Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » উল্কা-রহস্য || Sunil Gangopadhyay » Page 7

উল্কা-রহস্য || Sunil Gangopadhyay

সকালবেলা ব্রেকফাস্ট খেয়ে সন্তু আর কাকাবাবু গেলেন সমুদ্রের ধারে বেড়াতে।

আকাশ খানিকটা মেঘলা। বেলাভূমিতে খুব বেশি লোক নেই। কিছু ছেলেমেয়ে স্নান করতে নেমেছে। দূরে-দূরে দেখা যাচ্ছে খেলনা নৌকোর মতন ভাসছে জেলে ডিঙি।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, তোর পায়ের ব্যথাটা কেমন রে, সন্তু? স্নান। করতে নামবি নাকি?

সন্তু বলল, বাঃ, সমুদ্রের ধারে এসে চান করব না? পায়ের ব্যথাটা একদম সেরে গেছে। হাঁটুর ফোলাটাও নেই।

কাকাবাবু বললেন, ইউসুফ-ডাক্তার সত্যিই মিরাক্ল করেছেন দেখছি। আমিও স্নান করব। তবে এখন নয়, দুপুরবেলা। এখন কিছুক্ষণ সমুদ্রের টাটকা হাওয়া খাওয়া যাক। এর মতন ভাল জিনিস আর হয় না। পৃথিবীতে টাটকা বাতাস খুব কমে যাচ্ছে দিন দিন।

জলের খুব কাছাকাছি গিয়ে দুজনে বসল বালির ওপর। কাকাবাবু ক্রাচ দুটো পাশে রেখে বাবু হয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন সমুদ্রের দিকে।

সন্তু বালি দিয়ে একটা দুর্গ বানাতে লাগল, বাচ্চা বয়েসে সে বাবার সঙ্গে পুরী বেড়াতে এসেছিল। তখন সে প্রায় সারাদিন সমুদ্রের ধারে বসে বালি দিয়ে কতরকম ঘর-বাড়ি, পাহাড়, দুর্গ বানাত। মনে পড়ছে সেই কথা।

দুজনেই খানিকক্ষণ চুপচাপ।

হঠাৎ এক সময় সন্তু জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা কাকাবাবু, উল্কা পাথরটার মধ্যে সত্যি-সত্যি নতুন কোনও ধাতু আছে কি না, সেটা ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা না করে কি বোঝা যাবে? পদ্মনাভন বাংলোর ঘরে বসে খালি চোখে দেখে বুঝতে পারতেন? ওঁর ঘরে তো কোনও যন্ত্রপাতি নেই।

কাকাবাবু মুখ ফিরিয়ে সন্তুর দিকে ভুরু কুঁচকে তাকালেন।

তারপর ধমকের সুরে বললেন, দিলি তো আমার ধ্যান ভাঙিয়ে? তোর মাথায় বুঝি শুধু ওইসব ঘুরছে? বলেছি না, এসব নিয়ে আমাদের মাথা ঘামাবার দরকার নেই!

সন্তু হাসল।

কাকাবাবু আবার বললেন, সমুদ্রের ধারে বসে তোর কোনও কবিতা মনে পড়ছে না? সমুদ্র সম্পর্কে একটা কবিতা শোনা তো!

সন্তু একটুক্ষণ ভেবে বলল, ঠিক মনে পড়ছে না।

কাকাবাবু বললেন, তা হলে আয়, দুজনে মিলে একটা বানানো যাক। আমি একটা লাইন বলছি, তুই পরের লাইনটা বসিয়ে দিবি।

একটুখানি চুপ করে থেকে কাকাবাবু বললেন :

আকাশের নীল রং মিশে গেছে সাগরে

সন্তু প্রায় কিছু চিন্তা না করেই বলল :

ঝিনুক কুড়োতে যাব জাগো সব জাগো রে!

কাকাবাবু বললেন, বাঃ, বেশ মিলিয়েছিস তো। আচ্ছা, এর পর কী হতে পারে? ঢেউগুলো, ঢেউগুলো নিয়ে কিছু একটা…

বড় বড় ঢেউগুলি পাহাড়ের মতো প্রায়

সন্তু সঙ্গে-সঙ্গে বলল :

তিমিমাছ লাফ দিয়ে যেন পিলে চমকায়!

কাকাবাবু হেসে বললেন, খুব সোজা মিল পেয়ে যাচ্ছিস, তাই না? দাঁড়া, এবার একটা শক্ত দিচ্ছি।

ভুরু কুঁচকে মিনিটখানেক চিন্তা করার পর কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, এটার সঙ্গে মিলিয়ে দে তো দেখি।

মেঘ ডাকে গুরু-গুরু কাঁপে সারা অম্বর

সন্তু এবার কিছু উত্তর দেওয়ার আগেই পেছন থেকে কে যেন বলল, এই তো স্বয়ং অম্বর এখানে হাজির।

কাকাবাবু ও সন্তু একসঙ্গে পেছনদিকে মুখ ফেরাল। পাঞ্জাবি ও পাজামা পরা, কাঁধে একটা ঝোলা ব্যাগ নিয়ে, একগাল হেসে দাঁড়িয়ে আছে পীতাম্বর পাহাড়ী!

দু হাত তুলে সে বলল, নমস্কার, কাকাবাবু, দেখুন, আমি এখানেও এসে গেছি! বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতন, তাই না? নিশ্চয়ই আমাকে দেখে খুব : অবাক হয়েছেন!

কাকাবাবু যে আগেই জানতেন ওর আসবার কথা, তা প্রকাশ করলেন না। হেসে বললেন, আরে, পীতাম্বর, কী খবর? হঠাৎ তুমি এখানে?

সে বলল, পীতাম্বর না সার, শুধু অম্বর বলুন। আপনারা চলে আসার পর আমার মন কেমন করতে লাগল। ভাবলুম, কোনও জায়গা থেকে ঘুরে আসি। কথায় আছে না, উঠল বাই তো কটক যাই! তাই দেখুন কটক না হোক গোপালপুর এসে গেছি!

বালির ওপর ধপাস করে বসে পড়ে সন্তুর কাঁধে চাপড় মেরে সে আবার বলল, কী খবর, সন্তুবাবু? পা একেবারে ফিট হয়ে গেছে?

প্রথম দিন জঙ্গলের মধ্যে সাপ-ধরা পীতাম্বর পাহাড়ীকে দেখে সন্তুর বেশ ভাল লেগেছিল। কিন্তু সেই লোকটির হঠাৎ গোপালপুর চলে আসা সত্যি বেশ সন্দেহজনক।

সন্তু খানিকটা আড়ষ্টভাবে বলল, হ্যাঁ, ভাল হয়ে গেছে। আপনি ভাল আছেন?

অম্বর বলল, আমি ফার্স্ট ক্লাস আছি। আমি কক্ষনো খারাপ থাকি না।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, এখানেও সাপ ধরতে এলে নাকি? সমুদ্রের ধারে বিষাক্ত সাপ পাওয়া যায় বলে তো শুনিনি!

অম্বর বলল, না, না, এখানে সাপ ধরতে আসিনি। এসেছি বেড়াতে। টাকা রোজগারের জন্য বনে-জঙ্গলে সাপ ধরে বেড়াই, তা বলে কি আমাদেরও মাঝে-মাঝে ছুটি নিতে ইচ্ছে হয় না? কুঁজোরও তো চিৎ হয়ে শুতে সাধ জাগে মাঝে-মাঝে!

শেষের কথাটা সন্তু ঠিক বুঝতে পারেনি, তার মুখ দেখেই সেটা ধরা যায়। তার দিকে চেয়ে অম্বর বলল, কুঁজো মানে বুঝলে? জলের কুঁজো নয়, যে-লোকের পিঠে কুঁজ আছে, ইংরেজিতে যাকে বলে হাঞ্চ ব্যাক।

সন্তু বলল, আসামের জঙ্গলটাই তো একটা বেড়াবার জায়গা। সেখান থেকেও লোকে অন্য জায়গায় বেড়াতে যায়।

অম্বর বলল, পাহাড় আর জঙ্গল দেখতে-দেখতে একঘেয়ে হয়ে গেলে, তখন সমুদ্র দেখতে ইচ্ছে করে। তা ছাড়া আমার কেন যেন ধারণা হয়েছিল, এখানে এলে আপনাদের দেখতে পাব। দেখুন, কেমন মিলে গেল!

সন্তু বলল, এ জায়গাটা খুব ভাল।

অম্বর বলল, কাল রাত্তিরে হোটেলে এসেই শুনলাম, এখানে একজন বৈজ্ঞানিক রহস্যময়ভাবে উধাও হয়েছে। তোমরা সেই গেস্ট হাউসেই আছ। কাকাবাবু যখন এসে পড়েছেন, তখন নিশ্চয়ই রহস্যের সমাধান হবে। আমি তোমাদের কোনও কাজে লাগতে পারি? কাকাবাবু, আপনার একটা অ্যাডভেঞ্চারে আমি সঙ্গে থাকতে চাই। আমি কিছুদিন বক্সিং শিখেছিলাম।

কাকাবাবু তাড়াতাড়ি বললেন, আমরা এখানে ওসব কোনও ব্যাপারে মাথা ঘামাতে চাই না। দুজনেরই শরীর ভাল না, এখানে বিশ্রাম নেব শুধু।

একটা মোটরবোট গোঁ-গোঁ শব্দ করতে করতে ছুটে গেল সামনে দিয়ে। জেলে নৌকোগুলোর পাশ দিয়ে সেটা বেশ সুন্দরভাবে এঁকেবেঁকে চলে যাচ্ছে। জলে যারা সাঁতার কাটতে নেমেছে, তাদের মধ্যে দুজন চলে গেছে অনেকটা দূরে। আগে মনে হচ্ছিল সেখানে খুব গভীর জল, কিন্তু লোক দুটি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ল। সেখানে তাদের মোটে বুক-জল। আবার বড় ঢেউ উঠতেই তারা সামনে ঝাঁপ দিয়ে এগিয়ে গেল।

কাকাবাবু মুখ ফিরিয়ে হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, অম্বর, সেদিন ভোরবেলা গাছের নীচে তুমি যখন আমায় দেখতে পেলে, তখন আমার হাত বাঁধা ছিল। মুখটাও কি বাঁধা ছিল?

অম্বর অবাক হয়ে বলল, না তো!

কাকাবাবু বললেন, আমার মুখের বাঁধনটা নিজে নিজেই খুলে গিয়েছিল। তুমি আসবার আগেই। তোমাকে কি আমি বলেছিলাম যে, আমার মুখটাও বাঁধা ছিল আগে?

অম্বর বলল, না, তাও বলেননি। এই প্রথম শুনলাম। ফেলে দেওয়ার সময় আপনার মুখটাও ওরা বেঁধে দিয়েছিল বুঝি? সন্তুর বাঁধেনি?

কাকাবাবু বললেন, সন্তুকে তো ওরা ধরবার আগে নিজেই লাফ দিয়েছে! যাকগে, থাক ওসব কথা।

অম্বর বলল, হঠাৎ এ-কথাটা জিজ্ঞেস করলেন কেন?

কাকাবাবু বললেন, এমনিই মনে পড়ল।

অম্বর জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, আপনাদের কলকাতার বাড়ির ঠিকানাটা বলবেন? কলকাতায় গেলে দেখা করব। দাঁড়ান, লিখে নিচ্ছি।

নিজের পকেট ও কাঁধের ঝোলাটা হাতড়েও সে কলম খুঁজে পেল না। কাকাবাবু নিজের বুকপকেট থেকে কলমটা দিয়ে বললেন, এটাতে লিখে নাও!

ঠিকানা লেখার পর ফেরত দেওয়ার জন্য সে বাড়িয়ে দিতেই কাকাবাবু বললেন, ওটা তোমার কাছেই থাক। তোমার কলম নেই।

অম্বর বলল, না, না, আমার আছে। হোটেলে ফেলে এসেছি। আপনার কলম নেব কেন? এত দামি কলম।

কাকাবাবু বললেন, এমন কিছু দামি নয়। তুমি আমাদের জন্য অনেক কিছু করেছ। তোমাকে এই সামান্য একটা জিনিস আমি দিতে চাই।

অম্বর বলল, আমি এমন কিছুই করিনি। হঠাৎ সেখানে গিয়ে পড়েছিলাম। এ তো সবাই করে।

কাকাবাবু বললেন, তুমি এই কলমটা নিলে আমি খুশি হব।

অম্বর বলল, তা হলে ঠিক আছে, নিচ্ছি। আপনার ব্যবহার করা কলম। এটার দাম আমার কাছে অনেক?

কাকাবাবু আবার সমুদ্রের দিকে মুখ ফেরালেন।

অম্বর সন্তুকে রলল, তোমরা ছড়া মেলাবার খেলা খেলছিলে। আমার সঙ্গে খেলবে? আমিও খেলতে পারি। অম্বরের সঙ্গে কী মিলবে জানো? শম্বর!

সন্তু জিজ্ঞেস করল, তার মানে কী?

অম্বর বলল, একরকমের বড় হরিণ, দ্যাখোনি কখনও? মাথায় ডালপালার মতন শিং। মেঘে কালো অম্বর, ভয়ে কাঁপে শম্বর! ঠিক হল না? তোমার নাম

তো সন্তু। তার সঙ্গে মিল দিতে পারো অধিকন্তু!

কাকাবাবু উঠে পড়ে বললেন, দশটার সময় আমার কাছে একজন দেখা করতে আসবে। বাংলোয় ফিরবি নাকি রে, সন্তু?

কাকাবাবুর গলার আওয়াজ শুনেই সন্তু বুঝতে পারল, তিনি সন্তুকে সঙ্গে নিয়েই ফিরতে চান। সন্তু বলল, হ্যাঁ, আমারও একটা কাজ আছে।

কাকাবাবু বললেন, চলি, অম্বর। তুমি বোসো তা হলে।

অম্বর যেন এখানে বেশ অনেকক্ষণ ধরে জমিয়ে গল্প করার মেজাজ নিয়ে এসেছিল, কাকাবাবুরা হঠাৎ বিদায় নিতে চাইছেন দেখে সে বেশ ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেল।

বাংলোর দিকে ফিরতে-ফিরতে কাকাবাবু নিচু গলায় বললেন, অম্বর ছেলেটা হয়তো খারাপ নয়। কিন্তু ওকে দেখলেই আমার আসামের সেই ঘটনা মনে পড়ে যাচ্ছে আর রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে। কথা নেই বার্তা নেই, আমাদের খাদের মধ্যে ফেলে দিল?

সন্তু বলল, এরকম আগে কখনও হয়নি। কিন্তু ওই অম্বর পাহাড়ী বাইচান্স সেই সময় খাদের নীচে হাজির হয়েছিল বলেই তো মনে হচ্ছে।

কাকাবাবু বললেন, তোর তাই মনে হচ্ছে? এই ছেলেটা ওই বদমাশের দলের কেউ নয়।

সন্তু বলল, ওদের দলের হলে আর আমাদের বাঁচাবে কেন?

কাকাবাবু বললেন, এমনও হতে পারে যে, দেখতে এসেছিল আমরা সত্যি মরে গেছি কি না। যখন দেখল মরিনি, আমার সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল, তখন ও আমাদের সাহায্য করে নিজে ভাল সাজবার চেষ্টা করল।

সন্তু বলল, ইচ্ছে করলে তখনও অম্বর আমাদের মারতে পারত। আমি অজ্ঞান আর তোমার হাত বাঁধা ছিল।

কাকাবাবু বললেন, খুব সাঙ্ঘাতিক ক্রিমিনাল না হলে দিনের আলোয় মারতে পারে না। ও বোধ হয় তেমন পাকা নয়। আর-একটা জিনিস লক্ষ কর, যারা আমাদের ফেলে দিয়েছিল, তাদের সম্পর্কে ও এখন আর কোনও কথাই বলছে না। আমরা চলে আসার পর তাদের আর কোনও খোঁজখবর পাওয়া গেল কি না, সে-বিষয়েও উচ্চবাচ্য করল না একবারও।

ডাকবাংলোর পেছনদিকেও একটা গেট আছে। সেখান দিয়ে ঢুকে এসে কাকাবাবু আবার বললেন, আমি এখানেও বিপদের গন্ধ পাচ্ছি। পদ্মনাভনকে যারা ধরে নিয়ে গেছে, তারাই কি সত্যি আমাদের আসামে পাঠিয়েছিল? তা হলে তারা এখানেও তো আমাদের আর-একবার মারবার চেষ্টা করতে পারে। সাবধানে থাকতে হবে কিন্তু।

সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠার পর দেখা গেল দুজন মিস্ত্রি পদ্মনাভনের ঘরের ভাঙা জানলাটা সারাচ্ছে। কাকাবাবু ঘরটায় একবার উঁকি দিলেন।

বেরিয়ে এসে কাকাবাবু বললেন, তখন তুই একটা ভাল প্রশ্ন করেছিস, সন্তু। পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে পাথরটা কেনার পরেও পদ্মনাভন গোপালপুরের এই বাংলোয় এতদিন থেকে গেল কেন? তার মতন বৈজ্ঞানিকের তো উচিত ছিল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কোনও ল্যাবরেটরিতে নিয়ে গিয়ে পাথরটা পরীক্ষা করে দেখা। অবশ্য পদ্মনাভন খামখেয়ালি, পাগলাটে ধরনের লোক।

সন্তুর কাছে চাবি, সে নিজেদের ঘরের দরজা খুলল। কাকাবাবু একজন বেয়ারাকে দেখতে পেয়ে বললেন কফি দিতে।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, দশটার সময় কে আসবে?

কাকাবাবু বললেন, কেউ আসবে না। কফিটা খেয়ে আমি একবার বেরুব। একবার থানায় যেতে হবে। আমার কয়েকটা ফোন করার দরকার। থানা থেকেই সুবিধে। তুই ঘরে থাক, আমি ঘুরে আসছি।

সন্তু বলল, আমি শুধু-শুধু এখানে বসে থেকে কী করব? আমিও তোমার সঙ্গে যাই থানায়!

কাকাবাবু বললেন, তোর যাওয়ার দরকার নেই তো কিছু। তুই এখানে বিশ্রাম নে। বাইরে বেরোস না।

সন্তু এবার অধৈর্য হয়ে বলল, আমার যথেষ্ট বিশ্রাম হয়ে গেছে। সমুদ্রের ধারে বেড়াতে এসেও আমি ঘরের মধ্যে বসে থাকব নাকি?

কাকাবাবু কয়েক মুহূর্ত অপলকভাবে চেয়ে রইলেন সন্তুর দিকে। তারপর নরমভাবে বললেন, আমি এবার ভয় পেয়ে গেছি রে, সন্তু। হ্যাঁ, আমি রাজা রায়চৌধুরী, আমিও ভয় পাচ্ছি। তোকে একা-একা সমুদ্রের ধারে যেতে দিতে আমার সাহস হচ্ছে না। যারা আমাদের পাহাড় থেকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল, তারা এখানেও আমাদের মারবার চেষ্টা করতে পারে। আমাকে একবার থানায় যেতে হচ্ছে। সেখানে ডি. আই. জি. ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিষ্ট্রেট আর কয়েকজন সরকারি অফিসার আসবেন। সেখানে তোকে নিয়ে যাওয়াটা ভাল দেখায় না। তুই এখন ঘরের মধ্যেই থাক। আমি যতক্ষণ না ফিরে আসি ততক্ষণ বাইরে যাবি না। তবে, তোকে একটা কাজ দিয়ে যাচ্ছি। তুই পদ্মনাভনের ঘরটার দিকে নজর রাখবি। আমার ধারণা, চোরেরা ওখানে আবার ফিরে আসবে। দিনের বেলাতেও আসতে পারে।

কফি খেয়ে নিয়ে কাকাবাবু বেরিয়ে পড়লেন।

সন্তু শুয়ে পড়ল বিছানায়। তার মনটা খারাপ হয়ে গেছে।

সে একটা বই পড়বার চেষ্টা করল। ভাল লাগল না। একটু পরে সে বাইরের বারান্দায় চেয়ার টেনে বসল। আকাশ কালো হয়ে ফোঁটা-ফোঁটা বৃষ্টি নামল। একটু পরেই বেশ জোর বৃষ্টি শুরু হল। সব লোকও হুড়োহুড়ি করে পালিয়ে গেল, বেলাভূমি একেবারে ফাঁকা।

যাক, এই সময় সমুদ্রের ধারে বেড়ানো যেত না। বাংলোতে ফিরে আসতেই হত। বারান্দায় বসেই সমুদ্র দেখা যেতে পারে।

বৃষ্টির মধ্যেই একটা জিপগাড়ি চলে গেল বালির ওপর দিয়ে। ড্রাইভারের পাশে বসে আছেন দাড়িওয়ালা জজসাহেব। ওঁর সঙ্গে চোখাচোখি হলে সন্তু হাত তুলবে ভাবল। কিন্তু জজসাহেব এদিকে তাকালেনই না। জজসাহেব কোন হোটেলে উঠেছেন তা জিজ্ঞেস করা হয়নি।

বৃষ্টি চলতে লাগল অনেকক্ষণ।

সময় কাটাবার জন্য ডাকবাংলোর একজন বেয়ারাকে ডেকে খানিকক্ষণ গল্প করল সন্তু। উল্কাপাত আর পদ্মনাভনের উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনা আবার শুনল, কিন্তু নতুন কিছু জানা গেল না।

দুপুরবেলা একজন তোক একটা চিঠি নিয়ে এল কাকাবাবুর কাছ থেকে। কাকাবাবু লিখেছেন :

সন্তু, আমার ফিরতে খানিকটা দেরি হবে। তুই আমার জন্য অপেক্ষা করিস না। খেয়ে নে। সরকারি অফিসাররা ওঁদের সঙ্গে আমাকে লাঞ্চ খাওয়ার নেমন্তন্ন করেছেন। তা ছাড়াও কলকাতা থেকে একটা টেলিফোন আসার জন্য আমাকে বসে থাকতে হবে। দুই বাংলোতেই থাকিস, কেউ ডাকলে তার সঙ্গে বাইরে যাবি না।

চিঠিটা পেয়ে সন্তু ভাবল, তা হলে কি সমুদ্রে স্নান করতেও যাওয়া হবে না? গোপালপুরে এসে বাথরুমে স্নান?

বৃষ্টি অবশ্য এখনও থামেনি। এখানে বোধ হয় বৃষ্টির মধ্যে কেউ স্নান করতে যায় না। সন্তু ঠিক করল, যাই-ই হোক না কেন, কাল সকালেই সে দৌড়ে গিয়ে সমুদ্রে নামবে।

দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে সন্তু একটা বই নিয়ে বসে রইল ইজি চেয়ারে। মাঝখানের দরজাটা খোলা। একটা সরু বারান্দার ওপাশেই পদ্মনাভনের ঘর। মিস্তিরিরা চলে গেছে, সেই ঘর এখন তালাবন্ধ। সন্তু মাঝে-মাঝে সেই ঘরটার দিকে তাকাচ্ছে। কাকাবাবু নজর রাখতে বলেছেন।

ওই ঘরে এখনও চোরেরা আসতে পারে। তার মানে, পদ্মনাভনের পাথরটা এখনও পাওয়া যায়নি। সেইজন্যই কাকাবাবু ধরে নিয়েছেন যে, পদ্মনাভন বেঁচে আছেন। যারা তাঁকে ধরে নিয়ে গেছে, তারা পদ্মনাভনকে খুন করবে না। তা হলে তো পাথরটা পাওয়াই যাবে না।

এক সময় খানিকটা ঝিমুনি এসে গিয়েছিল সন্তুর। দরজায় খটখট শব্দ হতে আবার জেগে উঠল। বেয়ারা আর-একখানা চিঠি নিয়ে এসেছে। এটা কাকাবাবুর চিঠি নয়। এটা লিখেছে অম্বর।

সন্তু, তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম। ইচ্ছে ছিল খানিকক্ষণ গল্প করার। কিন্তু বাংলোর সামনে একজন পুলিশ আমাকে ভেতরে যেতে দিল। তোমার সঙ্গেও দেখা করতে দেবে না। কী ব্যাপার বুঝতে পারলাম। আমি রিপোজ হোটেলে আছি, রুম নং ১০। যদি ইচ্ছে হয়, চলে আসতে পারো। এই হোটেলে খুব ভাল পাঁপড় ভাজা ও ফিশ ফ্রাই পাওয়া যায়।

ইতি—অম্বর

চিঠিটা পড়ে সন্তুর বেশ রাগ হল। কী ব্যাপার, সে কি এই বাংলোতে বন্দী নাকি? অম্বরকে ভেতরে আসতে দিলে কী ক্ষতি ছিল। সে যদি অন্য দলের লোকও হয় তা হলে সে কি দিনের বেলা সন্তুকে জোর করে ধরে নিয়ে যাবে? অত সোজা নাকি?

তার একবার ইচ্ছে হল, এক্ষুনি রিপোজ হোটেলে চলে যেতে। ঘরের মধ্যে বসে থাকতে আর একটুও ভাল লাগছে না। বৃষ্টিও থেমে গেছে।

জুতো পরতে গিয়েও সন্তু পা সরিয়ে নিল। কাকাবাবু বারণ করেছেন, আজকের দিনটা সে মেনে চলবে। এরকম ভাবে ঘরের মধ্যে বন্দী হয়ে থাকার চেয়ে কলকাতায় ফিরে যাওয়াও ভাল।

কাকাবাবু ফিরলেন বিকেল পাঁচটার সময়।

জামা খুলতে-খুলতে বললেন, দু-একটা খবর শুনে সব কিছু যেন গুলিয়ে গেল রে, সন্তু! বছর তিনেক আগে পদ্মনাভনকে আর-একবার কারা যেন জোর করে ধরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। উটকামণ্ডের কাছে। সন্ধেবেলা মাঝরাস্তায় জোর করে গাড়ি থামিয়ে কারা যেন টেনে-হিচড়ে তাকে অন্য গাড়িতে তুলতে যাচ্ছিল। এই সময় একটা মিলিটারি কনভয় এসে পড়ে। তখন আততায়ীরা পদ্মনাভনের মাথায় একটা আঘাত করে তাকে ফেলে দিয়ে পালিয়ে যায়। আঘাতটা খুব গুরুতর হয়নি, পদ্মনাভন বেঁচে গেছে সে যাত্রায়। আরও একবার বোম্বে এয়ারপোর্টের বাইরে, বেশ গভীর রাত্তিরে কেউ ছুরি মেরেছিল তাকে। সেবারেও ছুরিটা লেগেছিল তার বুকের ডান দিকে, সেই অবস্থাতেও পদ্মনাভন লোকটাকে জাপটে ধরার চেষ্টা করেও পারেনি। তার মানে বুঝতে পারছিস, পদ্মনাভনের অনেক শত্রু আছে।

সন্তু বলল, অর্থাৎ এবারে যারা তাকে ধরে নিয়ে গেছে, তারা যে উল্কা পাথরটার জন্যই পদ্মনাভনকে চুরি করেছে, তার কোনও মানে নেই।

কাকাবাবু বললেন, ঠিক তাই। সন্তু বলল, আগে দুবার ওঁকে মারবার চেষ্টা হয়েছে, তবু উনি একা-একা ঘুরে বেড়ান?

কাকাবাবু বললেন, বৈজ্ঞানিকরা সাধারণত নিরীহ আর ঠাণ্ডা ধরনের মানুষ হয়। কিন্তু পদ্মনাভন যেমন দুঃসাহসী, তেমনই বেপরোয়া। সঙ্গে কোনও পাহারাদার নিয়ে ঘোরার মানুষই তো নয়। পুলিশের কাছেও সাহায্য চায় না। লোকটা খুব দুর্মুখও বটে, ছোটখাটো দোষের জন্য তার সহকারীদের এমন খারাপভাবে বকুনি দেয় যে, অনেকে তার অধীনে কাজ করতেই চায় না। এত দোষ থাকলেও পদ্মনাভন খুবই প্রতিভাবান, কোনও একদিন বিজ্ঞানে সে নোবেল প্রাইজ পেলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।

সন্তু বলল, যদি উল্কা-পাথরটাই আসল ব্যাপার না হয়, তা হলে যারা ওঁকে ধরে নিয়ে গেছে, তারা আর গোপালপুরে থাকবে কেন? অন্য জায়গায় চলে যাবে।

কাকাবাবু হেসে বললেন, তুই তো ঠিক লাইনেই ভাবতে পারিস দেখছি। তা হলে তো আমি এবার পুরোপুরি রিটায়ার করলেই পারি। পাথরটা হাতাবার মতলব না থাকলে, অন্য কোনও কারণে যদি পদ্মনাভনকে গুম করে থাকে কেউ, তা হলে সে আর এখানে বসে থাকবে কেন? পদ্মনাভনের হাত-মুখ বেঁধে একটা গাড়িতে চাপিয়ে নিয়ে যাওয়া শক্ত কিছু নয়। তা হলে আর তাকে এখানে খোঁজাখুঁজি করার কোনও মানে হয় না। তবে, আর-একটা প্রশ্ন আসে। পদ্মনাভনকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর তার ঘরে দুবার হামলা হয়েছে। জানলা ভেঙে লোক ঢুকে সারা ঘর তছনছ করছে। কী খুঁজছে তারা? পাথরটা নিশ্চয়ই? আর তো কোনও মূল্যবান জিনিস এখানে থাকার কথা নয়।

সন্তু বলল, দুপুরবেলা শুয়ে-শুয়ে আমি আর-একটা কথা ভেবেছি। এই যে চোরেরা পদ্মনাভনের ঘরে আসছে, এটা পুলিশের চোখে ধূলো দেওয়ার জন্যও তো হতে পারে? মনে করো, যারা পদ্মনাভনকে চুরি করেছে, তারা উল্কা-পাথটাও পেয়েছে। তারপর সেই জিনিসটা আর পদ্মনাভনকে নিয়ে তারা চলে গেল অনেকদূরে। এখানে দুটো লোককে ঠিক করে গেছে, যারা মাঝে-মাঝে এই ঘরের মধ্যে এসে হামলা করে যাবে। তাতে সবাই ভাববে, ওরা জিনিসটা খুঁজে পায়নি। এই সুযোগে ওরা অনেকদূরে চলে যাবে।

কাকাবাবু বললেন, তোর মতন এতটা বুদ্ধি কি ওদের আছে? যদি সেরকমই হয়, তা হলে ওদের বেশিদূর যেতেও হবে না। পাশের রাজ্য হচ্ছে অন্ধ্র। সেখানে পালিয়ে গেলে এ রাজ্যের পুলিশ আর খোঁজখবর করবে না।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, তুমি কাকে ফোন করতে গিয়েছিলে?

কাকাবাবু মুচকি হেসে বললেন, পাঞ্জাবে!

তারপর কিছু না বলে চলে গেলেন বাথরুমে। সন্তু ভেবেই পেলেন না, কাকাবাবু হঠাৎ কেন পাঞ্জাবে ফোন করতে গেলেন। এখান থেকে কতদূর পাঞ্জাব!

একজন বেয়ারা এসে বিকেলের চা-বিস্কুট দিয়ে গেল। বাইরে আবার বৃষ্টি নেমেছে ঝমঝম করে। আজ আর সমুদ্রের ধারে কেউ বেড়াতে পারবে না।

কাকাবাবু বেরিয়ে আসার পর সন্তু জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা কাকাবাবু, আমাকে কি এখানে পুলিশের পাহারায় থাকতে হবে? অম্বরবাবু আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন, পুলিশ তাঁকে ফিরিয়ে দিয়েছে। এটা কী ব্যাপার।

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, বাইরের পুলিশটি আমাকে সে-কথা বলল বটে। আসলে কী হয়েছিল জানিস, ওই অম্বর বাইরের গেট দিয়ে সোজা ভেতরে আসতে চাইলে বোধ হয় বাধা দিত না। কিন্তু অম্বর বাড়ির পাশ দিয়ে পেছনদিকে আসছিল, পদ্মনাভনের ঘরের জানলার পাশে দাঁড়িয়ে উঁকিঝুঁকি মারছিল। তাইতেই পুলিশের সন্দেহ হয়। তখন পুলিশটি গিয়ে তাকে চ্যালেঞ্জ করে। তারপর পুলিশের সঙ্গে তার কথা কাটাকাটি হয়। অম্বর নিজেই তখন চিঠি লিখে চলে গেছে।

সন্তু অবাক হয়ে বলল, জানলার কাছে উঁকি মারছিল?

কাকাবাবু বললেন, আরও ব্যাপার আছে। আমি যখন এখান থেকে বেরুই, তখন অম্বর একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। আমি থানার জানলা থেকেও অম্বরকে দেখেছি। ডি. আই. জি. সাহেবের বাড়ি গেলাম, সেখান থেকে বেরোবার পর দেখি অম্বর রাস্তার মোড়ে মিলিয়ে গেল। অম্বর আমাকে ফলো করছে নাকি? এ তো মজার ব্যাপার।

চা শেষ করে কাকাবাবু বাইরের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেন। আপনমনে বললেন, বিচটা একেবারে ফাঁকা। বৃষ্টিতে আর কেউ বেড়াতে বেরোতে পারছে না। আমরাই বা এখন কোথায় যাব। সন্তু, তুই বরং বাড়িতে চিঠি। লেখ। কিংবা বই পড়।

তারপর ভেতরে এসে বললেন, আমার শরীরটা ভাল লাগছে না রে! জ্বরটা ছেড়ে গেলেও মাথায় খুব ব্যথা। ভেতরে-ভেতরে ঠাণ্ডা লেগে আছে।

সন্তু বলল, তা হলে তো কলকাতায় ফিরে গেলেই হয়। তুমি কোনও ওষুধ খাচ্ছ না। পদ্মনাভনের ব্যাপারটা নিয়ে আমাদের যদি মাথা ঘামাবার দরকার না থাকে, তা হলে আমাদের কলকাতায় ফিরে যাওয়াই তো ভাল।

কাকাবাবু বললেন, কালকের দিনটা দেখা যাক। তার মধ্যেও শরীরটা ভাল না হলে কলকাতায় চলে যাব।

এর পর দুজনেই দুখানা বই নিয়ে বসল।

এক ঘন্টা পরে একজন পুলিশ এসে কাকাবাবুকে একটা চিঠি দিল। চিঠি পড়ে কাকাবাবু বললেন, ঠিক আছে।

তারপর সন্তুকে বললেন, আজও আমি তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়ব। মনে হচ্ছে যেন আবার জ্বর আসছে।

কাকাবাবু আটটার মধ্যে খাবার দিয়ে দিতে বললেন। সন্তুকেও খেয়ে নিতে হল। তারপর কাকাবাবু পোশাক বদলে শুয়ে পড়লেন বিছানায়। বুকের ওপর একটা বই।

এক সময় তাঁর হাত থেকে খসে পড়ে গেল বইখানা। একটু-একটু নাক ডাকতে লাগল।

শিলিং-এর মাঝখানে একটা মোটে জোরালো আলো। ঘরে একটা টেবিল ল্যাম্প আছে বটে কিন্তু সেটা খারাপ। সন্তু মুশকিলে পড়ে গেল। আলো জ্বেলে রাখলে কাকাবাবুর ঘুমের অসুবিধে হবে। কিন্তু সন্তু এত তাড়াতাড়ি ঘুমোবে কী করে?

কাকাবাবু ঘুমের মধ্যে দু-একবার ছটফট করতেই সন্তু নিভিয়ে দিল আলো। অন্ধকার হয়ে গেলেই যেন বাইরের শব্দ বেড়ে যায়। বিছানায় শুয়ে-শুয়ে সে শুনতে লাগল বাইরের বৃষ্টির শব্দ, বাতাসের শব্দ আর সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দ।

সেই শব্দ শুনতে-শুনতে, আর অন্ধকারের মধ্যে আকাশ-পাতাল চিন্তা করতে-করতে এক সময় সন্তুরও চোখ জড়িয়ে এল।

আজও সন্তুর ঘুম ভেঙে গেল মাঝ রাত্তিরে। আজ কোনও হইচই কিংবা গুলির শব্দ হয়নি। কোনও শব্দই নেই। তবু ঘুম ভাঙল কেন সন্তু প্রথমে বুঝতে পারল না।

তারপর তার মনে হল, মাথার কাছে একটা জানলা খোলা, সেখান দিয়ে ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে। সন্তু গায়ে কোনও চাদর-টাদর দেয়নি, তাই শীত করছে। তার। জানলাটা খুলে গেল কী করে? কিংবা জানলাটা কি শোবার আগে সে বন্ধ করেছিল? ঠিক মনে পড়ছে না। হঠাৎ জেগে উঠলে আগের কথা মনে আসতে অনেকটা সময় লাগে।

বেশ ঠাণ্ডা হাওয়া, জানলা বন্ধ করতেই হবে।

সন্তু উঠে গিয়ে জানলার কাছে দাঁড়াল। বৃষ্টি থেমে গেছে, মেঘও কেটে গিয়ে জ্যোৎস্না ফুটেছে এর মধ্যে। সমুদ্র যেন এগিয়ে এসেছে খানিকটা

কাছে।

হঠাৎ সন্তু পেছন ফিরে তাকাল। বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল সঙ্গে-সঙ্গে। কাকাবাবুর বিছানাটা ফাঁকা। কাকাবাবু নেই।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress