২৮. দিন গেল, মাস গেল, বছর গেল
তারপর দিন গেল, মাস গেল, বছর গেল।
গাড়লিয়ার চটকল চালু হয়ে গেছে। জগদ্দল আগুরিপাড়ার ঘাট বরাবর গাঁয়ের ভিতরে কালোদুলের আমবাগানের ধারে উঠে তেসুতি কলের কারখানা। সদর্পে বয়লারের চিমনি দাঁড়িয়ে মাথা উঁচু করে। প্রতিমুহূর্তে সোঁ-এসাঁ শব্দে যন্ত্র তার জয় ঘোষণা করছে।
কালেদুলে মরে গেছে। অধরা ছেলের বউ নিয়ে কাজ তেসূতির কলে। সাহেবদের সে খুব প্রিয়। অনেক কাজের মেয়ে জুটিয়ে দিয়েছে সে কারখানায়। কেউ কেউ চলে গেছে হুগলির পুল তৈরির কাজে। মা গঙ্গার উপর দিয়ে ইতিপূর্বেই হাওড়ায় তৈরি হয়ে গিয়েছিল পুল! অবিশ্বাসও কম ছিল না তবু, বিশেষ যারা সে পুল দেখেনি। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে যখন দেখা গেল তার উদ্যোগ আয়োজন, তখন স্থানীয় ছোট জাতের লোকেরা কুতুহলী দর্শকের মতো দল বেঁধে হাজির হতে লাগল।
খবর ছড়াল গুলবাঁধার কাছখান থেকে নাকি প্রায়ই গঙ্গার জলে ভেসে ওঠে নরমুণ্ড, কাটা হাত পা। অর্থাৎ এও সেই হাওড়ার পুলেরই অভিজ্ঞতা যে, গঙ্গার তুষ্টিসাধনে শতমানুষ বলি দিতে হয়েছে পুলের জন্য। অতএব সাবধান।
তবুও পেট বড় দায়। অনেকেই গেল কাজের জন্য।
গিয়েছিল নয়নও, কাঞ্চনের রূপপাগল সেই নেশামত্ত কিশোর ঢুলীশাবক।
সবাই যখন তাকে চলে আসার কারণ জিজ্ঞেস করল, সে বলল হাতের ঝটকা নিয়ে, ধুর শালা। কোম্পানি দিল ক্যাঁটালপাড়ার ভাঁটিখানাটা উঠিয়ে। কোন মরদ খাটবে সেখানে?
সত্যিই তখন পুলে খাটা মজুরদের অতিরিক্ত মাতলামোর জন্য মুক্তাপুরের খালের ধারে নৈহাটির মদের ভাঁটিখানা তুলে দেওয়া হয়। কিন্তু নয়নের মনের তল আরও গভীরে। সে সকলের কাছে ঘুরে ঘুরে কাঞ্চনের মৃত্যু সংবাদ সংগ্রহ করল এবং একদিন দেখা গেল কবিয়াল হয়ে বসেছে নয়ন…। মানুষের মন এতই বিচিত্র বুঝি তাই! নইলে ক্ষণিকের মস্করাতে যে কিশোর রূপবতী বাগদিনীর রূপ এঁকে রাখে বুকে, এ পৃথিবীরই আর দশটা ঢুলীর ঘরের ছেলের মতোই মনে হয়েছে। কাঞ্চনের পদাঘাত নয়ন বুকে নিয়ে এমনি করেই শোধ দিল। লোকে অবাক মানল নয়নের কবিয়াল। হওয়া দেখে আর নয়নের ভণিতারও হদিস পেল না কেউ। সে এখানে সেখানে ঘোরে, নানান জায়গার কথা বলে গানে গানে। সে বলে এই জগদ্দলের কথা, ফরাসডাঙার কথা, চাঁপদানির কথা, বলে সেনেদের কথা। সকলে তার গান শোনে। গানের শেষে ভণিতা করে : বলে জগদ্দলের লয়ন কাঞ্চন। কিংবা কহে ঢুলী কাঞ্চন লয়ন। সাঁটে অথবা মিল খুঁজতে গিয়ে অনেক সময় আমি যে গো কাঁচার লয়ন।
খাইয়ের সঙ্গেও তার ভারী ভাব। সে যে গায়,
কত ছিল কত গেল বলে শেষ আর পাই না
ঢোলক ছেড়ে গায়েন হলেম, শাপশাপান্ত কর না,
বলিহারি দুনিয়াদারি বেহ্মার মাথায় দিল বাড়ি
মোলীদাসের আখড়া গেল রসাতলে।
কালের বস্তু রইল না এ দিনও তো রবে না
সেথা—উঠেছে টমাসডমের চটকল।
লখাই মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করে, কাঞ্চন লয়ন কী হে?
একমুহূর্ত নির্বাক থেকে বিলম্বিত সুরে নয়ন জবাব দেয় :
দেবীর অঙ্গ পরশ পেয়ে পাথর পেল পান–
(আমি) দেবীর পদাঘাতে গান বাঁধি
পেয়ে লতুন জ্ঞান।
আমি যে গো সেই দেবী কাঁচার লয়ান।
বলে শ্রোতা ও গায়ক পরস্পরের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে। অনেকক্ষণ পর লখাই বলে, সোর, এই সোন্দর।…আবার এই সুন্দরের বক্তব্য নিয়ে গানের ডালি সাজিয়ে নয়ন চলে যায় নানান জায়গায়।
চক্রবর্তীদের বাড়ির বাইরের দিকে বাগানের ধারে ভদ্রলোক বসে বসে নানান গল্প করেন। জীবনের গত স্বর্ণযুগ হারানো স্বপ্নকাহিনী সব। জামাই আন্দু চক্কোত্তি অর্থাৎ আনন্দ এ আসরের শ্রেষ্ঠ এবং বিশিষ্ট। বটগাছের এ উঁচু ঢিবির যায় তাই আনন্দ-বেদী।
বিধ্বস্ত সেনাপাড়া। সেই বিরাট পরিবারের একটা শাখা এখনও বিরাজ করছে। বড় চাকুরে তারা। অন্যান্য পরিবারগুলি কেউ ব্রাহ্মণ ধর্মাবলম্বী ও শিক্ষিত ছিল। তারা অনেকেই কলকাতা এলাহাবাদে নানান সরকারি দপ্তরে কাজ নিয়ে বিদেশি হয়েছে।
হায়, এখনও দোল দুর্গোৎসবের আয়োজন হয়। নেই শুধু সেই দানখয়রাতি। কে একদিন সেনেদের শানের পাড় ঘাটে কিছু বাসন পেয়েছিল। লোকে বলে, ওখানে গেলেই নাকি জল ঝকঝকে কাঁসার বাসন আপনি ওঠে। পুরনো কিংবদন্তি ব কথায়, ঢঙে ও সুরে ছড়ায়। বংশের বর্তমান পুরুষেরা সেসব গরিমায় উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন। বিস্মিত হন।
অতীত দিনের এক ভাঙা পুরনো রাজপ্রাসাদের মতো সারা সেনপাড়া জগদ্দল বোধহীন, ক্ষমতাহীন, নির্বাক, বিহুল। অতীত আছে, ভবিষ্যৎ নেই যেন। কী আছে কেউ জানে না।
মাঝে মাঝে শীনাথ কাঠুরে কুড়ল কাঁধে আসে। কাঠ কাটতে কেউ ডাকলে যায়। আর মাঝে মাঝে লখাইকে বলে, একালে কি মেয়ে মায়ের পেটে যন্তরে ছেলে হয়? শালা দুটো মাগীই বিইয়েছে।
মুসলমান পাড়ার গনি মিয়ার জমি যেদিন শরাফত খাস করে নিল, সেদিন বোঁচকাকুঁচকি বেঁধে তৈরি হয়েছিল চলে যাবার জন্য। ওপারের হুগলিতে ব্যারাক তৈরি হচ্ছিল, এই সেনবাবুদের এক কর্তা তার কন্ট্রাক্টার ছিলেন। সেখানে মজুর খাটতে যাবে বলে স্থির করে।
সব নিয়ে থুয়ে দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে দেখেছিল, বাইরে শরাফত খাঁ দাঁড়িয়ে দাড়িতে হাত বোলাচ্ছে। হাওয়া উঠেছিল তার উঠোনের কুর্চি ফুলের গাছে, ঘরের বাতায়, মনে হয়েছিল ঘর কাঁদছে।…আবার সকলের হাত ধরে দরজা খুলে ঘরে ঢুকে পড়েছিল সে। আল্লা তার যে গতি খুশি করুন, ভিটে সে ছাড়বে না।
প্রথমে তার রোগা ছেলেটা মরে গেল। তারপরে মরল সে। আশ্চর্য! শরাফত খাঁও সেইদিনই মরেছিল এবং গোরস্থানে উভয়কে একই দিনে সমাহিত করা হয়েছিল।
গনির সুন্দরী বিবি লতিফা আজ ধান ভানে, শাকপাতা কুড়োয় জলা-জংলায়। কৈশোরের সীমায় এসেও তার ছেলে গোলাম ন্যাংটা হয়ে ঘুরে বেড়ায়। তেসুতিকলের সাহেবদের কাছে যায় কাজের আশায়। সাহেবরা বলেছে, সে কাপড় পরে এলে কাজ দেবে। সে আম্মার ছেড়াকাপড় পরে যেতে সাহেবরা কাজ দিয়েছে তাকে।…লতিফা কিছুই বলতে পারে না। কেবল সন্ধ্যা, হলে রোজ সে একবার গোরস্থানে যায়, বাতি দেয় কিন্তু কাঁদতে পারে না। একটু দূরে একবার আড়চোখে যেন বোরখার আড়াল থেকে দেখছে এমনি শরাফত খাঁয়ের গোরটার দিকে দেখে তারপর গনির কবরের দিকে তাকিয়ে বলে, গোলাম গোলামি করে গোরার কলে। আমি কিছু জানি না।
আর ওই গোলামের সঙ্গে ভারী ভাব হয়েছে তিন বছরের ছেলে হীরালালের। গোলামের সঙ্গে আসলে মধুর বন্ধুত্ব। উভয়ে এক হুঁকোর দোস্ত। যদিও বয়সের ফারাক তাদের অনেকখানি।
মধু মাঝে মাঝে বলে বসে, কলকারখানার কাজ ভারী মজার, ভারী মগজের দরকার। আমার শিখতে বড় মন চায়।
কিন্তু কালী বলে অন্য কথা। বলে, হারামজাদা, অধরা খেমটির ছেলের বউয়ের মুখ বড় মিঠে লেগেছে তোর, তাই কলে কারখানায় কাম ধরতে মন চায়না?
মধু মুখ ঝাষ্টা দেয়, বাজে বকিসূনে। তারপরে কথায় না পারলে বলে, হাঁ হাঁ তাই যা।
গোলামের হাতে তৈরি একখানি পেয়ারা কাঠের ছেলেমানুষি হাতুড়ি সব সময়েই হীরালালের হাতে দেখা যায়। লখাই বিস্মিত চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে ছেলেটা সারাদিন হাতুড়িটা দিয়ে এটা টুকছে, ওটা ঠুকছে, জিজ্ঞেস করলে বলে, আমি খুব বড় মিত্তিলি অর্থাৎ মিস্তিরি হব। লখাইয়ের মাথায় যেন আগুন জ্বলে ওঠে। তার রাগ গিয়ে পড়ে মধুর উপর। মধুই এ-সব মাথায় ঢোকায়।
একদিন তো লখাই খেপেই গেল হীরালালের কথা শুনে। সে জিজ্ঞেস করল হাতুড়িটা দেখিয়ে, ওটা কী রে?
হীরালাল চোখ বড় বড় করে বলল, হাম্বল। অর্থাৎ হাম্বর।
লখাই এক ধমকে তাকে একেবারে কুঁকড়ে দিয়ে হাতুড়িটা ছুড়ে ফেলতে গিয়ে আবার থেমে গেল। বলল, গুয়োটা, হাতুড়ি বলতে পারিসনে? বলে হীরালালের পায়ের কাছে ফেলে দিল সেটা। হীরালালের কাছেও দুর্বোধ্য হয়ে উঠেছে লখাই।
মুরলীদাস মরেছে। লখাইয়ের দুঃখ দিনের সই সারদা যৌবনের শেষ সীমায় দাঁড়িয়েছে এসে, আখড়া আজ তারই সম্পত্তি। মাঝে মাঝে বলে, বৃন্দাবন যাওয়া যায় না—রেলে করে? তারপর লখাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি যদি যাও তো যাই।…লখাই নীরব, কোনও উত্তর নেই তার।