উত্তরসাধক (Uttarsadhak) : 14
সেবার নতুন বছরের শুরুতেই ছাত্রসংঘের প্রেসিডেন্ট মৈথিলী ত্রিপাঠী সংঘের সাধারণ সভায় ঘোষণা করল তারা তাদের লক্ষ্যে পৌঁছতে পেরেছে। এই লক্ষ্য হচ্ছে সঙ্ঘবদ্ধ ছাত্রশক্তি দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের একটি ছোট্ট অবহেলিত, অনুন্নত, নিরন্ন গ্রামকে সব দিক থেকে স্বয়ম্ভর করে তোলা। সেক্রেটারি উজান আফতাব তার সুলিখিত প্রতিবেদন পড়ে শোনায় সঙ্গে সঙ্গে তার তাৎক্ষণিক টীকা ভাষ্য। সে জানায় দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ওই কেওড়া গ্রাম এখন জেলার সবচেয়ে উন্নত মানের গ্রামগুলির মধ্যে অন্যতম। এখানে প্রত্যেকটি গ্রামবাসী বাংলা ও ইংরেজিতে প্রাথমিক স্তরের পড়াশোনা করতে পারেন, দলিল-দস্তাবেজ ফর্ম ইত্যাদি পড়ে পূরণ করা এবং সই করবার বিদ্যা প্রত্যেকটি বয়স্ক মানুষের আয়ত্ত হয়েছে। অল্প বয়সীরা এখন নানারকম বৃত্তিমূলক শিক্ষায় উৎসাহী। যথাসম্ভব কাছাকাছি তাদের প্রশিক্ষণের কাজ ছাত্রসংঘ আরম্ভ করে দিয়েছে। একটি গ্রন্থাগার স্থাপিত হয়েছে। গ্রামের চাষীরা আপাতত বলদ এবং লাঙল নিয়ে পুরনো পদ্ধতিতেই চাষ করছেন। তা সত্ত্বেও তাঁদের জমি তেফসলি। ইঁদারা, পাতকুয়ো এবং নলকূপ যথেষ্ট পরিমাণে থাকায় এবং শস্যক্ষেত্রের মধ্যবর্তী অগভীর ডোবাগুলি ভালোভাবে খুঁড়ে বড় পুকুরে পরিণত হওয়ায় সেচের সমস্যা মিটেছে। তাঁদের প্রধান উৎপাদন নানারকম ফল ও সবজি তাঁরা নিজস্ব ভ্যান গাড়ি করে গঞ্জের বাজারে নিয়ে বিক্রি করে আসেন। প্রায় প্রতিদিন। পাইকারের হাত-ফেরতা হয়ে যায় না বলে লাভ অনেক বেশি থাকে। উদ্বৃত্ত ফল এবং কিছু কিছু আনাজ দিয়ে আচার-চাটনি তৈরি করার একটি মহিলাপ্রকল্প হয়েছে। এইসব বিশুদ্ধ ফলের আচার ছাত্রমেলায় বিক্রি হয়, ছাত্রসংঘের অফিসেও পাওয়া যায়, শহরের দোকানে সাপ্লাই দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। মহিলাদের দ্বিতীয় সমিতি সেলাইয়ের কাজ করে। জামা-কাপড় সেলাই ও বোনা, এর ফলে নিজেদের গ্রামে তো বটেই, আশপাশের গ্রামেও সস্তায় ভালো টিকসই জামা এবং গরম জামা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। গ্রামে রয়েছে একটি মাধ্যমিক স্কুল। বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্রে এখনও গ্রামের মানুষ আরও উচ্চস্তরের পড়াশোনার জন্য আসছেন। গ্রামের রাজ এরং ছুতোর মিস্ত্রিরা মিলে একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খুলেছেন, তাছাড়াও রয়েছে একটি ছোটখাটো আসবাব কারখানা। গ্রামান্তর থেকেও বহু ছাত্র এখানে শিক্ষা নিতে আসে। গ্রামগঞ্জে ব্যবহারের উপযোগী আসবাব তৈরি করে এবং মাদুর ও বেত বুনে এঁরা ভালোই উপার্জন করেন। সবচেয়ে মুশকিলে পড়া গিয়েছিল তেওড় পাড়া বা জেলে পাড়া নিয়ে। এঁদের অনেকটা পথ মাতলা বিদ্যাধরী দিয়ে গিয়ে হয় সুন্দরবনের বিপজ্জনক এলাকায় স্থানীয় মৎস্যজীবীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে মাছ ধরতে হত, নয়ত ক্যানিঙের আড়ৎ থেকে মাছ কিনে ফেরি করতে হত। মাতলা নদীও গ্রাম থেকে যথেষ্ট দূরে। হাঁটা পথ, জলপথ দুবার অতিক্রম করে সামান্য উপার্জন নিয়ে এঁরা ঘরে ফিরতেন। এখন গ্রামের মধ্যে একটি চমৎকার পুকুর বড় করে কাটিয়ে দিঘি করার এবং গ্রামের প্রান্তিক খাল ও জলাগুলির সংস্কার করে আল দেওয়ায় মৎস্যচাষের সুবিধে হয়েছে। ইতিমধ্যেই কিছু সুফল পওয়া গেছে। এ ছাড়াও তেওড় পাড়ার বেকার মানুষদের গ্রামের যৌথ ডেয়ারি ও পোলট্রির ভার দেওয়া হয়েছে। মৌমাছির চাষও শুরু হয়েছে। ডেয়ারির উদ্বৃত্ত দুধে ছানা, দই, মাখন ও ঘি হচ্ছে, স্থানীয় বড় গঞ্জে এগুলোর দারুণ চাহিদা। গ্রামে আছে পাতাল ফোঁড় শিবের মন্দির ও ফকিরসাহেবের মাজার সংলগ্ন একটি মসজিদ। চৈত্র সংক্রান্তিতে এবার ফুলতলির মাঠে বিরাট মেলা বসানো হয়, মেলাটি সম্পূর্ণ ভাবেই বাংলার গ্রামীণ সংস্কৃতির মেলা, মেলার পরিচালনাভার ছিল স্থানীয় স্কুলের হেডমাস্টার মশাই নিরঞ্জন খাঁড়ার ওপরে। গ্রামে বেশ কিছু সঙ্গীত প্রতিভা আছে, একটি সঙ্গীত শিক্ষালয় খুলে ছাত্রসংঘ আপাতত এ গ্রামকে স্বয়ম্ভর, শিক্ষিত, স্বাস্থ্যসচেতন, সংস্কৃতিবান একটি আদর্শ গ্রাম বলে ঘোষণা করছে।
এই দিনের অধিবেশনের পরে ছাত্রদের মধ্যে অভূতপূর্ব উৎসাহ লক্ষ্য করা যায়। ওই একদিনে তিন হাজার নতুন ছাত্র সদস্য হবার জন্য আবেদনপত্র পেশ করে। স্বতঃস্ফূর্ত কবিতা গান নাচ পাঠ কথকতা ইত্যাদির পর ছাত্রসংঘের আয়োজিত স্টল থেকে নানারকম মুখরোচক খাবার খেয়ে ছেলেমেয়েরা বাড়ি ফিরে যায়।
বার্ষিক অধিবেশন শেষ হয়ে যাবার পর মৈথিলী রাত নটায় অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরেছে। মেধাদির ফোন পেল। মৈথিলী আজকাল বেশির ভাগ চ্যাপেল রোডেই থাকছে। সে মায়ের চিঠি পাচ্ছে মাসে একটা করে। তার ছোটমামা সত্যেন সোরেন ইতিমধ্যে তার সঙ্গে একবার দেখা করে গেছেন। কাজেই সে এখন অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে গেছে। বাবা যখনই কলকাতায় থাকছে সে-ও চ্যাপেল রোডের বাড়িতে এসে থাকছে। মেধাদি বললেন—‘বৈজুলালকে বলে আজ রাতটা এখানে চলে আয়। কিছু দরকারি কথা আছে।’
ছাত্রসঙ্ঘের এই অধিবেশনটা হয় মউমিতাদের বহুতল ফ্ল্যাট কমপ্লেক্সের নিচের তলায়। শুধু ওদের কো-অপারেটিভের অনুমোদন ছাড়া আর কিচ্ছু লাগেনি। অধিবেশনের ছিল খানিকটা উৎসবের চেহারা। মুখে মুখে প্রচারিত এই ছাত্রমেলায় বহু ছাত্রছাত্রী সারাদিন ধরে এসেছে, গেছে। মৈথিলী আর উজানের গলায় রেকর্ড করা, ছাত্রসঙ্ঘের উদ্দেশ্য, তাদের কাজকর্ম এবং সাফল্যের খতিয়ান বারে বারেই টেপে বেজেছে। সঙ্গে পালান এবং সম্প্রদায়ের টেপ করা গান, আনোয়ারের মেয়ে ফতিমা ও ছেলে সুলেমনের গান। জায়গাটা ফার্ন-প্লেস থেকে বেশি দূরে নয়। মেধাদি আগে বললে মৈথিলী ওখানেই চলে যেত সোজা। কিন্তু এখন ন-টা তো বেজে গেছেই। আলিপুরের রাস্তা নির্জন। বড্ড ছিনতাই হচ্ছে আজকাল।
বৈজু বলল—‘আমি তোমাকে ছোট থেকে দু হাতে মানুষ করেছি মুন্নি, এই রাত্তিরে একা একা মুখের খাবার ফেলে যেতে চাও যাও, কিন্তু বৈজুর বুকে কষ্ট দিয়ে যাবে। চাকর-বাকর হতে পারি কিন্তু ভেবে দেখো আমি তোমার মায়ের কাজও করেছি, বাবার কাজও করেছি।’
মুন্নি আবার দিদিকে ফোন করল, বলল—‘রাত হয়ে গেছে, বৈজুদা যেতে দিচ্ছে না।’
মেধা বললেন, ‘ঠিক আছে তোর বৈজুদাকে বল, আমাকেও যেন খাওয়ায়।
আধঘণ্টার মধ্যে স্কুটারের আওয়াজ পাওয়া গেল। মেধাদি ঢুকতে ঢুকতে বললেন—‘বাঃ, এই বেশ ভালো হল। রোজ রোজ এক জায়গায় ঘুমোতে ভালো লাগে? কি বৈজু খুশি তো? কি খাওয়াবে?’
—‘আমি যা রাঁধি তা তো আপনার চলে না দিদি’—বৈজু গোমড়া মুখে বলল। অরুণা চলে যাবার পর দীর্ঘ দিন মুন্নি দিদির কাছে থেকেছে। তাকে মুন্নির ভার দেওয়া হয়নি, যদিও অরুণা দিল্লি গেলে বরাবর মুন্নি বৈজুর কাছে একলাই থেকেছে, সে এটা ভুলতে পারে না।
—‘কি রেঁধেছো বলোই না।’ মেধা হাসিমুখে বললেন।
—‘কিমাকারি আছে, আর গোল গোল পরোটা, ফিশ ফিংগার করেছিলুম কয়েকটা।’
—‘বাববাঃ এতো? তো ঠিক আছে, তোমার জন্য কি করেছো?’
বৈজু বলল—‘আলুচোখা আর চাটনি।’
—‘বাঃ তাই দিয়েই আমার হয়ে যাবে। আজ আমি বাড়ি তালা দিয়ে এসেছি।’
খাওয়া-দাওয়ার পর ধীরে সুস্থে গল্প-সল্প করলেন মেধা, মৈথিলীর সঙ্গে খানিকটা, বৈজুলালের সঙ্গে খানিকটা। তারপর বললেন—‘মৈথিলী, তোদের সভায় কোনও সাংবাদিক যায়নি?’
—‘কই না তো?’
—‘যায়নি? তাহলে যাবে। খবরটা ওদের কাছে খুব সম্ভব দেরিতে পৌঁছেছে। আমার কাছে এসেছিল।
—‘তাই নাকি? আপনি কি বললেন?’
—‘আমি বলেছি ছাত্রদের প্রতিষ্ঠানের কথা ছাত্ররাই জানে। আমি বিশেষ কিছু জানি না।’
—‘এ কথা কেন বললেন, দিদি?’
—‘সে কথাটাই তোকে বোঝাতে এসেছি। ছাত্রসঙ্ঘ গড়েছিলি প্রধানত তুই উজান আর দেব। আমাদের কয়েকজনকে তোরা উপদেষ্টা হিসেবে চেয়েছিলি। বাইরে থেকে এইরকম কিছু পরামর্শ দেওয়া ছাড়া আমরা আর কিছু করিনি।’
—‘কথাটা তো সত্যি নয়, দিদি!’
—‘শোন মৈথিলী, তোরা ঠিক কর তোরা প্রচার চাস কি না।’
মৈথিলী খানিকটা হকচকিয়ে গেছে। দিদি কি তাকে কোনও পরীক্ষার মধ্যে ফেলতে চাইছেন! সে বলল—‘আপনি কি বলতে চাইছেন আমি বুঝতে পারছি না দিদি।’
—‘যতক্ষণ তুই প্রাণপণ পরিশ্রম করছিস, একটা কিছু গড়বার সঙ্কল্প করে প্রাণপাত করছিস, ততক্ষণ দেখবি নানাজনে তোর সঙ্কল্প নিয়ে অনেক কথা বলবে। কেউ বলবে বোকামি, কেউ বলবে মতলব আছে, কেউ বলবে অবাস্তব ব্যাপার, কিন্তু যে মুহূর্তে সাফল্য পাবি অমনি এই লোকগুলোই তোকে ছেঁকে ধরবে। প্রচার এক হিসেবে খুব ভালো। কাগজে, টিভিতে, রেডিওতে। জনসাধারণ জানতে পারবে ছাত্ররা ভালো ভালো কাজ করছে। তোদের হয়ত সাহায্য করতে অনেক লোক এগিয়ে আসবে। কিন্তু এই প্রচারের একটা মারাত্মক বিপদের দিক আছে।’
—‘কি?’ মৈথিলী জিজ্ঞেস করল।
—‘জনসাধারণের সঙ্গে সব সময়ে মিশে থাকে কিছু বাজে লোক যারা স্বার্থসিদ্ধি ছাড়া আর কিচ্ছু বোঝে না। অনেক সময়ে এরা এমনকি কারণ বিনাই কুচক্রে লিপ্ত হয়। এই সব লোকেদের চোখে পড়ে গেলে তোর ছাত্রসঙ্ঘ ছত্রখান হয়ে যাবে। তোরা আর এগোতে পারবি না। দেখবি নানা দিক থেকে নানা বাধা আসছে। পাবলিসিটি অতি ভয়ানক জিনিস। আমার মনে হয় তোরা এই স্কুপ-নিউজ খুঁজতে আসা সাংবাদিকগুলোকে এড়িয়ে চল। প্রসারের জন্য প্রচার ভালো। কিন্তু প্রচারের জন্য প্রচার খুব বিপজ্জনক জিনিস। আরেকটা কথা, শীগগীরই তোরা অর্থাৎ তুই, লুকু, উজান, দেব তোদের গ্রুপটা আর ছাত্র থাকছিস না। তোকে দেবকে ইনটার্নি থাকতে হবে। প্রচণ্ড খাটুনি, উজানও যদি প্রথম পাস করার পরই কোনও ভালো জায়গায় চাকরি ধরতে না পারে ওর শিক্ষাটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তোরা এখন থেকেই ঠিক করতে থাক, কে বা কারা তাদের জায়গা নেবে।’
মৈথিলী অবাক হয়ে বলল—‘কেন দিদি, না-ই বা ছাত্র থাকলাম।’
মেধা হেসে বললেন—‘তোর কি মায়া হচ্ছে? এই মায়া কিন্তু একেবারেই ভালো নয়। ব্যাপারটা কি জানিস দেশের কল্যাণের জন্যে চিরকালই মুষ্টিমেয় মানুষ পরিশ্রম করে গেছে, আত্মত্যাগ করে গেছে, তাতে তাদের তো ভালো হয়ই নি, দেশেরও হয়নি। একটা প্রতিষ্ঠানের হাতে বা গুটিকয় মানুষের হাতে সমস্ত ভুবনের ভার সঁপে দিয়ে স্বার্থপর আত্মসুখে কাল কাটাবার এই ভারতীয় অভ্যাসটা আমাদের ছাড়াতে হবে। তোরা এই ছাত্রসঙ্ঘের ব্যাপারটাকে চলিষ্ণু রাখ। এত বড় বিরাট দেশ, দেশের অভ্যন্তরে কত যুগের আশঙ্কা, কুসংস্কারে আবদ্ধ বিশাল জনতা—এদের উন্নয়ন একা তোরা আমরা কতটুকু করতে পারি, অথচ এটাই আসল কাজ। এবং এটা এক জেনারেশনের কাজও নয়। তাই প্রজন্মের পর প্রজন্ম যাতে খুব স্বাভাবিকভাবে এই কাজটা জীবনের আর কয়েকটা প্রয়োজনীয় কাজের মতো করে করে যায়, তবেই সত্যিকার কিছু কাজ হবে। কেওড়াখালি নিয়ে আমরা যেটা করলুম সেটা একটা এক্সপেরিমেন্ট। এক্সপেরিমেন্টটা সফল হয়েছে। এবার এটাকে আমরা পেটেন্ট নেবো। রূপরেখাটা আমাদের জানা হয়ে গেছে। এই প্রজেক্ট এখন একসঙ্গে অনেকগুলো শুরু কর। যে কটা পারিস। তোদের জনবল, অর্থবল বুঝে। এবং বিভিন্ন প্রজেক্টের ভার দিতে থাক দায়িত্বশীল, উৎসাহী, কর্মী ছাত্রদের। এইভাবে তোদের উত্তরাধিকারী তৈরি হবে। তোরা ছাত্রাবস্থা থেকে বেরিয়ে যাবি, যুক্ত থাকবি হয়ত অনেক দিন উপদেষ্টা হিসেবে, কিন্তু ক্রমশ নিজের নিজের পেশায় ব্যস্ত হয়ে পড়বি, গৃহস্থ হবি, সচেতন নাগরিক, দেশ-সচেতন, মূল্যবোধ-সচেতন গৃহস্থ। তোদের পরবর্তী বছরের ছাত্ররা আসবে, তারাও ঠিক এইভাবে কাজ করে যাবে, তৈরি করবে ভবিষ্যতের নেতাদের। এই চেনটা তৈরি করতে থাক, না হলে তোদের সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত শেষ হয়ে যাবে। আর এক একটা গ্রাম বাছবি খুব সাবধানে। রাজনীতির আওতার বাইরে দরিদ্র, নিঃস্ব, ছোট্ট গ্রাম। শহরে, গঞ্জে, মফঃস্বলেও তোরা প্রজেক্ট কর, তবে সেগুলোর প্রকৃতি ন্যাচার্যালি আলাদা হবে। চিন্তা কর সে ক্ষেত্রে তোদের প্ল্যানে কোথায় কি অদলবদল হবে।’
মৈথিলী বলল—‘দিদি। আমরা কেউ কেউ যদি পুরো জীবনটাই এই কাজে থাকি তাতে ক্ষতি কি?’
মেধা হেসে বললেন—‘এসব কাজ এতো সময়সাপেক্ষ, এতো একঘেঁয়ে যে একটা সময় হতাশা আসবে, কল্পনাশক্তি ব্যবহার করতে পারবি না, নূতনত্বের স্বাদ না পেলে ক্লান্ত হয়ে পড়বি মৈথিলী। তাছাড়া আজ মনে হচ্ছে এই নিয়েই কাটাবি। সব সময়েই এইরকম মনোভাব থাকবেই তা বলা যায় না। না থাকাই স্বাভাবিক। মানুষের ফুল লাইফ চাই। পূর্ণ জীবন। সব চাই। স-ব। একটা ব্রতে নিজেকে সারাজীবনের জন্য বেঁধে ফেললে একদিন মুক্তির জন্য ছটফট করবি। কিম্বা অত্যধিক আসক্ত হয়ে, অটোক্র্যাট হয়ে যাবি, কাজটা মাঝখান থেকে মাটি হয়ে যাবে।’
কিন্তু এতো সাবধানতা সত্ত্বেও কলকাতার এক মাঝারি দৈনিকে ছবিসহ এক স্টোরি বেরিয়ে গেল। মেধা ভাটনগরের ছবি, মৈথিলীর ছবি, কেওড়াগ্রামের উন্নতিতে তাদের অবদানের কথা।
কার্য-নির্বাহক কমিটির মিটিং-এ উপস্থিত থেকে মেধা বললেন—‘সাংবাদিকদের কাছে আমিও মুখ খুলিনি, মৈথিলীও না। তোরা কে এ কাজ করেছিস স্বীকার কর। কাজটা হয়ত তোরা ভালো ভেবেই করেছিস, কিন্তু ঠিক করিসনি।’
উজান, দেবপ্রিয়, লুকু, গুঞ্জন কেউই স্বীকার করল না। মেধা বললেন—‘যাই হোক, তোদের জানা ছিল না, এখন জেনে রাখ প্রচার আমরা চাই না। প্রচার বিষ। আমরা নিঃশব্দে কাজ করে যাবো।’