একুশে পা (Ekushey Paa) : 20
‘কে জানত পথে পড়বে হুতোশের খাল?’
জুন মাসের এক দারুণ গরম দুপুরে ভেঙ্কট তার কলেজি বন্ধুবান্ধবদের নিজের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেছে। তার ‘পার্টিটা পেছোতে পেছোতে শেষ পর্যন্ত জুন। পরীক্ষার পর। ভেঙ্কট আর গৌতম দৌড়ে দৌড়ে বন্ধুদের ধরেছে। কারণ মেয়েদের সীট তো আলাদা জায়গায় পড়েছে! পড়ি-মরি করে দৌড়েও কয়েকজনকে ওরা ধরতে পারল না, বিদ্যাসাগর থেকে বেথুন। বেথুন কলেজের গেটের সামনে তখন উজ্জয়িনী, মিঠু, অণুকা, রাজেশ্বরী।
ভেঙ্কটের কথা শুনে উজ্জয়িনী বলল, ‘গেট-টুগেদার-এর আর টাইম পেলি না! জুন মানে জ্যৈষ্ঠ মাসের গুমোটে?’
ভেঙ্কট বললে, ‘এসোই না গুরু একবার। কবে থেকেই তো বলছি, কাটিয়ে দিচ্ছ সবাই। গরিবের কুঁড়েঘরে একদিন না হয় পা রাখলেই। মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে?’
উজ্জয়িনী বলল, ‘দেখছিস, দেখছিস, কিরকম ডায়ালগ দিতে শুরু করল। একবারও বলেছি যাব না!’
‘কিন্তু দু’একজন যেন মিসিং! বিষ্ণুপ্রিয়া, ঋতু!’
‘ঋতুকে আমি খবর দিয়ে দেব’, মিঠু বলল।
‘আর বিষ্ণুপ্রিয়া?’
‘ওকে তো তন্ময়ই খবর দিতে পারে’, উজ্জয়িনী বলল, ‘প্রিয়ার খুব সম্ভব ফোন নেই। থাকলে আমরা জানতে পারতাম।’
গৌতম বলল, ‘ঠিক আছে, ভেঙ্কট তুই তন্ময়কে বলে দিস।’
‘ঠিক হ্যায়।’ ভেঙ্কট বলল।
তন্ময়ের ফোন বাজছে, পরীক্ষা শেষ। দারুণ গরম। শ্রান্তিতে, এতদিনের নিবিড় মনোযোগের শ্রান্তিতে তন্ময় ঘড়ির কাঁটা চারটের দিকে এগোচ্ছে দেখেও শুয়েই ছিল। ফোন বাজছে। মা নেই, বাবা তো নেই-ই। বোন গেছে মামার বাড়ি। তন্ময় কেন কে জানে, বড় আশায় ফোনটা ধরল।
‘আমি ভেঙ্কট বলছি রে!’
তন্ময় মনে মনে বলল ধ্যাত্তেরিকা, নিকুচি করেছে। মুখে বলল, ‘বলো।’
‘কী হল তোমার গুরু? এমন দূরে ঠেলে রেখে কথা বলছ!’
‘কী বলছিস বল্।’
‘এই তো পথে এসেছ। আগামি শনিবারে দুপুর এগারোটা নাগাদ আমার বাড়ি চলে এসো।’
‘কেন?’
‘কেন? আরে হল্লাগুল্লা হবে। আর কদিন পরেই কে কোথায় ভেসে পড়ব কে জানে! তার আগে একবার সব মিলে নিই!’
‘ভেঙ্কট প্লিজ এক্সকিউজ মী।’
‘এক্সকিউজ কি রে, তুই তো আসছিসই! বিষ্ণুপ্রিয়াকে খবর দেবার ভারও তোর।’
‘পারব না, মাফ করতে হল।’
‘কি হল ইয়ার? গলাটা কেমন যেন শোনাচ্ছে!’
প্রচণ্ড রাগে তন্ময় রিসিভারটা দুম করে নামিয়ে রাখল। তারপর ছোট্ট বারান্দাটায় গিয়ে দাঁড়াল। বারান্দাটা এত ছোট যে এখানে চেয়ার পাতা যায় না, বড় জোর একটা মোড়া। কিন্তু দাঁড়ালেই ভাল লাগে। চতুর্দিকে ঝকঝকে সবুজ, আলোয় সাঁতার কাটছে সব। বিকেলের দিকের আলো। তাত মরে এসেছে। ঠিক চোখ-রাঙানি রোদ আর নেই, এ যেন রাগ-পড়ে-যাওয়া কিন্তু এখনও সে রাগের রেশ-রয়ে-যাওয়া চোখ। তবু, এই আলো, এই সবুজ, এই খোলামেলা দূষণহীন বিকেল যা লবণ হ্রদেরই বৈশিষ্ট্য, তন্ময় যার প্রচণ্ড ভক্ত, আজ ঠিক সেই জিনিসই তার অসহ্য মনে হল। বড্ড খোলা, যেন উদোম, চোখ মেলে চাইতে পারছে না তন্ময় প্রকৃতির দিকে, তার যেন চোখে জয়-বাংলা হয়েছে। চোখের ওপর হাত দিয়ে সে ঘরের ভিতরের আপেক্ষিক অন্ধকারে সরে এলো।
টেবিলে বইগুলো থাক থাক করে সরানো। এক একটা পেপার হয়ে গেছে আর সেই পেপারের বই খাতাগুলো একদিকে ঠেলে সরিয়ে রেখেছে তন্ময়। হঠাৎ তার মনে হল পরীক্ষার কদিন সে বেশ ছিল। একদম অন্য একটা তন্ময়। সে ছিল ধ্যানমৌন কোনও পাহাড়ের গুহায়, একদম একা, নিশ্চল, প্রয়োজন বলতে কিচ্ছু ছিল না, যেটুকু প্রয়োজন তা কে বা কারা যেন অলক্ষ্যে থেকে মিটিয়ে দিয়ে গেছে। সেই সুন্দর ঠাণ্ডা গুহার ভেতর থেকে এখন তাকে টেনে এনে একটা যান্ত্রিক, আত্মাহীন শহরের উলঙ্গ রাজপথে ঘাড় ধরে একা দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। তন্ময়ের এই গুহা আগেও ছিল, ছিল এই দাঁত-কিড়মিড় শব্দ রাক্ষসে ভর্তি বড় রাস্তাও। দুটোকেই সে মেলাতে পারত, কষ্ট হত না। তার ভেতরে কোনও এক সূক্ষ্ম স্নায়ুতন্তুর দৌলতেই হোক, কোনও অনাল গ্রন্থির সময়োচিত নিঃসরণের কারণেই হোক এই সেতু তার ব্যক্তিত্বের মধ্যে ছিল। কেমন করে কে জানে সেটা ছিঁড়ে গেছে, বা শুকিয়ে গেছে। সে পারছে না।
এই তৃতীয় তন্ময়কে, গুহাবাসী তন্ময়, রাজপথে বিপন্ন তন্ময় প্রাণপণে মনে মনে ডাকতে থাকে ‘তন্ময়! ত-ন্ময়!’
শোনো আমি বড্ডই বিপন্ন,
কে জানত পথে পড়বে হুতোশের খাল,
কালাপানি শুষে নেবে প্রতিবিম্ব
কে জানত এদিকেই তেষ্টামারির মাঠ
নিশি ডাকে, নিশি ডাকছে কবন্ধ…
বড্ডই বিপন্ন হে, বড্ডই…
তন্ময় ঘরে এসে নোট-বুকে তার মনের কথাগুলো টুকে রাখল, তারপর দু’ হাতে মাথাটা আঁকড়ে বসে রইল। আবারও খটাস করে ডট খুলল:
এরকম গনগনে সবুজ চোখে সয় না
এমন টকটকে আকাশ
হাটাও এই তড়বড়ে রোদ।
অশ্লীল, উলঙ্গ উচ্ছ্বাস! ছিঃ!
একটু ফিকে হও তো, ফিকে!
একটু ছায়া-ছায়া
একটু আস্তে, ধীরে-সুস্থে
নইলে সয় না।
পাতা-উল্টে গেল তন্ময়।
পেছন থেকে টুঁটি টিপে ধরছ কে? কে রে?
ঝিমন্ত বেলায় দ্বারপাল এখন ছাউনিতে
আসতে দাও! তাকে আসতে দাও!
পাকা বাঁশের লাঠি আর গাদা বন্দুক আছে।
সেগুলো কাজে লাগুক বা না লাগুক
অন্তত একটা ঝটাপটির সুযোগ…
কিংবা যে এসেছ, এসো সম্মুখে আমার
খোলা চোখে দেখতে দাও ক্রোধ-ঘৃণা-দম্ভের বাহার
পারলে ঘোরাও চক্র উল্লম্ব তর্জনী সংকেতে
কে বলতে পারে যদি তেমনি করে পার
বদ্ধপাণি, ত্যক্তরথ, হয়ত দণ্ড নেবো শির পেতে।
অনেকক্ষণ এক ভাবে, একই ভাবে বসে রইল তন্ময়। হাতে খোলা ডট। টেবিলে ডায়েরির খোলা পাতা। তার বাঁ হাত মাথায় ডান হাত কলমসুদ্ধ টেবিলের ওপর পড়ে আছে। টেলিফোনটা আবার বাজল। একটু বাজতে দিল তন্ময়। তারপর খুব নাছোড়বান্দা দেখে উঠে পড়ল।
‘হাললো।’
‘কে তন্ময়?’ মেয়ে-গলা, ‘আমি মিঠু বলছি, উজ্জয়িনীর বাড়ি থেকে।’
‘কী ব্যাপার?’
‘পরীক্ষা কেমন হলো?’
‘ভাল।’
‘ফার্স্টক্লাস হচ্ছে?’
‘এগজামিনার জানে।’
‘শনিবারে ভেঙ্কটরমণের বাড়ি যাচ্ছিস তো?’
‘দেখি!’
‘দেখি আবার কি? এই হয়ত শেষ! এরপর কি আর আমাদের গ্রুপটা এইরকম থাকবে? এক একজন একেক দিকে চলে যাব, তন্ময় প্লিজ আসিস!’
‘আচ্ছা!’
‘আমাদের মানে আমার আর উজ্জয়িনীর কিরকম পরীক্ষা হল। জিজ্ঞেস করলি না তো?’
‘ভালোই হয়েছে নিশ্চয়ই, জিজ্ঞেস করলেই তো বলবি একরকম।’
‘এটা ঠিকই বলেছিস। সত্যি রে, নিজেই বুঝতে পারি না। ভালো দিয়েছি কি মন্দ দিয়েছি। যে পেপারটা বানিয়ে লিখলুম পার্ট ওয়ানে, সেটাতে হায়েস্ট পেলুম। যেটা প্রায় আগাগোড়া তৈরি ছিল সেটায় যা-তা। এরপর আর দুরকম বলার সাহস থাকে? যাকগে, আসছিস তো?’
‘আসছি।’
‘থ্যাংকিউ। ছাড়ি?’
‘ঠিক আছে।’
ফোনটা ছেড়ে দিতে উজ্জয়িনী বলল, ‘কিছু বুঝলি?’
মিঠু বলল, ‘গোড়ায় যেন একটু স্টিফ ছিল, কথা বলতে বলতে শেষের দিকটা তো স্বাভাবিকই মনে হল।’
‘তবে ভেঙ্কট কী বুঝল?’ উজ্জয়িনী আপন মনেই বলল।
মিঠু বলল, ‘উজ্জয়িনী, আমি কিন্তু প্রিয়ার নাম করিনি একবারও। হয়ত সেইজন্যেই!’
‘আমি তো তোকে কোন কালেই বলেছি প্রিয়ার সঙ্গে ওর একটা গণ্ডগোল চলছে, তুই তো প্রেমটা পর্যন্ত বিশ্বাস করতে চাস না।’ উজ্জয়িনী মুখের একটা ভঙ্গি করে বলল।
‘আমি…মানে ক্লাস ফেলো তো…একই অনার্স আর…’
‘তা তোর ক্লাস ফেলোর সঙ্গে প্রেম হয়নি বলে আর কারো হবে না? ভেঙ্কট বা গৌতমেরও তো পল সায়েন্স, কই ওদের সঙ্গে তো ওরকম দিবারাত্র ঘুরত না প্রিয়াটা!’
মিঠু হেসে ফেলে বলল, ‘দূর, ভেঙ্কটটা যা ফাজিল, ওর সঙ্গে যে কারুর প্রেম-ট্রেম হতে পারে তাই বিশ্বাস হয় না। দেখ ও হয়ত বিয়ের সময়েও বউকে বলবে, কী গুরু! কী খবর!’
হাসতে হাতে উজ্জয়িনী বলল, ‘যা বলেছিস। তবে কি জানিস প্রিয়াটা বরাবর কি রকম বাগানে টাইপের ছিল। মনে আছে? তুই কী লিখেছিস। তুই কী লিখেছিস বলে কতবার যে আমার খাতা নিয়ে দৌড় মেরেছে! তন্ময়টা ব্রাইট বলেই বেছে বেছে ওর সঙ্গে প্রেম করেছে। এখন বোধ হয় নোট-টোট সব বাগানো হয়ে গেছে।’
‘তাই ওকে জিল্ট করেছে বলছিস?’ মিঠু অবিশ্বাসের চোখে তাকাল।
‘প্রমাণ ছাড়া তো এসব কথা বলার কোনও মানে হয় না। তবে তন্ময়টা ওরকম করবে কেন?’
মিঠু বলল, ‘যাক আমাদের কাজ উদ্ধার হয়ে গেছে। এখন প্রিয়াকে কোথায় পাই। উঃ, বাড়িতে একটা ফোন রাখতে কী হয়! আর তো কটা দিন বাদেই শনিবার। চলি রে জুন।’
মিঠু চলে গেল।
মায়ের এখনও ফিরতে দেরি আছে। উজ্জয়িনী যমুনাকে ডেকে বলল সে বাবার চেম্বারে যাচ্ছে। মা এলে যেন বলে দেয়। পরীক্ষাটা শেষ হয়ে খুব একটা মুক্ত-স্বাধীন লাগছে। কিন্তু এতদিনের ঘুম, ক্লান্তি সব কোথায় উবে গেছে। মনে হচ্ছে এখন সে অনেক কাজ করতে পারে। বাবার ঘরে গিয়ে সে জানলাগুলো হাট করে খুলে দিল। ঝড়ের মতো দক্ষিণে হাওয়া এসে ঘরময় তাণ্ডব শুরু করে দিল। ভাগ্যিস খুচরো কিছু নেই। বাবার ড্রয়ারগুলো আজ পরিষ্কার করতে হবে, অনেক দিন থেকে বলছে মা। টেবিলটা একেবারে খালি করে দিতে হবে। এ সব ঘরের আসবাবপত্র সবই বিক্রি হয়ে যাবে।
মা সবটা বলে না উজ্জয়িনীকে, কিন্তু খুব সম্ভব বাবার মৃত্যুর পর ওয়েল্থ্ ট্যাক্সফ্যাক্স দিতে অনেকটাই চলে গেছে। এদিকের ফ্ল্যাটটাও বিক্রি হয়ে যাবে। তাদের নিজেদের ফ্ল্যাট আর এই ফ্ল্যাট বিক্রির টাকা এর চেয়ে বেশি হয়ত তাদের কিছু আর থাকবে না। বাবার অ্যামবাসাডরটা বিক্রি হয়ে গেছে। তাদের মারুতিটাও মা বিক্রি করতে চাইছিল, উজ্জয়িনী কিছুতেই করতে দেয়নি। মায়ের কষ্ট হবে। শুধু শারীরিক কষ্ট নয়, মনে মনেও মা বড্ড কষ্ট পাবে। কত রকমের কষ্ট পেল মা, প্রৌঢ় বয়সে এটুকু না হয় না-ই পেল আর। টাকা এবং স্বামীর পদমর্যাদা দিয়েই তো মান, সে স্বামী চরিত্রহীন লম্পট হলেও। ডক্টর রজত মিত্র-র স্ত্রী হিসেবেই মা ‘জাগৃতি’, ‘নবনীড়’, ‘মাদার্স সেন্টার’ ইত্যাদি নানা সমিতির কোথাও সেক্রেটারি, কোথাও প্রেসিডেন্ট। এতদিন তিনি ঘোরাফেরা করেছেন গাড়িতে, আজ হঠাৎ ট্রাম বাস থেকে নামলে, বা রিকশা ঠুংঠুং করে গিয়ে উপস্থিত হলে ওই সমস্ত ফ্যাশনদুরস্ত করুণাময়ী মহিলাদের কাছ থেকে মা ঠিক কী ধরনের আপ্যায়ন পাবে, জানা নেই। মায়ের ওপর দিয়ে এই বয়সে, এই গবেষণাটা হোক উজ্জয়িনীর সেটা ইচ্ছে নয়। সে ড্রয়ারগুলো এক এক করে খুলতে লাগল, বাবার স্কুলজীবন থেকে শেষ পরীক্ষা পর্যন্ত অজস্র সার্টিফিকেট, ডিপ্লোমা, ডিগ্রি। কী সাঙ্ঘাতিক কেরিয়ার। একবারও বাবা ভুল করেও দ্বিতীয় হয়নি কোথাও। সযত্নে সব ফাইলবন্দী করা রয়েছে। কী লাভ! বাবার বাবা-মার না-জানি কী আনন্দ, কী গর্বই হয়েছিল। বংশের নাম রাখা, মা-বাবার মুখ উজ্জ্বল করা ছেলে। স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেননি বোধ হয় ওই ছেলে কী দাঁড়াবে। ভাগ্যিস, দাদু দিদা আগেই মারা গেছে। দিদা তো কবেই। দাদু বোধ হয় বাবার কিছু-কিছু কীর্তি-কাহিনী জেনেই গেছে। তখনও তাদের এই ফ্ল্যাট হয়নি। চেতলায় বিরাট যৌথ বাড়ির এক অংশে তারা থাকত। পিসিমা কিছু কিছু জানেন বোধ হয়, দিল্লি থাকেন। আসেন খুব কম। একটা অ্যালবাম। ভীষণ কৌতূহলে অ্যালবামটা তুলে নিল উজ্জয়িনী। বাবার ছবি, নানা বয়সের। কী সুন্দর হাসছে শিশু, দু ফোঁটা নাল গড়িয়ে ঠোঁটের তলায় থেমে গেছে। অবোধ নিষ্পাপ হাসি। বাবার এত ছোটবেলার ছবি সে দেখেনি কখনও। ক্রিকেট-ব্যাট হাতে নিয়ে বাবা। ক্রিজে দাঁড়িয়ে আছে, চোখ দুটো ঈষৎ কুঁচকে আছে, মুখটা উদ্বিগ্ন। স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধে হাত দিয়ে বাবা, এত সুন্দর তরুণ আর কখনও কোথাও দেখেছে বলে মনে করতে পারল না উজ্জয়িনী। এই তো মাথায় হুড, গায়ে কালো গাউন, হাতে পাকানো দলিল, বাবার এম-বি. বি-এস ডিগ্রি পাওয়ার ছবি। যেন শাহজাদা। পাতা উল্টোতে লাগল উজ্জয়িনী। মায়ের ছবি, অমিতা মিত্র। মায়ের এ ছবি উজ্জয়িনী আগে কখনও দেখেনি। দুটো বিনুনি দুদিকে। ঘাম চকচকে ছাত্রী-ছাত্রী মুখ। ঠোঁটে বিপন্ন হাসি। দু-চারগাছা চুল উড়ে পড়েছে কপালে। এই অমিতা মিত্রর সঙ্গে আজকের মার কোনও মিল নেই। কোথায় লুকিয়ে গেছে এইসব লাজুক লাজুক চাউনি, খুশির হাসি, নির্মল ছেলেমানুষি। মা কি তখন লুকিয়ে লুকিয়ে বাবার সঙ্গে প্রেম করত? আহা, বেচারি অমিতা কি তখন ভেবেছিল মেডিক্যাল কলেজের উজ্জ্বল ছাত্র রজত, তার রজত এমনি হবে? বাচ্চা মায়ের ছবির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে উজ্জয়িনীর দু চোখ ভরে জল এলো। ছবিটা সে খুলে নিজের অ্যালবামে রাখবে। তার পরের পাতায় একটা অদ্ভুত দেখতে মেয়ের ছবি, অনেকগুলো, নানা সময়ে, নানান কোণ থেকে তোলা। নিগ্রোদের মতো কুঁচি-কুঁচি চুল। মাথার চার পাশে ফেঁপে আছে, একটা টানা রেখার মতো ঠোঁট। চোখ দুটো যেন হীরের কুচির মতো জ্বলছে। গালের হাড় উঁচু। প্রথম ছবিটা উল্টে নিয়ে দেখল উজ্জয়িনী, লিপস্টিক মাথা লম্বা ঠোঁটের দাগ। তলায় ইংরেজিতে লেখা ইন্দু ব্র্যাকেটের মধ্যে রামস্বামী। তাড়াতাড়ি পাতাগুলো উল্টে গেল উজ্জয়িনী। ডোরার ছবি, ডোরা ডিসুজা, উজ্জয়িনীর দিকে তাকিয়ে হাসছে। তিন-চারটে ছবি। একটা বাবার সঙ্গে। ‘ডোরা, ডোরা’ ফিসফিস করে বলল উজ্জয়িনী, ‘তোমাকে আমি পুড়িয়ে ফেলেছি, তবু তুমি আবার এসেছ?’ কী দীর্ঘপক্ষ্ণ ভালবাসা ভরা ছাউনি, ছোট্ট নাক, ফুলো ফুলো ঠোঁট, রাশি রাশি চুল, কার্ল করা। হঠাৎ উজ্জয়িনী একটা ছবি তুলে নিয়ে বুকে চেপে ধরল। তার বুকটা যেন আবেগে ফেটে যাবে। সে আস্তে আস্তে ছবিটাকে মুখের কাছে তুলে আনল, তারপর গরম ঠোঁট রাখল ছবিটার ওপর। ছোট্ট একটা চুমুর শব্দ হল। সে মনে মনে বলল, ‘ডোরা, এত হাসি হাসছ কেন? তোমায় কেউ কিছু দেয়নি, তোমার কোনও স্মৃতি নেই, অস্তিত্ব নেই, তোমার মেয়ে তোমার নয়, তোমার পরিচয় সে একেবারে মুছে ফেলেছে। কোন অখ্যাত হাসপাতালে তুমি আত্মীয়-বান্ধবহীন একলা-একলা মরে গেছ।’ এইভাবে বলতে বলতে উজ্জয়িনী যেন আস্তে আস্তে ডোরা ডিসুজার কানীন কন্যা হয়ে যেতে লাগল। গ্লোব সিনেমার কাছে একটা বিরাট ভাঙাচোরা বাড়ি, তার দোতলায় উঠে একটা ঘর, বিরাট বিরাট জানলায় বেঁটে বেঁটে সাদা পর্দা দেওয়া। সে পুরনো বেতের সোফায় ডোরার মুখোমুখি বসল। ট্রেতে চায়ের জিনিস নিয়ে এক বৃদ্ধা অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মহিলা ঢুকলেন, ‘খাবে না? খাও না? কুকীজ! অল রাইট চা খেয়ো না, দুধ খাও। কী ফ্লেভার পছন্দ করো! সে কী এই বাড়িতে কোনদিন গিয়েছিল? ডোরাকে তো সে দেখতেই পারে না। সে এলো বলে ডোরাকে চলে যেতে হল। তাহলে? তার স্মৃতিতে ওই ঘর, ওই বৃদ্ধা কে? অনেকক্ষণ ভাবতে ভাবতে হঠাৎই ভদ্রমহিলাকে চিনতে পেরে গেল সে। উনি তো মিসেস রডরিগ্স্! নার্সারি কে· জি-তে তাদের সঙ্গে পড়ত কিম রডরিগ্স, তার দিদিমা। একদিন ওদের বাড়িতে গিয়েছিল সে। ডোরা কোথাও আর নেই। সে উজ্জয়িনী তার শেষ চিহ্ন। অবশেষ। কোথাও ডোরাকে রাখতেই হবে তাকে। কেমন করে, সেটা ভাবতে হবে। কিন্তু রাখা দরকার। উঠে আলোগুলো জ্বালিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিল উজ্জয়িনী। পাতা উল্টোলো। দারুণ সুন্দরী এক মহিলা মুখে গর্বিত হাসি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। এনলার্জড ছবি, পাতা জুড়ে। ইনি কি কোনও অ্যাকট্রেস? সেই রকমই দেখতে। ছবিটার ওপর দিয়েই নাম সই করা, বাঁকা করে, পুষ্পা হন্স্রাজ। পরের পাতাটা খালি। তার পরে বাবার সঙ্গে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে তাপসী নন্দী। একে খুব ভালো করেই চেনে উজ্জয়িনী। হঠাৎ উজ্জয়িনী চমকে উঠল। একটার পর একটা সে নানান মেয়ের ছবি দেখে যাচ্ছে। অমিতা মিত্রকে দিয়ে আরম্ভ। সে তবে বাবার হারেমে উঁকি মেরেছে। এই সমস্ত মহিলা কোন না কোন সময়ে ডক্টর রজত মিত্রকে সঙ্গদান করেছেন।
উজ্জয়িনী সহসাই বুঝতে পারল বাবা সম্পর্কে অন্তত এই রজত মিত্র সম্পর্কে তার আর কোনও অনুভূতি নেই। যে ভীষণ ঘৃণা, ক্ষোভ তার মধ্যে ছিল সে সব মুছে গেছে। উনি যেন তার কেউই নয়। আবার উল্টেপাল্টে অ্যালবামটা দেখে বাইরে একপাশে রেখে দিল সে। বাবার একার ছবিগুলো আর মায়ের ছবিটা সে খুলে নেবে। ডোরার ছবিগুলো, একটা গোপন খামে, গোপন তাকে থাকবে, বাকি অ্যালবামটা সে জ্বালিয়ে দেবে, এই সব সার্টিফিকেট, ডিগ্রি ইত্যাদির সঙ্গে। এগুলোই বা রেখে কী হবে?
আরও ড্রয়ার বোঝাই ইলেকট্রিকের বিল, ট্যাক্সের রসিদ। নানান রকম ওষুধ কোম্পানির ব্রোশিওর। সর্বশেষ ড্রয়ারটাতে একটা বহু প্রাচীন, হলুদ হয়ে যাওয়া প্যাকেটে কতকগুলো চিঠি পেল উজ্জয়িনী।
পাতলা কাগজে গোটা গোটা তার মায়ের লেখা চিনতে পারল উজ্জয়িনী। আগেকার লেখা, অনেক কাঁচা, তবু মায়েরই।
রন্টু দা,
তুমি আর অমনি করবে না কথা দাও। তবে, আমি আর যাবো না। মা জানতে পারলে আমাকে মেরে পাট করে দেবেন। বাবা কী করবেন ভাবতেও সাহস হয় না। আর তোমার বন্ধু? দাদা যদি জানতে পারে তো আমায় চিলে কোঠার ঘরে বন্ধ করে রাখবে। রন্টুদা, রন্টু তুমি কবে আসবে? তোমায় না দেখলে আমি থাকতে পারি না। আমার খুব কষ্ট হয়।
বলোতো কে?
তলায় মন্তব্য, চুলবুলের প্রথম চিঠি। আমার প্রথম চুমু। খুব ভয়ে ভয়ে দ্বিতীয় চিঠিটা খুলল উজ্জয়িনী। আর কোনও সম্বোধন নেই।
‘আমাকে নিশ্চয়ই ভুলে গেছ। এগারো দিন হল দার্জিলিং এসেছি। এগারো দিন তোমায় দেখিনি। সারা দিন সারা রাত দার্জিলিং কেঁদে যায়। ভিজে স্যাঁতসেঁতে হয়ে থাকে সব। কী হাওয়া দেয়। ঝড়ের মতো। ঝড় যদি আমাকে উড়িয়ে নিয়ে তোমার কাছে ফেলত! কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পাইনি। একদিনও না। কেমন করে পাব? আমি একলা একলা কোনও সুন্দর যে দেখতে পাই না। কবে দেখব তোমাকে? কবে দেখব? কত দূরে তুমি? কত দূর?
—জানোই তো—কে। এর তলাতেও পুরুষালি হাতের লেখার মন্তব্য ‘তুমি আমারই। যত দূরেই যাও।’
চিঠিটা মুড়ে যথাস্থানে রেখে চুপচাপ বসে রইল উজ্জয়িনী। তার বুকের মধ্যে কিসের ব্যাকুলতা, অসহ্য এক আনন্দে শিরায় শিরায় টান ধরেছে। আমি একলা-একলা কোনও সুন্দর যে দেখতে পাই না! কত দূরে, তুমি কত দূরে! খুব লোভ হচ্ছিল সব চিঠিগুলো পড়তে। কিন্তু ভয়ও করছিল। লজ্জা। লজ্জাও সেইসঙ্গে। অ্যালবাম থেকে সে ক্ষিপ্রহাতে মায়ের ছবিটা খুলে নিল। চিঠির প্যাকেটটার মধ্যে রেখে দিল। তারপর আর সব জিনিস ভেতরে রেখে চাবি দিয়ে দিল। এখন সে জানে এই টেবিলের সব ড্রয়ারে কী আছে না-আছে। সময় মতো ছেঁড়ার কাজ, পোড়ানোর কাজ করলেই হবে। আপাতত এই ছাইগাদা খুঁজতে খুঁজতে সে দামী কিছু পেয়ে গেছে।
রাত্তিরে খাওয়া-দাওয়ার পর মায়ের ঘরে গিয়ে সে বলল, ‘মা দ্যাখো তোমার ছবি।’
ছবিটা হাতে নিয়ে মা বলল, ‘কোথায় পেলি? এ তো আমার অনেক দিনের…’ মা নিবিষ্ট হয়ে দেখছে।
উজ্জয়িনী বলল, ‘বাবার ড্রয়ারে ছিল, আর এই চিঠিগুলো।’
‘দেখি দেখি’ চিঠির তাড়াটা তাড়াতাড়ি হাতে নিয়ে অমিতা লালচে হয়ে গেলেন। মেয়ের দিকে না তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুই পড়েছিস?’
বা রে! না পড়লে কি করে বুঝব তোমার চিঠি? একটাই পড়েছি মা, জাস্ট একটা।’
‘ঠিক বলছিস?’
‘জাস্ট দুটো মা। অন গড। চিঠিগুলো আর ছবিটা একসঙ্গে ছিল,’ বলে উজ্জয়িনী আর দাঁড়াল না। পায়ে পায়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল। এখন সে একটা ঘোরের মধ্যে আছে। তার মনের মধ্যে বসে কিশোরী চুলবুল অদ্ভুত অদ্ভুত কথা উচ্চারণ করছে। অনেক সাহিত্য পড়লেও এমন ঘোর-লাগা কথা সে কখনও, কোথাও পড়েনি। ‘একলা-একলা আমি কোনও সুন্দর যে দেখতে পাই না।’ মানে কী? এর মানে কী? একজন না থাকলে আরেক জনের দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে যায়? নাকি নিসর্গ-সৌন্দর্যের মতো একটা বাইরের জিনিসও দেখতে সুন্দর লাগে না। না, দেখতে ইচ্ছে করে না? ‘তুমি আমারই। যত দূরেই যাও।’ চুলবুল তার জায়গায় এখনও বসে আছে, রজত মিত্র কত দূরে চলে গেছে। সেখানে পাপপুণ্য নেই। উজ্জয়িনীর মনে হয় সেখানকার ধর্ম ভালোবাসা। এখন রজত মিত্র ওইখানে বসে শান্ত, সমাহিত, কলুষমুক্ত চোখ মেলে দেখছে এই পৃথিবীর দিকে, বলছে, ‘তুমি আমারই। যত দূরেই যাই।’ কথাগুলোর আঘ্রাণ নিতে নিতে উজ্জয়িনী বহুদিন পর একটা নিবিড় ঘুম ঘুমোলো। নিশ্চয়ই সুখ-স্বপ্নে ভরা, অথবা সুষুপ্তি, কেন না পরদিন সকালে তার মুখের যেসব কঠিন রেখা সে তার বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে, সে-সব কোমল হয়েছিল। যেন ফাঁকা ফাঁকা স্কেচের ওপর কেউ এইমাত্র নরম, নিটোল রঙ চাপালো।