Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » উল্কা-রহস্য || Sunil Gangopadhyay » Page 5

উল্কা-রহস্য || Sunil Gangopadhyay

পরদিনই কাকাবাবু কলকাতার প্লেনের টিকিট কাটলেন। সন্তু একবার জিজ্ঞেস করল, আমরা হাফলঙ ফিরে যাব না?

কাকাবাবু গম্ভীর মুখে বললেন, না। কলকাতায় গিয়ে কয়েকদিন বিশ্রাম নিতে হবে। তারপর কী করব ভেবে দেখা যাবে।

শিলচর বিমানবন্দরটি শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরে। সুন্দর পাহাড়ি রাস্তা। ডাক্তার বড়ঠাকুর আর প্রবীর গাড়ি করে পৌঁছে দিতে এল। প্রবীর অনেকবার অনুরোধ করেছিল, তাদের চা-বাগানে কয়েকদিন থেকে যাওয়ার জন্য। কাকাবাবু রাজি হননি।

প্লেনটা ঠিক সময়েই এসেছে। দুই ডাক্তারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কাকাবাবু আর সন্তু এগিয়ে গেল সিকিউরিটির দিকে। সন্তু এখন মোটামুটি স্বাভাবিকভাবেই হাঁটছে, শুধু তার একটা কানে খুব ব্যথা। কানেও যে চোট লেগেছিল, সেটা পায়ের ব্যথার সময় তেমন টেরই পায়নি।

প্লেন ছাড়ার পর কাকাবাবু একটা খবরের কাগজ চেয়ে নিলেন। বেশ কয়েকদিন খবরের কাগজের সঙ্গে কোনও সম্পর্কই ছিল না।

সন্তু বসেছে জানলার ধারে। আজ আকাশ মেঘলা, কিছুই দেখার নেই, তবু সে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল।

খবরের কাগজ পড়তে-পড়তে কাকাবাবুর ভুরু কুঁচকে গেল। বাংলা কাগজ শেষ করে তিনি একটা ইংরেজি কাগজ চাইলেন। তাড়াতাড়ি পাতা উলটে-উলটে কোনও একটা খবর খুঁজতে লাগলেন, সেই খবরটা পড়ে তিনিই সামনের সিটের ভদ্রলোকের কাছ থেকে আর-একটা ইংরেজি কাগজ চেয়ে নিয়ে প্রথম পাতায় চোখ রেখে চুপ করে বসে রইলেন খানিকক্ষণ।

সন্তু একবার একটা কাগজ নিয়ে খেলার খবরগুলো দেখে নিল ভাল করে। অন্য কোনও খবর পড়তে তার ইচ্ছে হল না।

এক ঘন্টার মধ্যে প্লেন পৌঁছে গেল দমদম।

বাইরে বেরিয়ে এসে কাকাবাবু বললেন, একটা ট্যাক্সি ধরে দিলে তুই বাড়ি চলে যেতে পারবি তো?

সন্তু চমকে গিয়ে বলল, আমি একা যাব! তুমি যাবে না?

কাকাবাবু বললেন, না। আমার একটা কাজ আছে।

সন্তু আবার জিজ্ঞেস করল, এয়ারপোর্টে কাজ আছে?

কাকাবাবু একটু আমতা-আমতা করে বললেন, না, ঠিক এয়ারপোর্টে কাজ নেই। আমাকে আজই ভুবনেশ্বর যেতে হবে।

সন্তু আরও অবাক হয়ে বলল, ভুবনেশ্বর? কেন?

কাকাবাবু এবার খানিকটা রেগে গিয়ে বললেন, তোকে সব কথা বলতে হবে নাকি? ভুবনেশ্বরে যাব, আমার ইচ্ছে হয়েছে।

সন্তু বলল, তা হলে আমি যাব না কেন? আমরা তো হাফলঙে আট-দশদিন থাকব, বলে এসেছিলাম বাড়িতে। মোটে তিন-চারদিন পরেই ফিরে এলাম। এখনও অন্য জায়গায় ঘুরে আসতে পারি।

কাক বাবু বললেন, তোর শরীর ভাল নয়। তোকে এখন কয়েকদিন শুয়ে থাকতে হবে।

সন্তু বলল, তোমারও তো শরীর খারাপ। আমি বেশ ভাল আছি। তুমি ভুবনেশ্বর গেলে আমি যাবই!

কাকাবাবু চোখ গরম করে বললেন, দ্যাখ সন্তু, তোকে একটা স্পষ্ট কথা বলি। এবার থেকে আমার সঙ্গে তোকে আর কোথাও নিয়ে যাব না ঠিক। করেছি।

সন্তু কাঁচুমাচু করে জিজ্ঞেস করল, কেন? আমি কিছু দোষ করেছি?

কাকাবাবু বললেন, নিশ্চয়ই দোষ করেছিস। তোকে আর কোনওদিন আমার সঙ্গে নেব না!

কাকাবাবুর রাগ থেকেও সন্তু ঠিক ভয় পেল না। হাতের ব্যাগটা মাটিতে নামিয়ে রেখে সে বলল, আমি একা কিছুতেই বাড়ি যাব না। আমি এখানেই থাকব।

কাকাবাবু সন্তুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত।

এয়ারপোর্ট থেকে অনবরত লোকজন বেরোচ্ছে আর ঢুকছে। বাইরে বেশ রোদ। গরম। এখানে আকাশে মেঘ নেই, অথচ শিলচরের আকাশে ছিল জমাট মেঘ। বাতাসও বেশ ঠাণ্ডা ছিল।

কাকাবাবু একটা ফাঁকা জায়গার দিকে সরে গেলেন। সন্তুও কাছে এসে দাঁড়াল।

কাকাবাবু বললেন, সন্তু, তোকে আমি সঙ্গে নিতে পারি। কিন্তু তার আগে তোকে একটা প্রতিজ্ঞা করতে হবে। তুই ইচ্ছে করে খাদে লাফ দিয়েছিলি কেন? পাগল ছাড়া এরকম কেউ করে?

সন্তু কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কাকাবাবু তাকে বাধা দিয়ে আবার বললেন, ওরকম আর কখনও করবি না। এবারে আমরা দুজনেই অদ্ভুতভাবে বেঁচে গেছি। আমাকে আচমকা ঠেলে দিয়েছিল। তোকে তো না ফেলে দিতেও পারত। হয়তো দু-একদিন ধরে রেখে দিয়ে পরে ছেড়ে দিত। সব সময় বেঁচে থাকার চেষ্টা করতে হয়। আমাকে যদি মেরেও ফেলে, তবু তুই পালিয়ে গিয়ে কিংবা যে-কোনও উপায়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করবি। না বাঁচলে তো কিছুই করা যায় না। বেঁচে থাকলে তবু আমার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে পারবি। বদমাশ লোকগুলোকে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে পারবি! আমার বয়েস হয়েছে, আমি এখন মরলেও ক্ষতি নেই। কিন্তু তোকে বেঁচে থাকতেই হবে।

সন্তু চুপ করে আছে দেখে কাকাবাবু বললেন, কী, মনে থাকবে তো? আর কোনওদিন ইচ্ছে করে ঝাঁপ দিবি না!

সন্তু দু দিকে মাথা নাড়ল।

কাকাবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, নাছছাড়বান্দা ছেলে, চল তা হলে। কিন্তু কেন এখন ভুবনেশ্বর যাচ্ছি তা জিজ্ঞেস করা চলবে না।

এয়ারপোর্ট ম্যানেজারকে চেনেন কাকাবাবু। তাঁর সঙ্গে কথা বলতেই দুটো টিকিটের ব্যবস্থা হয়ে গেল। দু ঘন্টা বাদেই ভুবনেশ্বরের প্লেন।

ভুবনেশ্বর বিমানবন্দরে নেমে একটা গাড়ি ভাড়া করলেন কাকাবাবু। শহরের দিকে গেলেন না। গাড়ি ছুটল বেরহামপুরের দিকে।

অনেকক্ষণ চুপ করে ছিল সন্তু। এবার সে আপন মনে বলল, বুঝেছি!

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কী বুঝেছিস।

সন্তু বলল, ভূবনেশ্বরে তোমার কোনও কাজ নেই। আমাদের গোপালপুর-অন-সি যাওয়ার কথা ছিল, তুমি সেখানেই যাচ্ছ।

কাকাবাবু বললেন, ঠিক ধরেছিস তো! আসলে এবারে সমুদ্রের ধারে গিয়ে কটা দিন কাটাব ঠিক করেছিলাম, হঠাৎ চলে যেতে হল পাহাড়ে। সমুদ্র মনটাকে টানছে। তাই ভাবলাম, যাই একবার, সমুদ্র-দর্শন করে আসি।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, ভুবনেশ্বর থেকে পুরী অনেক কাছে। সেখানে গেলে না কেন?

কাকাবাবু বললেন, পুরীতে বড় ভিড় হয়। গোপালপুরে আমরা একটা বাংলো বুক করেছিলাম মনে আছে? তাড়াহুড়োতে সেটা ক্যানসেল করানো হয়নি। সেখানে গেলে বোধ হয় জায়গা পাওয়া যাবে। শোন, সেখানে গিয়ে শুধু খাবি আর শুয়ে থাকবি। সম্পূর্ণ বিশ্রাম।

সন্তু মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করল, আর তুমি?

কাকাবাবু বললেন, আমিও বিশ্রাম নিতেই যাচ্ছি। কেউ তো আমাদের ওখানে যেতে বলেনি, কেউ কোনও কাজের ভারও দেয়নি। শুধু সমুদ্র দেখব আর শুয়ে-শুয়ে বই পড়ব!

ওরা গোপালপুরে পৌঁছে গেল সন্ধের ঠিক একটু আগে।

এখানে কয়েকটা হোটেল আছে। কিছু-কিছু ফাঁকা বাড়িও রয়েছে, লোকেরা সেই বাড়ি ভাড়া করে নিয়ে কয়েকদিনের জন্য থেকে যায়।

কাকাবাবু গাড়িটা থামালেন একটা বাংলোর সামনে। এটা সরকারি বাংলো, কাকাবাবুর নামে এখনও রিজার্ভেশান রয়েছে, জায়গা পেতে কোনও অসুবিধে হবে না।

জিনিসপত্র নামাবার পর পেছনদিকের বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই সন্তুর বুকটা ধক করে উঠল। সকালবেলায় ছিল পাহাড় অঞ্চলে। এখন সামনে বিশাল সমুদ্র। লাল রঙের সূর্য আধখানা ড়ুবেছে জলে, সামনে লাল রঙের ঢেউ, আকাশে কতরকম ছবি।

অনেকদিন সমুদ্র দ্যাখেনি সন্তু। তার এত ভাল লাগছে যে, সে যেন চোখ ফেরাতে পারছে না।

সন্তু সেইভাবে দাঁড়িয়ে রইল কয়েক মিনিট। একটু বাদে কাকাবাবু এসে তার কাঁধে হাত রাখলেন।

দুজনেই একটুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর কাকাবাবু বললেন, সমুদ্রের দিগন্তে সূর্যাস্ত, দেখলেই মনটা ভাল হয়ে যায়, তাই না রে? কোনও পাহাড়ের ওপরে উঠে দাঁড়ালেও দেখা যায় কতখানি নীল আকাশ, আর চোখ যতদূর যায় শুধু সবুজ। কী চমৎকার আমাদের এই পৃথিবী। তবু মানুষ এখানে মিলেমিশে শান্তিতে থাকতে পারে না। লোভ করে, হিংসে করে, খুনোখুনি করে!

সন্তু চুপ করে রইল। কাকাবাবু আপনমনে আবৃত্তি করলেন :

কী সুন্দর মালা আজি পরিয়াছ গলে
প্রচেতঃ! হা ধিক্ ওহে জলদলপতি!
এই কি সাজে তোমারে, অলঙ্ঘ্য, অজেয়
তুমি? হায়, এই কি হে তোমার ভূষণ
রত্নাকর?

হঠাৎ থেমে গিয়ে কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, এটা কার লেখা বল তো?

সন্তু টপ করে বলে দিল, মাইকেল মধুসূদন। মেঘনাদবধ কাব্য!

কাকাবাবু হেসে বললেন, আজকালকার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আর পরবার উপায় নেই। তারা এত কিছু জানে! আমাদের সময়কার ছাত্রছাত্রীরা এত সহজে বলতে পারত না। তোদর বুঝি মেঘনাদবধ পাঠ্য ছিল?

সন্তু বলল, না। আমি এমনিই পড়েছি। অনেক শক্ত-শক্ত কথা আছে, তবু পড়তে বেশ ভাল লাগে। রত্নাকর মানে যে সমুদ্র, সেটা বোঝা যায়। কিন্তু প্রচেতঃ মানেও যে সমুদ্র, সেটা আমাকে ডিকশনারি দেখে জানতে হয়েছে।

কাকাবাবু বললেন, সমুদ্র নয়, বরুণ দেবতা। কথাটা আসলে প্রচেতস কিংবা প্রচেতা, তাই না?

সন্তু বলল, অত আমি জানি না।

কাকাবাবু বললেন, যাঃ, সূর্য ড়ুবে গেল। শোন, আমরা এখন বেরুব। এখানকার ম্যানেজার বলল, বাংলোতে আর কোনও লোক নেই। আজ রাত্তিরে ওরা খাবার দিতে পারবে না। বাইরে থেকে খেয়ে আসতে হবে। কাল থেকে এখানেই সব পাওয়া যাবে।

সন্তু বলল, এক্ষুনি খেতে যাব?

কাকাবাবু বললেন, সারাদিনে দুবার প্লেন পালটাতে হয়েছে। তারপর গাড়িতে এতখানি রাস্তা। অনেক ধকল গেছে। আজ বিশ্রাম নেওয়া দরকার। তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়ব। দুপুরে তো ভাল করে খাওয়া হয়নি।

জামা-প্যান্ট না বদলেই বেরিয়ে পড়ল সন্তু।

রাস্তা দিয়ে না গিয়ে ওরা দুজনে হাঁটতে লাগল জলের ধার দিয়ে। সন্তু জুতো খুলে ফেলে প্যান্ট গুটিয়ে পা ভেজাতে লাগল। নরম বালিতে ক্রাচ দিয়ে হাঁটতে কাকাবাবুর একটু অসুবিধে হয়, কাকাবাবু তাই একটু দূরে রয়েছেন। সূর্য ড়ুবে গেলেও বিশেষ অন্ধকার হয়নি। এরই মধ্যে জ্যোৎস্না হয়েছে খানিকটা। ঢেউগুলো অবিরাম এসে ভেঙে পড়ছে তীরে।

মাঝে-মাঝে দু-একটা জেলে-নৌকো টেনে তোলা আছে পারের ওপর। ভোরবেলা জেলেরা এইসব নৌকো ভাসিয়ে মাছ ধরতে যায়। সন্তু একটা নৌকোয় লাফিয়ে ওঠার চেষ্টা করতে গিয়ে টের পেল, তার সেই হাঁটুতে এখনও খানিকটা ব্যথা আছে।

একটা ভোঁ-ভোঁ শব্দ শুনে সন্তু জলের দিকে তাকাল। বড় বড় ঢেউগুলো যেখানে ভাঙছে, তার থেকেও খানিকটা দূরে একটা স্পিড বোট যাচ্ছে মনে হল। সন্তু থমকে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল সেটাকে।

ঢেউয়ের ওপর লাফাতেলাফাতে স্পিড বোটটা যেন এদিকেই আসছে।

একটুক্ষণ অপেক্ষা করার পর স্পিড বোটটা তীরের কাছে এসে থামল। সেখানে প্রায় একহাঁটু জল। বোট থেকে একজন লোক নেমে জল ঠেলে এগোতে লাগল, বোটটা আবার মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল সমুদ্রে।

প্যান্ট-কোট পরা লোকটির মুখভর্তি দাড়ি। এক হাতে টর্চ। সেই টর্চের আলো ফেলে তিনি চারপাশটা দেখলেন। সন্তু দাঁড়িয়ে আছে একটা নৌকোয় হেলান দিয়ে, তার মুখে আলো পড়ল।

তার আগেই সন্তু সেই লোকটাকে চিনতে পেরেছে। হাফলঙের ডাকবাংলোর সেই জজসাহেব!

দুজনেই দুজনকে দেখে খুব অবাক হয়েছে।

বিচারকই প্রথম বললেন, আরে, তুমি এখানে? কী আশ্চর্য? কী আশ্চর্য!

দূর থেকে গলার আওয়াজ শুনে কাকাবাবু ডাকলেন, সন্তু? সন্তু?

এবার বিচারক আর সন্তু দুজনেই এগিয়ে গেল কাকাবাবুর দিকে। কাকাবাবু কিছু বলার আগেই বিচারক উচ্ছ্বসিতভাবে বললেন, এ তো দারুণ আনন্দের ব্যাপার। আপনার ভাইপোর পা ঠিক হয়ে গেছে? আপনাদের এখানে দেখতে পাব, ভাবতেই পারিনি! হোয়াট আ প্লেজান্ট সারপ্রাইজ!

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আপনি হঠাৎ এখানে?

বিচারক বললেন, আমার তো কিছুই করার নেই। ঘুরে-ঘুরে বেড়াই। আপনার মুখে সেদিন গোপালপুর-অন-সির নাম শুনলাম। তাই ভাবলাম, সে-জায়গাটা কখনও দেখিনি, যাই ঘুরে আসি। আপনারাও যে এখানে আসবেন, তা কল্পনাও করিনি। আগে জানলে একসঙ্গে আসা যেত!

কাকাবাবু বললেন, সন্তুর পা সেরে গেল। তাই আমরা এখানে এসেছি বিশ্রাম নিতে।

বিচারক বললেন, ভাল, ভাল, খুব ভাল! আছেন তো কয়েকদিন। দেখা হবে। এখন যাই হোটেলে। একটা স্পিড বোটে বেড়াতে গিয়েছিলাম। জলের ছিটে লেগে জামা-টামা সব ভিজে গেছে। এক্ষুনি পালটাতে হবে। বুড়ো হয়েছি তো। ঠাণ্ডা লেগে গেলেই মুশকিল।

বিচারক কাকাবাবুর সঙ্গে করমর্দন করলেন। সন্তুর পিঠ একবার চাপড়ে দিয়ে বললেন, ব্রেভ ইয়াংম্যান! পরে দেখা হবে, চলি!

টর্চের আলো ফেলতে-ফেলতে তিনি চলে গেলেন রাস্তার দিকে।

কাকাবাবু বললেন, রিটায়ার্ড জজ। সময় কাটে না। তাই নানান জায়গায় ঘুরে বেড়ান। ভদ্রলোকের বউ, ছেলেমেয়ে কেউ নেই!

সন্তু বলল, হাফলঙে উনি বাংলো ছেড়ে একটুও বেরুতেন না। সবসময় বারান্দায় বসে থাকতেন। আর এখানে এসেই স্পিড বোটে চেপে বেড়াতে গিয়েছিলেন। বেশ সাহস আছে!

কাকাবাবু বললেন, কেউ-কেউ পাহাড়ে ভয় পায়, কিন্তু জল ভালবাসে। আবার এর উলটোটাও আছে। পাহাড় আর সমুদ্রের মধ্যে তোর কোনটা বেশি ভাল লাগে রে সন্তু?

সন্তু বলল, দুটোই!

কাছাকাছি একটা হোটেলে খাওয়ার জন্য ঢুকে পড়ল দুজনে। বর্ষাকাল বলেই বোধ হয় টুরিস্ট বেশি নেই। সমুদ্রের ধারও ফাঁকা। হোটেলেও ভিড় দেখা গেল না।

মাংস নেই, শুধু দু-তিন রকমের মাছ। এখানে মাছ শস্তা। বেশ ভাল চিংড়িমাছ ভাজা, ডাল আর অন্য একটা মাছের ঝোল দিয়ে খাওয়া হয়ে গেল।

মাত্র সাড়ে সাতটা বাজে। হোটেল থেকে বেরিয়ে কাকাবাবু বললেন, আমার কিন্তু এর মধ্যেই খুব ঘুম পেয়ে যাচ্ছে। চল, আজ রাতটা ভাল করে ঘুমোব।

সন্তু বলল, আমার এত তাড়াতাড়ি ঘুম পাবে না। আমি বেশি রাত্তিরে আর-একবার সমুদ্রের ধারে যাব। ঢেউয়ের আওয়াজ শুনতে আমার খুব ভাল লাগে।

কাকাবাবু বললেন, থাকব তো কয়েকদিন। কাল রাত্তিরে যাস!

এবার আর হেঁটে ফেরা নয়। একটা সাইকেল রিকশা নেওয়া হল। বাতাসে মাছ-মাছ গন্ধ। হাফলঙের হাওয়া আর এখানকার হাওয়ায় কত তফাত। জাটিংগাতে ঠিক এই সময় ফাঁকা জায়গাটায় মশালের সামনে আকাশ থেকে ধুপ-ধুপ করে কয়েকটা পাখি পড়েছিল।

উলটো দিক থেকে আর একটি সাইকেল রিকশা আসছে। তাতে বসে আছেন একজন লোক। মাথায় বড় বড় চুল, কাঁধে একটা ঝোলা। পায়ের কাছে একটা সুটকেস।

রিকশাটা পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সন্তু একঝলক রিকশার যাত্রীটির মুখ দেখতে পেল। দারুণ চমকে সে কাকাবাবুর দিকে তাকাল। সেই সাপুড়ে যুবক, পীতাম্বর পাহাড়ী!

সে সন্তুদের দেখতে পায়নি, রিকশাটা পেরিয়ে চলে গেল। কাকাবাবু ঠিক লক্ষ করেছেন। তিনি খানিকটা মজার ভঙ্গিতে বললেন, কী ব্যাপার, পাহাড় থেকে লোকেরা সমুদ্রের ধারে চলে আসছে? হাফলঙের দুজনকে দেখা গেল এরই মধ্যে!

বিচারককে দেখার চেয়েও পীতাম্বর পাহাড়ীকে দেখে সন্তু খুব বেশি অবাক হয়ে গেছে। রিটায়ার্ড জজের হাতে কোনও কাজ নেই, অনেক পয়সা-কড়ি আছে, তিনি যেখানে খুশি বেড়াতে যেতে পারেন। কিন্তু যে-লোকটা জীবিকার জন্য বনে-জঙ্গলে সাপ ধরে বেড়ায়, সে কেন হঠাৎ এই সমুদ্রের ধারে আসবে?

কাকাবাবু বললেন, এই পীতাম্বর, মানে অম্বর, খাদের তলা থেকে তোকে আর আমাকে উদ্ধার করেছে। অনেক সাহায্য করেছে। ওর কাছে আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। কিন্তু এখন আমার মনে হচ্ছে, ও সেই সাতসকালে খাদের অত নীচে গেল কেন? শুধু সাপ ধরার জন্য? নাকি ও জানত যে, আমাদের ওখানে পাওয়া যাবে?

সন্তু চমকে বলল, অ্যাঁ?

কাকাবাবু বললেন, সাপটাপ খুব একটা খুঁজছিল বলে তো মনে হয় না। বন-জঙ্গল ভেদ করে সোজা যেন আমাদের সামনে এসে উপস্থিত হল।

সন্তু বলল, ও জানত যে, আমাদের কোথায় ফেলে দেওয়া হবে? কী করে জানবে? কুমার সিং-দের সঙ্গে তো ওর ভাব ছিল না। কুমার সিং প্রথম থেকেই ওকে পছন্দ করেনি।

কাকাবাবু বললেন, সেটা অভিনয় হতে পারে। আমাদের সামনে বোঝাবার চেষ্টা করেছে যে, ওরা দুজনে দুজনকে সহ্য করতে পারছে না।

সন্তু বলল, ও যদি কুমার সিং-দের দলেরই লোক হবে, তা হলে আবার আমাদের উদ্ধার করতে গেল কেন?

কাকাবাবু বললেন, সেটা একটা শক্ত প্রশ্ন বটে। এর উত্তরটা খুঁজে বের করতে হবে। ওর সাপ ধরার কথাটা সত্যি কি না, সেটাও জানা দরকার। খুব ভাল ট্রেইনিং না থাকলে এমনি-এমনি জঙ্গলে গিয়ে বিষাক্ত সাপ ধরা চাট্টিখানি কথা নাকি?

সন্তু বলল, ও জোঁকের ভয়ে জঙ্গলে ঘোরার সময় পকেটে নুন রাখে। কিন্তু কুমার সিং আর ভুবন দাসরা তো সেরকম কিছু বলল না। ওরা জোঁকের কথা জানেই না মনে হল। কিংবা যারা জঙ্গলে রোজ ঘোরে, তারা বোধ হয় জোঁকের ভয় পায় না।

কাকাবাবু বললেন, ওই জঙ্গলে জোঁক আছে এটা ঠিক। নুন দিয়ে খুব সহজে জোঁক মারা যায় এটাও ঠিক। অম্বর বলেছিল, ওখানকার জঙ্গলে বড়বড় বাঘ নেই, লেপার্ড আছে আর ভাল্লুক আছে। কুমার সিংরা বলল, ওখানে লেপার্ড নেই, ভাল্লুক একেবারেই নেই। বড় বড় বাঘ আর গতি আছে। তা বলে কারা ঠিক কথা বলছে?

সন্তু বলল, অম্বরের ভাল্লুকের গল্পটা বানানো মনে হয়েছিল?

কাকাবাবু বললেন, কুমার সিং-এর জঙ্গলের মধ্যে লরিতে শুয়ে থাকা আর বাঘ এসে পড়ার গল্পটা তোর বানানো মনে হয়নি? ওদের বিশেষ অভিজ্ঞতা

আছে বলে তো মনে হয় না!

সন্তু বলল, আমার মাথায় যে সব গুলিয়ে যাচ্ছে! তা হলে ওরা সবাই কি সত্যিই এক দলের?

কাকাবাবু জোরে হেসে উঠে বললেন, তোকে আর এখন এসব নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না। আজ রাত্তিরে টেনে এক ঘুম দে।

সাইকেল রিকশাটা থামল বাংলোর সামনে।

ভেতরে ঢুকতেই দেখা গেল পুরোদস্তুর পোশাক পরা দুজন পুলিশ বসে আছে সেখানে।

কাকাবাবুকে দেখেই একজন উঠে দাঁড়াল। হাতজোড় করে নমস্কার জানিয়ে বলল, আপনিই মিঃ রাজা রায়চৌধুরী?

কাকাবাবু মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ।

পুলিশ জিজ্ঞেস করল, আপনার নামে এই বাংলোর ঘর পাঁচদিন আগে বুক করা ছিল? আপনি তখন আসেননি কেন?

কাকাবাবু ভুরু কুঁচকে বললেন, কিছু একটা অসুবিধে ছিল। তাই আসিনি। কেন, না-আসাটা অপরাধ নাকি?

পুলিশটি সেকথার উত্তর না দিয়ে সন্তুর দিকে তাকিয়ে বলল, এই ছেলেটি কি আপনার ভাই?

সন্তুর চেহারা এখন বেশ বড়সড় হয়েছে। কাকাবাবুর শরীরে এখনও বয়েসের ছাপ পড়েনি। তাঁর চওড়া বুক ও হাতের মাল্ল দেখলেই বোঝা যায়। তিনি একজন বেশ শক্তিশালী পুরুষ। অনেকেই আজকাল সন্তুকে তাঁর ভাইপো ভাবে না, মনে করে ওরা দুই ভাই।

অন্য পুলিশটি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আপনাদের দুজনকে একবার থানায় যেতে হবে। এস. পি. সাহেব একবার আপনাদের সঙ্গে কথা বলবেন।

কাকাবাবু বললেন, থানায়? তা যেতে পারি। আমি যাব। এই ছেলেটি আমার ভাইপো। ওর শরীর ভাল নয়, ও যাবে না। সন্তু সঙ্গে-সঙ্গে বলে উঠল, হ্যাঁ, আমিও যাব। একজন পুলিশ বলল, আপনারা দুজনেই গেলে ভাল হয়।

কাকাবাবু জোর দিয়ে বললেন, না, ও যাবে না। আপনারা কি আমাদের অ্যারেস্ট করতে এসেছেন নাকি? ওয়ারেন্ট আছে?

অন্য পুলিশটি বলল, না, না, সেরকম কিছু নয়। ঠিক আছে, আপনি একলাই চলুন।

কাকাবাবু বললেন, আমি নিজেও যেতে রাজি হতে না পারতাম। আপনাদের বলতাম, আপনাদের এস. পি.-কে এখানে ডেকে আনতে। তিনি কী জানতে চান, এখানে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করুন। কিন্তু সেটা বলছি না, কারণ আমি নিজেই একবার থানায় যেতাম। কাল সকালে আমার কয়েকটা খবর নেওয়ার আছে।

তারপর তিনি সন্তুর দিকে তাকিয়ে বললেন, তুই ঘরে যা, সন্তু। আমি ঘন্টাখানেকের মধ্যে ফিরে আসছি।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress