উজ্জ্বল উদ্ধার
দোলনের মনটা আজ সকাল থেকেই ভাল নেই। কোন দিনই বা আর ভাল থাকে? তবে আজ একটু বেশিই খারাপ। তার কারণ আজকের এই সাতই বৈশাখ দিনটাতেই এই নিষিদ্ধ পল্লিতে তার স্থান হয়েছিল।
যেদিন থেকে এখানে তার স্থান হয়েছে, সেদিন থেকেই তার মন খারাপের শুরু।
প্রথম প্রথম খারাপ লাগত এখানকার পরিবেশ।
মেয়েদের মুখে অশ্লীল ভাষার যথেচ্ছ ব্যবহার। তারপর তো ছিলই খরিদ্দারদের বিকৃত রুচির যৌন আকুতি, যা তাকে মনে মনে ভীষণ কষ্ট দিত।
দোলনের মনে হত, আজও লোকগুলির মন থেকে পশুত্ব একটুও দূর হয়নি, যতই সে মানুষের মতো দেখতে হোক না কেন।
সতীত্ব নষ্ট হয়েছে বলে, তার জন্য বিশেষ কোন আপসোস ছিল না তার। কারণ সতীত্ব শব্দটা তার কাছে অর্থহীন বুজরুকি মনে হত। নির্ভেজাল সতীত্ব কোথায় আছে? একবার খুঁজে দেখুন তো সমাজে। একজন কেউ শারিরীক ভাবে ধর্ষিত হলে কি শুধু তার সতীত্ব নষ্ট হয়? আর মনের উপর যদি কখনও ধর্ষণ ঘটে, তবে কি তাতে তার সতীত্ব নষ্ট হয় না?
দোলনের বারো বছর বয়স যখন, সে ক্লাস সিক্সে পড়ে। মাঝে মাঝে তখন মা তাকে পাড়ার সুধীর কাকুর দোকানে, মুড়ি বিস্কুট কিংবা একটা মাদার ডেয়ারি দুধের প্যাকেট কিনে আনতে পাঠাত। সুধীর কাকু দোলনকে একটু দাঁড়াতে বলে, একে একে সকল খরিদ্দারদের জিনিষ দিয়ে, দোকানটা ফাঁকা হলে, দোলনকে দোকানের ভিতরে ডেকে নিত এই বলে, দ্যাখ তো দোকানের ভিতরে ট্রে-তে মাদার ডেয়ারি দুধ আছে কিনা?
দোলন সোজা সরল মনে দোকানের ভিতরে ঢুকলে, সুধীর কাকু একটা বিড়ি ধরিয়ে তার কাছে উঠে আসত। তারপর তার ছোট ছোট বুক দুটো জোরে জোরে টিপত। দোলনের ব্যথা লাগত। দোলন বলত, ছাড় কাকু, আমার ব্যথা লাগছে।
- শুধু কি ব্যথাই লাগছে ? ভাল লাগছে না একটুও? দোলন তার কথার কোন উত্তর দিতে পারত না। নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করত তার হাত থেকে। ভাল লাগত কিনা সে জানে না। তবে তার সারা শরীর কেমন শিরশির করে উঠত সে সময়। সুধীর কাকু তার হাতে, বয়েম থেকে বের করে একটা সন্দেশ বিস্কুট দিয়ে বলতেন, নে খা। দোলন বলত, না, আমি খাব না। তুমি আমার জিনিষগুলি দাও, আমি বাড়ি চলে যাই।
- আরে খা, খা। তোর জিনিষ তো আমি দেবই।
দোলন লজ্জায় সেসব কথা কাউকে বলতে পারেনি। এইসব তিক্ত অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়েই দোলনের শৈশব কেটেছে।
তারপর, যখন সে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে, তখন বাবা তাকে পড়ার জন্য একটা কোচিং সেন্টারে ভর্তি করে দিল, যাতে মাধ্যমিক পরীক্ষায় তার রেজাল্ট ভাল হয়।
সেখানে পড়তে গিয়ে ইংলিশ স্যার
দীপক বসুর সঙ্গে যৌবন-মোহে সে অন্তরঙ্গ হয়ে পড়ে। পরীক্ষার পর কোচিং ছেড়ে দিলেও তার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় থেকে যায় তার। দোলন গোপনে তার সঙ্গে ঢাকুরিয়া লেকে দেখা করত। দীপকদা, তখন দু’টো এগরোল কিনে নিয়ে পার্কে ঢুকত। তারপর এগরোল খাওয়া শেষ হলে, একটা সিগ্রেট ধরিয়ে নিয়ে, দোলনকে আদর করার নামে কাছে টেনে নিয়ে চুমু খেত। বুকে হাত দিত।
দোলনের তখন এসব খুব একটা খারাপ লাগত না। বরং মনে মনে একটা রোমাঞ্চ ভাব জাগত। কারণ, মেয়েদের মন আসে আগে, তারপর হরমোনের নিঃসরণের ব্যাপার আসে। দীপকদার আদরে সে উত্তেজনা বোধ করত মনে মনে। কিন্ত তা লজ্জায় তার কাছেও প্রকাশ করতে পারত না।
এইভাবে কয়েক মাস গোপন মেলামেশার পর, দীপক স্যার তার যৌন চাহিদা মিটে যাবার পর, সে ধীরে ধীরে দোলনকে উপেক্ষা করতে শুরু করল। এইভাবে তাদের সম্পর্কটা ভেঙে গেল অচিরেই। দোলন সব সহ্য করতে পারে, কিন্তু তার ভালবাসার অবমাননা সহ্য করতে পারে না।
পরে দোলন খবর নিয়ে জেনেছে, দীপক স্যারের স্বভাব চরিত্র ভাল ছিল না। দোলনের আগে অনিতা সেন নামে একজন ছাত্রীর সঙ্গে কিছুদিন মেলামেশা করেছিল। তারপর তাকে ছেড়ে দোলনের সঙ্গে মিশেছে। দোলনকে ছেড়ে এবার আবার কারও সঙ্গে নতুন সম্পর্ক তৈরি করবে, তাতে আর আশ্চর্য কী?
দোলন এরপর থেকে তাই আর কোন ছেলেকে বিশ্বাস করতে পারে না। তার বিশ্বাস ভেঙে গেছে ছেলেদের উপর থেকে। সে
এখন সব ছেলেদেরই ঘৃণা করতে শুরু করেছে।
দোলনের বাবা বিমলবাবু গড়িয়ায় একটা কাপড়ের দোকানে কাজ করত। সেখানে, ডায়মন্ড কোম্পানী থেকে একজন লোক আসত, দেখতে শুনতে, আদব-কায়দায় বেশ ভাল। দোকানে হোসিয়ারি গুডস মানে গেঞ্জি, জাঙিয়া, মেয়েদের প্যান্টি ব্রেসিয়ার সাপ্লাই করতে। তার নাম ছিল সনাতন বিশ্বাস। সে একদিন কথায় কথায় বিমলবাবুকে জানিয়ে ছিল, তার মা তাকে বিয়ের জন্য খুব চাপ দিচ্ছে। বিমলবাবুর যদি জানা শোনা কোন ভাল মেয়ে থাকে, তবে তাকে খবর দিতে। কথাটা সহজ সরল বিশ্বাসী মানুষ বিমলবাবু তো শুনে হাতে চাঁদ পেলেন। তাকে বললেন, তার নিজেরই বিয়ের যোগ্য একটি মেয়ে আছে। খুব গুণময়ী, সংসারী মেয়ে, দেখতে শুনতেও মন্দ নয়। যদি সনাতনবাবু কৃপা করে তার মেয়েকে একবার দেখতে যান তাদের বাড়িতে, তবে তিনি তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবেন।
দোলনকে দেখার জন্য দিনক্ষণ ঠিক হল হালখাতার পরের দিন, দোসরা বৈশাখ।
বাড়িতে একটা আনন্দের পরিবেশ তৈরি হল।
সেদিন সনাতনবাবু একাই মেয়ে দেখতে এলেন। দোলনকে দেখে তার পছন্দ হল। পরে বিয়ের দিনক্ষণ জানাবেন বলে, সেদিনকার মতো চলে গেলেন। বাবা তো খবরটা শুনে খুব খুশি। মা তাকে বললেন, তুমি একবার ছেলেটার বাড়ি-ঘরের খোঁজ খবর নাও। বিয়ের কথা পাকা করার আগে। মার কথার কোন গুরুত্বই দিলেন না বাবা। ছেলের কোন চাহিদা নেই জেনে, কোন খোঁজ খবর না নিয়েই বিয়ের কথা পাকা করে ফেললেন সনাতনবাবু সঙ্গে।
মা তবুও তখন বাধ্য হয়ে সনাতন বিশ্বাসকে বললেন, বাছা তোমার বাড়ি-ঘর কোথায়? সংসারে আর কে কে আছে তোমার? লোকটি নির্লিপ্ত ভাবে উত্তর দিলেন, আমার আপন বলতে তেমন কেউ নেই। আছেন দূর সম্পর্কের এক খুড়তুতো ভাই আর তার বউ ছেলে। বাড়ি আমার জলপাইগুড়ি। এখানে বৌবাজারে আমি একটি মেসে থাকি আমি। মেয়েকে এখান থেকে নিয়ে গিয়ে, জলপাইগুড়িতে আমার নিজের বাড়িতে বিয়ে হবে। সেখানে আপনারা কেউ যেতে চাইলে যেতে পারেন।
বাবা শুনে বললেন, না না তার আর দরকার কি? তোমাকে কি আমি চিনি না? আমাদের দোকানে কতদিন ধরে হোসিয়ারি জিনিষ সাপ্লাই করছ। মা তবুও প্রবল আপত্তি করে বলেছিল, না না, তা কি করে হবে? বিয়েতে মেয়ের বাড়ির কেউ উপস্থিত থাকবে না। তা কি করে হয়?
সনাতন বিশ্বাস তা শুনে হালকাভাবে মাকে বলল, তাহলে আপনারা কেউ উপস্থিত থাকতে চাইলে যাবেন। মেয়েকে নিয়ে আমি কাল জলপাইগুড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হব। আপনারা যেতে চাইলে বলুন, তাহলে আমি একসঙ্গে আপনাদেরও টিকিট কেটে নেব।
বাবা শুনে বললেন, না না, তার আর দরকার নেই কোনও। তোমরা দু’জনে তবে কালই রওনা হয়ে চলে যাও। ‘শুভস্য শিঘ্রম, আশুভাষ্য কালহরনম।’ দেরি করে আর লাভ কি বল? মার কোনও আপত্তিতেই বাবা তোমন কোনও গুরুত্ব দিলেন না। পাছে বিয়েটা ভেঙে যায় দোলনের সঙ্গে।
পরদিনই দোলনকে নিয়ে সনাতনবাবু তার মা বাবাকে বিদায় জানিয়ে শিলিগুড়িগামী বাসে চড়ে বসল ধর্মতলা বাস স্ট্যান্ড থেকে।
লোকটা শিলিগুড়িতে বাস থেকে নেমে একটা হোটেলে এসে উঠল। দোলন তা দেখে অবাক হয়ে বলল, আপনার বাড়িতে যাবেন না?
- হ্যাঁ, যাব। বাড়িতে খবর দেওয়া আছে, ওরা বিয়ের সব আয়োজন করে, আমাদের এই হোটেলে এসে, আমাদের এখান থেকে বাড়িতে নিয়ে যাবে। হয়তো তার জন্য আমাদের এখানে দু’দিন থাকতে হতে পারে।
দোলন তার কথা বিশ্বাস করে, তাকে আর কিছু বলল না।
সেদিনই রাতে লোকটা তাকে ভোগ করার জন্য জোর করল। দোলন আপত্তি করে বলল, আজ এসব থাক, আর দু’দিন পরেই তো আমাদের বিয়ে হবে, বিয়ের পরই এসব হবে। লোকটি তার কোন আপত্তি শুনল না। তাকে জোর করে ভোগ করল সেই রাত্রেই।
পরদিন সকালে দোলনকে একটু আসছি বলে লোকটি কোথায় বেরিয়ে গেল। দুপুরের মধ্যেই ফিরে এল আবার। এসে একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া করে। বিছানায় শুয়ে দ্বিতীয় বার দোলনকে সম্ভোগ করল।
দোলন এবার আর তেমন কোন জোর আপত্তি করল না। ভাবল আজ বাদে কাল তো বিয়ে হবেই, দু’একদিন আগে আর পরে, এসব কাজ করলে, আর মহাভারত কী অশুদ্ধ হবে?
পরদিন সকালে একজন লোক এল, তাদের বাড়িতে নিয়ে যাবার জন্য। সনাতন বিশ্বাস তাকে তার খুড়তুতো ভাই বলে পরিচয় দিল দোলনকে। তারপর একটা ভাড়া করা ছোট জিপ গাড়িতে দোলনকে তুলে দিয়ে বলল, তুমি ওর সঙ্গে বাড়ি যাও, আমি বিয়ের টোপর আর কিছু আচার অনুষ্ঠানের জিনিষ কিনে নিয়ে একটু পরেই বাড়ি আসছি। দোলন আপত্তি করে বলল, না না আমি একা যাব না। আপনি সব জিনিষ কিনে নিন, আমরা একসঙ্গে যাব। লোকটির তখন তার খুড়তুতো ভাইয়ের সামনেই তাকে আদর করে, চুমু খেয়ে বলল, দূর বোকা মেয়ে, আমি তো কিছুক্ষণের মধ্যেই কেনাকাটা করে বাড়িতে ফিরছি। তুমি নিশ্চিন্তে ওর সঙ্গে বাড়ি চলে যাও। এ কথা বলে, দোলনকে লোকটার সঙ্গে গাড়িতে তুলে দিল।
লোকটি তাকে নিয়ে কোচবিহার জেলার চ্যাড়াবান্দা বর্ডার এলাকার একটা নিষিদ্ধ পল্লিতে এনে তুলল। তারপর থেকে এখানেই তার স্থায়ী বসতি হল। দিনটি ছিল সাতই বৈশাখ, মানে আজকের দিন।
বাবার সেই অবিবেচক সিদ্ধান্তের মাশুল এখন গুনতে হচ্ছে দোলনকে।
এই একবছরে কত লোকের যে শয্যাসঙ্গিনী হতে হয়েছে তাকে তার হিসেব নেই।
মাস ছয়েক ধরে দত্তবাবু বলে একজন লোক তার কাছে আসেন। দোলন শুনেছে লোকটির বউ ছেলে আছে। একটি সুন্দর সাজানো সংসার আছে তার। তবু কেন যে মাঝে মাঝে দোলনের কাছে আসে? দোলন তা বুঝতে পারে না। একদিন দত্তবাবুর কাছে দোলন জানতে চেয়েছিল, আপনার বাড়িতে বউ ছেলে থাকতেও আপনি কেন এখানে আসেন? সেদিন দত্তবাবুকে সে কথা জিজ্ঞাসা করলেও তার কোন সদুত্তর পায়নি দোলন।
লোকটি একসময় পুলিশ কোর্টের মুহুরী ছিলেন। এখন রিটায়ার করেছেন। লোকটা তার কাছে সপ্তাহে দু-একদিন আসেন। যখন আসেন সঙ্গে নিজের জন্য একটা হুইস্কির পাইট, আর দোলনের জন্য সিঙাড়া কিংবা তেলেভাজা নিয়ে আসেন। হুইস্কিতে চুমুক দিতে দিতে দোলনের সঙ্গে টুকটাক গল্প করেন। তারপর মদ্যপান শেষ হয়ে গেলে, দোলনকে তার প্রাপ্য টাকা বুঝিয়ে দিয়ে চলে যান। কোনদিন তিনি অন্যদের মতো শারিরীক সম্পর্কে লিপ্ত হননি দোলনের সঙ্গে। লোকটাকে দোলনের অন্য রকম মানুষ বলে মনে হত। একদিন কথায় কথায় দত্তবাবু দোলনের কাছে জানতে চান, দোলন কিভাবে এখানে এসেছে?
দোলন আপন ভেবে তাকে সব ঘটনা খুলে বলল। তিনি সব শুনে বললেন, মাই গড ! তোমার মা-বাবা তাহলে, এসবের কিছুই জানেন না?
- আমি জানি না। তাদের কোনও খোঁজ খবর আমি আর পাইনি।
- আচ্ছা আমি দেখছি। বলে দত্তবাবু সেদিনকার মতো দোলনের পাওনা মিটিয়ে দিয়ে চলে যান।
পরদিনই আবার দত্তবাবু আসেন, নিজের জন্য হুইস্কির পাইট আর দোলনের জন্য কচুরি কিনে নিয়ে। সেদিন তার সঙ্গে দোলনের গোপন শলা-পরামর্শ হয়। পরদিন ভোরে এক কাপড়ে এখান থেকে বেরিয়ে তিনি দোলনকে বড় রাস্তার মোড়ে গিয়ে দাঁড়াবার কথা বলেন। তারপর যা করার তিনি করবেন বলে, সেদিনের মতো মদ্যপান সেরে, দোলনের পাওনা মিটিয়ে দিয়ে চলে যান।
মাসির নজর থাকে সারাদিন সকলের উপর। কেউ তাকে না কেউ বলে বাইরে বের হতে পারে না। আর বাইরে বের হতে হলে তাকে যথার্থ কারণ জানাতে হয়। কারণ যথার্থ মনে হলে মাসি তার সঙ্গে লোক দিয়ে, তাকে বাইরে যেতে অনুমতি দেয়। অন্যথায় তার চোখ এড়িয়ে কারও বাইরে বের হবার কোনও উপায় থাকে না। কিন্তু ভোর বেলা একটু ঢিলেঢালা ভাব থাকে। তখন সকলেই ঘুমিয়ে থাকে। মাসিও নিশ্চিন্তে ঘুমায়।
সেটাই একমাত্র উপযুক্ত সময়, এখান থেকে বাইরে বের হবার।
পরদিন ভোরবেলা উঠে, দোলন এক কাপড়ে বাইরে বেরিয়ে এসে দত্ত বাবুর কথা মতো, বড় রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়ায়। তখনও রাস্তায় তেমন লোকজনের চলাচল শুরু হয়নি। গাছে গাছে পাখি ডাকছে। কী মিষ্টি আমেজ ভোরবেলার। কতদিন এসব দৃশ্য দেখা হয না দোলনের। দোলন বুক ভরে শ্বাস নিল। বড় রাস্তা শুনশান ফাঁকা। একটু পরেই দত্ত বাবু একটা জিপ গাড়ি নিয়ে এসে হাজির হলেন, দোলনকে তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে বসতে বললেন। দোলন গাড়িতে উঠে পড়তেই, আর দেরী না করে, গাড়িটি আবার ফাঁকা রাস্তা ধরে ছুটতে শুরু করল।
অনেকক্ষণ পর তারা শিলিগুড়ি এসে পৌঁছাল। তারপর একটা কলকাতাগামী বাসে তারা টিকিট কেটে নিয়ে, গিয়ে উঠে বসল। কিছুক্ষণ পর যাত্রীতে ভরে গেলে, বাসটা হুইসেল বাজিয়ে ছেড়ে দিল।
এতক্ষণে যেন দোলনের বুক থেকে একটা মুক্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে এল।
ধর্মতলা এসে, বাস থেকে নামতে নামতে দুপুর গড়িয়ে গেল। বেশ খিদে পেয়েছে দেখে বাস থেকে নেমে, ওরা একটা ফুটপথের খাবারের দোকানে বসে, ভাত ডাল তরকারি খেয়ে নিল। তারপর দত্তবাবু গড়িয়াগামী ৮০-এ বসে উঠে তাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিল।
বাড়ি পৌঁছে দোলন জানতে পারল, বাবা অনেকদিন আগেই মারা গেছেন। পরে নিজের ভুল বুঝতে পেরে, অনুতাপে, অনুশোচনায় বিমলবাবু শোকে দুঃখে জ্বলে পুড়তে পুড়তে একদিন সেরিব্রাল অ্যাটাক হয়ে নাক মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে রাস্তায় পড়ে মারা যান।
সনাতন বিশ্বাসের সঙ্গে দোলন চলে যাবার তিনদিন পর, সনাতন বিশ্বাস যে ফোন নম্বর দিয়ে গেছিল, বিমলবাবু দোলনের খবর জানার জন্য সেই নম্বরে ফোন করলে, সেখান থেকে উত্তর আসে, ‘নম্বরটি পরীক্ষা করুন, নম্বরটি বৈধ নয়’ (Check the number, the number is not valid). শুনে বিমলবাবু মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েন। তা দেখে দোলনের মা তার কাছে জানতে চাইল, কি হল?
বিমল বাবু বলে উঠলেন, ‘নম্বরটি বৈধ নয়’ বলছে। আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে বোধহয় রমা।
মা তখন ঝাঁজিয়ে উঠে তাকে বলল, কেন, আমি তো তোমায় বারবার ভাল করে খোঁজ খবর নিয়ে বিয়েতে মত দিতে বলেছিলাম। তুমি তো তখন আমার কোন কথাই গ্রাহ্য করনি। এবার কি করবে?
- কি করব, বল তো? বিমল বাবু অসহায়ের মতো জিজ্ঞেস করলেন রমার কাছে।
- যাও, এক্ষুনি থানায় গিয়ে, সব কথা জানিয়ে রিপোর্ট করে এস। সঙ্গে দোলনের একটা ছবি নিয়ে যাও।
বিমল বাবু তাই করলেন, থানায় গিয়ে দোলনের ছবি জমা দিয়ে ডাইরি লিখিয়ে এলেন।
থানাার বড়বাবু সব শুনে বললেন, এভাবে কোন খোঁজ খবর না নিয়ে, বিয়ের ব্যাপারে আজকাল কেউ এগোয়? যা ঘটছে চারিদিকে।
বিমলবাবু হাউ-মাউ করে কেঁদে তার পায়ে পড়ে বললেন, যে ভাবেই হোক আমার মেয়েকে খুঁজে এনে দিন বড়বাবু।
বড়বাবু তাকে উঠিয়ে দাঁড় করিয়ে, চেয়ারে বসিয়ে বললেন। আচ্ছা, আচ্ছা আমি দেখছি। লোকটির কি নাম? আর কোথায় যেন বাড়ি বললেন? - নাম – সনাতন বিশ্বাস। বাড়ি জলপাইগুড়ি।
- আচ্ছা, আমি খোঁজ খবর নিয়ে দেখছি, খবর পেলেই আপনাকে জানাব, আপনি এখন বাড়ি যান।
বিমলবাবু থানার বড়বাবুর কাছে আশ্বাস পেয়ে, বাড়ি ফিরে এলেন।
আবার তার সাতদিন পরে থানায় গিয়ে খবর নিয়ে জানলেন, এখনও তারা কোন খবর পায়নি। তবে খোঁজ চলছে। কোন সন্ধান পেলেই জানাবেন।
ব্যর্থ মন নিয়ে বিমলবাবু বাড়ি ফিরে এলেন।
এইভাবে তিন মাস বিমল বাবু থানায় খোঁজ নিতে গেছেন। আর ব্যর্থ মনে বাড়ি ফিরে এসেছেন।একদিন, থানা থেকে ফেরার সময়ই সেরিব্রাল আক্রমণ হয়ে, নাক মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে, রাস্তায় পড়ে গিয়ে বিমলবাবুর মৃত্যু ঘটে। বিমলবাবু তো তেমন কোনও বিখ্যাত কেউ-কেটা লোক নয় যে, তার মেয়ের খোঁজ করতে থানার ফোর্স সক্রিয় হয়ে জলপাইগুড়ি ছুটে যাবে।
দোলনের চলে যাওয়ায় পর মা এমনিতেই মনে মনে মর্মাহত হয়ে ছিলেন। ভিতরে ভিতরে ক্ষয়ে যাচ্ছিলেন। তারপর বাবার মৃত্যু সংবাদ শুনে, আর সহ্য করতে পারলেন না, ধীরে ধীরে পাগল হয়ে গেলেন। কাউকে চিনতে পারেন না। অসংলগ্ন কথা বার্তা বলেন। দোলনকে দেখে বলল, তুই কে রে? আমার দোলনকে দেখেছিস তুই?
এই কথা শুনে দোলন, মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে, কান্নায় ভেঙে পড়ল। তা দেখে দত্ত বাবুর চোখ দু’টিও জলে ভরে উঠল।
সংসারের এই হাল দেখে, দত্ত বাবু আরও কিছুদিন এখানে থেকে যাওয়ার ভাবলেন। দোলনকে সে কথা জানাতে, দোলন শুনে বলল, তা হলে তো খুবই ভাল হয়। কিন্তু আপনার বউ ছেলে কিছু ভাববে না?
যা এতদিন জানতে চেয়েও দোলন জানতে পারেনি, তা আজ দ্ত্তবাবু দোলনকে খুলে বললেন।
যাকে আমার বউ ছেলে সকলে জানে, তারা কেউই আমার বউ ছেলে নয়। আমি বিয়েই করিনি। যাকে আমার বউ ভাবে, সে ছিল আমার একমাত্র প্রেমিকা। সুমনার আপত্তি থাকা সত্বেও, তার মা বাবা তাকে জোর করে এক সরকারী চাকুরের সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়। আমি তখন বেকার। চাকরি পেয়েছি, সুমনার বিয়ের কয়েক বছর পরে।
বিয়ের পর, সুমনা ভাল আছে দেখে, নিজে তাকে হারাবার দুঃখ ভুলে, আমি মনে মনে বেশ খুশিই ছিলাম। নিজে আর বিয়ে করিনি। তাদের ছেলে হল। ছেলে বড় হল। ছেলে স্কুল পাশ করে কলেজে ভর্তি হল। সব খবরই রাখতাম তাদের।
একদিন খবর পেলাম, সুমনার বর অফিস থেকে ফেরার পথে, লড়ির ধাক্কায় রাস্তার ধারে ছিটকে পড়ে, অজ্ঞান হয়ে গেছিল। রাস্তার সকলে তাকে ধরাধরি করে একটা ট্যাক্সিতে তুলে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করে দেয়। কিন্তু তাকে বাঁচানো যায়নি। মাথায় লড়ির ধাক্কা লেগেছিল। ব্রেন হেমারেজ। দু’দিন পরেই হাসপাতালে মারা গেল সে। সুমনার এই বিপদের সময় আমি আর দূরে থাকতে পারিনি। তখন তারা একটা বাড়িতে ভাড়া থাকত। সেখান থেকে তাদের তুলে এনে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিই। শুধু এইটুকুই আমি তাদের জন্য করেছি। সুমনা তার বরের পেনশন পায়, তাতেই তাদের সংসারের খরচ চলে যায়।
দোলন সব শুনে দত্ত বাবুর দিকে অবাক চোখে তাকাল। যেন নতুন করে চিনল তাকে। মনে মনে ভাবল, এমন মানুষও হয় আজকের দিনে! তার বিস্ময়ের অন্ত ছিল না।
দত্তবাবু এখানে থেকে, দোলনের মাকে গোবরা মেন্টাল হসপিটালে ভর্তি করে দিলেন। সেখানে তার চিকিৎসা চলতে লাগল।
দোলনের অভিভাবক হয়ে তিনি এখানে বেশ কয়েক মাস থেকে গেলেন। দোলনকে কলেজে ভর্তি করে দিলেন। তাকে বললেন, ভাল করে লেখা-পড়া করে নিজের পায়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করো।
একদিন দোকানে একা দেখতে পেয়ে সুধীর সাহা দোলনকে বলল, লোকটা কে রে তোদের বাড়িতে থাকে?
- তাতে তোমার কি?
- না, এমনি জিজ্ঞাসা করছি।
দোলন ভাবল, কোন উত্তর না দিলে, সুধীর সাহাই দোকানে আসা লোক-জনের কাছে রটাবে দোলনের নামে বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে অপবাদ দিয়ে, নানা নোংরা কথা-বার্তা। যা অনেকের কাছে আচারের মতো সুস্বাদু রসালো মনে হবে। আর সে কথা মুখে মুখে পাড়াময় রটে যাবে। তাই দোলন বলল, উনি আমার কাকা হন। বাবার পিসতুতো ভাই। - আগে তো দেখিনি কোনদিন
- আগে দেখবে কি করে? উনি তো জলপাইগুড়ি থাকেন।
- ওহ্, তোর যেখানে বিয়ে হয়েছে? কথাটা শুনে দোলনের ভিতরটা জ্বলে উঠল। তবুও সে নিজেকে শান্ত সংযত রেখে, সহজ সাবলীলভাবে উত্তর দিল, হ্যাঁ।
- তোর বর কেমন আছে?
- তাতে তোমার কি দরকার?
- না, মানে এমনিই জানতে চাইলাম।
- তার সাথে বনি বনা না হওয়ায়, তার সঙ্গে আমার ডিভোর্স হয়ে গেছে। তাকে ডিভোর্স দিয়ে, আমি কাকার সঙ্গে এখানে চলে এসেছি।
- ওহ্,আচ্ছা। তাই বুঝি?
- হ্যাঁ। আর কিছু জানার আছে?
- না, না।
দোলন নিজের মনে মনে গজগজ করতে করতে দোকান ছেড়ে বেরিয়ে এল। মুখে বলল, শালা আপদ একটা, যমের অরুচি, কত লোক মরে আর এ আপদটা মরতে পারে না।