Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » একুশে পা || Bani Basu » Page 22

একুশে পা || Bani Basu

জ্বলন্ত রোদের মধ্যে

মিঠু রিহার্স্যাল থেকে বাড়ি ফিরছে। একা একা। কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চে তাদের প্রথম কয়েকটা শো হয়ে গেছে। কিন্তু প্রায় প্রতিদিন এখনও মহলায় যেতে হয়। আরও ভালো, আরও নিখুঁত—পার্থপ্রতিমের দাবি এই। সাধনা এই। প্রথম প্রথম সে আর ঋতু একসঙ্গে ফিরত। কিন্তু গত ক’দিনই তাকে একলা ফিরতে হচ্ছে। ঋতু এমন করে যেন সে অবাঞ্ছিত উপস্থিতি একটা। যত তাড়াতাড়ি চলে যায় ততই মঙ্গল। পুরনো কলকাতার পটভূমিতে নাটক ‘কল্লোলিনী উনিশশ’। ঋতু তার কত্থক নাচে পারদর্শিতার জন্যেই সেজেছে বাইজি। নিকি বাইজি। খুব ভালো করছে। মিঠুর ভূমিকাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। সে এক ধনী সম্ভ্রান্ত ঘরের নিঃসন্তান বধূ। একলা। পর্দানশীন। কিন্তু সে নিধুবাবুর, দাশরথি রায়ের, রামপ্রসাদের গান গায়, তার এই গানে, একাকিত্বে তার চরিত্রের রহস্যময়তায় তাদের অভিজাত পরিবারেরই কোনও কোনও পুরুষ মুগ্ধ। একজন উদীয়মান কবির কাছে সে মূর্তিমতী প্রেরণা। ইতিহাস এবং কল্পনাকে খুব সূক্ষ্মভাবে মিশিয়ে নাটকটি তৈরি করেছেন পার্থপ্রতিম। এখানে নায়ক আর কেউ নয়—কলকাতা স্বয়ং। সে ক্রমাগত অর্থহীন ঘুরে বেড়াচ্ছে নিকি বাইজি আর কাদম্বিনীর জগতের মাঝখানে। এক জায়গায় শিল্প পণ্য হয়ে গেছে, রিপু বিকারের দাসত্ব করছে। আরেক জায়গায় শিল্প চিক আর মখমলের পর্দার আড়ালে অসূর্যম্পশ্যা। উচ্ছৃঙ্খল, বেপরোয়া কলকাতা। রক্ষণশীল, অত্যাচারী কুসংস্কারাচ্ছন্ন কলকাতা। এই দুইয়ের টানাপোড়েনে চমৎকার নাটক। ঋতুর কোনও জড়তাই নেই। মিঠুর একটু দেখা গিয়েছিল। কিন্তু পার্থপ্রতিম বলেছেন ওটা তার চরিত্রের সঙ্গে খুব সুন্দর মানিয়ে গেছে। পার্থপ্রতিম নিজে আছেন রামমোহনের ভূমিকায়। পরিচালনাও তাঁরই।

মিঠু বাড়ি ঢুকে মাকে খুঁজতে লাগল। খুব সঙ্কটের সময়ে তার মাকে দরকার হয়। মা ছাতে। পাঁচিলের কাছে গালে হাত দিয়ে মা দাঁড়িয়ে আছে। সন্ধের অন্ধকারে এটুকুই বোঝা যাচ্ছে। মিটু পাশে দাঁড়িয়ে ডাকল, ‘মা!’ চমকে পাশ ফিরলেন অনুরাধা, ‘এসেছিস? আজ তো খুব দেরি হল, ঋতুর সঙ্গে এলি?’

‘না। কেন আমি একা আসতে পারি না?’

—‘তা পারবি না কেন? কিন্তু তুই-ই তো দেখি একলা একলা যাওয়া-আসা করতে পছন্দ করিস না। খাবি এখন কিছু?’

‘উঁহু। বাবা আসুক। একসঙ্গে খাব।’

কিছুক্ষণ পর মিঠু বলল, ‘মা···পার্থপ্রতিম তোমার কি রকম বন্ধু?’

‘কি রকম বন্ধু? মানে? দুজনে আর্ট কলেজে এক সঙ্গে পড়েছি…।’

‘খুব বন্ধু? উনি কি রকম লোক, সত্যি?’ মিঠুর মুখ অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে না।

‘এতদিন পর একথা জিজ্ঞেস করছিস? পার্থপ্রতিম তো তোদের খুব ছোট থেকেই এ বাড়িতে আসছে!’ অনুরাধা অবাক হয়ে বললেন।

মিঠু একদম চুপ করে গেল। বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু তার মুখ কালো হয়ে আছে। সে ভীষণ ক্ষুব্ধ, অশান্ত।

অনুরাধা বললেন, ‘কী হয়েছে রে?’

মিঠু কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘ঋতুর সঙ্গে উনি এমন ভাবে মেশেন যে আমি…আমি মানতে পারি না।’

অনুরাধা কিছু বললেন না। তিনি চাইছেন মিঠু আরেকটু বলুক।

‘মা, আর্টিস্ট বলে কি তাদের কাছে আমাদের প্রাইভেসি থাকবে না? ঋতুর ওসব পেশোয়াজ টাজ, কস্টুম পরা যথেষ্ট অভ্যাস আছে, নাচ ও আজ করছে না, উনি কেন পরাতে আসছেন? মেকাপের লোক উনি?’

অনুরাধা বললেন, ‘আর্টিস্টরা একটু পার্ফেকশন খ্যাপা হয়।’

‘না, তা নয় মা। জানো আজকাল রিহার্স্যালের পর ঋতু কেন আমার সঙ্গে বাড়ি ফেরে না! ওঁর গলফ-গ্রীনের ডেরায় যায়। উনি ঋতুকে মডেল করে ছবি আঁকছেন। বেশির ভাগই নাচের ছবি। কিন্তু নুডও আছে।’ অন্ধকারে মিঠু মুখ বিকৃত করল বিতৃষ্ণায়, ‘ও কী মডেল যে…’

অনুরাধা বললেন, ‘ও যদি রাজি হয়ে থাকে তো—’

‘মা অত লাইটলি নিও না ব্যাপারটা। ও বাড়িতে বলে রেখেছে রাত্তিরে না ফিরলে বুঝতে হবে আমাদের বাড়ি থেকে গেছে। অর্ধেক দিনই ও বাড়ি ফিরছে না।’

অনুরাধার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে। মিঠু বলল— ‘সবার সামনেই ঋতু ওঁর সঙ্গে যা করে না, আমার তো কষে থাপ্পড় মারতে ইচ্ছে করে। উনিও তো প্রশ্রয় দেন। ছিঃ।’…এখন আমি কী করব মা?’

‘কি বিষয়ে?’

‘নাটকটা। নাটকটা করতে আমার খুব ভালো লাগছে। কিন্তু ওই ব্যাপারটা…আমার ঘেন্না করছে।’

‘কটা শো আছে?’

‘চার পাঁচটা এ দফায়।’

‘এগুলো করে নে। তারপর আর যাস না।’

মিঠুর চোখ ছলছল করছে। সে ঢোঁক গিলছে। অভিনয়ে তার নেশা লেগে গেছে এখন। একটু পরে সে বলল, ‘মাসিদের, মানে ঋতুর মা বাবাকে আমি কী বলব!’

‘কেন? তোর সামনেই কি তোর বাড়ি থাকার কথা বলেছে?’

‘একদম প্রথম দিনেই বলল তো। তখন তো আমি জানি না ও এ রকম করবে। এখন তো আমিও ওর সঙ্গে মিথ্যের জালে জড়িয়ে পড়ছি।’

একটু ভেবে অনুরাধা বললেন, ‘ঠিক আছে। আমি ভেবে দেখছি কী করতে পারি। তুই যা, জামা-কাপড় পাল্টে নে। হাত-মুখ পর্যন্ত ধুসনি মনে হচ্ছে!’

মিঠু আস্তে আস্তে নিচে নেমে গেল। খাবার সময়ে দেখল মা ভীষণ গম্ভীর, অন্যমনস্ক। বাবা এক সময়ে বলল, ‘কী ব্যাপার রাধা? আজ যেন তোমায় কেমন দেখাচ্ছে!’

‘এমনি, শরীরটা ভালো লাগছে না।’

বাবা উদ্বিগ্ন মুখে তাকাল। মা বলল, ‘তেমন কিছু না। ঠিক হয়ে যাবে।’ মিঠু মনে মনে ভাবল কথাগুলো সে মাকে না বললেও পারত। সে শিগগিরই অনার্স গ্র্যাজুয়েট হয়ে যাবে। ক্ল্যাসিক গল্প, উপন্যাস, নাটকের মেয়েদের থেকে সে বয়সে বড়। মাকে না ভাবিয়ে এই সমস্যাটার সমাধান সে করতে পারত না! একটু ভাবতে হত। সাহসের দরকার হত। আসলে ছোটবেলায় কিছু হলেই যেমন সে মায়ের কাছে ছুটে যেত, এখনও তাই-ই যাচ্ছে। মা তার খুব বন্ধু সন্দেহ নেই। কিন্তু মা অনেক সময়েই তাকে নিজস্ব বুদ্ধিতে চলার ইঙ্গিত দিয়ে থাকে। ঠিকই করে।

পরদিন সকাল এগারোটা নাগাদ সে ঋতুকে ফোন করল। ভেঙ্কটের বাড়ি থেকে গৌতম ফোন করেছিল ওদের গেট টুগেদারটা হচ্ছে না। ভেঙ্কটের টাইফয়েড। খবরটা সে ঋতুকে রিহার্স্যালে দেয়নি। সুতরাং এই একটা অজুহাত আছে।

‘ঋতু আছে?’

‘কে বলছ?’

‘আমি মিঠু।’

‘মিঠু? সে কী? ঋতু তো তোমাদের বাড়িতেই!’

‘এখনও ফেরেনি?’ খুব শান্ত গলায় মিঠু বলল। যদিও তার কান ভীষণ গরম, ‘একটা দরকার ছিল।’ সে ফোন রেখে দিল। ঋতুটা ভেবেছে কী? এগারোটা বেজে গেল। এখনও বেপাত্তা।

সাড়ে বারোটার পর ঋতু ফোন করল।

‘আমি ঋতু বলছি। মিঠু তোর ব্যাপার কী? ফট করে বাড়িতে ফোন করে আমায় চেয়েছিস। জেরায় জেরায় অস্থির হয়ে যাচ্ছি। আমি তো এসেই বলেছি মিঠুদের বাড়ি থেকে খেয়ে এসেছি।’

মিঠু শুনল কিছুক্ষণ। ঋতু খুব উত্তেজিত, বোঝাই যাচ্ছে। সে গম্ভীর ভাবে বলল, ‘দরকার ছিল। ভেঙ্কটের বাড়ির পার্টিটা ওই দিন হচ্ছে না। ওর টাইফয়েড।’

‘লেট ভেঙ্কট গো টু হেল। বাজে ব্যাপার সব। তুই কেন এই নিয়ে ফোন করতে গেলি?’

‘আমাদের বন্ধুদের একজনের সিরিয়াস অসুখ, এটাকে বাজে মনে করিনি প্রথম কথা, দ্বিতীয় কথা, তুমি তো আমার বাড়ি ছিলেও না, খেয়েও যাওনি, খাবার কথাও ছিল না।’

‘হোয়াট ডু ইউ মীন?’

‘ওনলি দিস যে তুমি সারা রাত্তির বাইরে কাটিয়ে দুপুরে বারোটায় বাড়ি ফিরবে আর আমি তোমার অ্যালিবাই খাড়া করব বসে বসে— এমন কোনও বোঝাপড়া আমাদের মধ্যে হয়নি। খোলাখুলি কথাটা হলে তখনই আমার আপত্তি জানিয়ে দিতাম। লজ্জা হওয়া উচিত তোমার।’

‘কী বললি? লজ্জা? লজ্জা হওয়া উচিত? কেন? আই লাভ পার্থপ্রতিম। হী লাভস মী। তোর কি হিংসে হচ্ছে?’

ঋতুর সোজাসুজি স্বীকারোক্তিটা মিঠুর কানের কাছে একটা বোমার মতো ফেটে গিয়েছিল। সে অনেক কষ্টে আত্মসংবরণ করে বলল— ‘হিংসে? কিসের জন্যে?’

‘জানিস না? একটা এ ক্লাস ট্যালেন্টেড লোকের কাছ থেকে মনোযোগ না পেলে হিংসে হয়? নিজের অ্যাক্টিং-এর চেয়ে অন্যের অ্যাক্টিং বেটার হলেও হিংসে হয়। জানতিস না বুঝি? জেনে রাখ’ ঋতুর গলা হিস হিস করছে।

‘তুইও জেনে রাখ’, মিঠু এখন চেঁচাচ্ছে, ‘বাবার বয়সী একটা লোকের কাছ থেকে তোর পদ্ধতিতে মনোযোগ আদায় করার কথা আমি কল্পনাও করতে পারি না। তোকে মনে করিয়ে দিচ্ছি ঋতু। তুই নিকির ভূমিকায় অভিনয় করছিস। অভিনয়। ওটা অভিনয়। আর কত ভালো অভিনয় তুই করছিস সে নিয়ে আমার কোনও মাথাব্যথা নেই। আমি তোদের ওই নোংরা রিহার্স্যাল-রুমে আর যাচ্ছি না, যাচ্ছি না।’

‘অত ঝগড়া করছিস কার সঙ্গে?’ মা পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। ঘুরে দাঁড়িয়ে মিঠু দেখল মায়ের পাশে পার্থপ্রতিম। সে তাঁকে উপেক্ষা করে মায়ের দিকে তাকাল, বলল, ‘ঋতুর সঙ্গে।’ তার পর পার্থপ্রতিমের দিকে ফিরে, মুখের দিকে না চেয়ে বলল, ‘শেষ কথাগুলো নিশ্চয়ই শুনেছ। আমি নাটক করছি না।’

‘সে কী? এখন এই শেষ মুহূর্তে? মিঠু বলছিস কী? অলরেডি তোর কাদম্বিনী খুব সুখ্যাতি পেয়েছে। শোন প্লিজ।’ পার্থপ্রতিম এগিয়ে আসছেন। মানুষটা বিরাট। মিঠু তাঁর কাঁধ পর্যন্তও পৌঁছয় না। মানুষটার একটা অদ্ভুত আকর্ষণ বরাবর ছিল। মিঠু তাঁকে কাকু বলে জানে, কিন্তু বেশির ভাগ সময়েই নামটা ধরতে হয়। পুরো নাম। উনি বলেন আমার পরিচয় আমি পার্থপ্রতিম, এই নাম ধরেই আমায় ডাকতে হবে। মিঠু পার্থপ্রতিমের হাতটা তার কাঁধের ওপর থেকে সরিয়ে দিল, বলল, ‘তুমি আমাদের বাড়ি আর আসবে না।’ বলতে বলতে তার কান্না পেয়ে গেল। কারণ ছেলেবেলায় যে সদাহাস্যময়, রহস্যে-ভরা, মুঠোয় চকোলেট, পকেটে-ছবি মানুষটির সঙ্গে তার পরিচয় সেই মানুষটাই এখন তার সামনে দাঁড়িয়ে। কিন্তু তাঁর অন্য মুখ সে দেখেছে। শ্রদ্ধা, বিশ্বাস, ভালোবাসার সেই মূর্তিটা এখন তার সামনে খান খান হয়ে ভেঙে পড়ছে। তার চেনা পার্থপ্রতিম একটা কিংবদন্তী। একটা মিথ্যেকে সে ভালোবেসেছিল।

কান্নাটাকে প্রাণপণে গিলে নিয়ে মিঠু সিঁড়ির কাছে দৌড়ে গেল। চটি পায়ে গলালো। হলুদ দোপাট্টা পেছন দিকে উড়ছে, সে সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে নেমে দৃষ্টির বাইরে চলে গেল। সদর দরজাটা টেনে বন্ধ করে দেবার শব্দ হল।

মুখের ওপর কালো ছায়া, পার্থপ্রতিম আস্তে আস্তে বললেন, ‘রাধা, তুইও কি এবার আমায় তাড়িয়ে দিবি? তোর মেয়ের মতো।’

অনুরাধা বললেন, ‘তুমি তো ওকে বাধ্য করলে পার্থপ্রতিম। মিঠুকে আমি এত রেগে যেতে, এত বিচলিত হতে কক্ষণো দেখিনি। বুঝতেই পারছ এই জন্যেই তোমায় ডেকেছিলুম। পার্থ···ঋতু আমার মেয়ের বন্ধু···আমি···’ অনুরাধা আর কিছুই বলতে পারলেন না। লবণের স্তম্ভের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন।

‘তুই তো জানিসই আমি একটা পাগল-ছাগল, বা শয়তান। শয়তানও বলতে পারিস। জানিস তো আমি ভণ্ডামিতে বিশ্বাস করি না। সংযম-টংযম মানি না। আমার যখন যা ইচ্ছে হয় করি। মানে যা ভালো লাগে। কারুর ওপর কিছু আমি ইমপোজও করি না। কিন্তু রাধা এগুলো বোধ হয় আসল আমি নয়। কাজটা, আমার কাজটাই আসল। সেখানে কোনও অসংযম তোরা দেখতে পাবি না। আহ্ “কল্লোলিনীটা” কী ভালোবাসা দিয়ে করেছিলুম রে। মিঠুকে দিয়ে…ওহ’, পার্থপ্রতিম মাথাটা নাড়তে লাগলেন যন্ত্রণায়। সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছেন পার্থপ্রতিম, কয়েক ধাপ পেছনে অনুরাধা।

‘আচ্ছা এত মেয়ে, সব বয়সের, আমার কাছে এরকম পতঙ্গের মতন ছুটে আসে কেন বল তো! কী আছে আমার! ওই মেয়েটি ঋতুপর্ণা—এ লাভলি অ্যানিমল, কয়েকটা স্কেচ যা নিয়েছি না! ননকনফর্মিস্ট, কিন্তু কী সাপ্ল বডি!’

অনুরাধা বললেন, ‘এসব কথা আমি সইতে পারছি না পার্থ, আমার গায়ে জ্বালা ধরছে।’

ঘুরে দাঁড়িয়ে পার্থপ্রতিম বললেন, ‘গায়ে জ্বালা ধরছে? বাঃ গুড সাইন!’

‘না, না,’ অনুরাধা বললেন, ‘আমি কিছুতেই ভুলতে পারছি না ও আমার মেয়ের বন্ধু, মেয়ের বন্ধু!’

‘মানে মেয়েও হতে পারত, এই তো!’ পার্থপ্রতিম মৃদু হেসে বললেন।

‘উঃ’, কানে আঙুল দিলেন অনুরাধা।

‘ঠারে-ঠোরে বলার চেয়ে সোজাসুজি বলাই তো ভালো’ পার্থপ্রতিম বললেন, ‘মিঠু তোর মেয়ে, আমারও তাই মেয়ে। কন্যা। কন্যাটি বড় হয়ে গেছে। খরশান। নিষেধাজ্ঞা জারি করে দিয়ে কেমন উন্নতগ্রীব রাজহংসীর মতো চলে গেল হলুদ পাখনা দুলিয়ে! এখন বড় হয়ে গেছে, নৈতিক বিচারগুলো করবার মতো বড় বলে মনে করছে নিজেকে। রাধা, ওকে আরো বড় হতে দিস। বাড়টা যেন ওপর থেকে কিছু চাপিয়ে বন্ধ করে দিস না। আরও বড় হলে, ও আমাকে পুরোপুরি মেনে নিতে না-ই পারুক, অন্তত বুঝতে পারবে। তখন হয়ত তোর মতই এক একটা পাকা চুল ঝিলিক দিচ্ছে মাথায়। তখন যদি দরজাটা খুলে দিয়ে বলে আবার—অনেক দিন আসোনি কাকু, এসো…আহ্!’

সদর দরজাটা মাথা একুট নিচু করে পার হলেন পার্থপ্রতিম। দরজাটা যথেষ্ট উঁচুই। কিন্তু তাঁর এরকমই অভ্যাস। কাঠবাদাম গাছটার পাশে একবার দাঁড়ালেন। খুন-খারাপি রঙের পাতাগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখলেন, তারপর রাস্তাটা দ্রুত পার হয়ে একটা বাঁক ফিরে চলে গেলেন জ্বলন্ত রোদের মধ্যে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress