Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

দেবুদা বললেন, ‘আমার জানাশোনা একজন ভালো সাইকোলজিস্ট আছেন। আমার সঙ্গে চল, একটা চেকআপ করিয়ে আনি।’

—’কেন? আমার কি মাথার ব্যামো হয়েছে?’

—’প্রথম কথা, তুই হ্যালুসিনেশান দেখছিস। শেষ রাতে নৌকো চড়ে গঙ্গা বেয়ে ঠাকুর এলেন তোকে দর্শন দিতে! একমাত্র ব্লাড ইউরিয়া বাড়লে মানুষ এইসব দেখে। তোর কিডনি ঠিক কাজ করছে তো? জলটল ঠিকমতো খাস তো? মাছ—মাংস খেলে গা—বমিবমি করে?’

একসঙ্গে অনেক প্রশ্ন। ভেবেচিন্তে উত্তর দিতে হবে। দেবুদা জেনেও ভুলে বসে আছে, মাছ—মাংস আমার জোটে না। ফলে গা—বমিবমি করে কী না, বলতে পারব না। জল আমি প্রচুর খাই, কারণ জলই আমার প্রধান খাদ্য। খিদে পেলেই জল খাই। আমার রোজগার এত সামান্য, কী করে বেঁচে আছি, ভাবলে অবাক হয়ে যাই। অনেক কায়দা করে দিন চালাতে হয়। সাবানের বদলে গায়ে গঙ্গামাটি মাখি। বেলা তিনটে, সাড়ে তিনটের সময় একবার খাই। ভাতের সঙ্গে একটু ছোলার ছাতু মেখে নিই, যাতে পেটে দমটা বেশ কিছুক্ষণ থাকে। মাঝে—মধ্যে তেলেভাজার ওপর কোঁত কোঁত করে দু—তিন গেলাস জল। কিছুক্ষণের মধ্যেই পেট ফুলে জয়ঢাক।

উত্তরে বললুম, ‘জল আমি প্রচুর খাই, কিডনিতে কোনো সমস্যা নেই।’

—’তাহলে মাথা! কারণ তোর প্রেম বোঝার ক্ষমতাটাও লোপাট পেয়েছে। তোর পৃথিবীটা হয়ে গেছে অন্ধকারের পৃথিবী। কোথাও কোনো আলো নেই। রুমকি তোকে ভালোবাসে, এটা তুই বুঝিস না?’

—’তা বলে সে বলবে, তুমি আমাকে দীক্ষা দাও, তুমিই আমার গুরু?’

—’সে কী রে! এই কথা বলেছে?’

—’তাহলে তোমাকে আর বলছি কী! পুজোর জোগাড়—টোগাড় সব রেডি। নতুন কাপড় পরে এসে হাজির।’

—’এই যে বললি, বাবার হার্ট—অ্যাটাক।’

—’সামলে গেছে সেই রাতেই। হার্ট—অ্যাটাক নয়, কে প্রচুর সিদ্ধি খাইয়ে দিয়েছিল।’

—’তুই কী করলি? দীক্ষা দিলি?’

—’আমি ফেরাতে পারিনি দেবুদা। আমার গুরুর দেওয়া ইষ্টমন্ত্র তাকে দিয়ে দিয়েছি।’

—’সে কী রে! তুই তো মরবি! গুরুর আদেশ ছাড়াই দীক্ষা দিয়ে দিলি?’

—তাই তো ভয়ে তোমার কাছে ছুটে এসেছি।’

—’এ ব্যাপারে আমি তোর কী করতে পারি? বাঘ তাড়া করে এলে, গুলি করে ফিনিশ করে দিতে পারতুম। এইটুকু বলতে পারি, কাজটা তুমি ঠিক করোনি। তুমি যদি গুরুই হও, রুমকি তোমার প্রথম শিষ্যা। এইবার রুমি তোমাকে বিয়ে করবে। তার মানে গুরু, শাস্ত্র যাকে বলছে পিতা, সেই পিতা কন্যাকে বিবাহ করছে—স্ক্যান্ডালাস! ঘোর কলি!’

—’তুমি আমাকে বাঁচাও। বিয়ে আমি করব না। সে প্রশ্নই আসে না। যার চালচুলোর ঠিক নেই, সে বিয়ে করবে কোন আক্কেলে?’

—’আমি বলে রাখলুম, রুমকি তোকে বিয়ে করবেই এবং তোর টাকার কোনো অভাব থাকবে না। দিস ইজ মাই প্রেডিকশান! ধর্ম যাবে, অর্থ আসবে।’

‘এই জীবনে প্রথম দেবুদার ওপর আমার খুব রাগ, রাগের পর অভিমান হল, ‘তোমার ধারণা, আমার গুরু হওয়ার কোনো যোগ্যতা নেই। সাত বছর বয়েস থেকে আমি সাধুসঙ্গ করছি।’

—’তাহলে সাধুর কমণ্ডুলুও তো মস্ত সাধু। সাধুর সঙ্গে সাত ধাম ঘুরছে। স্বভাবে যে কটু সেই কটু। সাধুসঙ্গ করে তোমার হয়েছেটা কী? ভাগবত কী বলছেন শোনো,

অদস্তস্যাবিনীতস্য বৃথাপণ্ডিতমানিনঃ।
ন গুণায় ভবন্তিস্ম নটস্যেবাজিতাত্মনঃ।।

—’বাংলা করে দাও।’

—’যে অস্থিরচিত্ত, অজিতেন্দ্রিয় আর অবিনীত আর সে বৃথাই নিজেকে পণ্ডিত বলে মনে করে, তার শাস্ত্র অধ্যয়ন অভিনেতার রাজবেশ পরার মতো। যথার্থ রাজা সে কোনোদিনই হতে পারবে না।’

নিজের সঙ্গে মেলাবার চেষ্টা করলুম। দুটো মিলছে। সত্যই আমি অস্থিরচিত্ত। কোনো কিছুই সেইভাবে ধরে থাকতে পারিনি। যাকে বলা যায় কচ্ছপের কামড়। আর ইন্দ্রিয়? সবকটাই যথেষ্ট প্রবল। সব সময়েই পাঁচটা উদ্দাম বানরের মতো লাফালাফি করে। আর একটা যেটা প্রবল, সেটা মাঝে মাঝে ঘুমোয়, মাঝে মাঝে তেড়েফুঁড়ে ওঠে। এই মনে হচ্ছে নেই, পরক্ষণেই মনে হচ্ছে, ভয়ংকরভাবে আছে।

এই ভাবনার মাঝেই দেবুদা বললেন, ‘অত্যন্ত বোকার মতো কাজ করলি। ও তোর পূর্বজন্মের বউ। যাচা ধন পায়ে ঠেললি। বিধাতার বিধানের উলটো রাস্তায় গেলি। খোদার ওপর খোদকারি করলি।’

দেবুদার কথায় কেমন যেন হয়ে গেলুম। পূর্বজন্মের সম্পর্ক। হলেও হতে পারে। আমার তো উপেক্ষার অন্ত নেই। মেয়েটি ভিন্নভাষী। পিতা ছোটোখাটো ব্যবসায়ী হলেও অর্থের অভাব নেই। মেয়েটি দেখতে শুনতে ভালো। যে—কোনোদিন ঘোড়ায় চেপে এসে যাবে বিত্তবান বর। বউ হয়ে চলে যাবে কলকাতার ফ্ল্যাটে। এই অঞ্চলে একটি রাজস্থানী ছেলে আছে। রুমকিকে পছন্দ করে। তার একটা গাড়ি আছে। জীবন বড়ো জটিল। জট ছাড়ানো সহজ নয়। কোনো কোনো কথা আছে রূপকথার মতো।

দেবুদাকে অবশেষে বললুম, ‘কিছু টাকা দান করবে? ধার চাইব না, কারণ শোধ করার গ্যারান্টি আমি দিতে পারব না।’

‘টাকা দিলে কী করবি?’

‘আমি বেরিয়ে পড়ব। হরিদ্বার হয়ে হিমালয়।’

‘তার মানে, আগে উপাধি তারপর লেখাপড়া।’

‘তোমার হেঁয়ালি আমার মাথায় ঢোকে না।’

‘হিমালয় থেকে নেমে এসে গুরু হয়, বা বলতে পারিস গুরু হয়ে নেমে আসেন। তোর হল উলটো। তুই গুরু হয়ে হিমালয়ে উঠবি?’

‘শোনো দেবুদা, ঠাকুরের একটা গল্প শোনো, এক চোর চুরি করতে গিয়েছিল। গৃহস্থ জেগে ওঠে, চোর—চোর চিৎকার। চোর ছুটছে, পেছনে তাড়া করে আসছে গ্রামের লোক। চোর দেখলে পালাবার পথ নেই। ধরা তাকে পড়তেই হবে। তখন সে এক ফন্দি বের করলে। সামনেই একটা ছাইগাদা। সর্বাঙ্গে ছাই মেখে একটা বটগাছের তলায় ধ্যানের ভঙ্গিতে বসে পড়ল। গ্রামের লোক চোরকে আর খুঁজে পেল না। ব্যাটা পালিয়েছে। কিন্তু গ্রামে এক নতুন সাধু এসেছে, এই কথাটা রাষ্ট্র হয়ে গেল। সবাই ফল—মূল প্রণামী এনে সাধুর চরণে নিবেদন করতে লাগল। সাধু তখন ভাবলে, ভেক ধরেই আমার এই অবস্থা, সত্যি সাধু হলে না—জানি আমার কী হবে? সে তখন সত্যি সাধু হওয়ার জন্যে বেরিয়ে পড়ল। সবাই এসে দেখলে, বটতলা ফাঁকা। আমারও হয়তো তাই হবে।’

দেবুদা বললে, ‘তোমার কাঁচকলা হবে! ঠাকুর বলতেন, ম্যাদামারাদের কিছু হয় না। রোখ চাই, তোর সেই রোখ কোথায়? তোর অনেক গুরু। মাথায় সব তালগোল পাকিয়ে গেছে। আর তোর যে বয়েসে তাঁরা এসেছিলেন, সেই সময়টা ছিল তোর কৈশোর ও যৌবনের সন্ধিকাল। মানুষের জীবনের সবচেয়ে রোম্যান্টিক সময়। ওই সময়টায় বেরিয়ে যেতে পারলে, তুই হয়তো প্রকৃতই এক বড়ো সন্ন্যাসী হতে পারতিস। ঠাকুর বলছেন, পাকা বাঁশ সহজে নোয়ানো যায় না। তুই পেকে গেছিস, সেইটাই হয়েছে মহা মুশকিল। তুই না ঘরকা, না ঘাটকা। তার ওপর, ঠাকুরেরই কথা, কাজলের ঘরে রয়েছিস, কালি তো একটু লাগবেই।’

‘তুমি রুমকির কথা বলছ?’

‘কেন, রুমকি রমণী নয়? নারীমোহিনী মায়া। সে বিদ্যামায়াই হোক আর অবিদ্যামায়াই হোক। সীতা আর রামচন্দ্রের কথা স্মরণ কর। রাম অবতার। তিনি জানতেন না, হরিণ কখনো সোনার হয় না? সীতাও কি জানতেন না? সেই রামচন্দ্র সীতার মায়ায় ধনুর্বাণ নিয়ে অবোধের মতো মায়া হরিণের পেছনে দৌড়োলেন, এদিকে হয়ে গেল সীতা—হরণ! বুঝলে ভায়া, বিদ্যামায়া আর অবিদ্যামায়া এ—ঘর ও—ঘর করে?’

আমার রোখ চেপে গেল, তবে রে! স্টেশনের রাস্তা ধরলুম। দেখি তো হয় কিনা।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *