৩. বংশী এসে দাঁড়ায়
বংশী এসে দাঁড়ায়।
কৌস্তুভ বলে, তোর বৌদিদি কী যেন বলবে!
অপর্ণা চোখ বোজে।
অপর্ণার রক্তহীন গালে যেন হালকা সিঁদুরের ছোপ পড়ে।
বংশী বার দুই বৌদি বৌদি ডেকে একটু ইতস্তত করে বলে, ঘুমোচ্ছেন!
কৌস্তুভ আশ্চর্য হয়
। অন্তত বংশী দেখে, বড়দা খুব আশ্চর্য হয়ে গেছে।
বলে, এই তো জেগে ছিল।
দাঁড়িয়ে থাকে খানিকক্ষণ বংশী, তারপর সরে পড়ে।
আর অনেকক্ষণ ধরে ঘুমের ভান করে পড়ে থাকতে হয় অপর্ণাকে।
.
মজার কথাটা সুদক্ষিণার কৌশিককে নিয়েই।
ক্লাসের একটি মেয়ে কতদিন ধরে বলছিল, তার মা নাকি সুদক্ষিণাকে দেখতে চেয়েছেন, তাই গিয়েছিল সুদক্ষিণা। আর তিনি সুদক্ষিণাকে হাতে পেয়ে–হি হি করে হাসে সুদক্ষিণা, বুঝলি ছোড়দা, আমাকে পেয়ে সে এক মজার প্রস্তাব!
হেসেই অস্থির, কৌশিক ওর মাথায় একটা বইয়ের কোণ ঠুকে দিয়ে বলে, প্রস্তাবটা কি তাই তো শুনলাম না। তোর বিয়ের নাকি? এমন একটি নিধিকে দেখেই বুঝি ছেলের বৌ করে নিতে ইচ্ছে করছে?
হি হি হি, প্রায় তাই, কাছাকাছি এনেছ। ছেলের বৌ নয়, মেয়ের বর। দেখা নিধির দিকে ফিরেও একবার দেখল না, না দেখা নিধির জন্যেই কাতর। পুঙ্খানুপুঙ্খ জিগ্যেস করল আমাকে তোর কথা।
আমার কথা? আমার কথা মানে? আমার আবার কী কথা?
আহা, এই তুমি রাগী না হাসিখুশী? মেজাজী না হেলাফেলা? ঝালের ভক্ত না মিষ্টির ভক্ত?
এই সব জিগ্যেস করল?
করল তো।
আর তুই তার উত্তর দিলি বসে বসে?
দিলাম তো!
গোল্লায় যা।
খাবারের প্লেট নিয়ে ঘরে ঢুকল চৈতালী। বলল, এ কি দিদি, হাত মুখ ধোওনি?
ধোবো! মজার কথাটা শুনে যাও, এই এই
কী?
ছোড়দার না, একটা হিল্লে হয়ে যাচ্ছে। আমার ক্লাসের একটা মেয়ের মা
.
এ বাড়ির সব কটা প্রাণীর মধ্যে সুদক্ষিণাই সুখী। সে সব কিছুর মধ্যে অত তলাতে যায় না।
নিজেকে নিয়েই মশগুল।
তা ছাড়া হয়তো বা বোধটাও একটু কম। চৈতালীকে নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করে সে ছোড়দাকে, তাই বলে সেটা নিয়ে যে সত্যি মাথা ঘামানো যেতে পারে, এ তার বুদ্ধির বাইরে।
তাই কথার মাঝখানে হঠাৎ চৈতালীকে চলে যেতে দেখে ও একটু চমকালো।
শুধু তো চলে যাওয়া নয়, মুখের চেহারাখানাও খুব খারাপ ঠেকল। ছোড়দার দিকে তাকাল।
ভুরু কুঁচকে বলল, ছোড়দা!
আজ্ঞা হোক!
ঠাট্টা ছাড়। ও মুখটাকে অমন করে চলে গেল কেন?
সেটা ওর মুখকেই জিগ্যেস করলে ভাল হয়।
না। তোর চোখ থেকেই উত্তর চাইছি।
তাহলে চোখের ভাষা পড়তে শেখ। ওটা জিগ্যেস করে হয় না।
হুঁ!… তাহলে তলে তলে সত্যিই এটি ঘটাচ্ছ?
ঘটাচ্ছি না। ঘটছে।
কিন্তু ছোড়দা, ব্যাপারটা কি ভাল হচ্ছে?
জগতে কি যেটা ভাল, শুধু সেটাই ঘটে?
কিন্তু না না ছোড়দা, ভয়ানক অস্বস্তি হচ্ছে।
হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু এ নিয়ে মাথাটা বেশী নাই বা ঘামালি?
তা না ঘামালে? পরিণতিটা ভাবতে হবে তো?
সমস্ত ব্যাপারেরই একটা ছকে বাঁধা সুষ্ঠু পরিণতি হবে, এমন ভাববার দরকার কি? কালের হাতে ছেড়ে দিয়েও দেখতে হয় কিছু কিছু। অনেক নদীই মরুপথে ধারা হারায়।
হুঁ, ব্যাপারটা যতটুকু ভাবছিলাম তার থেকেও ঘোরালো মনে হচ্ছে।
হেতু?
তোর মুখে দার্শনিক উক্তি!
ছেড়ে দে ওসব কথা। একটা অনুরোধ করি তোকে, ওকে কিছু বলতে যাস না।
ওকে বলব না, মাকে বলব।
ক্ষেণু! বেশী পাকামি করতে যাস না, বলবার দরকার বুঝি, আমিই বলব। তোকে উকিল ধরতে যাব না।
তুই বলবি? পারবি?
কেন পারব না? দরকার বোধ করলে সবই পারা যায়।
তা সে দরকারটা এখন বোধ করছিস না?
না।
.
না, সে দরকার এখন বোধ করছে না কৌশিক, করবে না।
সে হালকা স্বভাবের হতে পারে, হালকা বুদ্ধি নয়। চারাগাছকে মহীরুহ ভাবতে বসছে না সে।
হয়তো কৌশিক এদের এই গতানুগতিক সমাজবোধকে খুব একটা মূল্য দেয় না, কিন্তু অকারণ তাল ঠুকতেও সে চায় না।
তা ছাড়া চৈতালী?
তার কুণ্ঠিত সংকুচিত জীবনকে আগে বিকাশের পথ দেখিয়ে দেওয়া উচিত। তারপর সে জীবনের সার্থকতার প্রশ্ন।
.
তবু চোখে চোখ পড়লেই চোখের ভাষা মুখর হয়ে ওঠে।
একজোড়া ত্রস্ত সেখ বলতে চায়, এ তুমি কি করছ?
আর একজোড়া অভয় হাসি হেসে বলে, তাতে কি? জগতে কি এ রকম ঘটে না?
একজোড়া বলে, লোকে আমায় কি বলবে?
আর একজোড়া বলে, বলুক না। তুমি তো একা নও। আমিও তো রয়েছি
কিন্তু মুখের ভাষা কৌশিকের এখনো তেমনি। খেতে বসেই হাঁকডাক করে, রান্না যে আজকাল মুখে করা যাচ্ছে না, সে বিষয়ে যথেচ্ছ মন্তব্য প্রকাশ করে, আবার চেয়ে খায়। তাকেই যে বিশেষ করে অবহেলা করা হচ্ছে এই ছুতো তুলে সুলক্ষণাকে ডেকে নালিশ জানায়, সালিশ মানে, আর মায়ের অসাক্ষাতে হেসে বলে, কেমন জব্দ!
কিন্তু এই সহজ ভঙ্গীটাই যে সন্দেহজনক, সে বোধ কি আছে কৌশিকের?
নেই।
জগতের সমস্ত নবীনের মত সেও প্রবীণকে অবোধ ভাবে। সমস্ত যৌবন অতিক্রম করে, জগতের সর্ববিধ রূপ রস রহস্য, রঙ্গের রহস্য ভেদ করে আর আস্বাদন করে করে তবে যে ওরা প্রবীণ হয়েছে, সে কথা খেয়ালে আনে না। খেয়ালে আনে না–তোদের মুখের রঙের আভাস মাত্র দেখলেই ওরা ধরে ফেলে, কোথায় চলছে কতটা রঙের খেলা।
সুলক্ষণা বিধবা, সুলক্ষণা বুড়ী হয়ে গেছেন, অতএব সুলক্ষণা এ রহস্য বুঝতে পারছেন না। এটাই হিসেব।
কিন্তু সুলক্ষণা বুঝছেন।
তাই সুলক্ষণা শঙ্কিত হচ্ছেন।
আর গম্ভীর হয়ে যাচ্ছেন।
সুলক্ষণার কণ্ঠে আর যেন তেমন প্রশ্রয়ের সুর নেই। নিজের নিভৃতে ভাবতে থাকেন সুলক্ষণা, কৌশিকের কথা তো আগে ভাবিনি আমি।
ওকে যে আমি অনেক উঁচু জগতের মানুষ বলে জানতাম! আমি ওর সহৃদয়তাটুকুকে ভরসা করেছিলাম, ওর মমতাকে তো ভয় করিনি।
ওটাও কি তাহলে একেবারে সাধারণ?
আমি যে তাহলে হেরে গেলাম।
ঘি আর আগুনের সেই চিরপ্রচলিত কুৎসিত প্রবাদটার কাছেই মাথা নোয়াতে হল আমাকে?
.
দুপুরবেলা যখন চৈতালী এসে পায়ের কাছে বসে, পা গুটিয়ে নেন সুলক্ষণা। বলেন, থাক, তুই সরে যা। ঘুম পাচ্ছে আমার।
চৈতালী ভয় পায়।
আগের মত আর নিয়ে চুল নিয়ে জবরদস্তি করে না। আস্তে সরে যায়, নিজের জন্যে নির্দিষ্ট সেই ছোট ঘরটায় গিয়ে চুপ করে বসে থাকে। তারপর অনেকক্ষণ হয়ে যায়।
এক সময় নিঃশ্বাস ফেলে বইখাতা নিয়ে বসে।
সুদক্ষিণা বলেছে, বেশ কিছুটা এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে, তারপর তোমাকে স্কুলে পাঠানোর ব্যবস্থা করা যাবে।
চৈতালী এসব কথায় ম্লান হয়ে যায়।
বলে, এসব কি দরকার দিদি? এই তো আমি বেশ আছি।
বেশ আছছ? রাতদিন শুধু ভাত রাঁধছে, কাপড় কাঁচছে, ঘর মুছছে, বাসন ধুচ্ছ, গুল পাকাচ্ছ, মোচা কুচোচ্ছো, আর কোনও কিছু নেই, এ একটা জীবন! একে বলে বেশ থাকা?
আর কীই বা থাকে দিদি আমাদের মত মেয়েদের?
থাকে লক্ষ্য। থাকে উদ্দেশ্য। তোমার কি আছে?
স্রোতের কুটোর কি কোন লক্ষ্য থাকে? কোন উদ্দেশ্য থাকে?
তা স্রোতের কুটো হয়েই থাকবে নাকি চিরকাল?
ক্ষতি কি?
আমার ক্ষতিবোধ আসে। নিশ্চিন্ত চিত্তে একটা জীবনের অপচয় চোখের ওপর দেখতে ইচ্ছে করে না।
আমি তো মনে করি না অপচয়। তোমাদের বাড়িতে এই আশ্রয়টুকু পেয়ে আমি তো নিজেকে ধন্যই মনে করি।
কর সেটা তোমার মনের গুণ। কিন্তু আমি মনে করি না, আমাদের সংসারে দাসত্ব করে খুব একটা ধন্য হচ্ছ তুমি।… ওই সব হাবিজাবি কাজগুলো কমিয়ে এই জ্ঞানরাজ্যের সীমানায় এসে দাঁড়াও একটু, দেখবে তোমার এখনকার হিসেব সব অর্থহীন হয়ে যাবে।
.
সেই জ্ঞানরাজ্যের চাবিকাঠিটি হাতে তুলে দিতে চাইছে ওরা। চৈতালী কি অবহেলা করবে তাকে?
বইগুলো নিয়ে বসে।
মনে হয়, বাবা যদি মাঝে মাঝে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বাড়ি বসিয়ে না রাখতেন, আমিও হয়তো দিদির মত
সুলক্ষণা কোন একসময় হয়তো উঠে পড়েন। পাশ থেকে দেখতে পান, চৈতালী বইখাতা নিয়ে বসে আছে চুপচাপ! শুকনো, ম্লান মুখ।
স্বাস্থ্য খুবই ভাল হয়েছে ওর এখন, কিন্তু যখন একা থাকে, মুখটা বড় ম্লান দেখায়। যন্ত্রণার কপাল মেয়েটার। জীবনের মোটা যন্ত্রণার শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সূক্ষ্ম আর এক যন্ত্রণা কুরে খেতে বসেছে ওকে।
ভারী মমতা হয় তখন।
মনে হয়, আমি কেন ওর ওপর বিরক্ত হচ্ছি, ওর তো বয়েস কম, এই তো ভালবাসবার সময়। ওর সামনে যদি, ওর এই ঠিক ভালবাসায় বিকশিত হয়ে ওঠবার বয়সে, কৌশিকের মত ছেলে সামনে এসে দাঁড়ায়, কি করে নিজেকে রুখবে ও?
না, ওকে আমি দোষ দিতে পারি না।
ও তো মেয়েমানুষ।
মেয়েমানুষ যে ভালবাসায় ধন্য হয়ে যাবার জন্যই জন্মায়।
সুলক্ষণার এই মতবাদ শুনলে হয়তো লোকে হেসে উঠবে। বলবে, এ যুগে অন্তত তোমার ওই পচা থিয়োরি অচল। এ যুগের বহুমুখী প্রতিভাধর মেয়েদের দিকে তাকিয়ে দেখ। কত দিকে নিজেকে বিকশিত করে তুলছে তারা, স্বয়ংসম্পূর্ণতার দৃষ্টান্ত নিয়ে।
পুরুষের ভালবাসা তাদের কাছে অপ্রয়োজনীয় বস্তু।
বলবে।
বলুক কিন্তু তা হয় না।
প্রকৃতির নিয়ম উলটোয় না।
একটি পুরুষের ভালবাসা ভিন্ন কোনও মেয়েই সম্পূর্ণ নয়। অনুসন্ধান করো, দেখবে তার আপাত একক জীবনের অন্তরালে স্পন্দিত হচ্ছে একটি প্রেম–আকাশের কোলে ধ্রুবতারার মত, নাট্যপ্রবাহের পেছনে আবহ সঙ্গীতের মত।
সেই প্রেম তার সমস্ত জীবন ব্যেপে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে রাখে কল্যাণের দূরত্ব বজায় রেখে। রাখে গোচরে অগোচরে, জ্ঞাতসারে অজ্ঞাতসারে।
সে প্রেম সমাজবিরোধী কাজ করে তার জীবনের মানসীকে ধুলোয় টেনে নামায় না, শুধু হৃদয়ের উপস্থিতি দিয়ে ভরিয়ে রেখে দেয়।
নিঃস্বার্থ?
নিঃস্বার্থ প্রেম হয় না বলবে?
কিন্তু নিঃস্বার্থ কোথায়? সেই তার মানসী প্রিয়ার সুন্দর হয়ে ওঠা, মহৎ হয়ে ওঠা, উজ্জ্বল হয়ে ওঠাই তো তার স্বার্থ।
যে মেয়ে সত্যি একক, সত্যি নিঃসঙ্গ, সে কৃতী হতে পারে, উজ্জ্বল হয় না। সাফল্য অর্জন করতে পারে, সার্থক হয় না। সে তার অনেক জ্ঞানবুদ্ধি কর্মদক্ষতা, অনেক প্রতিষ্ঠা প্রতিপত্তি প্রাধান্য, অনেক যশ অর্থ সম্মানের বোঝা নিয়েও শুকিয়ে যায়, বুড়িয়ে যায়, নিষ্প্রভ হয়ে যায়।
মেয়েদের জীবনে মূল জীবনীরস ভালবাসা। সমাজ তাই ভয় পায়। তাই সদাসর্বদা শাসনের তর্জনী তুলে বসে থাকে, তাই অহরহ নিক্তি ধরে বিচার করে দেয়, কোনটা বৈধ, কোনটা অবৈধ, কোনটা শ্রেয়, কোনটা অশ্রেয়, কিসে কল্যাণ, কিসে অকল্যাণ।
না করে উপায় নেই। নইলে বাঁধ ভাঙবে মেয়েরা, কূল ছাপাবে। বাঁশীর ডাককে উপেক্ষা করবার শক্তি খুঁজে পাবে না।
.
এত সব ভাবেন সুলক্ষণা। বুদ্ধি দিয়ে, বিচার দিয়ে।
কিন্তু চোখের সামনে ওই হাসি ঠাট্টা কৌতুক কলগান কিছুতেই যেন ভাল লাগে না।
চৈতালীকে মেয়ের আসনে বসাতে পেরেছিলেন এক মুহূর্তে, তার অতখানি ত্রুটির বোঝা সত্ত্বেও পেরেছিলেন। কিন্তু বৌয়ের আসনে বসাবার কথা ভাবতেই পারছেন না। সমস্ত মনটা যেন সঙ্কুচিত হয়ে উঠছে।
তাই বারবার ভাবতে চেষ্টা করছেন সুলক্ষণা–আমার বড়ছেলের বৌকে এনেছিলাম আমি সেরা কুলীনের ঘর থেকে, সমাজের উঁচু চূড়ো থেকে!
.
হ্যাঁ, কথাটা সত্যি। একেবারে উঁচু চুড়ো থেকেই অপর্ণাকে এনেছিলেন এঁরা।
তাই নীচু হবার উপায় হল না অপর্ণার। নীচু হতে পারছে না বলেই জীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। অসতী মেয়ের কাহিনী শুনলে শিউরে উঠতে হয় ওকে, কুমারী মেয়ের কলঙ্ক কথা শুনলে কানে আঙুল দিতে হয়, তাই আঙুর আপেল বেদানা ছানা ডিম দুধ মাছ মাংসের সমারোহের মধ্যে ডুবে থেকেও শরীরে ওর রক্ত হয় না। আর অনেক উঁচু থেকে এসেছে বলেই বোধ করি এই নীচু তলার মানুষদের বিশ্বাস করতে পারে না সুলক্ষণার বড়বৌ।
চেষ্টা করেছিল।
বিয়ের পর প্রথম কিছুদিন চেষ্টা করেছিল। সাধনা করেছিল উজ্জ্বল হয়ে ওঠবার, পারল না। ব্যর্থ হল। বিছানা নিল।
তবু উঁচুঘরের কথাই ভাবেন সুলক্ষণা।
হাড়ে মজ্জায় যে সংস্কার বদ্ধমূল হয়ে আছে, তাকে তিনি উড়িয়ে দিতে পারেন না। মেয়ে আর বৌকে সমান কোঠায় ফেলতে পারেন না।
.
সুদক্ষিণা কিন্তু মার থেকে উদার।
সুদক্ষিণা সমাজ-সংস্কারমুক্ত বলে নয়, সুদক্ষিণা আধুনিকা বলেও নয়, সুদক্ষিণার মনটা সহানুভূতিপ্রবণ বলেই। ও ভাবে মরুকগে বাবা, হলেই বা। ছোড়দা যখন ঘেন্না করছে না, তখন দোষ কি? তোমাদের পুরাকালের শান্তরেও তো আছে বাবা স্ত্রীরত্নং দুঙ্কুলাদপি!
চৈতালী কি রত্ন?
তা যে মেয়ে যাকে ভালবাসল, প্রধানত সেই তো তার কাছে রত্ন হয়ে উঠল। তা ছাড়া কেনই বা রত্ন নয়?
কী পরিবেশে মানুষ হয়েছে ও!
তবু কী পরিচ্ছন্ন, কী সভ্য সুন্দর!
ওর মাত্রাবোধকে সমীহ করে সুদক্ষিণা।
সুলক্ষণার অভাবিত প্রশ্রয়ের আশ্রয় পেয়েও দিশেহারা হয়নি ও। সুলক্ষণার অতখানি দামী ছেলের কাছে দামী হয়ে উঠেও আত্মহারা হয়নি। অতবড় পাওয়াকে নিজের মধ্যে সংহত রেখে, সেই বাটনা বাটা, কুটনো কোটা, রান্না করা, কাপড় কাঁচার মধ্যেই নিজেকে অমন করে সমাহিত রাখা কি সহজ ক্ষমতার পরিচয়!
সুদক্ষিণাকে যদি হঠাৎ কোনও রাজপুত্র এসে বরমাল্য দেয়?
সুদক্ষিণা কি মাটি দিয়ে হাঁটবে?
এই প্রশ্ন নিয়ে সুদক্ষিণা চৈতালীকে সমীহর চোখে দেখে। ওদের দুজনের ভালবাসাকে তাই স্বীকৃতি দিতে কুণ্ঠিত হয় না।
কিন্তু কৌশিকের মন এখনো প্রশ্নহীন নয়।
কৌশিক ভাবছে এটা কি সত্যি?
নাকি সেই তুচ্ছ বস্তুটা?
একটা তরুণী মেয়ের প্রতি পুরুষের যে সহজাত মোহ, সেই-টা? অথবা করুণা?
ওর সঙ্গে আমার যে অসাম্য, সে কি আমি করুণা দিয়ে অনেকখানি ভরাট করে তুলে ভুল করতে বসেছি?
সুদক্ষিণা বলে, এই ছোড়দা, কবে বলবি মাকে?
ব্যস্ত হচ্ছিস কেন? সবুরে মেওয়া ফলে।
ওদিকে আর এক খেলা চলছে, খোঁজ রাখিস?
কি?
বড়গিন্নীর সারাক্ষণ চৈতালীকে না হলে চলছে না।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। আমার রাগারাগিতে সেই একটা নার্স রাখা হয়েছিল কদিন, দেখেছিলি তো?
দেখে থাকব! ওই জাতীয় একটা জীবকে কদিন যেন ঘুরতে দেখেছিলাম মনে হচ্ছে—
বিদেয় করে দিয়েছে সেটাকে। ওষুধ খাওয়াতে এসেছিল, হাত কামড়ে দিয়েছে তার
ফাইন! সুপারফাইন! দেখা যাচ্ছে কামড় দেওয়া ব্যাপারটা ছোটলোকের একচেটে নয়, স্রেফ মেয়েলোকদের একচেটে।
চৈতালীর এবাড়িতে আসার প্রথম দিনটার কথা মনে পড়ে গেল সুদক্ষিণার। ছোড়দার মুখের দিকে চেয়ে হাসল একটু।
তারপর বলল, সে যাক। সে নার্স তো পত্রপাঠমাত্র পদত্যাগপত্র! বৌদি এখন চৈতালীকে সর্বদা চাইছে, বলছে, সংসারের কাজের জন্যে অন্য লোক রাখো তোমরা–
কিন্তু অহেতুক এই রাহুর প্রেমের হেতু?
জিগ্যেসের সঙ্গে সঙ্গেই নিজের একটা প্রশ্নের উত্তর পায় কৌশিক। কদিন ধরেই দেখছে, চৈতালী যেন দুর্লভ হয়ে উঠেছে, দেখাই পাওয়া যাচ্ছে না তার। এমন কি মাঝে মাঝে বেঁধে বেড়ে রেখে কোথায় যেন হাওয়া হয়ে যাচ্ছে, ভাত বেড়ে দিচ্ছে বংশী।
মনে ভেবেছিল, হয়তো এ চৈতালীর নতুন জন্মানো লজ্জা, হয়তো বা নিজেকে গুটিয়ে রাখবার, সরিয়ে রাখবার দুরূহ সাধনা, আর নয়তো বা হা, একথাও ভেবেছিল কৌশিক, নয়তো বা কৌশিককে যাচাই। দুর্লভকে লাভ করবার জন্যে চেষ্টা করে বেড়ায় কিনা কৌশিক, তারই পরীক্ষা!
আজ বুঝল, ওসব কিছু না।
হরিণী ব্যাধের জালে আটক।
কিন্তু আটকের মানে পেল না। ইদানীং বৌদির ঘরে সে কদাচ ঢোকে। নেহাত মরণ বাঁচন শুনলেই তবে। তাই দেখেনি, ওখানে চৈতালীর অবস্থাটা কি।
তাই বলল, হেতু?
সুদক্ষিণা অবশ্য বেশী আলোকপাত করতে পারল না। সব প্রশ্নের যেটা শেষ উত্তর, সেটাই বলে দিল দু হাত উলটে, ঈশ্বর জানেন।
যাক তাহলে সময়মত সেই লোকটাকে একবার শুধিয়ে এলেই হবে।
আহা রে.. তবে শোন্
কী? আমার মনে হয়, বৌদি তোদের সন্দেহ করে।
সন্দেহ করে?
হ্যাঁ, আমার তাই মনে হয়।
তা এসব অধমাধম তুচ্ছ ব্যক্তিদের সন্দেহ করে ওঁর কী লাভ?
বাড়ির বড়গিন্নী, বোধহয় বাড়ির পবিত্রতা বজায় রাখবার দায়টা নিজের বলে গ্রহণ করেছেন। অথবা ভাবছেন, বিশ্বে শুধু নড়িবেক মোর ল্যাজটুকু! এ সংসারের তাবৎ আগ্রহ ঔৎসুক্য আর ভালবাসার ওপর ওঁর একচেটে অধিকার। আর কোথাও কিছু ঘটলেই ওনার নৈবেদ্যে কম পড়ে যায়।
হুঁ, মনস্তত্ত্বজ্ঞানটা যে বেশ জবর হয়ে উঠছে দেখছি।
না রে ছোড়দা সত্যি, আগে এত বুঝতে পারতাম না, সর্বদা ভয় পেতাম ওই বুঝি কি হয় বলে, এখন যেন অরুচি ধরে গেছে। ওর স্বার্থপরতা, আর দাদার কী বলব, কী আর বলব, স্ত্রৈণতাই, ঘেন্না ধরিয়ে দিয়েছে একেবারে। বুঝলাম যে রুগ্ন বৌ, তা বলে ন্যায্য অন্যায্য বলে কিছু থাকবে না? এটুকু বুদ্ধি থাকবে না যে ও ওই রোগ ভাঙিয়েই
এই থাম!
.
এই থাম!
সাবধান করে দেবার সময় এসেছে।
চৈতালী এসে দাঁড়িয়েছে।
দিদি!
কী গো?
এখন কি কেউ বেরোবেন?
কেউ মানে তো ছোড়দা। ওকেই জিগ্যেস করে দেখ।
চৈতালী মৃদুস্বরে বলে, জিগ্যেস করবার আর কী আছে। বলছিলাম যে থার্মোমিটারটা তো ভেঙে গেছে, আর একটা এনে রাখতে
ভেঙে গেছে। শুধু থার্মোমিটারটা? না আর কিছু?
চৈতালী চোখ তুলে বলে, না, আর কি ভাঙবে!
তা বটে, ভাঙতে হলে হাড়। তা অত বোধ করি ক্ষমতা নেই তোমার পেসেন্টের। বড় জোর চামড়াটা একটু ছিঁড়েখুঁড়ে
চুপ করুন।
চৈতালী চলে গেল। দ্রুতপায়ে।
অপর্ণা আস্তে আস্তে ঘরের দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।
.
বৌদি আজকাল ক্রমশই খারাপের দিকে চলে যাচ্ছে
নিঃশ্বাস ফেলে বলে সুদক্ষিণা।
কৌশিকও একটা নিঃশ্বাস ফেলে। তারপর আস্তে বলে, অথচ ওঁকে বাঁচানো যেত।
যেত?
যেত। যদি ওঁকে নিয়ে এমন শবসাধনার মহোৎসব করা না হত। যদি খাঁচার দরজা খুলে দেওয়া হত ওঁর।
খাঁচার দরজা খোলা পেলে কী করত ও শুনি?
খাঁচায় বন্ধ পাখীরা যা করে। উড়ে যেত।
না, তা যেত না সুদক্ষিণা বলে, পারত না! ওর কাছে ওই নিয়মিত ছাতু ছোলারও যে রীতিমত মূল্য আছে। আকাশের স্বপ্ন দেখেছে ও, কিন্তু ছাতুর ভাড়টা আঁকড়ে ধরে আছে।
আছে, তাই আছে।
নৈবেদ্যের ত্রুটি সহ্য করবে, এমন ক্ষমতা নেই অপর্ণার। অথচ অপর্ণা খাঁচার শিকে ডানা ঝাঁপটায়।
কিন্তু সেই ঝাপট যার গায়ে লাগে, সে এক অদ্ভুত সহিষ্ণুতার অবতার। একবার বলে ওঠে না, আঃ!
বলে ওঠে না, এই চুপ!
.
সুলক্ষণার আজকাল আবার একটু কাজ বেড়েছে।
বংশীর অসুখ, চৈতালী বেশীর ভাগ অপর্ণার ঘরে। নেমে এসে ভাঁড়ারে বসে ময়দা মাখছিলেন তিনি, চৈতালী এসে দাঁড়াল। এসেছিল অপর্ণার জন্যে জারক লেবু নিতে, ভুলে গেল, থমকে দাঁড়াল।
বলল, মা!
মা বলে অনেক দিন ডাকেনি। এমন নিভৃতির সুযোগই ঘটেনি অনেক দিন। চিরকঠিন সুলক্ষণার হঠাৎ চোখের কোণে জল এসে গেল এই ডাকে। সঙ্গে সঙ্গে কোন উত্তর দিতে পারলেন না।
চৈতালী কাছে বসে পড়ল, রুদ্ধকণ্ঠে বলল, মা, আমার হয়তো এবার চলে যাওয়া উচিত।
.
সুলক্ষণার অভিমান, এটা একটা আশ্চর্য বস্তু! ওঁর মেয়ে-ছেলেরা কেউ দেখেছে কিনা সন্দেহ, তবু সেই আশ্চর্য বস্তুটা চোখে দেখতে পেল চৈতালী।
সুলক্ষণা বললেন, কেন, চলেই বা যাবি কেন? তুই তো এখন বড় গাছে নৌকো বেঁধেছিস!
চৈতালী একটুক্ষণ চুপ করে থাকল, তারপর দাঁড়িয়ে উঠে আস্তে বলল, মা, বৌদি একটু জারক লেবু চাইছেন।
সুলক্ষণা এ মুহূর্তে একথা প্রত্যাশা করেননি। চকিত হলেন। মুখে চোখ তুললেন, দেখলেন ভয়হীন বেদনাহীন ব্যাকুলতাহীন অদ্ভুত এক নির্লিপ্ত মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে চৈতালী। আগুন লাগা ঘরের সামনে বুঝি এমনি মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মানুষ।
সুলক্ষণা শঙ্কিত হলেন।
সত্যি চলে যাবে না তো মেয়েটা? বনের পাখী ভালবাসায় বশ হয়ে আটকে পড়েছিল। সুলক্ষণা যদি সে ভালবাসা তুলে নেন, যদি হাতের ঠেলা দিয়ে সরিয়ে দেন, উড়ে যাওয়া তার পক্ষে বিচিত্র কি?
কিন্তু?
কিন্তু আরও এক কঠিন শেকলে তো বাঁধা পড়ে গেছিস রে বাপু! সে শেকল ছিঁড়তে পারবি?
সুলক্ষণার মনে হল ওর মুখে শেকল ছিঁড়ে বাইরে এসে দাঁড়ানোর ছাপ। চোখে জল নেই, মুখে রেখা নেই, শুধু একটা শূন্যতা।
বিচলিত হলেন একটু।
বললেন, বোস!
তারপর বললেন, চলে যাবি বলে তো খুব শাসাচ্ছিস, পারবি চলে যেতে?
চৈতালী শূন্যে দৃষ্টি তুলে বলল, তা সত্যি সহজে পারব না, কষ্ট হবে ঠিকই।
তা চলে যাবার কি হল হঠাৎ?
মা! তুমি তো সবই বুঝতে পারো।
সুলক্ষণার চোখেও একটা গভীর শূন্যতার ছায়া ঘনিয়ে এল। খুব আস্তে বললেন, যেন নিজেকেই তিনি বললেন, হ্যাঁ, আমি সবই বুঝতে পারি। বুঝতে পারছি। কিন্তু হেরে তুই পালিয়ে যাবি কেন?
আমি কি একটা মানুষ মা? তাই হার-জিতের কথা? তুমি দয়া করে রেখেছিলে, কৃতার্থ হয়ে ছিলাম, এখন দেখছি তোমার সুখের সংসারে অশান্তি আনলাম আমি, শান্ত ঘরে ঝড়। তবে? শুধু নিজের স্বার্থের মুখ চেয়ে লড়াই করে জিততে যাব?
.
সুলক্ষণা অবাক হলেন।
চৈতালী যে এত ভাবতে পারে, সে ভাবনাকে এত সুন্দর করে গুছিয়ে বলতে পারে এ যেন তার কাছে অভাবনীয় ঠেকল।
হঠাৎ মনে হল, যে মেয়েটাকে এই কত দিন যেন আগে এই ঘরে টেনে এনে হাত চেপে ধরে বলেছিলেন, তোর নাম কি বল? এ যেন সে মেয়েটা নয়।
তার মুখের আদল চুরি করে আর একজন কে বসে আছে তার কাছে। একে চেনেন না সুলক্ষণা।
এই অচেনা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ একটা অসতর্ক কথা বলে বসলেন সুলক্ষণা।
বললেন, তা জিততেই হবে। স্বার্থ তো শুধু আর এখন একা তোর নয়। আমার ছেলেটা যে তোর স্বার্থে মাথা মুড়িয়ে বসে আছে।
মা!
সুক্ষণা ওর লুটিয়ে-পড়া মাথাটার ওপর একটা হাত রেখে বলেন, আমি সব জানি চৈতালী! শুধু–মিথ্যে বলব না, মনকে মানিয়ে নিতে পারছিলাম না। বাধছিল। কিন্তু ভেবে দেখছি, মিথ্যে সংস্কারই যদি সব সিংহাসন দখল করে থাকবে, তাহলে বুদ্ধি বিবেচনা, মায়া মমতা, এরা কোথায় ঠাই পাবে?
মা!
হ্যাঁ মা? আর কোনদিন মাসীমা নয়।
মা! আমায় মাপ করো। ছেড়ে দাও। তোমার মাথা হেট হবে, এমন কাজ করবার সাধ্য আমার নেই।
সুলক্ষণা শান্ত হাসি হেসে বলেন, আমার মাথাটা কিসে হেঁট হবে, আর কিসে উঁচু হবে, সে বিধান কি তোর কাছে নিতে যাব আমি? এ তো শুধু তোর কথা নয়, এ যে আমার কুশীরও কথা! আমার নিজের সন্তানের কাছেই যদি আমি আমার স্নেহ নিয়ে, উদারতা নিয়ে, ক্ষমা নিয়ে, মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারলাম, বাইরের পাঁচজনের কাছে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর মূল্যটা কী? সে তো মেঘের প্রাসাদ! যে কোনও সময় বাতাসে উড়ে যাবে, আকাশে মিলিয়ে যাবে।
মা, আমি কি করে মুখ দেখাব তোমার কাছে? আমি যে এ ভাবতেই পারছি না?
সুলক্ষণা এবার একটু হালকা হলেন।
একটু হাসলেন।
বললেন, আমার উদোমাদা বোকা ছেলেটার সঙ্গে দিব্যি তো আমার আড়ালে প্রেম করতে পারছিলি? এখন বিয়ের বেলায় আর ভাবতে পারছিস না! মুখ দেখাতে লজ্জা করছে!
হাতের তালুতে আগুন থাকে, হাতের তালুতে উত্তাপও থাকে। আঙুলের ডগায় থাকে সেই উষ্ণতা, যে উষ্ণতা থাকে শীতের সকালের প্রথম রোদে, বৃষ্টির সন্ধ্যায় ঘরের আরামে।
তাই আর ছাড়ুন বলতে ইচ্ছে হয় না।
শুধু সেই হাত ধরা হাতটায় মুখটা রাখতে ইচ্ছে করে।
চৈতালী!
উ!
চৈতালী!
বল।
খুব অদ্ভুত লাগছে না তোমার?
আমার জীবনের কোনটা অদ্ভুত নয়?
তবু যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। আচ্ছা, কি করে বুঝতে পারলেন বল তো? কি করে এ সিদ্ধান্তে এলেন?
মা মা বলে!
ঠিক বলেছ চৈতালী! এতক্ষণে ধাঁধাটার উত্তর পেয়ে গেলাম! ভাবছিলাম, মা কি রাগ করে?… মা কি নির্লিপ্ত হয়ে?… মা কি অভিমানে?… এখন বুঝতে পারছি, মা সব বুঝতে পেরেছেন, মা বলে। এ সিদ্ধান্তে আসতে পেরেছেন মা বলে!
কিন্তু আমার বড় ভয় করছে।
জানি তোমার ভয় করবে। কিন্তু অভয় তো তোমার হাতের কাছেই চৈতালী! তাকে তুমি একটুও কেয়ার করছ না কেন? একবার যদি বলতে পারো, সব তুমি বুঝবে, তাহলেই দেখো ভয় সহজে কেটে যাবে।
কি জানি! যেন মনে হচ্ছে, চিরকাল বুঝি এই ছাতের ঘরের দরজার চৌকাঠটা ডিঙোলেই আমার বুক কাঁপবে, পা অবশ হতে চাইবে।
সর্বনাশ! তাহলে তো দেখছি ঘর বদলাতে হবে।
এই! বাঃ! তাই বললাম বুঝি? না গো না, এখানটা আমার স্বর্গ!
তুমি বলছ ভয় করছে, আমি ভাবছি বাবাঃ বাঁচা গেল। তখন আর দুটো কথার পর তিনটে কথা কইতে গেলেই বুকের মধ্যে হাতুড়ি পিটবে না?
আহা ইস্! তোমারও যেন
আমারও যেন মানে? হতো না নাকি ভেবেছ? নেহাত পৌরুষের মর্যাদাটুকু বজায় রাখতে মুখে বেপরোয়ার ভাব দেখাতে হত!
উঃ কী ওস্তাদ!
ওস্তাদ না হলে চোরকে বাটপাড়ি করে নিতে পারি?
এই, ভাল হবে না বলছি! খালি খালি চোর চোর বলা চলবে না—
একশো বার চলবে! এই তো বলছি–চোর চোর চোর!
.
চোর চোর চোর!
অপর্ণার রক্তহীন মস্তিষ্কে যেন বোলতা ঘুরছে,চোর চোর! সেই চোর মেয়েটা! মায়ের রুপোর গেলাসটা চুরি করতে গিয়ে হাতে-নাতে যে ধরা পড়েছিল। তবু মা ওকে ঘরের অন্দরে এনে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
এখন ও মার সোনার কৌটো চুরি করছে!
আমি যদি ভাল থাকতাম।… চোখের কোল দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল অপর্ণার। স্নায়ুশিরা রক্তহীন, তবু চোখের ওই জলটা ফুটন্ত লোনা। ওই জলটা ওর রগের পাশটা পুড়িয়ে দিচ্ছে।
আমি যদি ভাল থাকতাম, ওকে মেরে ফেলতাম আমি! ছাত থেকে ঠেলে ফেলে দিতাম! গায়ে কেরোসিন ঢেলে জ্বালিয়ে দিতাম!…
আমি অক্ষম।
তাই ও আমার সামনে নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে ওর অটুট স্বাস্থ্য নিয়ে, ওর নিটোল গড়ন নিয়ে। যেদিন এল, সেদিন ও আমারই মত রোগা ছিল। আমার স্বামীর টাকায় ভাত খেয়ে খেয়ে অতখানি হয়ে উঠেছে ও। অতখানি পুষ্টি, অতখানি লাবণ্য আদায় করে নিয়েছে।
আর এখন
.
বৌদি–আপনার গা মোছর সময় হয়েছে।
চৈতালী এসে দাঁড়াল গামলা তোয়ালে স্পঞ্জ নিয়ে।
হাতের কাছে এমন কিছু নেই যে হাত বাড়িয়ে তুলে নিয়ে ছুঁড়ে মারা যায় ওকে। তাই কিছু না পেয়ে শুধু ঝিমঝিমিয়ে ঘেমে উঠল অপর্ণা।
আর এদিকে অনেকক্ষণ খাটতে হল চৈতালীকে সেই ঘাম মুছিয়ে কিঞ্চিৎ সুস্থ করে তুলতে।
তারপর, সুস্থতার পর অপর্ণা সেই সেবার হাতটা ঠেলে দিয়ে বলল, মুছব না। ইচ্ছে নেই।
কাল মোছা হয়নি।
না হোক, অপর্ণা তার সরু সরু কাঠির মত আঙুল কটা বাড়িয়ে চেপে ধরল ওর হাত। শীর্ণ মুখে একটা বিকৃত হাসি হেসে বলল, কাল রাত্তিরে তুই কতক্ষণ ছিলি এঘরে?
রাত্তিরে?
হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি ঘুমিয়ে পড়ার পর!
আপনি ঘুমিয়ে পড়ার পর আর আমি থাকতে যাব কেন বৌদি? মশারি গুঁজে দিয়ে
থাকতে যাবি কেন? মশারি গুঁজে দিয়ে? আমি কিছু বুঝি না ভেবেছিস?
হাতটা আর ধরে থাকতে পারে না, ছেড়ে যায়।
বৌদি পাগলামি করবেন না। দেখুন তো কী অবস্থা হচ্ছে শরীরের! এই সব আবোলতাবোল ভেবে মিথ্যে কষ্ট পাচ্ছেন কেন?
.
বুকের তোলপাড় থামতে সময় লাগে অপর্ণার। আবার হাতটা বাড়িয়ে দেয়। খামচে ধরে ওর শাড়ীর আঁচলটা।
মিথ্যে কষ্ট! মিথ্যে কষ্ট পাচ্ছি আমি? আমি কি দেখতে পাই না, দিন রাত্রি, চব্বিশ ঘণ্টা তোর ওই দেহটাকে ও চোখ দিয়ে গিলে খায়!
আঃ বৌদি!
ধর্মের নামে শপথ করে বল, একথা সত্যি নয়? বল্ তোর মরা বাবার নাম করে, একথা মিথ্যে! কি, মুখ হেঁট হয়ে গেল তো? জানি জানি, সব জানি। ঘুমের আমার দরকার নেই, তবু আমায় ঘুমের ওষুধ খাইয়ে অজ্ঞান করে রেখে
আপনি যদি এসব কথা ফের বলেন, আমি আর আসব না এঘরে।
তা আসবি কেন? তোর তো একজন নয়! আমার বোকাহাবা শাশুড়ীটার দুটো ছেলেকেই তো গ্রাস করছিস তুই! দুটোকেই তো
চুপ করে যায় অপর্ণা।
বৌদি! বৌদি!
ধরে নাড়া দেয় চৈতালী। বাইরে গিয়ে ডাকে, ক্ষেণু, শীগগির একবার এসো তো!
.
ব্যাপারটা কী হয়েছিল বল তো?
কৌশিক অনেক চেষ্টায় একবার আটক করে। বলে, ব্যাপারটা কী হয়েছিল বল তো?
কী আর! বৌদি হঠাৎ মূর্ছা গিয়েছিলেন–
অকারণ?
ওঁর মূৰ্ছা যাওয়ার কারণ থাকে নাকি?
থাকে না। দৃশ্যত থাকে না, কিন্তু অলক্ষ্য লোকে কিছু থাকে। দাদার ব্যবহারে যদি ওঁর অভিযোগের কোন পথ থাকত, যদি অবহেলার অপরাধে দোষীর কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারতেন দাদাকে, তা হলে হয়ত এত মূৰ্ছা যেতেন না বৌদি। ভেতরের বাষ্পেচ্ছাসটা কিছু প্রশমিত হত। কিন্তু দাদা ব্যক্তিটি এমন পারফেক্ট ভদ্রলোক যে–
তোমার তো সাহসের অভাব নেই। একদিন দাদাকে নির্জনে ধরে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দাও না।
বোঝাতে গেলে আকাশ থেকে পড়বে।
ওটা বাড়িয়ে বলছ। খুব খারাপ লোক নাকি?
কৌশিক এবার গম্ভীর হয়।
বলে, না, লোক খারাপ বললে অবিচার করা হয়, খারাপ হচ্ছে ওনার ভাগ্য। কিন্তু সাধারণ মানুষের মত খারাপকে খারাপ বলে দীর্ঘশ্বাস না ফেলে, উনি সেটাকেই পরম সুখ বলে মেনে নেওয়ার ভান করতে বসেই অবস্থা জটিল করে তুলছেন। বৌদিকে যদি এতটা এমন না করতেন, সত্যি দুঃখের কান্না কেঁদে হালকা হয়ে বাঁচত বৌদি। কিন্তু সেটা হচ্ছে না। তাই কান্নার পাথরের ভার বয়ে বয়ে কখনো আগুন জ্বালছে, কখনো হয়তো মুছা যাচ্ছে।
চৈতালী মৃদু গম্ভীর হয়ে হেসে বলে, আগুন জ্বালাবারই বা ক্ষমতা কই? দেখে মায়া হয়। আমার কি মনে হয় জানো?
কি?
যদি ধৃষ্টতা বলে না ধরো তো বলি—
গৌরচন্দ্রিকা রাখো, সময় কম!
মনে হয় ওঁর কোন অতীত ইতিহাস আছে।
না না। আগে এমন ছিল না। স্বাস্থ্যভঙ্গের সঙ্গে সঙ্গেই সন্দেহ বাতিক ঢুকিয়ে মনটাকে ছারখার করে ফেলল।
সারবার কী কোন আর আশাই নেই?
আছে! মানে ছিল হয়তো। কিন্তু কোথায় সে সম্ভাবনা? অবিশ্যি সেটা আমার অনুমান। মনে হয় সত্যিকার একটু ভালবাসা পেলে ও হয়তো সেরে উঠত। কিন্তু পুতুলকে সত্যি ভালবাসা দিতে পারে, এমন মানুষ কোথায় পাওয়া যায় বল? আগে ছিল মোমের পুতুল, এখন হয়েছে কাগজের পুতুল। অথচ আবার একটা দিক বেশ তৈরি। ছলনা ধরতে পারে!
সত্যিকারের ভালবাসবার মত লোক কোথাও জোগাড় কর না?
হয় না! এদিকে আবার গোসাঁই বংশের মেয়ে, ঐহিক পারত্রিক সর্ববিধ বিশুদ্ধতা রাখাই ওঁর জীবনের লক্ষ্য। সরলতা আর কুটিলতার এক আশ্চর্য সমন্বয় ওই মহিলাটি। কিন্তু থাক, অনেকক্ষণ পরচর্চা করা গেছে।
তা গেছে। এ সব কথা বলতে ভয় করে। তবু দাদা আর তুমি, দুজনে এক মায়ের ছেলে ভাবতে অবাক লাগে
হঁ, তা লাগতেই পারে। একজন সুমহান হিমাচল, অন্যজন ক্ষুদ্র উইঢিবি, একজন বিশাল সমুদ্র, অন্যজন তুচ্ছ গোম্পদ, একজন বিরাট বটবৃক্ষ, অন্যজন হতভাগ্য তৃণদল, একজন
হয়েছে হয়েছে, থাক। সব বুঝতে পেরেছি। উঃ!
কি, এখন পস্তাচ্ছো তো? ভাবছো এই বাজে বাক্যবাগীশটাকে নিয়ে
আঃ থামো! অত বোলা না, আমার ভয় করে, আমার বিশ্বাস হয় না।
বিশ্বাস হয় না? উইটিবিকে গোষ্পদকে তৃণদলকে তোমার বিশ্বাস হয় না?
চৈতালী শান্ত চোখ তুলে বলে, না, ভাগ্যকে আমার বিশ্বাস হয় না!
এত ভয় কেন?
.
ভয় কেন?
চৈতালী শুধু একটা নিঃশ্বাস ফেলে। কেমন করে বোঝাবে ভয় কেন! এখনো যে ওর মন বলছে এত কেন দিতে আসছ ভগবান? এমন অদ্ভুত অসম্ভব দান তো চাইনি আমি। শুধু একটু নিশ্চিন্ত আশ্রয়, শুধু একটু স্নেহছায়া, শুধু একটুকু সান্নিধ্য, একটুকু চোখের সুখ, এই পেয়েই ধন্য থাকতাম আমি, কাটিয়ে দিতে পারতাম সারাজীবন। তোমার এই প্রচণ্ড দয়ার ভার কি বইতে পারব আমি? জীবনের প্রারম্ভ থেকে কিছু না পেয়ে পেয়ে, পাওয়াটাই যে ভয়ের হয়ে গেছে। তোমার এই অনাবৃষ্টি আর অতিবৃষ্টির খেলায় আমি কি জিততে পারব? বুঝি হেরে যাব!
.
এই বাড়িরই অন্য এক ঘরে আরও একজন তখন ঠিক ওই কথাই ভাবছিল, আমি তা হলে হেরে যাব! সব দিকেই হার হবে আমার! শাশুড়ী আমায় ভালবাসার ভান করেন, জানি সব মিথ্যে, ওই আঁস্তাকুড়ের জীবটাকে আমার থেকে অনেক বেশী ভালবাসেন তিনি। এরপর ওই রাক্ষুসীই এ বাড়ির সর্বেসর্বা হবে, আমার সামনে, আমার চোখের ওপর সংসারের সব আদর দখল করে নেবে। কৌশিকের সঙ্গে আমার ছোেট বোনটার সম্বন্ধ করাবো ভেবেছিলাম, সে আশায় ছাই পড়ল। সুপর্ণা এ বাড়ির বৌ হয়ে এলে আমার সব কিছু বজায় থাকত। আর
অনেকটা চোখের জল উপচে আসায় অনেকক্ষণ গেল সামলাতে। তারপর ভাবল অপর্ণা, ওই লক্ষ্মীছাড়া বিচ্ছিরি মেয়েটা কি ভাসুর বলে মানবে? ওকেও গ্রাস করবে! যেমন এখন করছে। অথচ কেউ ওর দোষ দেখতে পাবে না। মাকে ও তুক করেছে, বাকীগুলোকে তো বশীকরণ মন্তর দিয়েছে। কে বলতে পারে, ও কো-ঘরের মেয়ে!
আমি তবে কী করব গো? কী করব! হে ভগবান, আমায় তুমি সারিয়ে দিতে পার না! দিতে পার না অগাধ স্বাস্থ্য, প্রচুর শক্তি? ইচ্ছে করলে কী না পার তুমি! তোমার ভাঁড়ারে কত ঐশ্বর্য, তবু এত কৃপণ কেন গো তুমি, এত নিষ্ঠুর কেন?
.
কৌস্তুভ কোনদিন মাকে কোন প্রশ্ন করে না, আজ এসেছে প্রশ্ন করতে।
মা, এই অদ্ভুত সিদ্ধান্তটাই তুমি তাহলে পাকা রাখলে?
সুলক্ষণা তাঁর বড় ছেলে তার মুখের দিকে তাকিয়ে আস্তে মৃদু হেসে বলেন, পাকা বাবার জন্যেই তো সিদ্ধান্ত রে খোকা!
কুশী পাগল হতে পারে, কিন্তু তার সঙ্গে তুমিও পাগল হবে, এটা খুব আশ্চর্য লাগছে!
জগতে প্রতিদিনই কত রকমেব আশ্চর্য ঘটনাই তো ঘটছে খোকা!
এটা বোধকরি সব কিছুকে হার মানাবে। তোমার ভাবী পুত্রবধূর ইতিহাস বোধ হয় ভুলে গেছ!
ভুলবো কেন রে? সেই মানুষটা কি আছে আর?
তোমরাই বল স্বভাব যায় না মলে–
ব্যতিক্রমও থাকে। তাছাড়া কোনটা স্বভাব, কোল্টা অভাব, সেটাও বুঝতে চেষ্টা করতে হয় বৈকি। পরিবেশ মানুষকে যে কী ভাবে কী করায়–
কৌস্তুভ ঈষৎ উত্তেজিতভাবে বলে, মনে হচ্ছে অপর্ণাকে নিয়ে আমাকে এরপর অন্যত্র থাকতে হবে
ওমা! সুলক্ষণাও অবাক হন এবার, বৌমার সঙ্গে যোগাযোগ কোন্খানে? সংঘর্ষই বা কোথায়?
আমরা ভুলতে পারি, কিন্তু ও তো ভুলতে পারে না ও গোস্বামী বাড়ির মেয়ে।
সুলক্ষণা উত্তেজিত হন না, সুলক্ষণা গম্ভীর হন, কিন্তু ওর হাতে খেতে, সেবা যত্ন নিতে, আমার গোসাই বেয়াইয়ের মেয়ে তো কই আপত্তি করেনি খোকা?
খাওয়া আর ইয়ে–মানে ঘরের বৌ করে
সুলক্ষণা এক মুহূর্ত নির্নিমেষ চোখে তার বড় ছেলের দিকে তাকিয়ে বলেন, তুই বড় হয়েছিস, তোর পরামর্শ নেওয়া অবশ্য আমার উচিত। বল্ তবে, ওকে কি চলে যেতে বলব?
চলে যেতে? চলে যেতে বলেছি আমি?
কৌস্তুভ আর একটু লাল হয়।
তবে? সুলক্ষণা শান্ত নির্বিকার গলায় বলেন, তা ছাড়া? কী তবে করবে ও এরপর?
কেন যেমন আছে-আছে, তেমন থাকা যায় না?
যেমন আছে? মানে তোদর সংসারের রাঁধুনী হয়ে? তা হয়তো যায়, তবে কি জানিস খোকা, মানুষ জিনিসটা তো অঙ্কের সংখ্যা নয় যে তাকে ঠিকমত সাজিয়ে নির্ভুল কষে ফেলা যাবে। মানুষের মধ্যে মন বলে একটা বস্তু আছে।
বেশ, আমার আর কিছু বলার নেই। তবে জেনো, ক্ষের বিয়ের জন্যে অসুবিধেয় পড়তে হবে।
.
কৌস্তুভ ক্ষেণুর বিয়ের কথা বলে। যে কৌস্তুভ জীবনে কখনো এতগুলো কথা একসঙ্গে বলে না।
সুলক্ষণা বলেন, বুঝতে পারছি খোকা, আজ তুই নেহাৎ মরীয়া হয়েই লড়তে এসেছিস, নইলে এত কথা তুই কবে বলেছিস ব? এত কথা জানলিই বা কী করে? কিন্তু একটা কথা মনে রাখিস বাবা, অনিবার্য বলে একটা শব্দ আছে। সেটা হচ্ছে সম্পূর্ণ মানুষের হাতের বাইরে।
কৌস্তুভের মা ঠিকই বুঝেছেন, মরীয়া হয়েই এসেছে কৌস্তুভ, কারণ অপর্ণা বলেছে চৈতালীর বিষয়ে একটা হেস্তনেস্ত না হলে, অর্থাৎ তার এ বাড়ির বৌ হওয়াটা রদ না হলে অপর্ণা মরবে। কেঁদে কেঁদে হার্ট খারাপ করে মরবে, উপবাস ধর্মঘট করে মরবে, ঘুমের ওষুধ বেশী করে খেয়ে মরবে, যা হয় কিছু করবেই। অর্থাৎ ওর হাতে মৃত্যুর যা যা উপায় আছে, একে একে প্রয়োগ করবে। একটাও কি লাগবে না?
অগত্যাই তবে কৌস্তুভকে মায়ের কাছে আসতে হয় দরবার করতে। কিন্তু সুলক্ষণ ওর কথাকে উড়িয়ে দিলেন। বললেন অনিবার্যকে মেনে নিতে হয়।
তাহলে?
তবু লড়ল, কৌস্তুভ।
বলল অনিবার্যকেই যদি মেনে নিতে হয়, তা হলে তো মানুষের করণীয় বলে কিছু থাকে না মা। রোগে চিকিৎসা, অসহনীয় অবস্থাকে সহনীয় করার চেষ্টা, সবই দেখছি তাহলে অনাবশ্যক?
সুলক্ষণা এক মুহূর্ত ছেলের দিকে তাকিয়ে বলেন, তুই আজ বড় বেশী উত্তেজিত হয়েছিস বাবা, এখন তর্ক করতে বসলে পরে কষ্ট পাবি। তবে আমার কি মনে হয় জানিস, প্রত্যেকেরই এক একটা নিজস্ব এলাকা থাকে, তার বাইরে যেতে চেষ্টা করলেই অনেক ঝঞ্জাট, অনেক দুঃখ। কুশীর ব্যাপারটা বৌমার এলাকায় নয়, এটাই বৌমাকে বুঝিয়ে বলিস।
সুলক্ষণা চলে যান।
কৌস্তুভের মনে হয় এই মাত্র যেন তার চির স্নেহময়ী মা তাকে একটা চাবুক মেরে চলে গেলেন।
কৌস্তুভের সমস্ত সদ্বিবেচনাই যে বৌয়ের তাড়না অথবা প্রেরণা মাত্র, এইটাই তবে জেনে গেলেন সুলক্ষণা!
.
কিন্তু সত্যিই কি তাই?
কৌস্তুভের নিজের ভেতর কি কোনও প্রেরণা নেই? নেই কোন কিছুর তাড়না?
থাক।
যা কিছুই থাক, যত অসহনীয়, যত তীব্র, যত ক্ষোভ দুঃখ হতাশা, তবু ফিরে যেতে হবে সেইখানে। যেখানে এক অবুঝ স্বার্থপর নির্বোধ কুটিল মন নিজের এলাকার বাইরে বেরিয়ে অকারণ জ্বালায় আছড়ে মরছে।
কৌস্তুভের উদ্ধার নেই সেখান থেকে।
অদৃশ্যলোক থেকে অদৃষ্ট দেবতা তাকিয়ে দেখে
সেই নীল শির-ওঠা চুল উঠে-যাওয়া চওড়া কপাল, সাদা খড়ির মত রঙ।
সেই তার ওপর একখানি স্বাস্থ্যবান পুরুষের হাতের থাবা। আস্তে সন্তর্পণে এই কপালের ওপর হাত বুলোচ্ছে সেই পুরুষ।
ওই চামড়ার নীচে অদৃশ্য যে ললাটলিপি লেখা আছে তাকে কি মুছে দিতে চাইছে ওই হাত?
.
তোমার হাতের সেই চুড়িগুলো কি হল?
ভারী লাগে, খুলে রেখেছি।
হাতটা কিরকম যেন দেখাচ্ছে।
আর হাত! হাতটাই আর বইতে পারছি না।
না না, পোরা। এই একটা মাত্র চুড়িতে হাতটা যেন তোমার বলে মনেই হচ্ছে না। কোথায় রেখেছ?
আমি আর কোথায় রাখব?
অসীম ক্লান্তিভরা কাতর চোখের দৃষ্টি তুলে অর্পণা আস্তে বলে, ওকে রেখে দিতে বলেছি।
ওকে! কাকে?
ওই যে চৈতালীকে!
ও আবার কোথায় রাখল?
কি জানি! ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসে অপর্ণার।…শিশুর মত বিশ্বস্ত মুখটা শান্ত, সরলতায় শিথিল হয়ে আসে, রেখেছে কোথাও।
.
এই একটা সুযোগ।
এই উপলক্ষ্যে নিজেকে নিয়ে গিয়ে উপস্থাপিত করা যায়।
এখন সুলক্ষণা পুজোয় বসেছেন।
সকালের পুজো নয় যে সংসারের ডাকে তাড়াতাড়ি উঠবেন, এ সন্ধ্যেপুজো। এ সময়ে কোন ডাক নেই সুলক্ষণার জীবনে, তাই যতক্ষণ ইচ্ছে বসে থাকেন সুলক্ষণা পুজোর ঘরে।
সুলক্ষণার বড়ছেলে জানে একথা।
না, অন্য কিছু নয়।
শুধু অর্পণার ব্যবহারের জন্য একটু ক্ষমা চাওয়া চৈতালীর কাছে। শুধু বলা, আমি ওর জন্যে লজ্জিত। চোখের ওপর দেখতে পায় তো।
অদ্ভুত একটি অসহায়তা আর কোমলতায় ঢাকা ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর সেই নির্যাতন, বসে বসে সহ্য করা কী কঠিন।
গতকালের দৃশ্যটাই এখন শুধু চোখের ওপর দেখতে পায় কৌস্তুভ।
বিছানা ছেড়ে উঠে ইজিচেয়ারে বসেছিল অর্পণা, ন্যাকড়ার ফালির মত লটপটে হাত দুখানা দুপাশে ঝুলিয়ে। তখন তো সেই ঝকঝকে চুড়ির গোছাটা রয়েছে হাতে। তাই আরও সরু আর শিথিল দেখাচ্ছিল হাত দুটো।
চৈতালী বিছানা ঝাড়ছিল।
অপর্ণার বিছানা, কৌস্তুভের বিছানা। ঘরের দু দেয়ালের দু পাশে দুটো খাট।
অপর্ণা ডাকল, চৈতালী!
ও বলল, বলুন!
এর আগে ডানলোপিলোর গদিতে শুয়েছ কখন?
চৈতালী থমকে তাকাল।
বলল, আগে পরে ও কোনদিন চোখেও দেখিনি বৌদি।
অপর্ণা ক্ষুব্ধ ব্যঙ্গের হাসি হাসল।
কী যে বল চৈতালী! কাল রাতে যে আমি ঘুমের ওষুধ খেয়েও ঘুমোইনি, সেটা বোধহয় টের পাওনি!
আপনার কথা আমি বুঝতে পারছি না বৌদি।
এতগুলো কথা একসঙ্গে বলে কষ্ট হচ্ছিল অপর্ণার, তাই খানিকটা জিরিয়ে নিয়ে বলল, আমিও তো কিছুতেই বুঝতে পারি না চৈতালী, রাতে যে তোমাকে আমার দরকার হয় না, তবু তুমি এ ঘরে শুতে আস কেন?
কৌস্তুভ বলে উঠেছিল, সেই মুহূর্তে চুপ করে থাকা তার পক্ষে অসম্ভব হয়েছিল বলেই বলেছিল, অপর্ণা, কী সব বলছ যা!
অপর্ণা চোখটা একবার খুলে আর একবার বুজে বলেছিল, যা তা বলছি? তা হবে। ফিসফিস কথায় ঘুম ভেঙে গেল, চুপ করে পড়ে পড়ে শুনলাম কত হাসি, কত কথা, বললাম ভগবান আমায় যদি মশারি তুলে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াবার ক্ষমতা দিতেন!… দেখতাম কোন্ রাক্ষুসী আমার স্বামীকে
ফেন্ট হয়ে পড়েছিল অপর্ণা তক্ষুণি।
চৈতালীর সঙ্গে কৌস্তুভকেও লাগতে হয়েছিল তার চৈতন্য সম্পাদনের সাধনায়।
আর বার বার মনে হয়েছিল কৌস্তুভের, অজ্ঞান হয়ে গিয়েও যে অপর্ণার চোখটা সম্পূর্ণ বুজে যায় না, সেটা কি লক্ষ্য করেছে চৈতালী?
কৌস্তুভ কি বলে দেবে ওকে, অপর্ণার চোখ দুটো বড্ড বেশী বড় বলেই ওই রকম দেখায়।
বলেই অবশ্য।
জ্ঞান হবার আগেই ঘর ছেড়ে চলে গিয়েছিল চৈতালী।
.
তারপর এই।
কিন্তু পৃথিবীতে কি এতও প্রতিবন্ধক!
সুদক্ষিণা বসে আছে ওর কাছে।
এত কিসের হাসি গল্প ওদের?
বার দুই ফিরে এল কৌস্তুভ। তারপর দেখল, সুদক্ষিণা নিজের ঘরে বসে পড়ছে। একা।
নীচে রান্নাঘরে অন্ধকার। বংশীও দেশে গেছে কদিন।
ও তাহলে কোথায় গেল? কোথায় আছে এখন?
দোতলায় নয়, একতলায় নয়, বারান্দায় নয়, সিঁড়িতে নয়, তাহলে?
তিনতলায় কৌশিকের ঘর থেকে ছুরির ফলার মত তীব্র তীক্ষ্ণ একটা আলোর রেখা বারান্দার ওপর এসে পড়েছে।
সেদিকে তাকিয়ে ছুরির ফলার মত জ্বলতে থাকে একজোড়া চোখ। এই তবু জ্বলন্ত চোখের ধার নিয়েও দূর থেকে তাকিয়ে বিন্দুমাত্র দেখা যায় না।
তবে? কাছে যাওয়া ছাড়া উপায়?
একজন বিছানায় পা ঝুলিয়ে, একজন চেয়ারে।
যে চেয়ারে, তার মুখের ওপর জোর পাওয়ারের বিদ্যুৎবাতির সমস্ত আলোটা এসে পড়েছে। পড়েছে শরীরের সমস্ত রেখায় রেখায়। কোলের ওপর পড়ে থাকা শ্যামাভ হাত দুখানা পাথরে গড়া পুতুলের হাতের মত নিটোল মসৃণ। একগাছা করে সরু বালা যেন নিবিড় আলিঙ্গনে জড়িয়ে আছে সেই মণিবন্ধ দুটি।
ও যেদিন প্রথম এ বাড়িতে এসেছিল সে তো কতদিন হয়ে গেল! তখন ওর মুখের উঁচু রেখাগুলোর ওপর আলো পড়েছিল, আর ওর হাত দুটো চোখেই পড়েনি।
ওর মুখটা এখন ভরাট আর উজ্জ্বল।
কী বলছে ও? হেসে হেসে?
আর কী বলছে তার উত্তরে বখে-যাওয়া কৌশিকটা? বলছে, হ্যাঁ ঠিক তো। সার্থকনামা মহিলা। চৈতালী ঘূর্ণিই বটে। বাবাঃ একেবারে তচনচ্ কাণ্ড!
কার দোষ শুনি?
দোষ? এর মধ্যে দোষটা কোথা? সবটাই তো গুণ।
গুণ মানে?
মানে গুণতুক, জানো না সে-সব? জানো, ক্ষেণু তাই বলেছিল গোড়ায়। বলেছিল, মেয়েটা নিশ্চয় গুণতুক কিছু জানে ছোড়দা। নইলে মা খামোকা ওকে এত ভজলেন মানে কি? এখন বুঝছি ক্ষেণু কত দূরদর্শী!
আর নিজে? নিজে তো প্রথম দিনেই…
প্রথম দিনের কথা আর তুলো না—
হেসে উঠলো চৈতালী।
যে হাসি কৌস্তুভ কোনদিন চোখেও দেখেনি।
হাসি দেখতে না পেলেও কৌস্তুভ প্রতিনিয়ত মুগ্ধ দৃষ্টিতে ওর কাজ করা দেখেছে, দেখেছে কত অনায়াস অবলীলায় সংসারের সমস্ত গুরুভার নিজের ঘাড়ে তুলে নিয়ে সমাধা করে চলেছে। ও। কত শান্ত হয়ে অপর্ণার সেবা করছে। ঘামে না, হাঁপায় না, বসে পড়ে না, নিশ্বাস ফেলে না।
দেখেছে অলক্ষ্য দৃষ্টিতে, ওর নিটোল হাতের ওঠা পড়া, মসৃণ ঘাড়ের কমনীয়তা। শুধু ওর হাসি দেখেনি কোনদিন। দেখেনি হাসলে ওর ঠোঁটটা কত লাবণ্যময় হয়ে ওঠে।
.
ওই হাসি আর ওই লাবণ্যের কাছে কি এগিয়ে আসছে কৌশিক? কৌস্তুভর উচ্ছন্ন যাওয়া ছোট ভাইটা!
কৌস্তুভ দেখবে তাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে? ছি ছি!
তবে?
নেমে যাবে?
চোখ কান বুজে ছুটে?
না না। চলে যাবার সময়টাও দেবে না বুঝি ওরা।
তবে ঘরেই ঢুকে পড়া ভাল।
দরজার কাছে অন্তত! খুব দরকারী কথার জন্যে ঢোকা যাবে নাই বা কেন?
ঘরে আর কেউ আছে, এ যেন দেখতে পাচ্ছে না কৌস্তুভ। গম্ভীর ভারী গলায় প্রশ্ন করছে, অপর্ণার চুড়িগুলো কোথায় রেখেছ?
চুড়ি!
চমকে উঠল চৈতালী। ছিটকে বেরিয়ে এল চেয়ারটাকে প্রায় ঠেলে দিয়ে। বোবা গলায় বলল, চুড়ি!
হ্যাঁ, ও তখন যেগুলো খুলে রাখতে দিয়েছিল তোমায়!… আচ্ছা থাক, এখন সময় না থাকে পরে দিও।
.
তুমি রাখনি? তোমায় দিইনি আমি?
সর্বশরীর ঘেমে উঠেছে অপর্ণার, নাড়ী বসে গেছে মনে হচ্ছে। বলছে, ভগবান!
সুলক্ষণা একখানা হাতপাখা দিয়ে জোরে জোরে বাতাস করতে করতে বলেন, বৌমা, উতলা হয়ো না। একটু ভাবতে চেষ্টা করো, তুমি নিজেই হয়তো
আমি? আমি? তাহলে আমার বালিশের তলা খুঁজে দেখুন।
.
কথাটা সত্যি।
বালিশের তলা ছাড়া আর দৌড় কোথা অপর্ণার? ভারী লাগছে বলে যদি খুলেই রাখে অন্যমনস্ক হয়ে, ওইখানেই রাখবে।
আর কে ঘরে ঢোকে?
কৌস্তুভ।
সুলক্ষণা।
কদাচিৎ সুদক্ষিণা।
সুদক্ষিণাকে দেখলেই বিরক্ত হয় আজকাল অপর্ণা, চোখ এড়ায় না সুদক্ষিণার।
হয়তো যারাই পৃথিবীর আলো বাতাসের উপস্বত্ব ভোগ করে বেড়াচ্ছে, তাদের সকলের ওপরই বিরক্ত অপর্ণা।
অথচ এই কিছুদিন আগেও এ রকম ছিল না সে। তখন শুধুই ঘামত, তখন শুধুই অপরিসীম ক্লান্তিভরা চোখ দুটো তুলে অপ্রতিভের হাসি হাসত।
আর যখন একটু ভাল থাকত, তখন বলত, আমায় কিছু কাজ করতে দিন না মা!
.
সেই সেদিন থেকে অদ্ভুত রকমের বদলে গেছে অপর্ণা। যেদিন থেকে চৈতালীকে বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত করেছেন সুলক্ষণা।
সেদিন অপর্ণা শুধু অবাক হয়ে বলেছিল, ওই চোরটা? শুধু কাজের জন্যে?
সুলক্ষণা বলেছিলেন, কিসের জন্যে কি, সব কি আর বোঝানো যায় বৌমা! ধর শুধু কাজেরই জন্যে, সে দরকারও তো অস্বীকার করা যায় না? আমি আর কতকাল তোমাদের সংসার দেখতে পারব! সংসারের জন্যে লোকজন দরকার, তোমার জন্যেও একটি লোকের দরকার।
.
হ্যাঁ, এই ধরনের কথাই বলেছিলেন সুলক্ষণা। তারপর থেকেই যেন দ্রুত বদলে যাচ্ছে অপর্ণা, আরও বদলে গেছে চৈতালীকে নিজের ঘরে ডেকে এনে। আর ক্রমশই কাহিল হয়ে যাচ্ছে।
এখন আর ওর দৌড় বালিশের তলার বেশী নয়। খোঁজা হল সেখানে। অপর্ণাকে আস্তে বসিয়ে তোশকের তলা, গদির তলা পর্যন্ত। দেখা হল খাটের তলা, যদি গড়িয়ে গিয়ে থাকে।
সুলক্ষণা এতক্ষণ অপর্ণাকে বলছিলেন, এবার চৈতালীকে বললেন, ভাল করে ভেবে দেখ দিকি। তাড়াতাড়িতে কোথাও রেখেছিস কিনা–।
চৈতালী সুলক্ষণার দিকে স্থির দৃষ্টি মেলে বলল, ভাল করে ভেবে দেখেছি, মাসীমা।
কিন্তু যাবে কোথায় বল্ বংশীর কথা মুখে আনাও পাপ, তবু বংশীও তো নেই দু-তিন দিন। ঈশ্বর সত্যিই মঙ্গল করেছেন যে ও নেই এখন।
.
ঈশ্বর মঙ্গল করেছেন।
বংশীকে বাঁচিয়েছেন!
ভাবল চৈতালী। এই কথাই তাহলে বলতে চাইছেন সুলক্ষণা।
এ ঘরের দরজায় বাড়ির সবকটা প্রাণী এসে দাঁড়িয়েছে।
সুদক্ষিণা এসেছে সুলক্ষণার তীক্ষ্ণ প্রশ্ন শুনে, কৌশিক চৈতালীর সেই বোবা গলায় উচ্চারিত চুড়ি শুনে।
কিন্তু নেমে আসার আগে পর্যন্ত অবেনি, এ রকম একটা নাটকের অভিনয় দেখতে পাবে।
তাহলে গেল কোথায়!
এ কথা সুলক্ষণা উচ্চারণ করলেন, অনুচ্চারিত রইল অন্য আর একজনের মনে। কিন্তু উচ্চারণের সময়ই বা কোথায়? এদিকে যে আর এক বিপদ। অপর্ণার চোখ চাওয়ানো যাচ্ছে না। বাতাস দিয়ে নয়, চোখে মুখে জলের ঝাঁপটা দিয়ে নয়। নাড়ীর গতি ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে।
অতএব কৌশিককে এখন ছুটতেই হবে ডাক্তারকে একটা খবর দিতে।
কৌস্তুভ তো নাড়ী ধরে বসে আছে।
আর সুদক্ষিণা বাতাস করতে করতে ভাবছে, বৌদির গায়ে যদি আর সকলের মত রক্ত থাকত, তাহলে অনেক, অনেকদিন আগে মারা যেত বৌদি। রক্ত নেই বলেই যম ওকে অবহেলায় ফেলে দিয়ে চলে যায়।
ওরা মৃত্যুর পদধ্বনি গুনছে! আর সুলক্ষণা লোকলজ্জা ভুলে তন্ন তন্ন করে খুঁজছেন অপর্ণার ঘরের বাক্স আলমারি দেরাজ শেলফ ড্রেসিং টেবল! বড়লোক বাবার বাড়ি থেকে অনেক দামী দামী আসবাব পেয়েছিল অপর্ণা। তার চাবি নিয়ে সেই সব খুলে সুলক্ষণ দেখলেন।
নেই।
নেই! কোথাও নেই।
অপর্ণা তো আর তার চুড়িগুলো স্যাকরাবাড়িতে বেচে দিয়ে আসে নি।
তবে তোদের ঘরেই খোঁজা হোক– সুলক্ষণা সুদক্ষিণার দিকে তাকিয়ে ক্ষুব্ধ হাসি হেসে বলেন, আর কোথায় খুঁজতে যাব ব?
খোঁজো!
সুদক্ষিণা নিজের ঘরের বইপত্র বিছানা বাক্স তুলে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে।
বলে, দেখ বাবা, দেখে নাও। কপালে এও ছিল! যত সব পাগলামি।
কিন্তু এতক্ষণে কৌস্তুভ একটা কথা বলে, চুড়িগুলো চুরি যাওয়াটা তো পাগলামি নয়?
এ কথার উত্তর দেবে কে?
চুড়িগুলো যে সকাল পর্যন্তও জলজ্যান্ত প্রত্যক্ষ ছিল।
আমার ঘরটা দেখা হয় নি।
চৈতালী বলে ভাবশূন্য মুখে।
আর সেই সময়, ডাক্তার যখন সবে এসে দাঁড়িয়েছেন, ওষুধ দেন নি, তখন রোগী হঠাৎ চোখ মেলে ভাঙা ভাঙা ক্ষীণ গলায় বলে ওঠে, রাখলে কি ঘরে রাখবে তুমি?
ডাক্তারের সমস্ত মুখস্থ।
সপ্তাহে তিনদিন আসতে হয় তাঁকে। দরকার বোধ করলে আরও। যেমন আজ। যথারীতি পরীক্ষা করে বলেন, ঠিক আছে। সামান্য একটু বেশী উইক লাগছে। হজমের গোলমালে হতে পারে। পুরিয়াটা দিয়ে দেবেন একবার।
আর রাত্রে? কৌস্তুভ বলে, ঘুম না এলে?
নেহাত না এলে বড়িটা দেবেন। না দিলেই ভাল হয়। না দিতেই চেষ্টা করবেন। পালসটা একটু–কিছু না, ঠিকই আছে। ওই যা বললাম, খুব দরকার বিবেচনা করলে
দরকার বিবেচনা করলে।
ভাবলো কৌস্তুভ।
দরকার কাকে বলে?
.
বলা যায় না। সুদক্ষিণা বলে, অপরাধের বীজ রক্তে থাকে। এমনও হয় হয়তো সারাজীবন বড় বড় লোভ ত্যাগ করে শেষ জীবনে সামান্যর জন্যে
আছে। এরকম দৃষ্টান্ত ভুরি ভুরি আছে সুলক্ষণার জানার জগতে। সুলক্ষণা মুহূর্তের লোভের কাহিনী জানেন, রক্তের ঋণ শোধের কথা জানেন, সোনার জন্যে আদি অন্তের পৃথিবীতে কত কুশ্রীতা, কত নির্লজ্জতা, কত নিষ্ঠুরতা আর নির্বুদ্ধিতার ঘটনা ঘটছে, তার খবর বার্তা জানেন।
কিন্তু চৈতালী?
কিন্তু নয় কেন? কৌস্তুভ আস্তে আস্তে বলে, জগতে অসম্ভব বলে কিছু নেই। নেহাত নিরীহ একটা লোকও মানুষ খুন করতে পারে, নেহাত সাধু একটা লোকও চুরি করতে পারে। আর এর তো চমৎকার একটা হিস্ট্রিই রয়েছে। যাদের রক্তে চুরির নেশা থাকে, তারা অজ্ঞাতসারেও চুরি করতে পারে। তা ছাড়া তোমার কাছের এই কিছুদিন ছাড়া ওর আগের জীবনের কিছুই তো জানো না তুমি? কে বলতে পারে, দলের লোকের প্ল্যান অনুযায়ীই
খোকা চুপ কর–বলে উঠে আসেন সুলক্ষণা।
চৈতালীকে যে ঘরটা দিয়েছিলেন, সেই ঘরটায় আসেন। সারা ঘরে সমস্ত জিনিস ছড়িয়ে ছিটিয়ে চুপ করে গালে হাত দিয়ে বসে আছে চৈতালী।
সুলক্ষণা আস্তে বলেন, আচ্ছা, তোর কি মনে হয় বল্ দেখি চৈতালী?
চৈতালী মুখ তুলে বুঝি একটু হেসেই বলে, মনে যা হয়, তা কি বলতে আছে মাসীমা?
কিন্তু আমি যে ওদের কাছে মুখ দেখাতে পারছি না।
আমার ভাগ্য!
এবার যেন সুলক্ষণার চোখে একটা রুক্ষতা দেখা দেয়। যা এতক্ষণের মধ্যে দেখা যায়নি। সেই সন্ধ্যা থেকে এখন পর্যন্ত সুলক্ষণার চোখে উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে, উদ্বেগ দেখা দিয়েছে, অস্বস্তি দেখা দিয়েছে, চিন্তা দেখা দিয়েছে, কিন্তু রুক্ষতা এক মুহূর্তও দেখা দেয়নি।
এখনই দেখা গেল।
বললেন, ভাগ্য বলে চুপ করে বসে থাকলে তো চলবে না বাছা, গেল কোথায় সেটা তো দেখতে হবে?
দেখুন!
একটুকরো আগুনের মত কথাটা এসে লাগে সুলক্ষণার ওপর, দেখবার যা যা পদ্ধতি আছে, প্রয়োগ করুন সে সব।
আগুনের সঙ্গে হাসি ঝলসাল একটু।
সুলক্ষণার মনে হয়, এ যেন তাঁর নিত্য দেখা চেনা মেয়েটা নয়। সেই একদিনের দেখা অচেনা মেয়েটা।
যে বলেছিল, পুলিসে দিতে ইচ্ছে হয় পুলিসে দিন, চাকর দিয়ে মারাতে ইচ্ছে হয় মারুন, নামের কী দরকার?
সুলক্ষণা জ্বলে ওঠেন।
সুলক্ষণার উঁচু মাথাটা চিরতরে হেঁট হয়ে গেছে আজ, সুলক্ষণার বড় সাধের হিসেব তালগোল পাকিয়ে গেছে।
এখন সেই তালগোল পাকানো হিসেবের ওপর এসে এসে ভিড় করছে সেই সব শোনা আর জানা কাহিনী।
কাদের বিশ বছরের পুরনো চাকর চার আনা ওজনের সোনার লোভে মনিবের ছেলেকে খুন করেছিল, কার নিজের ভাইপো শুধু সিন্দুকের চাবিটা হাতাবার জন্যে কাকার গলা কেটেছিল। কোথাকার মঠের সাধু আজীবন কৃচ্ছসাধনের মহৎ পথ বেয়ে চলে এসে বৃদ্ধকালে বিগ্রহের গহনা চুরির অপরাধে বিতাড়িত হয়েছিলেন আর কোন্ পরম নিষ্ঠাবতী বালবিধবা সারা যৌবনকাল নির্জলা একাদশী করে আর কঠোর নিয়মে কাটিয়ে এসে, প্রৌঢ়ত্বে পা দিয়ে কলঙ্কের কালি মুখে মেখে কুলত্যাগ করেছিল, সেই সব এখন ভাবতে হচ্ছে সুলক্ষণাকে।
রোধ করতে পারছেন না এই চিন্তার ঢেউ।
সে ঢেউ সুলক্ষণাকে ডুবিয়ে মারতে চাইছে, শ্বাসরোধ করে দিচ্ছে।
সেই দমবন্ধ অবস্থায় সুলক্ষণা কিছুতেই আর মনে করতে পারছেন না, মানুষ অমৃতের সন্তান।
এখন বরং ভাবছেন, ভগবান খুব রক্ষা করেছেন। নেহাত সুলক্ষণাকে হাত ধরে ফিরিয়ে আনা যাবে না বলেই এতবড় একটা ধাক্কা দিয়ে ভুল পথ থেকে ফিরিয়ে এনেছেন।
কত বড় একটা ভুলই ঘটতে বসছিল।
কত বড় বিপদ।
আর কৌশিক?
প্রথমটায় সে তো ব্যাপারটার গুরুত্বই দেয়নি! ভেবেছিল বৌদির এটি একটি নতুন অবদান।
গহনা হারানোর ছুতোয় বুঝি আর এক নতুন কান্নার পথ আবিষ্কার!
কিন্তু সে ধারণার ওপর বিরাট একটা ধাক্কা এসে লাগল।
দেখতে পেল, চৈতালীকে আবার সবাই যেন তার পুরনো ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে তাকিয়ে দেখছে।
ভয়ানক একটা যন্ত্রণা বোধ করল কৌশিক, ওই অবনতমুখীর দিকে তাকিয়ে। কিন্তু কর্তব্যের ডাক, মায়া মমতা আকুলতা সব কিছুর অনেক উর্ধ্বে। ছুটতে হল তখন ডাক্তারবাড়ি।
আর ডাক্তারকে নিয়ে যখন ফিরল, তখন চৈতালী অদ্ভুত রকমের বদলে গেছে। যেন ওর সমস্ত সত্তাকে ঘিরে একটা পাথরের পাঁচিল বানিয়ে ফেলেছে চৈতালী। তার ওপিঠে আর কারুর প্রবেশাধিকার রইল না বুঝি।
ডাক্তারের বাণী শ্রবণ করে যখন ছিটকে এদিকে এল, দেখল চৈতালীর সেই ছোট্ট ঘরটার দরজায় সুদক্ষিণা কঠিন মুখে দাঁড়িয়ে, আর ঘরের মিথ্যা মালিক একটি একটি করে জিনিস খুলে ছড়িয়ে মেলে ধরছে তার সামনে!
কৌশিক রুদ্ধস্বরে প্রশ্ন করেছিল, কী হচ্ছে এসব ক্ষেণু?
চৈতালী মুখ তুলে মৃদু হেসে বলেছিল, সার্চ!
সুদক্ষিণা বোধ করি ছোড়দার সামনে লজ্জা পেয়েছিল, তাই বিরক্ত স্বরে বলে উঠেছিল, সব ঘরই তো খোঁজা হচ্ছে, তোমার ঘরও হল, এতে এত ব্যঙ্গ করবার কিছু নেই। আমার ঘরও তো তছনছ করলাম, কই অপমান তো বোধ করলাম না?
চৈতালী বলল, তোমার মহত্ত্ব!
সুদক্ষিণা রাগ করে সরে গেল।
কৌশিক কেমন এক নিরুত্তাপ দৃষ্টি মেলে বলে, চৈতালী! এই বিচ্ছিরি সমস্যাটা কি সংসারে এলেই চলত না? না এলেই ভাল হত না কি?
চৈতালী একটু ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলেছিল, কত জিনিসই তো না এলে ভাল হত। তবু সেই ভালটা আর হয় কই? আমিই তো তার প্রমাণ।
কিন্তু চৈতালী–
কী আশ্চর্য! আচ্ছা মানুষ তো আপনি? বাড়ির রাঁধুনী, তাও আবার চোর, তার ঘরে আপনি কেন?
কৌশিক থতমত খেয়েছিল।
তবু হেসেও ছিল।
বলেছিল, হয়তো ঘরের ঘরণীর মনে সাড়া জাগাতে!
ছিঃ!
কিন্তু সেই ছিঃটা উলটে ফিরে এল চৈতালীর কাছে। শেষ পর্যন্ত কৌশিক বলে উঠল, ছি ছি।
না, চোর বলে নয়। ওর রূঢ়তায়, ওর কঠোরতায়। অথচ কৌশিকের সঙ্গে এই রূঢ়তা কি সত্যিই কোন কারণ ছিল? কৌশিক তো সন্দেহ করতে আসে নি? কৌশিক শুধু প্রশ্ন করতে এসেছিল, সবাই সন্দেহ করছে কেন?
ঘটনা সংস্থাপনটা হল কী ভাবে?
চৈতালী ভুল বুঝল!
না, চৈতালী কৌশিককে ভুল বোঝে নি।
চৈতালী তার আগের ভুল বুঝতে পেরে সাবধান হল। চৈতালী বুঝতে পারল, ভয়ানক একটা ফাটলের ওপর মাটি চাপা দিয়ে প্রাসাদ গাঁথতে বসা ভুল। চৈতালী বুঝতে পারল, যে গাছের শিকড় নেই, সে গাছের আয়ু অনিশ্চিত।
অপর্ণার হারানো গহনা কোনখান থেকে না কোনখান থেকে পাওয়া যাবেই।
কিন্তু চৈতালীর ওপর থেকে হারানো বিশ্বাস কি আর ফিরে পাবেন সুলক্ষণা? ফিরে পাবে কৌশিক?
আর যদি সেই গহনাটা না পাওয়া যায়? যদি কৌস্তুভ ঘুমন্ত স্ত্রীর গা থেকে খুলে নিয়ে গিয়ে বেচে এসে থাকে? (যেটা ছাড়া এই মুহূর্তে আর কোন সদুত্তর খুঁজে পাচ্ছে না চৈতালী তার বোবা প্রশ্নের।)
তাহলে?
সেই গভীর বিদারণ রেখার ওপর দিয়েই চিরদিন পথ চলতে হবে চৈতালীকে।
যেটা অসম্ভব।
যেটা অবাস্তব।
.
তবু আবার এল কৌশিক।
বলল, চৈতালী, এমনও তো হতে পারে, এতক্ষণ ধরে ঠাট্টা করছিলে তুমি। বৌদির জিনিসটা লুকিয়ে রেখে মজা দেখছ।… এমনও হতে পারে, আমাদের পরীক্ষা করছ তুমি। আমরা তোমায় কতটুকু বিশ্বাস করি, তার পরীক্ষা!
চৈতালী হেসে উঠল।
বলল, আর এমনই কী হতে পারে না, লোভের জিনিস সামনে আসে নি বলেই রক্তের গুণ জেগে ওঠে নি, ঘুমিয়ে ছিল। সামনে আসতেই
কৌশিক ক্ষুব্ধস্বরে বলে ওঠে, ওকথা আমি অন্তত বিশ্বাস করি না।
চৈতালী আবার হেসে ওঠে, কেন কর না? প্রকৃতির নিয়ম উলটে যাবে নাকি তোমার বোকা বিশ্বাসের জন্যে? শোন নি, বাঘের ছানাকে দুধভাত খাইয়ে রাখলে সে পালক প্রভুর হাত চাটে, কিন্তু দৈবাৎ একদিন রক্তের আস্বাদ পেলে, সেই প্রভুরই ঘাড় ভাঙে।
ঠিক এই কথাই সুলক্ষণা বলেন।
শুনেছি পোষা বাঘ হঠাৎ একবার রক্তের আস্বাদ পেলে
কৌশিককেই বলেন।
কৌশিক উদ্ধত গলায় বলে দেয়, বৌদিকে আমি মোটেই বিশ্বাস করি না।
সুলক্ষণা গম্ভীর গলায় বলেন, হয়তো আমিও করি না। কিন্তু বৌদি তার গহনা নিয়ে গিয়ে আর কোনখানে লুকিয়ে এসেছে, সেটাও তো বিশ্বাস করার কথা নয়?
বেপরোয়া কৌশিক বলে ওঠে, কে বলতে পারে, দাদাই করেছে কিনা!
সুলক্ষণা হঠাৎ তীব্র কটু গলায় বলেন, তাহলে তুমিই বা নয় কেন?…
হঠাৎ রাগ চড়ে গেছে তার। হয়তো নিজের আশাভঙ্গে, কিংবা ছেলের ব্যাকুলতায়।
মা, তুমি কি সত্যিই তাহলে স্বীকার করছ, মানুষ চিনতে তুমি ঠকেছিলে?
সুলক্ষণা ছেলের যন্ত্রণাহত মুখের দিকে তাকিয়ে বলেন, কোথাও কোনখানে ঠকিনি, বা কোনদিন ঠকব না, এত বুদ্ধির অহঙ্কার আমার নেই কুশী।
তারপর আর ঘুরে বেড়াতে পারে নি কৌশিক। নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েছিল। আর সারাক্ষণ আশা করছিল দরজার কাছে একটি পদধ্বনি এসে থামবে।
কিন্তু থামল না।
মনে হচ্ছে অনেকক্ষণ আগে কোথাও থেমে গেছে সেই পায়ের শব্দ। চিরদিনের মত।