Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » এবং হিমু (১৯৯৫) || Humayun Ahmed » Page 7

এবং হিমু (১৯৯৫) || Humayun Ahmed

রেশমা খালার ‘প্যালেসে’ এক সপ্তাহ পার করে দিলাম। সমস্যামুক্ত জীবন যাপন। আহার, বাসস্থান নামক দু’টি প্রধান মৌলিক দাবি মিটে গেছে। এই দু্’টি দাবি মিটালেই বিনোদনের দাবি ওঠে। খালার এখানে বিনোদনের ব্যবস্থাও প্রচুর আছে। আমার ভালই লাগছে।
ট্রাক দেখলে লোকে রাস্তা ছেড়ে পালিয়ে যায়, কিন্তু সেই খোলা ট্রাক করে ভ্রমণের আনন্দ অন্য রকম। আমার অবস্থা হয়েছে এরকমই। রেশমা খালার সঙ্গে গল্পগুজব করতে এখন ভালই লাগে। শুধু রাতে একটু সমস্যা হয়। রেশমা খালা আমার দরজায় ধাক্কা দিতে দিতে বলেন, আয় আয় দেখে যা, নিজের চোখে দেখে যা। বসে আছে, খাটে পা দুলিয়ে বসে আছে।
আমি হাই তুলতে তুলতে বলি, থাকুক বসে। তুমিও তার পাশে বসে পা নাচাতে থাকবে। কাবাব যতই ভালই হোক, কাবাবের এক কোনায় ছোট হাড্ডির টুকরো থাকবেই।
রাতে রেশমা খালা হৈ-চৈ, ছোটাছুটি, চিৎকার অগ্রাহ্য করতে পারলে গনি প্যালেসে মাসের পর মাস থাকা যায়। তাছাড়া ঐ বাড়ির বাবুর্চির সঙ্গে আমার বেশ সখ্য হয়েছে। নাপিত সম্প্রদায়ের মানুষ খুব বুদ্ধিমান হয় বলে জনশ্রুতি—আমাদের বাবুর্চি সব নাপিতের কান কেটে নেয়ার বুদ্ধি রাখে। বোকার ভান করে সে দিব্যি আছে।
এক সকালে সে আমার জন্যে বিরাট এক বাটি স্যুপ বানিয়ে এনে বলল, আপনি একবার আরশোলার স্যূপ চেয়েছিলেন, বানাতে পারিনি। আজ বানিয়েছি। খেয়ে দেখুন স্যার, আপনার পছন্দ হবে। সঙ্গে মাশরুম আর ব্রকোলি দিয়েছি।
বাটির ঢাকনা খুলে আমার নাড়িভুড়ি পাক দিয়ে উঠলো। সাদা রঙের স্যুপ, তিন-চারটা তেলাপোকা ভাসছে। একটা আবার উল্টো হয়ে আছে। তার কিলবিলে পা দেখা যাচ্ছে।
বাবুর্চি শান্ত স্বরে বলল, সস-টস কিছু লাগবে স্যার?
আমি বললাম, কিছুই লাগবে না। তাকে পুরোপুরি হতভম্ব করে এক চামচ মুখে দিয়ে বললাম স্যুপটা মন্দ হয়নি। তবে আরশোলার পরিমাণ কম হয়েছে।
আমি কোন চীজ সে ধরতে পারেনি। ধরতে পারলে আমার সঙ্গে রসিকতা করতে যেত না। আমি তাকে সামনে দাঁড়া করিয়েই পুরো বাটি স্যুপ খেয়ে বললাম—বেশ ভাল হয়েছে। পরেরবার আরশোলার পরিমাণ বাড়াতে হবে। এটা যেন মনে থাকে।
বাবুর্চি বিড় বিড় করে বলল, জ্বি আচ্ছা, স্যার।

রেশমা খালা আমার প্রতি যথেষ্ট মমতা প্রদর্শন করছেন। সেই মমতার নিদর্শন হচ্ছে আমাকে বলেছেন ও হিমু, তোর তো ভিক্ষুকের মত হাঁটাহাঁটির স্বভাব। হাঁটাহাঁটি না করলে পেটের ভাত হজম হয় না। এখন থেকে গাড়ি নিয়ে হাঁটাহাঁটি করবি।
আমি বললাম, সেটা কি রকম?
‘পাজেরো নিয়ে বের হবি। যেখানে যেখানে হাঁটতে ইচ্ছে করবে ড্রাইভারকে বলবি, গাড়ি নিয়ে যাবি।’
‘এটা মন্দ না। গাড়িতে চড়িয়া মর্দ হাঁটিয়া চলিল।’
কিছুদিন থেকে আমি পাজেরো নিয়ে হাঁটছি। আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করছি,এই গাড়িতে বসলেই ছোট ছোট গাড়ি বা রিকশাকে চাপা দেয়ার প্রবল ইচ্ছা হয়। ট্রাক ড্রাইভার কেন অকারণে টেম্পো বা বেবীটেক্সির উপর ট্রাক তুলে দেয় আগে কখনো বুঝিনি। এখন বুঝতে পারছি। এখন মনে হচ্ছে দোষটা সর্বাংশে ট্রাক ড্রাইভারদের নয়, দোষটা ট্রাকের।
যে বড় সে ছোটকে পিষে ফেলতে চাইবে এটাই স্বাভাবিক জাগতিক নিয়ম।ডারউইন সাহেবের ধারণা ‘সারভাইভেল ফর দি ফিটেস্ট’ শুধু জীবজগতের জন্যে প্রযোজ্য হবে, বস্তুজগতের জন্যে প্রযোজ্য হবে না, তা হয় না।
পাজেরো নিয়ে হাঁটতে বেরুবার একটাই সমস্যা—গলিপথে হাঁটা যায় না। রাজপথে হাঁটতে হয়। এরকম রাজপথে হাঁটতে বের হয়েই একদিন ইরার সঙ্গে দেখা। সে বেশ হাত নেড়ে গল্প করতে করতে একটা ছেলের সঙ্গে যাচ্ছে। দূর থেকে দু’জনকে প্রেমিক-প্রেমিকার মত লাগছে। ছেলেটা সুদর্শন। লম্বা, ফর্সা, কোকড়ানো চুল। কফি কালারের সার্টে সুন্দর মানিয়েছে। তার চেহারায় আলগা গাম্ভীর্য। সুন্দরী মেয়ে সঙ্গে নিয়ে হাঁটলেই আপনাআপনি ছেলেদের চেহারায় কিছু গাম্ভীর্য চলে আসে। তার একটু বেশি এসেছে।
আমি পাজেরো ড্রাইভারকে বললাম, ঐ যে ছেলে মেয়ে দু’টি যাচ্ছে, ঠিক ওদের পেছনে গিয়ে বিকট হর্ন দিন। যে দু’জন ছিটকে দু’দিকে পড়ে যায়।
ড্রাইভার বিরক্ত হয়ে বলল, তারা যাচ্ছে ফুটপাতে। ফুটপাতে গাড়ি নিয়ে উঠব কিভাবে?
‘তাহলে তাদের সাইডে নিয়ে গিয়েই হর্ন দিন। চেষ্টা করবেন হর্নটা যথাসম্ভব বিকট করার জন্যে।’
তাই করা হল। হর্ন শুনে ছেলেটার হাত থেকে জ্বলন্ত সিগারেট পড়ে গেল। ইরা ছেলেটার মত চমকালো না। মেয়েদের স্নায়ু ছেলেদের চেয়ে শক্ত হয়। আমি গলা বাড়িয়ে বললাম, এই ইরা, এই? যাচ্ছ কোথায়?
ইরা চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আছে। সঙ্গী ছেলেটা হতভম্ব।
আমি প্রায় অভিমানের মত গলায় বললাম, ঐ যে তুমি মেসে এসে একবার গল্পগুজব করে গেলে, তারপর তোমার আর কোন খোঁজ নেই। ব্যাপার কি বল তো? আমি এমন কি অন্যায় করেছি?
আড়চোখে তাকিয়ে দেখি ছেলেটার চোখ-মুখ পাংশুবর্ণ ধারণ করেছে। তার প্রেমিকা অন্য একজনের মেসে গল্প করে সময় কাটাচ্ছে এটা সহ্য করা মুশকিল। কোন প্রেমিকই করে না।
আমি হাসি হাসি মুখে বললাম, উঠে এসো ইরা। উঠে এসো। তোমার সঙ্গে এক লক্ষ কথা আছে। আজ সারাদিন গাড়ি করে ঘুরব আর গল্প করব।
ইরা কঠিন মুখ করে এগিয়ে এল। গাড়ির জানালার কাছে এসে চাপা গলায় বলল, আপনি এইভাবে কথা বলছেন কেন?
‘কোনভাবে বলছি?’
‘এমনভাবে বলছেন যেন আপনি আমার দীর্ঘ দিনের পরিচিত। ব্যাপার সে রকম নয়। মুহিব না জানি কি ভাবছে?’
‘মুহিবটা কে? ঐ ক্যাবলা?’
‘ক্যাবলা বলবেন না, কোনদিন না। কখনো না?’
‘তোমার ক্লোজ ফ্রেন্ড?’
‘হ্যাঁ।’
‘তার ফ্রেন্ডশীপ কতটা গাঢ় সেটা আজ আমরা একটু পরীক্ষা করি। তুমি এক কাজ কর—মুহিবকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে গাড়িতে উঠে এসো। ওর প্রেমের দৌড়টা পরীক্ষা করা যাক। সে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকবে, রাগে থরথর করে কাঁপবে। সেটা দেখতে ইন্টারেস্টিং হবে।’
‘সবার সঙ্গেই আপনি একধরনের খেলা খেলেন। আমার সঙ্গে খেলবেন না। এবং আপনি আমাকে আবার তুমি করে বলছেন। এ রকম কথা ছিল না।’
‘আপনি তাহলে গাড়িতে উঠবেন না?’
‘অব্যশই না। আপনি আমাকে কি ভেবেছেন? পাপেট? সূতা দিয়ে বাঁধা পাপেট?’
‘গাড়িতে না উঠলে চলে যাই। শুধু শুধু সময় নষ্ট করার কোন মানে হয় না। তা ছাড়া মুহিব ছেলেটি কেমন ক্যাবলার মত হা করে আছে। দেখতে খারাপ লাগছে। আপনি বরং ওর কাছে চলে যান।ওকে বলুন হা করে তাকিয়ে না থাকতে। মুখে মাছি ঢুকে যেতে পারে।’
‘এ রকম অশালীন ভঙ্গিতেও আর কোন দিন কথা বলবেন না।’
‘আর কোনদিন আপনার সঙ্গে দেখাই হবে না। কথা বলার তো প্রশ্ন আসছে না।’
‘দেখা হবে না মানে কি?’
‘দেখা হবে না মানে, দেখা হবে না। মাসখানিকের জন্যে আমি অজ্ঞাতবাসে যাচ্ছি।’
‘কোথায়?’
‘হয় টেকনাফে, নয় তেতুলিয়ায়।’
‘বাদলের বাড়িতে আপনাকে যেতে বলেছিলাম, আপনি যাননি্।ঐ বাড়িতে আপনাকে ভয়ংকর দরকার।’
‘দরকার হলেও কিছু করার নেই। আচ্ছা ইরা, আমি বিদেয় হচ্ছি—তুমি কৃষ্ণের কাছে ফিরে যাও।’
ইরা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, আপনি এখন চলে গেলে আর আপনার দেখা পাব না। বাদলের আপনাকে ভয়ংকর দরকার।
‘তাহলে দেরি করে লাভ নেই, উঠে এসো।’
‘এই গাড়িটা কার?
‘কার আবার? আমার। তুমি দেরি করছ ইরা।’
‘আপনি আসলে চেষ্টা করছেন মুহিবের কাছ থেকে আমাকে সরিয়ে নিয়ে যেতে।কেন বলুন তো?’
‘ঈর্ষা।’
‘ঈর্ষা মানে? আপনি কি আমার প্রেমে পড়েছেন যে ঈর্ষা?’
মুহিব আরেকটা সিগারেট ধরিয়েছে। তার মুখে বিরক্তির গাঢ় রেখা। সে কর্কশ গলায় ডাকল—ইরা, শুনে যাও।
আমি বললাম, যাও, শ্রীকৃষ্ণের বাঁশি বেজে উঠেছে।
ইরা দোটানায় পড়ে গেলো। আমি ড্রাইভারকে বললাম, চল, যাওয়া যাক।
ড্রাইভার হুস করে বের হয়ে গেলো। যতটা স্পীডে তার বের হওয়া উচিত তারচেয়েও বেশি স্পীডে বের হল। মনে হচ্ছে সেও খানিকটা অপমানিত বোধ করেছে। পাজেরোর মত বিশাল গাড়ি অগ্রাহ্য করার দুঃসাহসকে সেই গাড়ির ড্রাইভার ক্ষমা করে দেবে, তা হয় না।
‘এখন কোন দিকে যামু স্যার?’
‘দিক টিক না—চলতে থাক।’

দুপুরের দিকে আমি আমার পুরানো মেসে গেলাম। বদরুল সাহেবের খোঁজ নেয়া দরকার। চাকরির কিছু হয়েছে কি—না।হবার কোন সম্ভাবনা আমি দেখছি না, তবে বদরুল সাহেবের বিশ্বাস থেকে মনে হচ্ছে, হয়ে যেতেও পারে। মানুষের সবচে’ বড় শক্তি তার বিশ্বাস।
অনেকক্ষণ কড়া নাড়ার পর বদরুল সাহেব দরজা খুললেন। তাঁর হাসি-খুশি ভাব আর নেই। চোখ বসে গেছে। এই দুদিনেই মনে হয় শরীর ভেঙে পড়েছে। তাঁর গোলগাল মুখ কেমন লম্বাটে দেখাচ্ছে।
‘বদরুল সাহেবের খবর কি?’
‘খবর বেশি ভাল না, হিমু ভাই।’
‘কেন বলুন তো?’
‘আমার স্ত্রীর শরীরটা খুব খারাপ। ছোট মেয়ের চিঠি গত পরশু পেয়েছি। চিঠি পাওয়ার পর থেকে খেতেও পারছি না, ঘুমুতেও পারছি না।’
‘ঢাকায় পড়ে আছেন কেন? আপনার চলে যাওয়া উচিত না?’
‘ইয়াকুব আগামীকাল বিকেলে দেখা করতে বলেছে, এই জন্যেই যেতে পারছি না।’
‘শেষ পর্যন্ত তাহলে আপনাকে চাকরি দিচ্ছে?’
‘জ্বি।চাকরিটাও তো খুব বেশি দরকার। চাকরি না পেলে সবাই না খেয়ে মরব। আমি খুবই গরিব মানুষ, হিমু ভাই।কত শখ ছিল স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিয়ে একসঙ্গে থাকব। অর্থের অভাবে সম্ভব হয় নাই। একবার মালীবাগে একটা বাসা প্রায় ভাড়া করে ফেলেছিলাম। দুই রুমের একটা ফ্ল্যাট। বারান্দা আছে। রান্নার একটা জায়গা আছে। সামনে বড় আমগাছ। ডালে দোলনা বাঁধা। এত পছন্দ হয়েছিল। ভেবেছিলাম কষ্ট করে কোনমতে থাকব। এরা ছয় মাসের ভাড়া এ্যাডভান্স চাইল। কোথায় পাব ছয় মাসের এ্যাডভান্স, বলুন দেখি।’
‘তা তো বটেই।’
‘হিমু ভাই, ছোট মেয়ের চিঠিটা একটু পড়ে দেখেন।’
মাত্র ক্লাস সিক্সে পড়ে। কিন্তু চিঠি পড়লে মনে হয় না। মনে হয় কলেজে পড়া মেয়ের চিঠি। দু’টা বানান অবশ্য ভুল করেছে।
চিঠি পড়লাম।
আমার অতি প্রিয় বাবা,
বাবা, মা’র খুব অসুখ করেছে। প্রথমে বাসায় ছিল, তারপর পাশের বাড়ির মজনু ভাইয়া মাকে হাসপাতালে ভর্তি করেছে। ডাক্তাররা বলেছে ঢাকায় নিয়ে যেতে। বাসায় সবাই কান্নাকাটি করছে।
তুমি কোন টাকা পাঠাও নাই কেন বাব? মা প্রথম ভেবেছিল পোস্টপিসে টাকা আসেনি। রোজ পোস্টপিসে খোঁজ নিতে যায়। তারপর মা কোথকে যেন শুনল তোমার চাকরি চলে গেছে।
বাবা, সত্যি কি তোমার চাকরি চলে গেছে? সবার চাকরি থাকে, তোমারটা চলে গেলো কেন? তোমার চাকরি চলে যাবার কথা শুনে মা বেশি কান্নাকাটি করেনি, কিন্তু বড় আপা এমন কান্না কেঁদেছে তুমি বিশ্বাস করতে পারবে না। বড় আপা কাঁদে আর বলে—“আমার এত ভাল বাবা! আমার এত ভাল বাবা!” আমি বেশি কাঁদিনি, কারণ আমি জানি, তুমি খুব একটা ভাল চাকরি পাবে। কারণ আমি নামাজ পড়ে দোয়া করছি।বাবা, আমি নামাজ পড়া শিখেছি। ছোট আপা বলেছে আত্তাহিয়াতু ছাড়া নামাজ হয় না। ঐ দোয়াটা এখনো মুখস্থ হয় নাই। এখন মূখস্থ করছি। মূখস্থ হলে আবার তোমার চাকরির জন্যে দোয়া করব।
বাবা, মা’র শরীর খুব খারাপ। এত খারাপ যে তুমি যদি মাকে দেখ চিনতে পারবে না। তুমি তাড়াতাড়ি চলে এসো বাবা।
ইতি তোমার অতি আদরের ছোট মেয়ে
জাহেদা বেগম
ক্লাস সিক্স
রোল নং ১

‘চিঠি পড়েছেন হিমু ভাই?’
‘জ্বি।’
‘মেয়েটা পাগলী আছে; চিঠির শেষে সব সময় ক্লাস, রোল নং কত লিখে দেয়। ফার্স্ট হয় তো, এই জন্যে বোধহয় লিখতে ভাল লাগে।’
‘ভাল লাগারই কথা।’
‘দু্’টা বানান ভুল করেছে লক্ষ্য করেছেন? খোঁজ আর মুখস্থ। মুখস্থ দীর্ঘ উকার দিয়ে লিখেছে। কাছে থাকি না, কাছে থাকলে যত্ন করে পড়াতাম। সন্ধ্যাবেলা নিজের ছেলেমেয়েদের পড়াতে বসার আনন্দের কি কোন তুলনা আছে? তুলনা নাই। সবই কপাল।’
‘বদরুল সাহেব।’
‘জ্বি হিমু ভাই।’
‘আগামীকাল পাঁচটায় সময় আপনার ইয়াকুব সাহেবের কাছে যাবার কথা না?’
‘জ্বি।’
‘আমি ঠিক চারটা চল্লিশ মিনিটে এসে আপনাকে নিয়ে যাব। আমিও যাব আপনার সঙ্গে। আপনার বন্ধু আবার আমাকে দেখে রাগ করবে না তো?’
‘জ্বি না, রাগ করবে না। রাগ করার কি আছে। সে যেমন আমার বন্ধু, আপনিও সে রকম আমার বন্ধু। আপনি সঙ্গে থাকলে ভাল লাগবে। চাকরির সংবাদ একসঙ্গে পাব। দুঃখ ভাগাভাগি করতে ভাল লাগবে। চাকরির সংবাদ একসঙ্গে পাব। দুঃখ ভাগাভাগি করতে ভাল লাগে না ভাই সাহেব, কিন্তু আনন্দ ভাগাভাগি করতে ভাল লাগে।’
‘ঠিক বলেছেন। দুপুরে কিছু খেয়েছেন?’
‘জ্বিনা।’
‘আসুন, ভাত খেয়ে আসি।’
‘কিছু খেতে ইচ্ছা করছে না, এম্নিতেই মেয়ের চিঠি পড়ে মনটা খারাপ, তার উপরে এমন একটা ঘটনা ঘটেছে—মনটা ভেঙে গেছে।’
‘কি ঘটনা?’
‘বলতে লজ্জা পাচ্ছি, হিমু ভাই।’
‘লজ্জা পেলে বলার দরকার নেই।’
‘না, আপনার কাছে কোন লজ্জা নেই। আপনি শুনন—ফার্মগেটে গিয়েছি—হঠাৎ দেখি রশিদ। আবদুর রশীদ। নগ্ন। শুধু কোমরে একটা গামছা। এর-তার কাছে যাচ্ছে আর বলছে—একটা লুঙ্গি কিনে দিতে।’
‘আপনার সঙ্গে কথা হয়েছে?’
‘জ্বি-না। ও যেন আমাকে দেখতে না পায় এই জন্যে পালিয়ে চলে এসেছি। তারপর নিজের একটা লুঙ্গি, একটা শার্ট নিয়ে আবার গেলাম। তাকে পাইনি। মানুষের কি অবস্থা দেখেছেন হিমু ভাই?’
‘জ্বি দেখলাম!’
‘ইয়াকুবের কাছ থেকে ও চাকরির কথা বলব বলে ভাবছি।’
‘আগে নিজেরটা হোক তারপর বলবেন।’
‘রশীদকে দেখে এত মনটা খারাপ হয়েছে।’
‘আপনি তাহলে দুপুরে কিছু খাবেন না?’
‘জ্বি না।’
‘তাহলে আমি উঠি। আগামী কাল চাকরির খবরটা নিয়ে আমার এক কাজ করব। সরাসরি আপনার দেশের বাড়িতে চলে যাব।’
‘সত্যি যাবেন হিমু ভাই?’
‘যাব।’
‘আপনার ভাবীর শরীরটা খারাপ, আপনাকে যে চারটা ভাল-মন্দ রেঁধে খাওয়াবে সে উপায় নেই।’
‘শরীর ঠিক করিয়ে ভাল-মন্দ রাঁধিয়ে খেয়ে তারপর আসব। ভাবী সবচে’ ভাল রাঁধে কোন জিনিসটা বলুন তো?’
‘গরুর গোশতের একটা রান্না সে জানে। অপূর্ব! মেথিবাটা দিয়ে রাঁধে। পুরো একদিন সিরকা-আদা-রসুনের রসে মাংস ডুবিয়ে রাখে, তারপর খুব অপ্ল আচেঁ সারদিন ধরে জ্বাল হয়। বাইরে থেকে এক ফোঁটা পানি দেয়া হয় না…কি যে অপূর্ব জিনিস ভাই সাহেব!’
‘ঐ মেথির রান্নাটা ভাবীকে দিয়ে রাঁধতে হবে।’
‘অবশ্যই অবশ্যই। পোনা মাছ যদি পাওয়া যায় তাহলে আপনাকে এমন এক জিনিস খাওয়াবো, এই জীবনে ভূলবেন না। কচি সজনে পাতা বটে পোনা মাছের সৃঙ্গে রাঁধতে হয়। কোন মসলা না, কিছু না, দু’টা কাঁচামরিচ, এক কোয়া রসুন, একটু পেয়াজ। এই দেখুন বলতে বলতে জিবে পানি এসে গেলো।’
‘জিবে পানি যখন এসে গেছে চলুন, খেয়ে আসি।’
‘জ্বি আচ্ছা, চলুন। আপনি দেশে যাবেন ভাবতেই এত ভাল লাগছে।’
মেস থেকে বেরুবার মুখে ম্যানেজার হায়দার আলী খাঁ বললেন, স্যার, আপনি মেসে ছিলেন না, আপনার কাছে ঐ মেয়েটা দু’বার এসেছিল।
‘ইরা?’
‘জ্বী, ইরা। উনার বাসায় যেতে বলেছে। খুব দরকার।’
‘জানি। আমার ঐ মেয়ের দেখা হয়েছে। ঐ মেয়ে যদি আবার আসে বলবেন get lost.’
‘স্যার, কি বলব?’
‘বলবেন get lost.কঠিন গলায় বলবেন।’
‘জ্বি, আচ্ছা।’
হায়দার আলী খাঁ পিরিচে চা খাচ্ছিল: আবারো সারা শরীরে চা ফেলে দিল। এই মানুষটা আমাকে এত ভয় পায় কেন কে জানে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *