রামায়ণ : উত্তরাকাণ্ড – শ্রীরামের অশ্বমেধ যজ্ঞারম্ভ
রাম বলেন অশ্বমেধ করিলাম সার।
অশ্বমেধ-যজ্ঞ সম ফল নাহি আর।।
এত যদি কহিলেন কমল-লোচন।
শুনিয়া হর্ষিত হৈল ভরত লক্ষ্মণ।।
রাম যজ্ঞ করিবেন ব্রহ্মা হরষিত।
ডাক দিয়া বিশ্বকর্ম্মে আনিলা ত্বরিত।।
ব্রহ্মা বলে বিশ্বকর্ম্মা কর সম্বিধান।
শ্রীরামের যজ্ঞস্থান করহ নির্ম্মাণ।।
চলিলেন বিশ্বকর্ম্মা ব্রহ্মার বচনে।
ভরত লক্ষ্মণ দোঁহে আছেন যেখানে।।
সেইখানে বিশ্বকর্ম্মা করিলা গমন।
বিশ্বকর্ম্মে দেখি হরষিত দুই জন।।
নানা রত্ন আনি দিল বিশায়ের স্থান।
বিশ্বকর্ম্মা যজ্ঞশালা করেন নির্ম্মাণ।।
ভরত লক্ষ্মণ ঠাট দুই অক্ষৌহিণী।
ভাণ্ডার হইতে রত্ন বহিয়া যে আনি।।
ধাতু প্রবালাদি রত্ন শুনে যেই দেশে।
সর্ব্ব ধন বহি আনে চক্ষুর নিমিষে।।
দিল মণি মাণিক্যাদি প্রবাল বিস্তর।
বিশ্বকর্ম্মা যজ্ঞকুণ্ড নির্ম্মায় সত্বর।।
কুম্ভ চারি যোজন সে আড়ে পরিসর।
কুম্ভ চারি যোজন উভেতে দীর্ঘতর।।
করিল যে ছয় যোজন কুণ্ডের মেখলা।
দ্বাদশ যোজন ঘর বান্ধে যজ্ঞশালা।।
দধি দুগ্ধ ঘৃতের করিল সরোবর।
তিল যব ধান্য মুগের তিন কোটি ঘর।।
সোণার প্রাচীর ঘর স্বর্ণ-আওয়ারী।
স্বর্ণ-নাট্যশালা বান্ধে স্তম্ভ সারি সারি।।
ইন্দ্র আদি করিয়া যতেক দেবগণ।
যজ্ঞঘর দেখিতে করিল আগমন।।
দেখিতে আসিবে যজ্ঞ পৃথিবীর রাজা।
ব্রহ্মা আদি করিয়া যতেক আছে প্রজা।।
দেখিতে আসিবে যজ্ঞ জগতের মুনি।
তা সবার ঘর করে মুকুতা গাঁথনি।।
আশী যোজনের পথ করে আয়তন।
তাহাতে বিচিত্র কুণ্ড করিল গঠন।।
একমাসে পুরীখান করিল নির্ম্মাণ।
বিশ্বকর্ম্মা চলিয়া গেলেন নিজ স্থান।।
ইন্দ্র যম বরুণ যজ্ঞের হৈল হোতা।
হইল যজ্ঞের অগ্নি আপনি বিধাতা।।
বড় বড় যত মুনি আছেন ভুবনে।
একে একে সব মুনি আইল সেস্থানে।।
জমদগ্নি আইল ভার্গব পরাশর।
সাবর্ণ কশ্যপ আদি আইল মুনিবর।।
ভরদ্বাজ হস্তদীর্ঘ আইল শীঘ্রগতি।
আইল দুর্ব্বাসা মুনি বড় ক্রোধমতি।।
আইল আস্তিক মুনি গৌতম ব্রাহ্মণ।
মৎস্যকর্ণ আইলেন ঋষি সঙ্গোপন।।
পর্ব্বত হইতে এল দক্ষ-মহামুনি।
আইল ঐ ষিল কুশধ্বজ মহাজ্ঞানী।।
বিষ্ণুপদ-মুনি আইল ঔর্ব্ব্য ও চ্যবন।
সনাতন সনক আইল দুই জন।।
করিল শাণ্ডিল্য গর্গ মুনি আগুসার।
আইল কপিল মুনি বিষ্ণু-অবতার।।
জৈমিনী দধিচী মুনি আর শরভঙ্গ।
চৈত্রবিক কৌশিক আইল যে মাতঙ্গ।।
আইল দেবর্ষি যত পরম আনন্দ।
বিভাণ্ডক ঋষ্যশৃঙ্গ আর শতানন্দ।।
বিশ্বশ্রবা আইল আরো সেই জহুমুনি।
পৃথিবীর মুনি আইল অপূর্ব্ব কাহিনী।।
যত মুনি আইলেন নাম নাহি জানি।
আইলেন আদি কবি বাল্মীকি আপনি।।
মুনিগণ সকলে করিল বেদধ্বনি।
যজ্ঞ করিবারে রাম বৈসেন আপনি।।
সস্ত্রীক হইয়া ধর্ম্ম করে এই জ্ঞানে।
স্বর্ণসীতা আনিলা সে শাস্ত্রের বিধানে।।
সর্ব্বত্র হইল সে যজ্ঞের নিমন্ত্রণ।
পাত্রাপাত্র আইল সে যজ্ঞে সর্ব্বজন।।
সুগ্রীব অঙ্গদ আদি শাখামৃগগণ।
মহেন্দ্র দেবেন্দ্র আর সুষেণ-নন্দন।।
শরভ কুমুদ আর মন্ত্রী জাম্ববান।
নল নীল আইলেন বীর হনুমান।।
সাগরের পারে গেল এই নিমন্ত্রণ।
তিন কোটি জ্ঞাতি সহ এল বিভীষণ।।
দেশে দেশে চলিল যজ্ঞের নিমন্ত্রণ।
নিমন্ত্রণ পাইয়া আইল রাজাগণ।।
আইল মিথিলা হৈতে জনক রাজর্ষি।
মহারাজ শাল্ব আইল রাঢ়-দেশবাসী।।
নেপালের রাজা এল দুর্জ্জয় দুর্দ্ধর।
রাজা গিরিরাজ্যের আইল ধুরন্ধর।।
অঙ্গের অধিপ এল লোমপাদ নাম।
বেহারের রাজা এল গীতিগিরি ধাম।।
বিজয়-নগর কাঞ্চী কলিঙ্গ কর্ণাট।
চৌদিকের রাজা এল সঙ্গে কত ঠাট।।
সদা রাজগণ থাকে শ্রীরামের কাছে।
আরো কত নৃপগণ আইল যত আছে।।
হেলঙ্গ তৈলঙ্গ দেশ কলিঙ্গ গান্ধার।
আটাইস কোটি আসে পশ্চিমের সার।।
সিংহল সিন্ধান্ত দেশে মনু নামে পুরী।
আইল সাতাশ লক্ষ শ্রীরামের পাশে।।
যত যত রাজা আছে ভারত ভিতর।
রাজচক্রবর্ত্তী রাম সবার উপর।।
আইল অনেক রাজা রামের নিকটে।
রামের আজ্ঞায় তারা দিবারাত্র খাটে।।
পৃথিবীতে রাজা আছে অযুত অযুত।
শ্রীরামের দ্বারে আসি হইল মজুত।।
অবধূত সন্ন্যাসী আইল দেশান্তরী।
গন্ধর্ব্ব কিন্নর আইল স্বর্গ-বিদ্যাধরী।।
পৃথিবীতে যত ছিল দুঃখিত ব্রাহ্মণ।
যজ্ঞের দক্ষিণা নিতে করিল গমন।।
স্বর্গলোক মর্ত্ত্যলোক আইল পাতাল।
দেবলোক নরলোক হইল মিশাল।।
ত্রিভুবনে যত লোক আইল অপার।
শত্রুঘ্ন মথুরা হৈতে হৈল আগুসার।।
বশিষ্ঠ বিশিষ্ট আর সুমন্ত্র সারথি।
যজ্ঞের যতেক দ্রব্য করিল সঙ্গতি।।
ধান্য যব গোধূম যে আতপ-তণ্ডুল।
দধি দুগ্ধ ঘৃত মধু আনিল বহুল।।
সূর্য্য সম সভায় বসিল সব ঋষি।
পর্ব্বত প্রমাণ চাহে তিল রাশি রাশি।।
তিন কোটি বৃন্দ চাহে শ্রীফলের কাঠ।
আইল সকল দ্রব্য যথা যজ্ঞ-বাট।।
বংশের প্রধান পাত্র সুমন্ত্র-সারথি।
ইঙ্গিতে সকল দ্রব্য আনে শীঘ্রগতি।।
যখন ভরত ভাই যেই আজ্ঞা করে।
সেই দ্রব্য শত্রুঘন যোগায় সত্বরে।।
শত্রুঘ্নের কটক যে দুই অক্ষৌহিণী।
যজ্ঞের যতেক দ্রব্য বহিল আপনি।।
যে রাক্ষসে দেখিলে পলায় মুনিগণ।
সে রাক্ষস মুনির যে পাখালে চরণ।।
নৃত্য গীত মঙ্গল যে নানা বাদ্য শুনি।
অখিল ভুবনে হয় রাম-জয়-ধ্বনি।।
বহু যজ্ঞ করিল ভূপতি কোটি কোটি।
কাহারো না হইল এমত পরিপাটী।।