একটা অন্ধকার পথ পড়ল
কয়েকগজ এগোতেই বামে একটা অন্ধকার পথ পড়ল। দুদিকে উঁচু দালান—- মাঝখান দিয়ে কুয়াশা অন্ধকার একটা খোলা জায়গায় পড়েছে, তার ওপারে আরেকটা পথ বাহুর মত পড়ে আছে। দুদালানের মাঝখানে এসে বেবি বলল, এসো এদিকে। চিপস খাবে? পটেটো চিপস?
খাবো।
নাসিমার মন উন্মুখ হয়ে উঠল বেবির এই আদরটুকু দুহাত ভরে নেবার জন্যে। প্রশ্রয় দেবার আগ্রহে কোমল হয়ে এলো তার চোখ। আবার বলল, তোমার ভালো লাগে, না?
মাঝে মাঝে। এই লোকটা সাইকেল নিয়ে রোজ সন্ধ্যেয় এখানে দাঁড়ায়। সবাই চেনে। শুধু কি পটেটো চিপস? —- আরো কত কী। আমি কখনো কখনো কিনি।
লোকটা সাইকেলের ক্যারিয়ারে বাঁধা ট্রাঙ্ক থেকে চিপস ভরে ঠোঙ্গা এগিয়ে দেয়। প্রশ্ন করে, অওর দু?
ব্যস, আভি নহি।
বেবি দালানের দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়। মুড়মুড় করে একটা দুটো চিপস দাঁতে কাটতে থাকে। সমুখে দাঁড়িয়ে নাসিমাও।
আরো নেবে?
নাহ্। চলো এগোই।
দূর থেকে চোখে পড়ে আঁধারে আবছা হয়ে আসা স্টেডিয়াম। তার কনস্ট্রাকশনের খাড়া লোহা অজস্র জটিলতা হয়ে আছে আকাশের গায়ে যে আকাশ থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে এখনো। রক্তিম একটা আভা। সব মিলিয়ে খানিকটা মোবাইল স্কাল্পচারের মত লাগে স্টেডিয়ামকে। গভীরে কোথাও কান পাতলে প্রাণস্পন্দন শোনা যাবে যেন।
বেবিকে নিয়ে নালিমা নির্জন স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে এসে দাঁড়াল। সিঁড়ি বেয়ে উঠলো ওপরে, আরো ওপরে, বাঁধানো চওড়া চত্বরে।
কেউ নেই। এ মাথা থেকে দৃষ্টি করলে সবচে দূরের বিন্দুটি চোখে পড়ে না। হাঁটতে হাঁটতে ওরা একেবারে ওদিকটায় গিয়ে পড়ল—- ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট বিল্ডিংয়ের চুড়োয় লাল তারার কাছাকাছি। দূর থেকে সমস্ত শহরের কোলাহল ঢেউয়ের মত কাঁপন তুলে মৃদু থেকে মৃদুতর হয়ে আছড়ে পড়ছে এই সীমানায়। এত দূরে আমি এসে গেছি। চিরকাল এমনি একটা সুদূরে পৌঁছুনোর চেষ্টা চলছিল বুঝি আমার। পায়ের নিচে সিমেন্টের রুক্ষ স্পর্শ নাসিমা অনুভব করতে থাকে স্যাণ্ডেল থেকে পদতল নগ্ন করে। আবার তারা হাঁটতে হাঁটতে প্রথম বিন্দুতে এসে পৌঁছোয়।
আস্তে আস্তে শহরটা যেন কাছে চলে আসে। যেন তারা দুজনে স্থির, ঘুরছে তাদের চারপাশে এই দিকের আলো–মানুষ আর ওদিকের আঁধার–নির্জনতা। লাল তারাটা ছোট থেকে বড় হয়ে আবার ছোট হয়ে যায়।
দূর থেকে বেশ দেখায়, না?
কী?
তারাটা।
হ্যাঁ।
আমার হৃদয় এমনি রক্তাক্ত। নাসিমা দূরে সরে যেতে যেতে লাল তারা থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আনে। নিচে মাঠের দিকে তাকায়। কয়েককটা লোক স্থির হয়ে বসে আছে। ওপর থেকে দেখাচ্ছে কালো পাথরের টুকরোর মত। আমিও কি ওখানে নেমে গেলে বেবির চোখে অমনি পাথর হয়ে যাবো? কালো পাথর?
দূরে সরে যাওয়ার ফলে বেবির চোখ থেকে নাসিমার মুখ অদৃশ্য হয়ে যায়। শুধু সাদা শাড়ি একটা রঙের পোচের মত আকাশের পটভূমিতে স্থির হয়ে থাকে। বেবির ভালো লাগে এই সাদা রঙটা থেকে এমনি দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে। অদ্ভুত, এমন কী অকারণ একটা কৃতজ্ঞতায় মন ভরে ওঠে তার নাসিমার জন্যে। মনে মনে বলে, আমার কী যে ভালো লাগছে তোমার সঙ্গ পেয়ে তুমি তা জানবে না। আমি তোমার কাছে কিছুই চাই না। আমাকে তুমি নাড়া দাও, ঝড়ের দোলায় অস্থির করে তোলো আমার আর কোনো বাসনা নেই। আমাকে প্রশ্ন করো, লক্ষ লক্ষ অযুত প্রশ্ন।
নাসিমাই প্রশ্ন করল। কী ভাবছিলে?
কই কিছু না।
আমাকে বলতে তোমার ভয় করে?
নাসিমার ইচ্ছে হয় দুহাত দিয়ে ধরে রাখে বেবির সুন্দর এখনো সবুজ মুখ। কোনদিন যেন তাকে হারাতে না হয় এমনি প্রার্থনায় কাঁপতে থাকে তার আত্মা। মমতায় নত হয়ে আসে নাসিমা। বলে, কেউ চুপ করে থাকলে আমার খারাপ লাগে। কেন? তুমি চুপ করে থাকলে আমার আরো খারাপ লাগে।
তখন বেবি ফস্ করে শুধোয়, তোমাকে কী বলে ডাকব?
আজ সন্ধ্যে থেকে এই সমস্যাটা তাকে পীড়িত করছিল।
বেবি গভীর প্রায় অসহায় একজোড়া চোখ মেলে তাকায় তার দিকে। নাসিমার ঠোঁট তখন নিঃশব্দ হাসির কাঁপনে ফুলে ওঠে। নাসিমা হাসে। বলে, ওই পোস্টের কাছে বসিগে চলো। বেবি তখন একটা নিদারুণ লজ্জার হাত থেকে বেঁচে যায়।
নাসিমা তার কাঁধে হাত রেখে বসে।
কাদা তোমাকে স্পর্শ করেনি, তুমি কোনোদিন কাদায় নেবে যেও না।
নাসিমা মনে মনে অনেকক্ষণ প্রার্থনা করলো বেবির জন্যে।
বেবিকে আমি ভালোবেসেছি, যেমন করে আকাশ ভালোবাসে প্রান্তরের একেলা গাছটিকে। যেমন করে পাখি তার সন্ধ্যেয় ফিরে আসে বাসাতে, তেমনি কি তুমিও ফিরে আসতে পারো না?
নাসিমার নিজেকে মনে হলো একটা শুকিয়ে ম্লান হয়ে যাওয়া বৃক্ষশাখা। বিশ্রাম কেউ নিতে পারে হয়ত, কিন্তু বাসা? বাসা কেউ বাঁধবে না।
নাসিমা বেবির চুলে যখন হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল তখন বেবির মন যেন অনর্গল একটা স্রোতধারা হয়ে উঠেছিল।
নাসিমা তার কানে কানে মুখ রেখে বলল, তোমাকে আমার এত আপন, এত ছোট মনে হয়। কথা দাও আমাকে তুমি কষ্ট দেবে না?
বেবি কিছুটা বিস্মিত হলো কিন্তু মুখে বলল না কিছু।
তখন নাসিমা বলল, আমি তোমার মা হতে চাই, বেবি। আমি তোমার মা।
বলতে বলতে উদ্বেগ যেন স্বেদ বিন্দুতে রূপান্তরিত হয়ে কাঁপতে লাগল নাসিমার কানের পিঠে, আর চিবুকে, আর কপালের ওপরে। বেবি তখন সমস্ত শরীরটাকে শিথিল করে দিল। কিছু বলল না। নাসিমা তাকে বুকের ভেতরে টেনে অসংলগ্ন কণ্ঠে উচ্চারণ করল, এখানে, এখানে।
তারপর মাতাল–প্রায় কণ্ঠে বারবার
—-বেবি, বেবি, বেবি। তুমি আমার, বেবি।
যেন নিজের ওপরে আর কোনো কর্তৃত্ত্ব নেই বেবির। আঙ্গুলের ডগা দিয়ে সবকিছু একটা শীতলধারা হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। তার মনে হলো পৃথিবীর বাইরে সে চলে গেছে। কোনো কিছু দিয়েই আর সে এই অবস্থার পরিমাপ করতে পারবে না। বদলে, নাসিমা একটা প্রখর শক্তির জন্ম অনুভব করতে পারে নিজের ভেতরে।
.
বিছানার ওপর নিজেকে এলিয়ে দিয়ে পরম একটু স্বস্তি অনুভব করল নাসিমা আখতার। জীবন নয়, মৃত্যু নয়, ক্ষতি নয়—- কিছুই আর নয়। শুধু পূর্ণতা। এই পূর্ণতা কিসের বা কেন তা তার নিজের কাছেই ঠিক বোধগম্য নয়। স্পষ্ট যা তা শুধু তার এই বিশেষ অনুভূতি।
এই পূর্ণতা আমি কতকাল প্রার্থনা করেছি আমার স্বপ্নে আমার জাগরণে কিন্তু কেবলি আঘাত।
মতির মা এসে বলল, অন্ধকারে শুয়ে আছেন, আপামণি, বাতি দেব?
দে।
বাতি জ্বলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে কেউ যেন তাকে কঠিন একটা দৈহিক আঘাত করলো। মুখটা মুহূর্তের জন্যে বিকৃত হয়ে এলো; পরে বলল, কী বলবি বল?
খাবেন না?
খাবার কথা আজ মনেই নেই তার। এমনকি মতির মা মনে করিয়ে দেয়া সত্ত্বেও সামান্যতম তাগিদও সে অনুভব করতে পারল না।
দৃষ্টি তার নিবন্ধ ছিল ঘরের কোণে রাখা টিপয়ের ওপর একটা উজ্জ্বল পদার্থের দিকে। উঠে বসে শুধালো নাসিমা, ওটা কী?
কোনটা?
কাছে গিয়ে নাসিমার নিজেরই হাসি পেল খুব। জার্মান কাঁচিটা ওখানে পড়ে আছে। আরজু যেভাবে মেয়েকে সাজাতে শুরু করেছে তাতে করে সেলাই কল না কিনে উপায় কী? কিন্তু মেয়েটা এখনো গোছালো হলো না; আগের মতই এলোমেলো। কাঁচিটা কি তুলে রাখতে হয় না?
অন্য কোনদিন হলে নাসিমা ভয় পেত ভীষণ রকমে ওই রূপোলি তীক্ষ্ণতা দেখে। আজ সে শুধু হাত দিয়ে কাঁচিটাকে আলোর সরলরেখা থেকে সরিয়ে রাখলো। পরে মুখ ফিরিয়ে বলল, কই, খেতে দিবি নে?
যেন অপরাধটা মতির মার–ই। কিন্তু মতির মা আজ আটদিন হলো দেখে আসছে নাসিমাকে; তাই এতে সে বিস্মিতও হয় না, বিরক্তও হয় না। শুধু বলে, না বললে দিই কী করে? ভালো কথা আপামণি, সন্ধ্যেয় আপনার জন্যে ফুল তুলে রেখেছি।
কথাটা শেষ করে মুখ টিপে হাসে। মুখটা তার চিকচিক করে ওঠে কৌতুকের তরঙ্গে। নাসিমা যেতে যেতে বলে, তরল কণ্ঠে, তুই মর মতির মা।
.
আজ সে তার শরীরে নতুন করে রক্তপ্রবাহ অনুভব করতে আসছে যেন। আর পৃথিবীর যেখানে যত সংকেত আছে সব কিছু যেন বোধগম্য হয়ে এসেছে। এত নির্ভরযোগ্য মনে। হচ্ছে তার নিজেকে যে, নাসিমা আপন মনে হেসে ফেলল, কেউ যদি আজ তাকে বলত গান গাইতে তাহলে সে অনুরোধ রাখত।
আজ খুব করে খেল নাসিমা। খেয়ে একটা দম আটকানো ক্লান্তি অনুভব করলো। তারপর জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
রাত অনেক হয়েছে। পথের বাতিগুলো তাই এত উজ্জ্বল। রাস্তার এখানে ওখানে চকচক করছে অ্যাশফট। আর কুকুর। আর একটা ঝড়ের মত মোটর কার।
নাসিমা এসে বসলো আরজুর আয়নার সমুখে।
তুমি আমার সন্তান। তোমাকে কেন্দ্র করে আমি বেঁচে থাকতে চাই অবিশ্বাসের এই পৃথিবীতে।
আয়নার সমুখে বসনেও প্রতিফলনের দিকে দৃষ্টি নেই তার। শুধু শুধু বসা। হঠাৎ বরফ হয়ে গেল যেন সব কিছু।
আজ কি বেস্পতিবারের রাত? নইলে ওই ভিখিবিটা কেন এমনি করে নিশুতি রাতে কান্না করে যাবে পথের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত অবধি? গত বেস্পতিবার রাতে, প্রথম যে দিন এসেছিল, অমনি হয়েছিল। এত করুণ, নিষ্ঠুর আর হিম করা তার আর্তনাদ। মতির মা বলেছিল, রোজ বেস্পতিবার রাতে আসে আপামণি।
আজও এসেছে। একটা অর্ধবৃত্তের মত পথ ধরে তার আর্তনাদ শোনালো নাসিমার শ্রুতিতে। নাসিমার মনটা চিৎকার হয়ে উঠতে চায়, হয় সে মরে যাক আর নইলে নিজে সে বধির হয়ে যাক।
হ্যয় কই আল্লাহ্ কা পেয়ারা, নবী কা দুলারা আন্ধা কো দো মুঠি খানা দে–এ–এ।
নাসিমা স্তব্ধ হয়ে অপেক্ষা করতে থাকে কখন সে ডাক মিলিয়ে যাবে দূরে। এক সময়ে চলে গেল। কিন্তু নিজেকে আর যেন ফিরে পেল না নাসিমা।
অতলে, আরো অতলে।
কম্পিত দুহাতে আয়নার পর্দাটা সে টেনে দিল তার প্রতিফলনের ওপরে।
.
দরোজার ওপরে দাঁড়িয়ে মুখ নিচু করে আবছা গলায় পারুল বলল, তাহলে তুমি সত্যি চলে যাচ্ছো।
নাসিমা তার খাটের ওপর সুটকেশ তুলে বই কাপড় গোছাচ্ছিল এতক্ষণ ধরে। কখন যে পারুল এসে দাঁড়িয়েছে সে বুঝতে পারে নি। তার কণ্ঠস্বরে মুখ ফিরিয়ে তাকাল।
পারুলের মুখটা কেমন ছায়া ছায়া হয়ে আছে।
এত কিশোরী তার মুখ যে দেখলে মমতা হয়। এখন সেই মুখ মেঘ ছায়া নিয়েছে। অস্পষ্ট হয়ে এসেছে মুখের রেখাগুলো। পারুল কি কেঁদে এসেছে কোনো নির্জন কোণ থেকে? নাসিমা এক মুহূর্ত তাকিয়ে দেখে দ্রুত মুখ ফিরিয়ে নিল। ব্যস্ত হলো তার গোছানোর কাজে। পারুল যদি কাঁদতে চায় তাহলে তাকে কাঁদতে দেয়া ভালো। নাসিমা উত্তর করল, সত্যি করে বলার কী আছে? হা যাচ্ছি।
কিন্তু সহজ হতে পারল না নাসিমা। বিদ্ধ হয়ে রইলো পারুলের এই নীরবে দাঁড়িয়ে থাকা। পারুল, তুমি চলে যাও।
যে দ্রুততা ছিল তার দুহাতে এখন তা শিথিল হয়ে আসতে লাগল। এক সময়ে সে তাকিয়ে দেখল তার দুহাত স্তব্ধ হয়ে গেছে অনেক আগেই। আস্তে আস্তে সমুখের দিকে দৃষ্টি করল নাসিমা।
এই বিন্দু থেকে কামরার তিনটে কোণ চোখে পড়ে। এইতো তার নিজের খাট। সুন্দর করে চাদর বিছানো ছিল—-নিভাঁজ, সাদা, কোমল—- আজ সকাল অবধি। এখন তা ভাঁজ করে তুলে ফেলা হয়েছে। বোর্ডিংয়ের দেয়া পাতলা কাঠ–কাঠ তোষক বিশ্রী একটা শূন্যতার প্রতীক হয়ে পড়ে আছে বদলে।
আর ওই কোণে পারুলের বিছানাটা এখনো পাতা। সুন্দর করে পাতা। পারুল রঙিন চাদর পছন্দ করে। আজ দুপুরে যখন কামরা কেউ ছিল না তখন চুপি চুপি সে পারুলের বিছানাটা শেষবারের মত নিজ হাতে পেতে রেখেছে।
সারাটা কামরায় ছিলাম আমরা দুজন। আজ থেকে আমি থাকব না। শুধু পারুল থাকবে। তারপর হয়ত, হয়ত কেন নিশ্চয়ই, অন্য কেউ আসবে। নাসিমার মনে একটা বেদনার দল মেলে উঠতে চাইল। সেও কি তার নিজের মত করে ভালোবাসবে পারুলকে? তার পারুল? চকিতে ঘুরে তাকাল নাসিমা।
পারুল তেমনি স্থির দাঁড়িয়ে আছে। দরোজার ফ্রেমে বাঁধানো একটা ছবির মত স্তব্ধ তার শরীর। পারুলের কষ্ট হচ্ছে।
কষ্ট হলো নাসিমার।
চোখে চোখ পড়তে পারুল দৃষ্টি নাবিয়ে নিল।
তখন নাসিমা এগিয়ে এসে ওর কাঁধে হাত রাখলো, থরথর করে কেঁপে উঠলো পারুলের দেহ। নাসিমা কিছু বলল না। স্পর্শের তরঙ্গে তরঙ্গে শক্তি প্রবাহিত করে দিতে চাইল পারুলের আত্মায়। কিন্তু শক্তি নয়, প্রবাহিত হলো বেদনা। পারুলের চোখ থেকে মুক্তো পড়ল ঝরঝর করে।
নাসিমা বলল, তুই কাঁদছিস কেন? আমি কি চিরকাল থাকব? আর আমি থাকলে কষ্ট যে তোর। তোর কষ্ট আমি কী করে দেখব, পারুল? আমি–নাসিমার স্বর তার নিজের কানেই শোনালো রুক্ষ, কর্কশ সেটাকে চাপা দেয়ার জন্যেই কথা বন্ধ করলো নাসিমা।
.
পারুল আর পারলো না। কান্নায় বিকৃত কণ্ঠে উচ্চারণ করল, আমি কী করব? আমি এখানে থাকতে পারব না। আমাকে তুমি নিয়ে যাও।
পাগল। আমার জন্য তুই মরবি কেন? আর আমি চলে গেলেই নাসিমা হাসতে চেষ্টা করল এখানে কেউ কিছু বলবে না। মানুষের নীচতাকে আমি ভয় পাই, পারুল। শক্তি নেই, নইলে লড়তাম। তাই পালিয়ে যাচ্ছি।
আমারো শক্তি নেই নাসিমা আপা।
আছে।
দৃঢ়কণ্ঠে এই উত্তরটা নাসিমা বিশেষ করে উচ্চারণ করল।
—-আছে, থাকবে না কেন? সবাই কি আমার মতো?
পারুলের জন্যে আমার মমতা হচ্ছে। কিন্তু আমি কী করব?
আমি চলে গেলে তোর খুব কষ্ট হবে জানি, কিন্তু আমার উপায় নেই। পারুল, শোন—-
পারুল আঁচলে মুখ ঢেকে বলল, তুমি কী নিষ্ঠুর নাসিমা আপা।
নাসিমা তখন চুপ করে ভাবতে লাগল পারুলের মুখ, যা সে গতরাতেও চুমোয় চুমোয় নিবিড় করে তুলেছিল।
নাসিমার সমস্ত শরীর জ্বালা করতে লাগল। পুড়ে পুড়ে যেতে লাগল একেকটা স্নায়ু। পারুলকে একেলা ফেলে বাথরুমে এলো নাসিমা। এসে গায়ে পানি ঢালতে লাগল টাব থেকে।
পারুল বোধ হয় কাঁদছে। আমি যে মরে গেছি, একথা পারুল বুঝবে কী করে? এখন দূর থেকে শুধু ওর দুঃখটা বুঝতে পারি, কাছে গিয়ে সান্ত্বনা দেয়ার শক্তি আর আমার নেই।
.
কলকাতা থেকে চলে এসে নাসিমা নতুন করে একটা মুক্তির সন্ধান পেয়েছিল পারুলের সান্নিধ্যে। স্কুলের সবচেয়ে তরুণী শিক্ষয়িত্রী পারুল—- যে স্কুলে পড়াতে এসেছিল নাসিমা। প্রথমদিন ওর মুখ দেখে নাসিমার মনে হয়েছিল পারুল বড় অবলম্বনহীন। কিন্তু কত আপন, কত চেনা। একেকটা মুখ এমনি মিলে যায় পথ চলতে চলতে যাকে খুব চেনা লাগে—-মনের কোনো একটা অস্পষ্ট মুখের সঙ্গে আশ্চর্য রকমে মিলে যায়। নাসিমা বেঁচে গিয়েছিল পারুলকে পেয়ে। বোর্ডিং হাউসে নিজের কামরায় নিয়ে এসেছে ওকে কদিন পরেই। প্রথমে একটা ভয় ছিল পারুলের দিক থেকে, কিন্তু পরে দেখা গেছে, পারুলও যেন কতকাল ধরে প্রতীক্ষা করছিল নাসিমার জন্যে। পারুল বলেছিল, আমার মনে হয় তুমি না এলে আমি মরে যেতাম।
নাসিমা তখন বলতে পারেনি—-পারুল, তোমাকে না পেলে মরে যেতাম আমিও।
কী পেলাম বা কী পেলাম না—- এ প্রশ্ন পারুল আর তার ভেতরে জাগবে না কোনদিন। শুধু আত্মার সান্নিধ্য। শুধু উত্তাপ।
প্রবীর, আনিস, লাবু চা বাগানের সেই পশু–ওদের আঘাত করবার হাতিয়ার থেকে কত মুক্ত নাসিমার এই নতুন জীবন। ঘৃণায় অবিশ্বাসে যার মন ভরে উঠেছে তার মুক্তি কি আছে এমনি করে?
কোনো কোনো রাতে পারুল উঠে আসতে তার বিছানায়। তার উত্তাপে স্পন্দিত হয়ে উঠতে সে। পশুর উত্তাপ নয়; কোমল, শুদ্ধ, পরিচ্ছন্ন একটা অনুভূতি। পারুল এতটুকু হয়ে আছে তার বুকের ভেতরে। এইসব মুহূর্তে চিরদিনের মত মরে যেতে পারত নাসিমা।
.
গোসল সেরেও জ্বালাটা কমলো না। ফিরে এসে দেখল পারুল ঘরে নেই। থাকবে বলে মনে মনে আশা করেছিল নাসিমা।
এখানকার সবাই তার বিরুদ্ধে চলে গেছে পারুলকে কেন্দ্র করে। কাদা ছড়িয়েছে। ছি–ছি ছি। না, ও কথা আর মনে করবে না নাসিমা। নিজে রেজিগনেশন দিয়ে চলে যাচ্ছে—-এর বেশি তার কিছু করার ছিল না। একেক সময় মানুষের উদ্যত জুতোর মুখে নিজেকে এত অসহায় মনে হয়। স্কুলের সেক্রেটারী খুশি হয়েছেন একটা ক্ষত সারানোর গৌরবে। রেজিগনেশন লেটার হাতে নিয়ে তার মুখ দেখার মত হয়ে ছিল। অতি দুঃখে, ঘৃণায় হাসি। পেয়েছিল নাসিমার।
পারুল জানে, আমি বিনষ্ট কোনো বাসনার হাতে নিজেকে তুলে দিইনি। আমি কিছুতেই বোঝাতে পারব না, কাউকে না। আমার যে কত বড় আনন্দ এনে দিয়েছিল পারুল পারুলও জানবে না। তার জন্যে আমার দৃঢ় মুখটাই চিরকালের জন্য সত্যি হয়ে থাকবে। যাবার আগে নাসিমা কাছে ডেকে নিল পারুলকে। বলল, তোকে মমতা দিয়ে কবর দিলাম। আমি যাই।
পারুল উত্তরে কিছু বলল না। তখন নাসিমা কণ্ঠস্বর আরো নামিয়ে প্রায় ফিসফিস কণ্ঠে উচ্চারণ করল, নিজেকে কোনদিন মরে যেতে দিস না, পারুল।
আর কিছু বলল না নাসিমা। দ্রুত মুখ ফিরিয়ে বাইরে দাঁড়ানো রিকশায় গিয়ে উঠে বসলো। সঙ্গে সঙ্গে দুচোখের সমুখে বিছিয়ে থাকা কাঁচা রাস্তাটাকে তার মনে হলো কত দীর্ঘ। এক বছর ধরে চেনা এখানকার দুপাশে বাসা বাড়ি গাছ মনে হলো কত অপরিচিত।
.
সারারাত খুব বাতাস বইছে। সেই বাতাসের হাহাকার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল নাসিমার। পৃথিবীতে আজ এত হাহাকার কেন? কান পাতলে যেন একটা উত্তর শোনা যাবে দূর পৃথিবীর অন্তস্থল থেকে।
নাসিমা উঠে পানি খেয়ে এসে শুয়ে পড়লো আবার। বালিশটাকে আঁকড়ে ধরলো শিশুর মতো। আরজুর এই শোবার ঘর যেন আস্তে আস্তে বাতাসের ধাক্কায় বিশাল থেকে বিশালতর। হয়ে আসছে। প্রতি মুহূর্তে প্রসারিত হচ্ছে তাকে আরো ক্ষুদ্র করে দিয়ে। বেবির মুখ অনেকক্ষণ ধরে ভাবতে চেষ্টা করলো নাসিমা। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারলো না। এমন কি মুখের সামান্য একটা ভঁজ কিংবা একটা কোণও তার মনে পড়ল না। আমি কিছুতেই মনে করতে পারছি না। অথচ আজ শিশুরাত্রিতে তার মুখ আমি দুহাত ভরে তুলে নিয়েছিলাম।
নাসিমার মনে হলো সে একটা ভাসমান পাটাতনের ওপর শুয়ে আছে। দুলছে। ফুলে ফুলে উঠছে।
বেবির মুখ মনে করবার চেষ্টাটাও এক সময়ে হারিয়ে গেল। শুধু একটা শূন্যতা। আর বাতাসের ভয়। আর আরজুর কামরার বিশালতা। নাসিমা বালিশটাকে আরো আপন করে আঁকড়ে ধরলো সারাটা শরীর গুটিয়ে এনে এতটুকু একমুঠো করে।
.
আনিস বলেছিল তোমার মুখ আকাশের মতো। কৈশোরের সেই রক্তিম বয়সটা থেকে শুরু করে তেইশ বছর বয়স অবধি তাকে পূর্ণ করে রেখেছিল আনিস। আনিসকে তার আত্মার চেয়েও গভীর করে ভালোবেসেছিল নাসিমা। পৃথিবীকে আমার অযুত কৃতজ্ঞতা, আমার আর কোনো প্রার্থনা নেই। আমার মৃত্যুর মুহূর্তেও যেন দুচোখ ভরে উজ্জ্বল হয়ে থাকে আনিসের মুখ।
কিন্তু সাপ–সাপকে কি কেউ মনে রাখে?
আনিসের অস্তিত্ব একটা সাপের মত পিচ্ছিল, কৃঢ় সত্তায় রুপান্তরিত হয়ে গেছে এক সময়ে। তোমাকে আমার অদেয় ছিল না কিছু। তুমি আর কী চেয়েছিলে আমার কাছে?
এসব প্রশ্নের উত্তর সে কোনদিন পাবে না।
শুধু একদিন সে তাকিয়ে দেখেছে—-আনিস দূরে সরে যাচ্ছে। আনিস খুঁজে নিচ্ছে তার নতুন বন্দর।
হামেদ তার চুলে হাত বুলোতে বুলোতে বলেছে, সিমু, তোর কী হয়েছে বলতো? কিছু না, কিছু না।
কিন্তু কণ্ঠস্বর ছিল তার বাষ্পে আকুল।
মনে আছে, হামেদ তখন তাকে খুশি করে তুলবার জন্যে কী–ই না করেছে। হামেদ তো। জানতো না, আমার এ দুঃখ অন্তরে বাহিরে এমন কিছু নেই ভুলিয়ে দেয়। হামেদ তাকে সারাক্ষণ নিয়ে বেরিয়েছে সিনেমায়, রেস্তোরাঁয়, জিনিস কিনে দিয়েছে রাশ রাশ। বলেছে, তোর যা খুশি বল——– আমি আছি কী করতে? আমি এনে দিচ্ছি। একেক সময় নাসিমারও বিশ্বাস করতে লোভ হতো এমনি করে হয়ত সে পেয়ে যাবে একদিন সব ভোলানো এক বিস্মৃতি। মগ্ন হয়ে থাকতো, থাকতে চেষ্টা করতো। কিন্তু কিছুতেই যে আর কিছু হবে না, একেকটা মনের মনে রাখবার ক্ষমতা যে এমনি অসাধারণ, এটা সে উপলব্ধি করতে পেরেছিল আরো অনেক পরে।
কিন্তু তখন একেকদিন খুব করে সজ্জা করে, নতুন কেনা উজ্জ্বল শাড়িটা পরে, বাইরের চলমান স্রোতে নিজেকে প্রবাহিত করে দিয়ে ভাবতো এই আমি বেরিয়ে আসতে পারছি স্মৃতির থাবা থেকে। হয়ত তা সফলও হতো কিছুক্ষণের জন্যে, কী একটা দিনমানের জন্যে, কিন্তু যখন হঠাৎ ভেঙ্গে পড়ত তখন দিনের পর দিন চোখ তুলে কারো দিকে তাকাবার শক্তিটুকু অবধি থাকতো না। নিজেকে তখন চরম একটা অবহেলা আর অযত্নের হাতে ছেড়ে দিয়ে নাসিমা শিক্ষিত করত নিজেকেই। এতটুকু কষ্ট তার সইতে পারেনি কেউ কোনদিন। হামেদও না। বার থেকে যতটুকু বোঝা যায় তার কষ্টের রূপ দেখে হামেদ ব্যথিত হতো, কিন্তু কিছুই করতে পারত না।
হামেদের আকুলতা দেখে নিজের ওপরেই আক্রোশ হতো নাসিমার। কেন আমি হামেদকে বিচলিত করে তুলছি তার মমতামূল অবধি?
একদিন সকালে উঠে সে প্রাণভরে নাইলো। নেয়ে আসবার পর নাশতার টেবিলে বসে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল, আবার সে পড়বে। এম. এ. দেবে—- সেটা এতদিন শুধু উৎসাহের অভাবে পড়ে ছিলো। হামেদ বলল, বেশ তো।
হামেদের স্বস্তি–সুন্দর মুখখানা তখন কী যে ভালো লেগেছিল নাসিমার।
—-পরীক্ষা দিবি এতো ভালো কথা। আমিও এদ্দিন তাই ভাবছিলাম। চল আজকেই, রি অ্যাডমিশন করিয়ে নি, কী বলিস?
চলো আজকেই। আর কিছু বইও কিনতে হবে। আর আমাকে, ভাইয়া, পড়বার জন্যে, হালকা একটা চেয়ার কিনে দেবে কেমন?
এত স্বচ্ছ সহজ কণ্ঠে সে কথা বলতে পারছিল তখন যে তার নিজের কানেই মনে হচ্ছিল অন্য কারো সুন্দর স্বর সে শুনতে পাচ্ছে।
হামেদের তখুনি হুকুম হলো বারান্দার কোণ খালি করে দেয়ার জন্যে। ওখানে সকালের রোদে, ঘরে যদি ভালো না লাগে, নাসিমা পড়তে পারবে। আর স্ত্রীকে বলল বাক্স থেকে একটা পর্দা এনে কোণটাকে আড়াল করে দিতে।
সন্ধ্যের ভেতরেই হামেদ এত নিপুণ হাতে সব আয়োজন করে দিল যে, নাসিমার মন ভীষণ রকমে প্রসন্ন হয়ে উঠলো। অনেক রাত অবধি পড়লো সে সেদিন।
সেই মাসগুলোতে সুখ কিংবা দুঃখ কিছুই আর সে যেন অনুভব করতে পারত না। এমনি করে পরীক্ষা দেয়া অবধি। নিজেকে সে একটা কোনো বৃত্তিতে নিযুক্ত রাখতে পেরেছে এটাকে তখন অবধি মুক্তি বলে মনে করলেও পরীক্ষা শেষ হয়ে যাওয়ার পর আর তা রইলো না।
আবার নিঃসঙ্গতা। আবার বরফের কুচিতে যৈন সে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে আছে এমনি প্রাণহীন শীত। দূর থেকে কতদিন আনিসকে দেখেছে কিন্তু মুখ ফেরায়নি। আনিসের জন্যে কষ্ট পাবে কিন্তু আনিসের কাছে আর সে ফিরে যাবে না।
.
এই কষ্ট পাওয়ার নেশা বিস্তৃত হয়ে ছিল বিয়ের পর অবধিও। বরং আরো নিবিড় করে অনেকদিন মনে পড়েছে সেই মানুষটাকে যে তার আত্মাকে চিরকালের মত নিঃসঙ্গ করে গেছে।
আর লাবু চা বাগানের সেই মানুষটার নাম কী ছিল? আশ্চর্য তার নামও আনিস। শুধু উপাধিটা আলাদা।
নাসিমা প্রথম দিনই নাম শুনে চমকে উঠেছিল। কিন্তু বুঝতে দেয়নি হামেদকে। মনে মনে তার ভাবনা এসেছে, যেন এক নামের দুটো মানুষ—-একটা সাধারণ বিন্দু থেকে পরস্পরের বিপরীতে তীরের মত দুটি রেখা ছুটে গেছে। তাদের গতিতে, দৈর্ঘে, বর্ণে কোনো মিল নেই। অস্পষ্ট একটা সহানুভূতি কিংবা সঠিক করে বললে কৌতূহল হয়ত গড়ে উঠেছিল এই নতুন আনিসের জন্যে।
লাবু চা বাগানের ম্যানেজার আনিসের বাংলো আলো করে আমি এসেছিলাম। কিন্তু সে আলো নিভিয়ে দিয়েছে আনিস নিজে।
.
বাংলার দুকামরার মাঝখানে উঁচু টুলের ওপর জ্বলছিল পেট্রোম্যাক্স।
শরীরটা ছায়ায় আবৃত হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠেছিল নাসিমা। ম্লানগতি চলচ্চিত্রের মত শিথিল ভাসতে ভাসতে ছায়াটা তাকে জড়িয়ে ধরছে, শ্বাপদের আলিঙ্গন যেন।
নাসিমা জানে কে এলো। এমনি ছায়া আজ কয়েক মাস ধরে তার শরীরে পড়েছে। তাই প্রথমে চমকে উঠলেও মুখ ফেরাল অনেকক্ষণ পরে, আস্তে আস্তে।
মুখ ফিরিয়ে দেখল—- আনিস। খাকি ট্রাউজার এখনো পরনে, সেটা পরে সারাদিন চা বাগান ঘুরে এসেছে। কেবল উধ্বাঙ্গ উন্মুক্ত। হাতে হুউস্কির গ্লাস প্রায় আদ্ধেকটা এখনো ছলছল করছে গলিত সোনার মত।
আনিস কোনো কথা বলল না। তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ। নাসিমার মনে হলো একটা পাহাড় তার পেছনে বিপজ্জনক রকমে বেড়ে উঠছে প্রতি মুহূর্তে। কেন কোনো কথা বলছে না আনিস?
কথা নয় পানীয় পানের শব্দ পেল নাসিমা।
গ্লাসটাকে টুলের ওপর রাখতে রাখতে আনিস বলল, আমি জানি তুমি কার কথা ভাবছ।
নাসিমা যেন জানত আনিস এ কথা বলবে তাই স্তব্ধ হলো না তার রক্তপ্রবাহ। এমন কি যখন হঠাৎ আনিস চিৎকার করে উঠল, তখনও না। আনিসের বীভৎস দ্রুত কণ্ঠস্বরে বাংলোর দেয়ালে দেয়ালে করাঘাত বেজে উঠল যেন।
আমি চাই না আমার সমুখে কেউ থাকবে। বুঝেছ? ইউ আন্ডারস্ট্যাণ্ড?—-নো মেমোরি নাথিং—-আই হ্যাড এনাফ অফ দোজ।
নাসিমা কিছু না বলে উঠে দাঁড়াল। চলে গেল পাশের কামরায়। স্মরণ কি পাপ? ভাগ্যের পরিহাস, দুজনেরই এক নাম।
চলে যেতে যেতে নাসিমা শুনতে পেল আনিস তার চেয়ারটাকে লাথি মেরে সরিয়ে দিল। তারপর আর কিছু না। অন্ধকার কামরায় গিয়ে শরীরটাকে বিছানায় এলিয়ে দিল নাসিমা। শুধু শরীর নয়, মনের দিক থেকেও এত ক্লান্ত লাগছে তার যে সামান্যতম প্রতিবাদেরও কোনো স্পৃহা নেই তার।
আনিস হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেল দেখে একবার মনে হলো উঠে গিয়ে দেখে আসে কী হলো লোকটার?—-যেন চিৎকার করে সব কিছু ছিটিয়ে ছড়িয়ে ফেললেই সে নিশ্চিত হতে পারত। তারপর বালিশে মুখ লুকিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল সে এক সময়ে। আস্তে আস্তে মন থেকে কান্নার স্পষ্ট কারণটা অপসারিত হয়ে গেল—-শুধু বেঁচে রইলো কান্না।
.
তুমি মদ খাও আনিস, আমি তাতে কোনদিন কিছু মনে করিনি। বরং বিয়ের পর এখানে এসে যেদিন জানলাম, মনে মনে একটা আঘাত পেলেও, বার থেকে আমার হাসিমুখ দেখে তুমি যে প্রীত হয়েছিলে সেটাই ছিল আমার সোনার মত পাওয়া।
আমি তোমাকে অবলম্বন করে পূর্ণ হয়ে উঠতে চেয়েছিলাম।
কিন্তু বিপরীতে আমাকে তুমি বুঝতে চাইলে না। আনিসকে আমি ভুলে যেতে পারিনি, কিন্তু তোমাকে তো ফিরিয়ে দিই নি? সুদূর একটা দ্বীপের মত করে কাউকে মনে রাখা কি পাপ? আনিস আমার জন্যে মরে গেছে। মৃতকে যদি ভুলে গিয়ে না থাকি তার মানে কি এই যে, জীবিতকে আমি অস্বীকার করছি? নিজেকে আমি শ্রদ্ধা করব না? আমার ফেলে আসা আমাকে?
বিয়ের পর নাসিমা মনের সমস্ত কথা খুলে বলেছিল স্বামীকে। নিজেকে নিবিড় আলিঙ্গনে সঁপে দিয়ে বলেছিল, যখন আনিস শুধিয়েছে, তোমার কথা বলো। বলবে?
বলবো।
তারপর প্রথম প্রেমের কথা বলতে গিয়ে, তার নামও ছিল আনিস।
মরে গেছে?
আমার কাছে।
তখন আনিস বুঝতে পারেনি—- আনিস মরে গিয়ে কী চরম শোধ নিয়েছে তার ওপরে। তখন সে বলেছে, আমি তোমার আনিস। যে গেছে সে চলে গেছে।
যে গেছে সে চলে গেছে সত্যি, কিন্তু মনের নিয়ম মানে না কোনো যুক্তির সিঁড়ি। বিষুব রেখা পার হয়ে এলে যেমন উত্তর থেকে এসে থাকি দক্ষিণে—-আর দুচোখে থাকে না তখন উত্তরের আকাশ, তখন শুধু দক্ষিণ, মনের পৃথিবী তো তেমন নয়!
একটা ছবির ওপর আরেকটা ছবি এসে পড়ে, দুটো মিলে নতুন ছবি হ্য। পেছনেরটা মুছে যায় না। পরে পরে আরো ছবি–আরো আকাশ। আঘাতের পর আঘাতে ভেঙ্গে যেতে থাকে প্রেক্ষিত। জ্বলে পুড়ে তখন ছাই হয়ে যেতে থাকে হৃদয় আর আত্মা আর স্মৃতি আর স্নায়ু আর চেতনা যে আগুন আজ জ্বলছে নাসিমার।
সেদিন যদি তার কখনো কখনো এই মনে রাখা মেনে নিতে পারত আনিস, তাহলে কী হতো? তাহলে আমাকে বারবার মরে গিয়ে নতুন জন্মের জন্য অধীর হয়ে উঠতে হতো না। তুমি আমার, সম্পূর্ণ আমার, কমপ্লিটলি, আর কারো কথা আমি জানতে চাই না।
আনিস ঘরে এসে নতুন করে পানীয় ঢালতে ঢালতে বলল—- দেয়ার মাস্ট বি নো ওয়ান। ইউ হিয়ার?
আবার কান্না পেল নাসিমার। সম্পূর্ণ করে সে দিতে চেয়েছে, দিয়েছে নিজেকে। যদি মনে পড়ে থাকে প্রথম প্রেমের কথা, তা কি তুমি সূহ্য করতে পারো না? মনে মনে সে মিনতি করল স্বামীর উদ্দেশে আমাকে তুমি এতটক দাও, তোমাকে আমার কোনো অনীহা স্পর্শ করবে না, আমার মনে কোনো মালিন্য নেই—- এ কথা তুমি বিশ্বাস করো একবার।
আনিস ডুবে যাচ্ছে নেশায়। শেষ পানীয়টুকু তা সম্পূর্ণ করে দিয়ে গেল। তখন যেন উদ্দাম হয়ে উঠলো সে।
দিনের পর দিন দেখে আসছি, তুমি—-তুমি ভুলতে পারছ না।
নাসিমা এত বড় অপবাদ সইতে পারল না। কখনো কখনো সে স্মরণকে ফিরিয়ে এনেছে বৈকি, সেটাই অসহ্য হয়ে দাঁড়াল? বলল, তুমি ভুল করছে।
লায়ার।
সব তোমার ভুল।
ইউ বিচ।
শোনো, আমাকে তুমি ভুল বুঝো না, আমি তোমারই। ছি–ছি লোকে কী ভাববে বল তো? বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেল নাসিমা। আনিসের শেষ কথাটা যেন এতক্ষণে তার কানে গিয়ে পৌঁচেছে। কয়েক মাসের মিনতির পুতুল সে আজ চূর্ণ চূর্ণ করে ভেঙ্গে ফেলে দিল। বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ঋজু গলায় উচ্চারণ করল, আমার ঘর থেকে তুমি বেরিয়ে যাও। যাও বলছি। একশো বার আমি মনে করব, আমার যা খুশি করব, তোমার কী তাতে?
পশু, ছোটলোক। শ্রদ্ধা নেই যার হৃদয়ে তাকে আমার কোনো প্রয়োজন নেই।
আমার হৃদয় তুমি থুতু দিয়ে ভরে তুলেছ। আমি তোমাকে ক্ষমা করব কী করে?
কিন্তু আনিস নড়লো না। তখন নাসিমা নিজে বেরিয়ে এসে পাশের কামরায় খিল তুলে দিল। সারাটা শরীর তার বেতস–লতার মত থরথর করে কাঁপছে। দ্বিতীয় মৃত্যুর অনুভূতি বুঝি এমনি হয়।
অনেকরাত অবধি সেদিন লাবু চা বাগানের ম্যানেজার তার দরোজায় করাঘাত করেছে। শিলাবৃষ্টির মত আর অভিশাপ।
নাসিমা। নাসিমা। নাসি—-মা–আ।
তবু সে দরোজা খোলেনি।
আই উইল কিল দ্যাট সোয়াইন। আই হেট হিম। গিভ মি মাই গান। ইউ কাম আউট, নাসিমা।
তার উঁচু পর্দাটা নেমে এসেছে। থেমে গেছে করাঘাত। তখন বিড়বিড় করে, লেট মি ইন লেট মি ইন—-লেট মি ইন।
ঘুমের মত তার কণ্ঠস্বর যেন আস্তে আস্তে তলিয়ে গেছে। আর সারাক্ষণ নাসিমা অন্ধকারে লড়াই করেছে নিজের সঙ্গে।
এর পরে তাদের আর কোনো কথা হয় নি। পরদিন বিছানা পাশের ঘরে নিয়ে এসেছে নাসিমা।
চারদিন পর। সেদিন দুপুরে ঘুমিয়েছিল তার বিছানায়। সারাটা বাংলো দুপুরের নিশুতি নূপুরে আর বাইরের চোখ ধাঁধানো রোদে নিমগ্ন হয়েছিল।
হঠাৎ কী একটা শব্দে আর নিঃশ্বাসের উষ্ণতায় তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। যেন কেউ তাকে জাগিয়ে দিল অতি সন্তর্পণে। মুখ ফেরানো ছিল জানালার দিকে। চোখ মেলেই পাহাড় আর স্তব্ধ নিবিড় আকাশ। অনুভব করল মনে মনে সেই মানুষটার উপস্থিতি। তুমি কি অনুতপ্ত? আমি আর বহন করতে পারছি না, আমার অভিমান এত বিশাল হয়ে উঠেছে। তুমি একবার ডাকো, ক্ষমা করবার জন্যে আমার মন আকুল হয়ে আছে। ধীরে ধীরে মুখ ফেরালো নাসিমা।
চোখে চোখ পড়তেই যেন বধির হয়ে গেল সে। চিৎকার করে উঠল, না—-না।
আনিসের মুখ অনুতাপে নয়, লালসায় ক্ষুধায় আরক্ত হয়ে উঠেছে। ঠিক তখন সমস্ত শরীর আর মন ঘৃণায়, বিদ্রোহে, বঞ্চনায় বিদীর্ণ হয়ে গেল। একটা বমি উলটে আসতে চাইলো পাকস্থলী থেকে। জট পাকিয়ে কঠিন হয়ে গেল শরীরের প্রতিটি স্নায়ু। এ তুমি কি করলে আমার?
এরপর দুদিন পর পর ফিট হলো নাসিমা। আনিস দৃষ্টি করলেই, মনে হতো কতগুলো কীট যেন শরীর বেয়ে উঠতে চাইছে। গোসলের জন্যে মনটা অধীর হয়ে উঠতো। মিথ্যে, সব মিথ্যে। শরীরটাকে তখন একটা ভার মনে হতো তার যা তাকে চিরকাল বইতে হবে।
কাদার আলপনা আর থুতু। কাকে আমি ক্ষমা করতে চেয়েছিলাম? আমি সাজিয়ে নেবো আমার পৃথিবী আমার জন্যে। আমার অহংকার তোক নির্মম।
আসামকে পেছনে ফেলে কলকাতায় এলো নাসিমা।