সতেরো
পোড়ো বাড়ির সিঁড়ি, হুড়মুড় করে নামবো বললেই তো নামা যায় না। একটা ধাপ ভাঙা তো একটা ধাপ ভালো। দেয়ালে হাত রাখলেই ঝুর ঝুর। কিন্তু বাড়িটার বেশ একটা চরিত্র আছে। কেউ না থাকলেও মনে হয় ঘরে ঘরে অতীতের সব চরিত্ররা বসে আছেন। তাঁদের কারওকেই আমি দেখিনি, আমার মহা আবির্ভাবের আগেই তাঁরা চলে গেছেন; কিন্তু এই পরিবারের দু—শো বছরের ইতিহাস তো জনশূন্য হতে পারে না।
নীচের উঠোনে একদল পাড়ার ছেলে ভিড় করে আছে। দেখেই গা জ্বলে গেল। যত ভাবি খারাপ কিছু ভাবব না, ততই সব বিশ্রী ভাবনা মাথায় ঢুকে পড়ে। এই হল পরিবেশের দোষ। এই সবকটা ছেলে রুমকির জন্যে ছোঁক ছোঁক করছে। হিন্দি ছবির নায়কের মতো ওই যে ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে, ওটা মহা শয়তান। সাট্টার বুকি। এমন কোনো পাপ কাজ নেই, যা ও করেনি। ক্রমশই বাড়ছে। বাকি সবাই ওরই চেলাচামুণ্ডা। ওরই পয়সায় ফূর্তি করে, মদ খায় আর গুরুর পাপকাজে মদত দেয়।
অন্ধকারে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে ওদের কথাবার্তা শুনে যতটুকু অনুমান করতে পারলুম, রুমকির বাবার হার্ট—অ্যাটাক হয়েছে। অ্যাম্বুলেন্স এল বলে। একবার মনে হল, রুমকির পাশে গিয়ে দাঁড়াই। অনেক অসুস্থ মানুষের সেবা আমি করেছি। পরমুহূর্তেই মনে হল, এই ছেলেগুলো আমাকে পাড়ায় টিকতে দেবে না। ওই সাট্টাঅলা আমাকে রোজই একবার করে বলে, বাড়িটা আমাকে বেচে দাও। আমি ফ্ল্যাট তৈরি করি। তোমাকে আমি সাত লাখ দেবো। তিন লাখ হোয়াইট, চার লাখ ব্ল্যাক। আর একটা ফ্ল্যাট ফ্রি। আমি রোজই বলি, ভেবে দেখছি। এইবার ও যদি কোনো ভাবে একবার রটাতে পারে, রুমকির সঙ্গে আমার একটা সম্পর্ক আছে, তাহলে আমি শুধু বাড়িঅলা নই, লম্পট বাড়িঅলা, তারপর একদিন ধোলাই। ও বেশ ভালোই জানে, আমি বদনামকে ভয় পাই। আমাকে পাড়া ছেড়ে পালাতে হবে। তখন ও যে—কোনো দামে আমার বাড়িটাকে হাতাবে।
এই মুহূর্তে এই বাড়ি ছেড়ে সরে পড়াই ভালো। অন্ধকার ছায়ার মতো ওদের পেছন দিয়ে সদর পেরিয়ে একেবারে রাস্তায়। নারীঘটিত কেলেঙ্কারির অনেক ফ্যাচাং। হয়তো চেপে ধরবে পাড়ার মোড়লরা, বাড়িটা চুমকির মতো রুমকির কপালে ঝুলিয়ে দাও। তারপর সাট্টার বুকি রুমকির সঙ্গে ব্যবস্থা করে নেবে।
এই সব আমার ভাবা উচিত নয়। ওই যে বলে, বিষয় বিষ। সেই বিষে জ্বলছি। মাঝে মাঝে যে লোভ আসে না, তাও তো নয়। সাতলাখ টাকা তো কম নয়। একটা ফ্ল্যাট ফ্রি। আমি একা মানুষ। আমি তো তখন রাজা। আমাকে আর পেটের চিন্তায় ঘুরতে হবে না।
একটা রাত বাইরে কোথাও কাটানো, আমার কাছে কোনো সমস্যাই নাই। আগে মাঝে মাঝে শ্মশানে গিয়ে পাকুড় গাছের তলায় বাঁধানো বেদিতে শুয়ে পড়তুম। বটের তলায় শোওয়ার জায়গা নিয়ে খুব গুঁতোগুঁতি হত। পাকুড়ের তলায় ভয়ে কেউ আসত না। পাকুড়ের পাতায় পাতায় ভূত। প্রথম প্রথম আমারও ভয় করত। অনেক রকম শব্দ শুনতে পেতুম। মনে হত, ছুটে পালাই। জোর করে নিজেকে শুইয়ে রাখতুম। মনে মনে ভাবতুম, আমি মহাদেব। ভাবতে ভাবতেই আমি ঘুমিয়ে পড়তুম। তখন হরেক রকম মজার মজার স্বপ্ন আসত। পাকুড় খুব স্বপ্ন দেয়। প্রায়ই যে স্বপ্নটা আসত সেটার আকর্ষণেই আমার রোজ ইচ্ছে করত ঘরের ফাটা মেঝে ছেড়ে পাকুড়ের তলায় গিয়ে শুয়ে থাকি। স্বপ্নটা এই রকম : বিরাট একটা মাঠ। জমিটা টকটকে লাল। সেইখানে সাধুদের ভাণ্ডারা হচ্ছে। অনেক অনেক সাধু। টকটকে লাল গেরুয়া, কমলা গেরুয়া। তাঁরা সব পাতা থেকে গরম গরম খিচুড়ি সেবা করছেন। হাসছেন, কথা বলছেন। ভাষা সংস্কৃত। আনন্দের হিল্লোল বইছে। ত্রিশূল হাতে এক ভৈরবী তত্ত্বাবধান করছেন। টকটকে মুখ, কপালে সিঁদুরের গোল টিপ। মাঠটাকে ঘিরে আছে বড়ো বড়ো গাছ। সব গাছেই থোকা থোকা সাদা ফুল। একপাশে হোম হচ্ছে বিশাল এক হোমকুণ্ডে। লকলকে আগুনের শিখায় চারধার থেকে চারজন সন্ন্যাসী আহুতি দিচ্ছেন—স্বাহা, স্বাহা—মন্ত্রে। এই স্বপ্ন আমি যে রাতে দেখি—তারপরের দিনটা আমার ভীষণ ভালো যায়। ভালো মানে ভালো খাওয়া, হঠাৎ একগাদা টাকা পাওয়া নয়—অদ্ভুত একটা আনন্দে থাকা, আনন্দে ভরপুর অবস্থা।
দেখলুম অ্যাম্বুলেন্স আসছে। রুমকিকে একবার দেখার ইচ্ছে করছিল খুব। মেয়েটা সত্যিই ভীষণ ভালো। এখন হলটা কী, মা বাতে পঙ্গু। এই দানবগুলোর সঙ্গে রুমকিকেই হাসপাতালে বা বড়ো কোনো নার্সিংহোমে যেতে হবে। সাট্টার বুকি যখন এগিয়ে এসেছে, তখন সেরা জায়গাতেই নিয়ে যাবে। খরচপত্র সব নিজেই করবে। মানে রুমকিকে একেবারে অক্টোপাশে বেঁধে ফেলবে। রুমকির বাবা যদি মারা যান, তাহলে রুমকির মাকে কব্জা করে গেড়ে বসবে। অজগর শিকারকে আচমকা জড়িয়ে ফেলে, তারপর চাপ দিতে থাকে। রক্তবাহী শিরা, উপশিরা সব ফেটে যায়, তারপর প্রাণীটাকে একটু একটু করে গিলে ফেলে।
নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করলুম—আমি এইসব ভাবছি কেন! আমি যে—পথের পথিক সে—পথে তো রুমকির থাকার কথা নয়! একটা মন প্রশ্ন করে, আর একটা মন উত্তর দেয়। উত্তরদাতা মন একটা যুক্তি তৈরি করে দিলে—আহা, এটা তো তোমার কর্তব্য! তোমার বাড়ির নীচের তলায় কী হচ্ছে খবর নেবে না? এ তো মানুষের কর্তব্য।
পাকুড়ের তলায় আস্তে আস্তে শুয়ে পড়লুম। চিৎ, বুকের ওপর হাত দুটো। শ্বাস—প্রশ্বাস ওঠা—নামা করছে। কী আছে ভেতরে পরিষ্কার টের পাচ্ছি—আছে ভয়, আছে সেই ধূর্তামি। আমার যেমন বেণী তেমনি রবে, আমি চুল ভেজাব না। দেহবাসনা যথেষ্টই আছে অথচ ভাব দেখাই, মহাকাশে মহাবিশ্বে মহাযোগী। এরাই সাংঘাতিক। ঠাকুর বলছেন, যে খায়দায় ঘুরে বেড়ায়; কিন্তু কোনো অসৎ চিন্তা করে না, সে ওই ভণ্ড ধার্মিকদের চেয়ে শতগুণে ভালো। আমার তো চব্বিশ ঘণ্টাই অসৎ চিন্তা। এ কেমন মন? একটু আগে যে ধ্যান করছিল, সে একটু পরেই রুমকির ভাবনায় ভেবে পড়ল। রুমকির বাবার কী হল, দেখার দরকার নেই, যেন রুমকিরই হার্ট—অ্যাটাক। সাট্টা—বুকি ছুটে না এলে তুমি কী করতে? তোমার ক্ষমতায় কুলোত? একেই বলে ঈর্ষা!
টকাস করে একটা পাতা বুকের ওপর পড়ল। চিন্তার ধারা চমকে উঠল। অন্যদিকে ঘুরে গেল। নিজের ওপর একটা ঘৃণা এল। আমার এ জীবনটা নয়—ভ্যাগাবন্ড। আমি সাট্টার বুকি ও তার দলবলকে ঘৃণা করছি, ওরাও কিন্তু আমাকে সেই চোখেই দেখছে। একটা বেকার, এক পয়সা রোজগার নেই, চোখ উলটে ধার্মিক সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কী হবে এই ব্যর্থ জীবন নিয়ে বেঁচে থেকে। কুকুর—ছাগলের মতো? আমার গুরু বলতেন—তিনি কৃপা না করলে তাঁকে পাওয়া যায় না।
উঠে বসলুম। আকাশের তারার স্থান দেখে মনে হচ্ছে—রাত দুটো হবে। গঙ্গায় জোয়ার চলছে, কানায় কানায় ভরে গেছে। ভীষণ ইচ্ছে করছে—ওই জলে ডুবে যাই। কী হবে এই জীবন রেখে? ঠাকুরের কাছে গেলে, যা হয় দু—চার কথা মুখ ঘুরিয়ে শোনেন। তিনি কোনো দিন আমার কাছে যেচে আসেন না। ঠিক আছে ঠাকুর, আপনার যাঁরা তাঁদের নিয়েই থাকুন—আমি যাই। ক্রমশই জলে নামছি, মাথার ওপর তারাভরা আকাশ। কোমরের কাছে জল, ভীষণ স্রোত।