রাত প্রায় ভোর
০৫.
রাত বোধ হয় প্রায় ভোর হয়ে এল। নদীর দিক থেকে কী একটা পাখি ডাকছে থেকে থেকে। শেয়াল ডাকল একসঙ্গে অনেকগুলো। পাশ ফিরে শুল তৃষা। পরপুরুষের বিছানা, লেপ, বালিশে অনভ্যস্ত কিন্তু স্নিগ্ধগন্ধে এবং পরপুরুষের শরীরের ওম-এর উষ্ণতামাখা বিছানাতে যে, শুয়ে আছে একথা ভাবতেই ভীষণ উত্তেজিত বোধ করছিল ও। ওর পায়ের কাছে দরজা আগলে একবোঝা খড়ের ওপরে একটি ব্যাগ মাথায় দিয়ে নিজের গায়ের পুরু দেহাতি ধূসররঙা আলোয়ানটা জড়িয়ে গুঁড়িশুড়ি মেরে শুয়ে আছে ঋক। ফিতে-কমানো। লণ্ঠনের মৃদু আলোটা এসে ঋক-এর মুখের একপাশে পড়েছে। কোনো দেবশিশুর মুখ বলে মনে হচ্ছে যেন। তার গায়ের পাশে শোয়ানো আছে লাঠিখানা।
আবারও পাশ ফিরল তৃষা। এ রাতে কতবার সে পাশ ফিরল! ঋক অঘোরে ঘুমোচ্ছে। আসলে ঘুমোচ্ছে কি? শুয়ে থাকা মানুষকে দেখে মনে হয় যে, তারা ঘুমোচ্ছে। তারা যে, ভাবনার গভীরে ডুবুরির মতো ডুব দিয়ে বেড়াচ্ছে, তা তাদের শান্ত আপাত ঘুমন্ত মুখ দেখে বোঝার উপায় থাকে না।
ঘরের উষ্ণতা যেন, বেড়ে গেছে মনে হল। ওর বন্ধচোখের সামনে, কে যেন গলানো কাঁসার ঝরনা ঝরাচ্ছে। আস্তে আস্তে চোখ মেলল তৃষা। প্রথমে কিছুক্ষণ বুঝতে পারল না কোথায় আছে ও। ও কোথায়? দেখল পায়ের দিকের পুবের জানলাটা খুলে দিয়ে গেছে ঋক। পুবের জানলা দিয়ে রোদ এসে পড়েছে তার লেপের ওপরে। ঝকঝকে নীল আকাশ। এমন আকাশ কলকাতা তো দূরস্থান মুরাদগঞ্জেও দেখা যায় না।
খুব-ই ভালো লাগছিল। উঠতে ইচ্ছে করছিল না। পরক্ষণেই লজ্জা হল খুব। প্রণতর কথা মনে হওয়ায় কাঁটা বিঁধল মনে। সে তার বিবাহিত স্বামী। ধড়মড়িয়ে উঠে ব্রেসিয়ারটা আবার টাইট করে নিয়ে দাঁড়িয়ে উঠে লেপটাকে ভাঁজ করল। এদিক-ওদিক তাকাল বেডকভারের খোঁজে। দেখতে পেল না। দেখল কাল রাতের খড়-এর একটি কুটোও ঘরের মেঝেতে পড়ে নেই। সবকিছু নিড়িয়ে নিকিয়ে নিয়ে গেছে ঋক। বাইরে এসে দাঁড়াতেই মন ভরে গেল কমলালেবুর মতো সকালবেলার আলোয়, নীল বেনারসির মতো আকাশের নীলে, নদীর গন্ধময় শব্দে। গেরুয়া পাল তুলে ছোট্ট নৌকো চলেছে মন্থর গতিতে। নদী বেয়ে।
এমন সকালে ঘুম থেকে উঠেই নিজেকে খুব কেজো করে তুলতে ইচ্ছে যায়। মনে হয় তৃষার যে, ও ভীষণ-ই কাজের লোক হয়ে উঠবে। শঙ্খদার কবিতা মনে পড়ে যায়। শঙ্খ ঘোষের–
আলো একপাশে থাকে সে আলোর ভিতরে থাকে না।
–তারপর কী যেন! আমার স্মৃতিশক্তি ভারি দুর্বল। দুর সব ভুলে যাই।
বলল ঋককে।
–কার কবিতা?
–শঙ্খদার।
–ভোর?
–হ্যাঁ হ্যাঁ ভোর। তুমি জান?
আলো একপাশে থাকে, সে আলোর ভিতরে থাকে নাজল তাকে ডাক দেয়, মাটি তার পায়ে পায়ে হাঁটের কোনো দুঃখ নেই, আজ তার ভার আছে শুধু।একাকার হয়ে আছে তার সব দিন আর রাতেপ্রতিবিম্ব নিয়ে আজ একা একা দূরে গিয়েছে সেসুন্দর যেখানে এসে জীবিকার সীমায় মিশেছে।তুমি তাকে একা বলো? স্বচ্ছতার কতদূর একা?সে দেখে দিগন্তময় স্থির তার ভবিতব্যরেখা ভবিতব্যরেখাঢেউয়ের উপরে ঢালে আলো, সেই আলো পাশে থাকেআমিও তো কাজ চাই, কাজের ভিতরে পাব তাকে।
–বা : কী সুন্দর আবৃত্তি করো তুমি ঋক!
–কবিতা ভালো হলে আবৃত্তি ভালোই হয়। আর কবিতাই যদি ভালো না হয় তবে মিছিমিছি জুয়ারি দিয়ে কথা বলে আঁতেলশ্রেষ্ঠ হয়ে আবৃত্তি করলেও তা কবিতা বা আবৃত্তি দুটোর কিছুই হয় না।
তারপর বলল, মুখ-চোখ ধুয়ে নাও। চা করছি, চা খাও। রাম সিং এসেছিল। তোমার জন্যে ভালো ঘি আর দুধ নিয়ে আসতে বলেছি। সরও নিয়ে আসবে। আমি বেরিয়ে যাওয়ার পর সদর দরজা বন্ধ করে তুমি এই উঠোনের ওই কোনাতে পাটি পেতে শুয়ে সান-বেদিং করো, মুখে সর মেখো, সারাশরীরে খাঁটি কাড়ুয়া তেল মাখো। তোমাকে কেউ-ই দেখবে না। দেখতে পারে, শুধু একটি দাঁড়কাক। সে মাঝে মাঝে দেওয়ালটার ওপরে বসে ঘাড় বেঁকিয়ে তাকাবে। আর দেখবে চক্রাকারে ঘুরতে থাকা চিল আর হঠাৎ আকাশের নীলে সবুজ ঝিলিক মেরে চলে-যাওয়া টিয়ার ঝাঁক। একটা টিকটিকি আছে বটে সেও দেখতে পারে। সুন্দর জিনিস দেখতে তো কোনো দোষ নেই। দেখলে, সৌন্দর্য পরিপ্লুত হয়।
–এখানে জল কোথায় পাব?
–সব বন্দোবস্তই হয়েছে। কুয়ো তো আছেই। তোমার জন্যে একজন দাসীও ঠিক করে দিয়েছে রাম সিং। তার নাম লালপাতিয়া। রাম সিং-এর গ্রাম থেকে আসবে সে। তোমার সকালের নাস্তা আর স্নান হয়ে গেলে তোমার সঙ্গেই থাকবে, তোমাকে নিয়ে নদী পেরিয়ে বাজরা আর মটরছিম্মির সবুজ কাডুয়া আর সরগুজার হলুদ খেতের পাশ দিয়ে দূরের গ্রামে বেড়িয়ে আসবে। এই শালবনের গভীরেও যেতে পারে। লালপাতিয়া তোমাকে রান্না করে দেবে। চাও তো তার কাছ থেকে রান্না শিখেও নিতে পারো। লিট্টি খেয়েছ কখনো? ছাতুর লিটি। কোত্থেকেই বা খাবে তুমি! কলকাতার মেয়ে তো! লিটি খুব গরম। এই শীতকালেই খেতে হয়। বলব লালপাতিয়াকে, বানিয়ে দেবে।
এমন সময় দরজায় কে যেন ধাক্কা দিল।
ঋক গিয়ে দরজা খুলল।
বলল কা হো মালি ভাইয়া? ক্যা বাত।
–খাত ভেজিন সাহাব, মেমসাহেবকো লিয়ে।
–তো আও। আর আও। বইঠো। চায়ে পিয়েগা মালিভাই? তুরন্ত বন যায়গা। শীতে বেঁকেছিল মালি ছেঁড়া পুরোনো সোয়েটারে। মাথা নোয়াল। চিঠিটা হাতে নিয়ে মালিকে উঠোনের রোদে বসিয়ে ঋক বলল তৃষাকে, এই যে তোমার চিঠি!
–জবাব লেকে যানা হোগা। সাহাব বোলিন।
মালি বলল।
ঋক বলল, তুমি ঘরে গিয়ে আমার লেখাপড়ার টেবিলে বসে জবাব লিখে দাও। খারাপ বা রাগের কথা লিখো না। রাগটাগ সব কাল রাতের সঙ্গেই মরে গেছে তোমার জীবন থেকে। এ কথা জেনো। ভুলে যেয়ো না। রাগ দুর্বলের রিপু।
একবার তাকাল তৃষা ঋক-এর দিকে। তারপর চিঠিটা নিয়ে ঘরে গেল।
বার বার পড়ল চিঠিটা। বিশ্বাস হল না তৃষার যে, প্রণত এরকম চিঠি লিখতে পারে। মনটা খারাপ হয়ে গেল বড়ো। কিন্তু কিছু করারও নেই। কী লিখবে উত্তরে? লিখলে যে, অনেক কথাই লিখতে হয়, অনেকদিন ধরে লিখতে হয়। তা তো সম্ভব নয় এখন। মালি বসে আছে এখুনি উত্তর নিয়ে যাবে। চিঠিটা হাতে নিয়ে বোকার মতো অনেকক্ষণ বসে রইল তৃষা।
ঋক শঙ্খদার কবিতা সকালবেলায় আবৃত্তি করে তৃষার মধ্যে বহুদিন বন্ধ হয়ে থাকা কবিতার উৎসমুখ খুলে দিয়েছে যেন। একসঙ্গে বহুকবিতা মনে আসছে। জীবনে আনন্দের কত কী ছিল, আছে; ভুলেই ছিল এতদিন।
তৃষা লিখল–
সুরাইয়াটোলি
২৩-১২-৮৮
প্রণত, ভীতিভাজনেষু,
মাটি খুব শান্ত, শুধু খনির ভিতরে দাবদাহহঠাৎ বিস্ফারে তার ফেটে গেছে পাথরের চাড়। নিঃসাড় ধূলায় দাও উড়িয়ে সে লেখার অক্ষর।যে লেখায় জ্বর নেই, লাভা নেই, অভিশাপও নেই।
তুমি তোমার মতো বাঁচো। আমাকেও বাঁচাতে দাও আমার মতো করে।
সুখী হও। আমাকে ভুলে যাও। তুমি বড়োদেরি করে ফেললে, এখন আর কিছু করণীয় নেই, আমার মেজোমামা তোমাকে যা কিছু দিয়েছিলেন যৌতুক হিসেবে তা তোমার-ই। আমি কিছু চাই না সেই যৌতুকের।
ভালো থেকো।
ইতি–তৃষা
মালির চা খাওয়া হলে চিঠিটা খাম বন্ধ করে তার হাতে দিল তৃষা।
–মালি বলল, মাঝে মাঝে আসব মেমসাব।
–নিশ্চয়ই আসবে। মুঙ্গলী কেমন আছে?
–কাল রাতে তো এখান থেকে ফিরে গিয়ে সাহাব তাকে ডেকে নিলেন। সাহাবের সঙ্গে শুয়েছিল।
–আহা। শুক। শুক। কাল যে, বড়ো শীত ছিল রাতে। সকলেই সুখে থাকুক।
তৃষা বলল। মালি বোকার মতো মুখ করে চলে গেল।
ঋক স্নান করে নিয়েছে ততক্ষণে। আলুর চোকা আর পরোটা প্রায় বানিয়ে ফেলেছে নাস্তা হিসেবে। তৃষাকে বলল, স্নানঘরে টুথপেস্ট আছে। তোমার ব্রাশ যদি না এনে থাকে তো আমি বেরোচ্ছি নিয়ে আসব। আর কী কী আনতে হবে? তা মুখ ধুয়ে এসে জলখাবার খেয়ে বরং আমাকে একটা লিস্ট করে দাও।
–আমি তোমার সঙ্গে যাব।
–না। আজ নয়। আজ চান-টান করো। কাল রাতের গ্লানি অপমান, কষ্ট, চোখের জল সব ধুয়ে ফ্যালো। নতুন জীবন শুরু করবে আজ থেকে। আজ থেকে আলাদা ঘরেও শোবে লালপাতিয়ার সঙ্গে। যদি ডিভোর্স নিতে চাও, উকিলের সঙ্গে কথা বলতে চাও তো অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে আসব।
–একসঙ্গে তুমি এতকিছু বলো যে, আমি বুঝতে পারি না।
তৃষার মুখে কিছুক্ষণ রইল ঋক। তারপর বলল, আচ্ছা। ভবিষ্যতে আস্তে আস্তে কথা বলব।
বলেই বলল, আর শোনো। তোমার যাঁরা গার্জেন তাঁদের এক্ষুনি একটা টেলিগ্রাম করা দরকার। তোমার গার্জেনদের নাম-ঠিকানা আমাকে লিখে দাও।
–মানে মামাদের?
–মামারা যদি গার্জেন হন তবে মামাদের-ই!
-–আমার গার্জেন…
ঋক তৃষার মুখের দিকে চাইল। তৃষা বুঝল যে, ঋক বোঝাতে চাইছে সে তার গার্জেন নয়, হতেও চায় না।
ভীষণ ভয় করতে লাগল তুষার। কী যে বলবে, ভেবে পেল না।
ঋক বলল, ঠিকানাটা?
দিচ্ছি লিখে।
মেজোমামার নাম ঠিকানা নিয়ে ঋক চলে গেল। তার আগেই লালপাতিয়া এসে গেছিল। তাকে সব বলে গেল যাওয়ার আগে ঋক। রাম সিং লালপাতিয়ার হাতে কিছু টাটকা আনাজপাতি, ডিম এবং একজোড়া ছোটো দিশি মুরগাঁও পাঠিয়েছিল। কিন্তু বেরিয়ে যাওয়ার আগে ঋকের মনোভাবে খুব-ই বিস্রস্ত হয়ে পড়ল তৃষা। ঋককে এই প্রথমবার কাল দুপুরের পর থেকে বড়ো আশ্চর্য ঠেকল ওর চোখে।
ঋক চলে যেতেই ঘরে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ল তৃষা। তারপর চান-টান না করেই মেজোমামাকে একটি চিঠি লিখতে বসল।
সুরাইয়াগঞ্জ
পূজনীয় মেজমামা,
আমি কাল রাতে প্রণতর বাড়ি থেকে চলে এসেছি। এসে উঠেছি ওদের-ই অফিসের একজন অ্যাকাউন্টেন্ট ঋক রায়ের বাড়িতে। কেন এসেছি তা তোমাকে চিঠিতে জানাতে পারছি না, কিন্তু তুমি সব শুনলে বুঝবে যে, আমার কোনো উপায় ছিল না। আমার বড়ো বিপদ মেজোমামা। তুমি যদি একদিনের জন্যেও আসতে পারতে তবে বড় ভালো হত, নইলে আমার ভেসে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। তোমার সঙ্গে হয়তো আর কখনোই এ-জীবনে দেখা হবে না। অন্য মামাদেরও আমার কথা বোলো।
ইতি ভীতা তৃষা
আমার ঠিকানাঃ
প্রযত্নে ঋক রায়, সুরাইয়াগঞ্জ, ভায়া মুরাদগঞ্জ, জেলা পাটনা, বিহার।
পুনশ্চ- যদি আসো তো একা এসো। ছোটোমামা বা ছোটোমামিমা যেন না আসে সঙ্গে।
চিঠিটা Speed-Post-এ পাঠাতে হবে। চান-টান পরে হবে! লালপাতিয়া বলল, পোস্ট অফিস মুরাদগঞ্জে। এদিকে কোনো পোস্ট অফিস নেই! ইতিমধ্যে রাম সিং এসে হাজির। সে বাজারেই যাচ্ছিল। আজকে ঝামার-এ হাটও আছে। বিকেলে হাট করে ফিরবে। রাম সিংকে টাকা দিয়ে স্পিডপোস্ট-এর ব্যাপারটা বুঝিয়ে চিঠিটা ওকে দিয়ে পাঁচটা টাকা দিয়ে অনুরোধ করল তার কাজটি যেন এক্ষুনি সে করে। রাম সিং পাঁচ টাকাটা ফেরত দিয়ে বলল, আপনি ঋকবাবুর মেহমান। আপনার কাছে টাকা আমি নিতে পারব না। ওঁর সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের সম্পর্ক। বকশিশ-এর নয়।
লজ্জা পেয়ে ক্ষমা চাইল তৃষা। রাম সিং চলে গেলে অনেকক্ষণ উঠোনে রোদের মধ্যে থামে হেলান দিয়ে বসে রইল– কী করল, কী করবে এইসব ভাবতে ভাবতে। রোদ তার চোখের পাতার মধ্যে লাল-নীল দেশলাই জ্বেলে দিল। রোদ জ্বলতে লাগল, সময়ও জ্বলতে লাগল, গলতে লাগল তৃষাও।
.
০৬.
প্রণত অফিসে আসেনি। ঋক অফিসে গিয়েই জানল। তারপর নিজের কাজ কিছুটা গুছিয়ে ম্যানেজার সাহেবের কাছ থেকে ছুটি নিল বাকি দিনের।
–কী ব্যাপার রায়?
–আমার ব্যক্তিগত কাজ আছে স্যার।
–ক্যাজুয়াল লিভ কাটা যাবে একদিন।
–নেবেন কেটে স্যার।
–ওক্কে।
সাইকেলটা এখনও মেরামত করতে দিতে পারেনি। অসুবিধে হচ্ছে খুব-ই। ব্যাঙ্কে গিয়ে কিছু টাকা তুলল। তারপর হেঁটে হেঁটেই চলল প্রণতর বাড়ির দিকে।
উইক-ডে। বেলা বারোটা বাজে। চারদিকে কর্মব্যস্ত মানুষদের ছোটাছুটি। ধুলো উড়ছে উত্তরের হাওয়ায়। গমগম করছে বাজার এলাকা। তা পেরিয়ে এসে প্রণতর বাংলোর পথে পড়ল এবারে। যখন গেট খুলে বাংলোতে ঢুকল তখন কাউকেই দেখা গেল না। মালিকেও নয়। বারান্দায় উঠে এদিক-ওদিক তাকিয়েও কাউকে দেখতে পেল না। তখন ডাকল মালি বলে।
মালি পেছন দিক থেকে দৌড়ে এল। এবং ঋককে দেখে অবাক এবং আতঙ্কিত গলায় বলল, আপ?
–সাহাব নেহি হ্যায় ক্যা ঘরমে মালি?
–হ্যায়, হ্যায়। পিছুকা বাগানমে বৈঠকর পি রহা হ্যায়। আভভি হুয়া আপকি যানা ঠিক নেহি হোগা।
–কাহে না ঠিক হোগা?
বলে, ঋক বাংলোটা ঘুরে পেছন দিকে পৌঁছোল। একটা চেরিগাছের ছায়ায় বেতের চেয়ারে বসে বেতের টেবিলের ওপর হুইস্কির বোতল রেখে টেবিলের ওপর দুটি পা তুলে দিয়ে হাতে গ্লাস নিয়ে হুইস্কি খাচ্ছে প্রণত। বোতলের অনেকখানিই খালি হয়ে গেছে।
ঋক বলল, স্যার!
–কে? কে?
চমকে উঠে ঘাড় ঘুরিয়ে চাইল প্রণত।
–আমি ঋক স্যার।
–ঋক! তুমি? এসো এসো। হোয়াট আ প্লেজেন্ট সারপ্রাইজ। বোসো। খাবে নাকি? ও তুমি তো এসব খারাপ জিনিস খাও-টাও না।
–কে বলেছে খাই না? কখনো-সখনো খাই। আপনার সঙ্গে আজ খাব স্যার।
-–খাবে? মাই প্লেজার। তবে আমাকে আবার স্যার স্যার করছ কেন? কাল রাতে তো প্রণতবাবু বলছিলে। আমি বলব, বাবুটাও কর্তন করা। শুধুই প্রণত বলো। চাকরির সম্পর্কটা কোনো সম্পর্ক নয়।
–মালি। ও মুঙ্গলী!
মুঙ্গলী বোধ হয় রান্নাঘর থেকে সাড়া দিল, সাহাব।
–ঔর এক গ্লাস লাও।
–জি সাহাব।
–ঔর ওমলেট লাও বাদমে। দো।
মুঙ্গলী ঋককে দেখে একটু অবাক হল। বলল, আপ? হিক বাবু? বলেই, গ্লাসটা রেখেই পালাল।
–কিছু বলতে এসেছ আমাকে ঋক?
–না। শুনতে।
ঋকের গ্লাসে হুইক্সি ঢেলে দিতে দিতে প্রণত বলল, সে তো অনেক কথা। তা ছাড়া তুমি শুনেই বা কী করবে! তোমার উপকারও আমি করতে পারব না, আমার উপকারও তুমি নয়।
–আমি হয়তো আপনার উপকার করতে পারি।
–তুমি আমাকে তুমিই বোলো। আমি যখন এতদিন পদাধিকার বলে তুমি বলে এসেছি, তুমি বন্ধুত্বের দাবিতেই বলো। নাও খাও। চিয়ার্স।
ঋক বলল চিয়ার্স গ্লাস তুলে। তারপর বলল, আপনার চিঠির উত্তরে….!
–তুমি করেই বলো। আমাদের সম্পর্কটা এমন প্রায় সতীনের মতো।
–তুমি ভুল করছ প্রণতদা। তোমার স্ত্রীর হাতেও আমি হাত দিইনি। তোমার স্ত্রী তোমার ই আছে। তোমার চিঠির উত্তরে কী লিখেছিল তৃষা?
–তুমি জানো না?
–না। আমি তখন ওর জন্যে ব্রেকফাস্ট তৈরি করছিলাম!
–তুমি! মাই গুডনেস। এত গুণের লোক বলেই না!
ঋক হাসল। কী লিখেছিল তৃষা?
লিখেছিল যে, দেরি হয়ে গেছে আমার। আর কিছু করণীয় নেই। তার সঙ্গে কে এক কবি শঙ্খ ঘোষ-এর কবিতা কোট করে দিয়েছিল। আমি ভাই ওসব কিছুই বুঝি না। আরও গন্ডগোল হয়ে গেল। কী যে বলতে চেয়েছে তাও বুঝলাম না। কবিতা-টবিতা কি আমার জন্যে?
হুঁ। ঋক বলল হুইস্কিতে চুমুক দিয়ে।
প্ৰণত অবাকচোখে ঋককে দেখছিল। বলল, কাল রাতে যখন লাঠি হাতে নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলছিলে তখন অবাক হয়েছিলাম। এখন আরও অবাক হচ্ছি। তুমি রাতারাতি ভীষণ-ই বদলে গেছ ঋক। আনথিংকেবল।
–তুমি-ই বদলে দিয়েছ। তুমি নিজেও কি রারারাতি বদলাওনি প্রণতদা? তুমি কাল রাতে যা করেছ, মানে যে-ব্যবহার তৃষার প্রতি; তাতে তুমি যে, রাতারাতি বদলে গেছ সে সম্বন্ধেও তো সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
–আমি? হ্যাঁ। তা বলতে পারো। তবে আমি নই। এই অ্যালকোহল। কাল মদ আমাকে খেয়েছিল ঋক! কালকে আমি মানুষ ছিলাম না। আজকাল আমি প্রায়-ই যা বলি, যা করি তা আমার বলা বা করা নয়। আমার স্মৃতিশক্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমি মদেই নষ্ট হয়ে গেলাম একেবারে। কিছুতেই থামতে পারছি না। সত্যিই আমি যা করেছি তার ক্ষমা নেই। সে জন্যে আমি লজ্জিত। আমি তৃষার পায়ে ধরে ক্ষমা চাইতে রাজি আছি, যদি তুমি তৃষাকে ছেড়ে দাও।
–বাঃ। হাসল ঋক। বলল, ধরলামই-বা কখন যে, ছাড়ব? তুমি পাগল। কাল রাতে আমি তোমার ট্রাস্টির মতো তৃষাকে সযতনে রেখেছি। তার ওপরে আমার কোনো দাবি নেই। তবে অস্বীকার করব না, তৃষাকে আমার প্রথম দিন থেকেই খুব ভালো লাগে। সেই যেদিন পাটনা জংশনে তোমাদের আনতে গেছিলাম। কিন্তু ভালো লাগলেই বা কী। ভালো লাগাতে অনেক রকম হয়। সব ভালো লাগাকেই যে, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের ছকে বেঁধে ফেলতেই হবে তার কি মনে আছে? তোমার স্ত্রী হিসেবেও তো তাকে আমার ভালো লাগতে পারে। তুমি ও সে দু-জনেই তো আমাকে বন্ধুর মতো ভালোবাসতে পারো সমানভাবে কি? পারো না?
–সুস্থ কোনো সম্পর্কর কথাই ভাবিনি ঋক এতদিন। তাই তৃষাকে এত কষ্ট দিয়েছি। নিজেও বড়ো কম পাইনি। তোমার কথা ভেবে দেখবার।
–আসলে ব্যাপারটা কী স্যার জানেন?
–আঃ ঋক।
–ও। ব্যাপারটা কী জানেনা প্রণতদা? তুমি আরও চাই আরও চাই-এর দলে পড়ে গেছ। তুমি একা নও। তোমরাই এখন দলে ভারী। তোমাদের কারও পেছনে একবারও চাইবার অবকাশ নেই। ভালো আসবাব, ভালো ফার্নিশিং, ভালো গাড়ি, ভালো মদ, ভালো স্ত্রীর উপরি এক বা একাধিক নারী, কালার টি. ভি., ভি. সি. আর, এয়ারকণ্ডিশনার এই গেল তালিকা। গত মাসে রিডার্স ডাইজেস্ট-এ পড়ছিলাম, Quotable quotes-এ যে When we have provided against cold, hunger and thrist, all the rest is but vanity and excess কথাটা বড়ো ভালো লেগেছিল। সুখ, প্রাচুর্যর মধ্যে, আধিক্যের মধ্যে কোনো দিন-ই ছিল না প্রণতদা। সুখ ছিল তোমার মনে। আমার মনে। নিজের মনে তাকিয়ে দেখার অবকাশ হয়নি কখনো তোমার। চিরদিন বাইরের দিকে চোখ ছিল, ভেতরে কখনোই চেয়ে দ্যাখোনি। তৃষা অত্যন্ত অন্তর্মুখী, সুন্দরী, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন শিক্ষিতা মেয়ে। ও তোমাকে ডিভোর্স করে নিজে স্বাবলম্বী জীবনযাপন করতে পারে সহজেই। হাজার ছেলে দৌড়ে এসে ওকে বিয়েও করবে। তোমার দয়ানির্ভর সে নয়। কিন্তু তুমি যদি তৃষাকে হারাও তবে আর কখনোই তৃষার মতো অন্য কাউকেই পাবে না।
–আসলে বৃন্দা…..
–বৃন্দা কে?
–তৃষার ছোটোমামি।
–এসব কথা আমাকে বলার দরকার নেই। তৃষার সঙ্গে বসে দু-জনের সব ভুল বোঝাবুঝি পরিষ্কার করে নিয়ো। আমি সব সাহায্য করব। আমাকে আর একটা হুইস্কি দাও।
মুঙ্গলী ওমলেট নিয়ে এল।
প্রণত ঋককে আর একটা ড্রিঙ্ক ঢেলে দিল।
ঋক বলল, আজ সন্ধে লাগতেই তুমি স্নান করে, ধুতি-পাঞ্জাবি পরে এবং শাল গায়ে দিয়ে আমার মাটির কুটিরে আসবে। গাড়ি নিয়ে এসো না। ও সব আড়ম্বর ওখানে মানায় না। যে রিকশা নিয়ে যাবে তাকেই বলে দেবে কালকে সকাল সাড়ে সাতটাতে আসতে। নিয়ে যাবে। তোমাকে। রাতটা তোমার স্ত্রীর সঙ্গেই কাটাবে।
–সে কি আমার মুখ আর দেখবে? মনে হয় না ঋক।
–সে তুমি ছেড়ে দাও আমার ওপরে। কিন্তু এই তোমার শেষ সুযোগ। ক্ষমা চাইবার, প্রায়শ্চিত্ত করার। এইটা শেষ করেই আমি উঠব। আমার অনেক কাজ আছে। ভালো করে স্নান করে সুন্দর করে সেজে, সুগন্ধি মেখে যেয়ো। মনে কোরো, অভিসারে যাচ্ছ। আবারও বলে গেলাম।
প্রণত অবাক হয়ে চেয়েছিল ঋকের মুখের দিকে।
বলল, তোমরা দু-জনে কি আমাকে খুন করে নদীতে ভাসিয়ে দেবে? মতলবটা কী বলো তো! আমি যা করেছি গতরাতে তৃষার সঙ্গে, তোমার সঙ্গে তারপরে তোমার এই ব্যবহার রীতিমতো রহস্যময় বলেই মনে হচ্ছে।
–জীবন তো রহস্যময় হবেই প্রণতদা। জীবনের মতো এমন গভীর-গোপন মালটিডাইমেনশনাল রহস্য আর কী আছে?
–ঋক! তোমার এই তুমিকে এতদিন কোথায় লুকিয়ে রেখেছিলে?
–জীবনের মধ্যেই। রবীন্দ্রনাথের সেই কবিতা পড়োনি?
রাতের সব তারাই আছে।দিনের আলোর গভীরে।
–আমার মধ্যেই ছিলাম। দেখতে পাওনি শুধু।
–না। কোনো কবিতা-টবিতা পড়িনি বলেই তো তোমার তৃষার সঙ্গে বনিবনা হল না।
–তৃষা আমার নয়। তবে জীবনে সুখী হতে হলে, সম্পূর্ণ মানুষ হতে হলে, মেয়েদের বুঝতে হলে একটু কবিতা-টবিতা পড়া দরকার। কবিতা না পড়লে মানুষের মনুষ্যত্ব অপূর্ণ থেকে যায়।
কিছুক্ষণ বোকার মতো চেয়ে থাকল প্রণত ঋক-এর মুখের দিকে।
ঋক বলল, উঠলাম। এবার গিয়ে শুয়ে পড়ো প্রণতদা। ভালো করে এক লম্বা ঘুম দিয়ে নিয়ে উঠে চান-টান করে চলে এসো। তোমাকে নতুন জীবন দেব। কথা দিলাম। তুমি বদলে কিছু দাও আর নাই দাও।
.
০৭.
ফেরার সময়ে একটু ঘুর হলেও খাদি গ্রামোদ্যোগ-এ গিয়ে একটি ডাবল-বেড বেডশিট এবং বেডকভার কিনল ঋক। তারপর রাবড়ি কিনল পাঁড়ের দোকান থেকে, মুসলিম-এর দোকান। থেকে এককেজি পাঁঠার সিনা, বাজার থেকে লেড়ো বিস্কুট। তারপর এসব নিয়ে একটি রিকশা নিয়ে বাড়ির দিকে চলল।
তৃষার সারাদিন আজ বড়ো আনন্দে কেটেছে। লালপাতিয়া বলেছিল, দিদি তোমাকে ভালো করে তেল মাখিয়ে দিচ্ছি। সর মাখিয়ে দিচ্ছি মুখে। তারপর কুয়ো থেকে জল তুলে তোমাকে চান করিয়ে দেব। রোদে বসে থাকবে তুমি। লজ্জা কীসের। আর তুমি ছাড়া এখানে আর কেউ তো নেই।
তাই করেছে তৃষা। এত টাটকা লাগছে নিজেকে তা বলার নয়।
দুপুরে লালপাতিয়াই বেঁধেছিল। বাসমতী চালের ভাত, সোনামুগের ডাল মধ্যে তিন-চার রকমের শাক দিয়ে, বেগুন ভাজা, নদীর কুচোমাছের ঝাল, পুদিনার চাটনি। ঘরে ছিল লেবু আর আমলকীর আচার। ভাতের মধ্যে রাম সিং-এর গ্রামের খাঁটি ঘি ফেলে দিয়েছিল। আঃ খাবার না যেন অমৃত। এমন-ই ঘি যে, ডান হাতে এখনও তুড়ি দিতে পারছে না সাবান দিয়ে ধুয়েও।
সারাদুপুর পেছনের বারান্দার রোদে বসে নদীর দিকে চেয়ে থেকেছে। আর লালপাতিয়ার কাছে গান শুনেছে তাদের গ্রামের, রাম সিং-এর এবং তাদের ঋকবাবুর। কখন যে, বেলা পড়ে এসেছে মেছোবকেরা শান্ত ভড়ানে জঙ্গলের ভেতরে তাদের ডেরায় ফিরে গেছে, পশ্চিমের আকাশে সিঁদুর খেলে সূর্য চলে গেছে তা খেয়াল-ই হয়নি। লালপাতিয়া মুচমুচে কুচো নিমকি আর চা করে এনে বলেছে, এবারে ঘরে চলো দিদি। ঠাণ্ডা ধরে নেবে।
ওরা ঘরে আসতে-না-আসতেই ঋক এসে হাজির। লালপাতিয়াকে বলেছে, কাঁধের থলি নামিয়ে রেখে, শিগগির আদা, পেঁয়াজ, রসুন আর পেঁপে বেটে সেই রসে এই সিনাগুলো ভিজেয়ে রাখ লালপাতিয়া। রাতে রাম সিং আর আমার আর একজন মেহমান খাবে। আমি হাত-মুখ ধুয়ে নিয়ে এসেই ভুনি খিচুড়ি চাপাব। আলু আর বেগুন কাটবি ভাজার জন্যে। শুকনো লঙ্কা বের করবি। মনে আছে তো কোথায় রাখা আছে? ওই ঝোলানো হাঁড়িটার মধ্যে। কী রে?
–মনে আছে বাবু।
বলে, হেসেছে লালপাতিয়া।
–কেমন কাটল দিন? তৃষা?
–দারুণ। এক অন্য দিন। ভারি ভালো লাগল।
–জীবনের প্রত্যেকটি দিনকেই অন্যদিন যারা করে তুলতে পারে তাদের জীবন। কখনোই পুরোনো হয় না। তোমার জীবনও পুরোনো হবে না।
–আমার আবার জীবন! আছেটা কী? সব শেষ।
–বলো কী তুমি! এই তো সবে শুরু।
সারাদিন-ই আনন্দে কেটেছে তৃষার কিন্তু মনের মধ্যে একটিই প্রশ্ন বারবার কাঁটার মতো বিঁধেছে। ঋক-এর টেবিলে যে-মেয়েটির ছবি সে দেখেছে সে মেয়েটি কে? লালপাতিয়াকে জিজ্ঞেস করতে পারত কিন্তু লজ্জা করেছে। তা ছাড়া লালপাতিয়া হয়তো জানেও না।
হাত-মুখ ধুয়ে এসে জামকাপড় ছেড়ে খদ্দরের পায়জামা আর পাঞ্জাবি পরে, গরম দেহাতি কাপড়ের জহরকোট পরে ঋক কাজে লেগে গেছে। তৃষাকে বলেছে, ভালো করে সাজাতে হাত-পা মুখ ধুয়ে নিয়ে। ঋকের গণ্যমান্য অতিথিকে খেতে বলেছে সে আজ। আলাপ করিয়ে দেবে তৃষার সঙ্গে। খুব ভালো লাগবে তৃষার।
তৃষা যখন হাত-মুখ ধুতে গেছে স্নানঘরে, সেখানে লালপাতিয়া কেরোসিনের টিনে করে জল তুলে রেখেছিল; তখন ঋক, লালপাতিয়ার সাহায্যে পেছনের দিকের ঘরে অনেক পোয়াল এনে প্রায় একহাত উঁচু করে দু-জনের বিছানা করেছে। তার ওপর পেতে দিয়েছে নতুন কেনা ডাবল বেডের চাদর। ঢেকে দিয়েছে বেডকভার দিয়ে। নতুন ওয়াড় পরিয়ে দেওয়াল-আলমারি খুলে দু-টি বালিশ বের করে পেতে দিয়েছে এবং পাছে বিছানা ঠাণ্ডা হয়ে যায় তাই নতুন লেপ বের করে তাতে পাতলা মার্কিনের ওয়াড় পরিয়ে তা দিয়ে বালিশ এবং বিছানাও ঢেকে দিয়েছে। লালপাতিয়াকে বলেছে ওই ঘরের কোণে-কাঠকয়লার আগুনের মালসা রেখে দিতে যাতে গরম হয়ে থাকে ঘর। আর এই ঘরের বিছানা সম্বন্ধে কিছু বলতে মানা করেছে তৃষাকে। পেছনের বাগান থেকে লাল আর হলুদ গোলাপ তুলে এনে পাপড়ি ছড়িয়ে দিতে বলেছে তাকে লেপের নীচে।
তৃষা মুখ-হাত ধুয়ে ঋকের ঘরে গিয়েই সেজেগুজে এসেছে। একটি মেরুনরঙা সিল্কের শাড়ি পরেছে। লণ্ঠনের আলোয় ওকে একটি মসৃণ উজ্জ্বল প্রজাপতির মতো দেখাচ্ছে। লণ্ঠনের আলো বিজলি আলোর চেয়ে অনেক-ই ভালো। যেটুকু দেখবার দেখায়, যেটুকু দেখাবার নয়, লুকিয়ে রাখে। অনেক রোমান্টিক। কোনো বিদেশি পারফিউম মেখেছে। তার গন্ধে ঋক-এর মাটির ঘরবাড়ি ম-ম করছে।
একবার জোরে নাক টেনে নিশ্বাস নিয়ে ঋক বলল, আহা রোজ যদি এমন সুগন্ধে ভরে যেত আমার এই গোবর-লেপা ঘর-বাড়ি।
তৃষা মুখ তুলে বলতে গেছিল তুমি ইচ্ছে করলেই ভরে যেতে পারে। কিন্তু বলতে গিয়েও বলল না। ঋক পরক্ষণেই গেয়ে উঠেছে ওহে সুন্দর মম গৃহে আজি পরমোৎসব রাতি, ওহে সুন্দর।
হেসেছে তৃষা।
মানুষটিকে ও ঠিক বুঝতে পারছে না। কাল রাতে বুঝেছিল। ভেবেছিল যে, বুঝেছিল। কিন্তু সকাল থেকেই কেমন সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।
ঋক যখন চা খেল তখন তৃষা আর লালপাতিয়াও আর একবার করে খেল। এমন শীতে চা সবসময়ই আনন্দর। ওরা যখন চা খাচ্ছে তখন রাম সিং এল। বলল আমার চা?
লালপাতিয়া হেসে বলল, আছে। রাম সিং চা খেয়ে লণ্ঠন আর ছুরি হাতে করে পেছনের দরজা খুলে মুরগি দুটোকে নিয়ে নদীর দিকে চলে গেল বানিয়ে আনবে বলে।
–ভুনি খিচুড়ি, আলু বেগুন আর শুকনো লঙ্কা ভাজা, পাঁঠার সিনা ভাজা ক্র্যাম দিয়ে; আর মুরগির কষা মাংস। ভালো হবে না?
–তুমি বড়ো খাদ্যরসিক।
তৃষা বলল।
–জীবন-রসিক মাত্রই খাদ্যরসিক। ভালো খাওয়া, ভালো গান, ভালো কবিতা, ভালো পোশাক (দামি নয়), ভালো সুগন্ধ, ভালো ভালোবাসা এই সবকিছু নিয়েই তো জীবন। একের সঙ্গে অন্যের যে, অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। তোমাকে কিন্তু রান্না শিখে নিতে হবে তৃষা। রান্না, মেয়েদের একটি মস্ত গুণ। যে-মেয়েরা একথাটা জানে না তারা ভুল করে। দিন-রাত হেঁসেল ঠেলার কথা বলছি না। প্রয়োজনে এবং শখে রান্না যে-মেয়ে করে না সে পুরোপুরি মেয়েই নয়।
তৃষা হেসে উঠল। বলল, মেয়েদেরও এক নতুন ডেফিনেশান শুনছি।
ঠিক সেই সময়ে একটি সাইকেল রিকশার ঘণ্টা শোনা গেল এবং বাইরের লোহার হুড়কোতে কে যেন শব্দ করল।
ঋক বলল, ওই বোধ হয় আমার অতিথি এল। তৃষা কিছু বলার আগেই ঋক উঠে দরজা খুলতে গেল। অর্ধেক পথ গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, আমাকে তুমি ভালোবাসো? তৃষা?
তৃষা কথা না বলে, মাথা নোয়াল, খুব-ই লজ্জা পেয়ে।
–আমার অতিথির সঙ্গে সুন্দর ব্যবহার কোরো তাহলে।
বলেই, দরজার কাছে গিয়ে দরজা খুলে বলল, এসো এসো। আমার কী সৌভাগ্য! তৃষা লণ্ঠনের আলোতে ধুতি-পাঞ্জাবি পরা লম্বা, চওড়া সুপুরুষ মানুষটিকে চিনতে পারল না প্রথমে। পরক্ষণেই চিনতে পেরে একদৌড়ে ঘরের মধ্যে চলে গেল। যে-ঘরে (ঋকের ঘরে) তৃষা গেল সেই ঘরেই প্রণতকে নিয়ে ঋক ঢুকল এসে। বলল, তৃষা ইনি একজন বন্ধু আমার, দাদা স্থানীয়। নতুন মানুষ। এঁকে তুমি চেনো বলে জানো বটে, আসলে কিন্তু চেনো না। ভালো করে আজ আলাপ করিয়ে দেব বলেই নেমন্তন্ন করেছি।
তৃষা বলল, রাগত স্বরে, আমি এর কোনোই মানে বুঝছি না।
প্রণত মুখ নীচু করে অপরাধীর মতো বলল, আমিও কিন্তু না। এসব ঋক-এর কারসাজি।
ঋক হেসে বলল, আমিও বুঝিনি কিন্তু পরে হয়তো বুঝব। এখন এসব কথা ছেড়ে আমরা অন্য কথা বলি। প্রণতদা তুমি তৃষার গান শুনেছ কখনো? শুনতে চাওনিও তো কখনো? কবিতা? আর তৃষা তুমি প্রণতদার মুখে তাঁর অফিসের কলিগদের গল্প শুনেছ কখনো? হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যাবে তোমার।
তৃষা আড়ষ্ট হয়েই ছিল। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে। প্রণতও মুখ নীচু করে অপরাধীর মতো বসেছিল। লণ্ঠনের আলোতে ওদের দুজনের ছায়া পড়েছিল মাটির দেওয়ালে। ওদের আসল মাপের চেয়ে অনেক বড়ো হয়ে।
ঋক বলল, এক কাজ করো। এখনও শিশির পড়া আরম্ভ হয়নি। তোমারা এই লণ্ঠনটি নিয়ে আমার বাড়ির শালবনের পথে একটু হেঁটে এসো। দু-জনেই মাথা ঢেকে নিয়ে কিন্তু। আমার রান্নাটা ততক্ষণে আমি এগিয়ে নিই। কেমন?
বলেই ডাকল, লালপাতিয়া। যা তো বোন, সাহেব মেমসাহেবকে লণ্ঠনটা নিয়ে এগিয়ে দে। শালবনের পথটা দেখিয়ে লণ্ঠনটা দিয়েই ফিরে আসবি। অনেক কাজ আছে আমাদের।
রাম সিং ফিরে এল লালপাতিয়া ফেরার আগেই।
রাম সিং বলল, যা করার চেষ্টা করছ তা কি পারবে?
–না পারি, চেষ্টা করতে ক্ষতি কী বলো? দু-টি অমূল্য জীবন বেঁচে যাবে। মওত তো অনেক রকমের হয়। এ তো জীবন-মরণের ব্যাপার। অমিল থাকে না কোন মিয়া-বিবির মধ্যে? তা বলে সবাই যদি কথায় কথায় একে অন্যকে ছেড়ে যেত।
প্রণত বলল, তৃষাকে, এই! আমাকে কি কোনোরকমেই ক্ষমা করা যায় না?
–না।
তৃষা বলল।
–আমি জানি। তুমি আমি হলেও আমাকে ক্ষমা করতাম না। আসলে তোমাকে আমার অনেক কিছু বলার ছিল তোমার ছোটোমামির কথা, ম্যানেজার শ্রীবাস্তবের কথা, মুঙ্গলীর কথা।
–আমার শোনার আর ইচ্ছে নেই কোনো। বললে তো অনেক আগেই বলতে পারতে।
-–একটা শেষ সুযোগ দিয়ে দেখলে পারতে! সুযোগ দিলেই যে, ক্ষমা করতে হবে এমন কোনো মানে নেই।
–এই ঋক মানুষটা মোটেই সুবিধের নয়। কাল যাকে লাঠি হাতে মারতে গেল আজ তাকেই নেমন্তন্ন করে আনবার মানে কী? আমি তো কিছু বুঝেই উঠতে পারছি না।
–আমিও সে কথাই ভাবছি। লোকটা সুবিধের কি না জানি না তবে, লোকটার চরিত্রর রকম সম্বন্ধে আমারও সন্দেহ হচ্ছে। যে, কাল আমার স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস করল সেই আজ আমার কাছে তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্যে উদগ্রীব।
–সহবাস করল মানে কী? কী বলতে চাইছ তুমি? সকলেই কি তোমার মতো? তুমি এই যদি বলতে পারলে, তবে বলতেও পারে যে, লালপাতিয়ার সঙ্গেও ঋক-এর কোনো, সম্বন্ধ আছে। তোমার মন তো নয়। আস্তাকুঁড়।
-তা বলছি না। তবে কিছু থাকলেও দোষের কী? বেশ তো মেয়েটি।
–ছি : তোমার নজর-ই নোংরা।
–হয়তো। তবে তোমার-ই হাতে নিজেকে সঁপে দেব এবারে। তুমি যেমন করে গড়ে নেবে….
–যাক। আর যাত্রা করতে হবে না।
–কী সুন্দর গন্ধ বেরোচ্ছে একটা না? জঙ্গলের?
–বাবাঃ কোন দিকে সূর্য উঠল। এসবও তোমার নাকে যায়? জঙ্গলের গন্ধের সঙ্গে আমার পারফিউমের গন্ধও আছে।
–তোমার শরীরের গন্ধও।
–থাক।
–আকাশভরা কত তারা।
–বাবাঃ ভূতের মুখে রামনাম। তা তারা তো তোমার বাড়ির আকাশেও আছে। কোনোদিন দেখেছিলে কি?
–না। এবার থেকে দেখব।
–একা বসে দ্যাখো। মালি আর মুঙ্গলীকে সঙ্গে নিয়ে।
–না। তোমার সঙ্গেই দেখব।
–তুমি একটা মানুষ-ই নও।
–মানুষ ঠিক-ই, তবে বেশিদিন বোধ হয় বনমানুষ থেকে মানুষ হইনি। নানারকম ব্যাপার এখনও বড়ো প্রবল।
–কীরকম?
–যেমন শরীর।
-–তুমি একটি পার্ভার্ট। স্ত্রীর শরীর না চেয়ে তুমি নোকরানির শরীর চাও।
–হ্যাঁ। চেয়েছিলাম। অনেক নির্ঝঞ্ঝাট বলে। তোমাকে অনেক কথা বলার ছিল। কিন্তু তুমি আমার নতুন বউ, তোমাকে সুন্দর র্যাপিং পেপারের মোড়ক খুলে দেখিনি পর্যন্ত। আমি সত্যিই অমানুষ! সব পাপ ক্ষালন করে দেব দেখো। তোমাকে আমি ভালোবাসি তৃষা।
-ফুঃ। ভালোবাসা!
–বিশ্বাস করো, কাল রাতের আগে একথা আমি নিজেও জানতাম না। আজ সারাদিন কী যে, কষ্টে কেটেছে আমার, কী যে অনুশোচনা, গ্লানি–কী বলব তোমাকে।
–থাক। ওসব কথা। আমার নাক দিয়ে জল গড়াচ্ছে। বেশ ঠাণ্ডা বাইরে।
প্রণত পাঞ্জাবির পকেট থেকে রুমাল বের করে তৃষার নাক মোছাতে গেল! তৃষা ছোঁ মেরে রুমালটা নিয়ে নিজেই মুছে বলল, আদিখ্যেতা কোরো না বেশি বেশি বলে রুমালটা ফেরত দিল।
ওরা ফিরতই রাম সিং দরজা খুলে দিল। শুনল রান্নাঘর থেকে দরাজ গলায় গান গাইছে ঋক–
এলো যে শীতের বেলাবরষ পরে, এলো শীতের বেলা। …..বাহিরে কাদের পালা হইবে সারাআকাশে উঠিবে সন্ধ্যাতারাআসন আপন হাতে পেতে রেখো আঙিনাতেঅতিথি আসিবে রাতে তাহারি তরে।
–এসো এসো। বাঘ-টাঘ সামনে পড়েনি তো!
প্রণত বলল, এ জঙ্গলে শেয়াল থাকলেই বেশি, তার বাঘ।
আর বাঘ সত্যি সত্যিই আর কজনের সামনে পড়েছে আজ অবধি। সব-ই তো কল্পনার বাঘ। স্বপ্নের পোলাউতে যেমন, ঘি ঢালতে কষি করতে নেই দুঃস্বপ্নের বাঘের সাইজেও তেমন কার্পণ্য করতে নেই। এ পর্যন্ত ছোটোবাঘও কেউ কি দেখেছে? শুনেছ কারও মুখে?
–তা ঠিক। বেশ মজার মজার কথা বলেন আপনি ঋকবাবু।
–আমাকে তুমি তুমিই বোলো। যেমন বলছিলে! প্রণতদা তো ঘরের লোক। তার সামনে লজ্জা কী!
তারপর-ই বলল, ঠাণ্ডা লাগিয়ে এসেছ তো! এই দ্যাখো ঠাণ্ডার ওষুধও এনে রেখেছি। তৃষাকে একটু গরম জল দিয়ে দিচ্ছি। আর আমি আর প্রণতদা এমনিই জল দিয়ে খাব।
–কী?
চোখ বড়ো বড়ো করে বলল তৃষা।
–ব্রাণ্ডি। ঠাণ্ডার যম।
–তুমি মদ খাও?
–খাই বই কী! তুমি মিছেই প্রণতদাকে দোষ দাও। আজকাল মদ খায় না কে? তবে প্রণতদা মাঝে মাঝে বাড়াবাড়ি করে ফেলে এই যা। এবার থেকে করবে না শুনতে পাচ্ছি।
–কে বলেছে তোমাকে?
তৃষা বলল।
–শুনতে পাচ্ছি। এই নাও তৃষা। একটু একটু করে চুমুক দাও। আড়ষ্টভাবটা চলে যাবে। শীতও পড়েছে। বড়োদিনও এসে গেল। আমাদের মতো কেরানিদেরও বড়োদিনে একটু কেক খেতে আর মদ খেতে হয়। সাহেবদের কাছে শিক্ষা। বুঝলে না। কই গেলে রাম সিং? কই এসো। তুমি-ই বা বঞ্চিত হও কেন? এই লালপাতিয়া তুই খেয়ে-দেয়ে শোয়ার সময়ে এক চুমুকে খেয়ে নিবি। ঘুম ভালো হবে। তোর জন্যেও রেখে দেব। ভাবিস না।
চিয়ার্স বলল ঋক। তারপর বলল, কই তৃষা খাও। তৃষা অবাক হচ্ছিল। মদ ব্যাপারটার মধ্যে ও চিরদিন-ই একটি গর্হিত অপরাধ লক্ষ করেছিল। আজ ঋক ব্যাপারটাকে রান্নাঘরে ঢুকিয়ে এমন জল-ভাত করে দিল বলে সত্যিই আশ্চর্য হচ্ছিল।
বলল, জীবনে কোনোদিনও খাইনি।
এই কথাটা শুনলেই আমার হাসি পেয়ে যায়। জীবনে বিয়ের আগে কোনোদিনও একটা জিনিস করেছিলে? অবশ্য না–করে থাকলে আমি জানি না।
ঋক ভালোমানুষের মতো মুখ করে বলল।
প্রণত হো হো হো করে হেসে উঠল।
তৃষা কথার মানেটা একটু পরে বুঝল। বুঝেই লজ্জায় লাল হয়ে গেল। বলল, এত অসভ্য না।
নাও, এবার খাও। স্বামী-স্ত্রীর জীবনের সঙ্গী হবে, স্ত্রী স্বামীর। দূরে দূরে ছেড়ে ছেড়ে থাকে বলেই আমাদের দিশি দম্পতি একে অন্যকে পরিপূর্ণভাবে পায় না। কিটসন সাহেবকে দ্যাখোনি প্রণতদা? স্বামী-স্ত্রী যেন একে অন্যকে পলকে হারায়। স্বামী যা করতেন স্ত্রীও তাই করতেন। নইলে কীসের জীবনসঙ্গিনী?
–তা বলে মদ খেতে হবে?
তৃষা বলল।
–একে মদ খাওয়া বলে না। সোশ্যালড্রিঙ্কিং এর নাম। আমার কথা শোনো। দু-জনে মিলে একসঙ্গে গল্প করতে করতে, গান শুনতে শুনতে, কবিতা পড়তে পড়তে একটু খেলে ক্ষতিই বা কী? বাইরে খাওয়ার চেয়ে বাড়িতে খাওয়া অনেক ভালো। স্ত্রী না খেলে স্বামী মদ্যপদের পাল্লায় পড়ে রোজ-ই দেরি করে বাড়ি ফিরবে। আর মাতাল মানুষ আর কাটনেওয়ালা জানোয়ারের তফাত কী আছে বলো?
–তোমার খিচুড়ির গন্ধটা বেশ ছেড়েছে।
প্রণত বলল কী বলবে ভেবে না পেয়ে।
–এখন-ই কী? যখন খাবে, তখন বুঝবে। চলো। বাকিটা রাম সিং ভাই আর লালপাতিয়া সামলে নেবে। আমরা আমার ঘরে গিয়ে বসি। একটু আড্ডা মারা যাক।
রাত প্রায় সাড়ে দশটা এখন। ওদের খাওয়া-দাওয়া শেষ। তৃষা দুটো বড়ো ব্রাণ্ডি খেয়েছে গরম জলে। প্রণতর প্রতি বিরূপতা যেন অনেকখানি কেটে গেছে। তবে তার প্রধান কারণ ঋকের মজার মজার কথা, গান, কবিতা। ঋক যেখানে থাকে সেখানে কারও ব্যাজার মুখে থাকার উপায় নেই।
প্রণত বলল, এবার একটা রিকশা ডেকে দিতে হয় ঋক!
–রিকশা? রিকশা এখানে কোথায় পাবে? রিকশা ডাকতে হলে সেই মুরাদগঞ্জের মোড়ে যেতে হবে। গাড়ি থাকতে গাড়িখানা নিয়ে এলে না কেন? পরস্ত্রীর বোঝা আর আমার বইতে হত না! মিয়া-বিবিকে একসঙ্গে তুলে দিতাম গাড়িতে। তোমার গাড়িখানা কি কেবল-ই গরিবের সাইকেল ভাঙার জন্যে? ওরা সকলেই হেসে উঠল। প্রণত বলল, তোমাকে আমি একটি অটো সাইকেল কিনে দেব।
–হ্যাঁ! আমি নিলে তো! পায়ে বাত হবে। সাইক্লিং ইজ আ ভেরি গুড এক্সসারসাইজ।
–আমি এখন যাব কী করে? ঋক?
—তুমি যে, এখান থেকে একা যাবে তা তো হবে না। রাত নটার পর থেকে এই রাস্তা একটা পাগলা শেয়ালের টেরিটোরি হয়ে যায়। কাল আসা-যাওয়ার পথে দ্যাখোনি তাকে?
-না তো!
–কোথায় যাবে এতরাতে। আর তোমার রিকশা ডাকতে গিয়েই বা কে নিউমোনিয়া বাধাবে! জলে তো আর পড়োনি। আমার আবার ভীষণ ঘুম পেয়ে গেছে। যা গেল না সারাটা দিন!
তা ঠিক। তৃষা বলল।
–আই অ্যাম সরি ঋক।
–আর কথা না বাড়িয়ে এবারে এসে দেখি। বিছানা পর্যন্ত পেতে রেখেছি।
–সে কী! কোথায়?
তৃষা অবাক হয়ে বলল।
–এসোই না।
–আমি কিন্তু কাল যেখানে শুয়েছিলাম সেখানেই শোব।
তৃষা বলল।
–আমি কি তাহলে প্রণতদার মতো একজন আধোচেনা ধুমসো পুরুষমানুষকে জড়িয়ে ধরে রাত কাটাব। ওসব হচ্ছে না।
তারপর-ই গলা নামিয়ে ঋক বলল, তৃষা কথা শোনো। ডোন্ট ক্রিয়েট আ সিন। ওরা আছে না। কী ভাববে!
ঘরে একটি লণ্ঠন ফিতে কমিয়ে রেখে ঋক বলল। প্রণতদাকে বাথরুমটা দেখিয়ে দিয়ে তৃষা। যদি রাতে যান। খাবার জল রইল জাগে। গ্লাস। আর এই দ্যাখো, সব নতুন। বলেই লেপটা তুলে দেখাল। লাল আর হলুদ গোলাপের পাপড়ি ছড়ানো বেডশিটের ওপর।
–দেখছ! কী পাজি!
তৃষা বলল।
–বেডশিটটা তো আর তুলোর না। নীচ থেকে ঠাণ্ডা তো উঠবেই। তোশক-টোশক তো নেই। তারপর গলা নামিয়ে বলল, দু-জনে দু-জনকে যতটুকু গরমে রাখতে পারো ততটুকুই গরম। ওক্কে গুড নাইট। আমি শুতে চললাম। আমার ঘর থেকে তোমার স্যুটকেসটা দিয়ে যাচ্ছি তৃষা। যদি কোনো কিছুর দরকার হয়। ও একটা কথা শোনো প্রণতদা।
বলেই, প্রণতকে উঠোনে ডেকে এনে ঋক বলল, বিয়ে তো আমি করিনি কিন্তু বিশ্বস্তসূত্রে জেনেছি যে, দম্পতির সব ঝগড়া বিছানাতেই মিটে যায়।–কথাটা যে সত্যি তা প্রমাণ করো।
.০৮.
এখন বেলা আটটা। ঋকের স্নান হয়ে গেছে। নাস্তাও হয়ে গেছে। তৃষাদের জন্যে নাস্তার বন্দোবস্ত করে অফিসে বেরোল ঋক। ও ঘরের দরজা এখনও খোলেনি। রোদ ঝলমল। আকাশের দিকে চেয়ে মনটা ভারি প্রসন্ন লাগল ঋকের। বহুদিন এত ভালো লাগেনি ওর।
বেরোবার সময়ে রাম সিংকে বলে গেল মুরাদগঞ্জের মোড় থেকে রিকশা ডেকে এনে দু জনকেই তুলে দিতে সব মালপত্র দিয়ে। অফিস-ফেরতা ওঁদের বাড়ি গিয়ে দেখা করবে ঋক। অফিসেও বলে দেবে যে, সাহেব আজও অফিসে যাবেন না। আর একটা কথা রাম সিং। লালপাতিয়াকে সঙ্গে করে তুমি রাতে নিয়ে যাবে সাহেবের বাংলোয়। ওখানেই থাকতে হবে ওকে কিছুদিন। আমার মুখ চেয়ে। যতই কষ্ট হোক ওর গ্রাম ছেড়ে থাকতে।
শিশিরভেজা শালবনের পাতায় পাতায় রোদ পড়ে লক্ষ হিরের মতো ঝলমল করছে দু দিক। জোরে নিশ্বাস নিলে এখনও নাকে ব্যথা করে এমন ঠাণ্ডা। একটা নীলকণ্ঠ পাখি পাতা থেকে শিশির ঝরিয়ে আকাশের নীল আর রোদকে কুচিকুচি করে ছিঁড়ে তার প্রাণের অকলুষ উৎসারে ডাকতে ডাকতে চলে গেল নীদর দিকে। ভেজা ধুলোর গন্ধ উঠছে চারপাশ থেকে। নদীর গন্ধ ভাসছে থম-ধরা সকালে। হাওয়াটা এখনও শুরু হয়নি। বেলা বাড়লে শুরু হবে। বনে বনে উশখুশ উশখুশ। ঝরা পাতা উড়বে এদিকে ওদিকে উত্তরের হাওয়ায়।
কোনো মানুষকেই খারাপ বলে কখনো ফেলে দিতে নেই। ঋক আবার বলল মনে মনে। লণ্ঠনের আলোতে যেমন সব দেখা যায় না মুখের কিছুটা অন্ধকার থাকে, আমাদের চোখের আলোও তেমন-ই। আসলে প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই আলোকিত দিকটুকুই বেশি অন্ধকার দিকের চেয়ে। জীবনকে দেখতে, অন্যকে দেখতে আজকের সকালবেলার আলোর মতো আলো চাই।
কী করছে এখন তৃষা কে জানে? হয়তো প্রণতদাকে জড়িয়ে ধরে আশ্লেষে ঘুমোচ্ছ। আসলে কাল-ই ওদের ফুলশয্যার রাত গেছে। বিয়ের বহুদিন পরে এল।
কে জানে কী বলবে তৃষা আজ যখন দেখা হবে ওদের বাড়িতে রাতে? ওর প্রিয়কবি শঙ্খ ঘোষের কবিতা আবৃত্তি করেই বলবে কি?
নিচু হয়ে এসেছিল যে মানুষ অপমানে, ঘাতেঝরে গিয়েছিল যার দিনগুলি প্রহরে উজানেতারই কাছে এসে ওই পাঁজরে পালক রেখেছিলেতোমার আঙুলে আমি ঈশ্বর দেখেছি কাল রাতে।