Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » এবং হিমু (১৯৯৫) || Humayun Ahmed » Page 4

এবং হিমু (১৯৯৫) || Humayun Ahmed

বদরুল সাহেব আমাকে দেখে চেঁচিয়ে উঠলেন, কোথায় ছিলেন এতদিন?
তাঁর গলা মোটা, শরীর মোটা, বৃদ্ধিও মোটা। আমি আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি প্রশস্ত মানুষের অন্তরও প্রশস্ত হয়। বদরুল সাহেবের অন্তর প্রশস্ত, মনে মায়াভাব প্রবল। আমি ছ’-সাত দিন ধরে মেসে আসছি না। কেউ হয়ত ব্যাপারটা লক্ষ্যই করেনি। তিনি ঠিকই লক্ষ্য করেছেন। আমাকে দেখে তিনি যে উল্লাসের ভঙ্গি করলেন সেই উল্লাসে কোন খাদ নেই।
‘কোথায় ছিলেন রে ভাই?’
আমি হাসলাম। অধিকাংশ প্রশ্নের উত্তর আমি ইদানীং হেসে দেবার চেষ্টা করছি। একেক ধরনের প্রশ্নের উত্তরে একেক ধরনের হাসি। এখন যে হাসি হাসলাম তার অর্থ হচ্ছে—আশেপাশেই ছিলাম।
বদরুল সাহেব বললেন, গত বৃহস্পতিবার মেসে ফিস্ট হল। বিরাট খাওয়া-দাওয়া। পেলেও, খাসির রেজাল সালাদ। খাসির মাৎস আমি নিজে কিনে এনেছিলাম। একটা আস্তে খাসি দেখিয়ে বললাম, হাফ আমাকে দাও, নো হাংকি-পাংকি।
‘হাফ দিয়েছিল?’
‘দিবে না মানে? মাংস কেটে আমার সামনে পিস করতে চায়। আমি বললাম, খবর্দার, আগে ওজন করে তারপর পিস করবে।’
‘আগে পিস করলে অসুবিধা কি?’
‘আগে পিস করতে দিলে উপায় আছে? ফস করে বাজে গোসত মিক্স করে ফেলবে। কিছু বুঝতেই পারবেন না। ম্যাজিক দেখিয়ে দেবে। খাসির গোশত কিনে নিয়ে রান্না করার পর খেতে গিয়ে বুঝবনে পাঁটার গোশত। মিস্টার পাঁটা।’
বদরুল সাহেবের সঙ্গে আমার দেখা মেসের সিঁড়িতে, তিনি বেরুাচ্ছিলেন। আমাকে দেখে আমার পেছনে পেছনে ঘরে এসে ঢুকলেন। ফিস্টের ব্যাপারটা না বলে তিনি শান্তি পাবেন না। গোশত কেনা থেকে যে গল্প শুরু হয়েছে সেই গল্প শেষ হবে খাওয়া কিভাবে হল সেখানে। আমি ধৈর্ঘ নিয়ে গল্প শোনার প্রস্ততি নিচ্ছি। খাওয়া-দাওয়ার যে কোন গল্পে ভদ্রলোকের অসীম আগ্রহ। এত আনন্দের সঙ্গে তিনি খাওয়ার গল্প করেন যেন এই পৃথিবী সৃষ্টিই হয়েছে খাওয়ার জন্যে। খাওয়া ছাড়াও যে গল্প করার আরো বিষয় থাকতে পারে ভদ্রলোক তা জানেন না।
‘খু্ব চর্বি হয়েছিল। গোশতের ভাজে ভাজে চর্বি।’
‘বাহ, ভাল তো।’
‘চর্বিদার গোশত রান্না করা কিন্তু খুব ডিফিকাল্ট। বাবুর্চি করে কি—যেতেতু চর্বি বেশি, তেল দেয় কম। এটা খুব ভুল। চর্বিদার গোশত তেল লাগে বেশি।’
‘জানতাম না তো।’
‘অনেক ভাল ভাল বাবুর্চিই ব্যাপারটা জানে না। রান্না তো খুব সহজ ব্যাপার না। আমি নিজে বাবুর্চির পাশে বসে দেখিয়ে দিলাম।’
‘খেতে কেমন হয়েছিল?’
‘আমি নিজের মুখে কি বলব—আপনার জন্য রেখে দিয়ছি। চেখে দেখবেন।’
‘রেখে দিয়েছেন মানে? বৃহস্পতিবার ফিস্ট হয়েছে, আজ হল শনিবার।’
‘দুই বেলা গরম করেছি। নিজের হাতেই করেছি। অন্যের কাছে এইসব দিয়ে ভরসা পাওয়া যায় না। ঠিকমত জ্বাল দেবে না। বসুন, আমি নিয়ে আসছি।’
তিনি আনন্দিত মুখে গোশত আনতে গেলেন। আজ দিনটা মনে হয় ভালই যাবে। সকালে ভরপেট খেয়ে নিলে সারাদিন আর খাওয়া নিয়ে চিন্তা করতে হয় না। বড় ফুপার বাসা থেকে ভোরবেলা বের হয়েছি। সবাই তখনো ঘুমে। কাজের মেয়েটা জেগে ছিল। সেই দরজা খুলে দিল। বেরিয়ে আসার সময় টুক করে এক কদমবুসি। আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, ব্যাপার কি?
সে নিচু স্বরে বলল, খাস দিলে আফনে এটু দোয়া করবেন ভাইজান। আমার মাইয়াটা বহুত দিন হইছে নিখোঁজ।
‘বল কি? কতদিন হয়েছে নিখোঁজ।’
‘তা ধরেন গিয়া দুই বচ্ছর হইছে। এক বাড়িত কাম করত। এরা মাইর-ধইর করতো—একদিন বাড়ি থাইক্যা পালাইয়া গেছে। আর কোন খুঁইজ নাই।’
সমাজে সর্বনিম্ন স্তরে যাদের বাস তাদের আবেগ-টাবেগ বোধহয় কম থাকে। দু’বছর ধরে মেয়ে নিখোঁজ এই সংবাদ সে দিচ্ছে সহজ গলায়। যেন তেমন কোন বড় ব্যাপার না।
‘নাম কি তোমার মেয়ের?’
‘লুৎফুন্নেসা। লুৎফা ডাকি।’
‘বয়স কত?’
‘ছোট মাইয়া, সাত-আট বছর। ভাইজান, আফনে এটু চেষ্টা নিলে মেয়েটার ফিরত পাই। মেয়ে ঢাকা শহরেই আছে।’
‘জান কি করে ঢাকা শহরে আছে?’
‘আয়না পড়া দিয়া জানছি। ধনখালির পীর সাব আয়না পড়া দিয়া পাইছে। অখন আফনে একটু চেষ্টা নিলে…’
‘আচ্ছা দেখি।’
সে আবার একটা কদমবুসি করে ফেলল।
সকালের শুরুটা হল কদমবুসির মাধ্যমে। শুরু হিসেবে মন্দ না। সাধু-সন্ন্যাসীর স্তরে পৌঁছে যাচ্ছি কি-না বুঝতে পারছি না। সাধু-সন্ন্যাসীরা পায়ের পবিত্র ধূলি বিতরণের মাধ্যমে সকাল শূরু করেন। তারপরের অংশে ভুরি ভোজন, ঘি, হালুয়্য, পারেট মাংস।

বদরুল সাহেব তাঁর বিখ্যাত খাসির গোশতের বাটি নিয়ে এসেছেন। গোশত বলে সেখানে কিছু নেই। জ্বালের চোটে সব গোশত গলে কালো রঙের ঘন স্যুপের মত একটা বস্ত তৈরি হয়েছে। চুমুক দিয়ে খেয়ে ফেলা যায়। তবে বদরুল সাহেবের বিবেচনা আছে। তিনি সঙ্গে চায়ের চামচ এনেছেন। আমি সেই চামচে তরল খাসির মাংস এক চুমুক মুখে দিয়ে বললাম, অসাধারণ! রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতার কাছাকাছি।
বদরুল সাহেব উজ্জ্বল মুখ করে বললেন, বাসি হওয়ার টেন্ট আরো খুলেছে, তাই না? গোছতের ঐ মজা যত বাসি তত মজা। টেস্টে খুলছে না?
‘খুলছে বললে কম বলা হয়।এক্কেবারে ডানা মেলে দিয়েছে।’
‘গরম গরম পরোটা দিয়ে খেলে আরো আরাম পেতেন! আপনি একটু ওয়েট করুন, আমি দৌড় দিয়ে দু’টা পরোটা নিয়ে আসি। সাড়ে ছ’টা বাজে, মোবারকের স্টলে পরোটা ভাজা শুরু করেছে।’
‘পরোটা আনার দরকার নেই। আপনি আরাম করে বসুন তো। বরং এক কাজ করুন, আরেকটা চামচ নিয়ে আসুন, দু’জনে মিলে মজা করে খাই।’
‘না না, অল্পই আছে।’
‘নিয়ে আসুন তো চামচ। ভাল জিনিস একা খেয়ে আরাম নেই।’
‘এটা একটা সত্য কথা বলেছেন।’
বদরুল সাহেব চামচ আনতে গেলেন। ভদ্রলোকের জন্যে আমার মায়া লাগছে। গত দু’মাস ধরে তাঁর কোন চাকরি নেই। ইনসুরেুন্স কোম্পানীতে ভাল চাকরি করতেন। ইন্সপেক্টর জাতীয় কিছু। কোম্পানী তারা তাকে ছাঁটাই করে দিয়েছে। এই বয়সের একজন মানুষের চাকরি চলে গেলে আবার চাকরি জোগাড় করা কঠিন। ভদ্রলোক কিছু জোগাড় করতে পারছেন না। মেসের ভাড়া তিন মাস বাকি পড়েছে। যতদূর জানি, মেসের খাওয়াও তাঁর বন্ধ। ফিস্টে তার নাম থাকার কথা না, বাজার-টাজার করে দিয়েছেন, রান্নার সময় কাছে থেকেছেন এই বিশেষ কারণে হয়ত তাঁর খাবার ব্যবস্থা হয়েছে।
চামচ নিয়ে এসে বদরুল সাহেব আরাম করে খাচ্ছেন। তাঁকে দেখে এই মুহূর্তে মনে করার কোন কারণ নেই যে, পৃথিবীতে নানান ধরনের দুঃখ-কষ্ট আছে। যুদ্ধ চলছে বসিনিয়ায়। রুয়ান্ডায় অকারণে, একজন আরেকজনকে মারছে। তাঁর নিজের সমস্যাও নিশ্চয়ই অনেক। দু’মাস বাড়িতে মনিঅর্ডার যায়নি। বাড়ির লোকজন নিশ্চয়ই আতংকে অস্থির হচ্ছে। ভদ্রলোক নির্বিকার।
‘হিমু সাহেব।’
‘জ্বি।’

‘হাড়গুলি চুষে যে খান, মজা পাবেন। ইংরেজিতে একটা কথা আছে ‘Nearer the bone, sweeter is the meat.’
আমি একটা হাড় মুখে ফেলে চুষতে লাগলাম।
তিনিও একটা মুখে নিলেন। আনন্দে তাঁর চোখে প্রায় বন্ধ।
‘বদরুল সাহেব!’
‘জ্বি।’
‘চাকরি-বাকরির কিছু হল?’
‘এখনো হয়নি, তবে ইনশাআল্লাহ্ হবে। আমার অনেক লোকের সঙ্গে জানাশোনা। এদের বলেছি—এরা আশা দিয়েছে।’
‘শুধু আশার উপর ভরসা করাটা কি ঠিক হচ্ছে?’
‘আমার খুব ক্লোজ একজনকে বলেছি। ইস্টার্ন গার্মেন্টস-এর মালিক। ইস্কুলে এক সঙ্গে পড়েছি। এখন রমরমা অবস্থা। গাড়ি-টাড়ি কিনে হুলস্থুল। বাড়ি করেছে গুলশানে।’
‘তিনি কি আশা দিয়েছেন?’
‘পরে যোগাযোগ করতে বলেছে। সেদিনই সে হংকং যাচ্ছিল। দারুণ ব্যস্ত। কথা বলার সময় নেই। এর মধ্যেই সে পেস্ট্রি কোক খাইয়েছে। পূর্বাণীর পেস্ট্রি, স্বাদই অন্য রকম। মাখনের মত মোলায়েম। মুখের মধ্যেই গলে যায়। চাবাতে হয় না।’
‘আপনার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু?’
‘বললাম না স্কুল-জীবনের বন্ধু। নাম হল গিয়ে আপনার ইয়াকুব। স্কুলে সবাই ডাকত—বেয়াকুব।’
‘আসলেই বেকুব?’
‘তখন তো বেকুবের মতই ছিল। তবে স্কুল-জীবনের স্বভাব-চরিত্র দেখে কিছু বোঝা যায় না। আমাদের ফার্স্ট বয় ছিল রশিদ। আরে সর্বনাশ, কি ছাত্র। অংকে কোন দিন ১০০-র নিচে পায় নাই। প্রিটেস্ট পরীক্ষায় এক্সটা ভুল করেছে। সাত নাম্বার কাটা গেছে। কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছিল। সেই রশিদের সঙ্গে একুশ বছর পর দেখা। গাল-টাল ভেঙ্গে, চুল পেকে কি অবস্থা। চশমার একটা ডাণ্ডা ভাঙ্গা, সুতা দিয়ে কানের সঙ্গে বেঁধে রেখেছে। দেখে মনটা খারাপ হল।’
‘অংকে একশ পাওয়া ছেলের এই অবস্থা, মন খারাপ হবারই কথা। অংকে টেনে—টুনে পাশ করলে কানে সূতা বেঁধে চশমা পরতে হত না।’
‘কারেক্ট বলেছেন। একুশ বছর পর দেখা—কোথায় কুশল জিজ্ঞেস করবে, ছেলেমেয়ে কতবড় এইসব জিজ্ঞেস করবে—তা না, ফট করে একশ’টাকা ধরে চাইল।’
‘ধার দিয়েছেন?’
‘কুড়ি টাকা পকেটে ছিল, তা-ই দিলাম। খুশি হয়ে নিয়েছে।’
‘মেসের ঠিকানা দেননি তো? মেসের ঠিকানা দিয়ে থাকলে মহা বিপদে পড়বেন। দু’দিন পরে পরে টাকার জন্যে বসে থাকবে। আপনার জীবন অতিষ্ঠ করে ফেলবে।’
বদরুল সাহেব দুঃখিত গলায় বললেন, স্কুল-জীবনের বন্ধু তো—দুরবস্থা দেখে মনটা এত খারাপ হয়েছে, আমার নিজের চোখে পানি প্রায় এসে গিয়েছিল। সুতা দিয়ে কানের সাথে চশমা বাঁধা—
বদরুল সাহেব দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। তাঁর ভবিষ্যতের চেয়ে বন্ধুর ভবিষ্যতের চিন্তায় তাঁকে বেশি কাতর বলে মনে হল।
‘হিমু ভাই।’
‘জ্বি।’
‘ভাল একটা নাশতা হয়ে গেল, কি বলেন?’
‘হ্যাঁ, হয়েছে। আপনি যে কষ্ট করে আমার অংশটা জমা করে রেখেছেন তার জন্যে ধন্যবাদ।’
‘আরে ছিঃ ছিঃ! এটা একটা ধন্যবাদের বিষয় হল? এতদিন পরে ফিস্ট হচ্ছে আপনি বাদ পড়বেন এটা কেমন কথা? তাছাড়া আপনি যেদিন মেসে খান না সেদিনের খাওয়াটা আমি খেয়ে ফেলি।’
‘ভাল করেন। অবশ্যেই খেয়ে ফেলবেন। দেশে টাকা পাঠিয়েছেন?’
‘গত মাসে পাঠিয়েছি। এই মাস বাদ পড়ে গেল। তবে সমস্যা হবে না, আমার স্ত্রী খুবই বুদ্ধিমতী মহিলা—সে ব্যবস্থা করে ফেলবে।’
‘আপনার চাকরি যে নেই সেই খবর স্ত্রীকে জানিয়েছেন?’
‘জ্বি-না। আপনার ভাবী মনটা খারাপ করবে। কি দরকার! চাকরি তো পাচ্ছিই, মাঝখানে কিছুদিনের জন্যে টেনশানে ফেলে লাভ কি? আজই ইয়াকুবের সঙ্গে দেখা করব। সংস্কৃতে একটা কথা আছে না—“শুভস্য শীঘ্রম”। চা খাবেন হিমু ভাই?’
‘জ্বি-না। দরজা-টরজা বন্ধ করে লম্বা ঘুম দেব। আমার স্বভাব হয়ে গেছে বাদুরের মত। দিনে ঘুমাই রাতে জেগে থাকি।’
‘কাজটা ঠিক হচ্ছে না ভাই সাহেব। শরীরের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। শরীর নষ্ট হলে—মন নষ্ট হয়। আমার শরীরটা ঠিক আছে বলেই এত বিপদে-আপদেও মনটা ঠিক আছে। শরীরটা ঠিক রাখবেন।’
‘আমার আবার উল্টা নিয়ম। মনটাকে ঠিক রাখে যাতে শরীর ঠিক থাকে।’
বদরুল সাহেব বাটি এবং চামচ নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। লজ্জিত ভঙ্গিতে বললেন, ছোট্ট একটা কাজ করে দিবেন হিমু ভাই!
‘জ্বি, বলুন।’
‘মেসের মালিক আমাকে বলেছে সোমবারে মধ্যে মেস ছেড়ে দিতে। আজেবাজে সব কথা। গালাগালি। আপনি যদি একটু বলে দেন! ও আপনাকে মানে।’
‘আমি এক্ষুনি বলে দিচ্ছি।’
‘তাকে বললাম যে চাকরি হয়ে যাচ্ছে। ইয়াকুবকে বলেছি। এত বড় গার্মেন্টস-এর মালিক। চাকরি তার কাছে কিছুই না। সে একটা নিঃশ্বাস ফেললে দশটা লোকের এমপ্লয়ম্নেট হয়ে যায়। বিশ্বাস করে না। আপনি বললে বিশ্বাস করবে।’

আমাদের ম্যানাজারের নাম হায়দার আলি খাঁ। নামের সঙ্গে তার চেহারার কোন সঙ্গিত নেই। রোগা, বেঁটে একজন মানুষ। বেঁটেরা সচবাচর কুঁজো হয় না। তিনি খানিকটা কুঁজো। ব্যক্তিবিশেষের সামনে তার কুজোভাব প্রবল হয়। আমি সেই ব্যক্তিবিশেষের একজন। তিনি কোন কারণ ছাড়াই আমাকে ভয় পান।
হায়দার আলি খাঁ চেয়ারে গুটিসুটি মেরে বসে আছে। পিরিচে করে চা খাচ্ছে। ঐ লোককে আমি কখনো চায়ের কাপে করে চা খেতে দেখিনি। আমি কাছে এসে হাসিমুখে বললাম, ভাই সাহেব, খবর কি?
ভদ্রলোক যে ভাবে চমকালেন তাতে মনে হল, সাত রেক্টার স্কেলের একটা ভূমিকম্প হয়ে গেছে। পিরিচের সব চা তার জামায় পড়ে গেল। আমি বললাম, করেছেন কি?
‘চা খাচ্ছি স্যার।’
‘খুব ভাল। বেশি বেশি করে চা খান। রিসার্চ করে নতুন বের করেছে—দৈনিক যে সাত কাপ চা খায় তার হার্টারি কখনো ব্লক হয় না।’
‘থ্যাংক য়্যু, স্যার।’
যেভাবে তিনি থ্যাংক য়্যু বললেন তাতে ধরণা হতে পারে হার্টের আর্টারি সংক্রান্ত রিসাচটা আমার করা। আমি অবসর সময়ে মেসের ঘরের দরজা বন্ধ করে রিসার্চ করেছি।
‘বদরুল সাহেবকে নাকি নোটিশ দিয়ে দিয়েছেন—কথা কি সত্যি?
‘জ্বি। তিন মাসের রেন্ট বাকি। আর নানান যন্ত্রণা করে। বোডাররা নালিশ করেছে।’
‘কি যন্ত্রাণা করেছে?’
‘রান্নার সময় বাবুর্চির পাশে বসে থাকে। ফিস্ট হয়েছে—ত্রিশ’ টাকা করে চাঁদা। একটা পয়সা দেয় নাই—ফিস্ট খেয়ে বসে আছে।’
‘চাঁদা না দিলেও খাটাখাটনি তো করেছে। গোশত কিরে আনা, খাসির গোশত যে-কেউ কিনতে পারে না। খুবই জটিল ব্যাপার। খাসি ভেবে কিনে এনে রান্নার পর প্রকাশ পায় পাঁটা।’
হায়দার আলি খাঁ তাকাচ্ছেন। আমার কথাবাতার ধরন বুঝতে পারছেন না। কি বলবেন তাও গূছিয়ে উঠতে পারছে না।
‘ম্যানেজার সাহেব।’
‘জ্বি স্যার।’
‘বদরুল সাহেবকে আর কিছু বলবেন না।’
‘তিন মাসের রেন্ট বাকি পড়ে গেছে। অন্য পাটিকে কথা দিয়ে ফেলেছি। মানুষের কথার একটা দাম আছে। ঠিক না স্যার?’
‘ঠিক তো বটেই। কথার দাম আগে যা ছিল মুদ্রাস্ফীতির কারণে সেই দাম আরো বেড়েছে। তবু একটা ব্যবস্থা করুন। এক মাসের মধ্যে সব পেমেন্ট ক্লিয়ার হয়ে যাবে।’
‘কিভাবে হবে? শূনেছি উনি ছাঁটাই হয়ে গেছেন । অফিসের পাওনা টাকাপয়সাও দিচ্ছে না। টাকাপয়সার কি না-কি গন্ডগোল আছে।’
‘গন্ডগোল তো থাকবেই। পৃথিবীতে বাস করবেন আর গন্ডগোলে পড়বেন না, তা তো হয় না। এই গন্ডগোল নিয়েই বাস করতে হবে। উপায় কি? মনে থাকবে তো কি বললাম?’
‘জ্বি স্যার।’
আমি ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে শূয়ে পড়লাম। ম্যানেজার অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে জ্বি স্যার বলেছে বলেই ঠিক ভরসা পাচ্ছি না। বিনয়ের বাড়াবাড়িটাই সন্দেহজনক। আমার নিজের ধারণা বিনয় ব্যাপারটা পৃথিবী থেকে পুরোপুরি উঠে গেলে পৃথিবীতে বাস করা সহজ হত। বিনয়ের কারণে সত্য-মিথ্যা প্রভেদ করা সমস্যা হয়। মিথ্যার সঙ্গে বিনয় মিমিয়ে দিলেই সেই মিথ্যা ধরার কারো সাধ্য থাকে না।
ঘুমের চেষ্টা করছি। ঘুম আসছে না। বেশ কয়েকদিন থেকে নিদ্রা এবং জাগরণের সাইকেলটা বদলাবার চেষ্টা করছি। রাত ঘুমের জন্যে এবং দিন জেগে থাকার জন্যে, এই নিয়ম ভাঙা দরকার। মানুষ ঘুমকে নিয়ন্ত্রণ করবে। সৃর্য নিয়ন্ত্রণ করবে না। সৃর্য হচ্ছে জ্বলন্ত অগ্নিগোলক। মানুষের মত অসাধারণ মেধার প্রাণীগোষ্ঠিকে নিয়ন্ত্রণ করার তার কোন অধিকার নেই।
টানা ঘুম দিলাম। ঘুম ভাঙল সন্ধ্যায় সন্ধ্যায়। এই সময় মেসটা ফাঁকা ফাঁকা থাকে। বেশির ভাগিই চা-নাশতা খেতে বাইরে যায়। মেসে শূধু একবেলা খাবার ব্যবস্থা, রাতে। এক কাপ চা খেতে হলেও রাস্তা পার হয়ে স্টল যেতে হবে। ইদানীং অবশ্যি নতুন, এক চাওয়ালা শ্রেণীর উদ্ভব হয়েছে। এরা বিশাল ফ্লাস্কে করে চা ফেরি করে। চায়ের দাম ফক্সড—এক টাকা কাপ। চিনি বা দুধের দাম বাড়ালে কাপের সাইজ ছোট হয় কিন্তু চায়ের দামের হের-ফের হয় না। আমাদের এখানে যে ছেলে চা বিক্রি করে তার নাম মতি। দেখতে রাজপুত্রের মত, আসলে ভিখিরিপুত্র। বারান্দায় এসে মতিকে খুঁজলাম। মতি এখনো আসেনি, তবে অপরিচিতি এক ভদ্রলোক এসেছেন। শুকানো মুখ টুলে বসে আছেন। ভদ্রলোক অপরিচিত হলেও দেখামাত্র চিনলাম—কারণ তাঁর চশমার একটা ডাঁটা ভাঙা সুতা দিয়ে কানের সঙ্গে বাঁধা। ভদ্রলোক সন্দেহজনক দুষ্টিতে আমাকে দেখছেলন। আমি বললাম, কি ভাই, ভাল আছেন?
তিনি হকচকিয়ে গেলেন। উঠে দাঁড়ালেন।
‘বদরুল সাহেবের কাছে এসেছেন, তাই তো?’
‘জ্বি স্যার?’
‘টাকা ধারের জন্যে?’
ভদ্রলোক খানিকটা বিভ্রান্ত হয়ে গেছেন। চট করে কিছু বলতে পারছেন না। আবার খুব চেষ্টা করছেন কিছু বলতে।
আমি বললাম, বদরুল সাহেব আমাকে আপনার কথা বলেছেন। খুবই প্রশংসা করছিলেন। প্রি-টেস্ট পরীক্ষায় একটা এক্সটা না-কি ভুল হয়েছিল। তাড়াহুড়া করেছিলেন নিশ্চয়ই। অনেক সময় ওভার কনফিডেন্সেও সমস্যা হয়। যাই হোক, কেমন আছেন বলুন।
‘জ্বি ভাল। বদরুল কখন আসবে?’
‘উনি আসবেন কোথেকে?’
‘এখানে থাকেন না?’
‘আগে থাকতেন। মেসে অনেক বাকি পড়ে গেছে। চারদিকে ধার-দেনাঅ পালিয়ে গেছেন।’
‘নিচের ম্যানেজার সাহেব আমাকে বললেন, মেসেই থাকে।’
‘ম্যানেজার তাই বলেছেন? সে রকমই বলার কথা। সেও জানে না। জানলে জিনিসপত্র ক্রোক করে রেখে দিত। চুপি চুপি পালিয়েছে। শুধু আমি জানি। আপনাকে বললাম, কারণ আপনি তার ক্লোজ ফ্রেন্ড। ছাত্র জীবনের বন্দু। অংকে সব সময় হাই মার্ক পেয়েছেন।’
‘বদরুল থাকে কোথায়?’
‘সেটাও বলা নিষেধ। যাই হোক, আপনাকে বলছি। দয়া করে খবরটা গোপন রাখবেন। উনি টেকনাফের দিকে চলে গেছেন।’
‘কোন দিকে গেছে বললেন?’
‘টেকনাফের দিকে । চিটাগাং হিল ট্রেক্ট।তাঁর দুর সম্পর্কের এক মামা আছেন, বন বিভাগে চাকরি করেন, তাঁর কাছে গেছেন। কিছু মনে করবেন না, আপনার নামটা যেন কি?’
খোঁজে আসাও অর্থহীন। চলে যান।’
‘চলে যাব?’
‘আপনাকে এক কাপ চা খাওয়াতে পারি, শুধু চা খাবেন?’
আবদুল রশীদ হ্যাঁ-না কিছুই বলল না। মুখ দেখে যাচ্ছে সে পুরোপুরি আশাহত। আমি ভদ্রলোককে চা খাওয়াতে নিয়ে গেলাম। চা খাওয়ালাম, সিঙ্গাড়া খাওয়ালাম। এইখানেই শেষ করলাম না, রাস্তার পাশে ঘড়ি সারাইয়ের দোকানে নিয়ে গিয়ে চশমার ডাঁট লাগিয়ে দিলাম। আমার সর্বমোট ১৩ টাকা খরচ হল।
ভদ্রলোক বললেন, ভাই সাহেব, আপনাকে একটা কথা বলি যদি কিছু মনে না করেন। আপন ভেবে বলছি।
‘বলুন, কিছু মনে করব না।’
‘কথাটা বলতে খু্বই লজ্জা পাচ্ছি। আপনি অতি মহৎপ্রাণ এক ব্যক্তি। আপনাকে বিব্রত করতেও লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে…’
‘মাথা কাটা যাওয়ার কিছু নেই, আপনি বলুন।’
‘দারুণ এক সংকটে পড়েছি ভাই সাহেব। আত্মহত্যা ছাড়া এখন আর পথ দেখছি না।’
‘ছেলে অসুস্থ। টাকার অভাবে চিকিৎসা হচ্ছে না?’
‘ধরেছেন ঠিকই। তবে ছেলে না, মেয়ে। কনিষ্ঠা কন্যা। সকাল থেকে হাঁপনির মত হচ্ছে। ডাক্তার ইনজেকশন, সেই সঙ্গে কি ট্যাবলেট যেন দিয়েছে। আমি আমার স্ত্রীকে বললাম, চিকিৎসা করার টাকা কোথায়? তুমি বরং গলা টিপে মেরে ফেল।’
‘উনি গলা টিপে মারতে রাজি হচ্ছেন না।
আবদুর রশীদ আমার এই কথায় অস্বস্তিতে পড়ে গেল। আমি বললাম, এইসব কঠিন কাজ স্ত্রীকে দিয়ে হবে না। এইসব হল পুরুষের কাজ। গলা টেপে মারতে হলে আপনাকেই মারতে হবে।
‘ভাই সাহেব, ঠাট্টা করছেন?’
‘না, ঠাট্টা করছি না। মৃত্যু কোন ঠাট্টা-তামাশার বিষয় না। আমি আপনাকে একশ’ টাকা দেব।’
‘দিবেন? সত্যি দিবেন?’
‘অবশ্যই দেব।স্কুল-জীবনে আপনি অংকে খুব ভাল ছিলনে, তাই না? কেমন ভাল ছিলেন প্রমাণ দিন দেখি। সহজ একটা অংক জিজ্ঞেস করব। কারেক্ট উত্তর দেবেন—একশ’ টাকা নিয়ে চলে যাবেন।’
আবদুর রশীদ ক্ষীণ স্বরে বলল, কি অংক?
‘একটা বাড়িতে চারটা হারিকেন জ্বলছিল। গভীর রাতে কথা নেই বার্তা নেই শুরু হল ঝড়। একটা হারিকেন নিভে গেল। এখন আপনি বলুন ঐ বাড়িতে হারিকেন এখন কয়টা?’
‘তিনটা!’
আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, হয়নি। একটা হারিকেন নিভে গেছে ঠিকই। হারিকেনের সংখ্যা তো কমেনি। হারিকেন চারটাই আছে। আপনি তো ভাই অংক শিখতে পারেননি। টাকাটা দিতে পারলাম না। কিছু মনে করবেন না।
আবদুর রশীদ দাঁড়িয়ে আছে—আমি হাঁটা ধরেছি। মেসে ফিরে যাব। সারাদিন কিছু না খাওয়াতে খিদেয় নাড়িভুড়ি পাক দিচ্ছে। মেসে রান্না হয়েছে কি-না খোঁজ নিতে হবে। মেসের ভাত সকাল সকাল নেমে যায়। ভাত নেমে গেলে একটা ডিম ভেজে দিতে বলব। আগুন-গরম ভাত ডিমভাজা দিয়ে খেতে অতি উপাদেয়। তবে খেতে হয় চুলা থেকে ভাত নামার সঙ্গে সঙ্গে, দেরি করা যায় না।

ঘর থেকে বেরুবার জন্যে রাত বারোটা খুব ভাল সময়। জিরো-আওয়ার। কাউন্ট আপ শুরু হয় জিরো-আওয়ার থেকে—0,1,2,3,…ঠিক রাত বারোটায় কি বার হবে? শনিবার নয়, রবিবারও নয়। জিরো আওয়ারে বার থেমে থাকে।
দরজা তালাবন্ধ করে বেরুচ্ছি, দেখি বদরুল সাহেব। কলঘর থেকে হাত-মুখ ধুয়ে ফিরছেন। মুখ ভেজা, কাঁধে গামছা। রাত বারোটায় আমার মন-টন খুব ভাল থাকে। কাজেই আমি উল্লাসের সঙ্গেই বললাম,কি খবর বদরুল সাহেব।
তিনি লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসলেন।
‘কোথায় ছিলেন আজ সারাদিন?’
তিনি আবারো হাসলেন। আমি বললাম, গিয়েছিলেন নামি ইয়াকুব আলির কাছে?
‘জ্বি।’
‘দেখা হয়নি?’
‘দেখা হয়েছে। অতিরিক্ত ব্যস্ত।’
‘কথা হয়নি?’
‘হয়েছে। চাকরির ব্যাপারটা বললাম।’
‘আগেও তো বলেছিলেন। আবার কেন?’
‘ভুলে গিয়েছে। নানান কাজকর্ম নিয়ে থাকে তো। আজকে তার আবার একটা দুঘর্টনা ঘটল। তার মনটা ছিল খারাপ।’
‘কি দুঘর্টনা?’
‘একুশ লাখ টাকা দিয়ে নতুন গাড়ি কিনেছে। সেই গাড়ির হেডলাইট ভেঙ্গে ফেলেছে। কেয়ারলেস ড্রাইভার। ঐ নিয়ে নানান হৈ-চৈ, ধমকাধমকি চলছে, তার মধ্যে আমি গিয়ে পড়লাম।’
‘আপনি ধমক খেয়েছেন?’
‘জ্বি-না, আমি ধমক খাব কেন? আমার ছেলেবেলার বন্ধু। ভেরি ক্লোজ ফ্রেন্ড। গাড়ির হেডলাইট ভাঙার কারণে ইয়াকুবের মন খারাপ দেখে আমারো মন খারাপ হল।এর মধ্যে চাকরির কথাটা তুলে ভুল করেছি।’
‘ইয়াকুব সাহেব রেগে গেছেন?’
‘তা ঠিক না। বলল বায়োডাটা তার সেক্রেটারির কাছে দিয়ে যেতে। দু’টা পাসপোর্ট সাইজের ছবিসহ বায়োডার্টা, সে দেখবে।’
‘দেখবে তো বটেই। স্কুল-জীবনের বন্ধু, ফেলবে কি করে? বায়োডাটা নিয়েই সারাদিন ছোটাছুটি করলাম। একদিনের মধ্যে ছবি তুলে, বায়োডাটা টাইপ করে , পাঁচটা সময় একেবারে ইয়াকুবের হাতেই ধরিয়ে দিয়েছি।’
‘ইয়াকুব সাহেব আপনার কর্মতৎপরতা দেখে নিশ্চয়ই খুব খুশি হলেন।’
বদরুল চুপ করে রইলেন। আমি বললাম, খুশি হননি?
‘জ্বি-না। একটু মনে হয় বেজার হয়েছে; সেক্রেটারির হাতে দিতে বলেছে, আমি তা না করে তার হাতেই দিলাম—এতে সামান্য বিরক্ত। এত বড় একটা অর্গানাইজেশন চালায়। তার তো একটা সিস্টেম আছে। হুট করে হাতে কাগজ ধরিয়ে দিলে হবে না। ভুলটা আমার।’
‘বদরুল সাহেব, আপনার কি ধারণা ইয়াকুব আলি আপনাকে চাকরি দেবেন?’
‘অবশ্যই। আমার সামনেই সেক্রেটারিকে ডেকে বায়োডাটা দিয়ে দিল। বলল উপরে আর্জেন্ট লিখে ফাইল রাখতে।’
‘কবে নাগাদ চাকরি হবে বলে মনে করছেন?’
‘খুব বেশি হলে এক সপ্তাহ। ইয়াকুব আমাকে এক সপ্তাহ পরে খোঁজ নিতে বলেছে। আগামী শনিবারের মধ্যে ইনশাআল্লাহ হয়ে যাবে। স্বপ্নেও তা-ই দেখলাম।’
‘এর মধ্যে স্বপ্নও দেখে ফেলেছেন?’
‘জ্বি। ছোটাছুটি করে কাগজপত্র জোগাড় করে টায়ার্ড হয়ে গিয়েছিলাম। ভাবলাম, একটু রেস্ট নেই। ইয়াকুবের পি. এ. বলল, বসুন চা খান। চা খাওয়ার জন্যে বসেছি। বসে থাকতে থাকতে ঝিমুনির মত এস গেল। তখন স্বপ্নটা দেখেছি। দেখলাম কি—ইয়াকুব এসেছে। তার হাতে বিরাট এক মৃগেল মাছ। এইমাত্র ধরা হয়েছে। ছটফট করছে। ইয়াকুব বলল, নিজের পুকুরের মাছ। তোর জন্যে আনলাম। নিয়ে যা। মাছ স্বপ্নে দেখা খুবই ভাল। হিমু ভাই, আপনি যাচ্ছেন কোথায়?’
‘হাঁটতে যাচ্ছি।’
‘রাতদুপুরে কেউ হাঁটটে যায়? আশ্চর্য! দুপুর রাতে হাঁটার মধ্যে আছে কি?’
‘চলুন, আমার সঙ্গে হেঁটে দেখুন।’
‘যেতে বলছেন?’
‘এক রাতে একটু অনিয়ম করলে কিছু হবে না।’
‘খুবই টায়ার্ড লাগছে হিমু ভাই। ভাবছি ঘুমুব।’
‘ঘুম তো আপনার আসবে না। খিদে পেটে শুয়ে ছটফট করবেন। এরচে’ চলুন কোথাও নিয়ে গিয়ে আপনাকে খাইয়ে আনি। মনে হচ্ছে সারাদিন কিছুই খাননি।’
‘সারাদিন খাইনি কি করে বুঝলেন?’
‘বোঝা যায়। মানুষের সব খাবার তার চোখে লেখা থাকে। ইচ্ছে করলেই সেই লেখা পড়া যায়। কেউ ইচ্ছে করে না বলে পড়তে পারে না।’
‘আপনি পারেন?’
‘মাঝে মাঝে পারি। সব সময় পারি না। আপনি যে সারাদিন খাননি এটা আপনার চোখে পড়তে পারছি। এই সঙ্গে আরেকটা জিনিশ পড়া যাচ্ছে, সেটা হচ্ছে, আজ দিনটা আপনার জন্যে খুব আনন্দের।’
বদরুল সাহেব হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছেন। হতভম্ব ভাব কাটার পর বললেন, আপনি ঠিকই ধরেছেন। আজ আমার বিবাহ বার্ষিকী। আমি ভুলে গিয়েছিলাম, সন্ধ্যার সময় হঠাৎ মনে হয়েছে—আরে আজ তো ২৫শে এপ্রিল।
‘চলুন, রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বিয়ের দিনের গল্প করবেন। অনেকদিন কারো বিয়ের গল্প শুনি না।’
বদরুল সাহেব লজ্জিত গলায় বললেন, বলার মত কোন গল্প না।
‘সব গল্পই বলার মত।’

রাস্তায় নেমেই বদরুল সাহেব বিস্মিত স্বরে বললেন, হাঁটতে তো ভালই লাগছে। রাস্তাগুলি অন্য রকম লাগছে। আশ্চয় তো! ব্যাপারটা কি?
আমি ব্যাপার ব্যাখ্যা করলাম না। রাতের বেলা রাস্তার চরিত্র বদলে যায় কেন সেই ব্যাখ্যা একেক জনের কাছে একেক রকম। আমার ব্যাখ্যা আমার কাছেই থাকুক।
বদরুল সাবেহ বললেন, হাঁটতে হাঁটতে আমার কোথায় যাব?
আমি বললাম, মাথায় কোন নিদিষ্ট জায়গা থাকলে হাঁটার কোন আরাম থাকে না। হাঁটতে হবে এলোমেলোভাবে। বলুন কি ভাবে আপনাদের বিয়ে হল।
‘মুন্সিগঞ্জে বেড়াতে গিয়াছিলা। খালার শৃশুরবাড়িতে। ওদের একান্নবর্তী পরিবার। লোকজন গিজ গিজ করছে। কে কখন খায় ঠিক নেই। খাওয়া-দাওয়ার ভেতরে কোন যন্ত নেই। খেলে খাও, না খেলে খেও না ওই রকম ভাব। মাঝে মাঝে কি হয় জানেন? ভাল একটা পদ হয়ত রান্না হচ্ছে, এদিকে বেশির ভাগ মানুষ খেয়ে উঠে গেছে। কেউ জানেই না—মুল পদ এখনো রান্না হয় নি…
বদরুল সাহেব তার বিয়ের পল্পের জায়গায় খাওয়ার গল্প ফেদেঁ বসেছেন। এই খাওয়া-দাওয়ার ভেতর থেকে বিয়ের গল্প হয়ত শুরু হবে, কখন হবে কে জানে। ভদ্রলোকের সম্ভবত খিদেও পেয়েছে। খিদের সময় শুধু খাবার কথাই মনে পড়ে। তাঁকে খাওয়াতে কি ব্যবস্থা করা যায় বুঝতে পারছি না। আবার পকেটবিহীন পাঞ্জাবি নিয়ে বের হয়েছি। এই পাঞ্জাবি মনে হয় আর ব্যবহার করা যাবে না। বদরুল সাহেব গল্প চালিয়ে যাচ্ছেন—সেদিন কি হয়েছে শুনুন। পাবদা মাছ এসেছে। এক খলুই মাছ, প্রত্যেকটা দেড় বিষং সাইজ। এ বাড়িতে আবার অল্প কিছু আসে না। যা আসে ঝুড়ি ভর্তি আসে…আমরা ফুল রাস্তা ছেড়ে গলিতে ঢুকলাম। বদরুল সাহেবের গল্পে বাধা পড়ল। আমরা টহল পুলিশের মুখোমুখি পড়ে গেলাম। খাকি পোশাকের কারণে সব পুলিশ একরকম মনে হলেও এটি যে গতকালেরই দল এতে আমার কোন সন্দেহ রইল না। আমি আন্তরিক ভঙ্গিতেই বললাম, কি খবর?
টহল পুলিশের দল থমকে দাঁড়াল।
‘আজ আপনাদের পাহারা কেমন চলছে?’
এই প্রশ্নেরও জবাব নেই। বদরুল সাহেব হক চকিয়ে গেছেন। কথাবার্তার ধরন ঠিক বুঝতে পারছেন না।
কালকের ওস্তাদজি আজও প্রথম কথা বললেন, তবে তুই-তোকারি না, ভদ্র ভাষা।
‘আপনারা কোথায় যান?’
‘ভাত খেতে যাই। আজ অবশ্যি আমি খাব না। এই ভদ্রলোক খাবেন। উনার নাম বদরুল আলম। উনাকে থাপ্পড় দিতে চাইলে দিতে পারেন। উনিও কিছু বুঝতে পারছি ন। কি সমস্যা?
‘কোন সমস্যা না। জনগনের সেবক পুলিশ ভাইরা এখন আপনার রাতের খাবার ব্যবস্থা করবেন।’
পুলিশ দলের একজন বলল, কালকের ব্যাপারটা মনে রাখবেন না। নানা কিসিমের বদলোক রাস্তায় ঘুরে, নেশা করে। আমরা বুঝতে পারি নাই। একটা মিসটেক হয়েছে।
‘আমি কিছু মনে করিনি । মনের ভেতর অতি সামান্য খচখচকি আছে, সেটা দুর হযে যাবে—যদি আপনারা বদরুল সাহেবের রাতের খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন।’
‘এত রাতে?’
‘আপনাদের কারবারই তো রাতে। আপনাদের একটা বুদ্ধি শিখিয়ে দি—কোন একটা বাড়িতে গিয়ে কলিংবেল টিপুন। বাড়িওয়ালা দরজা খুলে এতগুলি পুলিশ দেখে যাবে ভড়কে। তখন আপনাদের যে ওস্তাদ তিনি বিনীত ভঙ্গিতে বলবেন, স্যার, এত রাতে ডিসর্টাব করার জন্যে খুবই দুঃখিত। একজন বিশিষ্ট ভদ্রলোক সারাদিন না খেয়ে আছেন। যদি একটু খাওয়ার ব্যবস্থা করেন! দেখবেন তৎক্ষণাৎত খাবার ব্যবস্থা হবে। মধ্যরাতের পুলিশ ভয়াবহ জিনিশ।’
বদরুল সাহেবের হতভম্ব ভাব কাটছে না। তাঁর ক্ষুধা-তৃষ্ণাও সম্ভবত মাথায় উঠে গেছে। পুলিশ দলের একজন আমার কাছে এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বলল, স্যার, আপনার সঙ্গে একটু ‘প্রাইভেট টক’ আছে।
আমি ‘প্রাইভেট টক’ শোনার জন্যে ফুটপাত ছেড়ে নিচে নামলাম। সে কানের কাছে গুন গুন করে বলল, স্যার, বিরাট মিসটেক হয়েছে। রাস্তায় কত লোক হাঁটে, কে সাধু, কে শয়তান বুঝব কি ভাবে!
আমিও তার মতই নিচু গলায় বললাম, না বোঝারই কথা।
‘ওস্তাদজী একটা ভুল করেছে। চড় দিয়ে ফেলেছে। তারপর থেকে উনার হাত ফুলে প্রচণ্ড ব্যথা। ব্যথার চোটে রাতে ঘুমাতে পারেননি।’
‘বেকায়দায় চড় দিয়েছে। রগে টান পড়েছে। কিংবা হাতের মাসলে কিছু হয়েছে।’
‘কি যে ব্যাপার সেটা স্যার আমরা বুঝে গেছি। এখন স্যার আমাদের ক্ষমা দিতে হবে। এটা স্যার আমাদের একটা আবদার।’
‘আচ্ছা যান, ক্ষমা দিলাম।’
‘ওস্তাদজী আজ ছুটি নিয়েছে। সারাদিন শুয়েছিল, রাতে বের হয়েছে শুধু আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্য।’
‘ভালই হয়েছে দেখা হয়ে গেল।’
‘আপনি স্যার আমাদের জন্যে একটু দোয়া রাখবেন।’
‘অবশ্যই রাখব।’
‘উনার খাবার ব্যাপারে স্যার কোন চিন্তা করবেন না।’
আমি বদরুল সাহেবকে বললাম, আপনি এদের সঙ্গে যান। খাওয়া-দাওয়া করুন। তারপর মেসে চলে যাবেন। আমি ভোরবেলা ফিরব।
তিনি পুরোপুরি হকচকিয়ে গেছেন। কিছুতেই যাবেন না। পুলিশরা বলতে গেলে তাকে গ্রেফতার করেই নিয়ে গেল। বেচারার হতাশ দৃষ্টি দেখে মায়া লাগছে। মায়া ভাল জিনিশ না। অনিত্য এই সংসারে মায়া বিসজর্ন দেয়া শিখতে হয়। আমি শেখার চেষ্টা করছি।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *