Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

একদিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে

একদিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই সরযূদেবী দেখলেন, তাঁর গলায় সাত ভরি ওজনের মটরদানা হারটা নেই। নেই তো নেই-ই। সারাবাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজেও সেটা পাওয়া গেল না। সরযূদেবীর তো মাথায় হাত। ঠিকেকাজের লোক সাবি কাজ করতে এসে হঠাৎ হাউমাউ করে বলে উঠল, “ও মা! তোমার হাতের বালাজোড়া কোথায়? সেও কি চোরের বাপের শ্রাদ্ধে গেল?”

সরযূদেবী চমকে উঠে অবাক হয়ে খেয়াল করলেন, সত্যিই তো? বালাজোড়াও তো নেই। তিনি কুঁকড়ে কেঁদে উঠে বললেন, “ওরে, দানুকে শিগগির ডাক। দানুই তো রাতে পাহারা দেয়!”

কিন্তু দানুকে কোথাও পাওয়া গেল না। নীচের বারান্দায় তার চটের বিছানা একপাশে পরিপাটি গুছিয়ে রাখা। সে কোথাও নেই। নেই তো নেই-ই। একেবারে ভো ভা।

সুতরাং দুইয়ে-দুইয়ে চার করতে কারও দেরি হল না। খবর পেয়ে গায়ের লোক ভেঙে পড়ল সরযূদেবীর বাড়িতে।

জয়লাল বলল,”আমি আগেই জানতাম এরকম হবেই।”

তারক তর্কালঙ্কার খিঁচিয়ে উঠে বলল, “কী জানতে শুনি?”

“ওহে, কোনও জিনিসেরই বাড়াবাড়ি ভাল নয়। বেশি করিতকর্মা লোক দেখলেই বুঝতে পারি মতলব খারাপ। এই যে দানু দু’ দিনে তিরিশ-চল্লিশটা গাছের নারকোল পাড়ল, একদিনে অত বড় পুকুরের পানা পরিষ্কার করল, ফুটবল খেলতে নেমে গন্ডায়-গন্ডায় গোল করল, এসব কি ভাল? এ হল কোপ দেওয়ার আগে ঘাড়ে তেল মালিশ করা।”

তারক বলল, “ওহে, বিজ্ঞান প্রমাণ ছাড়া কোনও সত্যকে গ্রহণ করে না। অপরাধবিজ্ঞানও কিন্তু একটা বিজ্ঞান। প্রমাণ কই?”

হারানবাবু এসে উত্তেজিতভাবে বললেন, “আমার বাড়িতেও কাল চোর ঢুকেছিল।”

খগেন তপাদার বললেন, “কী করে বুঝলেন?”

“আমার পাঁচ ব্যাটারির টর্চটা আমার বালিশের পাশেই থাকে। সকালে উঠে দেখি সেটা চুরি হয়ে গিয়েছে। তারপর ধরো, চ্যবনপ্রাশের কৌটোটা গায়েব, অ্যালার্মক্লকটা হাওয়া, একখানা গেঞ্জি পাওয়া যাচ্ছে না…”

হারানবাবুর মেয়ে খেদি পাশ থেকে বলল, “ও বাবা, টর্চটা তো কাল জামাইবাবুকে দিলে? চ্যবনপ্রাশের কৌটো খালি হয়ে গিয়েছে বলে মা তাতে পাঁচফোড়ন রেখেছে। অ্যালার্মক্লকটা তো সারাতে দেওয়া হয়েছে, আর গেঞ্জি আজ সকালে কেচে দেওয়া হয়েছে।”

“অ, তা হবে?” খগেন তপাদার বললেন, “গা থেকে গয়না খুলে নেওয়া সহজ কাজ নয়। নিশ্চয়ই ঘুমের ওষুধ স্প্রে করা হয়েছিল।”

জয়লাল বলল, “আহা, খাওয়াতেও তো পারে। জলের সঙ্গে গুলে দিলেই হল!”

তারক বলল, “জল কেন, দুধ কী দোষ করল?”

দানু যে একাজ করতে পারে তা অবশ্য অনেকের বিশ্বাস হল। কিন্তু সবচেয়ে মন খারাপ হয়ে গেল প্রাণারামের। বলতে কী, সে-ই তো দানুকে পিসির বাড়িতে বহাল করেছিল!”

ভূপেনদারোগা তদন্তে এসে সব দেখেশুনে গম্ভীরভাবে বললেন, “ফুটবল খেলোয়াড় চোর হয় জীবনে এই প্রথম দেখলাম মশাই। বেঁচে থাকলে আরও কত দেখতে হবে!”

দ্বিজেন সামন্ত তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে বিগলিত মুখে বলল, “যেমন-তেমন খেলোয়াড় নয় ভূপেনবাবু, হবিবপুরকে পাঁচ গোল দিয়েছিল একাই।”

ভূপেনদারোগা মাছি তাড়ানোর মতো হাত নেড়ে বললেন, “ফুঃ, পাঁচ গোল! তার মধ্যে দু’টো তো পরিষ্কার অফসাইড। রেফারি হবিবপুরকে একটা ন্যায্য পেনাল্টি দেয়নি।”

কালীপদবাবু একটু উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে বললেন, “না না, এটা কী বলছেন দারোগাবাবু? সেদিন তো আমরাই তিন তিনটে ন্যায্য পেনাল্টি পাইনি। তিনবারই দানুকে পেনাল্টি বক্সে ল্যাং মেরে ফেলে দেওয়া হয়েছে।”

ভূপেন অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে বললেন, “আমাকে বাধ্য হয়েই প্রতিবাদ করতে হচ্ছে। ফুটবলে ল্যাঙাল্যাঙি হয়েই থাকে, নতুন কিছু নয়। ওরকম আনাড়ি প্লেয়ার জন্মে দেখিনি। যত না খেলে, তার চেয়ে বেশি আছাড় খায়। আর গোলগুলো তো ফঁকতালে হয়ে গিয়েছে। একটাও ক্রিয়েটেড গোল নয়, চান্স গোল।”

এবার হারানবাবু বেশ গরম হয়েই বললেন, “কাকে আনাড়ি বলছেন ভূপেনবাবু? ওকে যে লোকে ‘পায়েসপুরের মারাদোনা’ বলে ডাকে?”

তেমনই তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে ভূপেনদারোগা বলে উঠলেন,

“রেখে দিন মশাই মারাদোনা! মারাদোনা গাছে ফলে কিনা! ড্রিবলিং নেই, পাসিং নেই, বল প্লে নেই, মারাদোনা বললেই হল? এমনকী, মারাদোনার হাইটটা পর্যন্ত নেই! তালগাছের মতো ঢ্যাঙা একটা ছেলে ল্যাঙপ্যাঙ করে দৌড়চ্ছে, যেন অ্যানিমেটেড কাটুন। দুর দুর, যে যাই বলুক, আপনাদের পায়েসপুরের মারাদোনা জাতের খেলোয়াড়ই নয়।”

মদনপাগলা ভিড় দেখে পিছনে এসে দাঁড়িয়ে সব শুনছিল। এবার বলে উঠল, “ওরে, ভূপেনের শ্বশুরবাড়ি যে হবিবপুরে?”

একটা সেপাই কাক করে তাড়াতাড়ি মদনপাগলার ঘাড় ধরে তাকে বাইরে নিয়ে গেল।

ভূপেনবাবু বললেন, “পরের ম্যাচে দেখবেন, হবিবপুরের কাছে পায়েসপুর উড়ে যাবে। সেদিন রথীন হাজরা খেলেনি, তাই। আর আপনাদের দানুও তো শুনছি পালিয়েছে। তা পালাবে না, প্রতি ম্যাচেই তো আর বরাতজোরে গোল করা যাবে না? হেঁ-হেঁ বাবা, ফুটবল অত সোজা জিনিস নয়।”

এবার দেশপ্রেমিক তথা পায়েসপুরমুগ্ধ হারাধনবাবু এগিয়ে এসে বুক ফুলিয়ে বললেন, “পায়েসপুরের গৌরব দানুকে আমরা ফিরিয়ে আনবই।”

ভূপেনদারোগা ব্যঙ্গ গলায় বললেন, “আর হাসাবেন না মশাই, দানু তো শুনি পায়েসপুরের ছেলেই নয়। তার বাড়ি তো প্রতাপগড়ে?”

হারাধনবাবু একটু মিইয়ে গিয়ে বললেন, “না না, তা কী করে হবে?”

ভূপেনবাবু চোখ রাঙিয়ে বললেন, “হবিবপুরের লোকেরা এর জন্য আপনাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারে তা জানেন? তার উপর সে একজন চোর এবং অপরাধী। একজন অপরাধীকে লুকিয়ে রেখে এবং আশ্রয় দিয়ে আপনারা প্রশাসনকে প্রতারণা করেছেন বলেও আপনাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। আমি হুলিয়া দিয়ে দিচ্ছি। আগামী চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে দানুকে ধরে হাজতে পোরা হবে। নেক্সট ম্যাচ পর্যন্ত যাতে সে জামিন না পায় আমি তারও ব্যবস্থা করব।”

হারাধনবাবু অত্যন্ত ব্যথিত সুরে বললেন, “সেটা কি পায়েসপুরের প্রতি অত্যন্ত অবিচার হবে না? পায়েসপুরের ঐতিহ্যের কথা একবার ভেবে দেখুন!”

ভূপেনবাবু তেরিয়া হয়ে বললেন, “পায়েসপুরের আবার ঐতিহ্য কীসের মশাই? এ তো অখদ্দে জায়গা। চোর-গুন্ডা বদমাশ গিজগিজ করছে। পায়েসপুরের কুমড়ো নাকি ভূবনবিখ্যাত। তা সেদিন কে যেন একটা পায়েসপুরের কুমড়ো নিয়ে এসেছিল। খেয়ে দেখি, একেবারে জোলো আর পানসে। সেই কুমড়ো শেষে গোরুকে খাওয়ানো হয়েছিল। পায়েসপুরের গামছার কথা আর বলবেন না মশাই, জলে দিলেই গলগল করে রং উঠে যায়। অথচ সেই গামছা নিয়ে নাকি কবিতা লেখা হয়েছে। আপনিই না বুক ফুলিয়ে বলেছিলেন, আপনাদের বিজ্ঞানী হলধর ঘোষ একদিন নোবেল প্রাইজ পাবেন? তা তার ‘ইন্ধনহীন রন্ধন’-এর উনুনে তো আজ অবধি জলও গরম হল না! আপনাদের ব্যায়ামবীর বটেশ্বর তো আরশোলা দেখলে ভয়ে মূৰ্ছা যায়। আর কত শুনবেন?”

কথাটা শুনে ভিড়ের পিছনে হলধর ঘোষ টুপ করে তার মাথাটা নামিয়ে নিলেন।

ভূপেনবাবু সদম্ভে বুটের শব্দ তুলে বিদায় নিলেন। প্রাণারামের মন ভারী খারাপ! বলতে কী, সে-ই দানুকে পিসিমার বাড়িতে বহাল করেছিল। পিসিমা আজ সকালেই তাকে বলেছেন, “ওরে পান্টু, শেষে তুই আমার এত বড় সর্বনাশ করলি?” শুনে পান্টু ওরফে প্রাণারামের লজ্জায় মাটিতে মিশে যাওয়ার কথা। দানুকে সারাদিন তারা সম্ভব-অসম্ভব সব জায়গায় খুঁজেছে। কোথাও পাওয়া যায়নি। প্রতাপগড়েও খোঁজ নিতে লোক গিয়েছিল। তারা এসে বলেছে, ও নামে প্রতাপগড়ে কেউ কখনও ছিল না। এমনকী, ওরকম চেহারারও কেউ নেই। দানু যে চোর এটা বিশ্বাস করতে প্রাণারামের মন চাইছে না। কিন্তু সাক্ষ্যপ্রমাণ দানুর বিপক্ষেই যাচ্ছে।

দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর মলিন মুখ করে জানালার পাশে চেয়ারে বসে ঘটনার বিশ্লেষণ করতে-করতে পান্টু মাথা নেড়ে অস্ফুট গলায় বলে ফেলল, “নাঃ, দানুকে চাই।”

প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই জানালার বাইরে দানুর গলা শোনা গেল, “আমাকে খুঁজছ?”

স্তম্ভিত প্রাণারাম কিছুক্ষণ হাঁ করে অবিশ্বাসের চোখে চেয়ে থেকে বলল, “তুই! তুই কোথায় ছিলি হতভাগা? তোর নামে যে হুলিয়া বেরিয়েছে?”

“কেন?”

“সবাই বলছে তুই নাকি পিসিমার গয়না চুরি করে পালিয়েছিস?”

“গয়না চুরি যাবে কেন?”

“তা হলে গয়নাগুলো গেল কোথায়?” গলার ঘামাচি চুলকোচ্ছিল বলে পিসিমা নিজেই হারটা খুলে ঘুমচোখে বালিশের নীচে রেখেছিলেন। রাখতে গিয়ে সেটা ওয়াড়ের মধ্যে ঢুকে যায়। সেখানেই আছে।”

“আর বালা?”

“পিসিমার বড্ড ভুলো মন। কাল পোস্ত বাটতে গিয়ে বালা খুলে তেজপাতার কৌটোর পিছনে রেখেছিলেন, তারপর ভুলে গিয়েছেন।”

“তা হলে তুই পালালি কেন?”

“না পালিয়ে উপায় নেই। আমাকে একজন ধরতে এসেছে!”

“তোকে ধরতে এসেছে? তোকে ধরবে কেন?”

“সব কথা বলা যাবে না। আমার খুব বিপদ। তবে খুব যদি দরকার হয় তা হলে আমাকে ডেকো, ডাকলেই আসব।”

“আমার ডাক তুই শুনতে পাবি কী করে?”

দানু বড়-বড় দাঁত দেখিয়ে হেসে বলল, “তোমার ডাক আমি ঠিক শুনতে পাই। তবে এ কথাটা কাউকে বোলো না।”

“তোর কীসের বিপদ আমাকে বলবি না? আমরা তো তোর বিপদে সাহায্য করতে পারি!”

“পরে তোমাকে সব বলব। এখন যাই?”

“যা!”

দানু চোখের পলকে হাওয়া হয়ে গেল। কিন্তু তার কথামতো বালিশের ওয়াড়ের ভিতরে আর তেজপাতার কৌটোর পিছনে সরযূদেবীর হারানো গয়না পাওয়া গেল। ফের পায়েসপুরের মাতব্বররা জড়ো হয়ে এই ব্যাপারটা নিয়ে তুমুল আলোচনা করলেন।

ভূপেনদারোগাকে যখন ঘটনাটা জানানো হল, তখন উনি ভ্রু তুলে বললেন, “তাই নাকি? তা হলে কী সাব্যস্ত হল?”

হারাধনবাবু এগিয়ে এসে বুক চিতিয়ে বললেন, “তাতে এই সাব্যস্ত হল যে, দানু মোটেই চুরি করেনি এবং নেক্সট ম্যাচে হবিবপুরের বিরুদ্ধে খেলবে।”

ভূপেনবাবু মাথা নেড়ে বললেন, “না, খেলবে না।”

“কেন খেলবে না বলুন?”

“তার বিরুদ্ধে আরও একটি গুরুতর অভিযোগ আছে। ম্যাচের দিন সে হবিবপুরের লোকজনের উপর হামলা করেছিল। তার সেই হামলায় কয়েকজন গুরুতর আহতও হয়। হবিবপুরের শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের উপর বিনা প্ররোচনায় এই আক্রমণ অত্যন্ত নিন্দনীয়।”

হারাধনবাবু এবং কালীপদবাবু একযোগে বলে উঠলেন, “না স্যার, সেদিন হবিবপুরের গুন্ডারাই ম্যাচ হেরে গিয়ে আমাদের উপর চড়াও হয়। আমরা থানায় নালিশও জানিয়েছি।”

“আপনাদের পাঁচ মিনিট আগে হবিবপুর এফ আই আর করেছে। সুতরাং তাদের কে অনেক জোরালো।”

সবাই কাঁচুমাচু হয়ে পাংশু মুখে ফিরে এলেন। এবং সবাই একবাক্যে স্বীকার করলেন যে, এই রকম অন্যায়ভাবে হবিবপুরের কাছে হেনস্থা হওয়াটা দুর্ভাগ্যজনক। হারাধনবাবু অত্যন্ত ব্যথিত মুখে বলতে লাগলেন, “না হে, এখন আমাদের পায়েসপুরের বড় দুঃসময় চলছে।”

পরশুদিন সন্ধের সময় যখন এই ঘটনা নিয়ে চণ্ডীমণ্ডপে মিটিং চলছিল, তখনই খবর আসে যে, বটেশ্বরকে এক নরখাদক সাধু ধরে নিয়ে গিয়েছে। এবং সেটা নিয়ে তোলপাড় শেষ হতে না-হতেই রাধাগোবিন্দর নিরুদ্দেশ হওয়ার খবরে পায়েসপুর একেবারে শোকে স্তব্ধ হয়ে গেল।

ভূপেনদারোগা তদন্তে এলেন বটে, কিন্তু কেমন যেন গা ছাড়া ভাব। বটেশ্বরের খবর শুনে নাক কুঁচকে বললেন, “পায়েসপুরে কেমন পালোয়ান তৈরি করেন আপনারা বলুন তো? নেংটি পরা একটা সাধু এসে একটা তাগড়াই লোককে তুলে নিয়ে গেলেই হল? তেমন পালোয়ন থাকা না-থাকা সমান। ওরকম অপদার্থকে যদি সাধু কেটেকুটে রান্না করে খেয়ে ফেলেই থাকে, তা হলে একরকম ভালই হয়েছে। আর রাধাগোবিন্দবাবু! হাঃ হাঃ। তিনি নাকি ডাকসাইটে দারোগা ছিলেন! হেসে বাঁচি না। যখন যেখানে বদলি হয়ে যেতেন, সেখানেই চোর-ডাকাতদের মধ্যে আনন্দের সাড়া পড়ে যেত। একবার তো কালিকাপুরের ডাকাতরা তাকে গণসংবর্ধনাও দিয়েছিল। আর দেবে না-ই বা কেন? সকালে একপেট ভাত খেয়ে সেই যে থানার চেয়ারে বসে ঘুমিয়ে পড়তেন, সেই ঘুম ভাঙত বিকেল পাঁচটায়, তার বাড়ি যাওয়ার সময়। তার মতো লোক বটেশ্বরকে উদ্ধার করতে গিয়ে লোপাট হয়েছেন, এও কি বিশ্বাস করতে বলেন? তিনি আবার ‘দারোগার দীর্ঘশ্বাস নামে বই লিখছেন। হুঃ! দারোগাগিরির উনি জানেনটা কী?”

কেপুবাবু আমতা-আমতা করে বললেন, “কিন্তু নিকুঞ্জ বৈরাগী যে বলেছিল, রাধাগোবিন্দবাবু রেগে গেলে খ্যাপা ষাঁড়!”

“ষাঁড় কথাটা খারাপ নয়। ‘অকালঘেঁড়ে’ বলে কী একটা কথাও যেন আছে। রাধাগোবিন্দবাবু হচ্ছেন তাই। তবে আপনারা যাই বলুন, ওই সাধুর গল্পটি আমি বিশ্বাস করছি না। ওটা আষাঢ়ে গল্প। আমার সেপাইরা সারা জঙ্গল তছনছ করে খুঁজে এসেছে, কোথাও কোনও সাধুর চিহ্নমাত্র দেখেনি।”

জয়লাল বলল, “তা হলে ওরা গেল কোথায়?”

“আত্মীয়স্বজন বা কুটুমদের বাড়ি খুঁজে দেখুন। বাড়িতে ঝগড়া করে বৈরাগী হয়েছে কিনা খোঁজ নিন। তবে লাশটাশ পাওয়া গেলে খবর দেবেন, তখন এসে দেখব। এখন আমার সময় নেই। চারদিকে খুব চুরি-ডাকাতির খবর পাচ্ছি। কিছু খুনখারাপিও হচ্ছে। আমাকে তদন্তে যেতে হবে।”

ফুটবল ম্যাচে হবিবপুর পাঁচ গোল খাওয়ার পর থেকেই যে ভূপেনদারোগা পায়েসপুরের উপর চটে আছেন, তাতে সন্দেহ নেই। দারোগা চলে যেতেই দ্বিজেন সামন্ত উত্তেজিত গলায় বলে উঠল, “ভাইসব, এর পরের ম্যাচে কিন্তু হবিবপুরের কাছে আমাদের হেরে যেতেই হবে। না হারলে আমাদের উপর এই অবিচার বন্ধ হওয়ার নয়, এই বলে দিলুম। এখন কয় গোল খাবে তা ঠিক করে নাও। আমার তো মনে হয়, পাঁচ গোল খাওয়াই ভাল। ওদের প্লেয়ার গোল দিতে পারে ভাল, নইলে আমাদের প্লেয়াররাই সেমসাইড গোল খেয়ে বসবে’খন।”

হারাধনবাবু লাফিয়ে উঠে গর্জন করলেন, “কভি নেহি! প্রাণ থাকতে নয়!”

“কিন্তু না হারলে যে ভূপেনদারোগা আমাদের হাল কেরাসিন করে ছাড়বে।”

“যা খুশি করুক, যা হয় হোক। পায়েসপুর কারও কাছে কোনও দিন মাথা নোয়ায়নি, আজও নোয়বে না। ঝড়ঝা যাই আসুক, দুর্গমগিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার পাড়ি দিতে হবে। পায়েসপুরের দুঃসময় চলছে ভাইসব, তোমরা প্রস্তুত থেকো। কিন্তু চিরকাল এরকম যাবে না। পায়েসপুরে আবার একদিন সূর্য উঠবে।”

পরদিন সকালে পায়েসপুরে ঢুকে গদাইয়ের মনে হল, এ যেন সেই পায়েসপুর নয়। না, সেই পায়েসপুরই। সেই শ্মশান, সেই গোচারণ, সেই ফটিক রাজার ঢিবি, খেলার মাঠ, ইশকুলবাড়ি, সব ঠিক আছে। তবে চারদিকটা দুঃখ আর বিষাদ মাখানো। সারা গায়ে যেন একটা দুঃখের হাওয়া বইছে। কাকের ডাকেও কেমন যেন মন খারাপের ভাব। গাছগুলোও হাওয়ায় দুলছে বটে, কিন্তু যেন খুব অনিচ্ছের সঙ্গে। দুলতে হয় বলে দোলা। গোরুর হাষার মধ্যেও যেন শচীমাতার ‘নিমাই’ ডাক।

ময়লা পাতলুন, ময়লা জামা, কাঁধে ঝোলা, গদাই চারদিকে চেয়ে দুঃখটা খুব টের পাচ্ছিল। সে পায়েসপুরের লোক নয় বটে, কিন্তু জায়গাটা তার চেনা। বেশ হাসিখুশি জায়গা। কিন্তু আজ হঠাৎ গায়ে এত দুঃখ কেন ঢুকে পড়ল, সেটা ঠিক বুঝতে পারছিল

গদাই। নগেন সর্বাধিকারীর বেশ বড় দোতলা বাড়ি। সামনে একটু বাগান আছে, বাগানের পর চওড়া বারান্দা, তারপর কোঠা। বারান্দায় জুত করে বসে গদাই হক মারল, “কর্তা আছেন নাকি?”

পাংশু মুখে বেরিয়ে এসে নগেন কাহিল গলায় বললেন, “গদাই নাকি রে? তাগাদায় এসেছিস বুঝি?”

“আহা, শুধু তাগাদা কেন, খবরবার্তা নিতেও আসা।”

নগেন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “আর খবরবার্তা! দিন ঘনিয়ে এল বলে। বয়স হয়েছে, তাই নিজের জন্য ভাবনা নেই। কিন্তু নির্বংশ হয়ে যাব, এইটেই এখন চিন্তা।”

“বলেন কী নগেনকর্তা? নির্বংশ হতে যাবেন কোন দুঃখে?”

“সে অনেক কথা রে বাপু! তা বাতের তেল বাবদ তোর কত পাওনা যেন? আজই নিয়ে যা বাবা, ঋণ রেখে মরলে নরকবাস ঠেকায় কে?”

“আজ্ঞে, পাওনা বেশি নয়, কুল্লে পঁচিশটি টাকা। কিন্তু আপনাকে যে বড় কাতর দেখাচ্ছে কর্তা? একটু ভেঙে বললে হয় না?”

ফঁত করে একটা বড় শ্বাস ফেলে নগেনবাবু বললেন, “সে আর বলিসনি বাবা, বড় বিপদের মধ্যে আছি। এক ভয়ংকর সন্ন্যাসীর কোপে পড়ে আমার বংশ লোপ হওয়ার জোগাড়।”

“আহা, সব রোগেরই তো নিদান আছে, না কি? সমস্যা থাকলে উপায়ও হয়ে যায়।”

“তা হওয়ার নয় রে! পঁচাত্তর বছর আগে এক বিভীষণ সন্নিসি আমার বাবাকে একটা পিদিম দিয়ে হুঁশিয়ার করে গিয়েছিল, সে পিদিম ফেরত নিতে পঁচাত্তর বছর পর আবার আসবে। তখন বিশ্বাস করিনি বাবা। সে সত্যিই এসেছে, কিন্তু পিদিমের হদিশ নেই। ক’দিন আগে বাড়িতে একটা চুরি হয়েছিল বটে, তবে বিশেষ কিছু নিয়ে যেতে পারেনি। তা সেই পিদিমখানাই নিয়ে গেল কিনা বুঝছি না। বড় বিপদ যাচ্ছে বাবা।”

“ঘাবড়াবেন না কর্তা। একটু ঠান্ডা মাথায় ভেবে বলুন দেখি, ইদানীং বেশ বড়সড় চেহারার করিতকর্মা কোনও লোকের কি হঠাৎ এ গাঁয়ে আগমন হয়েছে?”

“বড়সড় চেহারার করিতকর্মা লোক? কেন রে বাপু, হঠাৎ এ কথা কেন?”

“কারণ আছে কর্তা। হয়ে থাকলে বলুন।”

“না, সেরকম কিছু তো চোখে পড়েনি। তবে ইদানীং দানু নামে একটা খুব ঢ্যাঙা ছেলে আমার মেয়ে সরফুর বাড়িতে এসে জুটেছিল বটে। সে খুব করিতকর্মা বলে শুনেছি। দারুণ নাকি ফুটবলও খেলে। হবিবপুরকে সে পাঁচ গোল দিয়েছিল বলে গাঁয়ে বড় অশান্তিও হচ্ছে রে বাপু! তবে দানুকে ক’দিন হল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তুই বরং আমার নাতি পান্টুর সঙ্গে কথা কয়ে দ্যাখ তো!”

পান্টু ওরফে প্রাণারাম শুনেই বলল, “দানুর খবর চাও? ওঃ, তা হলে তো তুমি পুলিশের পাই!”

গদাই একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “সে চেষ্টা কী আর করিনি রে বাপু? কিন্তু পুলিশ তো মোটে আমাকে আমলই দিল না।”

“তা হলে দানুর খবর দিয়ে কী করবে?”

“ভালর জন্যই বলছি, দানুকে আর লুকিয়ে রাখাটা তোমার উচিত হবে না। সে যদি পিদিমের সেই দত্যিটাই হয়ে থাকে, তা হলে তাকে পিদিম সমেত সাধুবাবাকে ফেরত দেওয়াই উচিত হবে। দানুর জন্য দু’-দু’টো নিরীহ লোক সাধুর হাতে খাবি খাচ্ছে। তার উপর নির্বংশ হওয়ার ভয়টাও তো উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।”

পান্টু হোঃ হোঃ করে হেসে বলল, “তুমি দাদুর ওই আজগুবি গল্পে বিশ্বাস করো বুঝি? প্রদীপ থেকে দৈত্য বেরোয়, এ তো রূপকথা! তবে সাধুটা যে জি তা আমরা জানি। আমরা দল বেঁধে লাঠিসোটা নিয়ে তার ডেরা খুঁজে বের করবই।”

“ওরেব্বাস রে! ও কাজও কোরো না। কোনও মনিষ্যির সাধ্যিই নেই তার কিছু করে। হিতে বিপরীত হয়ে যাবে বাবা! পিদিম না পেলে সে যে গায়ে ঢুকে কী কুরুক্ষেত্র বাধাবে কে জানে।”

“পিদিম! পিদিম তো আমাদের কাছে নেই! চুরি হয়ে গিয়েছে।”

চোখ বড়-বড় করে গদাই বলল, “নেই! তা হলে তুমি দানুকে পেলে কোথায়? তার তত পিদিম থেকেই বেরনোর কথা!”

“তোমার মাথা! দানু মোটেই পিদিম থেকে বেরোয়নি।”

“তা হলে!”

“আচ্ছা, তোমার কি ঘটে কোনও বুদ্ধি নেই? চিরকাল বুজরুকি গল্পে বিশ্বাস করে যাবে? পিদিমের মধ্যে কি কোনও মানুষ লুকিয়ে থাকতে পারে?”

“আহা, মানুষ পারবে কেন? তবে দত্যিদানোরা যে সূক্ষ্মদেহ ধারণ করতে পারে?”

“দত্যিদানো বলেও কিছু নেই। ওসব মানুষের অলস কল্পনা। সূক্ষ্ম দেহটেহ সব বাজে কথা। এখন কেটে পড়ো!”

গদাই উঠতে-উঠতে বিড়বিড় করে বলল, “ভাল কথাটা শুনলে বাবা, ঠেলা বুঝবে!”

ঠেলা টের পেতে দেরি হল না পান্টুর। গদাই পায়েসপুরের ঘরে-ঘরে খবরটা ছড়িয়ে দিয়ে সবাইকে হুশিয়ার করে দিয়ে গেল। আর খবরটা খেয়েও গেল সবাই। নগেনবাবুর বাবার আমলের পিদিমের কথা কানাঘুষোয় সবাই শুনে গিয়েছিল। দানুর কীর্তিকাহিনির কথাও সবাই জানে। এবং সাধুর আগমন নিয়ে তো কোনও সন্দেহের অবকাশই নেই। সেই সঙ্গে প্রদীপের দৈত্য দানুর জন্যই যে আজ পায়েসপুরের দুঃসময় এসেছে, সে বিষয়েও কারও আর সংশয় রইল না।

সন্ধেবেলায় চণ্ডীমণ্ডপে জরুরি মিটিং ডাকা হল। সেই মিটিঙে সর্বসমক্ষে নগেন সর্বাধিকারী সাধুর দেওয়া পিদিমটার কথা স্বীকার করলেন। তবে এও বললেন, “পিদিমের মহিমার কথা আমি জানি না। আমার বাবা হয়তো জানতেন, কিন্তু আমাদের পিদিম নিয়ে নাড়াচাড়া করায় বারণ ছিল।”

জয়লাল বলল, “আঃ হাঃ, বিরাট দাওটা ফসকেছেন দাদা! এতদিনে তো আপনার টাটা-বিড়লা হয়ে যাওয়ার কথা!”

হারাধন বললেন, “আগে জানলে তো পায়েসপুরকে একেবারে অলকাপুরী বানিয়ে ছাড়তাম মশাই। আগে বলতে হয়। এসব খবর চেপে রাখাটা ভুল হয়েছে।”

তারক সভয়ে বলল, “যাকগে, ওসব ভেবে আর লাভ নেই। পিদিমের মেয়াদ শেষ হয়েছে, যার পিদিম সে ফেরত নিতে এসেছে এবং পায়েসপুরের সামনে এখন ঘোর বিপদ। সুতরাং পান্টুকে ডাকা হোক। পিদিম তার কাছেই আছে এবং দানুই যে পিদিমের দৈত্য, সে বিষয়েও আর সন্দেহের অবকাশ থাকছে না।”

এ কথায় সবাই একমত হল। কিন্তু পান্টু এসে সবার সামনে বলল, “আমি পিদিম কখনও চোখেও দেখিনি। দানু মোটেই দৈত্যদানো নয়।”

দ্বিজেন সামন্ত চেঁচিয়ে উঠে বলল, “দানু দৈত্য নয় বললেই হবে? দৈত্য না হলে কেউ দু’দিনে চল্লিশ-পঞ্চাশটা গাছের নারকোল পেড়ে ফেলতে পারে? এত বড় পুকুরটার কচুরিপানা একদিনে তুলে ফেলতে পারে? নাকি হবিবপুরের মতো শক্ত টিমকে পাঁচ-পাঁচখানা গোল দিতে পারে?”

সবাই হইচই করে দ্বিজেনকে সমর্থন জানাল। দু-চারজন পান্টুর পক্ষ নেওয়ার চেষ্টা করল বটে, কিন্তু তারা নিতান্তই সংখ্যালঘু।

সকলের সমবেত বাক্যবাণে এবং উগ্রতা দেখে পান্টু যখন কোণঠাসা, তখনই হঠাৎ অন্ধকার কুঁড়ে দানু চণ্ডীমণ্ডপে উঠে এসে বলল, “ওকে ওরকম হেনস্থা করছেন কেন? যা বলার আমাকে বলুন।”

প্রথমটায় হকচকিয়ে গেলেও পরক্ষণেই রে রে করে তেড়ে গিয়ে সবাই দানুকে পেড়ে ফেলল। দানু তেমন বাধাও দিল না।

দ্বিজেন সামন্ত বলল, “ভাল করে দড়ি দিয়ে বাঁধো, যাতে পালাতে না পারে। কাল সকালেই ওকে সাধুর কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। যদিও প্রদীপের দৈত্যকে দিয়ে অনেক ভাল কাজও হতে পারত, কিন্তু আমরা আর কোনও ঝুঁকি নিতে পারি না। কী বলো ভাইসব?”

সকলেই হইহই করে উঠল, “ঠিক ঠিক!”

Pages: 1 2 3 4 5 6 7

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress