একুশে পা (Ekushey Paa) : 17
আমাদের ওপর স্যাক্রিফাইসের খাঁড়াটা না নামলেই হচ্ছে না।
‘সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে আর তোরা এখানে গজল্লা করছিস?’ ভেঙ্কট হাতের খাতা উঁচু করে ঝড়ের মতো ঘরে ঢুকল। পার্ট ওয়ান পরীক্ষার পর থেকে ওদের দেখাশোনা কমে গেছে। তবে ক্লাস আরম্ভ মোটামুটি একই সময়ে। তাই চোখের দেখা হয়। পাঁচ নম্বর ঘরে আজ ক্লাস হচ্ছিল না। ওরা অনেকেই বসে গল্প করছিল। হলে ঢুকেই দেখতে পেয়েছে ভেঙ্কট। ধেয়ে আসছে। দেখে উজ্জয়িনী বলল, ‘দফা সারল।’
ভেঙ্কট ঢুকে দাঁড়িয়েছে চ্যালেঞ্জের ভঙ্গিতে। মিঠু বলল, ‘আমরা মোটেই গজল্লা-মজল্লা করছি না। আমরা সিরিয়াস টক করছি।’
‘তোরা? সিরিয়াস টক? সাহিত্যের ছাত্রীরা? হাঃ’, ভেঙ্কট ডান হাতটা সামনে প্রসারিত করে দিল, ‘তোরা প্রেম, মান-অভিমান, কি বড়জোর একটু রাগারাগির গল্প করবি। বানানো সব গপ্প। রিয়্যালিটির সঙ্গে তোদের সম্পক্ক কী রে?’
‘ভালো হবে না ভেঙ্কট’, মিঠু বলল, ‘আমরা সাহিত্যের, তোরা তবে কিসের?’
‘আমরা সায়েন্স। পলিটিক্যাল সায়েন্স’, খুব গর্বের সঙ্গে বুক ঠুকে ভেঙ্কট বলল।
‘আমাদের রিয়্যালিটির সঙ্গে সম্পর্ক নেই কে বললে?’ উজ্জয়িনী গম্ভীর মুখে বলল।
‘সম্পর্ক থাকলে ভাই হাহুতাশ করতে যে সেই গেল তো দুদিন আগে গেল না কেন সোভিয়েতটা, কনস্টিট্যুশনটা আর পড়তে হত না।’
গৌতম পেছনেই ছিল, বলল, ‘তাহলে তো ভারতবর্ষটা টুকরো টুকরো হয়ে গেলে আরও ভালো হয় রে! ইন্ডিয়ান কনস্টিট্যুশনও পড়তে হয় না!’
মিঠু উৎসাহিত হয়ে বলল, ‘ঠিক বলেছিস। ঠিক বলেছিস। তবে কী জানিস। কত গোর্বাচভ যাবে। কত গোর্বাচভ্ আসবে, কত সোভিয়েত ভাঙবে, কত সোভিয়েত গড়বে কিন্তু মিলটন, সেক্সপীয়ার, ডান, এলিয়ট, এইসব রাইটাররা চিরকাল, চিরটা কাল থাকবে। তো আমরা তাদেরই স্টাডি করছি। তোদের সিলেবাসের অংশ চিরকালের মতো কালের অতলে হারিয়ে গেল। শত শত সাম্রাজ্যের ভগ্নশেষ পরে, আমাদের সাহিত্য ঠিক কাজ করে যাচ্ছে।’
‘তোরা তোদের এলিটিস্ট সাহিত্য নিয়ে থাক নাক-উঁচু করে, আমরা ভাঙা-গড়ায় মোর ইনটরেস্টেড’, ভেঙ্কট বলল।
অণুকা বলল, ‘এই ভেঙ্কট চুপ কর না, সন্তোষের বাবা আজ প্রায় এক বছর হতে চলল নিখোঁজ। জানিস? এই রিয়্যালিটিটা জানিস!’
‘সে কী? কেন?’ ভেঙ্কট মুখ হাঁ করে খাতা গুছিয়ে বসে পড়ল।
মিঠু বলল, ‘ও তো গোড়ার দিকে সেই কয়েক মাস ক্লাস করেই অ্যাবসেন্ট হতে লাগল, মাঝে মাঝে যখন আসত, জিজ্ঞেস করলে এড়িয়ে যেত। শরীর খারাপ, মায়ের শরীর খারাপ এই সব বলত। তারপর তো একেবারেই বন্ধ করে দিল আসা। আমাদেরই অন্যায়, খোঁজ নেওয়া উচিত ছিল, পরীক্ষাতেও বসল না। কদিন আগে দেখি শুকনো মুখে কলেজে এসেছে, এবারে দেবে পরীক্ষা, খোঁজখবর করতে এসেছে। বলল, নাকি চাকরি করছে।’
গৌতম বলল, ‘চাকরি? আন্ডার গ্র্যাজুয়েট একটা মেয়ে কী চাকরি পাবে? করছেই বা কেন! আগরওয়াল তো ওরা? টাকার গদীর ওপর বসে থাকে।’
‘ওরকম বাইরে থেকে মনে হয়,’ অণুকা বলে উঠল, ‘ওরা এমন কিছু ওয়েল-অফ ছিল না। বাবা বিজনেস করতেন, বাবার ইনকামই সব।’
‘হ্যাঁ। তো সেই বিজনেসের ইনকামটা কী কম?’ গৌতম ঝাঁঝিয়ে উঠল।
মিঠু বলল, ‘আসল কথাটা শোন না। আমরা যখন এইচ এস-এর ফাইন্যাল দিচ্ছি তখন সন্তোষের দিদি ভিজয়ের বিয়ে হল। ওদের জানিস তো, মেয়ের বিয়েতে সাংঘাতিক খরচ। লাখ-লাখ টাকা শুধু ডাউরি দিতে হয়। সন্তোষের বাবা বোধ হয় সবই দিয়েছিলেন খালি ওরা একটা ফ্ল্যাট চেয়েছিল অন্তত দেড় হাজার স্কোয়্যার ফুটের, তো সেইটে দোব দোব বলে দেননি। মানে দিতে পারেননি আর কি!’
ভেঙ্কট বলল, ‘লাখ লাখ টাকা পণ, আবার ফ্ল্যাট? আই ব্বাপ। তো তারপর?’
মিঠু বলল, ‘ভিজয়কে ওরা ভীষণ খোঁটা দিত, মারধর করত। ভিজয় আত্মহত্যা করে। তারপর ওর বাবা কেমন হয়ে যান। একদিন কাউকে কিছু না বলে কোথায় চলে গেছেন। আজও হাজার থানা পুলিশ করেও ওরা কোনও খবর পায়নি। বিজনেস গুটিয়ে ফেলেছে, অ্যাসেটস বিক্রি করে দিয়েছে। সন্তোষরা তো তিন বোন, সবচেয়ে ছোট ভাই। সন্তোষ তাই রিসেপসনিস্টের চাকরি নিয়েছে।’
ভেঙ্কট বলল, ‘স্যাড। ভেরি স্যাড। আচ্ছা আমরা ছাত্র-ছাত্রীরা একটা “সেল” করতে পারি না। যেখানেই ডাউরির ব্যাপার আছে খবর পেলেই চলে যাব, আর আচ্ছা করে প্যাঁদানি দোব!’
গৌতম বলল, ‘হ্যাঁ তোর এবার ওইটেই বাকি আছে। সবার সব করছিস তো, এবার লার্জ-স্কেল সোশ্যাল-ওয়ার্কে নেমে পড়। পুলিশকে ছুটি দিয়ে দে। কোর্ট-ফোর্ট উকিল-ব্যারিস্টার এদেরও ছুটি করে দে।’
রাজেশ্বরী বোধ হয় অনেকের জটলা দেখেই পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিল। শেষ কথাগুলো তার কানে গিয়েছিল। সে বলে উঠল, ‘তা যদি বলিস গৌতম আমাদের আত্মপ্রসাদের মোড়ক খুলে নিজেদের একটু বহির্বিশ্বে বার করে আনারও দরকার আছে। চতুর্দিকে করাপশন, ঘুষ-ঘাষ আর ব্ল্যাক-মানির ফোয়ারা ছুটছে, কেউ কাজ করে না, এদিকে আসামে, ত্রিপুরায়, পাঞ্জাবে, কাশ্মীরে কী হচ্ছে বল। সমস্ত দেশটা রক্তে স্নান করছে, আর আমরা বছরের পর বছর বইপত্তর ব্যাগে করে প্রাণপণে ইস্কুল করে যাচ্ছি। কানে গুঁজেছি তুলো আর পিঠে বেঁধেছি কুলো।’
‘তাহলে কি করব বল?’ গৌতম ফিরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘কিছু মনে করিস না রাজেশ্বরী কিছু পলিটিক্যাল লোচ্চা নিজেদেরটা গুছিয়ে নেবার জন্যে খুনোখুনি মারামারিতে মাতিয়ে দিয়েছে দেশটাকে। সেই ফাঁদে পড়ে, আমরা নিজেদের কেরিয়ার-টেরিয়ার সব ফেলে গাধার মতো দৌড়ব দেশ সামলাতে?’
‘রাজেশ্বরী বলল, ‘তাই বলে এই রকম উদাসীন হব? জাস্ট আমাদের টাচ করছে না বলে ব্যাপারগুলো! পাঞ্জাবের পরিবারের পর পরিবার খতম হয়ে যাচ্ছে, কাশ্মীরে …’
গৌতম উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘উদাসীন হব। হ্যাঁ হ্যাঁ, একশবার উদাসীন হব। আমাদেরও বাবা-মা-ভাই-বোন আছে। আমরা এই ইঁদুর-দৌড়ে জিততে না পারলে আমাদের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পুরো পরিবারগুলো ধসে পড়বে। বন্দুক ছুঁড়ে মেরে ফেলতে হবে না। স্রেফ না খেয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে শেষ হয়ে যাবে। হুঁঃ, পাঞ্জাবে সন্ত্রাস। ওসব বিপ্লবের বিলাস করার সময় যাদের আছে তারা করুক। স্বাধীনতার পর নেহরু-গভর্মেন্টের মদতে গ্রীন রেভোল্যুশন কোথায় সম্ভব হয়েছিল রে? বিভক্ত বাংলায় নয়, বিভক্ত পাঞ্জাবে, মাথা-পিছু আয় পাঞ্জাবে সবচেয়ে বেশি। পাঞ্জাবের চাষী যে স্ট্যান্ডার্ড অফ লিভিং পেয়েছে ভারতবর্ষের কোথাও কেউ পায়নি, এত কিসের রে? শুধু শুধু খলিস্তান-খলিস্তান করে ক্ষেপে উঠেছে!’ রাজেশ্বরী লাল মুখে বলল, ‘যতই যাই বলিস, আমরা ছাত্ররা ভয়ানক স্বার্থপর।’
‘চেঞ্জ ফর দা বেটার’, গৌতম হাঁকড়ালো, ‘বারীন ঘোষ, উল্লাসকর, ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী। ওই তোদের মাতঙ্গিনী হাজরা। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, সূর্য সেন—সব কী পেয়েছে রে? কী পেয়েছে তাদের পরিবার, পরের জেনারেশন? বেরিড, বেরিড, এখন তো সবাই বলে মহাত্মা গান্ধী আর কংগ্রেসই স্বাধীনতা সম্ভব করেছে। বেরিড, বেরিড, দোস ব্রেভ সোল্স্ হ্যাভ বীন বেরিড ফর এভার অ্যান্ড এভার।’
রাজেশ্বরী বলল, ‘একটা দেশকে শুধু সঠিক পথে চালনা করতে গেলেই কতজনের স্যাক্রিফাইস দরকার হয়, তার স্বাধীনতা!’
‘তা স্যাক্রিফাইসটা এই পলিটিকসের লোকগুলো করুক না কেন? নেপোর দল যত সব। সামনে পেছনে সানাইয়ের পোঁ অলা গাড়ি, লাখ লাখ টাকা ইলেকট্রিক আর টেলিফোনের বিল, গোষ্ঠীবর্গ নিয়ে যখন তখন সুসম্পর্ক রক্ষার্থে বিদেশ সফর। আত্মীয়-স্বজন যে-যেখানে সুনজরে আছে সাতপুরুষের বসে-বসে খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া—এগুলো বাদ দিক, কি একটু কমাক। আমাদের ওপর স্যাক্রিফাইসের খাঁড়াটা না নামালেই হচ্ছে না?’
‘আচ্ছা বাবা আচ্ছা, করিসনি কিচ্ছু। তোকে কিছু করতে বলছি না। হাতজোড় করছি’, রাজেশ্বরী রণে ভঙ্গ দিল।
গৌতম বলল, ‘করব না নয়। করব। তোরা যতটা বিলাস-ব্যসনের পেছনে ছুটবি, বাজি রেখে বলতে পারি আমি তার চেয়ে কম ছুটব। যা সুযোগ, যেটুকু—আমার চারপাশে আছে, কেঅস, সবটাই কেঅস, এই কেঅস থেকে যদি নিজেকে একটা সফল মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারি। সেটাই আমার দিক থেকে দেশকে দেওয়া হবে। একটা সৎ, বুদ্ধিমান, যুক্তিপরায়ণ, ন্যায়নিষ্ঠ নাগরিক। বল রেয়ার কিনা। তা সেই রেয়ার জিনিসটাই আমি আমার দেশকে দিতে চাই। মিছিল, স্লোগান, হঠাৎ হঠাৎ সব ঝটিকা প্রোগ্রাম, পদযাত্রা আর বড় বড় আলোচনা—এ সবেতে আমার ঘেন্না, ঘেন্না ধরে গেছে। কত বোকা এদেশের লোক তাই ভাবি যে দিনের পর দিন ধোঁকা খেয়ে যাচ্ছে।’
মিঠু এবার হাত নেড়ে বলল, ‘তোরা চুপ করবি? এই গৌতম, এই রাজেশ্বরী। এই অবস্থায় সন্তোষকে আমরা কিভাবে সাহায্য করতে পারি!’ রাজেশ্বরী কিছু জানে না। সে মিঠুর কাছে গিয়ে বসে অবহিত হল। ভেঙ্কট বলল, ‘সন্তোষের তো অনার্স নেই। সুদ্দু তিনটে পাস সাবজেক্ট। আমরা আমাদের নোটস ওকে সাপ্লাই দিতে পারি। সে ক্ষেত্রে ওর কলেজে আসার সময়টা বেঁচে যাবে। চাকরি করতে হচ্ছে যখন।’
মিঠু বলল, ‘ঠিক বলেছিস। রাজেশ্বরী যাবি আজ সন্তোষদের বাড়ি?’
রাজেশ্বরী বলল, ‘আমার একটা মিটিং আছে। আচ্ছা চল। সন্তোষের বাড়ি থেকে সোজা চলে যাব। ক্লাসগুলো হয়ে যাক।’
যে যার ক্লাসের খোঁজে চলে গেল। রাজেশ্বরী একটু এগিয়ে গেছে ভেঙ্কটেশ গৌতমের কাঁধে চাপড় মেরে বলল, ‘ব্রাভো গুরু, কী দিলে?’
গৌতম বলল, ‘এই পলিটিকস-করা ছেলেমেয়েগুলোর লম্বা লম্বা কথা শুনলে মাইরি আমার গা জ্বালা করে। স্যাক্রিফাইস? থেকেছিস কখনও বাবা-মা-দিদির সঙ্গে এক ঘরে? খেয়েছিস দিনের পর দিন মাছের বালাই শূন্য লাঞ্চ ডিনার? পড়েছিস হাটের মাঝ-মধ্যিখানে?’
ভেঙ্কটেশ বলল, ‘গুরু তুমি জিতলে, দেখলুম। কিন্তু পরাজয়ও কী সুন্দর! হেরে মেয়েটা তোমাকে ল্যাং মেরে বেরিয়ে গেল।’
গৌতম বলল, ‘ভ্যাট? আচ্ছা তো তুই?’
‘কুল’টা দেখলে? কী কা-মা! তুমি উত্তেজিত, কিন্তু ও ভাষা দিচ্ছে, আবেগের কাছে আত্মসমর্পণ করছে না, এমনকি জয়পত্রটা তুলে দিল তোমার হাতে কী গ্রেসফুলি!’
গৌতম হেসে ফেলে চড় তুলে বলল, ‘মারেগা এক …’
ভেঙ্কট দ্রুত তার নাগালের বাইরে চলে যেতে যেতে বলল, ‘যতই মারো আর ধরো ইয়ার, রাজেশ্বরী ইজ রাজেশ্বরী। তুমি ওর নাগাল পাচ্ছ না।’
‘নাগাল পাওয়ার চেষ্টা করতে আমার বয়ে গেছে।’
‘তাহলে তুমি অত বাতেল্লা দিচ্ছিলে কেন? কোনদিন তো তোমায় অত একসাইটেড হতে দেখিনি!’
‘তুই কি ভাবছিলি আমি ওকে ইমপ্রেস করবার চেষ্টা করছিলুম! ওঃ ভেঙ্কট তোর মাথাটা এক্কেবারে গেছে।’
ক্লাসে পৌঁছে ঠিক রাজেশ্বরী পেছনে বসে গৌতম সারাক্ষণ টিপ্পনি কাটতে থাকল, ‘এই রাজেশ্বরী ভেঙ্কটরমণ তোর বক্তৃতায় মাত হয়ে গেছে।’ রাজেশ্বরী মুখটা একটু কাত করে বলল, ‘বক্তৃতা তো তুই দিলি, আমি আর কী দিলুম?’—‘ওইতেই মাত। একেবারে মস্ত্!’ ভেঙ্কট চিমটি কাটছে, ‘উঃ’ গৌতম চাপা গলায় বলে উঠল, ‘রাজেশ্বরী, সত্যি-কথা ফাঁস করে দিচ্ছি বলে ভেঙ্কট আমায় চিমটি কাটছে।’ রাজেশ্বরী বলল, ‘কী সত্যি কথা?’—‘ওই যে ভেঙ্কট মস্ত্ হয়ে আছে!’ ভেঙ্কট আরেকটা চিমটি কাটতে গৌতম সরবে চেঁচিয়ে উঠল, ‘উঃ।’
নন্দিতাদি লেকচার থামিয়ে বললেন, ‘ওন্ট ইয়ু এভার বী সিরিয়াস?’
গৌতম বলল, ‘ম্যাডাম, রাম-চিমটি কেটেছে, রাম-চিমটির ইংরিজি কী আমি জানি না।’
নন্দিতাদি বললেন, ‘ভেঙ্কট, অ্যায়াম সরি। বাট প্লিজ গেট আউট অফ দা ক্লাস।’
ভেঙ্কট হাত জোড়া করে উঠে দাঁড়াল, ‘এবারের মতো মাফ করে দিন ম্যাডাম। বড্ড ক্ষতি হয়ে যাবে। ব-ড্ড ক্ষতি হয়ে যাবে।’ ক্লাস-সুদ্ধ চাপা হাসি হাসছে তার রকম দেখে। নন্দিতাদি চেষ্টা করে হাসি চেপে বললেন, ‘অল রাইট। সিট ডাউন প্লিজ অ্যান্ড ডোন্ট ডিসটার্ব দা ক্লাস।’
ক্লাসের শেষে রাজেশ্বরী হেসে বলল, ‘উঃ ভেঙ্কট। তুমি হলে ক্লাসের প্রাণ, তন্ময় অবশ্য মাথা কিন্তু ডেফিনিটলি তুমি হচ্ছ প্রাণ।’ সে বেরিয়ে যেতে ভেঙ্কট নিজের বুকে হাত রেখে বলল, ‘আর তুমি? তুমি হলে হৃদয়।’
তন্ময় পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল। ভেঙ্কটের ফচকেমি আজকাল আর ভালো লাগে না তার। আরেকটা ক্লাস আছে এক পিরিয়ড পরে। সে লাইব্রেরিতে গিয়ে বসল ডে-কার্ডে একটা গল্পের বই নিল। বাংলা গল্পের বই—কমলকুমার মজুমদার। অদ্ভুত ধরনের বাংলা লেখেন ভদ্রলোক। দুস্তর কিছু পার হবার একটা মজ্জাগত বাসনা আছে তন্ময়ের। সেইজন্য অন্যান্য সহজবোধ্য, সুখপাঠ্য বই ফেলে কমলকুমার নিয়ে বসেছে। আজকাল সহপাঠীদের সঙ্গ একেবারে ভালো লাগে না। বিষ্ণুপ্রিয়া থার্ড ইয়ারের ক্লাস আরম্ভ হয়ে থেকে আসছে না। ভর্তি হয়ে আছে কিন্তু আসছে না। তার সঙ্গে দেখা হবার উপায় নেই। কী এক মধ্যযুগীয় বাড়ি! সহপাঠী সে পুংলিঙ্গ হলেই নো অ্যাডমিশন। এরকম আজকালকার দিনে শিক্ষিত পরিবারে হয়? বিষ্ণুপ্রিয়া আসছে না, কিন্তু সে সযত্নে তার জন্য দরকারি ক্লাস নোটস জিরক্স করে রাখছে। কবে রেজাল্ট বেরোবে কে জানে! ক্লাসের আরও কেউ-কেউ আসছে না। রেজাল্ট বার না হলে আসবে না বোধ হয়। তন্ময়ের পরীক্ষা খুব ভালো হয়েছে। প্রিয়া কী রকম দিল কে জানে? পরীক্ষার আগে দু-একদিন দেখা হয়েছে লাইব্রেরিতে। খুব ব্যস্ত হয়ে বই খুঁজতে লেগে গেছে বিষ্ণুপ্রিয়া। আবার কখনও তাকিয়ে ফিকে হেসেছে, ‘ভালো আছ?’ ব্যাস। অ্যাতো রাগ! তন্ময়ের এমন অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল বিষ্ণুপ্রিয়ার পাশে থাকাটা যে এখন কেমন ফাঁকা-ফাঁকা একা-একা লাগে।
শেষ ক্লাসটা হয়ে যাবার পর সে হঠাৎ ঠিক করল বিষ্ণুপ্রিয়ার বাড়ি যাবে খোঁজ করতে। একজন বন্ধু আরেক জনের খোঁজ করছে। বিশেষ করে সে দীর্ঘদিন কলেজ যাচ্ছে না বলে।
বাড়িটার সামনে এসে একবার ইতস্তত করে বেলটা বাজাল তন্ময়, ভেতরে ঝনঝন করে একটা রাক্ষুসে আওয়াজ হল, এত জোর যে বাইরে দাঁড়িয়েও তন্ময় চমকে গেল। দরজাটা খুলে গেল। কোমরে ধুতির খুঁট কষে বাঁধা একটি লোক, ‘বিষ্ণুপ্রিয়া বাড়ি আছে?’
‘বিষ্ণুপ্রিয়া? ও বুড়ি? আপনি কে?’
‘কলেজ থেকে এসেছি। ও যায় না, প্রোফেসররা খোঁজ করছেন।’ বয়স্ক কাজের লোকটিরও কেমন একটা দৃঢ়, রক্ষণশীল ব্যক্তিত্ব, অজান্তেই তন্ময়ের মুখ দিয়ে মিথ্যা কৈফিয়ত বেরিয়ে এলো।
লোকটি তাকে একটা বৈঠকখানা ঘরে এনে বসালো। পুরনো কালের তক্তাপোশের ওপর জাজিম বিছেনো। কিছু সোফা-কৌচ, গদি-দেওয়া কাঠের চেয়ার। শ্রীরামকৃষ্ণ আর সারদা দেবীর ছবি। শ্রীঅরবিন্দর ছবি-ওলা একটি ক্যালেন্ডার। মাথার ওপরে বিরাট হাণ্ডাঅলা আগেকার ডি সি ফ্যান।
‘তুমি?’ দরজার সামনে বিষ্ণুপ্রিয়া এসে দাঁড়িয়েছে। একটা লম্বা চেক-চেক স্কার্ট। দুদিকে দুটো বেণী। বিষ্ণুপ্রিয়া যেন বাচ্চা স্কুলের মেয়ে।
‘কী ব্যাপার তোমার? কলেজে যাও না!’ তন্ময় বলল কোনরকমে। বিষ্ণুপ্রিয়ার উপস্থিতিতে সে যেন হঠাৎ জমে গেছে। তার ভেতরে রক্তস্রোত সব কিসের প্রতীক্ষায় জমে অনড় হয়ে গেছে।
বিষ্ণুপ্রিয়া সামনের চেয়ারে বসল। বলল, ‘রেজাল্ট না বেরোলে গিয়ে লাভ? হয়ত অনার্স পাব না।’
‘ক্লাস কিন্তু ভালোই আরম্ভ হয়ে গেছে। তুমি মুশকিলে পড়বে। অনার্স পাবে না বলছ কেন? ভালো হয়নি?’ থেমে থেমে তন্ময় বলল।
‘ভালো মন্দ কিছু বুঝতে পারিনি। লেখার কথা লিখে দিয়ে এসেছি।’
‘তার মানে ভালোই হয়েছে। —এত রাগ করে আছ কেন?’
‘রাগ?’ বিষ্ণুপ্রিয়া হঠাৎ ভীষণ অপ্রস্তুত মুখে তার দিকে চাইল। বলল, ‘রাগ করে নেই তো!’
‘প্রিয়া একদিন একটু এসো, অনেক কথা বলার ছিল। প্লিজ।’
বিষ্ণুপ্রিয়া হঠাৎ বলে উঠল, ‘ও মা, এখনও তোমার চা আনল না।’
সে দৌড়ে ভেতরে গেল। সঙ্গে মাকে নিয়ে ঢুকল। তার হাতে একটা ট্রে। তার সামনে টেবিলের ওপর ট্রে-টা নামিয়ে রেখে বিষ্ণুপ্রিয়া হেসে বলল, ‘সব খেতে হবে কিন্তু।’
‘মা এ আমাদের কলেজের সবচেয়ে ভালো ছেলে। তন্ময় হালদার।’
বিষ্ণুপ্রিয়ার মা হঠাৎ অবাক হয়ে বললেন, ‘ও মা!’ তিনি মেয়ের সঙ্গে চোখাচোখি করে হাসলেন। বললেন, ‘খাও বাবা।’
‘আমি এত খাই না,’ প্লেটের দিকে কুয়াশাচ্ছন্ন চোখে চেয়ে তন্ময় বলল।
বিষ্ণুপ্রিয়া বলল, ‘চালাকি করবে না, সব খেতে হবে। জানো মা, ও খুল ভালো রান্না করতে পারে। সব রকম!’
‘ওমা’, বিষ্ণুপ্রিয়ার মা বললেন। চা আনল প্রৌঢ় চাকরটি। বিষ্ণুপ্রিয়ার মা সামনে বসে খাওয়ালেন। ‘কী তোমার মতো হয়েছে?’ জিজ্ঞেস করলেন হেসে। তন্ময় বলল, ‘এসব তো আমি পারি না, পাটিসাপটা, মাছের চপ এসব? অসম্ভব!’ সে চায়ে চুমুক দিল।
বিষ্ণুপ্রিয়ার মা বললেন, ‘ও মাঃ!’ তিনি হেসে উঠলেন, যেন তন্ময় খুব হাসির কথা বলেছে। তন্ময় বলল, ‘তুমি কি কিছু নোট রাখবে বিষ্ণুপ্রিয়া?’
‘দাও।’ বিষ্ণুপ্রিয়া হাত বাড়াল।
তন্ময় বলল, ‘কিছু-কিছু জেরক্স করিয়ে রেখেছি। এটা কিন্তু নেই। সপ্তাহখানের মধ্যে দিতে পারবে তো? না, ধরো দিন দশেক!’
‘হ্যাঁ’, বিষ্ণুপ্রিয়া মাথা হেলালো।
দিন চারেক পরে। বোন বলল, দাদা তোর একটা রেজিস্টার্ড পার্সেল এসেছে।
‘রেজিস্টার্ড পার্সেল? আমার? অবাক হয়ে পার্সেলের দড়িগুলো ছুরি দিয়ে কাটতে লাগল তন্ময়। ভেতরে সযত্নে প্যাক করা তার সেই নোটস। তন্ময় খুঁজতে লাগল কোথাও যদি আর একটাও কাগজ থাকে, ছোট্ট একটা চিরকুট। নাঃ। আর কিছু নেই। কিচ্ছু নেই।
নোটগুলো হাতে করে চুপচাপ নিজের পড়ার চেয়ারে বসে রইল তন্ময়। তার ভেতরটা যেন হঠাৎ কে কিসের কাঠি ছুঁইয়ে স্তব্ধ করে দিয়েছে। মানে কী? কি মানে এর? রাগ? অভিমান? না বিতৃষ্ণা! ক্রমশই বইয়ের থাক, সব রকমের তত্ত্ব, মা-বাবা-বোনের কথাবার্তা, বন্ধুদের সংসর্গ সবই তন্ময়ের একদম অর্থহীন মনে হতে লাগল। নিজের ওপর তার একটা ভীষণ বিতৃষ্ণা বোধ হতে লাগল। এমন কী কঠিন অভিমান যা সে ভেদ করতে পারবে না! কমলকুমারের বাংলার চেয়ে দুর্বোধ্য, দুঃসাধ্য হয়ে গেল বিষ্ণুপ্রিয়ার মান ভাঙানো!