডান দিকে একটা বার্গার কিং-এর দোকান। ওরা খুব ভোরেই খোলে। ব্রেকফার্স্ট খেয়ে নেবে। পারবে না? কাল শুক্রবার, আমরা তো এখানে হুট করে ছুটি নিতে পারি না, ইউনিভার্সিটি যেতেইহবে। সাড়ে দশটা-এগারোটার মধ্যে চলে আসব।
আপনার অসুবিধে হলে আরও দেরিতে আসতে পারেন।
দুপুর বারোটায় তোমার চেকিং আউট টাইম। যদি কালকেই বাফেলো যেতে হয়…ঠিক আছে, সেটা কাল এসে ঠিক করব। আমার ফোন নাম্বার তো তুমিই জানোই, রাত্তিরে কোনওরকম অসুবিধে হলে আমাকে ফোন করবে।
অবনীদা, আমি কি এ-রকম ভাবে এসে পড়ে খুব ভুল করেছি?
এসেই যখন পড়েছ, তখন আর ওকথা ভেবে লাভ নেই। এরপর কী হবে, সেটাই এখন ভাবতে হবে।
দরজা পর্যন্ত অবনীর সঙ্গে এগিয়ে এল নিশা।
সামনের লম্বা করিডরটা একেবারে শূন্য। একটা মাত্র মৃদু আলো জ্বলছে। এমনই নিঃশব্দ যে, মনে হয় ধারেকাছে আর একটিও মানুষ নেই।
অবনী বলল, হয়তো কাল অনেক বেলা পর্যন্তও তোমার ঘুম ভাঙবে না। জেট ল্যাগে এ-রকম হয়। ঘুমোতে ইচ্ছে করলে ঘুমিয়েই থেকো।
নিশা অন্য রকম গলায় ডাকল, অবনীদা–।
আর কিছু বলল না।
অবনী মুখ ফিরিয়ে দেখল, আবার নিশার দুচোখের কোণে চিকচিক করছে অশ্রু। ঠোঁটটা একটু একটু কাঁপছে।
এক লহমার জন্য অবনীর মনে হল, মেয়েটি কি চাইছে, আমি ওকে একটা চুমু খাব?
পরে মুহূর্তেই সে ভাবল, না না, তা কী করে হয়! এ পর্যন্ত সে নিশার হাতও ছোঁয়নি। তার সঙ্গে কোনও রকম অন্তরঙ্গ সম্পর্ক নেই, তবু কি চুমু খাওয়া যায়? এ-দেশে অবশ্য ও-সব কিছু সম্পর্ক লাগেনা, এক ঘন্টার পরিচয়ে ছেলেরা-মেয়েরা বিছানায় চলে যায়। কিন্তু নিশা তো এ-দেশের মেয়ে নয়। আর অবনীরও ও-রকম অভিজ্ঞতা এ পর্যন্ত হয়নি।
তবে কি শুধু কৃতজ্ঞতার জন্য?
আর কিছু বলছেনা নিশা, অবনীও শোনার অপেক্ষা না করে এগিয়ে গেল। সে টের পাচ্ছে বুকের মধ্যে একটা আলোড়ন। শরীর যেন হঠাৎ জেগে উঠে নিজস্ব আবেদন জানাচ্ছে, আর একটু হলেই একটা কিছু ঘটে যেত।
বাইরে বেরিয়ে আসার পর অবনীর মনে হল, এই মেয়েটি তার স্ত্রী হলেও তো হতে পারত। তাহলে ওর জীবন হত অন্য রকম। এমন অপমানের বোঝা ঘাড়ে নিয়ে ওকে আসতে হত না এ-দেশে।
নিশাও কি সেই কথাই ভাবছে?
.
০৪.
বাড়ি ফিরতে ফিরতে এগারোটা বেজে গেল।
এত রাতে কি কারুকে টেলিফোন করা যায়? অথচ বাফেলোতে খোঁজ নেওয়া বিশেষ দরকার। যত দেরি হবে, ততই নিশাকে মোটেলের ঘরভাড়া গুণতে হবে। বাফেলোতে ওকে আদৌ যেতে হবে কি না, সেটাই তো এখনও বোঝা যাচ্ছে না। মাত্র চারশো ডলার সম্বল করে বেচারি এসেছে এই দেশে।
বোস্টনেও অনেক বিবাহিত বাঙালি পরিবার আছে। সে-রকম কোনও পরিবারে নিশাকে কয়েক দিনের জন্য আশ্রয় দেবার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, সে-রকম কোনও পরিবারের সঙ্গেই অবনীর ঘনিষ্ঠতা নেই। অনেকেই বাড়িতে অতিথি এসে থাকতে শুরু করলে আড়ালে বিরক্তি প্রকাশ করে। একমাত্র জহিরভাই এই ঘটনাটা কোনও ক্রমে জানতে পারলেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন। কিন্তু জহির আর সীতা ঢাকা-কলকাতায় গেছেন গত সপ্তাহে।
নিশার স্বামীর হদিশ যদি শেষ পর্যন্ত না পাওয়া যায়, তাহলে ওকে দেশেই ফিরে যেতে হবে। কোথায়? সেই শ্বশুর বাড়িতেই। সেখানে তার অবস্থা এরপর আরও খারাপ হয়ে যাবে না? যে-মেয়েকে তার স্বামী ত্যাগ করেছে, স্বামীর বাবা-মা তাকে কী চোখে দেখবে?
অবনী এত সব ভাবছে কেন?
এই উটকো ঝামেলার জন্য অবনী যতটা বিরক্ত হয়েছিল প্রথমে, এখন তা অনেক কমে গেছে, মেয়েটিকে দেখার পর তার মন নরম হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। নিশার তো কোনও দোষ নেই, তবু সে কেন কষ্ট ও অপমান সহ্য করবে?
না না, যাই-ই হোক না কেন, অবনী ওর দায়িত্ব নিতে পারবে না।
আনিসারিং মেশিন চালিয়ে দেখল, হ্যাঁ, রেহানা ঠিক ফোন করেছিল। মেসেজ রেখেছে, ফিরে এলেই ফোন করবেন।
কিন্তু সে তো সাতটার সময়। এখন নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছে রেহানা। ছুটির দিন ছাড়া কেউ এখানে বেশি রাত জাগে না।
রেহানা অবশ্য এক দিন রাত পৌনে বারোটায় সময় ফোন করে আকাশে ঈদের চাঁদ দেখতে বলেছিল।
দ্বিধা কাটিয়ে ফোন তুলল অবনী। ঘুমিয়ে পড়েছিলে?
আমি কি প্যাঁচা যে, মাঝরাত্তিরে জেগে থাকব?
এখনও ঠিক মাঝ রাত হয়নি। তুমি ফোন করতে বলেছিলে।
এতক্ষণ কোথায় ছিলেন?
সে একটা ব্যাপার হয়েছে। তোমার ধৈর্য থাকলে শোনাতে পারি। তার আগে বলো, তুমি কেন ফোন ব্যাক করতে বলেছিলে? জরুরি কিছু?
তেমন জরুরি নয়, অন্তত আপনার পক্ষে নয়। আমার হাজব্যান্ড আনোয়ার বোস্টনে যাচ্ছে আগামী কাল, দুদিন থাকবে। ও জানতে চেয়েছে, আপনি ফ্রি থাকবেন কিনা, তাহলে আপনার সঙ্গে এক সন্ধে আড্ডা দেবে। আসল কথা, ওর চাচার বাড়িতে তো ড্রিঙ্কিং চলে না, তাই আপনার ওখানে–।
হ্যাঁ, আমি ফ্রি থাকব। আনোয়ার বোস্টনে আসছে, তুমি আসবে না?
আমার ক্লাস রয়েছে! আনোয়ার ওখান থেকে বাফেলোতে এসে কয়েক দিন থেকে যাবে। তাই আমি আর যাচ্ছি না। আপনি চলে আসুন না আনোয়ারের সঙ্গে।
তোমরা কপোত-কপোতী অনেক দিন পর একসঙ্গে থাকবে, এর মধ্যে আমি গিয়ে কী করব? টু ইজ কম্পানি, থ্রি ইজ ক্রাউড। একটা ফরাসি কথাও আছে, মেনাজে ত্রোয়া!
আর ফরাসি ঝাড়তে হবে না। আমাদের বিয়ে হয়েছে সাড়ে পাঁচ বছর আগে, এখনও কপোত কপোতী? আপনাকে আসতে হবে না। এক বছর হয়ে গেল, এর মধ্যেও নায়েগ্রা ফলস দেখেননি, এ-রকম বেরসিক আর এক জনও আছে কিনা জানি না। এবারে বলুন, আজ সন্ধেবেলা কী ঘটল?
সেটা বলতে খানিকটা সময় লেগে যাবে। তুমি ঘুমোচ্ছিলে, ঘুমোও। কাল বরং –।
আমি ঘুমোচ্ছিলাম না। টিভিতে একটা ফিল্ম দেখছিলাম। খুব সাংঘাতিক ভূতের গল্প। ভয়ও করছিল, ছাড়াও যাচ্ছিল না। এখন বন্ধ করে দিয়েছি।
রেহানা, ওই যে অরূপ নামে ভদ্রলোক তোমাদের ওখানে থাকেন, তার স্ত্রী আজ হঠাৎ দেশ থেকে এসে উপস্থিত হয়েছে। বার বার ফোন করেও অরূপের কোনও সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। আপাতত মেয়েটি এখানকার একটা মোটেলে আছে।
নিশার কাহিনিটি পুরোটাই শোনাতে হল।
রেহানা চুপ করে শোনবার পর বলল, ভদ্রলোককে আমি দু’দিন আগেও দেখেছি সুপার মার্কেটে, অনেক বাজার করলেন, এর মধ্যে কি বাফেলো ছেড়ে চলে গেলেন? ঠিক আছে, আমি খবর নিয়ে জানাব।
কাল সকালে আমি সাড়ে সাতটার মধ্যে বেরিয়ে যাব।
আপনি এখন ফোন রাখুন।
ঠিক দশ মিনিট বাদে আবার বেজে উঠল ফোন। রেহানা বলল, আমি রফিককে ফোন করে অনেক খবর জেনে নিয়েছি। ভাল করে শুনে নিন।
অবনী সঙ্কোচের সঙ্গে বলল, ছি ছি, এত রাতে তুমি রফিককে বিরক্ত করলে? কাল সকালে–।
রেহানা বলল, রফিককে জাগাতে হয় না। ওকে সবাই বলে রাত রফিক। ইনসমনিয়ার রুগি। আমরা বলি, বিয়ে না করলে ওর এ রোগ সারবে না! শুনুন, রফিক বলল, ওই অরূপনামে ভদ্দরলোক এমনিতে বেশ ভাল, চমৎকার গান করেন, খুব মজার, কিন্তু খেয়ালি ধরনের। বাঙালি ছাড়াও অন্য বন্ধু-বান্ধবী আছে। হঠাৎ হঠাৎ কোথায় যেন চলে যান। মনে হয়, বাঁধা কোনও চাকরি করেন না। কিছু দিন আগে কোথা থেকে যেন অনেক টাকা পেয়ে গেছেন, দু’হাতে ওড়াচ্ছেন। কাল থেকে এঁর অ্যাপার্টমেন্ট বন্ধ, গাড়িটাও নেই, আবার কোথাও গেছেন মনে হচ্ছে, কিন্তু অ্যাপার্টমেন্ট তো ছাড়েননি। আবার ফিরে আসবেন।
নিশা তাহলে এখন কী করবে?
ওকে বাফেলোতে পাঠিয়ে দিন।
অরূপের অ্যাপার্টমেন্ট বন্ধ। নিশা গিয়ে উঠবে কোথায়?
আপাতত আমার কাছে।
তোমার কাছে? পাগল নাকি?
এর মধ্যে পাগলামির কী হল?
আনোয়ার সাহেব যাচ্ছেন তোমার কাছে। এর মধ্যে আবার এক জন অতিথি, না না, এটা ঠিক নয়।
একটি মেয়ে বিপদে পড়েছে, তাকে যদি আমি সাহায্য না করি, তাহলে কি আমি মানুষ? না জন্তু? আনোয়ারই জানতে পারলে আমার ওপর রাগ করবে। ওসব কথা ছাড়ুন। ভদ্রমহিলা কি একা একা ট্রাভেল করতে পারবেন? না হলে আনোয়ারের সঙ্গে ওকে পাঠিয়ে দিন। এখানকার দায়িত্ব আমার।
একা ট্রাভল করতে পারে।
বাসে তুলে দিয়ে আমাকে জানাবেন। আমি এখানে রিসিভ করে নেব। এর মধ্যে রফিক ওর হাজব্যান্ডের খোঁজখবর নেবে। ভদ্রলোক এমন ইরেসপনসিবল কেন?
আমি তো তাকে চিনিই না।
ওর স্ত্রী, তাকে চিনতেন আগে থেকে, ওদের বিয়েতে অ্যাটেন্ড করেননি? আগেই চলে এসেছিলেন?
তা ঠিক নয়। একে আমি মাত্র একবারই দেখেছি।
ঠিক আছে, এখানে পাঠিয়ে দিন। তারপর সব দায়িত্ব আমার। গুড নাইট। খোদা হাফিজ।
অবনীও অজান্তে বলে ফেলল, খোদা হাফেজ। ফোন ছেড়ে দিয়ে কয়েক মিনিট সে রেহানার কথাই ভাবল।
আশ্চর্য মেয়ে। অদম্য এর প্রাণশক্তি। চেনে না, শোনে না, অথচ একটি মেয়ে অসুবিধেয় পড়েছে শুনেই তার দায়িত্ব নিয়ে নিল স্বেচ্ছায়।
এরপর আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লেও অনেকক্ষণ ঘুম এল না অবনীর। মনের মধ্যে একটা অপরাধবোধ খচ খচ করছে। যেন নিজের ঘাড় থেকে দায়িত্ব নামিয়ে নিশাকে সে তুলে দিল রেহানার হাতে। যদিও রেহানাকে সে জোর করেনি, কোনও ইঙ্গিতও দেয়নি। অবশ্য, একটি মেয়ে হয়ে রেহানা যতটা সাহায্য করতে পারবে নিশাকে, তা অবনীর পক্ষে সম্ভব নয়।
সকালে ঘুম থেকে উঠতে খানিকটা দেরি হয়ে গেল।
অন্য কোনও দিন এ-রকম দেরি হলে সে ছোটাছুটি শুরু করে। দাড়ি কামাতে কামাতে কফিতে চুমুক দেয়, দাঁত মাজতে মাজেতে প্যান্ট পরে। আজ সে-রকম ইচ্ছে করল না। অলস ভাবে দু’কাপ কফি শেষ করার পর সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, আজ আর ইউনিভার্সিটিতে যাবেই না। গত এক বছরে সে এ-রকম এক দিনও করেনি।
একটা টেলিফোন করে জানিয়ে দিল তার প্রফেসারকে। তারপর তৈরি হয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল আধ ঘণ্টার মধ্যে।
মোটেলটায় এসে, লম্বা করিডর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ তার বুকটা ধক করে উঠল। কী হয়েছে?
এক জায়গায় দেওয়ালে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিশা। চুল আঁচড়ায়নি, মুখখানা যেন রক্তশূন্য। যেন সর্বস্ব লুঠ হয়ে গেছে তার।
অবনী জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার? এখানে দাঁড়িয়ে আছ?
নিশা কোনও উত্তর দিল না।
অবনী আরও উৎকণ্ঠিত ভাবে বলল, কী হয়েছে? রাত্তিরে কোনও বিপদ হয়েছে?
নিশা তবু চুপ।
এবার অবনী তার বাহু ছুঁয়ে বলল, কী হয়েছে, বলো আমাকে।
নিশা এবার বলল, আমার মরে যাওয়াই উচিত।
অবনী মৃদু ধমক দিয়ে বলল, এ-সব কী ছেলেমানুষের মতো কথা? যা হয়েছে খুলে বলো, বাইরে দাঁড়িয়ে আছ কেন?
নিশা অবনত মুখে বলল, চাবিটা… চাবিটা ভেতরে রেখে দরজা বন্ধ করে ফেলেছি।
এবারে অনেকটা আশ্বস্ত হয়ে অবনী বলল, এই ব্যাপার? এটা এমন কিছু নয়। রিসেপশান কাউন্টারে গিয়ে বললে না কেন? ওদের কাছে মাস্টার কী থাকে, ওরা এসে খুলে দেবে।
নিশা তবু ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
অবনী বলল, দাঁড়াও, আমি চাবি নিয়ে আসছি। প্রথম প্রথম অনেকেরই এই ভুল হয়।
নিশা বলল, অবনীদা, অবনীদা, এখন আমি কী করব? আমার সব শেষ হয়ে গেছে।
রাত্তিরবেলার মতো জায়গাটা এখন আর তেমন নির্জন নয়। দু’চারজন লোক যাতায়াত করছে, দেখছে আড়চোখে। তবে, এ-দেশে কেউ এ-রকম দৃশ্য দেখলেও থমকে দাঁড়ায় না, কোনও মন্তব্য করে না।
অবনী বলল, চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকো। আমি চাবি আনছি।
দরজা খোলবার পর অবনী নিশার হাত ধরে ভেতরে নিয়ে এসে বলল, শান্ত হও, চোখ মোছো, কী হয়েছে, আস্তে আস্তে খুলে বলো।
খাটে বসতে গিয়েও কাত হয়ে নিচে পড়ে গেল নিশা। আর উঠল না। সেই অবস্থাতেই বলল, আমার আর কিছু নেই, যা বোকামি করেছি, তাতে আমার এখন মরে যাওয়াই উচিত।
অবনী বলল, শোনো, আগে তোমাকে আমি একটা ভাল খবর দিচ্ছি। আমি এর মধ্যে খবর নিয়েছি, তোমার স্বামী এখনও বাফেলো শহরেই থাকেন। বোধহয় দু’এক দিনের জন্য বাইরে গেছেন, কিন্তু অ্যাপার্টমেন্ট ছাড়েননি। তুমি আপাতত ওখানে একটি মেয়ের বাড়িতে থাকতে পারবে।
একথা শুনেও নিশাশূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
অবনী জিজ্ঞেস করল, ঘুম থেকে উঠে চা কিংবা কফি খেয়েছ? তোমাকে বলেছিলাম, রাস্তার উলটো দিকেই দোকান।
আবার পাগলের মতো কান্না শুরু করল নিশা।
সকালবেলাতেই কোনও মেয়ের এমন কান্নাকাটির দৃশ্য অবনীরমতো একজন অবিবাহিত পুরুষের একেবারেই অভিজ্ঞতার বাইরে।
ধমক দিতে গিয়েও সামলে নিয়ে সে নরম গলায় বলল, শুধু কাঁদলে আমি বুঝব কী করে যে কী হয়েছে? তোমাকে কালকে তো বেশ স্মার্ট মেয়ে মনে হয়েছিল।
এরপর নিশা আস্তে আস্তে যে-ঘটনা বলল, তা শুনে অবনীকেও বেশ কিছুক্ষণ বাক্যহারা হয়ে যেতে হল।
রাত্তিরে একেবারেই ঘুম হয়নি নিশার।
ভোরের আলো ফুটতে না-ফুটতেই তার চা খাওয়ার ইচ্ছে হয়েছিল। অত সকালে দোকান খোলে কিনা তা সে বুঝতে পারেনি। তাই খানিকটা দেরি করে অবনীর নির্দেশ মতো বাইরে বেরিয়ে দেখতে পেয়েছিল বার্গার কিং। সকালবেলাতেই সেখানে বেশ ভিড়। কত রকম খাবার! ফ্রুট জুসই সাত রকম। চমৎকার কফির গন্ধ। সে একটা ফ্রুট জুস, এক প্লেট আলুভাজা আর কফি নিয়ে বসেছিল একটা টেবিলে। সে-টেবিলে আর এক জন লোক কাগজ পড়ছিল। চোখাচোখি হতে একবার শুধু হাই, মরনিং বলে আর কোনও কথা বলেনি। কফিটা শেষ করার পর নিশার শরীরটা বেশ চাঙ্গা লাগল। সেখানে কত রকম মানুষ, কত রকম পোশাক, দেখতেও ভাল লাগে। আর এক কাপ কফি খেতে ইচ্ছে হল নিশার। যে-কোন কিছু কিনতে গেলেই লাইন দিতে হয়।
একটু পরে কফি নিয়ে ফিরে এসে নিশা দেখল, টেবিলের ওপর রাখা তার হ্যান্ডব্যাগটা নেই। কাগজ-পড়া লোকটিও নেই!
সেই হ্যান্ডব্যাগেই তার পাসপোর্ট, টিকিট এবং সব ডলার।
সকালবেলায় কোনও মানুষই তেমন সাবধান হয় না। চুরি-ডাকাতির কথা মনে পড়ে না। ওসব যেন অন্ধকারের ব্যাপার। আদিম কাল থেকেই মানুষের মনের মধ্যে রয়ে গেছে অন্ধকার-ভীতি। সব রকম বিপদ অন্ধকারের সঙ্গে জড়িত।
দীর্ঘ বিমানযাত্রা, সারা রাত ঘুম নেই, ভবিষ্যতের উদ্বেগ, এইসব মিলিয়ে নিশার মাথাটা স্বাভাবিক ছিল না। সাহেবদের দেশে, এমন প্রকাশ্যে সকালের আলোয় কেউ যে তার হ্যান্ডব্যাগটা তুলে নিয়ে যেতে পারে, এটা তার কল্পনাতেই আসেনি।
যে-নোটবইতে অবনীর ফোন নাম্বার লেখা ছিল, সেটাও ছিল ওই হ্যান্ড ব্যাগের মধ্যে। অবনীকে ফোন করারও কোনও উপায় ছিল না নিশার।
সেই দোকানের কাউন্টারে গিয়ে নিশা জানিয়েছিল তার ব্যাগ খোওয়া যাওয়ার কথা। অল্পবয়সী মেয়েরা সেখানে কাজ করে, তারা শুনে শুধু কাঁধ ঝাঁকিয়েছিল। খদ্দের সামলাতে তারা ব্যস্ত, সহানুভূতি জানাবারও সময় নেই। পাশের টেবিলে বসেছিল কয়েক জন, নিশা তাদের জিজ্ঞেস করেছিল সেই কাগজ-পড়া লোকটির কথা। তার কোনও কথা না বলে এ-ওর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করেছে, এসব ব্যাপারে মাথা গলাতে চায় না কেউ।
ধাতস্থ হতে কয়েক মিনিট সময় লাগল অবনীর।
এর আগেও এ-রকম দু’একটা ঘটনা শুনেছে অবনী। এয়ারপোর্ট থেকে বেরুতে না-বেরুতেই চুরি হয়ে গেছে সব কিছু। নিশা তো তবু অনেকটা সামলে এসেছিল।
অবনী যদি ইউনিভার্সিটিতে চলে যেত, তাহলে এগারোটা-সাড়ে এগারোটার আগে তার পক্ষে এখানে আসা সম্ভব হত না। ততক্ষণ কী করত নিশা? ওই রকম দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত, না কি হঠাৎ ছুটে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ত কোনও চলন্ত গাড়ির নিচে? অবনী বিশ্ববিদ্যালয়ে গেল না কেন? সে কি অবচেতনে কোনও তরঙ্গে নিশার এই বিপদের কথা টের পেয়েছিল?
এখন নিশাকে বকুনি দেবার কোনও মানে হয় না। যা হবার তা তো হয়েই গেছে। থানায় একটা খবর দিতে হবে অবশ্যই, যদিও ওই ব্যাগ আর ফিরে পাবার বিন্দুমাত্র আশা নেই।
নিশার মাথায় হাত রেখে সে বলল, কেঁদো না, সব ঠিক হয়ে যাবে।
দু’হাতে অবনীর হাঁটু জড়িয়ে ধরল নিশা।
অবনীর শরীর শির শির করে উঠল। নিজেকে ছাড়িয়ে নিল না। আস্তে আস্তে বলল, নতুন পাসপোর্ট করা এমন কিছু ঝামেলার ব্যাপার নয়। তাছাড়া তোমার এক্ষুনি লাগবে না। এ-দেশে একবার ঢুকে পড়লে আর কেউ পাসপোর্ট দেখতে চায়না। টিকিটও ডুপ্লিকেট পাওয়া যাবে, কমপিউটারে তো তোমার নাম আছে। শুধু চারশো ডলার। এ-দেশে এমন কিছু নয়। আর দামি কিছু ছিল না তো?
নিশা দু’দিকে মাথা নাড়ল।
অবনী বলল, আমার কাছে ক্রেডিট কার্ড আছে, আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। অরূপবাবুর খোঁজ পাওয়া গেছে, এটাই তো সব চেয়ে বড় কথা। পরে ওঁকে বোলো, আমার টাকাটা শোধ করে দিতে। এখন তৈরি হয়ে নাও, আমি তোমাকে টিকিট কেটে বাফেলোর বাসে তুলে দেব। ওখানে রেহানা নামে একটি বাংলাদেশের মেয়ে আছে, আলাপ করলে তোমার খুব ভাল লাগবে। সে তোমার স্বামীকে খবর দেবার চেষ্টা করছে, যদি তিনি শহরে এখন না থাকেন রেহানা নিজে তোমাকে বাস স্টেশনে রিসিভ করবে। কোনও ভয় নেই, কোনও চিন্তা নেই।
নিশা মুখ তুলে বলল, অবনীদা, আপনি না থাকলে আমি কী করতাম এখন?
এক ঘণ্টা বাদে মোটেলের ভাড়া মিটিয়ে নিশাকে বাসে তুলে দিল অবনী। বাসটা ওখানে এক পাক ঘুরে আবার সামনে দিয়ে যায়, ততক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল সেখানে। জানলার কাঁচে নিশাব মুখ। কেমন যেন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
সেই মুখখানা সারা দিন তার মন জুড়ে রইল।
.
০৫.
রেহানার কাছে দু’দিন থাকল নিশা।
তার হ্যান্ডব্যাগ চুরি নিয়ে এমন ঠাট্টা-ইয়ার্কি করতে লাগল রেহানা যে, নিশার মন খারাপের কোনও অবকাশই রইল না।
প্রথম দিনেই দু’জনের তুমি তুমি সম্পর্ক হয়ে গেল। যেন কত কালের চেনা।
রেহানা বলল, ব্যাগ চুরি গেলে সব চেয়ে বেশি ক্ষতি কী হয় জানো? টাকা-পয়সার ক্ষতির চেয়েও, দু’দিন-তিন দিন পর্যন্ত মুখখানা বোকা বোকা হয়ে থাকে। অনেক শিক্ষিত মহিলাকেও তখন দেখে মনে হয়, যেন একটুও লেখাপড়া জানে না, গাঁইয়া বলদ!
নিশা জিজ্ঞেস করল, তুমি কী করে জানলে? তুমি কি এ-রকম কারুকে দেখেছ?
রেহানা বলল, আমার নিজেরই তো একবার ব্যাগ চুরি গিয়েছিল। তখন আয়নায় মুখ দেখেছি।
তারপর দুজনেরই কী হাসি!
রেহানার কাছে সে বাংলাদেশের গল্প শোনে।
নিশার বাবা-মায়েরও বাড়ি ছিল আগেকার পূর্ববঙ্গে, জায়গাটার নাম নরসিংদি, এইটুকুই শুধু নিশা জানে, সে-জায়গা সে দেখেনি, কখনও বাংলাদেশে যায়নি।
রেহানা তাকে বাংলাদেশে বেড়াতে নিয়ে যাবে। রবিবার, ছুটির দিন, দুপুরের দিকে একটা ফোন এল। ফোন ধরল রেহানা।
একটি পুরুষকণ্ঠ বলল, নমস্কার, আমার নাম অরূপতন দাস, আপনার সঙ্গে আমার পরিচয় নেই, হঠাৎ ফোন করছি, আশা করি বিরক্ত হবেন না। আমার প্রতিবেশী রফিক একটা খবর দিল, জানি না প্র্যাকটিকাল জোক কি না, তবু জিজ্ঞেস করছি, আমার স্ত্রী নাকি আপনার কাছে আছে?
রেহানা বলল, আলাপ না হলেও আপনাকে আমি চিনি, আপনার গান শুনেছি। আপনার স্ত্রী কি হারিয়ে গেছে?
অরূপ বলল, সে হারিয়ে গেছে, না আমি হারিয়ে গেছি, তা বলা মুশকিল। সত্যি কথা বলতে কী, মাঝে মাঝে আমি নিজেকে খুঁজে পাই না।
রেহানা বলল, আমার কাছে একটি মেয়ে এসে রয়েছে। সে আপনার স্ত্রী কিনা প্রমাণ দিতে হবে। প্রমাণ না পেলে তো যার-তার হাতে তুলে দিতে পারি না।
অরূপ বলল, প্রমাণ না পেলে আমিই-বা যে-কোনও মেয়েকে নিজের স্ত্রী হিসেবে মেনে নেব কী করে? তার সঙ্গে কি একটু কথা বলা যেতে পাবে?
রেহানা বলল, সেটুকু অনুমতি দেওয়া যায়।
নিশা ফোন ধরে শান্ত গলায় বলল, তুমি কেমন আছো? তোমার পা ভেঙেছিল?
দারুণ আবেগের সঙ্গে অরূপ বলল, নিশা? তুমি সত্যিই এ-দেশে এসেছ? কী আশ্চর্য! আমাকে আগে খবর দাওনি?
নিশা বলল, তুমি আমার চিঠি পাওনি? টেলিফোনও করেছিলাম।
অরূপ বলল, না, চিঠি তো পাইনি। কয়েক দিন আমি শহরে ছিলাম না। ঠিক আছে, আমি এক্ষুনি যাচ্ছি, তোমাকে নিয়ে আসব।
ঠিক পনেরো মিনিটের মধ্যে গাড়ি নিয়ে চল এল অরূপ।
ঘরে ঢুকে, রেহানার সঙ্গে কথা বলার আগেই সাড়ম্বরে জড়িয়ে ধরল নিশাকে। গালে গাল ঠেকিয়ে চুপ করে রইল কয়েক মুহূর্ত।
তারপর বলল, হোয়াট আ প্লেজান্ট সারপ্রাইজ! দারুণ কাণ্ড করেছ নিশা। তুমি যে এত স্মার্ট মেয়ে আমি বুঝিনি। বেশ করেছ, খুব ভাল করেছ। আমি নিজেই তোমাকে– ।
অরূপের পরনে জিনসের প্যান্ট, জিন্সেরই শার্ট, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, মাথায় লম্বা চুলের প্রান্তে একটা গিট বাঁধা। স্বামীর এ-রকম চেহারা আগে দেখেনি নিশা।
রেহানা বলল, অরূপবাবু, আপনার সুন্দরী স্ত্রীটিকে খুব সাবধানে আগলে রাখতে হয়েছিল, পাছে অন্য কেউ নজর দেয়।
অরূপ রেহানার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনাকে মনে হচ্ছে আমার স্ত্রীর যমজ। আপনি অনায়াসে আমার শ্যালিকা হতে পারেন। নিশার আর কোনও বোন নেই, এই নিয়ে আমার খুব দুঃখ
রেহানা বলল, ঠিক আছে, আর দুঃখ করার দরকার নেই। কী খাবেন বলুন?
অরূপ বলল, আপনি খুব ভাল ওমলেট বানাতে পারেন শুনেছি, সেই একটা টেস্ট করে দেখতে চাই।
আপনি কী করে জানলেন?
রফিকের কাছ থেকে আপনার সব খোঁজখবর নিয়েছি। আপনার স্বামী তো আজই আসছেন।
অনেক খবর নিয়েছেন দেখছি।
আপনার অ্যাপার্টমেন্টটা তো ভারি সুন্দর। জানলা দিয়ে অনেকখানি ফাঁকা, মনে হচ্ছে যেন ক্যানাডা পর্যন্ত দেখা যায়। ঢাকাতে আপনার কোথায় বাড়ি?
ঢাকা!
একবার গান গাইতে গিয়েছিলাম। বিয়ের আগে। খুব ফ্যাসিনেটিং শহর। আমার বউকে আপনি কী করে চিনলেন?
আপনি এখানে ছিলেন না। এক জন কমন ফ্রেন্ড খবর দিল, তাই নিশাকে এখানে এনে রেখেছি।
সব কথা পরে শুনব। আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ জানানো উচিত। অনেক মানে কত? একের পিঠে চারটে শূন্য দিলে হবে?
আরও দুটো শূন্য যোগ করুন। তাতেও ঠিক শোধ হবে না। এক দিন ভাল করে অনেকক্ষণ গান শোনাতে হবে। আর নিশা রান্না করে খাওয়াবে।
গ্রান্টেড। আপনার স্বামী এসে পড়বে, এখন আমাদের চটপট কেটে পড়াই উচিত। নিশা সব গুছিয়ে নাও।
অরূপের গাড়িটা ঝরঝরে, এ-দেশে যাকে বলে জ্যালোপি। ধোয়-টোয় না কোনওদিন। চালায় খুব জোরে।
গুন গুন করে গান গাইছে অরূপ, দেশের কথা, বাবা-মা কেমন আছেন, কিছুই জিজ্ঞেস করল না। মাঝেমাঝে শুধু বলতে লাগল, চিনে রাখো, এই সুপার মার্কেটে আমরা বাজার করি, এখানে মশলাপাতি সস্তা, আর কোণের ওই দোকানটা বাংলাদেশিদের, ওখানে টাটকা মাছ পাওয়া যায়। আমাদের বাড়িতে ওয়াসিং মেশিন নেই, এই লন্ডোম্যাটে জামা-কাপড় কাঁচতে হবে।
বাড়িটা তিন তলা, অরূপের ঘর সব চেয়ে ওপরে, অ্যান্টিকে। লিফ্ট নেই। অত বড় সুটকেস সে সিঁড়ি দিয়ে টেনে তুলবে? অরূপের পায়ে এখনও একটু একটু ব্যথা আছে।
সে কাচুমাচু মুখ করে বলল, নিশা, তুমি কি এটা তুলতে পারবে? আমি তুলতে গেলে যদি আবার খোঁচ-টোঁচ লেগে যায়।
নিশা বলল, না না, তুমি হাত দিও না, আমি পারব।
বেশ কষ্ট হচ্ছে নিশার।
দো-তলার সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল রফিক। উজ্জ্বল মুখ করে বলল, ইনিই বুঝি ভাবী?
অরূপ বলল, ভাবীটাবী কিছুনা। ওর নাম নিশা, ওর নাম ধরেই ডাকবে।
রফিক বলল, এত বড় সুটকেস, দিন, দিন! আমাকে দিন।
অরূপ বলল, নিজের বউকে দিয়ে সুটকেস বওয়াচ্ছি, লোকে ভাববে আমি একটা পাষণ্ড। কিন্তু আমার যে পায়ে এখন ব্যথা।
রফিক বলল, জানি তো! আমি তুলে দিচ্ছি।
অরূপ বলল, চিনে রাখো, এই হচ্ছে পরপোকারী রফিক। যখন যা অসুবিধে হবে, বিনা দ্বিধায় এর শরণাপন্ন হবে।
নিশা কৃতজ্ঞ চোখে তাকাল রফিকের দিকে।
রফিক বলল, আমি দো-তলায়, আপনাদের পদতলেই আছি!
চাবি দিয়ে দরজা খুলে অরূপ বলল, এসো রফিক, এক কাপ কফি খেয়ে যাও।
রফিক বলল, না, আমি এখন দৌড়োব। অলরেডি লেট করে ফেলেছি। ভাবী, আপনার সাথে পরে আলাপ হবে। আসি। নিশা মাথা হেলাল।
যে-সব মেয়ে স্বামীর পেছনে কাপড়ের পুঁটুলির মতো দাঁড়িয়ে থাকে, নতুন কারুর সঙ্গে আলাপ হলেও কথা বলতে পারে না, নিশা সে-রকম নয়। সে নিজেই অনুভব করল, রফিকের সঙ্গে কিছু বলা উচিত ছিল, অন্তত ধন্যবাদ জানানো, কিন্তু কিছুতেই সে আড়ষ্টতা কাটাতে পারছে না।
যথারীতি ঘরের মধ্যে সব জিনিসপত্র এলোমেলো ভাবে ছড়ান।
অরূপ বলল, এই তোমার নতুন সংসার। এবার নিজের মতো করে গুছিয়ে নাও। ওঃ, কত দিন পরে আবার সংসারী হচ্ছি।
ফ্রিজ খুলে সে একটা বিয়ারের ক্যান বার করল।
নিশার মনে হচ্ছে, সে যেন অন্য কারুর বাড়িতে অতিথি হয়ে এসেছে। অরূপ যে মাসের পর মাস চিঠি লেখেনি, চিঠির উত্তরও দেয়নি, টেলিফোন ধরেনি, তার কোনও চিহ্ন নেই তার ব্যবহারে। যেন সে নিশার প্রতীক্ষাতেই বসে ছিল।
তবু নিশা অনুভব করছে, অরূপের ব্যবহারে কেমন যেন একটা সূক্ষ্ম কৃত্রিমতা আছে। ঘরের ঠিক মাঝখানটায় দাঁড়িয়ে রইল নিশা।
অরূপ বলল, অ্যাপার্টমেন্টটা ছোট, পরে একটা বড় জায়গায় যাব ঠিক করে ফেলেছি।
নিশা বলল, আমি একটা কথা বলব?
বলো!
শুনলে তুমি রাগ করবে, তবু আমাকে বলতেই হবে।
রাগ করব? আগে শুনি!
আমি হ্যান্ডব্যাগটা হারিয়ে ফেলেছি। তার মধ্যে আমার পাসপোর্ট, টিকিট, চারশো ডলার, সব গেছে! আমারই বোকামির জন্য।
হ্যান্ডব্যাগ হারিয়েছে। এতে রাগ করব কেন? বেশ করেছ! যারা সব জিনিস ঠিকঠাক করে, জিনিসপত্র সামলে রাখে, কখনও কিছু হারায় না, তাদের সঙ্গে আমার একটুও মেলে না। মোটে চারশো ডলার? ফুঃ!
সাইড পকেট থেকে একটা মোটাসোটা পার্স বার করে সেটা নিশার হাতে দিয়ে বলল, এটা রাখো, অনেক টাকা আছে, যেমন ইচ্ছে খরচ করবে!
তারপর সে আপন মনে, নাচের ভঙ্গিতে বলতে লাগল, ব্যাগ হারিয়েছে, ব্যাগ হারিয়েছে, হা-হা হা-হা!
দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল নিশাকে। চুমু দিল, যাকে বলে প্রগাঢ় চুম্বন। শুরু হল আদর। টানতে টানতে নিয়ে গেল সোফার ওপর।
শারীরিক মিলনে উদ্বোধন হল এই নতুন সংসারের। দিন সাতেকের মধ্যে এই জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেল নিশা।
সে এখন একা একা রাস্তায় বেরোয়। দোকানে কেনাকাটি করে। সে দেশে কিছু দিন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়িয়েছে, ইংরিজি বলতে তার অসুবিধে হয় না।
অরূপ যখন-তখন বেরিয়ে যায়। কোথায় যায়, বলে না। আবার কখনও ঘণ্টার পর ঘন্টা টেবিলে বসে লেখালেখি করে, সে ইংরিজিতে একটা উপন্যাস লিখতে শুরু করেছে। একটা কমপিউটার এনেছে, তবু হাতেই লেখে, এক-এক সময় অনেকগুলো পাতা ছিঁড়ে ফেলে।
সেই ছেঁড়া টুকরোগুলো উড়তে থাকে ঘরের মধ্যে।
বাড়িতে থাকলে সর্বক্ষণই সে বিয়ার খায়, গাঁজা খায়। বেশি রাতে হুইস্কি নিয়েও বসে, তখন নেশার ঝোঁকে গান গায়, বিড় বিড় করে আপন মনে বকে।
এক-একসময় নিশা যে ঘরের মধ্যে আছে, তা যেন সে গ্রাহ্যই করে না। টেলিফোনে কারুর সঙ্গে গল্প করে বহুক্ষণ।
নিশা বুঝতে পারে, তার স্বামী এত দিনের দূরত্বে তার কাছে এখন অনেকখানি অচেনা হয়ে গেছে। নিশার সঙ্গে অবশ্য সে খারাপ ব্যবহার করে না। সংসার নিয়ে মাথা ঘামায় না।
শুধু একরাত্তিরে, অরূপ মদের বোতল পাশে নিয়ে লেখার টেবিলে অনেকক্ষণ ধরে ব্যস্ত, একটাও কথা বলছে না, একা একা টিভি দেখে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে নিশা। হঠাৎ অরূপ তাকে এক ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে জড়িত গলায় জিজ্ঞেস করল, অ্যাই, তুই কে রে?
ধরমড় করে উঠে বসল নিশা।
অরূপ আবার জিজ্ঞেস করল, তুই কে? আমার বিছানায় শুয়ে আছিস কেন?
নিশা বলল, তুমি কী বলছ?
অরূপ ধমক দিয়ে বলল, কী বলছি, শুনতে পাচ্ছিস না? কানে কালা? তুই কে?
আমি নিশা। তোমার স্ত্রী।
আমার স্ত্রী! আমি আবার বিয়ে করলাম কবে?
তোমার নেশা হয়ে গেছে!
আলবাৎ নেশা হবে! কারুর বাপের টাকায় নেশা করি না। গায়ে খেটে, হা-হা-হা-হা, নিজের শরীর দিয়ে রোজগার করি।
তুমি এবার শুয়ে পড়ো প্লিজ!
শোবো? তোর পাশে? তুই কে, তা না জেনে?
নেশা করলে কি মানুষের চোখের দৃষ্টিও নষ্ট হয়ে যায়? ভাল করে তাকিয়ে দেখো, আমি নিশা।
নিশা? নেশা! আমার কি নিশা হয়েছে, না নেশা হয়েছে? ও হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমার নিশা নামে একটা বউ আছে। ভাল মেয়ে। সুন্দর মেয়ে। কিন্তু সে তো ইন্ডিয়ায়, এখানে আসবে কী করে? কেনইবা এখানে আসতে যাবে? এখানে কিছু নেই। ফক্কা! কেন এখানে এসেছিস?
এসেছি তোমার জন্য!
আমার জন্য? আমি, আমি অরূপ দাস, একটা বিফল মানুষ। আমি মরে যেতেও পারতাম। জীবন নিয়ে জুয়া খেলেছি। নিশার মতো একটা সরল, পবিত্র মেয়ে আমার কাছে কী পাবে? আমার কেন পা ভেঙেছিল জানো? আমার একটাও পয়সা ছিল না, নট আ সিংগল ডাইম, হা-হা-হা-হা, কেউ বুঝতে পারেনি, ড্যাম ইট, আমি বেঁচে আছি কেন, কেন, কেন?
হঠাৎ নিশাকে ছেড়ে দেওয়ালে মাথা ঠুকতে লাগল অরূপ।
প্রথমে ভেবেছিল, এ-সব মাতালের প্রলাপ, এখন নিশা আরও ভয় পেয়ে গেল। মানুষটা পাগল হয়ে গেছে নাকি? এত জোর মাথা ঠুকছে যে দুম দুম শব্দ হচ্ছে, সেই সঙ্গে কাঁদছে অরূপ।
নিশা উঠে গিয়ে জোর করে টেনে হিঁচড়ে তাকে শুইয়ে দিল বিছানায়। একটা তোয়ালে ভিজিয়ে এনে মুছে দিল মুখ। তখনও অরূপ অবোধ শিশুর মতো কেঁদেই চলেছে, কাঁদতে কাঁদতেই ঘুমিয়ে পড়ল একসময়।
সকালে সে আবার স্বাভাবিক মানুষ। আগের রাতের কথা উল্লেখও করল না একবারও।
নিশাও কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পেল না।
প্রথম দিন অরূপ যে-রকম প্রবল ভাবে শারীরিক আদর করেছিল নিশাকে, তারপর আর একবারও তাকে সে-রকম ভাবে স্পর্শ করেনি। কিছু একটা যেন দুশ্চিন্তা তার মাথা জুড়ে আছে।
রফিক আসে মাঝে মাঝে। তখন বেশ স্বাভাবিক ভাবে গল্প হয়। রফিক দারুণ গান ভালবাসে, এলেই অরূপকে কোনও না-কোনও গান শোনাবার জন্য ফরমাস করে। অরূপ গান গায়। এখন সে ইংরিজি গানও বেশ গাইতে পারে। কয়েকটা বাউল গান, রবীন্দ্রসঙ্গীত ইংরিজিতে অনুবাদ করেছে, স্থানীয় টেলিভিশনেও এক দিন অরূপ সেইসব গান গেয়েছে।
এক দুপুরে বেল শুনে নিশা দরজা খুলে দেখল, একটি লম্বা মতো আমেরিকান মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তার দু’কাঁধে কয়েকখানা ঝোলা ব্যাগ, মাথার চুল উলুস ঝুলুস, ঠোঁটের এক কোণে একটা বড় আঁচিল।
দু’জনেই দু’জনকে দেখে কয়েক মুহূর্ত থমকে রইল।
তারপর লিজই আগে খানিকটা যান্ত্রিক ভাবে বলল, হাই! আই অ্যাম লিজ সেগান।
অরূপ টেবিলে বসে লিখছিল, উঠে এসে বলল, লিজ! কাম অন ইন। মিট মাই ওয়াইফ নিশা।
ওয়াইফ কথাটা শুনে লিজের মুখে সামান্য একটা ছায়া খেলে গেল। তার পরই সে নিশার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, গ্ল্যাড টু মিট ইউ।
অরূপ জিজ্ঞেস করল, লিজ, তুমি মেরিল্যান্ড থেকে কবে ফিরলে? অনেক দিন তোমার পাত্তা নেই।
লিজ বলল, আজই সকালে। মা অসুস্থ ছিল, তাই থেকে যেতে হল। মা এখন ভাল আছে।
অরূপ নিশাকে বলল, নিশা, এই আমার বান্ধবী লিজ। ওর কাছে আমি স্প্যানিশ ভাষা শিখছি।
নিশা বলল, আপনি বসুন। একটু চা কিংবা কফি খাবেন?
অরূপ বলল, ও চা-কফি একদম খায় না। বিয়ার দিচ্ছি।
লিজ নিশাকে জিজ্ঞেস করল, আপনি বেঙ্গলি? ক্যালকাটা থেকে আসছেন? বেঙ্গলি হলে নিশ্চয়ই ফুলকপি ভাজা করতে পারেন? এক্ষুনি খেতে পারি।
দু’চার মিনিট কথার পর নিশা ফুলকপি ভাজতে গেল, আর অরূপ সিগারেটে ভরতে লাগল গাঁজা।
অরূপের জোরাজুরিতে নিশা এর মধ্যে দু’একবার গাঁজা-সিগারেটে টান দিয়ে দেখেছে, তার সহ্য হয়নি। তার বেদম কাশি হয়। এরপর অনেকক্ষণ ধরে লিজ আর অরূপ গাঁজা টানতে টানতে গল্প করতে লাগল নিজেদের মধ্যে, নিশাকে পাত্তাই দিল না।
তারপর দুজনেই এক সঙ্গে বেরিয়ে গেল সন্ধের সময়
পরদিন দুপুরে প্রায় ওই একই সময় বেজে উঠল টেলিফোন। নিশা ফোন তুলে শুনল স্ত্রীকণ্ঠ। লিজ। সে জিজ্ঞেস করল, নিশা, তুমি কি খুব ব্যস্ত আছ? আমি একবার তোমার ওখানে আসতে পারি?
অরূপ দশটার সময় বেরিয়ে গেছে, লাঞ্চ খেতেও আসেনি।
সে বলল, অরূপ তো এখন বাড়িতে নেই।
লিজ বল, অরূপ নেই তা জানি, আমি তোমার সঙ্গেই কয়েকটা কথা বলতে চাই। আসব?
এসো।
আজ লিজের চুল আঁচড়ানো, স্কার্ট-ব্লাউজ পরা, মুখখানায় বেশ শান্ত ভাব। অতগুলো ঝোলা ব্যাগ নেই। একটা দামি পারফিউম ও এক বাক্স ভাল সাবান এনেছে।
সেগুলো নিশার হাতে দিয়ে বলল, আমি দুঃখিত, কাল তোমার সঙ্গে ভাল করে কথা বলা হয়নি। অত দূর থেকে তুমি আমাদের দেশে এসেছ, তোমাকে ওয়েলকাম করা উচিত ছিল। এক-এক দিন আমার মাথার ঠিক থাকে না। তোমার কেমন লাগছে এ-দেশে?
নিশা শুকনো ভাবে বলল, ভালই তো।
দেশের জন্য মন কেমন করছে না? আমি শুনেছি, ও-দেশ থেকে যারা নতুন আসে, তার প্রথম কিছু দিন হোম সিকনেসে ভোগে।
দেশের জন্য? হ্যাঁ, মন কেমন করে। যদিও দেশে আমার আপন জন বলতে বিশেষ কেউ নেই।
আমি তোমাকে কয়েকটা কথা বলতে এসেছি নিশা। কী করে শুরু করব, বুঝতে পারছি না। একটা অনুরোধ করব? আমি যা বলব, তুমি বিশ্বাস করবে? আই হেট টু টেল লাইজ।
শুধু শুধু তুমি দুপুরবেলা মিথ্যে কথা বলতে আসবে কেন? আমি তো তোমার কাছে কিছু জানতে চাইনি।
তবু আমার বলা দরকার। অরূপ আমার বেশ কিছু দিনের বন্ধু। ও নানা রকম গান করে। গান ভালবাসে খুব, সেখানেই আমাদের মিল। মানুষ হিসেবেও খুব ইন্টারেস্টিং। কিন্তু ও যে বিবাহিত, সেকথা আমাকে কোনও দিন ঘুণাক্ষরেও বলেনি। আমি ওর বাড়ির কথা অনেক বার জানতে চেয়েছি। ও অনেক লোকের কথা বলেছে, কিন্তু নিজের স্ত্রীর অস্তিত্বের কথা উচ্চারণও করেনি।
হয়তো আমার কথা ভুলেই যেতে চেয়েছিল। আমি জোর করে এখানে এসেছি। জানি না, সেটা আমারই ভুল হয়েছে কি না।
সেটা তোমাদের দুজনের ব্যাপার। কিন্তু সে-জন্যে আমি কোনও কারণ হতে চাইনা। পৃথিবীতে বিবাহিত লোকেরা অনেকেই বউয়ের কথা গোপন করে অন্য মেয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে, প্রেম করে, এমনকী শয্যাসঙ্গীও হয়, এটা এমন কিছু নতুন ব্যাপার নয়। বিবাহিত মেয়েরাও কি এরকম করেনা? বিয়ে জিনিসটাই তো একটা কৃত্রিম সামাজিক বন্ধন! আমি ও জিনিসটার কানাকড়িও মূল্য দিইনা।
সেটা তোমাদের দেশে সম্ভব। কিন্তু আমাদের দেশে– ।
শোনো নিশা, বিয়ে হোক বা না থোক, কোনও নারীর কাছ থেকেই তার পুরুষকে আমি কেড়ে নিতে চাই না। সেটা আমার রুচিতে বাধে। তাছাড়া মিথ্যে কথা বলে ও আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে গেল কেন? কাল আমি আগে থেকেই একটু নেশা করে এসেছিলাম, তখন মাথার ঠিক থাকে না। ঠিক খেয়াল করিনি। আজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই মনে হল, অরূপের সঙ্গে আমার সম্পর্ক শেষ। এটা একশো ভাগ সত্য। আগে যা হয়েছে, সেটা যদি তুমি মেনে নিতে পারো, তবে আমি বলছি, আমার দিক থেকে তোমার কোনও রকম বিপদ হবার সম্ভবনা নেই। এরপর অরূপ আমার কাছে গেলে আমি তার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেব।
নিশা চুপ করে রইল।
লিজ নিশার বাহু ছুঁয়ে আবেগের সঙ্গে বলল, এটা তোমাকে বিশ্বাস করতেই হবে।
নিশা কী বলবে, ভেবে পেল না।
লিজ আবার বলল, তুমি একটি মেয়ে, আমিও একটি মেয়ে, আমি জীবনে কক্ষনও কোনও মেয়ের ক্ষতি করবনা। পুরুষরা এখনও কত রকম ভাবে মেয়েদের দমিয়ে রাখে, তার পরে মেয়েরাও যদি মেয়েদের সঙ্গে শত্রুতা করে, তাহলে আমরা ওদের সঙ্গে সমান হয়ে দাঁড়াব কী করে?
ধন্যবাদ, লিজ।
এখনও বিশ্বাস করছনা?
করছি।
অরূপ মানুষটা ঠিক খারাপ নয় কিন্তু–। অনেকগুণ আছে। এক-এক জন মানুষ বোধহয় একাকিত্বের অসুখ নিয়ে জন্মায়। কিছুতেই সেটা ঘোচে না। তাই তারা এক-এক সময় ছটফট করে, হিংস্র হয়ে ওঠে, অনেকের মধ্যে নিজেকে লুকোতে চায়, অরূপও সে-রকম। আমি ছাড়াও ওর আরও বান্ধবী আছে। মার্থা নামে একটা মেয়েকে নিয়েও কদিন খুব মেতে উঠেছিল। কিন্তু আমি জানি, কারুর সঙ্গেই ওর গভীর সম্পর্ক হয় না, সবই ওপর ওপর, সব সময় অস্থির। তোমাকে একটা কথা বলব নিশা? শুধু এক জন মানুষের স্ত্রী হয়ে থাকা ছাড়াও তোমার একটা নিজস্ব অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করা উচিত। তোমার একটা আলাদা পরিচয়। তাহলে অরূপও তোমাকে সম্মান করতে বাধ্য হবে।
সেকথা আমিও অনেক বার ভেবেছি।
তুমি একটা কিছু কোর্স নাও। বাড়িতে বসে থেকো না। অথবা পৃথিবীতে একটি নতুন শিশুকে নিয়ে এসো।
হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে লিজ বলল, আমি বেশি বেশি কথা বলছি, না? বক্তৃতার মতো শোনাচ্ছে? মাস্টারি করি তো! আমি ক্লাসে ভাল পড়াই। আবার আমার মধ্যেও সব কিছু ভাঙার একটা প্রবণতা আছে। নিজেকেও ভাঙতে চাই। সবরকম নিয়ম ভাঙতে চাই। বোধহয় সেই জন্যই নেশা করা –। চলি, আমার কাজ আছে।
দরজার কাছে গিয়ে সে আবার ফিরে দাঁড়িয়ে বলল, আমাকে তোমার বন্ধু বলে গণ্য করলে খুব খুশি হব।
.
০৬.
পর পর দুদিন অরূপ প্রায় একটাও কথা বলল না নিশার সঙ্গে।
কখনও সে লিখছে, কখনও পায়চারি করছে ঘরের মধ্যে, অথবা ঝুপ করে শুয়ে পড়ছে লম্বা সোফাটাতে। হঠাৎ হঠাৎ বেরিয়ে যাচ্ছে, কিংবা খেতে বসেও উঠে যাচ্ছে মাঝখানে। নিশা কিছু জিজ্ঞেস করলে, উত্তরে শুধু হ্যাঁ কিংবা না।
দিনের পর দিন সে স্নান করে না, দাড়ি কামায় না, জিন্সের যে প্যান্ট-শার্ট পরে থাকে সারা দিন, তাই পরেই ঘুমোয়। সিগারেটের টুকরো জমে জমে অ্যাশট্রেটা পাহাড় হয়ে যায়।
তৃতীয় দিন আবার একটা দারুণ চমক পেল নিশা। ঘুম থেকে চক্ষু মেলেই। এত সকালেই স্নান করে নিয়েছে অরূপ, চুল ভিজে। পরিষ্কার দাড়ি কামানো। সব চেয়ে বড় কথা, সে পরে আছে ধপধপে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি। যেন সম্পূর্ণ নতুন মানুষ।
নিজে দুকাপ চা বানিয়ে নিশাকে ডেকে তুলেছে।
বিছানায় উঠে বসে চায়ে চুমুক দিল নিশা। অরূপ একটু দূরে, চেয়ারে।
অরূপ শান্ত গলায় বলল, তোমাকে কয়েকটা কথা বলা দরকার নিশা। কদিন তোমার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করিনি, তাতে তুমি নিশ্চয়ই কষ্ট পেয়েছ। সেজন্য আমার মায়াও হচ্ছিল, অথচ মেজাজ ঠিক করতে পারছিলাম না। আমি এ-রকমই। একটা কথা জিজ্ঞেস করি, আমার সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি, কথা হয়নি, তবু তুমি হুট করে এই দূর দেশে চলে এলে কোন সাহসে?
নিশা সরাসরি অরূপের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, আমিও এ-রকমই।
অরূপ বলল, বাঃ! তুমি এসেছ বলে আমি যে খুশি হইনি, তা নয়। কেন খুশি হব না? আমি তোমাকে ভালবেসে বিয়ে করেছি, কেউ তো জোর করে বিয়ে দেয়নি। সে-ভালবাসা চলেও যায়নি। আবার একথাও ঠিক, খানিকটা অস্বস্তিও বোধ করেছি। সংসার মানেই দায়িত্ব! দায়িত্ব নেবার অভ্যেস আমার চলে গেছে। যখন যা খুশি করি। এখন একটা দায়িত্বের বোঝা ঘাড়ে নেওয়া–।
নিশা বেশ জোর দিয়ে বলল, আমি তোমার বোঝা হয়ে থাকতে চাই না। তুমি আমার পাসপোর্ট আর টিকিট উদ্ধার করার ব্যবস্থা করে দেবে? আমি ফিরে যাব।
অরূপ বলল, হ্যাঁ, সেগুলি উদ্ধারের ব্যবস্থা করতে হবে এবার। কিন্তু তুমি কেন ফিরে যাবে? আমি তো তোমাকে বোঝা বলিনি। দায়িত্বটাই বোঝা। সেটা যদি ভাগ করে নেওয়া যায়…। আসলে কি জানো নিশা, আমি নিজেকেই বিশ্বাস করতে পারি না। এবার সামলে উঠতে হবে। আজ সকালে হঠাৎ মনে হল, এবার অন্য জীবন শুরু করা দরকার। তুমি আমাকে সাহায্য করবে?
নিশা বলল, আমি কী সাহায্য করব জানি না। তবে, তুমি যদি বলে দাও, সাধ্যমতো নিশ্চয়ই–
অরূপ বলল, তোমাকে একটা কথা বলা দরকার। আমার অনেক দিন চাকরি নেই, এলেবেলে চাকরি করতেও ইচ্ছে করে না, মন টেকে না। এর মধ্যে আমি এমন একটা কাণ্ড করেছি, শুনলে তুমি শিউরে উঠবে। জীবন নিয়ে জুয়া খেলেছিলাম। তখন আমার হাতে একটাও পয়সা ছিল না। বাড়িভাড়া বাকি, চতুর্দিকে ধার। তখন লেসলি নামে একটা কালো ছেলে একটা বুদ্ধি দিল। ইনসিওরেন্স কোম্পানির কাছ থেকে টাকা আদায় করা। তার একটা উপায়, বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া। আগে ফায়ার ইনসিওরেন্স করিয়ে তারপর ক্ষতিপূরণ চাওয়া। কিন্তু তাতে ঘরের মধ্যে কিছু অদ্ভুত দামি দামি জিনিস রাখতে হয়, আগুন ধরার আগে সেগুলো সরিয়ে নিলেই হল। কিন্তু দামি জিনিস রাখার সামর্থ্যও ছিল না, আগেই সব বিক্রি করে দিয়েছি। আর একটা উপায়, কোনও চলন্ত গাড়ির সামনে ঝাঁপিয়ে পড়া। এমন ভাবে পড়তে হবে, যাতে বিশেষ ক্ষতি না হয়। বড় রাস্তায় গাড়ি খুব স্পিডে ছোটে। কোনও গলি থেকে বড় রাস্তার মুখে, সকালে, যখন রাস্তায় অনেক লোক থাকে, কাছাকাছি পুলিশ আছে কিনা দেখে রাখতে হয়, ইনসিওরেন্স কোম্পানি ক্লেইম দিতে বাধ্য…আমার একটু ভুল হয়েছিল, টাইমিং-এর ভুল, তাই বাঁ-পায়ের ওপর একটা চাকা এসে পড়ল, সেই মুহূর্তে মনে হয়েছিল, আমি বুঝি মরেই গেছি।
নিশা এমন ভাবে তাকিয়ে আছে, যেন সে ভূত দেখছে। ইচ্ছে করে কোনও শিক্ষিত মানুষ, শুধু টাকা রোজগারের জন্য চলন্ত গাড়ির সামনে লাফিয়ে পড়তে পারে?
অরূপ হাসতে হাসতে বলল, এটা জুয়া খেলা নয়? রাশিয়ান রুমেৎ নামে এক রকম জুয়া আছে, রিভলবারের মধ্যে একটা মাত্র গুলি ভরে, তারপর নিজের কপালে…অবশ্য ইনসিওরেন্স কোম্পানির কাছ থেকে ভাল টাকা আদায় করতে গেলে মামলা লড়তে হয়। উকিলের খরচও অনেক। সে-টাকা পাব কোথায়? এ-দেশে এক রকমের উকিল থাকে, তাদের বলে ভালচার, শকুনি। এ ধরনের ঘটনা ঘটলে তারা নিজেরাই উড়ে আসে। নিজেরাই মামলা লড়ে। ক্ষতিপূরণের টাকা আদায় করে, খরচ খরচা বাদ দিয়ে তার অর্ধেকটা উকিল নিয়ে নেয়। আমি বেশ ভাল টাকাই পেয়েছিলাম। এই হচ্ছে আমার পা ভাঙার রহস্য।
নিশা বলল, তুমি আমার ফিরে যাবার ব্যবস্থা করে দাও, প্লিজ!
অরূপ আরও জোরে হেসে উঠে বলল, ভয় পেও না। ও-রকম কাজ দ্বিতীয় বার করতে গেলে ধরা পড়ে যাব। জীবনটা বাজি রেখে একবারই জুয়া খেলা যায়। এবার একটা কিছু চাকরি করতেই হবে। পেয়ে যাব। কিন্তু তার আগে– ।
কয়েক মুহূর্ত সে স্থিরভাবে চেয়ে রইল নিশার দিকে। অনেকটা যেন আপন মনেই বলতে লাগল, তার আগে শ্লেটটা মুছে ফেলতে হবে। আই মাস্ট স্টার্ট উইথ আ ক্লিন শ্লেট। পারব কি? কেন পারব না!
আবার নিশাকে বলল, লিজ তোমাকে কী বলে গেছে আমি জানি। কিছুই অস্বীকার করছি না। এ-রকম কিছু কিছু কাণ্ড আমি করেছি। লোকে যা ইমমরাল বলে, সে-রকম অনেক কীর্তি করেছি নেশার ঝোঁকে। আমার লিবিডো প্রবল। সংযম-টংযম গ্রাহ্য করিনি। কিন্তু এবার সত্যিই সেসব পুরনো ব্যাপার মুছে ফেলতে চাই। তোমাকে নিয়ে একটা সুস্থ, সুন্দর জীবন শুরু করতে চাই। আগে যা যা করেছি, তার জন্য কি তুমি আমাকে ক্ষমা করতে পারবে? স্বামী হিসেবে নতুন করে মেনে নিতে পারবে আমাকে?
নিশা হঠাৎ কাঁদতে শুরু করে দিল।
অরূপ অস্থিরভাবে বলল, নিশা, চুপ করে থেকো না, বলো, বলো, আমি সব কিছুর জন্য তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি।
নিশা কান্না সামলাতে পারছে না, কথা বলতে পারছে না।
এরপর সারাদিনটা যেন নিশার জীবনে সব চেয়ে মধুর দিন। অরূপ বাইরে বেরুল না। সে নিজে নতুন নতুন রান্না করে খাওয়াল নিশাকে। বিয়ার পান করলনা, গাঁজা টানল না, শুধু মুখোমুখি বসে অনেক গল্প।
এক সময় অরূপ বলল, তুমি এত দিন এসেছ, তোমাকে তো কিছুই দেখানো হয়নি। এই শহরে এসে সবাই আগে নায়েগ্রা ফলস দেখতে যায়। একটা ব্রিজ পেরিয়ে, ও-পারে ক্যানাডার দিক থেকে দেখা যায় খুব ভাল করে। চলো, কালই নিয়ে যাব তোমাকে।
একটু ভেবে সে আবার বলল, আরও কয়েক জনকে নিয়ে বেশ একটা পিকনিক করলে হয়। দাঁড়াও, রফিককে জিজ্ঞেস করি।
ফোনে কথা হল রফিকের সঙ্গে। রফিক রাজি, কিন্তু কালই যেতে পারবে না, তিন দিন পরেই শনিবার, সেই দিনই তার সুবিধে।
অরূপ তাতেই রাজি। রফিকের গাড়িটা বড়, যাওয়া হবে সেই গাড়িতে।
পরবর্তী দু’দিন বেশ ব্যস্ত রইল অরূপ। নানা জায়গায় চাকরির সন্ধান করছে। সন্ধের সময় সে অনেকরকম কেক-পেস্ট্রি কিনে আনে। নেশা করে না। গান শোনে। সত্যিই সে যেন অন্য মানুষ হয়ে গেছে।
শনিবার বেলা এগারোটায় বেরিয়ে পড়ার কথা। তার আগে অরূপ বলল, তাকে এক জায়গায় ইন্টারভিউ দিতে যেতে হবে। ফিরে আসবে ঠিক এগারোটার মধ্যে। বড় জোর পাঁচ-দশ মিনিট দেরি হতে পারে।
স্নান-টান সেরে তৈরি হয়ে নিল নিশা। আজ সে বেশ সাজগোজ করল। এই প্রথম তার বেড়াতে যাওয়া।
এর মধ্যে রেহানার সঙ্গেও কথা হয়েছে, সে-ও যাবে। এখানকার পাট চুকিয়ে রেহানা চলে যাচ্ছে ক্যালিফোর্নিয়ায় আর চার দিন পরে। সেখানে সে তার স্বামীর কাছাকাছি থাকবে।
এগারোটার একটু আগেই পৌঁছে গেল রেহানা। রফিকও ওপরে এসে তাড়া দিল, সব রেডি তো? একটা বাস্কেট নানা রকম খাবার-দাবার, বিয়ার, কোল্ড ড্রিংকস গুছিয়ে নেওয়া হয়েছে। এখন শুধু অরূপের ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা।
সাড়ে এগারোটা, বারোটা বেজে গেল, অরূপের পাত্তা নেই।
ওরা তিন জন গল্পে মেতে আছে বটে, মাঝে মাঝেই ঘড়ি দেখছে অস্থির ভাবে। সাড়ে বারোটা, একটা, দেড়টা…।
টেলিফোন বেজে উঠল। নিশা ধরার পর অরূপ বলল, ছি ছি, কী লজ্জার কথা, তোমরা নিশ্চয়ই তৈরি হয়ে বসে আছ, আমি বিশ্রীভাবে আটকে গেছি। এখানকার জেনারাল ম্যানেজার আমাকে বসিয়ে রেখেছে, কোম্পানির ভাইস প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আমাকে কথা বলিয়ে দিতে চায় আজই। তোমরা বেরিয়ে পড়ো, ফোনটা রফিককে দাও।
রফিক বলল, তুমি আসতে পারছ না? তাহলে আজ থাক।
অরূপ বলল, না না, শুধু শুধু তোমরা দিনটা নষ্ট করবে কেন? তোমরা চলে যাও। আমি যদি আর কিছুক্ষণের মধ্যে ছাড়া পাই, আমি ওখানে গিয়ে তোমাদের সঙ্গে জয়েন করব। তুমি গাড়িটা পার্ক করবে কোথায়? আমি খুঁজে নেব। আর দেরি কোরো না, মেঘলা হয়ে গেলে রামধনুটা দেখতে পাবে না। নিশাকে ভাল করে ঘুরিয়ে দেখিও। নিশার ভার তোমার ওপর।
ফোন ছেড়ে দিয়ে রফিক বলল, অরূপের কি শরীরটা খারাপ? গলার আওয়াজ ভাঙা ভাঙা শোনাল।
নিশা বলল, আমারও কেমন যেন লাগল। সকালবেলা তো ঠিকই ছিল।
একটু মনটা খুঁতখুঁত করতে লাগল নিশার। কিন্তু বেড়াতে গিয়ে সে অপূর্ব আনন্দ পেল। নায়েগ্রা জলপ্রপাতের বিষয়ে সে জানত, ছবিতেও দেখেছে, কিন্তু নিজের চোখে দেখার অভিজ্ঞতাই অন্য রকম। এত বিশাল! এমন স্পষ্ট, স্থায়ী রামধনুও সে আগে কখনও দেখেনি।
এই শহরে যারা থাকে, তাদের বার বার নায়েগ্রা দেখতে হয়, অতিথিদের জন্য। রেহানা দেখেছে তিনবার, রফিক দেখেছে সতেরো বার। ওদের আর তেমন আগ্রহ থাকার কথা নয়। কিন্তু ওরা, বিশেষ করে রফিক এমন যত্ন নিয়ে সব কিছু দেখাতে লাগল নিশাকে, যেন সে-ও প্রথম বার দেখছে।
একেবারে নিচে বোটে চড়তে গিয়ে বেশ ভয় পাচ্ছিল নিশা, রফিক তার হাত ধরে রইল। রেহানা অবশ্য ভয় পায় না, সে সব কিছুতেই হাসে। বাড়ি ফিরে এল রাত সাড়ে নটায়।
অরূপ তখনও ফেরেনি। অরূপকে সব গল্প শোনাবার জন্য ছটফট করছে নিশা। খিদে নেই, তবু সে জেগে বসে রইল।
সে-রাতেই আর ফিরল না অরূপ। পরদিনও না। পাঁচ দিন কেটে গেল, অরূপের কোনও সাড়াশব্দ নেই। যেন মানুষটা একেবারে অদৃশ্য হয়ে গেছে।
টেলিফোন বাজলেই নিশা ছুটে যায়। অন্য নারী বা পুরুষ। তারা অরূপের খোঁজ করে। রফিক প্রত্যেক দিনই একবার করে আসে। অরূপ ফেরেনি শুনে মুখ কালো করে চলে যায়। ষষ্ঠ দিনে রফিক একগাদা মাছ-তরকারি বাজার করে নিয়ে এল।
সে বলল, ভাবী, আমি লক্ষ্য করেছি, আপনি এর মধ্যে একবারও বাড়ি থেকে বেরোননি। টেলিফোনের জন্য অপেক্ষা করেন, তাই না?
নিশা বলল, তা বলে আপনি এত জিনিস কিনে আনবেন? আমি একা একা কত খাব?
রফিক বলল, আমাকেও তো নিজে রান্না করে খেতে হয়। কখনও আপনি রাঁধবেন, আমরা দু’জনে খেতে পারি।
নিশা বলল, তাহলে আজই আপনি এখানে খেয়ে যান।
চেয়ারে বসে রফিক বলল, ভাবী, ব্যাপারটা যদিও খুব অস্বস্তিকর, তবু আপনার জানা দরকার। আপনার স্বামী গায়ক মানুষ, স্বভাবটা খুবই বাউণ্ডুলে হয়ে গেছে। এখানকার যে-সব ছেলে-মেয়ে খুব নেশা-ফেশা করে, তাদের সঙ্গে খুব ভাব। আমি অনেক বার ঠারেঠোরে নিষেধ করেছি। এদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কি আমরা পারি? লিজি নামে একটা মেয়ে আছে, এখানে অনেকেই চেনে, এ বাড়িতে বেশ কয়েক বার আসতে দেখেছি। মাঝে মাঝেই সে উধাও হয়ে যায় কোনও ছেলের সঙ্গে। সে-ই হয়তো ভুলিয়ে ভালিয়ে অরূপকে কোথাও নিয়ে গেছে।
লিজির নাম শুনে নিশার মুখখানা কয়েক মুহূর্তের জন্য কঠিন হয়ে গেল। মেয়েটা একদিন এসে কত বড় বড় কথা শুনিয়ে গেল। সে নাকি মিথ্যে কথাকে ঘৃণা করে। তার পুরোটাই মিথ্যে! এ-দেশের মেয়েরা এমনই হয়?
মুখ তুলে সে বলল, অরূপ কি ছেলেমানুষ যে-তাকে কেউ ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিয়ে যাবে? একটা খবর পর্যন্ত দিল না!
রফিক বলল, এমনিতে মানুষটা ভাল, মাঝে মাঝে কী যে পাগলামি চাপে মাথায়।
আপনি আমার একটা উপকার করবেন? আমার পাসপোর্ট, টিকিট হারিয়ে গেছে, সেগুলোর ডুপ্লিকেট জোগাড় করার ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন?
হারিয়ে গেছে?
হ্যাঁ, বোস্টনে, চুরি গেছে! থানায় ডায়েরি করা আছে, সে প্রমাণও আছে আমার কাছে।
টিকিটের আগে, আপনার পাসপোর্টের ব্যবস্থা করতে হবে। সেটাই আপনার আইডেনটিটি। এখানে হবে না, নিউ ইয়র্ক থেকে… আপনার ইন্ডিয়ান পাসপোর্ট, ওখানে তো আমার কেউ চেনা নেই, দেখি খোঁজখবর নিয়ে।
দেখুন প্লিজ, আমি বুঝে গেছি, এ-দেশে আমার থাকা হবে না।
অত চিন্তা করবেন না। একটা কিছু ব্যবস্থা হয়ে যাবেই!
কী রান্না করব, আপনি কী ভালবাসেন বলুন!
ছোট বাঁধাকপি এনেছি, তার সঙ্গে চিংড়ি মাছ দিয়ে কেমন হয়?
ভালই হবে। চিংড়ি মাছকে আপনারা ইচা মাছ বলেন না বাংলাদেশে?
অনেকে বলে। আপনি জানলেন কী করে?
আমার মা-বাবা সবাই তো বাঙাল!
দিনের পর দিন কেটে যায়, অরূপের কোনও সাড়াশব্দ নেই। কোনও দুর্ঘটনা ঘটতে পারে? আবার কি সে জীবন নিয়ে জুয়া খেলতে গেছে? গাড়িটা নিয়ে গেছে, সঙ্গে ক্রেডিট কার্ড আছে, দুর্ঘটনায় পড়লে পুলিশ ঠিক পরিচয় বার করে ফেলে। টিভি-তে সেই রকম কত ঘটনা দেখায়।
প্রত্যেক দিন রফিক একবার খোঁজ নিয়ে যায়। তার আচরণ অত্যন্ত ভদ্র। দুজনে এক সঙ্গে বসে খায় প্রায়ই কিন্ত রফিক কক্ষনও কোনও অসভ্যতা তো দূরে থাক, হাতটাও ধরেনি।
রেহানা এখানে নেই, আর কার সঙ্গেই-বা কথা বলবে নিশা।
কয়েকবার অবনীর কথা ভেবেছে। কিন্তু অবনী তো নিজে থেকে একবারও তার খোঁজ করেনা। অবনীর কাছে তার ধার আছে শুনে অরূপ তক্ষুনি সে টাকাটা পাঠাবার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। সেই সময় অবনীর সঙ্গে ফোনে তার কথা হয়েছে। অবনী এখানকার ফোন নাম্বার জানে। সে যেন নিশার সঙ্গে কোনও রকম ব্যক্তিগত সম্পর্ক চায় না।
একবার অবনী যথেষ্ট সাহায্য করেছে, আবার বিপদে পড়ে সে অবনীর কাছে সাহায্য চাইবে কেন? না, কোনও দরকার নেই।
নিছক কৌতূহলে সে একবার ফোন করল লিজকে। সে বাড়ি নেই, চারবার রিং হবার পরেই চালু হয়ে গেল আনসারিং মেশিন। দূর ছাই বলে রেখে দিল নিশা।
শুধু ওই দূর ছাইটুকু শুনেই রাত্তিরে ফোন করল লিজ। কিন্তু এখন আর নিশার কথা বলতে ইচ্ছা করছে না।
সে বলল, ফোন করেছিলাম বলে দুঃখিত। আমার কিছু বলার নেই।
লিজ বলল, এক সেকেন্ড। তুমি কি আমার সম্পর্কে কিছু ভুল ধারণা করেছ?
আমার আর কিছু যায় আসে না।
শোনো, আমি আজই জানতে পারলাম যে, অরূপ শহরে নেই। তোমার সঙ্গে কথা হবার পর আর একবারও অরূপের সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। আমি আমার বাড়িতে তাকে আসতে বারণ করে দিয়েছি। তবে আমাদের কয়েক জন কমন বন্ধু আছে, তাদের কাছ থেকে নানা রকম খবর পাই। অরূপ তোমাকে না জানিয়ে কোথাও চলে গেছে?
সে বেঁচে আছে কি না আমি তা-ও জানি না।
মার্থা নামে আমাদের বান্ধবীকেও কয়েক দিন দেখছি না। তার গাড়ি রয়েছে বাড়ির সামনে, সে নেই। অরূপ কি গাড়ি নিয়ে গেছে?
হ্যাঁ।
তাহলে মার্থার সঙ্গেই কোথাও গেছে মনে হয়। বাল্টিমোরে একটা মিউজিক ফেস্টিভাল হচ্ছে।
থাক, আমি আর শুনতে চাই না।
সত্যিই এই ধরনের কথা আর শুনতে ইচ্ছে করে না নিশার।
এর মধ্যে সে এক দিনও আর কাঁদেনি। বরং সব সময় যেন রাগে ফুঁসছে। অনেকটা নিজেরই ওপর রাগ। কেন নিজের পায়ে দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই তার?
সেই রাগটা পরদিন অকারণে রফিকের ওপরই প্রকাশ করে ফেলল।
ইলিশ মাছ জোগাড় করে এনেছে রফিক। টাটকা। নিশা দরজা খোলার পরই সে উল্লাসের সঙ্গে বলে উঠল, বৃষ্টি আসছে, আজ খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ ভাজা।
রাগে গনগনে মুখ করে নিশা বলে উঠল, কেন রোজ রোজ এ-সব নিয়ে আসেন আপনি? আমি কি আপনার রাঁধুনি? আমার ওপর করুণা করছেন? আমি করুণা সহ্য করতে পারি না। আমি নিজেই নিজের ব্যবস্থা করতে পারব। ফেরত নিয়ে যান ওটা। এ পর্যন্ত কত খরচ করেছেন আমার জন্য, বলে দেবেন, আমি মিটিয়ে দেব।
মুখটা চুপসে গেল রফিকের। তবু সে মিন মিন করে বলল, আপনাকে রান্না করতে হবে না। আমি রাঁধলে আপনি খাবেন আজ?
গলা চড়িয়ে নিশা বলল, না, আমি কিছু খাব না। আমি খাই বা না খাই, তাতে আপনার কী যায় আসে?
রফিক বলল, আপনার আজ খুবই মেজাজ খারাপ দেখছি। তাহলে ইলিশ থাক ডিপ ফ্রিজে। পরদিন সকালে আর রফিক এল না, নিশাও তাকে ডাকতে গেল না। কেন সে বার বার অন্যের অনুগ্রহের ভিখারি হবে? দুপুরবেলা ফোনটা হঠাৎ অচল হয়ে গেল।
রফিক এক দিন ইঙ্গিত দিয়েছিল, এখানে ফোনের বিল এক মাসের বেশি বাকি রাখলেই লাইন কেটে দেয়। এই ভাবে রান্নার গ্যাসও বন্ধ হয়ে যায়।
এই অ্যাপার্টমেন্টের ভাড়া কত দিন বাকি আছে কে জানে! এখানে মামলা-টামলার দিকে কেউ বড় একটা যায় না। ভাড়া দাওনি, গেট আউট। যে-কোনও দিন বাড়িওয়ালা এসে নিশাকে এখান থেকে বার করে দিতে পারে।
পাসপোর্টের ডুপ্লিকেট করার জন্য নিশাকে নিউইয়র্কে যেতে হবে। কে তাকে নিয়ে যাবে, কোথায় উঠবে, ভাড়ার টাকাই-বা কোথায় পাবে? এর মধ্যে আবার একমাত্র বন্ধু রফিককে মনে দুঃখ দিয়ে দূরে সরিয়ে দিয়েছে।
ক্রেডিট কার্ডের যুগ, বাড়িতে ক্যাশ টাকা বিশেষ কেউ রাখে না। শুধু খুচরো পয়সা অনেক জমে যায়। একটা কাচের বোলের মধ্যে রাখা ডাইম আর কোয়ার্টারগুলো গুনে দেখল নিশা, মোট বিয়াল্লিশ ডলার, চল্লিশ সেন্ট। এই তার সম্বল।
অরূপ তার নামে একটা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলে দেবে বলেছিল, দেওয়া হয়নি। ফ্রিজ খালি, ওই খুচরো পয়সা দিয়ে এখনও রুটি-মাখন-ডিম কিনে আনা যায়, তবু বেরুল না নিশা। না খেয়ে থাকবে। কত মানুষই তো এক দিন-দু’দিন খায় না। এখনও চা-চিনি আছে।
চার দিন হয়ে গেল, রফিক আর খোঁজ নিতে আসেনি।
খুব অভিমান হয়েছে! রফিক তার ওপর জোর করে না কেন? নিশা যখন ধমকাচ্ছিল, উলটে সে-ও কেন ধমক দেয়নি? রফিক কি বুঝতে পারে না, কেন নিশার মেজাজ খারাপ হয়? তাহলে আর কীসের বন্ধুত্ব! ইলিশ মাছটা কি সে নিজে রান্না করে খেয়ে ফেলেছে এর মধ্যে?
কিংবা রফিকও অন্য কোথাও চলে গেল নাকি?
নিশা রফিকের খোঁজ নিতে যাচ্ছে না বটে, কিন্তু সর্বক্ষণ মনে মনে রফিকের সঙ্গেই যেন কথা বলছে।
অরূপের ফেলে যাওয়া কিছু সিগারেট রয়ে গেছে। কোনও দিন খায় না, তবু আজ একটা সিগারেট ধরালো নিশা। না, এর মধ্যে গাঁজা-টাজা নেই। অনবরত কাশছে, তা-ও ফেলবে না। গান বাজাতে লাগল খুব জোরে জোরে। সারা দিন যে কিছু খায়নি, সেজন্য বেশ একটা অহঙ্কার বোধ করছে। পয়সা একেবারে ফুরোয়ানি, রফিকের কাছেও কিছু চাইবে না, সে ইচ্ছে করেই না খেয়ে থাকতে পারে।
দিনের পর দিন না খেয়ে সে এই ঘরেই মরে পড়ে থাকবে। তাতে কার কী আসে যায়? এ-দেশে অনেক নিঃসঙ্গ বুড়ো-বুড়ির এই দশা হয়, দুর্গন্ধ পেয়ে দরজা ভেঙে বার করা হয় তাদের মৃতদেহ। নিশার বয়েস এখন একত্রিশ বছর চার মাস।
পরদিন সকালে মত বদলে ফেলল নিশা।
সে কেন সম্পূর্ণ হার মানবে? সে কি নিজের চেষ্টায় বাঁচতে পারবে না? কোনও ক্রমে যদি একটা কাজ জোগাড় করা যায়, যাতে ঘরভাড়াটা অন্তত, আর খাওয়ার খরচ তো সামান্য।
অনেক দোকানের বাইরে নিশা ‘হেলপ ওয়ান্টেড’ এই বোর্ড ঝোলানো দেখেছে। ওগুলো অস্থায়ী চাকরি। এক মাস, দুমাসের জন্য রাখে। আপাতত সেই রকমই একটা পেলে হয়। সে রেস্তোরাঁয় কাশ-ডিশ ধুতে পারবে, টেবিল মোছার কাজ নিতেও আপত্তি নেই। এ-দেশে অনেক ভাল ভাল ঘরের ছাত্র-ছাত্রীরা পড়ার খরচ জোগাবার জন্য ওই চাকরি নেয়। কোনও কাজই অসম্মানের নয়।
মন দিয়ে সাজগোজ করল নিশা। প্যান্ট-শার্ট পরল, ভুরু আঁকল, লিপস্টিক দিল ঠোঁটে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখল নিজেকে। বাইরেটা দেখে কেউ কি বুঝতে পারবে যে, তার বুকটা একেবারে খালি?
দরজা বন্ধ করে নামতে লাগল সিঁড়ি দিয়ে। অনেক দিন পর।
দো-তলায় রফিকের ঘরের দরজা বন্ধ। বেরিয়ে গেছে, না ঘরেই আছে? সপ্তাহে কবে কবে যেন সে বেলা করে বেরোয়?
বাচ্চা মেয়ের মতো পা টিপে টিপে সে রফিকের দরজায় কান পেতে রইল। কার গলার আওয়াজ? ওঃ, টিভি চলছে, তার মানে রফিক ঘরেই আছে। ডাকল না নিশা।
প্রথমে একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে দ্বিধা করতে লাগল। কী করে কথাটা বলতে হয়? প্রথম বাক্যটা কী হবে? আমি তোমার কাছে চাকরি চাইতে এসেছি? কিংবা আই অফার মাই সারভিস টু ইউ? কিংবা কিছু কি লিখে আনতে হয়?
এসে যখন পড়েছে, চেষ্টা করে দেখতেই হবে। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে সে কাউন্টারের কাছে দাঁড়াল। এক জন মোটাসোটা লোক সেখানে বসে আছে।
নিশা বাইরে ঝোলানো ‘হেল্প ওয়ান্টেড’ বোর্ডটার দিকে আঙুল দেখিয়ে কিছু বলার আগেই লোকটি বলল, আহ-হা, তুমি দেরি করে এলে? একটু আগেই এক জন কথা বলে গেছে, বোর্ডটা খোলা হয়নি। তোমার মতো এক জন ফাইন, ইয়াং লেডিকে পেলে আমি খুবই লাভবান হতাম। তুমি সামনের মাসে আবার খোঁজ নিও। অবশ্যই এসো।
এর পরের দুটি দোকনেও কাজ পাওয়া গেল না, এবং প্রথমটির মতো ভাল ব্যবহারও পেল না। দু’জায়গাতেই গম্ভীর ভাবে উত্তর পেল, দুঃখিত, আমরা পুরুষ খুঁজছি।
চতুর্থ জায়গাটিতে একটি সাংঘাতিক কাণ্ড হল।
কাউন্টারের লোকটির চওড়া ধরনের মুখ, চেহারাটি প্রায় দৈত্যের মতো। রেস্তোরাঁ চালাবার বদলে কুস্তিগির হলেই যেন তাকে মানাত।
নিশার দু’একটা কথা শোনার পরই সে বলল, পাসপোর্ট দেখি!
নিশা ইতস্তত করে বলল, পাসপোর্ট আমার সঙ্গে নেই।
লোকটি জিজ্ঞেস করল, পাকিস্তানি?
নিশা বলল, না, ভারতীয়।
লোকটি এবার ঠোঁট উলটে বলল, ওই একই হল। ইললিগাল ইমিগ্রান্ট। এরা দেশটা ছেয়ে ফেলল।
নিশা পেছন ফিরে চলে যাবার উদ্যোগ করতেই লোকটি চেঁচিয়ে বলল, দাঁড়াও! আইমাস্ট ইনফর্ম দা পুলিশ! ততক্ষণ তুমি যেতে পারবে না।
পাশের টেবিল থেকে এক জন খদ্দের বলল, হেই, তুমি কোনও মহিলাকে জোর করে আটকে রাখতে পারো না।
মালিকটি বলল, ওকে ছেড়ে দিলে ও ভিড়ে মিশে যাবে। আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। পুলিশকে খবর দেওয়া আমাদের নাগরিক কর্তব্য।
খদ্দেরটি বলল, খুঁজে বার করা পুলিশের দায়িত্ব। যতক্ষণ না কিছু প্রমাণ হয়, ততক্ষণ কারুকে ধরে রাখার অধিকার তোমার নেই।
অন্য দু’এক জন খরিদ্দার উঠে দাঁড়িয়ে তাকে সমর্থন করল। আবার কয়েক জন মালিকের পক্ষে গিয়ে বলল, ও ঠিকই বলেছে, এই ইললিগাল ইমিগ্রান্টরা হাজার রকম সমস্যা তৈরি করছে। পুলিশের হাতেই ওকে তুলে দেওয়া উচিত।
শুরু হয়ে গেল দু’পক্ষের তর্কাতর্কি। পাংশু মুখে দাঁড়িয়ে আছে নিশা।
মালিকটা কাউন্টার ছেড়ে নিশার পাশে চলে এসে অসম্ভব আত্মম্ভরিতার সঙ্গে বলল, যে-যাই বলুক, আমি ওকে ছাড়ছিনা। পাসপোর্ট দেখতে চাইলেই এরা পালায়। অল দিজ ডার্টি ওরিয়েন্টালস।
ভিড় ঠেলে সামনে চলে এল রফিক। শান্ত গলায় বলল, খবর্দার, ওর হাত ধরবে না।
মালিকটি চোখ দুটি হিংস্র করে বলল, তুমি আবার কে?
রফিক বলল, এই মহিলা আমার স্ত্রী।
তারপর তেজের সঙ্গে বলল, তুমি কী করে জানলে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী? আমি আমেরিকার নাগরিক। তোমারই মতো আমার সমান গণতান্ত্রিক অধিকার। আমার স্ত্রীরও একই অধিকার।
মালিকটি বলল, দেখি তোমার পাসপোর্ট।
রফিক বলল, তুমি কি সব সময় পাসপোর্ট নিয়ে ঘোরো? তাছাড়া আমার পাসপোর্ট তোমাকে দেখাতে বাধ্য নই। এই আমার কার্ড। অফিস, বাড়ি দু’জায়গায়ই ফোন নাম্বার আছে। তুমি যত ইচ্ছে পুলিশকে খবর দিতে পারো।
মালিকটি এবার খানিকটা চুপসে গিয়ে বলল, তোমার স্ত্রী পাসপোর্ট আনেনি কেন? চাকরি চাইতে গেলে পাসপোর্ট দেখাতে হয় জানো না?
রফিক বলল, ওর পাসপোট চুরি গেছে। কোনও একজন ডার্টি, হোয়াইট শিট, সান অপ আ বীচ ওর হ্যান্ডব্যাগ চুরি করেছে। পুলিশে খবর দেওয়া আছে।
তারপর বাংলায় সে নিশাকে বলল, ভাবী, চলে আসুন আমার সঙ্গে। ভিড় দু’ফাঁক হয়ে গেল। নিশার হাত ধরে, মাথা উঁচু করে বেরিয়ে এল রফিক। কিছুক্ষণ ওরা হাঁটল নিঃশব্দে।
একটু পরে রফিক ক্ষমাপ্রার্থীর মতো সঙ্কুচিত ভাবে বলল, ভাবী, আমাকে ওই কথাটা বলতে হল বাধ্য হয়ে। কিছু মনে করবেন না।
নিশা বলল না কিছুই।
রফিক আবার বলল, আপনার হাত ধরেছি, সেজন্য মাপ করবেন।
নিশা মুখ নিচু করে রাস্তা দেখছে।
রফিক বলল, আপনি চাকরি করতে চান .. আমাকে বললে, কোনও ইন্ডিয়ান বা বাংলাদেশি দোকানে ব্যবস্থা করা যেত, ওরা বিশেষ কিছু জিজ্ঞেস করেনা, বেতন অবশ্য কম দেয়।
এবারে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে নিশা জিজ্ঞেস কবল, আপনি ঠিক এই সময়েই এই দোকানে হাজির হলেন কী করে?
লাজুক ভাবে হেসে রফিক বলল, কাকতালীয় হতে পারে।
নিশা বলল, হতে পারে নয়, কী হয়েছে জানতে চাই।
রফিক বলল, আজ আপনি বেরোলেন অনেকদিন পর, আমার দরজার কাছে দাঁড়িয়েছিলেন, টের পেয়েছি। তারপর ইচ্ছে হল, আপনার পিছু পিছু ঘুরছিলাম। প্রত্যেকটা দোকানেই দূর থেকে দেখেছি। ও-রকম গোলমাল না হলে আমি সামনে আসতাম না।
রফিকের চোখের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে নিশা বলল, আজ থেকে আমাকে আর ভাবী বলে ডাকবে না। আমার নাম নিশা। সেটাই আমার পরিচয়। আজ থেকে আমি আর অরূপের স্ত্রী নই। স্বামীরা স্ত্রীকে ত্যাগ করে পালাতে পারে, স্ত্রীরা কেন তা পারব না? আমার জীবন থেকে আমি অরূপের নাম মুছে দিলাম।
সে নিজে হাত বাড়িয়ে রফিকের একটা হাত ধরল।
রফিক বলল, বৃষ্টি এসে গেল, আসুন দৌড়ই।
ছুটতে লাগল দুজনে।
ছুটতে ছুটতেই রফিক বলল, ইলিশটা এখনও ডিপ ফ্রিজে রাখা আছে। আজ খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ ভাজা হবে?
নিশা বলল, হবে।
.
০৭.
দরজার বেল শুনে খুলে দিল রফিক। ও-পাশের মানুষটিকে দেখে সে প্রথমে কথাই বলতে পারল না।
সারা সন্ধে বৃষ্টি হচ্ছে। সেই লম্বা মানুষটির গায়ে একটা রেনকোট। চুল উস্কোখুস্কো, চোখ দুটো লাল, দেখে মনে হয়, সারা দিন নেশা করেছে।
মিষ্টি হেসে অরূপ বলল, আসসালামু আলাইকুম, কী রফিক মিঞা, চিনতে পারছ না নাকি? মরিনি। জলজ্যান্ত ফিরে এসেছি। তারপর খবরটবর কী?
শুকনো ভাবে রফিক বলল, ভাল।
অরূপ বলল, ওপরে আমার ফ্ল্যাটটা বেদখল হয়ে গেছে দেখলাম।
রফিক বলল, ভাড়া বাকি থাকলে কি মালিক ফেলে রাখে?
আমার মালপত্তর?
নিচে বেসমেন্টে রাখা আছে।
আর আমার বেটার হাফটি কোথায় বলতে পারো? তাকে তো আর বেসমেন্টে ডাম্প করা যায় না!
আপনি এত দিন পরে তার খবর নিচ্ছেন?
মতিভ্রম মতিভ্রম বুঝলে ভাই, মুনি-ঋষিদেরও মতিভ্রম হয়। পাগল হইয়া বনে বনে ঘুরি আপন গন্ধে মম..হা-হা-হা-হা। তা সে গেল কোথায়? দেশে ফিরে গেছে? দা বয় স্টুড অন দা বার্নিং ডেক এর মতো সে ভাঙা সংসারে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবে না জানি, কিন্তু কোথাও তো থাকবে। এ কী রফিক, তুমি দরজা আটকে দাঁড়িয়ে রইলে, আমাকে ভেতরে ঢুকতে দেবে না? তোমার মতো এত ভদ্র মানুষ… বদলে গেলে নাকি?
আসুন।
ভেতরে এসে, চারদিক তাকিয়ে, নাক দিয়ে ফুঁ ফুঁ করে সে বলল, মেয়েলি গন্ধ পাচ্ছি। এর মধ্যে বিয়ে করে ফেলেছ নাকি?
রফিক বলল, না।
ভুরু নাচিয়ে অরূপ জিজ্ঞেস করল, তাহলে লিভিং টুগেদার?
রফিক বলল, কথাটার যেমন মানে হয়, সে-অর্থে নয়!
সোফায় বসে পড়েও আবার লাফিয়ে উঠে অরূপ বলল, নিশা, নিশা! আমার ধর্মপত্নী! গন্ধটা ঠিক চিনেছি। আমার নাকটা কত চোখা দেখেছ? নিশা এখানে আছে, তাইনা?
রফিক ঘাড় হেলাল।
অরূপ ছুটে এসে রফিকের কাঁধ চাপড়ে বলল, গ্রেট, গ্রেট! তুমি বিপদের সময় নিশাকে আশ্রয় দিয়েছ। উপকারী রফিক! অসময়ের বন্ধুই তো আসল বন্ধু। তোমাকে কত যে ধন্যবাদ দেব। তুমিই তোমার তুলনা। নিশা কি এখন আছে? একবার ডাকো।
একটু ইতস্তত করে রফিক ভেতরে চলে গেল।
তার অ্যাপার্টমেন্টটা বড়। বসবার ঘর ছাড়াও একটা শয়নকক্ষ, রান্নাঘরেও অনেকটা জায়গা। সেই রান্নাঘরের জানলার কাছে পাথরের মর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে নিশা।
রফিক বলল, কে এসেছে, বুঝতে পেরেছ?
নিশা চুপ করে রইল।
রফিক বলল, তোমাকে ডাকছেন।
নিশা মুখ না ফিরিয়েই বলল, বলে দাও, দেখা হবে না।
রফিক বলল, যদি কিছু বলতে চান।
নিশা বলল, আমি শুনতে চাই না। তারপর মুখ ফিরিয়ে বলল, আমি ওর মুখও দেখতে চাই না, কিছুতেই না।
রফিক বসবার ঘরে ফিরে এসে বলল, দাদা, উনি এখন দেখা করতে চাইছেন না আপনার সঙ্গে।
অরূপ বলল, রাগ করে আছে? তা তো হতেই পারে। আমার মতো একটা পাষণ্ডের ওপর রাগ করবে না? রফিক, তুমি আমার সঙ্গে আপনি আজ্ঞে করে কথা বলছ কেন? আমাদের তুমি-তুমি’র সম্পর্ক ছিল।
অনেক দিনের কথা। ভুলে গেছি।
ঠিক চার মাস। গলা শুকিয়ে গেছে, তোমার কাছে বিয়ার-টিয়ার নেই?
না। চা খাবেন?
চা? সন্ধের পর চা খেলে শরীর খারাপ হয়। ওঃ হ, আমার কাছেই তো খানিকটা আছে।
রেনকোটের পকেট চাপড়ে সে একটা স্কচের পাঁইট বার করল। খানিকটা গলায় ঢেলে দিয়ে বলল, একটু বসি। খানিক বাদে রাগ কমলে ডেকে দিও।
রফিক বলল, উনি আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান না স্পষ্ট বলে দিয়েছেন।
তুমিই তো বললে, তোমাদের বিয়ে হয়নি। হবেই-বা কী করে! আমার সঙ্গে তো ডিভোর্স হয়নি। তার মানে, নিশা এখন আমার আইনসঙ্গত স্ত্রী। ওর সঙ্গে দেখা করার আমার রাইট আছে।
উনি যদি না চায়…।
আমি ভেতরে যাব।
সেটা সম্ভব নয়।
আমি যেতে চাইলে তুমি কী করবে?
বাধা দেব। আপনি জানেন, আপনার থেকে আমার গায়ের শক্তি বেশিই হবে। কিন্তু আমি বলপ্রয়োগ একেবারে পছন্দ করি না।
চোপশালা! আমাকে গায়ের জোর দেখাচ্ছিস? আইন আছে না, পুলিশ আছে না? আমার বিয়ে করা মাগী, আমি চুল ধরে হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে যাব।
হুইস্কিতে আর একটা চুমুক দিল অরূপ।
কঠিন মুখে রফিক বলল, আপনি আইন দেখাচ্ছেন, পুলিশ দেখাচ্ছেন! ও-সব বাইরে গিয়ে যা ইচ্ছে করুন। আমার এখানে ও-রকম কোনও কথা শুনতে চাই না। প্লিজ গো।
না, যাব না! আমার বউকে তুই লুকিয়ে রেখেছিস শালা। দেখা করতে দিবি না কেন রে?
আমি মোটেই লুকিয়ে রাখিনি। তিনি এখানে আছেন, তা আমি অস্বীকার করিনি। তিনি দেখা করতে চাইলে আমার কোনওই আপত্তি নেই। কিন্তু আপনাকে আমি জোর ফলাতে দেবনা!
নিশা। নিশা!
প্লিজ, ও-রকম চিৎকার করবেন না। আপনি নিজের মান-সম্মান নষ্ট করছেন।
আমার মান-সম্মান বলে কিছু নেই। আমি শালা পাগলা দিগম্বর। বোম ভোলা! নিশা, নিশা, একবারটি এখানে এসো। লক্ষ্মীটি।
ও-রকম ভাবে চেঁচিয়ে কোনও লাভ নেই।
আমাকে ভয় দেখাচ্ছ, রফিক। নিশাকে তোমার বিয়ে করার মতলব?
আমার কোনওই মতলব নেই।
লিভিং টুগেদার কত দিন চালাবে? তোমাদের বাংলাদেশিরাই বয়কট করবে তোমাকে। বিয়ে করতে পারবে না। আমি ডির্ভোস দিলে তো! দেবনা, কিছুতেই দেব না। তোমাদের নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাব।
এ-সব অবান্তর কথা আমি শুনতে চাই না।
তোমাকে গালাগালি দিয়েছি বলে আমি দুঃখিত। হঠাৎ হঠাৎ মাথা গরম হয়ে যায়। ওটাই তো আমার রোগ। মাপ করে দাও! এবার ঠাণ্ডা মাথায় বলছি, নিশা এত দিন তোমার সঙ্গে ছিল, আই ডোন মাইন্ড, আমিও তো… ওতে কিছু আসে যায় না। জানো তো, অমৃত কখনও উচ্ছিষ্ট হয় না? এখন নিশাকে আমি ফেরত চাই। আমি আবার সংসার পাতব। চাকরি পেয়েছি, আর কোনও প্রবলেম নেই। এবার থেকে সব কিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে। এই কথাগুলো বলতে দাও আমাকে।
উনি আসতে চাইছেন না, তা আমি কী করব?
কোন ঘরে আছে?
যে-ঘরেই থাক, আপনার জোর করে যাওয়া চলবে না!
তাহলে এখান থেকেই বলি? নিশা, ফিরে এসো! তুমি আমার বউ! নিজের অধিকারে, নিজের সংসারে থাকবে। পুরনো সব কিছু মুছে ফেলব। ট্রাস্ট মি! নতুন ভাবে জীবন শুরু হবে। আই ওয়ান্ট আ চাইল্ড! নিশা, ফিরে এসো! সোনা আমার, লক্ষ্মী আমার। তোমার জন্য বুকটা টন টন করে। মাইরি বলছি! অন্য কোনও মেয়ের সঙ্গে তোমার তুলনাই হয় না!
নিশা ঠায় একই ভাবে দাঁড়িয়ে আছে জানলার দিকে মুখ করে। এবার সে দু’হাতে কান চাপা দিল।
আর এক চুমুকে বোতলটা শেষ করে ছুঁড়ে ফেলে দিল অরূপ। সেটা ভাঙল ঝন ঝন করে।
তারপর বিকৃত গলায় চেঁচিয়ে উঠল, এই হারামজাদি, বেরিয়ে আয়! বড় বেশি দেমাক হয়েছে, তাই না? তোর বিষদাঁত কী করে ভাঙতে হয় আমি জানি।
রফিক সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল, মাইন্ড ইয়োর ল্যাঙ্গোয়েজ। আমার ধৈর্য শেষ হয়ে যাচ্ছে।
চোপ শালা, বলে রফিককে একটা ধাক্কা দিতে গিয়ে অরূপ নিজেই টলে গিয়ে ধড়াম করে পড়ে গেল মেঝেতে। বেশ জোরে মাথা ঠুকে গেছে।
কয়েক বার উঃ উঃ করার পর সে গলার সুর বদলে ফেলে কাতর ভাবে বলতে লাগল, ভুল, ভুল, সবই ভুল হয়ে গেছে। আর তোমাকে কষ্ট দেবনা নিশা। তুমি নতুন জীবন শুরু কর। শুধু একবার দেখতে দাও তোমাকে। এই পাপী, হতভাগাটাকে তুমি ক্ষমা করো। তোমার পা ছুঁয়ে ক্ষমা চাইব। সত্যি কথা, এটা আমার অন্তরের কথা। একবার দেখা দাও, নিশা, নিশা–।
কাতরাতে কাতরাতে সে থেমে গেল। উপুড় হয়ে পড়ে রইল সে একটা ধ্বংসস্তূপের মতো।
রফিক একটা জলের বোতল এনে বলল, একটু পানি খেয়ে নিন।
মাথা তুলে অসহায়ের মতো রফিকের দিকে চেয়ে রইল অরূপ। জল পান করল অনেকখানি। বিড় বিড় করে বলল, পাগলামি করছি। সত্যি পাগল হয়ে যাচ্ছি নাকি? আমার হাতটা ধরে তোলো তো রফিক!
রফিক তাকে তুলে দাঁড় করিয়ে দিল।
চোখে যেন কিছু দেখতে পাচ্ছে না, মাথাটা ঝাঁকাল কয়েক বার। তারপর অরূপ বলল, লস্ট কেস! আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়! চলি রফিক, আর কোনও দিন তোমাদের ডিসটার্ব করব না। নিরুদ্দেশের পথিক, সেই-ই ভাল। সে-ই ভাল সে-ই ভাল, আমারে না হয় না জানো– ।
রফিক বলল, গাড়ি এনেছেন? এই অবস্থায় চালাতে পারবেন?
কোনও উত্তর দিল না অরূপ, টলতে টলতে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। দরজা খোলা রেখেই বেরিয়ে গেল। রফিক এসে দাঁড়াল সেখানে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে একবার হুড়মুড় করে পড়ে গেল অরূপ। আবার নিজেই উঠে দাঁড়াল। আবার রেলিং ধরে ধরে নেমে, সদরের বাইরে চলে গেল।
রফিক ও নিশার জীবন থেকে সেটাই তার অন্তিম প্রস্থান।
নতুন বছরে সস্ত্রীক বাংলাদেশে বেড়াতে এসেছে রফিক।
নিশার নাম এখন মেহেরুন্নিসা, ডাকনাম নিশাই আছে। রফিক অবশ্য বলেছিল, ধর্মান্তর গ্রহণের কোনও প্রয়োজন নেই, যে যার নিজের মতো থাকবে। নিশা বলেছিল, ওতে কিছু যায় আসে না, প্রতি দিনের জীবনে কোনও ধর্মীয় আচরণই তো পালন করা হয় না। নামটা বদলে পাসপোর্ট-ভিসার অনেক ঝামেলা এড়ানো গেছে। তাছাড়া শুধু নিশার চেয়ে মেহেরুন্নিসা নামটা তার বেশি পছন্দ, এতে ইতিহাসের গন্ধ পাওয়া যায়।
প্রথম চার দিন কাটাল ঢাকায়। গুলশান আর এলিফ্যান্ট রোডে রফিকের দুই বড় ভাই থাকে, তাছাড়া তার অনেক বন্ধুবান্ধব। সকলের সঙ্গে মিশে যেতে নিশার কোনও অসুবিধে হল না। শুধু দুবেলা নেমন্তন্ন খেতে খেতে প্রাণ ওষ্ঠাগত হবার জোগাড়।
অনেকে মিলে দল বেঁধে কক্সবাজারে বেড়াতে যাওয়া হবে, সে-রকম পরিকল্পনা করে রেখেছে রফিকের বন্ধুরা। তার আগে রফিককে একবার যেতে হবে দেশের বাড়িতে, মা আছেন সেখানে। ঢাকা থেকে বেশি দূর নয়।
বেরিয়ে পড়া হল একটা গাড়িতে।
শহর ছাড়িয়ে বাইরে আসার পর নিশা বলল, এটা আমার মা, বাবার দেশ ছিল। ওঁরা কত গল্প বলতেন এখানকার। মা তো এক-একসময় কেঁদেই ফেলতেন। অথচ আমার সেরকম কোনও অনুভূতি হত না। আমার জন্ম জামশেদপুরে। ওখানে আমার বড় মামা থাকতেন।
রফিক বলল, তা হলেও তুমি বাঙাল। এখানকার মাটির সাথে তোমার রক্তের সম্পর্ক!
নিশা বলল, কিন্তু যা-ই বলো, এখানে যা দেখছি, নতুন কিছুই মনে হচ্ছে না। একই তো রকম। তবু মা অত হা-হুতাশ করতেন কেন বুঝি না। কতবার বলতেন, তোরা হতভাগ্য, পৈতৃক ভিটেটাও দেখতে পেলি না। কী সুন্দর বাগান ছিল, কত বড় নদী! আচ্ছা বলো তো, পশ্চিমবাংলায় কি বাগান নেই, নদী নেই?
তবু নিজস্ব বাগান আর অন্যের বাগান কি এক হয়?
নদীটা তো আর নিজস্ব নয়। মামার বাড়িতে বাগান ছিল জামশেদপুরে। সুবর্ণরেখা নদী আছে। খুব সুন্দর নদী!
তোমার দেখছি ওই দিকটাই বেশি পছন্দ।
বাঃ, আমি যেখানে জন্মেছি, সে-জায়গার ওপর আমার বেশি টান থাকবেনা? আমার মা এখানে জন্মেছেন, মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাঁদতেন। আমার সে-রকম ফিলিং হয় না, আমি কী করব?
ইতিহাসে বহু মানুষ বার বার জায়গা বদলেছে, দেশ বদলেছে। আমি যেমন জন্মেছি বাংলাদেশে, এখন হয়ে গেছি মার্কিন দেশের নাগরিক। কিন্তু ইচ্ছের বিরুদ্ধে যদি দেশত্যাগ করতে হয়, কেউ তাড়িয়ে দেয়, সে-অপমান আর দুঃখ কখনও ভোলা যায় না। যেমন হয়েছিল হিটলারের জার্মানিতে। আমাদের দেশভাগও তো সেই রকম, দুই দিকেই তো কত অসংখ্য পরিবারকে ভিটে-মাটি ছেড়ে পালাতে হয়েছে। তোমাদের বাড়ি ছিল কোথায়?
বিশেষ কিছুই জানি না। শুধু নরসিংদি এই নামটা মনে আছে।
আমাদের গ্রামও তো নরসিংদি’র কাছেই। খোঁজ করা যেতে পারে।
কত কাল আগেকার কথা। বাবা-মা চলে গিয়েছিলেন পঁয়ষট্টি সালে। এখন আর তাদের কথা কে মনে রাখবে?
পুরনো আমলের লোক তো কিছু কিছু আছে এখনও।
আমার জন্মের আগের সব কিছুকেই মান্ধাতার আমল মনে হয়।
নরসিংদি গঞ্জ মতো শহর, প্রচুর মানুষ। সেখান থেকে রফিকদের গ্রাম রসুলপুরের রাস্তা মোটেই ভাল নয়। কিছুদূর পর একেবারে কাঁচা রাস্তা। কোনও রকমে গাড়ি চলে। ধানখেত, পুকুরপাড় দিয়ে যেতে হয় এঁকেবেঁকে। এক জায়গায় একটা ছোট খালের ওপর বাঁশের সাঁকোর কাছে গাড়িটা থেমে গেল। এরপর হাঁটা ছাড়া উপায় নেই।
নিশা জীবনে এই প্রথম বাঁশের সাঁকোয় উঠল।
দুটো বাঁশ পাতা, এক পাশে ধরার ব্যবস্থা আছে বটে, কিন্তু সাঁকোটা খুব দোলে। একেবারে শহুরে মেয়ের মতো নিশা ভয়ে চাঁচাতে লাগল।
রফিক ইচ্ছে করে আরও দোলাতে লাগল সাঁকোটা।
নিশা বলল, তোমরা এখানে একটা ব্রিজ বানিয়ে দিতে পারো না? তোমার দাদারা তো বেশ বড়লোক দেখলাম। তুমিও ডলারে রোজগার করো।
রফিক বলল, গ্রামে আর কে থাকে এখন? আমার ভাইরা এত কাছে থাকেন, তবু আসতে চান না। যত দিন মা আছেন…।
সাঁকো থেকে নেমে রফিক বলল, নিশা, তোমাকে একটা অনুরোধ আছে। আমার আম্মার বয়স হয়েছে, কখন কীরকম ব্যবহার করেন ঠিক নেই। দু’বার আমার বিয়ে ঠিক করেছিলেন, আমি রাজি হইনি। তোমাকে দেখে প্রথমটায় যদি উলটো-পালটা কিছু বলেন, তুমি প্লিজ মেনে নিও। পরে ঠিক হয়ে যাবেন, সে-বিষয়ে আমি শিওর।
রফিকদের বাড়িটা ছবির মতো। একটা পুকুর ঘিরে কত রকম গাছ, এক পাশে একটা সাদা রঙের এক তলা বাড়ি। উঠোনে ধানের গোলা।
দেখলেই মনে হয়, এই রকম বাড়িতে শান্তি আছে, এখানেই সারা জীবন থাকি! তবু মানুষ এসব ছেড়ে শহরের ভিড়, ধুলো, ধোঁয়া, বিকট শব্দ পছন্দ করে।
রফিকের মায়ের সামনে যাবার আগে নিশার বুক ঢিপ ঢিপ করতে লাগল। উলটো-পালটা ব্যবহার মানে কী, গালমন্দ করবেন? পছন্দ করবেন না হিন্দু বলে? কিন্ত নিশা তো আর হিন্দু নেই।
একটা ছোট্ট মোড়ার ওপর বসে আছেন মা। প্রথম দেখেই দারুণ চমকে গেল নিশা। ঠিক যেন তার নিজের মা!
সাদা শাড়ি পরা, একটু ভারি শরীর, মাথার চুল কাঁচা-পাকা, গায়ের রঙ ফর্সা টুকটুকে। নিজের মায়ের অবিকল এই চেহারাটাই মনে আছে নিশার। একটু যেন বয়স বেড়েছে।
মানুষে মানুষে এমন মিল হয়!
এ-রকম কথা মনে হলেও তক্ষুনি বলতে নেই। আবেগ দমন করল নিশা। মাথায় আগেই ঘোমটা দিয়েছিল, হাঁটু গেড়ে বসে ফতিমা বিবির পা দুটি ছুঁয়ে বলল, মা, আমি মেহেরুহুন্নিসা, আপনার কাছে দোয়া চাইতে এসেছি।
ফতিমা বিবি নিশার মাথায় হাত রেখে বললেন, এসো মা, এসো। আশীর্বাদ করছি, ধনে-পুত্রে সুখী হও! কী সুন্দর লক্ষ্মীশ্ৰী তোমার মুখে, ঘর আলো করে থাকো।
নিশার জন্য আর একটা চমক অপেক্ষা করে ছিল।
পরদিন নিশাকে নদী দেখাতে নিয়ে গেল রফিক। এখানে মেঘনা নদীর রূপ অপূর্ব। নিশা সুবর্ণরেখা নদীর প্রশংসা করেছে, একবার তুলনা করে দেখুক তো!
কোনও নদীর সঙ্গেই কোনও নদীর তুলনা চলে না। সুবর্ণরেখার পটভূমিকায় পাহাড় আছে, তা এখানে নেই। আবার মেঘনা নদীতে এত অসংখ্য নৌকো, এর রূপ অন্য রকম।
একটা নৌকোয় চেপে ঘুরতে ঘুরতে খানিক বাদে চোখে পড়ল একটা পরিত্যক্ত বাড়ি। সামনের বাগান জঙ্গল হয়ে গেছে। দরজা-জানলা ভাঙা, শুধু খাড়া হয়ে আছে কাঠামোটা।
রফিক বলল, এলাটা নিশ্চয়ই কোনও হিন্দু বাড়ি ছিল। নিশা কিছু না বলে শুধু তাকিয়ে রইল সে-দিকে।
রফিক কৌতুক করে বলল, এমন হতে পারে, এটাই ছিল তোমাদের বাড়ি!
নিশা কোনও রকম উৎসাহ দেখালো না।
রফিক নৌকোর মাঝিদের সঙ্গে কথা বলতে লাগল। তার অনুমান ঠিক, এক জন বুড়ো মাঝি জানে, ওটা ছিল দত্তবাবুদের বাড়ি।
রফিক জিজ্ঞেস করল, নিশা, তোমার বাবার পদবী কি দত্ত ছিল?
নিশা আস্তে আস্তে মাথা নাড়ল।
রফিক উত্তেজিত হয়ে বলল, তবে? দত্তদের বাড়ি! তোমাদের সেই বাড়ি!
নিশা বলল, যাঃ, এতটা মিল হয় নাকি? আরও কত দত্ত থাকতে পারে!
রফিক তবু বলল, তবু গিয়ে দেখা যাক। যদি কারুর নাম লেখা-টেখা থাকে। তোমার নিজের বাড়িতে পা দেবে।
মাঝিদের সে বলল সেই বাড়িটার ঘাটের দিকে যেতে।
কেন যেন নিশার মুখখানা লাল হয়ে গেছে। চোখ দুটো বেশি উজ্জ্বল।
সে রফিকের হাত চেপে ধরে বলল, না, ওখানে যাবার দরকার নেই।
রফিক বলল, কেন? দেখতে ইচ্ছে করছে না?
নিশা বলল, আমি মিলিয়ে দেখতে চাই না। কোনও দরকার নেই। আমি তো তোমার কাছে এসেছি। তোমার বাড়িতে। আমি সবটা অতীত মুছে ফেলতে চাই।
একটু থেমে সে খুব নরম কাতরতার সঙ্গে বলল, তুমি আমার কাছ থেকে দূরে চলে যেও না কখনও।