রামায়ণ : উত্তরাকাণ্ড – গৃধিনী ও পেচকের দ্বন্দ্ব বৃত্তান্ত
অযোধ্যাতে রঘুনাথ যান শীঘ্রগতি।
পাত্র মিত্র রাজ্যখণ্ড রামের সংহতি।।
মহামুনি অগস্ত্যের বাটী দক্ষিণেতে।
শ্রীরাম বলেন সবে চল সেই পথে।।
অগস্ত্যের বাটী রাম যান দিব্যরথে।
পক্ষীর কোন্দল রাম শুনিলেন পথে।।
গৃধিনী পেচকে দ্বন্দ্ব বাসার লাগিয়া।
আসিয়াছে বহু পক্ষী দুই পক্ষ হৈয়া।।
অনেক পক্ষীর ঘর বনের ভিতর।
নানা জাতি পক্ষী সব আছে একত্তর।।
সারস সারসী ডাক কাক কাদাখোঁচা।
গৃধিনী কোকিল চিল আর কালপেঁচা।।
শারী শুক কাকাতুয়া চড়া মৎস্যরঙ্ক।
খঞ্জন খঞ্জনী ফিঙ্গে ধকড়িয়া কঙ্ক।।
বাউই পাউই শিখী পক্ষী হরিতাল।
পায়রা প্রবাজ আর শিকরা সঞ্চাল।।
বক বকী বাদুড় বাদুড়ী নুরি টিয়া।
ঝাঁকে ঝাঁকে চামচিকে কাষ্ঠ-ঠোকরিয়া।।
জলে স্থলে আছিল যেখানে যত পক্ষ।
করিতেছে মহাদ্বন্দ্ব হয়ে দুই পক্ষ।।
গৃধিনী কহিছে পেঁচা ছাড় মোর বাসা।
পরঘরে রহিবে কেমনে কর আশা।।
পেঁচা বলে কোথা হৈতে আইলি গৃধিনী।
এতকাল বাসা মোর তোরে নাহি চিনি।।
কোন্দল উভয়ে মিলি করে মারামারি।
শ্রীরামে দেখিয়া সবে কহে ধীরি ধীরি।।
গৃধিনী বলিছে প্রভু কর অবধান।
বিচারে পণ্ডিত নাহি তোমার সমান।।
যুদ্ধেতে জিনিলে তুমি দেব সুরপতি।
শশধর জিনি তব শ্রীঅঙ্গের জ্যোতি।।
দিবাকর জিনি তেজ বিশাল তোমার।
সাগর জিনিয়া বুদ্ধি গভীর অপার।।
পবন জিনিয়া তব ত্বরিত গমন।
অমৃত জিনিয়া তব মধুর বচন।।
পৃথিবী পালিতে তুমি দয়াল শরীর।
গুণের সাগর তুমি রণে মহাবীর।।
স্বর্গ মর্ত্ত্য পাতালে তোমার করে পূজা।
ত্রিভুবন মধ্যে রাম তুমি মহারাজা।।
রজোগুণ ধর তুমি সৃষ্টির কারণ।
সত্ত্বগুণে সবাকারে করহ পালন।।
সংসার নাশিতে তুমি তমোগুণ ধর।
আত্ম-নিবেদন করি তোমার গোচর।।
অনেক শক্তিতে আমি সৃজিলাম বাসা।
বলেতে পেচক মোর কাড়ি লয় বাসা।।
পেঁচা বলে, প্রভু তুমি বিষ্ণু-অবতার।
রজোগুণে সৃষ্টি কৈলে সকল সংসার।।
তুমি চন্দ্র তুমি সূর্য্য তুমি দিবা রাতি।
অনাথের নাথ তুমি অগতির গতি।।
ধর্ম্মেতে ধার্ম্মিক তুমি পরম শীতল।
বিপক্ষ নাশিতে তুমি জ্বলন্ত অনল।।
আদি অন্ত মধ্য তুমি নির্দ্ধনের ধন।
সেবক বৎসল তুমি দেব নারায়ণ।।
অন্ধের নয়ন তুমি দুর্ব্বলের বল।
অপরাধী হই যদি দেহ প্রতিফল।।
সভা কৈলা রঘুনাথ বসি বৃক্ষতলে।
পাত্র মিত্র সভাসদ বসিল সকলে।।
বশিষ্ঠ নারদ আদি আইল মুনিগণ।
সুমন্ত্র কশ্যপ মুনি আইল দুজন।।
শ্রীরাম কহেন কথা সভাসদ শুনে।
হেনকালে দেবগণ এল সেইখানে।।
গৃধিনীরে কন রাম সভার ভিতর।
কতকাল হৈতে তোর এই বাসাঘর।।
গৃধিনী কহিছে শুন বচন আমার।
মহাপ্রলয়েতে যবে হৈল নিরাকার।।
বিষ্ণুনাভি পদ্মমূলে ব্রহ্মার উৎপত্তি।
দেব দানব বিধাতা সৃজিল নানা জাতি।।
তখন অবধি বাসা এ ডালে আমার।
কোন লাজে পেঁচা বেটা করে অধিকার।।
ঈষৎ হাসেন রাম গৃধিনী-বচনে।
পেঁচারে জিজ্ঞাসে রাম বিচার-বিধানে।।
পেঁচা বলে নিবেদন শুন রঘুবর।
বৃক্ষের উৎপত্তি হৈল ধরণী উপর।।
তার পরে উৎপন্ন হইল যত ডাল।
এইরূপে বনমধ্যে যায় কতকাল।।
উড়িতে অশক্ত হইনু হৈল বৃদ্ধদশা।
তার পরে এই ডালে করিলাম বাসা।।
রাম বলেন সভাখণ্ড করহ বিচার।
মিথ্যা দ্বন্দ্ব করে কেন এই বাসা কার।।
সভাতে বসিয়া যেবা সত্য নাহি কয়।
কোটি কল্প বৎসর নরক মাঝে বয়।।
এক এক বৎসরে বন্ধন নাহি খসে।
তিন কুল নষ্ট হয় মিথ্যা সাক্ষ্য-দোষে।।
শ্রীরামের বচনেতে কহে রাজ্যখণ্ড।
গৃধিনীর উপরে উচিত রাজদণ্ড।।
চারিবেদ সর্ব্বশাস্ত্র তোমার গোচর।
সাক্ষাতে শুনিলে প্রভু গৃধিনী-উত্তর।।
প্রলয় হইল যবে সৃষ্টির সংহারে।
স্থাবর জঙ্গম কিছু না ছিল সংসারে।।
ত্রিভুবন শূন্য যবে এক নিরঞ্জন।
সেই নিরঞ্জন হৈল সৃষ্টির কারণ।।
জলেতে পৃথিবী ছিল করিয়া উদ্ধার।
পৃথিবী সৃজিয়া কৈল জীবের সঞ্চার।।
বিষ্ণুনাভিপদ্মে হৈল ব্রহ্মার উৎপত্তি।
দেবাদি নরাদি সৃষ্টি কৈল নানা জাতি।।
আগে জীব সৃজিলেন বৃক্ষ হৈল পিছে।
কিরূপে গৃধিনী আসি বাসা কৈল গাছে।।
গৃধিনী অন্যায় বলে সভার ভিতর।
রাজদণ্ড অর্শে প্রভু গৃধিনী-উপর।।
সভামধ্যে মিথ্যা কহে নাহি ধর্ম্ম-ভয়।
গৃধিনীর প্রাণদণ্ড উপযুক্ত হয়।।
দেবগণ কহে রাম করি নিবেদন।
স্বাভাবিক গৃধিনী যে নহে এই জন।।
রয়েছে গৃধিনী-পক্ষী হয়ে ব্রহ্মশাপে।
শাপমুক্ত কর পক্ষী না মারিহ কোপে।।
শ্রীরাম বলেন পক্ষী হয় কোন জন।
ব্রহ্মশাপ ভোগ করে কিসের কারণ।।
দেবগণ কহে এই ছিল যে রাজন।
প্রত্যহ করাত লক্ষ ব্রাহ্মণ ভোজন।।
দৈবে এক বিপ্র চুল পাইল অন্নেতে।
নৃপতির শাপ দ্বিজ দিলেক ক্রোধেতে।।
ব্রাহ্মণেরে মাংস দিয়া নষ্ট কৈলে ব্রত।
গৃধিনী হইয়া বঞ্চ, খাও মাংস রক্ত।।
শাপ শুনি ভূপতির বিরস বদন।
দ্বিজের চরণে ধরি করিলা ক্রন্দন।।
শাপ-বিমোচন প্রভু করহ এখন।
কত দিনে হবে মোর শাপ-বিমোচন।।
স্তবে তুষ্ট হয়ে বিপ্র কহিতে লাগিল।
শাপে মুক্ত হবে বলি আশ্বাস করিল।।
রঘুবংশে জন্মিবেন বিষ্ণু যেইকালে।
শাপে মুক্ত হবে তুমি তাঁকে পরশিলে।।
ব্রহ্মশাপে পক্ষিযোনি হইল ভূপতি।
গৃধিনীর বৃত্তান্ত শুনহ রঘুপতি।।
বহু দুঃখ পেয়ে রাজার এতেক দুর্গতি।
তুমি পরশিলে হয় পক্ষীর সদগতি।।
দেবতার বাক্য শুনি রাম রঘুমণি।
গৃধিনীরে স্পর্শ রাম করেন তখনি।।
পক্ষিদেহ পরিহরি নিজ দেহ ধরি।
বিমানেতে ভূপতি চলিল স্বর্গপুরী।।
দিব্যরথে চড়ি রাজা গেল স্বর্গবাস।
গাহিল উত্তরকাণ্ড কবি কৃত্তিবাস।।