রামায়ণ : উত্তরাকাণ্ড – শ্রীরাম সীতাকে দেশে আনিতে বাল্মীকিকে অনুরোধ এবং পুনরায় পরীক্ষা লইবার ইচ্ছা
একমাসে গীত যদি হইল বিরাম।
জিজ্ঞাসা করেন তবে দোঁহারে শ্রীরাম।।
আজি তোমা সবাকে জিজ্ঞাসি বিবরণ।
কোন্ বংশে জন্মিলে বা কাহার নন্দন।।
লব কুশ তখন শ্রীরামের সাক্ষাতে।
ছলে পরিচয় কহে দোঁহে হেঁটমাথে।।
না জানি পিতার নাম মাতৃ নাম সীতা।
বাল্মীকির শিষ্য মোরা নাহি চিনি পিতা।।
এই পরিচয় পেয়ে শ্রীরঘুনন্দন।
দুই পুত্রে কোলে করি করেন ক্রন্দন।।
আর পত্নী না করিনু নহিল সন্ততি।
কোন্ দোষে বর্জ্জিলাম সীতা গর্ভবতী।।
শ্রীরাম বলেন, হে বাল্মীকি জ্ঞানবান।
জান ভূত ভবিষ্যৎ আর বর্ত্তমান।।
এতেক জানিয়া তুমি না কহ আমারে।
পরীক্ষা লইব সীতা আন মম ঘরে।।
যত লোক আসিয়াছে যেবা না আইসে।
শুনিয়া সীতার কথা আইল হরিষে।।
স্ত্রী পুরুষ আইলেক সকল সংসার।
বৃদ্ধ শিশু কানা খোঁড়া কৈল আগুসার।।
কুলবধূ যত আছে রাজার কুমারী।
সীতার পরীক্ষা শুনি এল সারি সারি।।
আসিয়া সকল নারী কহে পরস্পর।
শ্রীরাম জানেন না কি সীতার অন্তর।।
তবে কেন সীতারে দিলেন বনবাস।
কেন বা পরীক্ষা লন একি সর্ব্বনাশ।।
এইরূপে রামাগণ করে কাণাকাণি।
হেনকালে আইলেন বৃদ্ধা তিন রাণী।।
কৌশল্যা কৈকেয়ী আর সুমিত্রা সতিনী।
রামেরে বুঝান তিন রাজার গৃহিণী।।
লইলে পরীক্ষা এক সাগরের পার।
কি হেতু পরীক্ষা নিতে চাহ আরবার।।
ধন্য জনকেরে মান্য জানকীর বাপ।
হেন জনকেরে আর নাহি দিও তাপ।।
সীতারে জানিহ তিনি কমলা আপনি।
নাহিক সীতার পাপ জানে সর্ব্ব প্রাণী।।
সীতারে লইয়া তুমি থাক গৃহবাসে।
জনক সন্তুষ্ট হয়ে যাক্ নিজ দেশে।।
শ্রীরাম বলেন মাতা না কর বিষাদ।
পরীক্ষা না নিলে দিবে লোকে অপবাদ।।
মহারাজ জনকের নাহি উপরোধ।
পরীক্ষা লইলে সবে পাইবে প্রবোধ।।
রাজা হয়ে স্ত্রীর যদি না করে বিচার।
স্ত্রীর অনাচারে নষ্ট হইবে সংসার।।
এত যদি রঘুনাথ বলেন নিষ্ঠুর।
কান্দিতে কান্দিতে রাণী গেলা অন্তঃপুর।।
শ্রীরাম বলেন হে বাল্মীকি তপোধন।
আপনি আপন দেশে করুন গমন।।
সঙ্গে রথ লয়ে যাক সমুন্ত্র সারথি।
রথে করি আনহ সীতারে শীঘ্রগতি।।
মহামুনি শ্রীরামের অনুজ্ঞা পাইয়া।
স্বদেশে গেলেন মুনি সুমন্ত্রে লইয়া।।
মুনির চরণে সীতা করি নমস্কার।
মুনিকে জিজ্ঞাসা করে কহ সারোদ্ধার।।
পিতা পুত্রে কেমনে হইল পরিচয়।
সে সব কহেন মুনি সীতার আলয়।।
শুনহ আমার বাক্য জনক-দুহিতে।
পূর্ব্বের নির্ব্বন্ধ যাহা কে পারে খণ্ডিতে।।
রামের আজ্ঞায় দেশে করহ গমন।
পরীক্ষা দেখিতে এল যত দেবগণ।।
প্রথমে পরীক্ষা দিলে সংসারে বিদিত।
এবার পরীক্ষা তব ললাটে লিখিত।।
এক ঠাঁই হইয়াছে সবর্ব দেবগণ।
কারো বাক্য না মানেন শ্রীরঘুনন্দন।।
জানকীরে কহিলেন এইমত মুনি।
সীতার নয়নে জল ঝরিল অমনি।।
মুনির তনয়া বধূ তাপেতে আকুলি।
সে সবার সঙ্গে সীতা করে কোলাকুলি।।
বিদায় চাহেন সীতা করি নমস্কার।
মেলানি দেহ মা, দেখা নাহি হবে আর।।
মুনিপত্নী বলে লক্ষ্মী ছাড়ি যাহ কোথা।
বুকে শেল রহিল থাকিল মর্ম্মব্যথা।।
জানকী বলিয়া মোরা না ডাকিব আর।
না শুনিব মধুর বচন যে তোমার।।