একুশে পা (Ekushey Paa) : 18
‘তারা যেন রূঢ় হাতে পর্দা সরিয়ে ওদের তিনজনের …’
সুহাস পুনেতে একটা খুব পছন্দসই কাজ পেয়েছে। এতদিন সে খালি ধরছিল আর ছাড়ছিল। এবার মনে হচ্ছে স্থিত হবে। ‘এক্সপ্রেশনস’ নামে এই প্রতিষ্ঠানটি সারা মহারাষ্ট্র জুড়ে পাবলিক থিয়েটার, স্থায়ী প্রদর্শনী কক্ষ, বাগান, রেস্তোরাঁ ইত্যাদি বানাচ্ছে। খুব নাম করেছে শিল্পসম্মত কাজের জন্য। সুহাস এর আগে ওদের একটি ‘লোগো’ প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়। এবারে ওরা একটা আর্ট গ্যালারির লে-আউট চেয়েছিল অ্যাপ্লিকেশনের সঙ্গে। স্কোয়্যার ফুটেজ, মোটামুটি ব্যয়ের একটা হিসেবও দিয়ে দিয়েছিল। তারই বিচারে সুহাস চাকরিটা পেয়েছে। এটা ছিল বলতে গেলে তার একটা স্বপ্নই। ও একটা ছোট বাংলো পাবে পুনের শহরতলিতে।
সুহাস বলল, ‘মা, ধরো যদি একটা বিয়ে শাদি করি এবার।’
‘বিয়ে তো একটাই করবি।’ তার মা হাসি-হাসি মুখে জবাব দিলেন।
‘তা নয়। আসলে, আমার একজনকে বিশেষ পছন্দ।’
‘সে তো খুব ভালো কথা। নিয়ে আয় একদিন মেয়েটিকে, আলাপ করি।’
‘চেনো তাকে, আসে মাঝে মধ্যে, মিঠুর বন্ধু।’
মিঠু ছিল। খুব উৎসাহিত হয়ে বলল, ‘কে? ঋতু?’ যদিও ঋতু দাদার বউ হবার সম্ভাবনায় সে খুব খুশি নয়।
‘উঁহু, ইমন।’ সুহাস বলল। তার মুখে একটু একটু লজ্জার হাসি।
অনুরাধা অবাক হয়ে বললেন, ‘ইমন? কিন্তু ইমন তো একটা স্টার। ওকি এখন .. কিংবা তোকে বিয়ে করতে চাইবে? বলেছিস?’
‘না মা। বলি টলিনি। তোমরা বলো, ইমনের মাকে জানাও।’ সুহাস কেমন একটা সহজাতবোধে বোঝে ইমনের মার ভীষণ গুরুত্ব।
‘সুহাস, ওরা আবার তার ওপর মুখার্জি। মফস্বলের পরিবার। আমাদের বাড়ি … রাজি না-ও হতে পারে। না হবার সম্ভাবনাই বেশি।’ অনুরাধার মুখটা বলতে বলতে চুপসে যেতে থাকে।
সুহাস অসহিষ্ণু হয়ে বলল, ‘ইমন খুব প্রোগ্রেসিভ মা।’
‘ইমন হতে পারে। কিন্তু ওর মা না-ও হতে পারেন সুহাস। সে ক্ষেত্রে … তা ছাড়া ওর খেলা!’
‘ও যাতে খেলার সুযোগ পায় সেটা আমি সব সময়েই দেখব। খেলা আর কতদিন। ধরো দশ বছর! তার পর টেবল-টেনিস প্লেয়ারের আর ধার থাকে না। ও যদি চালাতে পারে, নিশ্চয় চালাবে।’
মিঠু বলল, ‘কিন্তু দাদা ওর যদি কাউকে পছন্দ থাকে!’ সে ঋতুর কথাগুলো মনে করে বলল।
‘না, সে রকম কিছু নেই।’ সুহাস জোর দিয়ে বলল।
‘তুই কী করে জানলি? তুই তো ওর সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলিসনি।’
সুহাস এবার একটু লাল হয়ে বলল, ‘আমি ওসব খেলার জগতের খবরাখবর রাখি। ইমনের তেমন কোনও বন্ধু নেই।’
মিঠু অনেকক্ষণ ধরেই আনন্দ চেপে রাখতে পারছে না। সে বলল, ‘দাদা, তুই এতদিনে একটা কাজের মতো কাজ করলি।’
অনুরাধা বললেন, ‘বাজে কথা ছাড় তো! গাছে না উঠতেই এক কাঁদি! ইমনকে অনেক দিন দেখি না। একদিন ডাক। এসে থাকুক কদিন। সেই সময়ে ওকে বলা হবে।’
মিঠু খবর নিয়ে এলো ইমন বাড়ি গেছে। কবে ফিরবে ঠিক নেই। মিঠু ওর ঠিকানা নিয়ে ফিরেছে। ওরা তিনজন রানাঘাট যাবে। ওদের ইচ্ছে বাবাও যান। কিন্তু সাদেক কিছুতেই রাজি হলেন না। বললেন, ‘কোনও সামাজিক ব্যাপারের শুরুতে তোমরা আমাকে নিয়ে যাবার কথা কী করে ভাবো? দেখবে হয়ত আমার জন্যেই ব্যাপারটা আটকে যাবে।’ ছেলে-মেয়ের শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘কী আশ্চর্য! বী প্র্যাকটিক্যাল।’
মিঠু চুপিচুপি দাদাকে বলল, ‘আচ্ছা দাদা, ইমনের মা যদি খুব গোঁড়া হন, রাজি না হন, তাহলে?’
সুহাস বলল, ‘ইমন নিজে যদি সংস্কার কাটাতে না পারে, তাহলে আর কী! হবে না!’ ‘হবে না’টা সে খুব হতাশভাবে উচ্চারণ করল।
কৃষ্ণনগর লোক্যালে ওরা যখন রানাঘাটে পৌঁছল বারোটা বেজে গেছে। ইছাপুর ছাড়িয়ে ট্রেন থেমে রইল বহুক্ষণ। হট্টগোল, মারামারি, কয়েক দফা নালিশ নিয়ে রেল রোকো আন্দোলন শুরু হয়ে গেল হঠাৎ। উদ্বিগ্ন হয়ে কোনও লাভ নেই। এসব লাইনে এইরকমই হচ্ছে আজকাল। দুটো সাইকেল রিকশা করে রানাঘাট মহকুমা হাসপাতালে পৌঁছল ওরা সাড়ে বারো নাগাদ।
‘জকপুর রোডের হাসপাতাল বলতে এটাই’, রিকশাওয়ালা বললে, ‘সব আছে, বাচ্চাদের, ছোঁয়াচে রোগের স-ব। টি. বি হাসপাতাল অন্য দিকে।’
‘না না, এটাই আমাদের দরকার’, অনুরাধা ঠিকানা-লেখা কাগজটার দিকে চোখ রেখে বললেন।
বিরাট চত্বর জুড়ে, ঘেরা পাঁচিলের মধ্যে হাসপাতাল। মেন বিল্ডিংটার দিকে যেতে যেতে অনুরাধা বললেন, ‘হাসপাতালের ঠিকানা কেন রে মিঠু?’ তাঁর হাসপাতাল একেবারে ভালো লাগে না।
সুহাস বলল, ‘কত বড় জায়গা দেখছ না, এখানেই নিশ্চয়ই কোয়ার্টার্স। অফিস বলে মনে হল যে ঘরটাকে, সেটাতে ঢুকে সুহাস বলল, ‘আচ্ছা, মিসেস শান্তি মুখার্জি নামে একজন সিসটারকে আমরা খুঁজছি…। ওঁর কোয়ার্টার্স…?’
ভদ্রলোক বললেন, ‘দক্ষিণের বিল্ডিংটা দেখছেন, ওইখানে স্টাফ কোয়ার্টার্স, ওখানে গিয়ে জিজ্ঞেস করুন।’
পাশ থেকে আরেকজন বললেন, ‘কী নাম বললেন—শান্তি মুখুজ্জে? আমাদের পরিতোষ মুখুজ্জ্যের স্ত্রী নাকি? কিন্তু নার্স তো নয়! এই মহাদেব! স্মৃতি আছে কি না দেখো তো!’
তিনি ওদের দিকে ফিরে সহানুভূতির সুরে বললেন, ‘প্যারালিসিসের কেস নাকি? ট্রেইন্ড আয়া চাইলে কিন্তু শান্তি মুখুজ্জ্যেকে দিয়ে হবে না। ওর কোনও ট্রেনিং নেই।’ অনুরাধা বা সুহাসের দিক থেকে কোনও সাড়া না পেয়ে ভদ্রলোক দেশলাই কাঠির পেছন দিয়ে নিজের কান খোঁচাতে আরম্ভ করলেন।
কিছুক্ষণ পর নীল পাড় সাদা শাড়ি পরা একজন মহিলা এসে দাঁড়াতে ভদ্রলোক বললেন, ‘শান্তি ডিউটিতে এসেছে নাকি স্মৃতি?’
স্মৃতি নামের মহিলা বললেন, ‘শান্তিদি তো এক তলাতেই ৩ নম্বর কেবিনে ডিউটিতে রয়েছে? কেন?’
‘এঁদের দরকার, একবারটি ডাকো দিকিনি!’
স্মৃতি বললেন, ‘আপনারা বাইরে এসে দাঁড়ান, আমি ডেকে আনছি।’
বাইরে অপেক্ষা করতে করতেই ওরা দেখতে পেল, ভেতর দিক থেকে নীল পাড় সাদা শাড়ি পরা বিশুষ্ক চেহারার এক মহিলা স্মৃতির সঙ্গে কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসছেন, ‘এঁরা।’ ওদের দেখিয়ে স্মৃতি বললেন।
‘তাড়াতাড়ি বলুন, পেশেন্ট বড় খিটখিটে, এক্ষুনি তেড়েমেড়ে উঠবে।’
‘আমরা ইমনের খোঁজে এসেছি। এ ইমনের বন্ধু মিঠু,’ মিঠুর পিঠে হাত রেখে অনুরাধা বললেন।
ভদ্রমহিলার মুখ লাল হয়ে গেল। তিনি মুখ নিচু করে আঁচল দিয়ে মুখ মুছতে লাগলেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।
‘আমরা আপনার বাড়ি যাব, যদি একটু দেখিয়ে দেন।’
শান্তি দৌড়ে গিয়ে স্মৃতি নামের সেই মহিলাকে কী বলে এলেন, তারপর অনুরাধার দিকে ফিরে, চোখ না তুলে বললেন, ‘আসুন।’
হাসপাতালের গেট পেছনে ফেলে, জকপুর রোড পেছনে ফেলে একটা সরু রাস্তার মধ্যে ঢুকলেন ইমনের মা। একটা ছাল-চামড়া ওঠা টালির চালের বাড়ি। ইঁট বার করা সিঁড়ি দিয়ে দাওয়ায় উঠল সবাই। কালো রঙের দরজাটা ঠেলে মহিলা খুব আস্তে গলায় ডাকলেন, ‘ইমন।’
কালো চেক-চেক শাড়ি পরা হিলহিলে ইমন কোমর থেকে পায়ের পাতা অবধি ফ্রেম-আঁটা ভাইকে হাঁটাচ্ছে। সবে এসেছে এই ফ্রেম, জুতো। মুখ তুলেই সে ছবির মতো দাঁড়িয়ে গেল। তার মুখের সব রক্ত কে শুষে নিয়েছে।
একপাশে ইঁটের সারির ওপর বসানো তক্তাপোশ। তার ওপর চৌখুপি কাটা বেডকভার পাতা। তলায় হাঁড়িকুড়ি, শিলনোড়া, বাসনপত্র। কোণে স্টোভ। দেয়ালে দড়ি টাঙানো। তাতে শাড়ি, প্যান্ট, গামছা।
‘তুই অনেক দিন যাসনি ইমন, তোকে অনেক দিন..’ মিঠু কথা শেষ করতে পারল না। ইমনের মুখের সেই পরিচিত হাসি, অভ্যর্থনা এসব সে খুঁজে পাচ্ছে না। ইমন এখনও তাকে বসতে বলেনি। কোনও রকম আনন্দ প্রকাশ করেনি। ইমনের মা তক্তাপোশটা হাত দিয়ে ঝেড়ে বললেন, ‘বসুন আপনারা, আমি যাই, ডিউটি ফেলে এসেছি।’
অনুরাধা সুহাসের দিকে একবার তাকিয়ে কী বুঝলেন তিনিই জানেন, হঠাৎ বললেন, ‘আপনি একটু দাঁড়িয়ে যান মিসেস মুখার্জি। আপনার কাছে আমার একটা জরুরি আর্জি ছিল।’
মা মেয়ে দুজনেই তাকিয়ে তাঁর মুখের দিকে। অনুরাধা বললেন, ‘আমাদের ইচ্ছে আপনার মেয়েটিকে আমাদের ঘরের মেয়ে করে নিই। এই যে আমাদের ছেলে সুহাস। পঁচিশ বছর বয়স ওর। আর্কিটেক্ট। পুনাতে চাকরি করছে। প্রস্তাবটা আজ রেখে গেলাম। আপনি… আপনারা বিবেচনা করে জবাব দেবেন।’
ইমনের মা হঠাৎ কেঁদে ফেলে মুখ ঢাকলেন, ‘ওই মেয়েই সব, মেয়ে ছাড়া তো আমার কেউই নেই।’ তারপর মুখ মুছে ফেলে অন্য দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘পেশেন্ট খুব খিটখিটে। আমি যাই।’ তিনি নিঃশব্দে দরজা দিয়ে বার হয়ে গেলেন।
অনুরাধা বললেন, ‘ইমন, আমার সঙ্গে কথা বলবি না?’
ইমন জোর করে হাসবার চেষ্টা করে বলল, ‘মাসি, আপনাদের জন্যে খিচুড়ি চাপিয়ে দিচ্ছি, এখুনি হয়ে যাবে। প্রেশার কুকার আছে। বসুন।’
‘তুই অত ব্যস্ত হস নি। আমরা একেবারে না বলে-কয়ে হুট করে এসে পড়েছি। স্টেশনের কাছে অনেক হোটেল আছে। কোনও একটাতে খেয়ে নেবো। আমরা চলি রে!’
‘না না, যাবেন না, আমি এখুনি রেডি করে দিতে পারব, সময় লাগবে না।’
মিঠু বলল, ‘আমি ওকে হেল্প করি না মা, চট করে হয়ে যাবে।’
অনুরাধা কী ভেবে বললেন, ‘ঠিক আছে কর। সুহাস আমরা বরং একটু ঘুরে আসি।’ তিনি তাঁর ঝোলা থেকে কমলা, আপেল, আঙুর আর কলকাতার উৎকৃষ্ট সন্দেশের বাক্স বার করে ইমনের ভাইয়ের দিকে এগিয়ে দিলেন, হাসিমুখে বললেন, ‘তোমার নাম কী?’ ছেলেটি তাঁর দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে জবাব দিল, ‘কল্যাণ।’
সুহাসকে নিয়ে তিনি বাইরে বেরিয়ে এলেন। শীতকাল হলে কী হবে, এই ঘিঞ্জি মফঃস্বল টাউনে মাথার পর এখনও প্রখর রোদ। অনুরাধা শালটা মাথায় ঘোমটার মতো করে জড়িয়ে নিলেন। এলাকাটা নীরবে পার হলেন দুজনে। সুহাস বলল, ‘মা কোথায় যাবে? একটা রিকশা নিই। না হলে চিনতে পারব না।’
রিকশায় উঠে অনুরাধা বললেন, ‘কোনও একটা দোকান থেকে একটু ভাজা মাছটাছ যদি পাওয়া যায়।’
সুহাস বলল, ‘ছাড় তো, এই রিকশা ভাই এখানে নদী আছে না একটা।’
‘আছে বাবু।’
‘ওইদিকে নিয়ে চলো তো, একটু ঘুরব।’
খানিকটা ঘুরিয়ে রিকশা-অলা বলল, ‘ওই দেখুন বাবু, ওপারে কলাইঘাটা, রামকৃষ্ণ ঠাকুর এসেছিলেন। পালচৌধুরীদের বাড়ি দেখবেন?’
সুহাস বলল, ‘নাঃ। মা… এভাবে না বলেকয়ে আসাটা আমাদের খুব অন্যায় হয়ে গেছে।’
‘অনুরাধা শুধু বললেন, ‘হুঁ।’
একটু পরে সুহাস বলল, ‘মা!’
‘বল্।’
‘তোমার কি আপত্তি হচ্ছে এখন?’
‘আমার? আপত্তি? সুহাস আমার আপত্তি নেই, আপত্তির কোনও অধিকার আছে বলেও আমি মনে করি না। কিন্তু ইমন কেন এমন ব্যবহার করল? ওর যে সরল সহজ চেহারাটা আমার চেনা আছে সেটা যেন ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে…’ অনুরাধার মুখে বেদনার চিহ্ন, তিনি বললেন, ‘ওর মায়ের তো খুব স্পষ্টই আপত্তি। শুনলি তো। মেয়েটা আসলে ওঁর একমাত্র অবলম্বন। সুহাস আমি বুঝতেই পারছি না তুই কী করে অ্যাট অল…’
দুজনে একটা রাস্তার ধারের দোকান থেকে অনেক কষ্টে কিছু মাছ ভাজিয়ে নিতে পারলেন, বাজার বন্ধ, তবু ধরাধরি করে এক গোছা কলাপাতা। ঘণ্টা দেড়েক পরে যখন ফিরলেন তখন তক্তাপোশের একপাশে শুয়ে ইমনের ভাইটি ঘুমিয়ে পড়েছে। তার অসহায় পা দুটোর ওপর কম্বল চাপা। ইমন ঘরের মেঝে ভালো করে মুছে ফেলেছে। খিচুড়ির গন্ধ বেরোচ্ছে।
মেঝেতে শতরঞ্চি বিছিয়ে, কলাপাতায় খিচুড়ি বেগুনভাজা আর মাছভাজা পরিবেশন করল মিঠু আর ইমন। অনুরাধা বললেন, ‘ইমন তুমি বসবে না? কল্যাণ বসবে না?’
‘আমাদের তো অনেকক্ষণ খাওয়া হয়ে গেছে মাসি!’ এইবারে ইমন একটু লাজুক হাসল।
‘ওমা, তাও তো বটে। বেলা তো অনেক। ইসস, এত মাছ ভাজাটাজা এ কি আমাদের জন্যে এনেছি নাকি? রেখে দাও ইমন, রাতে খেও। খাবে কিন্তু ঠিক।’
খেয়ে-টেয়ে উঠে অনুরাধা বললেন, ‘আমরা এগোই ইমন, যত তাড়াতাড়ি ট্রেন ধরতে পারি ততই ভালো। তোমাকে খুব কষ্ট দিলুম। শুধু শুধু।’ ইমন মুখ তুলে অনুরাধার দিকে চাইল। তার চোখ দুটো যেন কী বলতে চাইছে। ভীষণ দুরূহ কিছু। বলতে পারছে না।
মিঠু বলল, ‘ফিরে আমাদের বাড়ি যাস। ওখান থেকেই পরীক্ষাটা দিলে খুব ভাল হবে। দুজনেরই সুবিধে হবে। যাস ইমন!’ ইমন ম্লান হেসে মিঠুর হাতটা ধরল শুধু।
কিন্তু কলকাতায় ফিরে তো ইমন মিঠুদের বাড়ি গেল না! হোস্টেল থেকেই পরীক্ষা দিল। তা দিক। কিন্তু গেল না তো একবারও! পরীক্ষার সময়ে একেবারে হলে দেখা হল। তখন মিঠুর নিজেরও মাথার মধ্যে গজগজ করছে পড়া, ইমনও একটা লম্বা খাতা নিয়ে চুপচাপ। কেমন হচ্ছে, কীরকম প্রশ্ন এসেছে এই সবই কথা হল। শেষ পেপারটার পর মিঠু খুব তাড়াতাড়ি উজ্জয়িনীর সঙ্গে বাড়ি ফিরে গেল। বেশ খানিকটা যাবার পর তার মনে হল, যাঃ ইমনের সঙ্গে তো দেখা করে আসা হল না! কিন্তু তখন আর ফেরবার সময় নেই।
পরীক্ষার পর মাথাটা অবকাশ পেয়েছে অনেকটা। এখন সামনে লম্বা ছুটির দিন। ওরা সবাই পুনে যাচ্ছে দাদার কোয়ার্টার্সে। লম্বা প্রোগ্রাম। মহাবালেশ্বর, গোয়া, কেরালার উপকূল। সুটকেস গোছাতে গোছাতে মিঠুর হাত দুটো হঠাৎ শ্লথ হয়ে যায়। ইমন কি খুব রাগ করেছে? কেন? তারা যেন রূঢ় হাতে পর্দা সরিয়ে ওদের তিনজনের ঘরে উঁকি দিয়েছে। ইমন যেন ক্ষুব্ধ, অপমানিত। সেদিন ওদের বাড়িতে মা আর দাদা চলে যাওয়ার পর মিঠু যতই সহজ হতে গেছে, ইমন হয়ে গেছে ততই আড়ষ্ট, অস্বচ্ছন্দ। কী এমন ঘটল! বিয়ের প্রস্তাবের জন্যেই কি ও লজ্জা পেল? না কি তাদের ওখানে যাওয়াটাই অনধিকার প্রবেশ! আসবার সময়ে ইমন জোর করে মুখে হাসি টেনে এনে বলল, ‘আচ্ছা।’ শোনাই যায় না এমন। সে কারও দিকে তাকাল না। পরে মা দাদাকে বলল, ‘তোর আগে মেয়েটার মন বুঝে নেওয়া উচিত ছিল। দেখ তো কী বিশ্রী হল! এ কি ছেলেখেলা?’