Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

ঘর ছেড়ে আকাশের তলায় বেরিয়ে আসতে পারলেই মনের সংকীর্ণতা অনেকটা কেটে যেতে পারে। মুক্ত থেকেই তো মুক্তি শব্দটা এসেছে। দেহ একটা খাঁচা। সেটা আবার ঝুলছে কোথায়? পাঁচ দেয়ালের কুঠরিতে। তার নাম ঘর। দেয়ালে ছোপ ধরে আছে। বহুদিনের, বহুজনের বেঁচে থাকার দুঃখ, সুখ, কামনা, লালসা, বিশ্বাস, অবিশ্বাস, সংস্কার, কুসংস্কার। কত কী কাটলে তবে মানুষ মুক্ত হতে পারবে। মুক্তি কি মুখের কথা? মুক্তি শব্দটার মধ্যে মুক্তি নেই। কঠিন একটা যুক্তাক্ষর। মুক্তি, যুক্তি, বন্ধন, নিষ্কৃতি, ভক্তি, শক্তি সবই কঠিন শব্দ। এই কাঠিন্যই বোঝাতে চাইছে, পথ দুর্গম। মুক্তি যুক্তিতে নেই, ভক্তি শক্তিতে নেই, বন্ধন রজ্জুতে নেই, সব আছে মনে। খাঁচার দরজাটা খুব ছোটো কিন্তু একবার খুলতে পারলেই একেবারে গায়ে গায়েই লেগে আছে মহাকাশের ঠিকানা। তামাশাটা এই, বন্ধনে প্রবেশ আর মুক্তিতে প্রকাশের পথ খুবই সংকীর্ণ। একটা ফোকরের মতো। এপাশে অন্ধকার ওপাশে আলো।

বন্ধনের একটা তামসিক আলস্য আছে। মায়া আছে। ঠাকুর, আপনার সেই উপমা। মাছ আর জাল। কিছু মাছ জালে পড়া মাত্রই লাফিয়ে পালায়। এরা হল নিত্যসিদ্ধের থাক। মানুষের মধ্যে এঁরা হলেন নারদাদি ভক্তের দল। সংসারে আবদ্ধ হন না। কিছু মাছ পালাতে পারেনি, জালে আটকে পড়েছে; কিন্তু ধপাং ধপাং করছে। পালাবার, মুক্ত হওয়ার ভয়ংকর প্রচেষ্টা। অর্থাৎ এরা মানুষের মধ্যে মুমুক্ষুর থাক। বেঁধেছ বটে তবে সেই বন্ধন থেকে যেভাবেই হোক মুক্ত হতে হবে। আর কিছু মাছ জাল মুখে করে চোঁচোঁ একেবারে পুকুরের গভীর পাঁকে গিয়ে আরামসে শুয়ে পড়ে, ভাবে বেশ আছি। এরা হল বদ্ধজীবের উপমা।

বেশ আছি! আপনি দিলেন উটের উপমা। উট কাঁটাগাছের পাতা খায়। দু—কষ বেয়ে রক্ত ঝরছে। সেইটাই উটের সুখ। বদ্ধজীব মুক্ত হতে ভয় পায়। মুক্তি, সে এত উদার, যে অতটা অনেকেরই সহ্য হয় না। বন্ধনের প্রথম দান, ভয়। বেশ বড়ো মাপের একটা ইঁদুরকলে আমাদের চির বসবাস। সেইখানেই জন্ম, সেইখানেই মৃত্যু। কী দিয়ে তৈরি এই কল? সংস্কার আর অভ্যাস। কেউ আমাকে বন্দি করেনি। আমি নিজেই নিজেকে বন্ধনে ফেলে রেখেছি। সমুদ্রতীর থেকে দেখায় কোনো আতঙ্ক নেই। অন্তহীন মাঝসমুদ্রে মহাভয়। পৃথিবীর মাটিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সুনীল আকাশ, কবিতা। অনন্ত আকাশে ভেসে থাকা মহাভয়। সেখানে কবিতা নেই।

আমার একটা নতুন ডেরা হয়েছে। মানুষটা বড়ো ভালো। বড়ো মজার মানুষ। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সব ঘোরা হয়ে গেছে। কোনো দেশ বাকি নেই। লেখাপড়াও প্রচুর। নাম দেবাংশু মিত্র। আমার দেবুদা। বয়েস মনে হয় পঞ্চাশ পেরিয়েছে। দেখে বোঝার উপায় নেই। সংসার করেননি। একা একটা বাড়িতে থাকেন। সাবেক আমলের বনেদি বাড়ি।

মাঝেমাঝেই চিৎকার করেন, ‘কোই হায়? কোথায় সব গেলে বাবা! মরে ভূত?’

দেবুদার একটা ডেকচেয়ার আছে। রেলস্টেশনের রিটায়ারিং রুমে যেমন থাকে। ‘এটা আমার ঠাকুরদার জিনিস। রায়বাহাদুর বিশ্বম্ভর মিত্র এই আরামকেদারায় আড় হয়ে শুয়ে গড়গড়ায় অম্বুরি তামাক সেবন করতেন, আর নিজের সমৃদ্ধি বাড়াবার ফন্দি আঁটতেন। রায়বাহাদুর মরলেন কীসে, না বজ্রাঘাতে। ভাগ্যবান অবশ্যই। এমন মৃত্যু ক—জনের হয়? বসন্ত, ওলাওটায় মরার চেয়ে ওই মৃত্যু কত মজাদার। চড়াক করে একটা ফ্ল্যাশ, ঝলসে পোড়া কাঠ।’

দেবুদা ঘুমঘুম চোখে বললেন, ‘আয়, কোথায় ছিলিস এ কদিন? শরীরটা বড়ো বেজুত হয়েছে রে! চব্বিশ ঘণ্টাই ঘুম পাচ্ছে!’

দেবুদা যেখানে বসে আছে তার সামনের দেয়ালে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের বিশাল এক ছবি। সেই ছবির দিকে হাত তুলে দেবুদা বললেন, ‘বুড়োকে জিজ্ঞেস কর তো প্ল্যানটা কী?’

‘প্ল্যান আবার কী! তোমার খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো হচ্ছে না।’

‘পঞ্চাশের পর খাওয়াটা কোনো ফ্যাকটার নয়।’

‘আজ কী খেলে শুনি?’

‘আজ ফাসকেলাশ। মুড়ি, আলুর চপ, বেগুন, ফুলুরি। আর এখনও পর্যন্ত সাতকাপ চা। সবে সন্ধে। বারো কমপ্লিট করে শুতে যাব। এই তো এখুনি অষ্টম কাপ হবে! তুই এসে গেছিস, জগার দোকানে বলে আয়!’

‘এইটা তোমার খাওয়া হল! এতে শরীর থাকে!’

‘তুমি কী খেয়েছ মানিক?’

‘আমি তোমার চেয়ে ভালো খেয়েছি। ছাতু, আচার, পেঁয়াজ, লঙ্কা।’

‘আজ এমন বিহারী ভোজ কেন?’

‘রান্নায় বৈরাগ্য এসেছিল। রোজ রোজ রান্না করা যায়, তুমিই বলো।’

‘তাহলে আমাকে জ্ঞান দিচ্ছিলে কেন চাঁদ?’

‘তোমার তো রান্নার লোক আছে!’

‘তিনি ভূতের ভয়ে পালিয়েছেন।’

‘সে আবার কী!’

‘এই বাড়িতে তিনি প্রায়ই ভূত দেখেন। সেই ভূত আছে রান্নাঘরের দিকে যে একতলা অংশটা তারই ছাতে। সে আবার মহিলা। চুল এলো করে দাঁড়িয়ে থাকে যখন—তখন। তুই কখনো ভূত দেখেছিস?’

‘না। আমার গুরু বলেছিলেন, যে ভূত দেখেছে সে ভগবানকে একদিন দেখবে।’

‘ভূত অনেকেই দেখে, ভগবান অত সহজে দর্শন দেন না। আমি তাই ভূত নিয়ে গবেষণা করছি। জানিস তো, রমণী ভূত সব সময় সাদা শাড়ি পরে থাকে! কখনো চুল বাঁধে না। মুখটা কঙ্কালের মতো হলেও চুলটা ঠিক থাকে। তুই কোনো মহিলা ভূতকে রঙিন শাড়ি পরতে দেখেছিস?’

‘আমি তো ভূতই দেখিনি! কী পরে আছে, সে আর দেখব কী করে?’

‘ভূত হল ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ফোটোগ্রাফ। কালো শরীর সাদা পোশাক, যাতে অন্ধকারে স্পষ্ট হয়। এসব বিজ্ঞানের ব্যাপার, বুঝলি তো!’

‘তুমি দেখেছ?’

‘কদিন ধরে খুব চেষ্টা করছি। প্রহরে প্রহরে ওইদিকে যাই, আর ছাতটার দিকে তাকিয়ে থাকি। এখনও পর্যন্ত বেড়াল ছাড়া চোখে কিছু পড়েনি।’

‘বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ঘুরে তোমার শেষে এই জ্ঞান হল, ভূত আছে।’

পৃথিবীতে সব কিছুই থাকতে পারে। অবিশ্বাস করব কেন? আমার বুড়ো বলতেন, অবিশ্বাস কোরো না। অবিশ্বাস হল অজ্ঞান। চারপাশে অবিশ্বাসের পাঁচিল খাড়া করে রাখলে জ্ঞান ঢুকবে কী করে? মনে নেই, মাস্টারমশাইকে প্রথম দর্শনের দিন জিজ্ঞেস করছেন, আচ্ছা তোমার ‘সাকারে’ বিশ্বাস, না ‘নিরাকারে’? মাস্টারমশাই মনে মনে ভাবছেন, এ আবার কী। সাকারে বিশ্বাস থাকলে কি নিরাকারে বিশ্বাস হয়? ঈশ্বর নিরাকার, এ বিশ্বাস থাকলে ঈশ্বর সাকার এ বিশ্বাস কি হতে পারে? দুটো বিপরীত অবস্থা কি সত্য হতে পারে? সাদা জিনিস—দুধ, কি আবার কালো হতে পারে? উত্তর দিলেন, আজ্ঞে নিরাকার—আমার এইটা ভালো লাগে।

ঠাকুর বলছেন, ‘তা বেশ। একটাতে বিশ্বাস থাকলেই হল। নিরাকারে বিশ্বাস, তা তো ভালোই। তবে এ বুদ্ধি করো না যে, এইটি কেবল সত্য আর সব মিথ্যা। এইটি জেনো যে, নিরাকারও সত্য আবার সাকারও সত্য। তোমার যেটি বিশ্বাস, সেইটিই ধরে থাকবে।

‘এই পৃথিবীতে কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যা, কেমন করে বলব! কতটুকুই বা জানি! ঠাকুর একদিন বলছেন, দেবু মোড়লের বাড়িতে দেখেছিলাম একজন পিশাচসিদ্ধ। পিশাচ কত কী জিনিস এনে দিত। ঠাকুর এক বাগানবাড়িতে গিয়েছিলেন। তাঁর উপস্থিতিতে সেখানে কিছু পাপাত্মা ছিল, তারা সহ্য করতে না পেরে হইহই করে উঠল, তুমি কেন এলে, তুমি কেন এলে?

‘কোথায় কী আছে ভাই, কে বলতে পারে? আমি মূর্খ মানুষ, যে যা বলে তাই বিশ্বাস করি। একদিন খুব মাথার যন্ত্রণা, এই চেয়ারটায় পড়ে আছি। আচ্ছন্ন হয়ে। হঠাৎ মনে হল, কে যেন খুব ভালোবেসে মাথায়, কপালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে! ভয়ে আর চোখ খুলিনি। একসময় ঘুমিয়ে পড়েছি।’

‘যাক ভূত তাহলে তোমাকে অনশনে রাখবে, এই সিদ্ধান্তই করেছ! রাতে কী? মুড়ি?’

‘মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে। সেই ছেলেবেলার মতো ফিস্টি করবি। ফুলকো লুচি, ঝাল—ঝাল আলুর দম। ভাঁড়ারে সব কিছুই আছে।’

‘তা করলে হয়। বহুদিন ভালো কিছু খাইনি। ক—দিন খুব ছোলার ডাল খেতে ইচ্ছে হয়েছে।’

‘তাও আছে। চল, বুড়োকে আজ ভোগ নিবেদন করা যাক।’

কর্মযজ্ঞ শুরু হল। খুব ধুমধাম। দেবুদা বসে গেলেন বাটনা বাটতে। রাত দশটার সময় ধূপ জ্বেলে, গঙ্গার জলে মেঝে মুছে ঠাকুরকে নতুন থালায় ভোগ নিবেদন করা হল। দরজা বন্ধ করে আমরা বাইরে। দেবুদা গান ধরেছেন,

এবার আমি ভালো ভেবেছি
ভালো ভাবির কাছে ভাব শিখেছি
যে দেশে রজনি নাই, সেই দেশের এক লোক পেয়েছি।
আমি কিবা দিবা কিবা সন্ধ্যা সন্ধ্যারে বন্ধ্যা করেছি।।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *