চব্বিশ
আমার পৃথিবীটা হঠাৎ আমারই চোখের সামনে কেবল ভালো হয়ে যাচ্ছে। একেবারে অবাক কাণ্ড। যাদের শয়তান ভেবেছিলুম তারা সব ভগবানের মতো আচরণ করছে। যারা একটু মস্তান প্রকৃতির ছিল, রুমকির দিকে যাদের নজর ছিল, ভেবেছিলুম ধরে পেটাবে, কি রুমকিকে টেনে নিয়ে যাবে, তারাই এগিয়ে এল পরম বন্ধুর মতো।
এই হয়, পৃথিবীটাকে আমরা আগেই শয়তানের কারখানা ভেবে বসে থাকি। ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ কত প্র্যাকটিক্যাল ছিলেন। ঠিক এই কথাটাই বললেন, যে রঙের চশমা পরে দেখবে, সেই রংই দেখবে। যাদের মাস্তান ভেবেছিলুম তারা ওই তথাকথিত ভদ্রলোকেদের চেয়ে অনেক অনেক ভালো। তারা যা করে নিজেদের এলাকায়। মারামারি, খুনোখুনি সবই নিজেদের হিস্যা নিয়ে নিজেদের ভেতর। সৎ, নিরীহ মানুষ এদের কাছে যদি আত্মসমর্পণ করে, এরা জান দিয়ে তাকে আগলাবে।
এই কায়দা দুটি শ্রীঠাকুর ও জননী সারদা আমাদের শিখিয়ে গেছেন।
ঠাকুর বলছেন, ‘এই কয়েকটির কাছ থেকে সাবধান হতে হয়। প্রথম, বড়োমানুষ। টাকা, লোকজন—অনেকে মনে করলে তোমার অনিষ্ট করতে পারে, তাদের কাছে সাবধানে কথা কইতে হয়। হয়তো যা বলে সায় দিয়ে যেতে হয়। তারপর কুকুর। যখন কুকুর তেড়ে আসে কি ঘেউ ঘেউ করে, তখন দাঁড়িয়ে মুখের আওয়াজ করে তাকে ঠান্ডা করতে হয়। তারপর মাতাল। যদি রাগিয়ে দাও, তাহলে বলবে তোর চোদ্দপুরুষ, তোর হেনতেন, বলে গালাগালি দেবে। তাকে বলতে হয়, কী খুড়ো কেমন আছ? তাহলে খুব খুশি হবে, তোমার কাছে বসে তামাক খাবে।’ শ্রীঠাকুর আরও বলছেন, ‘অসৎ লোক দেখলে আমি সাবধান হয়ে যাই। যদি কেউ এসে বলে, ওহে হুঁকো—টুকো আছে? আমি বলি, আছে। কেউ কেউ সাপের স্বভাব। তুমি জান না, তোমায় ছোবল দেবে। ছোবল সামলাতে অনেক বিচার আনতে হয়। তা না হলে হয়তো তোমার এমন রাগ হয়ে গেল যে, তার আবার উলটে অনিষ্ট করতে ইচ্ছা হয়।’
এই আদেশে আমি চলে হাতে হাতে ফল পেয়ে গেছি। আর জননী সারদা শেখালেন আত্মসমর্পণ। রুমকি ঘরে এল। কপালে লাল গোল একটা টিপ, যেন ললাটে সূর্যোদয়। মুখটা এত সুন্দর যে আমার চোখে জল এসে গেছে। মনে হয় রান্নাঘরে ছিল। মুখটা মিহি ঘামে চকচক করছে।
আমাকে লক্ষ করে বললে, ‘এ কী চোখে জল কেন?’
আমি আমার হাতে ধরা বইটার মলাট দেখালুম।
‘শ্রীসারদা দেবীর জীবনকথা, স্বামী বেদান্তানন্দ। কোত্থেকে পেলে?’
‘কাল উদ্বোধন থেকে কিনেছি। যে জায়গাটা পড়ছিলুম তোমাকে শোনাই, একটু সময় আছে?’
‘আছে। পড়ো, পড়ো, শুনি।’
‘আগে একটু ভূমিকা করে নিই, তাড়াহুড়ো চলবে না কিন্তু।’
‘তোমার এইসব ব্যাপারে আমি তাড়াহুড়ো করি? বলো।’
‘মা সারদা তৃতীয়বার দক্ষিণেশ্বরে আসছেন গ্রামের কয়েকজন প্রাচীনার সঙ্গে। তারা আসছিলেন গঙ্গাস্নানে। জয়রামবাটি থেকে কামারপুকুর দু—ক্রোশ পথ। সেখান থেকে ঠাকুরের ভাইঝি লক্ষ্মী ও ভাইপো শিবরাম সঙ্গী হলেন। চারক্রোশ হেঁটে আরামবাগ। প্রথমে ঠিক হয়েছিল আরামবাগে রাত কাটানো হবে। বেলা তখনও অনেকটা আছে দেখে সিদ্ধান্ত হল রাত্রিবাস হবে তারকেশ্বরে। যতটা এগিয়ে থাকা যায়। একটু বিশ্রামের পর শুরু হল আবার হাঁটা। মায়ের স্বভাব ছিল নিজের শতকষ্ট হলেও অন্যের অসুবিধা সৃষ্টি না করা। দীর্ঘপথ হাঁটার অভ্যাস তাঁর ছিল না, কষ্ট হচ্ছে, তবু তিনি তাঁদের পরিকল্পনায় রাজি হয়ে আবার যাত্রা শুরু করলেন। অর্ধেক পথ সঙ্গীদের সঙ্গে সমান তালে চললেন কোনো রকমে, তারপর দলছাড়া হয়ে ক্রমেই পিছিয়ে পড়তে লাগলেন। সঙ্গীরা বারদুয়েক থামলেন। তাড়া দিতে লাগলেন, বেলা পড়ে আসছে, সামনেই তেলো—ভেলো আর কৈকালার বিশাল বড়ো মাঠ পার হতে হবে। আশেপাশে গ্রাম নেই, লোক নেই জন নেই, খোলা মাঠ ধুধু করছে। প্রকাণ্ড অজগর সাপের মতো একটা পথ এঁকে—বেঁকে চলে গেছে সামনে। ডাকাতের উৎপাতের জন্যে প্রসিদ্ধ এই পথ। পথিকের করে সর্বস্ব হরণ। প্রাণেও মেরে ফেলে।’
সঙ্গীরা ভয় পাচ্ছেন দেখে মা বললেন, ‘তোমরা এগিয়ে যাও, আমি ঠিক তোমাদের পেছনে পেছনেই আসছি।’
এইবার শোনো স্বামী বেদান্তানন্দ কী লিখছেন—’দেখতে দেখতে সূর্যদেব পাটে বসলেন। দিনের আলোর শেষ রেখাটুকু দিগন্তে মিলিয়ে গেল। গাঢ় অন্ধকার নেমে এল ধরণীর বুকে। দশহাত দূরের জিনিস দেখা যায় না, সারদা দেবী সঙ্গীদের আর দেখা পাবেন কী করে? অন্ধকারে একাকী তিনি পথ চলতে লাগলেন।
এমন সময় সামনে আসতে দেখলেন অন্ধকারের চেয়ে কালো প্রকাণ্ড এক চেহারা। মাথায় তার ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল, কাঁধে প্রকাণ্ড এক মোটা লাঠি, হাতে রূপার বালা। তিনি স্থির হয়ে দাঁড়ালেন ও শুনলেন কর্কশ কণ্ঠস্বর—এমন সময় কে দাঁড়িয়ে ওখানে? প্রশ্ন শুনে কি তিনি ভয়ে মূর্ছা গেলেন, না দৌড়ে পালাতে চেষ্টা করলেন? ভয় তিনি পেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর চিহ্ন তাঁর কথাবার্তায় প্রকাশ পেল না। দরকারমতো উত্তর যেন তাঁর মুখে জোগানো ছিল। তিনি বললেন, ‘বাবা, আমার সঙ্গীরা আমায় ফেলে গেছে। আমারও মনে হচ্ছে যেন পথ হারিয়ে ফেলেছি। তুমি আমার সঙ্গীদের কাছে পৌঁছে দেবে চলো। তোমার জামাই দক্ষিণেশ্বরে রানি রাসমণির কালীবাড়িতে থাকেন। আমি তাঁরই কাছে যাচ্ছিলাম। তুমি যদি আমাকে তাঁর কাছে রেখে আসতে পার বাবা, তাহলে তিনি তোমাকে খুব যত্ন করবেন।’ এই বলে তিনি তাড়াতাড়ি পায়ের রূপার মল দু—গাছা খুলে অপরিচিত বাগদি পুরুষের হাতে দিলেন। তাঁর কথা শেষ হতে না হতে এক স্ত্রীলোক এসে তাঁর সামনে দাঁড়াল। তিনি তখন যেন অনেকটা স্বস্তি বোধ করলেন এবং সেই মেয়েটির হাত ধরে বললেন, ‘আমি তোমার মেয়ে সারদা। সঙ্গীরা ফেলে যেতে বিষম বিপদে পড়েছিলাম। ভাগ্যিস বাবা ও তুমি এসে পড়লে। নইলে কী যে করতাম।’
‘তাঁর মিষ্টি কথা, সরল ব্যবহার ও ছোটোদের মতো পরকে বিশ্বাস ও আপনবোধ দেখে সেই বাগদি স্ত্রী—পুরুষের প্রাণ ভালোবাসায় গলে গেল। তাদের মনে হল সারদা যেন তাদের কত জন্মের আপনার মেয়ে। বাগদি—বউ স্বামীকে বললে, ‘আমার মেয়ে এত রাতে আর চলতে পারবে না, থাকবার জায়গা দেখো।’ পাশের তেলোভেলো গ্রামে এক দোকানে থাকবার ব্যবস্থা হল। মেয়েটি নিজের আঁচল পেতে তার পথে পাওয়া কন্যাটিকে শুতে দিল—আর পুরুষটি দোকান থেকে মুড়িমুড়কি কিনে এনে তাঁকে খেতে দিল। সারদাদেবী ছোটো খুকিটির মতো শুয়ে শুয়ে খেতে লাগলেন।
পরদিন সকালে তারা সারদাদেবীকে সঙ্গে নিয়ে গেল তারকেশ্বরে। এক দোকানে তাঁকে বসিয়ে রেখে পুরুষটি গেল বাবা তারকনাথের পূজা দিতে ও সারদাদেবীকে ভালো করে খাওয়ানোর জন্য বাজার করতে। এদিকে তাঁর সঙ্গীরাও তাঁর জন্য খুব ভাবনায় পড়েছিলেন এবং চারদিকে তাঁকে খুঁজছিলেন। দোকানের মধ্যে তাঁকে পেয়ে সকলে যখন খুব আনন্দিত, তখন বাগদি পুরুষটি ফিরল পূজা সেরে, প্রসাদ ও বাজার নিয়ে। সারদাদেবী সকলের সঙ্গে আশ্রয়দাতাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন।
যাত্রীর দল শ্রীশ্রীতারকনাথের পূজা দিলেন এবং আহার ও বিশ্রাম সেরে আবার বেরিয়ে পড়লেন বৈদ্যবাটির দিকে। বাগদি স্বামী—স্ত্রীও কিছু পথ তাঁদের সঙ্গে এল। কেমনভাবে তারা সারদাদেবীর কাছে বিদায় নিল, সে কথা তাঁর নিজের মুখেই শোনা যাক।—একটি তো রাত। তার মধ্যে পরস্পরকে এতদূর আপনার করে নিয়েছিলাম যে বিদায় নেবার সময় কাঁদতে লাগলাম। অবশেষে সুবিধামতো দক্ষিণেশ্বরে এসে আমায় দেখে যেতে বার বার অনুরোধ করাতে আমার বাগদি—বাবা আসবেন বলে স্বীকার করলে অতিকষ্টে তাদেরকে ছেড়ে এলাম। আসবার সময় তারা অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে এসেছিল এবং আমার বাগদি—মা পাশেরই খেত থেকে কতকগুলো কড়াইশুঁটি তুলে এনে আমার আঁচলে বেঁধে দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, ‘মা সারদা, রাতে যখন মুড়ি খাবি, তখন এইগুলো দিয়ে খাস।’
রুমকি স্থির ধ্যানস্থ হয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। নীচের থেকে কে একজন চিৎকার করছে, টেবিল এসেছে, টেবিল এসেছে! লম্বা লম্বা কাঠের টেবিলের অর্ডার দিয়েছিল রুমকি। কাপড় ছাপার কাজে লাগবে।
দুজনেই উঠে পড়লুম। আর সময় নেই বসে থাকার। শুরু হয়ে গেল কর্মের দিন। বেশ লাগছে এই ব্যস্ততা। জীবনের একটা নতুন মানে বেরিয়ে আসছে।
মা সারদা যেন অনুক্ষণ বলছেন :
গৃহীদের বহিঃ—সন্ন্যাসের দরকার নেই। তাদের অন্তর—সন্ন্যাস আপনা হতে হবে। তবে বহিঃ—সন্ন্যাস আবার কারও কারও দরকার। তোমাদের আর ভয় কী? তাঁর শরণাগত হয়ে থাকবে। আর সর্বদা জানবে যে ঠাকুর তোমাদের পেছনে আছেন।